Friday, July 31, 2020

আয়া সোফিয়া

মানযূর আহসান

কতদিন বসফরাসের উপর দিয়ে

কাকের মত উড়ে যেতে যেতে

আমার হৃদয় তোমাকে চেয়ে চেয়ে

দেখেছে হে আয়া সোফিয়া!

 

মুহ্যমান ব্যথিত হৃদয়ের

অগণন হাহাকার গলে গলে

আমার চোখের কত নোনাজল

গড়িয়ে পড়েছে

তোমার পাশ দিয়ে বয়ে চলা

নীল পানির বসফরাসের বুকে…

 

অনন্য এক কাবার মত

কত না সোনালী সকাল,

কাকপোড়া রৌদ্রোজ্জ্বল দুপুর কিংবা

আলো ডুবো ডুবো ক্লান্ত সন্ধ্যায়

দেখেছি খুঁটিয়ে তোমায়

অন্য এক তাওয়াফের মত —

তুমি নাকি মিউজয়ম.. তুমি নাকি জাদুঘর!

 

একটিমাত্র সেজদা দেবার জন্য হে সোফিয়া

তোমার বুকে

হৃদয়ের বিপুল আবেগ, আর

চোখ ভরা অশ্রু সাথে করে

ছুটে ছুটে গিয়েছি বার-বার

তোমার গৌরবের দহলিজে

অথচ প্রতিবারই

এক অদৃশ্য আতাতুর্ক ও তার জীবিত প্রেতাত্মারা

কেমন উল্লাস করে করে বলেছে-

চলে যাও , চলে যাও

এ আর মসজিদ নয়, তোমাদের খোদার ঘর নয়

 

কিন্তু বিশ্বাস করো দীর্ঘ ছিয়াশিটি বছর

একটি মুহূর্তের জন্যেও মনে হয়নি-

তুমি মিউজিয়ম, মসজিদ নও!

তুমি জাদুঘর, আল্লার ঘর নও!

 

The post আয়া সোফিয়া appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%86%e0%a7%9f%e0%a6%be-%e0%a6%b8%e0%a7%8b%e0%a6%ab%e0%a6%bf%e0%a7%9f%e0%a6%be/

মাহমুদ মুযযাম্মিলের দুটি কবিতা

কুকুর

কুকুরের ঘেউ ঘেউ স্বভাবতই ভয় জাগায় মনে ৷

কুকুরের কামড় বিপজ্জনকও বটে ৷

ভাদ্রমাসে কুত্তাকুত্তির খোলামাঠে বেলেল্লা মিলন

সবাইকে বিব্রত করে বৈকি ৷

শিশুরা মক্তব থেকে ফিরতে পারে না

নেড়িকুত্তার ডরে ৷

পাড়ায় পাড়ায় কতো কুকুর আমরা তাড়িয়ে বেড়াই

মেরেও ফেলি কয়েক ডজন কুকুর

গর্তে চাপা দিই দারুণ উল্লাসে

মনে মনে স্বস্তি নিই—

আপাতত কুকুরীয় উৎপাত থেকে রেহাই মিললো ৷

 

কিন্তু না,

আসল কুকুরগুলো ফুলেফেঁপে উঠছে

মানুষের বসবাস হারাম করে দিতে ৷

 

ওইসব বেজন্মার কোনো বিহিত কেউ করে না ।

 

ক্যান্টিন ও কোয়ারেন্টিন

আমার মা থাকেন গ্রামে ৷

গেরস্ত তদারকির জীবন তার ৷

ন্যূনতম শিক্ষাও যদি পেতেন সেই কালে ৷

আমি শহরের কপিলবর্ণের ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকি

পড়ি ইউনিভার্সিটিতে

খাই-দাই ভার্সিটি লাগোয়া হলুদবর্ণের ক্যান্টিনে ৷

 

একদিন মা জানতে চাইলেন—

কী খাস? কোথায় খাস?

বললাম— ভাত-রুটি, চা বিস্কিট সবই

ক্যান্টিনে যখন যা পাই তাই খেয়ে নিই

আঁৎকে উঠলেন মা

হাউমাউ কান্না জুড়ে দিলেন

তুই ‘কেন্টিনে’ আছত?

করোনা অইছে তর? আমি জানি না!

কবে থেইকারে বাবা?

তর গুলশানের মামারও ত করোনা

এহন ‘কেন্টিনে’ আছে ৷

 

আরে মা!

আমার করোনা হয়নি

আমি ক্যান্টিনেও নই

আমি বাসায় সুস্থ আছি ৷

শোনো,

করোনা-রোগীর জন্য হলো ‘কোয়ারেন্টিন’

আমাদের খাবারের দোকানের নাম ‘ক্যান্টিন’

তুমি ‘কোয়ারেন্টিনকে’ ‘কেন্টিন’ বলো কেনো?

গেরামের সবাই ত কয়

হেরে বাবা!

মুরুক্ষ অইয়া তোগো কত কষ্ট দেই ৷

সাবধানে থাকিস বাবা ৷

করোনা অইলে কিন্তু ‘কেন্টিনে’ যাইতে অইব ৷

 

The post মাহমুদ মুযযাম্মিলের দুটি কবিতা appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%b9%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%a6-%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%af%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a7%8d%e0%a6%ae%e0%a6%bf%e0%a6%b2%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%a6%e0%a7%81%e0%a6%9f%e0%a6%bf/

হায়াতুননেছা

ইমরান আল হাদী:

সরিষা ক্ষেতময় সারাদিন

মধুভার মৌচাকে ভায়োলিন

কাঠচেরা হাহাময় সারাদিন

করাতের হ্রেসায় সমাসীন

বিষখালী নদী তীর বুধবার

বাকু বাদশাহর মজলিশ

জঙ্গমে কাঁপে কচি বুক তার

আজনবি চোখেতে সে নবিশ

ঠোঁটের উপর ফোটে তাসাহুদ

মুনাজাতে ঝরে মোর সে দাবি

রাত্রির রোনাজারে বুদবুদ

খোয়াবের মশকোতে সে ছবি

নালিশের লঘুভার ফরিয়াদে

হায়াতুননেছা নাম ইয়ায়াদে।

 

গৃহস্থ-ভরা দিন দুধভাত

বলক ফোটা ভাতে স্বাদুবাস

চৈতি দুপুরে ভাতঘুম মৌতাত

বঁধুয়ার গতরে কারুবাস

ছায়ানীল গগনে উড়োচিল

মাতৃ কুক্কুট ডানাতে ঘনঢাল

ফি-বছর ভাঙে যে নদীকূল

কৃষানের ভরসা পয়মাল

তবু সে জোড়ে হাল ব্যথাতুর

গোলাতে সোনা রং বীজধান

দু-চোখে ফসলের নেশাতুর

মাতৃ আচলে শস্য আঘ্রাণ

যেন সে কৃষানের ডুবুচর

হায়াতুননেছা বাধে বালিঘর।

 

ইকারুসের ডানাতে নমরুদ

কুমতি আসমানে ছোড়ে তীর

সমাচার ঠোঁট ছোঁয়া হুদহুদ —-

দূতালি, সুলেমান সে নবীর

নৈর্ঋতে উড়ে আসে আবাবিল

সহস্র মাতঙ্গ ——–ধূলিময়

নখরে ছুড়ে যায় কালোতিল

আবরাহা মরুভুমে লয় হয়

মহিষের শিং নাচে দামোদর

ঘনঘোর রাতভর কি বাদল

নদী চিরে পার হয় যে সাগর

সে নাম মনে রাখে মহাকাল

ইতিহাস মেনে এ অবরোধ

হায়াতুননেছাতে নেশাবুদ।

 

বাতাসে আজো ভাসে ইভ-নাম

বায়ুতে আদমের ——সে স্বর

কোন প্রেম খেয়েছিল যে আদম

হাওয়াতে বিস্মৃত তমোহর

ঘাতকের ইস্পাতে লহু-লাল

বেলালের ধ্বনিতে সরগম

ঘুরেঘুরে ফিরে সে মহাকাল

কে ডাকে দয়াময়  হরদম

কাবিলে সঁপে দেই দেহধর

পথে নামে ক্ষিণায়ু শেষ রোদ

সন্তাপ জুড়ে নামে কালাজ্বর

খুলেখুলে যায় শেষ ঘনরাত

তুমি মোর পবিত্রা রাহবার

হায়াতুননেছা তে অধিকার।

The post হায়াতুননেছা appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a7%9f%e0%a6%be%e0%a6%a4%e0%a7%81%e0%a6%a8%e0%a6%a8%e0%a7%87%e0%a6%9b%e0%a6%be/

জ্যোৎস্নাস্নাত ঘোরে

সায়েম সালাহ্উদ্দীন:

দূর স্রোতে

রাখা চ্ছলাৎ চ্ছলাৎ

স্বপ্নের অন্তরে

 

যেন কোনো রাতে

যেন কোনো গাঢ়

জ্যোৎস্নাস্নাত ঘোরে

 

একটা নদী

মহাকাশ জুড়ে

বৃষ্টির মতো ঝরে;

 

ঝ’রে ঝ’রে পরে

স্বপ্নের অন্তরে–

 

যেন কোনো রাত

কোনো সুঘন

জ্যোৎস্নাস্নাত ঘোরে।

The post জ্যোৎস্নাস্নাত ঘোরে appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%9c%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a7%8b%e0%a7%8e%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%a4-%e0%a6%98%e0%a7%8b%e0%a6%b0%e0%a7%87/

ইমদাদুল হকের কয়েকটি ছড়া

কবি

বুকে আছে বিশ্বাস

ঈমানের নূর

একা একা চলেছেন

হেঁটে বহুদূর।

পাক সাফ দেহমন

নয় নেশাবুঁদ

আমাদের কবি তিনি

আল মাহমুদ।

 

মেঘের নাটাই

জলের সুতো লম্বা এবং পুরু

আকাশ থেকে নামছে শুধু

নেই শেষ তার শুরু।

 

মধ্যি রাতে

দিন দুপুরে,

পাখির বাসায়

মাঝ পুকুরে

 

মেঘের নাটাই ছাড়ছে সুতো ছাড়ছে

সুতোর টানে মন যেন কে কাড়ছে।

 

