হাবীব হুবায়বী
ন্যূনতম দ্বীনের জ্ঞান রাখেন এমন ব্যক্তিকে যদি প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশে ‘কুরআন শেখার প্রাথমিক পাঠশালা কোনটি?’ নিশ্চয়ই তিনি উত্তর দেবেন, ‘সকালের মক্তব’। ছোট ছোট ছেলে-মেয়ের সহিহ শুদ্ধ করে কুরআন তেলাওয়াত শেখার পাশাপাশি শরিয়তের মৌলিক বিষয়াদি সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান লাভের কারখানা হলো ভোরের এই পাঠশালা।
মক্তবের গুরুত্ব
মক্তব থেকে শিশুরা নামাজ রোজার নিয়ম-কানুন, হালাল হারামের ভেদাভেদ, শরিয়তের জরুরি মাসায়িল এবং বিভিন্ন দুয়া কালাম শিখতে পারে। নিকট অতীতেও বাংলার প্রায় প্রতিটি পাড়ামহল্লায় সবাহি মক্তবের ব্যাপক চর্চা ছিল। বাংলার পথে-ঘাটে ভোরের পাখিদের সঙ্গে মক্তবগামী কুরআনের পাখিদের দেখা মিলত। মসজিদের মুসল্লায় বসে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে তারা জপত— বা, অর্ধ বা, যুক্ত বা…
হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য ধারা
দুঃখের বিষয় হলো, ধর্মীয় ঐতিহ্যের ধারক ভোর সকালের এসব মক্তব ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অনেক মসজিদে এমনিতেই মক্তবগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। আবার কোনো কোনো মসজিদে যা-ও চালু আছে, সেগুলোতেও আগের মতো জৌলুশ নেই। শিশুদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। নামেমাত্র চলছে সেগুলো। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের অবেহলাসহ নানান কারণ উল্লেখ করেছেন মসজিদের ইমাম সাহেবগণ। ফাতেহের কাছে তুলে ধরেছেন নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা।
মক্তব কেন জৌলুস হারাচ্ছে?
একসময় মসজিদে মক্তব পড়তে আসত শত-শত ছাত্র, আধুনিক কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোর কারণে আজ সেই মসজিদের বারান্দায় দু-চারজন শিশু রেহাল নিয়ে বসে আছে। চিত্রটি বাংলাদেশের চায়ের রাজধানী খ্যাত শ্রীমঙ্গল শহরের একটি মসজিদের। মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুর রব ফাতেহকে জানান, ‘গত সাত আট বছর আগেও মসজিদের বারান্দায় ছাত্রদের জায়গা দেওয়া সম্ভব হতো না। ছাত্র সংকুলানের জন্য বাইরে কার্পেট বিছানো লাগত। কিন্তু বিগত চার পাঁচ বছরে ছাত্র সংখ্যা কমতে কমতে এই আটজনে এসে ঠেকেছে।’
মাওলানা আব্দুর রব বিগত দেড় যুগ ধরে এই মসজিদে ইমামতি করছেন। পাশাপাশি একটি এতিমখানার দায়িত্বে আছেন তিনি। দিনদিন বাচ্চাদের মক্তববিমুখ হওয়ার পেছনের কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন— ‘বাচ্চাদেরকে আধুনিক করতে অভিভাবকদের বেপরোয়া অভিপ্রায়ই মূলত এর জন্য দায়ী। যে বাচ্চার ঘুম থেকে উঠে মক্তবে আসার কথা ছিল, তাকে তারা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পাঠাচ্ছেন। সুতরাং সে মক্তববিমুখ হবে, এটা তো স্বাভাবিক।’
দায়ী স্কুলের মর্নিং শিফটও
মাওলানা আব্দুর রব মনে করেন— কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোতে মর্নিং শিফট চালু হওয়ার পর থেকেই মক্তবগুলো জৌলুশ হারাচ্ছে। শিশুরা ধর্মীয় প্রয়োজনীয় ইলম-কালাম শেখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যে শিশু ঘুম থেকে উঠে নিজে অজু করে মক্তবে যেত, তাকে জোর করে ঘুম থেকে তোলে গোছগাছ করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে স্কুলে। শিশিরভেজা মেঠোপথ অথবা ধুলিউড়া সড়ক মাড়িয়ে এখন কেউ মক্তবে যায় না, কথা বলতে শেখার আগেই পাঠিয়ে দেওয়া হয় স্কুলে। বাচ্চাদের বুকে দ্বীনি জ্ঞান প্রবেশের আর সুযোগ হয়ে ওঠে না।