 জলের ফোঁটা

টিনের চালে

গাছের ডালে

জলের ফোটা টুপ্

 

দুষ্টু ছেলে

শেষ বিকেলে

দেয় পুকুরে ডুব।

 

রাত দু’পরে

হঠাৎ করে

একটু কাশি খুক্

 

একটু নুয়ে

আলতো ছুঁয়ে

কাঁপে মায়ের বুক।

 

The post ইমদাদুল হকের কয়েকটি ছড়া appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%87%e0%a6%ae%e0%a6%a6%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%81%e0%a6%b2-%e0%a6%b9%e0%a6%95%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%95%e0%a7%9f%e0%a7%87%e0%a6%95%e0%a6%9f%e0%a6%bf-%e0%a6%9b%e0%a7%9c%e0%a6%be/

শরণার্থী (উপন্যাসিকা)

রাকিবুল হাসান:

তারা দংখাল ঘাটে এসে পৌঁছলো বিকেল তিনটায়।

রোদ পড়ে গেলেও রোদের তেজ কমেনি। বলশালী পুরুষের মতো সূর্যটা এখনো সুঠাম, তেজস্বী। হাতের ঘড়ি না থাকলে তারা ভাবতো এখন বোধহয় দুপুর একটা। কিন্তু হাতের ঘড়ি বলে দিচ্ছে একটা না তিনটাই বাজে। মংডু শহর থেকে তারা রওয়ানা হয়েছিল দুপুর বারোটায়। আকাশে তখন মেঘ ছিল। মনে হচ্ছিল বৃষ্টি নামবে। চারদিক থেকে শোনা যাচ্ছিল চিৎকার, গুলির শব্দ। আলম সবাইকে তাড়া দিয়ে বলছিলো, ‘যা নেবার জলদি নিয়ে নাও। বেশিক্ষণ এখানে থাকলে সেনাবাহিনী এবং বৌদ্ধদের হাতে আমাদেরও মারা পড়তে হবে।’
আলমের মা আছমা বেগম বললেন, ‘এই বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাবো?’
‘যেখানে সবাই যাচ্ছে। বাংলাদেশে।’
‘আমরা হেঁটে যাবো। কিন্তু ফাতেমা কী করবে। এই সময়ে তো বেশী হাঁটতেও পারবে না।’
‘আগে এই জাহান্নাম থেকে বেরুতে হবে। তারপর দেখা যাবে কোথায় কিভাবে যেতে পারি।’
‘ছাতাটা নে। বৃষ্টি নামবে মনে হয়। ফাতেমাকে বৃষ্টিতে ভিজতে দেয়া যাবে না।’
‘আচ্ছা।’
‘পানির কলসিটাও নে। ওখানে মটকায় কিছু ছাতু আছে, নিয়ে নে।’
‘নিয়ে নিলাম। আরকিছু নেয়া যাবে না। এখন শুধু জীবনটা নিয়ে পালিয়ে যেতে পারলেই হলো।’
আলমের মায়ের জিনিসপত্র নেয়া শেষ হয় না। আলম একপ্রকার জোর করেই তার মাকে ঘর থেকে বের করে আনে। পাঁচ মিনিটের জায়গায় পনেরো মিনিট হয়ে গেছে। সারা জীবন ধরে যে সংসার তিনি গুছিয়েছেন, যে ঘরটাকে আবাদ করে তুলতে তার ব্যয় হয়েছে দীর্ঘ ৪০ টি বছর, মাত্র পনেরো মিনিটেই কি তা সব ছোট্ট একটা পুটলিতে তুলে নেয়া সম্ভব? কিন্তু জীবন যখন বিপন্ন হয়ে যায়, প্রচণ্ড ভারী পাথরের মতো নিজের জীবন যখন নিজের ওপরই চেপে বসে, তখন জীবন সামলে রাখাই তো দায় হয়ে পড়ে। সংসারের মায়া, জন্মভূমির টান তখন তুচ্ছ হয়ে যায়। সংসার থেকে পালানো যায়। নিজের থেকে নিজে কখনো  পালানো যায় না। তাই নিজেকে নিজে বাঁচানোর প্রশ্ন এলে, তখন নিজের মায়া ছাড়া অন্যসব মায়া ত্যাগ করতে হয়।

মংডুর বুদিচং এলাকা থেকে দংখালি ঘাটে এসে পৌঁছতে তাদের প্রায় চারঘণ্টা লেগে গেছে। পথটা চারঘণ্টার না, দুই ঘণ্টার। কিন্তু ফাতেমার কারণে দেরী হয়েছে। ফাতেমা ছয় মাসের গর্ভবতী। সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। একটু হাঁটে, একটু বসে। একটু পরপর পানি খেতে চায়। তার মাথা ঘুরায়। তাকে পানি খাওয়ানোর দায়িত্ব পালন করছে ছোটভাই রফিক। আলম তার মায়ের সঙ্গে থাকছে। তার মায়ের অবস্থাও তেমন ভালো না। নাজিয়ার হাতে কোনো ভারী জিনিস দেয়া হয়নি। তার হাতে একটা কলসি দেয়া হয়েছে। খালি কলসি নিয়ে সে সবার সঙ্গে দৌড়ে দৌড়ে চলছে। নাজিয়া আলমের ছোট বোন। আলমের দু বছর পর পৃথিবীতে এসেছে ফাতেমা। তারপর রফিকুল। তারপর নাজিয়া।

ঘাটে এসে ফাতেমা একদম নেতিয়ে পড়েছে। একটা গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসে পড়েছে। তার বমি বমি ভাব হচ্ছে। ঘাটে এখন প্রচণ্ড ভীড়। কেউ কারো দিকে তাকানোর ফুরসত নেই। সবাই তাদের মতো জীবন নিয়ে পালাচ্ছে। নাফ নদীটা পেরুলেই একটা না একটা গতি হবে। সেখানে সেনাবাহিনীর নির্মমতা নেই। বৌদ্ধদের নৃশংসতা নেই। আলম বললো, ‘বমি করবি ফাতেমা?’
‘ভাব হচ্ছে। পেট গুলাচ্ছে।’
‘এখানেই বমি করে নে। নৌকায় উঠে গেলে বমি করার সুযোগ পাবি না। দেখিস না একটা নৌকায় কেমন গাদাগাদা করে মানুষ তুলছে।’
রফিক বললো, ‘আমরা পাঁচজন। ছোট নৌকাগুলো তুলছে বারো তেরোজন করে। বড় নৌকাগুলো তুলছে চল্লিশ জন করে। নদীতে আছে ঢেউ।’
ফাতেমা ওয়াক ওয়াক শুরু করলো।
আলম বললো, ‘গলায় আঙুল ঢুকালে তাড়াতাড়ি বমি হয়। বমির পর দেখবি শরীর  ফুরফুরা লাগবে। আমি নৌকা দেখে আসছি।’

নাজিয়া তার ওড়নার এক কোণা দিয়ে ফাতেমাকে বাতাস করছে। রফিকের হাতে পানির বোতল। বমির পর পানি ঢালতে হবে মাথায়। চোখে মুখে দিতে হবে পানির ছিটা। তারপর ফাতেমা কুলি করবে। দু’এক ঢোক পানি খাবে। বমির পর পানি না খেলে গলা জ্বলে।
মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আনমনা হয়ে যাচ্ছেন বৃদ্ধ মা আছমা বেগম। ফাতেমার স্বামী হামিদুল সঙ্গে থাকলে ফাতেমার মনটা অন্তত ভালো থাকতো। মায়ের মন খারাপ থাকলে নাকি গর্ভের বাচ্চা বড় হয় গুমরোমুখো হয়ে। তার জীবনে হাসির অংশ থাকে কম, কান্নার অংশ থাকে বেশি। হামিদুল এখন তাদের সঙ্গে নেই। একমাস আগেই তাকে ধরে নিয়ে গেছে সেনাবাহিনী। হঠাৎ করেই একদিন সকালে বুটের শব্দ তুলে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো উর্দি পরিহিত কয়েকজন। কর্কশ গলায় বললো, হামিদুল কই?
হামিদুল বাইরে এসে বললো, ‘আমিই হামিদুল।’
‘থানায় যেতে হবে।’
‘কেন?’
‘তোরা থাকিস এই দেশে, সমর্থন করিস বাংলাদেশকে? আমাদের কাছে রিপোর্ট আছে।’
‘কী রিপোর্ট? আমি সাধারণ একজন মুদি দোকানি।’
‘মিয়ানমার-বাংলাদেশ ফুটবল ম্যাচে তুই সবসময় সমর্থন করিস বাংলাদেশকে। সেদিনের ম্যাচে বাংলাদেশ যখন আমাদেরকে হারালো, এত খুশি দেখাচ্ছিল কেন তোকে? থানায় চল, কথা হবে।’
সেই যে গেলো, হামিদুল আর ফিরে আসেনি। থানায় গিয়ে হামিদুলের খোঁজ নিবে, তাও সম্ভব না। যে খোঁজ নিতে যাবে, তাকেই দেশদ্রোহী  আখ্যা দিয়ে আটকে রেখে দিবে। তবুও ফাতেমা যেতে চেয়েছিল, আছিয়া বেগম দেননি। মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছেন, ‘আমরা হচ্ছি সুতোয় বাঁধা ঝুলন্ত বিস্কুটের মতো। কোনোকিছুর নিশ্চয়তা নেই। রোদ উঠলেও শুকিয়ে ঝরে যাব, বৃষ্টি নামলেও ভিজতে ভিজতে ভেঙে পড়বো। তোর না হয় জীবনের ভয় নাই। কিন্তু এখন তো তুই একা না। তোর সঙ্গে আরেকজন আছে, তোর নাড়ির সঙ্গে জুড়ে। তাকে তো বিপদে ফেলতে পারবি না।’
অনাগত সন্তানের কথা চিন্তা করে ফাতেমা আর থানার দিকে পা বাড়ায়ানি। কিন্তু সেই সন্তানের কথা চিন্তা করেই তাকে এখন ছেড়ে যেতে হচ্ছে জন্মভূমি। পাড়ি দিতে হচ্ছে নদী। একটু মাথা গুঁজবার ঠাই পাবার জন্য তাকে হাত পাততে হচ্ছে আরেক দেশের কাছে। কী বর্ণিল এই জীবন। একটা জীবন মানুষ কাটিয়ে দেয়। কিন্তু জীবনের রংটা ঠিকঠাক ধরতে পারে না। এই যেমন ধরতে পারছে না ফাতেমা।

নৌকায় আলমদের সঙ্গে আরও তিন চারটি পরিবার উঠেছে। নাফ নদী পাড়ি দেবার জন্য তাদের সবাইকেই গুণতে হচ্ছে জনপ্রতি পাঁচশ টাকা করে। এতটাকা আলমদের কাছে নেই। মাঝির এক কথা, ‘যাইলে যাইবেন, না যাইলে নাই।’
আলম বললো, ‘যেতে তো হবেই।’
‘তাহলে টাকা বের করেন। টাকা আমরা একা খাই না। প্রশাসনকেও টাকা দিতে হয়।’
‘টাকা নাই। সোনার একটা হার আছে, দিয়ে দিব।’
সোনার হারের কথা শুনে চকচক করে উঠে মাঝির চোখ। এ কদিনে সে আরও কয়েকটি সোনার হার পেয়েছে। এখন সে বুঝে গেছে টাক না থাকলেও ছাড় দেয়া যাবে না। চাপ দিতে হবে। টাকা না হোক , সোনা-রূপার হার বেরিয়ে আসবে নিশ্চিত।
মুচকি হেসে মাঝি বললো, ‘টাকা না নিয়া পারি না। বুঝলেন? প্রশাসন জ্বালায় খুব। হার তো বড় কথা না, বড় কথা হচ্ছে আমরা আপনাদেরকে আমাদের দেশে নিয়ে যাচ্ছি।’
আলম বললো, ‘ওপারে যেতে কতঘণ্টা লাগবে?’
‘কম করে হলেও সাড়ে তিন ঘণ্টা।’
‘নদীতে আজ ঢেউ। আপনারা তেমন নড়াচড়া কইরেন না।’
‘আমাদের নিয়ে নামাবেন কোথায়?’
‘নাফ নদী দিয়ে যাদেরকে পার করি, তাদেরকে পাঁচটা পয়েন্টে নামাতে পারি। নাইট্যংপাড়া, নয়াপাড়া, শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়া, হারিয়াখালি, ঘোলারচর।’
‘কোথায় নামলে সুবিধা?’
‘আপনাদেরকে আমি শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়া নামিয়ে দেবো। সেখান থেকে হেঁটে, রিকশায় বা ইজি বাইকে করে চলে যাবেন টেকনাফ। সেখান থেকে উখিয়া বা অন্যান্য রোহিঙ্গা শিবিরে যাবেন।’

নৌকায় চুপচাপ বসে থাক সম্ভব হলো না কারো। তারা সবাই একই পথের যাত্রী, একই দেশের শরণার্থী। তাদের একেকজনের বুকে জমে আছে পাহাড় পাহাড় দুঃখ। নৌকা দংখালি ঘাট থেকে যত দূরে যাচ্ছে, ততই ক্রমশ অস্পষ্ট হচ্ছে তাদের মাতৃভূমি। নৌকার মহিলারা কেউ কেউ গুণগুনিয়ে বিলাপ করছে। গুণগুনিয়ে বিলাপ মনের দুঃখ হালকা করে। পুরুষরা বিলাপ করতে পারে না। তাদের দুঃখ কমানোর কোনো পন্থা নেই। লুকিয়ে লুকিযে চোখের জল ফেলে দুঃখ কমে না। ছাইচাপা আগুনের মতো দপদপ করে ভেতরে জ্বলতে থাকে। তবে তারা দুঃখ কমাতে চেষ্টা করে বিলাপরত মহিলাদের ধমক দিয়ে। আলম তার মাকে ধমক দিলো, ‘কান্দা বন্ধ করো। বিলাপ কইরা লাভ কী। দেখো, নৌকার মাথায় একজন বইসা আছে। তার পায়ে গুলি লাগছে। সেও তো কান্দে না।’
যার পায়ে গুলি লাগছে, সে কাঁদছে না কথাটা মিথ্যা। কান্নার শব্দ যেন না হয়, তাই সে মুখে কাপড় দিয়ে রেখেছে মোটা করে। একটু আগেও তার পা বেয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছিলো। পায়ে কাপড় দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেয়া হয়েছে। ব্যান্ডেজে ব্যবহার করা হয়েছে এক ধরণের পাতার রস। মাঝি বললো, ‘সকালে একজনকে পার করলাম। তার সারা গায়ে কোপের যখম। কিন্তু গতকাল একজনকে ওপারে নিতে পারিনি। গুলির যখম থেকে এমনভাবে রক্ত পড়ছিলো, পাতার রস দিয়েও থামানো যায়নি। মাঝ নদিতে মারা গেলো। জীবিত মানুষেরই যেখানে পায়ের তলায় মাটি নেই, শোবার জন্য মৃত মানুষ জায়গা পাবে কই। তাই সবাই মিলে তাকে সলিল সমাধি দিয়েছি।’
নৌকার সবাই পড়লো, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউজন।’
মাঝি বললো, ‘শুনলাম সেনাবাহিনীর সঙ্গে বৌদ্ধরাও মানুষ মারতেছে?’
আলম বললো, ‘হুম।’
সেনাবাহিনী না হয় সরকারের আদেশে মারছে। বৌদ্ধরা কেন মারতেছে?’
‘মুসলিমরা না থাকলে তাদের জায়গাগুলো তারা ভোগ করতে পারবে। তাই মুসলিমদের বাঙালি আখ্যা দিয়ে তাড়াতে চায়। তাদের ভেতর সাম্প্রদায়িক হিংসা বেশি। বৌদ্ধরা মুসলিমদের একদমই সহ্য করতে পারে না।’
‘সরকারও তো বৌদ্ধ?’
‘হুম।’
‘নৌকা বেয়ে অনেক টাক পাচ্ছি ঠিক। কিন্তু সারাদিন নৃশসতার এত গল্প শুনে, এত দৃশ্য দেখে রাতে ঘুমুতে পারিনা। গতকাল তাকে সলিল সমাধি দেবার পর সারারাত ঘুমাতে পারিনি। চোখ বন্ধ কররেই সে হাজির হয়। মুখ ভার করে বলে, মাঝি তুমিও বৈষম্য করো? মুসলিম হিসেবে তোমাদের ভূমিতে আমাকে সাড়ে তিনহাত জায়গাও দিতে পারলে না? তোমাকে তো মাটির ওপরে জায়গা দিতে বলছি না শরণার্থীদের মতো। আমি চাইছি কেবল মাটির নিচে একটু জায়গা। নাফ নদীর পানিতে অনেক মুসলিমের রক্ত লেগে আছে। আমার কষ্ট হয়। খুব কষ্ট।’

আলমদের নৌকাটি শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়া ঘাটে যখন পৌঁছল, তখন  ইশার আজান পড়ছে। জোহর , আসর , মাগরিব তিন ওয়াক্তের আজান তারা শুনতে পায়নি। এখন ইশার আজান শুনতে পেয়ে তাদের মনে খানিক প্রশান্তির বাতাস বয়ে গেলো। তারা এখন নিরাপদ। তাদের ওপর চাইলেই এখন আর বৌদ্ধরা আক্রমণ করতে পারবে না। ঘর না থাকুক, বাড়ি না থাকুক। নৌকা থেকে নামার আগে সবার কাছ থেকে ভাড়া তুলে নিল মাঝি। আলম যখন সোনার হারটা দিচ্ছিল, মাঝি জিজ্ঞেস করলো, ‘কোথায় যাবেন?’
‘উখিয়ার কুতুপালং যাব?’
‘যেতে পারেন। এখনো সব ঠিকঠাক হয় নাই। নতুন নতুন শিবির তৈরী হচ্ছে।’
‘আগে এক জায়গায় গিয়ে পা রাখি।’
‘উখিয়া যাবার ভাড়া আছে? হেঁটে তো যেতে পারবেন না। সঙ্গে পোয়াতি মেয়ে।’
‘ভাড়া নেই।’
‘তাইলে আমি কিছু টাকা দিচ্ছি। এই নেন।’
মাঝি আলমকে তিনশ টাকা দিয়ে বললো, ‘পোয়াতি মেয়েটার জন্য আমার পক্ষ থেকে উপহার।’
আলমের চোখে জল এসে গেলো।

ইজি বাইকে উঠার পর থেকে না হলেও পঞ্চাশটা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে আলম। বাইকটির চালক সোহেল একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে।
‘আপনারা কোথায় থাকতেন?’
‘মংডুর বুদিচং।’
‘আপনারা কেউ আহত হয়েছেন?’
‘হয়েছি।’
‘কে কে। আপনার কেউ?
‘আমার দাদা। তাকে জবাই করে ফেলেছে বৌদ্ধরা।’
‘আপনার বাবা নাই?’
‘না। দুই হাজার বারো সালে দাঙ্গার সময় মারা গেছেন।’
‘খুব মারতেসে?’
‘হুম। আমাকেও গুলি করছিলো। কিন্তু খাটো হওয়ার কারণে বেঁচে গেছি। গুলি লাগেনি।’
‘খাটো হওয়াটাও আল্লাহর ইচ্ছে। আল্লাহ কোনোকিছুই অনর্থক করেন না। সবকিছুরই একটা কারণ থাকে।’
‘মাতৃভূমি থেকে উচ্ছেদ করারও কারণ থাকে?”
‘আলবত থাকে। আমাদের নবিজিকে মাতৃভূমি থেকে বের করে দেয়া হইছিলো। তারপর তিনি বিজয়ীর বেশে নিজের মাতৃভূমি মক্কায় ফিরে গেছেন। আপনারাও একদিন ফিরে যাবেন।’
‘ইনশাআল্লাহ।’

আলমের মনে হতে থাকে তারা কোনো অপরিচিত দেশে আসেনি। তারা এসেছে তাদেরই মুসলিম ভাইদের কাছে, বেড়াতে। কিছুক্ষণের জন্য সে ভুলে যায় দুঃখ, মাতৃভূমি  হারানোর বেদনা। ঠকঠক করে ইজি বাইক চলছে। বাইকে দুলুনিতে তাদের চোখে নেমে আসে তন্দ্রা।