অভিভাবকদের অবহেলা
ফাতেহের প্রতিনিধি শ্রীমঙ্গল শহরের আরো কয়েকটি মসজিদ পর্যবেক্ষণ করেন। হবিগঞ্জ রোডস্থ অনেকগুলো মসজিদ থেকে সাবাহি মক্তবের প্রচলন উঠে গেছে। অভিভাবকদের অবহেলার কারণে মসজিদের ইমাম সাহেবরা এখন মক্তবে কুরআন পড়ানোর আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন বলে উল্লেখ করেছেন শ্রীমঙ্গলের হবিগঞ্জ রোডস্থ পিজিসিবি মসজিদের ইমাম। তিনি ফাতেহকে জানান, সকালের মক্তবে একজন দুজন ছাত্র আসে, তা-ও কোনোদিন আসে না। হুজুরকে বসে থাকতে হয়।
মক্তবে ছাত্র আসে না বা আসতে চায় না কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন— ‘বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে এখন অভিভাবকেরা কঁচিকাঁচা শিশুদের মক্তবে পাঠাতে চান না। তাছাড়া সকালে ঘুম থেকে উঠে বাচ্চাদের স্কুলের কোচিং অথবা ক্লাসের সময় হয়ে যায়, ফলে তার আর মক্তব পড়া হয় না।’
মক্তব হারালে ক্ষতি কী?
শুভ্র-শান্ত সকালটাকে গিলে ফেলেছে আধুনিক শিক্ষার নামে নানান প্রতিষ্ঠান। দ্বীনি ঐতিহ্যবাহী প্রাক প্রাথমিক এ পাঠশালাগুলো যদি এভাবে হারিয়ে যেতে থাকে, তাহলে ইসলামের বুনিয়াদি শিক্ষার ঐতিহ্যগত প্রতিষ্ঠান চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। এই ব্যাপারে মাওলানা আব্দুর রব বলেন, ‘যদি মক্তব এভাবে তার জৌলুশ হারাতে থাকে, তাহলে এর প্রভাবে মুসলমানদের মাঝে ধর্মীয় জ্ঞানশূন্য একটি বিশাল জনগোষ্ঠী তৈরী হবে।’
দ্বীনের সামান্যতম জ্ঞান না থাকায় একসময় মুসলিম ছেলেমেয়েরা ঈমান হারাও হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
এই সংকট থেকে পরিত্রাণের উপায় জানতে চাইলে এই ইমাম বলেন— ‘সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, দায়িত্ববান অভিভাবকদের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রভাতি মক্তবগুলো জমজমাট রাখার ব্যবস্থা করা। এবং যেই মক্তবগুলো বন্ধ হয়ে গেছে সেগুলোও চালু করা। পাড়ায় পাড়ায় নতুন নতুন সাবাহি মক্তব প্রতিষ্ঠা করা।’
বঙ্গ দেশে ইসলাম ওলী-দরবেশদের মাধ্যমে এলেও ইসলামের প্রচার প্রসারের ক্ষেত্রে মক্তব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সত্যিকার অর্থে একজন ভালো মানুষ তৈরীর জন্য মক্তব চালু করার বিকল্প নেই। নৈতিক মূল্যবোধ মানুষের মধ্যে গড়ে তোলার পেছনে মক্তব শিক্ষা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সহজেই সুহ্রদয় দিয়ে সকল প্রতিবন্ধকতার সহজ সমাধান করে মক্তবগুলো আবার আমরা চালু করতে পারি। এতে সমাজের সকল শ্রেণীর শিশুদের জন্য দ্বীনি শিক্ষার বুনিয়াদ গড়ে ওঠবে। আবারও পাড়ামহল্লায় ছোট ছোট শিশুর কন্ঠে কুরআনের ধ্বনি উচ্চারিত হবে। তারা পাবে একটি সুন্দর দ্বীনি পরিবেশ। একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যত। মক্তব বেঁচে থেকে বাঁচিয়ে দেবে আমাদের ঈমান, আদর্শ, আত্মগৌরব।
The post হুমকির মুখে মুসলমানদের প্রথম পাঠশালা : হারিয়ে যাচ্ছে মক্তবের ঐতিহ্য appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%b9%e0%a7%81%e0%a6%ae%e0%a6%95%e0%a6%bf%e0%a6%b0-%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%96%e0%a7%87-%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%b8%e0%a6%b2%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%aa/
No comments:
Post a Comment