কুতুপালংয়ের ২৯ নং ক্যাম্পে জায়গা হয়েছে আলমদের। কাল এসে আজ জায়গা পাওয়ার কথা না। কিন্তু পেয়েছে তাদের মসজিদের ইমামের বদৌলতে। এখানে গতকাল রাতে এসেই বুদিচং জামে মসজিদের ইমাম নুরুল হকের সঙ্গে দেখা। তিনি এসেছেন একদিন আগে। এই ক্যাম্পের নেতার সঙ্গে তার সখ্যতা আগে থেকেই। সেই হিসেবে তিনি জায়গা পেয়েছেন। ছোট্ট একটা কোণায় আলমদের জায়গা দিয়েছেন। তবে ইমাম বলে দিয়েছেন, ‘ত্রিপল দিতে পারবো না। ত্রিপল ব্যবস্থা করে যদি তাবু বানিয়ে নিতে পারো, সবসময়ের জন্য থাকতে পারবে।’
বিনয়ে বিগলিত হয়ে আলম বলেছে, ‘হুজুর, জায়গাটুকু দেয় কে? আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো।’

সঙ্গে আনা চাদর বিছিয়ে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটিয়েছে আলমরা। শীতকাল হলে বড্ড মুশকিলে পড়তে হতো। মাটি ঠাণ্ডা। বাতাস বইছে দিগম্বর। গরম কাল হওয়ায় রক্ষে। তবুও ফাতেমার নিচে মোটা করে কাপড় বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। সতর্ক থাকা ভালো।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই বেরিয়ে পড়েছে আলম। রফিককে রেখে গেছে মা-বোনদের দেখাশুনা করতে। ত্রাণ নিয়ে একটা ট্রাক এসেছে ঢাকার বড় এক মাদরাসা থেকে। সবাইকে লাইনে দাঁড় করানো হচ্ছে। কিন্তু কেউ লাইনে দাঁড়াতে চাচ্ছে না। মনে হচ্ছে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আসা মানুষগুলোর তর সইছে না। কেড়ে নিতে চাইছে সবকিছু। একজন মাওলানা হ্যান্ড মাইক দিয়ে বলছেন, ‘কেউ হুড়োহুড়ি করবেন না। পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রিপল এবং খাবার নিয়ে এসেছি। লাইনে দাঁড়ালে তাড়াতাড়ি দিতে পারবো।’
ভীড় থেকে কেউ বললো, ‘দুদিন হলো খাবার পাচ্ছি না। আর কত সহ্য করবো?’
যতটুকু সম্ভব লাইন বজায় রেখে ত্রাণ দেয়া হলো। দুই কেজি করে চাল, দুই কেজি আলু, এক কেজি তেল, এক কেজি মুড়ি। একটি ত্রিপল। ট্রাক খালি হয়ে যাবার পর মাওলানা দেখলেন, তার সামনে হাত পেতে দাঁড়িয়ে আছে শত শত মানুষ। তাদের চেহারায় ক্ষুধার স্পষ্ট অভিঘাত। ঠোঁটগুলো শুকিয়ে গেছে। পেতে রাখা হাতগুলো কাঁপছে।
মাওলানা বললেন, ‘আমি ক্ষমাপ্রার্থী। যতটুকু এনেছিলাম, শেষ হয়ে গেছে। আমি এক মাদরাসা থেকে এসেছি। আরও অনেক মাদরাসা-মসজিদ থেকে ত্রাণ আসছে। একটু অপেক্ষা করুন।’
মাওলানার কথা শেষ না হতেই আরেকটি ট্রাক এসে  থামলো। অমনি সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়লো তার ওপর। এই ট্রাকটি এসেছে ঢাকার মধ্যবাড্ডার একটি মসজিদ থেকে। মসজিদের মুসল্লিরা নিয়ে এসেছে এই ত্রাণ। ট্রাকটি ক্ষুধার্ত মানুষের নগ্ন থাবা থেকে কোনোভাবেই রক্ষা করা গেলো না। তবুও সাধ্যমতো চেষ্টা করা হলো কেউ যেন একসঙ্গে দু পেকেট না নিতে পারে।
মাওলানা তখনো বলেই যাচ্ছেন, ‘আমরা মিয়ানমারের মতো নির্দয় সংকীর্ণ নই। আমাদের দিল দরিয়ার চেয়েও বিশাল। আমরা একমুঠো ভাত কম খেয়ে আপনাদের খেতে দিব। খাবার নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমরা আপনাদের পাশে আছি।’

ত্রিপল দিয়ে কোনোরকম একটা তাবুর মতো বানালো আলম। মাটি খুঁড়ে চুলা বানিয়ে শুরু হলো রান্না। আজ আলু ভর্তা আর ভাত। রফিকের ছোট একটা ডায়রি আছে। ডায়রিটা সে কিনেছিল কবিতা লেখার জন্য, বুদিচং বাজার থেকে। ক্লান টেইনে পড়তো সে। আসবার সময় ডায়রিটা সঙ্গে নিয়ে এসেছে। ডায়রিতে আজ নতুন একটা অধ্যায় শুরু হলো। অধ্যায়টার নাম ‘বাংলাদেশ’।
রফিক তার ডায়রিতে লিখলো, দুুদিন পর আজ ভাত খাবো। আলু ভর্তা দিয়ে। এগুলো এদেশের মাওলানাদের পক্ষ থেকে আমাদের জন্য মেহমানদারি। মাথার ওপরে যে ত্রিপল দিয়ে চাল দেয়া হয়েছে, এটাও তাদের দেয়া। বিকেলে আমিও ত্রাণ খুঁজতে বাইরে যাবো। মিয়ানমার সামরিক জান্তার নৃশংসতায় আমার জীবন পেলো নতুন এক অধ্যায়। তার নাম বাংলাদেশ। মহান বাংলাদেশ। ১.৯.২০১৭।

রফিকের ডায়রিতে যেদিন বাংলাদেশ পর্বটা লেখা শুরু হলো, সেদিনই বাংলাদেশের বিমানবন্দরে এসে নামলেন আমেনা এরদোগান। তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রজব তাইয়েব এরদোগানের স্ত্রী। তিনি এসেছেন একটি প্রাইভেট বিমানে। ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেই তিনি বললেন, ‘আমি রোহিঙ্গাদের দেখতে ক্যাম্পে যাবো।’
রাষ্ট্রদূত বললো, ‘এখনই?’
‘হুম, এখনই। আমি এখানে বেড়াতে আসিনি। এসেছি রোহিঙ্গাদের দেখতে।’
‘এখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। রাতে সেখানে না যাওয়াটাই ভালো। দিনে গেলে সবকিছু দেখা যাবে।’
‘আচ্ছা।’
‘বাংলাদেশে সকালবেলার সফর খুব আরামদায়ক। বেলা একটু বাড়লেই সেই আরাম থাকে না। ভ্যাপসা গরম শুরু হয়ে যায়।’
‘আপনি সকালবেলা কোথায় কোথায় সফর করেছেন?’
‘কক্সবাজার। রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে বেশিক্ষণ লাগে না। কক্সবাজারের বিশার সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে সকাল বেলার সূর্যোদয় দেখলে বাংলাদেশেই থেকে যেতে ইচ্ছে করবে।’
আমিন এরদোগান বললেন, ‘শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছে না। কিন্তু তবুও এলাম। আমি এসেছি তাদের সাহস দিতে। মজলুমের পাশে দাঁড়াতে হয়। কাল সকালেই রওয়ানা হবো। সকালের ফ্রেশ আবহাওয়ায় শরীরটাও ভালো লাগবে।’
‘আচ্ছা। আপনি যেমন বলবেন তেমনই হবে।’

সকাল সকালই উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে পৌঁছে গেলেন আমিনা এরদোগান। অনেকে তাকে না চিনলেও তার বহর দেখে বুঝছে গুরুত্বপূর্ণ কেউ এসেছেন। তার গায়ে মিষ্টি কালারের জামা, মাথায় হিজাব, চোখে চশমা। তেমন আহামরি সাজ না। তাকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ক্যাম্পের শিশুগুলো। তিনি একটি শিশুকে ডাকলেন। শিশুটি পুষ্টিহীনতায় একদম লিকলিকে হয়ে আছে। গলার হাড়, পিঠের হাড় বেরিয়ে আছে। আমিনা এরদোগান জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবু, কোথায় থাকো?’
ইশারা করে বাচ্চাটি বললো, ‘ঐদিকে।’
বাচ্চাটির হাত ধরে আমিনা এরদোগান তার খুপরিতে গেলেন। খুপরি এতটাই নিচু, মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো যায় না। নুয়ে নুয়ে ঢুকতে হয়। তিনিও নুয়ে ঢুকলেন। তাকে দেখে বাচ্চাটির মা মাথায় ঘোমটা তুলে দিল।
‘কবে এসেছেন এখানে?’
‘তিন-চারদিন হবে।’
‘কার সঙ্গে এসেছেন?’
‘একা একা। এই বাচ্চাটি বুকে নিয়ে চলে এসেছি। আমার ঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আমার চোখের সামনে আমার স্বামী এবং বড় ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে।’
আমিন এরদোগান চোখ মুছেন। তিনি দেখেন ছোট্ট খুপড়িজুড়ে একটা হাহাকার বয়ে চলছে। নিঃসীম এক নৈশব্দতা বিরাজ করছে। বাচ্চাটির মায়ের চোখের দিকে তাকানো যায় না। তার চোখে মৃত মানুষের চোখের মতো শুভ্রতা, নিসঙ্গতা।
‘খাবার কিভাবে খাচ্ছেন?’
‘ত্রাণ দিচ্ছে, খাচ্ছি। বাচ্চাকে নিয়ে ত্রাণ আনতে যেতে কষ্ট হয়। কিন্তু কী করবো। হুড়োহুড়ি করেও ত্রাণ পাওয়া যায় না।’
আমিনা এরদোগান মেয়েটিকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। বুকের উষ্ণতায় তিনি বুঝাতে চান, তাদের সঙ্গে তিনি আছেন। তার দেশ  তুরস্ক আছে। এই খুপরি থেকে বেরিয়ে আরেকটি খুপরিতে ঢুকেন তিনি।
কাউকে ঢুকতে দেখে বিছানায় উঠে বসে ফাতেমা। আছিয়া বেগম তখন খুপরিতে নেই। আমিনা বেগম ফাতেমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, ‘তোমরা কয়জন এসেছো?
‘পাঁচজন। আমি , মা, বোন, দুই ভাই। দাদাকে হত্যা করা হয়েছে। বাবা নেই। আমার স্বামীকে তুলে নিয়ে গেছে। জানি না এখন তিনি কেমন আছেন?’
‘মেহমান কবে আসবে?’
ফাতেমার ক্লিষ্ট মুখে হাসি ফুটে উঠে। সে খানিকটা লজ্জা পায়। মিনমিন করে বলে, ‘নভেম্বরের শেষ, অথবা ডিসেম্বরের শুরু।’
‘সতর্ক থাকবে। ইউনিসেফের টিকা নিয়ে নিও একটা।’
‘আচ্ছা।’
‘ভয় করো না। আমরা পাশে আছি।’

খুপরি থেকে বেরিয়ে আসার পর রাষ্ট্রদূত বললো, ‘ম্যাম, একজনের সঙ্গে একটা ছবি তুলবেন না?’
আমিনা এরদোগান বললেন, ‘না।’
‘মিডিয়ার লোকেরা চাইছিলো।’
‘ছবি বা সেলফি কিছুই তুলবো না।’
‘প্লিজ ম্যাম!’
‘যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের পক্ষে আমরা কিছুই করতে পারিনি, যাদের জন্মভূমিতে থাকার অধিকারটুকু দিতে পারিনি, তাদের সঙ্গে ছবি তুলতে আমি লজ্জা পাই।’
আমিনা এরদোগান একটি ছবিও তুললেন না। রোহিঙ্গাদের উপর চলা নৃশংস নির্যতনের বর্ণনা শুনে তার মন বিষাদে ছেয়ে গেলো। বারবার চোখের কোণায় জল জমলো। দেশে ফিরবার সময় বিমানের জানালার পাশে বসে একটা পরিকল্পনা করলেন তিনি। এবার দেশে ফিরেই তিনি বিশ্ব নেতাদের স্ত্রীদের কাছে তিনি একটি চিঠি লিখবেন। চিঠিতে রোহিঙ্গা মুসলমানদের দুঃখ-দুর্দশার দিকে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন। চিঠিতে তিনি লিখবেন–

‘মায়ানমারে চলমান মানবিক ট্রাজেডির দিকে এখনো আন্তর্জাতিকভাবে জনমত তৈরী হয়নি। এজন্যই রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধ এবং লাখ লাখ শরণার্থীদের দুরবস্থা লাঘবে আন্তর্জতিক সম্প্রদায়ের সুদৃষ্টি নিয়ে আসার জন্যই মূলত আমি এই চিঠি লিখছি।

শরণার্থী ক্যাম্পে আমি এক মহিলার সঙ্গে কথা বলেছি। মিয়ানমারে তার বাড়ঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তার সামনে তার স্বামী এবং সন্তাদদের হত্যা করা হয়েছে। তার কথা আমকে গভীরভাবে পীড়া দিচ্ছে। ক্যাম্পগুলোতে অসহায় শরণার্থীদের করুণ দৃষ্টির কথা, আকুতির কথা আমি কখনো ভুলতে পারবো না।

আমি আশা করি বিশ্ব নেতাদের স্ত্রী হিসেবে মানবিক প্রচেষ্টা চালানোর মাধ্যমে আমরা আন্তর্জতিক সম্প্রদায়ের কাছে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারি। একজন মা হিসেবে, একজন নারী হিসেবে, এবং একজন মানুষ হিসেবে আমি মনে করি, আমাদের এমন একটি বিশ্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেখানে সকলে মানবিকভাবে বসবাস করতে পারবে। কোনো ধরণের জাতিগত ও ধর্মীয় ভেদাভেদ থাকবে না।’

একটা এনজিওতে কাজ পেয়েছে আলম। রফিক কাজ পেয়েছে ব্রাকের একটা স্কুলে। বেতন খুবই অল্প, টেনেটুনে চলে যায়। ক্যাম্পের এনজিওগুলোতে আগে কাজ করতো কক্সবাজার এবং তার চারপাশের স্থানীয় বাসিন্দারা। কিন্তু নতুন করে বাংলাদেশে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা প্রবেশের পর কক্সবাজারের বাসিন্দাদের সে দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। তারা নতুন করে কাজ পাচ্ছে না। অথচ এই মুহূর্তে তাদের কাজ পাবার কথা ছিল দ্বিগুণ। তাদের জায়গায় এনজিওগুলো এখন নিয়োগ দিচ্ছে নতুন শরণার্থীদের। তাদেরকে বেতনও কম দিতে হয়, তারা কাজও করে বেশি। একটি কাজ দিলে তারা অনুগত হয়ে থাকে বাধ্য গোলামের মতো।
আলম যার অধীনে কাজ করে তার নাম নুরুল আবছার। তিনি ফিল্ড অফিসার। কেতাদুরস্ত আদমি। তার চোখের ওপর একটা তিল আছে। এই তিলটার কারণে তাকে কুৎসিত লাগে। তিল হবে মেয়েদের । থুতনিতে ফুটে থাকবে তারার মতো। আর সেই তিলে মুগ্ধ হবে পৃথিবী। পারস্যের বিখ্যাত কবি ওমর খৈয়ামের মতো কবিরা লিখবেন, ‘প্রিয়ার চিবুকের একটি তিলের বিনিময়ে আমি দিয়ে দিব বুখারা-সমরকন্দ।’
আজ অফিসে ঢুকতেই নুরুল আবছার বললেন, ‘আলম সাহেব, স্থানীয় বসিন্দারা কিন্তু আমাদের ওপর ক্ষেপা।’
আলম কপাল কুঁচাকায়, ‘কেন?’
‘এনজিওতে তাদের কাজ না দিয়ে আপনাদের কাজ দিয়েছি তাই। শুনছি তারা দফায় দফায় মিটিং করছে।’
‘তারা কারা?’
‘তারা এদেশের মানুষ। কক্সবাজারের আশপাশে তাদের বসবাস। তাদের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের কর্মীরাও আছে।’
‘আমাদের কাজ থাকবো তো স্যার?’
‘থাকবে। তবে আমাদের ডিরেকশন অনুযায়ী আপনাদের কাজ করতে হবে।’
‘জ্বি।’
‘শুনতেছি তারা মানববন্ধন করবে। তাদের চাকরি দিতে এনজিওগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করবে।’
‘স্যার, তারা স্থানীয় বাসিন্দা। চাইলে দেশের যেকোনো জায়গায় চাকরি নিতে পারে । যেকোনো কাজ করতে পারে। কিন্তু আমরা চাইলেই তো যেকোনো জায়গায় গিয়ে কাজ করতে পারবো না। আমরা তো একপ্রকার বন্দী।’
নুরুল আবসার হাসলেন, ‘দূরে গিয়ে কাজ করতে তাদের কষ্ট হয় না? এখানের কাজ তো সহজ, দূরেও যেতে হয় না। বেতনও টাইম টু টাইম।’
‘জ্বি স্যার।’
‘আজ কি বার?’
‘মঙ্গলবার। সেপ্টেম্বরের একুশ তারিখ।’
‘জাতিসংঘে আজ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ দেয়ার কথা।’
‘সেখানে সবাই তো ভাষণ দেয় ইংরেজিতে। আমরা তো ইংরেজি বুঝি না।’
‘বুঝার ব্যবস্থা আছে। প্রধানমন্ত্রী আজ রোহিঙ্গা বিষয়ে কথা বলবেন। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। বিশ্ব নেতাদের সামনে তিনি তোমাদের জন্য কী প্রস্তাবনা পেশ করেন, তাই দেখার বিষয়। একটু পর অফিসে তোমাদের দুজন নেতা আসবেন। আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটসের সভাপতি মুহিব্বুল্লাহ এবং ভয়েস অফ রোহিঙ্গার চেয়ারম্যান শামসু আলম।’
‘আমার কী দায়িত্ব আজ?’
‘আজ তুমি তাদের সেবা-যত্ন করবে। আমি যা বলি তা করবে।’
‘জ্বি।’
‘এখন যাও। ২৭ নং ক্যাম্পে আমাদের শাখা অফিস থেকে একটি ফাইল নিয়ে আসো।’

আলমের পথ আটকে দাঁড়িয়েছে এক যুবক। এই যুবককে আলম চেনে না। কখনও দেখেওনি। তবে সে যে রোহিঙ্গা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আলম বললো, ‘আপনার নাম কি? কোন ক্যাম্পে থাকেন?’
‘আমার নাম নকিব। থাকি উনচিপ্রাং শরণার্থী শিবিরে। এখানে এক আত্মীয়ের কাছে এসেছিলাম।’
‘আমাকে চিনেন?’
‘বুদিচং বাজারে একবার দেখেছিলাম আপনাকে। তাই একটু কথা বলতে ইচ্ছে হলো।’
আলম হাসলো। তার হাসিতে ঝলমলে আনন্দ।
নকিব বললো, ‘কোন ক্যাম্পে থাকেন?’
আলম বললো, ’২৯ নং ক্যাম্পে। এনজিওতে চাকরি করি।’
নকিব বললো, ‘আচ্ছা। পরে কথা হবে।’
আলম জোর কদমে হাঁটা দিলো। আজকে নেতারা আসবেন অফিসে। দেরি করা যাবে না। কিন্তু আলম একটুও  টের পেলো  না একটু আগে যার সঙ্গে কথা বলেছে, সে তার সঙ্গে মিথ্যা বলেছে। যুবকটির নাম নকিব না। তার আসল নাম আদনান হক। রোহিঙ্গা ব্লগ ‘আরবি’ এর সম্পাদক। এই ব্লগের প্রধান কাজ অনুসন্ধানী রিপোর্ট। আগস্টে ঘটে যাওয়া রোহিঙ্গা গণহত্যার গুরুত্বপূর্ণ কিছু গোপন ভিডিও ফাঁস করেছে ব্লগটি। তারা মিথ্যা কিছু ছাপে না। যা ছাপে, তার সঙ্গে যথেষ্ট এভিডেন্স যুক্ত করেই ছাপে। এই কাজটি করতে হয় খুব গোপনে। তার পরিবারের কেউ জানে না সে কাজটি করছে। আলমের সঙ্গে তার আজকের সাক্ষাৎ পরিকল্পিত। আদনান হক তার মোবাইলে আসা সর্বশেষ মেসেজটার দিকে তাকিয়ে হাসলো।

ফাইলটা নিয়ে ফিরতে ফিরতে আলমের একটু দেরী হয়ে গেলো। তখন অফিসে দুজন রোহিঙ্গা নেতা বসে বসে চা খাচ্ছে। আলম তাদের দুজনকে সালাম দিলো। মুহিব্বুল্লাহ জিজ্ঞেস করলো, ‘এখানে নতুন মনে হয় তুমি।’
‘জ্বি। একমাসও হয়নি।’
‘চা টা তুমি বানিয়েছো?’
‘জ্বি।’
‘দারুণ চা বানাতে পারো।’
‘আমার ইচ্ছে ছিল চায়ের দোকান দিব। সেপ্টেম্বরের এক তারিখ থেকে চায়ের দোকানে বসার কথা ছিল। সব গুছিয়েছিলাম। কিন্তু দেশ ছেড়েই চলে  আসতে হলো।’
‘নিজেই শিখেছো চা বানানো? নাকি চা বিদ্যা শেখার গুরু আছে?’
‘গুরু ছাড়া বিদ্যা হয় না। বিদ্যাটা যত ছোটই হোক। আমার গুরু ইউটিউব।’
‘বাহ!’
আলমের খুব আনন্দ হচ্ছে। গর্বে তার বুকের ছাতি ফুটে উঠেছে। রোহিঙ্গ দুজন নেতা তার চা খেয়ে প্রশংসা করেছে। ফাইল আনতে যাবার আগেই নুরুল আবছার বলেছে, আলম চা বানিয়ে দিয়ে যাও। তার বানিয়ে দিয়ে যাওয়া চা এভাবে কাজে লাগবে সে কল্পনাও করেনি। সঙ্গে তাকে একটা গাঢ় দুঃখবোধও ছুঁয়ে গেলো। এখানে সে মাসে তিন হাজার টাক পাবে। চা বানানো , ফাইল টানাটানি, ফুট-ফরমায়েশ খাটা সহ কত কাজ তাকে করতে হবে। কিন্তু সে একটা চায়ের দোকান দিতে পারলে উপার্জন করতে পারতো তারচে বেশি টাকা। যত কাপ বিক্রি, তত টাকা উপার্জন। নিম্ন এবং মধ্যবিত্ত মানুষের প্রধান শখের পানীয় চা।

একজন অনুবাদক ঠিক করা হয়েছে। অনুবাদক জাতিসংঘে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ অনুবাদ করে শুনাচ্ছে। হুবহু অনুবাদ না, ভাব অনুবাদ। তাকে ঘিরে বসেছে অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এই অফিসের দুই তৃতীয়াংশ কর্মচারী রোহিঙ্গা শরণার্থী। তারাও উৎসুক হয়ে শুনছে। তারা যে দেশে আশ্রয় পেয়েছে, সে দেশের প্রধানমন্ত্রী তাদের অধিকার নিয়ে আজ বিশ্বের  সবচে গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চে কথা বলছে। চৌদ্দই সেপ্টেম্বর তাকে ‘মাদার অফ হিউম্যানিটি’ বলে আখ্যা দিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম চ্যানেল ফোর। চ্যানেলটির এশিয়া প্রতিনিধি জনাথান মিলার তার প্রতিবেদনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এই উপাধি দেন।

অনুবাদক বললেন, মাদার অফ হিউম্যানিটি আজ জাতিসংঘে রোহিঙ্গাদের পক্ষে পাঁচটি দাবি জানিয়েছেন।
এক. অনতিবিলম্বে এবং চিরতরে মিয়ানমারে সহিংসতা ও ‘জাতিগত নিধন’ নিঃশর্তে বন্ধ করা। দুই. অনতিবিলম্বে মিয়ানমারে জাতিসংঘের মহাসচিবের নিজস্ব একটি অনুসন্ধানী দল প্রেরণ করা। তিন. জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান এবং এ লক্ষ্যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুরক্ষা বলয় গয়ে তোলা। চার. রাখাইন রাজ্য হতে জোরপূর্বক বিতাড়িত সকল রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে তাদের নিজ ঘরবাড়িতে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা। পাঁচ. কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালার নিঃশর্ত, পূর্ণ এবং দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।

রোহিঙ্গারা হাত তালি দিলো। একজন আরেকজনের দিকে তাকাতে শুরু করলো। এই দাবিগুলোই তারা শুনতে চাচ্ছিল। এগুলো তাদের মনের কথা, প্রাণের দাবি। শামসু আলম বললো, ‘এবার প্রত্যাবাসনের প্রসঙ্গটা খুব জোরালোভাবেই উঠবে।’
মুহিব্বুল্লাহ বললো, ‘হুম।’
‘প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণের মাধ্যমে তার সূচনা হলো।’
‘কিন্তু আমাদেরও ভেবেচিন্তে কাজ করতে হবে। চাপে পড়ে মিয়ানমার কিছু নাগরিক নিয়ে যাবে ঠিক, কিন্তু সেখানে তাদের অধিকার দিবে না। তাই সবকিছু নিশ্চিত করেই যেতে হবে।’
‘এখন থেকেই ভাবতে হবে আমাদের দাবিগুলো নিয়ে।’
‘হুম।’
নুরুল আবছার রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে একটা ক্লোজডোর বেঠক করবেন। অফিসের সবাইকে ছুটি দিয়ে দিয়েছে। আলমও বাইরে বেরিয়ে এসেছে। কুতুপালং ক্যাম্পের মাথার ওপর কালো ওড়নার মতো সন্ধা নামছে। আলম একটা উঁচু টিলার ওপর এসে দাঁড়ায়। সন্ধ্যায় এখানে এসে দাঁড়ালে ক্যাম্পের একেকটা খুপড়িকে কবরের মতো মনে হয়। সে নিজেও একটু পর এমন একটি কবরে গিয়ে ঢুকবে। কবরে ঢুকার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হবে জীবনের হিসাব নিকাশ। কতটাকা খরচ হলো, কোথায় কী ঘটলো, নাজিয়ার বয়স বাড়ছে, ফাতেমার কোলে নতুন মেহমান আসছে, গলির কার সঙ্গে কার ঝগড়া হলো এইসব। রোজকার হিসাব মিলাতে মিলাতে ক্লান্ত হয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়বে সে।

নাজিয়াকে নিয়ে মোটামুটি রকমের একটা ঝগড়া বেঁধে গেছে গলিটাতে। ঝগড়ার কারণটা খুবই স্পর্শকাতর। নাজিয়াদের খুপরির দুই খুপরির পরের খুপরিতেই থাকে মতিনদের পরিবার। মতিনদের খুপরির সামনে দিয়েই পানি আনতে যেতে হয় কলপাড়ে। ফজরের সময় কলপাড়ে ভীড় একটু কম থাকে। প্রতিদিন এই সময় পানি আনতে যায় নাজিয়া। আজও যাচ্ছিল। আচমকা তার হাত ধরে টান দিয়ে খুপরির পাশে নিয়ে যায় মতিনের ছোট ছেলে জাকির। নাজিয়া চিৎকার করতে চায়। জাকির মুখ চেপে ধরে।
‘নাজিয়া, আমার কথা একটু শুন।’
‘তোর কী কথা শুনবো?’
‘আছে গুরুত্বপূর্ণ কথা।’
‘গুরুত্বপূর্ণ কথা দিনে বলা যাবে।’
‘না, এখনই বলতে হবে।’
‘ছাড় বলছি। নয়তো আমি চিৎকার দেবো।’
‘একমাস ধইরা তোকে দেখছি। তোরে আল্লা কী দিয়া বানাইছে বলতো।’
‘কেন, মাটি দিয়া।’
‘মিছা কথা। তোরে আল্লা স্পেশাল মাটি দিয়া বানাইছে। ফজরের এই অন্ধকারেও দেখ কেমন চকচক করতাছে।’
‘আমি চিৎকার দেব বললাম।’
‘আমি তোরে ভালোবাসমু। দে না একটু অনুমতি।’
জাকির চুমু খেতে যায় নাজিয়ার ঠোঁটে। ঠিক তখনি নাজিয়া চিৎকার দিয়ে উঠে। জাকির নাজিয়াকে ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। মেয়ের চিৎকার শুনে খুপরি থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসেন আছিয়া বেগম। তার সঙ্গে বেরিয়ে আসে অন্যান্য খুপরির মানুষেরাও। সবার চোখে ঔৎসুক্য। দাঁতের মাজন মুখে দিয়ে দাঁত ঘষতে ঘষতে বেরিয়ে আসে মতিন। আঙুলটা মুখে রেখেই জানতে চায়, ‘কী হইলো গো আলমের মা?’
আছিয়া বেগম ফোঁস করে উঠেন, ‘এখন আইছে জিগাইতে। তোমার পোলায় যখন মেয়ে মানষের গায়ে হাত দেয়, তখন কোথায় থাকো? বউয়ের আচলের তলে?’
মতিন তেড়ে আসে, ‘সাবধানে কথা কও বেটি। কার ছেলের কথা বলছো?’
‘কার আবার তোর বেটার কথা বলছি।’
‘আমার বেটা গেছে নামাজ পড়তে। তার ওপর অপবাদ দিবা না। এটা আমার বেটা।’
‘তোর ছেলের আজ বিচার হইবো। আমার মেয়ের গায়ে হাত দেয়ার বিচার।’

মতিন এবার হাত উঁচু করে মারতে আসে আছিয়া বেগমকে। তাকে থামিয়ে দেয় কাশেম। নয়তো যেভাবে তেড়ে যাচ্ছিল, আছিয়া বেগম মাটির সঙ্গে মিশে যেতেন। আলম ফজর নামাজ পড়তে গিয়েছিল। আসার পথে ভীড় দেখে বললো, ‘কী হইছে ওখানে?’
একজন বললো, তোর বোনের গায়ে হাত দিছে মতিনের ছোট ছেলে।
আলম দৌড়ে জটলা ভেঙে সামনে আসে। তাকিয়ে দেখে নাজিয়া এক কোণায় জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার সর্বাঙ্গে লজ্জার ছাপ লাল হয়ে আছে। পানির কলসিটা পাশে রাখা। নাজিয়াকে এমন জড়োসড়ো কখনও দেখেনি আলম। নাজিয়ার গায়ের রঙ শ্যামলা। সারাক্ষণ সে থাকে চঞ্চল টলমল।
আলম কর্কশ গলায় বললো, ‘মতিন মিঞা, ছেলেরে ডাকাও।’
মতিন বললো, ‘আমার ছেলে এমন করবে না। ছেলেকে অপবাদ দিয়ে শুধু শুধু কলঙ্ক ডেকে এনো না।’
‘কিসের কলঙ্কে কথা বলছো মতিন মিঞা?’
‘আমিও কিন্তু কাউকে ছেড়ে কথা বলবো  না।’
‘চোরের মায়ের বড় গলা।’
‘আমার ছেলেকে দোষ না দিয়ে তোমার বোনরে জিগাও কার সাথে ফস্টিনষ্টি করতে গেছে।’

দু পক্ষে তুমুল হাতাহাতি শুরু হয়ে গেলো। অবশেষে বিষয়টির সুরাহা করলেন ক্যাম্প প্রধান। কপালে প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে তিনি বললেন, ‘সকাল নাই, বিকাল নাই, রাত নাই, ভোর নাই। সারাক্ষণই ঝগড়া লেগে থাকেন আপনারা। বিষয়টাতো ঠিক না।’
আলম বললো, ‘সব বিষয়ের সঙ্গে এই বিষয়কে না মেলালে ভালো হয়।’
প্রধান বললেন, ‘তা ঠিক।’
মতিন বললো, ‘আমার ছেলে যে করছে, তার তো প্রমাণ নাই। আমার ছেলেরে তো কেউ দেখে নাই।’
প্রধান বললেন, ‘মেয়ে সত্য বলেছে। তার চোখ এবং শরীরের দিকে তাকায় দেখেন। কেমন মিইয়ে যাচ্ছে। সবসময় প্রমাণ দিয়ে বিচার হয় না। কিছু কিছু প্রমাণ মানুষের চোখে লেগে থাকে। বিশেষ করে নারীঘটিত বিষয়ে। এই তিন বছরে কম তো নারীঘটিত বিষয়ে বিচার করিনি।’
দুতিনটা চর-থাপ্পর এবং ক্ষমাপ্রার্থনার মধ্য দিয়ে বিচার শেষ হলো। প্রধান সতর্ক করে দিলেন, আবার যদি এমন হয়, পুলিশে দিবেন।

দুদিন আগে ফেসবুকে নতুন একটা পেজ খুলেছে রফিক। নাম ‘দ্য আর্ট গার্ডেন অফ রোহিঙ্গা’। কবিতা লেখার আগ্রহ থেকেই পেজটি খোলা। তবে এখানে কেবল কবিতাই দেয়া হবে না, রোহিঙ্গাদের দুঃখগুলো এখানে ফুটিয়ে তোলা হবে। তার সঙ্গে আরও কয়েকজন কবিতাপ্রেমী শরণার্থী কবি যুক্ত হয়েছে। পেজটিতে আজ কিছু লিখবে লিখবে করেও লেখা হয়ে উঠেনি। বোনের লাঞ্চনা দেখে নিজের কাছেই নিজে লজ্জা পাচ্ছে সে। সারাদিন সে কিছুতেই মন দিতে পারেনি। ক্লাসে দাঁড়িয়ে আনমনা হয়ে গেছে বারবার।
সন্ধ্যায় পেজের ইনবক্সে একটা কবিতা এলো। কবিতাটি লিখেছে হামিদুল্লাহ। হুবহু এই কবিতাটিই পেইজে পোস্ট করে দিলো রফিক।

আমি কি ধর্ষণের পণ্য?
ধর্ষিত হয়ে বেঁচে আছি
স্মৃতিতে কেবল ধর্ষণের উৎসব
বলে যাচ্ছি ধর্ষণের গল্প।
আমি কি ধর্ষণের পণ্য?
আমার ওপর চেপে বসেছে দৈত্যপুরুষ
ছিঁড়ে ফেলেছে স্কার্ট
কামড়ে খাচ্ছে উরু নিতম্ব
আমি কি ধর্ষণের পণ্য?
মুখ চেপে ধরেছে কুৎসিত হাত
তীব্র যন্ত্রণায় ছিন্ন করছে সতিত্ব
আমি শ্বাস নিতে পারছি না
দৈত্যপুরুষর ভারে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে  রক্ত চলাচল।
আমি কি ধর্ষণের পণ্য?

নাজিয়া ইদানিং খুব চুপচাপ হয়ে গেছে। তেমন কথা বলে না। বাইরে বেরুয় না। ঝিম মেরে পড়ে থাকে খুপরির ভেতর। সামনের খুপরিতেই থাকে তার সবসময়ের আড্ডার সঙ্গী বুশরা। দুদিন ধরে তার সঙ্গেও তেমন মন খুলে কথা বলছে না। বুশরা বলেছে, নাজিয়ার মন ভালো করার দায়িত্ব বুশরার। বুশরা নতুন একটা ক্লাবের সন্ধান পেয়েছে। ক্লাবে বুশরাকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। বুশরা নাজিয়াকে সঙ্গে নিয়ে যাবে।
নাজিয়া বললো, ‘কিসের ক্লাব?’
বুশরা বললো, ‘এনজিওদের।’
‘কাজটা কি ওখানে?’
‘ওখানে শরণার্থী কিশোর-কিশোরীদের বিভিন্ন কিছু শেখানো হয়। এই যেমন ধর কেমনে সতর্ক হয়ে চলবি, পিরিয়ডে কেমনে নিজের যত্ন নিবি, মন কেমনে ভালো করতে হয় ইত্যাদি। ওখানে গেলে আরও জানতে পারবো।’
‘আচ্ছা।’
‘ক্লাবের নাম ‘কিশোর-কিশোরী ক্লাব’। আমার খুব ইচ্ছা নাচ শিখব। ওখানে নাকি নাচও শেখানো হয়।’
নাজিয়ার চোখ কপালে, ‘তুই শিখবি  নাচ?’
‘ইচ্ছা।’
‘তোর মতলব খারাপ।’
নাজিয়ার গায়ে চিমটি কাটে বুশরা। নাজিয়াও পালটা চিমটি দিতে যায়। কিন্তু পারে না। বুশরা সরে যায়। নাজিয়া চিমটি দিতে না পেরে প্রতিশোধ নেয় অন্যভাবে। মুখ ভ্যাঙচিয়ে বলে, ‘আজ থেকে তোর নাম নর্তকী বুশরা। এই নর্তকী, একটু নাচ তো।’

ক্লাবে যাবে শুনেই খেক করে উঠেন আছিয়া বেগম। তিনি বলেন, বুশরা গেলেই তোকে যেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। মেয়েদের আবার কিসের ক্লাব? বুশরা তাকে বুঝাতে চেষ্টা করে আজ কেবল দেখতে যাবো। এনজিওর লোকেরা এসে বলে গেছে। এনজিওর কথা শুনে খানিকটা নরম হন আছিয়া বেগম। তার দুই ছেলে এনজিওর কল্যানেই চাকরি পেয়েছে। তবুও তিনি আশস্ত হতে পারলেন না। রফিককে ডেকে বললেন, ‘দেখ তো তারা নাকি ক্লাবে যাবে?’
রফিক জিজ্ঞেস করে বিস্তারিত। বুশরা গতকাল দিয়ে যাওয়া এনজিওকর্মীর কার্ডটা দেখায়। দেখেই সবকিছু বুঝে যায় রফিক। ইউনিসেফের একটি প্রকল্প চলমান আছে কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে। ক্লাবের মাধ্যমে তারা বাল্যবিয়ে, শিশুশ্রম ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে তাদেরকে সতর্ক করে। তাদের সেই প্রকল্পটি রোহিঙ্গা শিবিরেও চলছে।
রফিক তার মাকে বললো, ‘আমি যে এনজিওতে কাজ করি, সে এনজিওর ক্লাব। মা, তাদেরকে যেতে দাও। অনেক কিছু শিখতে পারবে।’
ছেলের কথায় মা অনুমতি দেন। বিস্তারিত ব্যাখ্যা দাবি করার সাহস তার হয় না।

রুটিন চেকাপের জন্য স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে এসেছে ফাতেমা। তার সঙ্গে এসেছে তার মা  এবং রফিক। কেন্দ্রে প্রচুর ভীড়। এখানে না এলে সে জানতেই পারতো না শরণার্থীরা এত রোগে ভুগছে। তবে সবচে বেশি রুগী ডায়রিয়া এবং ঠাণ্ডা-কাশির। যতক্ষণ সে কেন্দ্রে ছিল, একটা মিনিটও এমন যায়নি যে একটা কাশিও সে শুনেনি।
ফাতেমাকে টুকটাক চেকাপ করে ডাক্তার হেলেন  চাকমা বললেন, ‘একটা টিকা দিয়ে দেই।’
চমকে উঠে ফাতেমা, ‘টিকা নেব না।’
‘কেন?’
‘এমনিতেই।’
‘এমনিতেই কেউ না করে? তোমার পেটে সন্তান। টিকা দিচ্ছি যেন ক্যাম্পে ছড়িয়ে পড়া রোগ জীবাণু থেকে মুক্ত থাকতে পারো। এই সময়ে টিকা নেয়াটা খব জরুরী।’
‘টিকা ছাড়াই চলবে আমার।’
‘চলবে না।’
‘আপনারা কি আমার বাচ্চাকে মেরে ফেলতে চান?’
হেলেন চাকমা  মুচকি হাসলেন। তিনি ফাতেমার টিকা না নেয়ার কারণটা ধরতে পারছেন। অধিকাংশ রোহিঙ্গা নারীরা মনে করে, টিকা নিলে তারা আর মা হতে পারবে না। গর্ভের সন্তান মারা যাবে। টিকা নিলে মুসলিম শিশুরা খৃস্টান হয়ে যাবে। মিয়ানমারে দীর্ঘদিন যাবৎ তারা শিক্ষাবঞ্চিত থাকায় তাদের ভেতর বটগাছের শেকড়ের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কুসংস্কার। একটা জাতির উত্থান  থামিয়ে দেবার জন্য তাদের শিক্ষার অধিকার কেড়ে নেয়াই যথেষ্ট। শুধু শিক্ষার আলো নিভিয়ে দিলেই হয়। সমাজ তলিয়ে যায় বহুবিধ অন্ধকারে। কুসংস্কারের অন্ধকার সবচে গাঢ় অন্ধকার।

হেলেন চাকমা ফাতেমাকে একটু একটু করে বুঝালেন। প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে এসব বুঝাতে হয়। তাদের উৎসাহিত করতে হয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশের নারীরা দলবেঁধে টিকা দিতে যায়। টিকা দিতে যাওয়ার দৃশ্য দেখে মনে হয়, তারা কোনো উৎসবে যাচ্ছে। কই তারা তো মা হতে পারছে। তাদের সন্তান সুস্থ থাকছে। ফাতেমা চুপ করে থাকে। হেলেন চাকমা উঠে তাকে একটা টিকা দিয়ে দেন। ফাতেমা বাধা দেয় না, প্রতিবাদও করে না। চোখ বন্ধ করে মনে মনে পড়তে থাকে-আসতাগফিরুল্লাহ, আসতাগফিরুল্লাহ।

হেলেন চাকমা ফাতেমাকে দেখা করিয়ে দেন নুরি বেগমের সঙ্গে। তিনিও একজন রোহিঙ্গা নারী। পঞ্চাশ বছর বয়সী এই নারীকে বলা হয় মডেল মাদার বা আদর্শ মা। তিনি সন্তানসম্ভবা রোহিঙ্গা নারীদের ঘরে গিয়ে গিয়ে তাদের স্বাস্থ্যটিপস দেন। রোহিঙ্গা শিবিরে তার মতো এমন মডেল মা রয়েছেন ২৪০ জন। তাদের প্রধান কাজ রোহিঙ্গা নারীদের ঘরে গিয়ে গিয়ে সঠিক তথ্য সরবরাহ করা। এই প্রকল্পটিও ইউনিসেফের।
নুরি বেগম বলেন, ‘ঠিকানা আর ফোন নাম্বার দিয়ে যাও। সপ্তাহে একবার গিয়ে তোমাকে দেখে আসবো।’

নতুন একটা মসজিদ এবং মকতব উদ্বোধন করা হবে আজ। উদ্বোধন উপলক্ষে খিচুরির ব্যবস্থা করা হয়েছে। লেটকা খিচুরি। এই খিচুরি নলা করে খাওয়া যায় না। দুধের মতো চুমুক দিয়েও খাওয়া যায় না। খেতে হয় ফিরনির মতো আঙুল দিয়ে। এখানে আঙুলের কাজ বেশি। আঙুল দিয়ে যে যত সুন্দর করে খিচুরি মুখে তুলতে পারবে, সে তত বেশি স্বাদ পাবে। দাঁতের কাজ খুবই নগণ্য। যেহেতু ছোট-বড়, জোয়ান-বৃদ্ধ সবাই খাবে, তাই এই খিচুরির আয়োজন। আলম এবং রফিকও এসেছে। সকাল সাতটা থেকে উদ্বোধন কার্যক্রম শুরু। ফজর নামাজ পড়ে তারা দুজন আর বাড়ি যায়নি।

শুভ্রদাড়ির একজন মাওলানা মসজিদ প্রাঙ্গনে সবার মধ্যমণি হয়ে বসে আছেন। তার পাশে বসে আছেন নুরুল হক। তিনি আগে বুুদিচং জামে মসজিদের ইমাম ছিলেন। আলমরা তার পেছনে সেই ছোট থেকে নামাজ পড়ে আসছে। এখনও তার পেছনেই পড়তে পারবে। নতুন যে মসজিদটি হতে যাচ্ছে, সেখানে ইমাম হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন তিনি।

শুভ্রদাড়ির মাওলানার নামটা জানা গেছে। তার নাম ওমর সুলাইমান। তার বাড়ি টুঙ্গিপাড়া উপজেলার গওহরডাঙা গ্রামে। মসজিদ উদ্বোধনের কাজ শুরু করলেন তিনি। মসজিদ ঘরের জন্য তিনি শাবল দিয়ে প্রথম কোপ দিলেন। দ্বিতীয় কোপ দিলেন নুরুল হক। তারপর গর্ত খুড়ে একটা বাঁশের পাল্লা বসিয়ে দেয়া হলো। পাল্লার মাথায় টানিয়ে দেয়া হলো একটা সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ডে লেখা–আল্লামা শামসুল হক রহঃ (সদর সাহেব) জামে মসজিদ-১। নির্মাণে: কওমি  মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড, গওহরডাঙা বাংলাদেশ। স্থাপিত: ১.১০.২০১৭ ইংরেজী।

মসজিদের পাশেই একটি মকতবের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হলো। সেখানেও টাঙানো হলো একটি সাইনবোর্ড। তাতে লেখা–খাদেমুল ইসলাম ফুরকানিয়া মকতব। নির্মাণে: কওমি  মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড, গওহরডাঙা বাংলাদেশ। স্থাপিত: ১.১০.২০১৭ ইংরেজী।

উদ্বোধন শেষ হলে খাবার আগে সংক্ষিপ্ত একটি বয়ান পেশ করলেন মাওলানা ওমর সুলাইমান। বয়ানের পুরো অংশটুকুই যার নামে মসজিদ করা, তার পরিচয় নিয়ে।

আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. সদর সাহেব নামে পরিচিত। তিনি একজন বাংলাদেশি ইসলামি চিন্তাবিদ, প্রখ্যাত আলেম, সমাজ-সংস্কারক ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সিপাহসালার মাওলানা হোসাইন আহমদ রহ. এর বিশেষ শাগরেদ। বড় কাটারা মাদরাসা, ফরিদাবাদ মাদরাসা, লালবাগ মাদরাসা, গওহরডাঙা মাদরাসা সহ বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী কয়েকটি মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা তিনি।

সদর সাহেব মাদরাসার পাশাপাশি চালু করেন মসজিদকেন্দ্রিক কোরআনি মক্তব। মক্তবে যুক্ত করেন প্রাইমারি সিলেবাস। যেন মানুষ মক্তব শিক্ষার সঙ্গে সন্তানদের সাধারণ শিক্ষাও দিতে পারে। এজন্য তিনি তার শাগরেদ মাওলানা কারী বেলায়েত সাহেবের মাধ্যমে চালু করেন ‘নুরানি প্রাইমেরি’ শিক্ষা। আরেক শাগরেদ  মাওলানা আবদুল ওহহাবের মাধ্যমে চালু করেন ‘নাদিয়াতুল কুরআন’ নামে ভিন্নধর্মী এক মক্তব প্রশিক্ষণ। সকাল হলে বাংলাদেশের পথে পথে অদ্ভুত সুন্দর এক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। ফেরেশতার মতো ছোট ছোট শিশুরা নাদিয়াতুল কুরআনের কায়দা বুকে নিযে মক্তবে যায়। তাদের মাথায় থাকে টুপি, হিজাব। রেহালের সঙ্গে মিশে থাকে থরো থারো শ্রদ্ধা।

পাকিস্তান আমলে এদেশে খৃস্ট ধর্ম প্রচার করতে আসে পাদ্রী পায়ার। মানুষের নৈতিক ও অর্থনৈতিক দুর্বলতার সুযোগে সে তাদের ধর্মান্তরিত করার প্রয়াস চালায়। আইয়ুব সরকার তাকে সাহায্য করে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন সদর সাহেব। প্রতিষ্ঠা করেন আঞ্জুমানে তাবলিগুল কুরআন। আঞ্জুমানের প্রচার সম্পাদক ছিলেন মাওলানা ফজলুর রহমান। সদর সাহেব পাদ্রী পায়ারের বিরুদ্ধে মাওলানা ফজলুর রহমানকে পাঠান। মাত্র কয়েকদিনে তিনি পাদ্রীকে দেশছাড়া করেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মীয় সূত্রে দাদা ছিলেন সদর সাহেব হুজুর। তিনি যখন লালবাগ মাদরাসার মুহতামিম, তখন শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রাজনীতিতে তরুণ নেতা। তিনি ছিলেন সদর সাহেব হুজুরের একান্ত ভক্ত। সপ্তাহে কয়েকবার দাদাকে দেখতে লালবাগে যেতেন। ফলে তৎকালিন সদর সাহেবের সমসাময়িক অনেক আলেমকে তিনি দাদাজি বলে সম্বোধন করতেন। তাদের সাথে তাঁর সুগভীর এক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।

সদর সাহেব হুজুর সব সময় পাঞ্জাবির উপরে কালো কোট পড়তেন। একদিন লালবাগে হুজুরের কামড়ায় বসে শেখ মুজিবুর রহমান বসা। মুজিব বললেন, ‘দাদা আপনার কোট আমার খুব ভাল লাগে।’
সদর সাহেব হুজুর বললেন, ‘পড়তে চাও নাকি?’
মুজিব হেসে বললেন, ‘দাদার কোট নাতি পড়লে কি সুন্দর দেখাবে?’
সদর সাহেব হুজুর বললেন, ‘দাদার কোটে তো নাতিদেরই সুন্দর দেখাবে।’
মুজিবের ঠোঁটে হাসিটা বিস্তৃত হয়। সদর সাহেব হুজুর কোটটা গা থেকে খুলে বাড়িয়ে দিলেন মুজিবের দিকে।
‘সত্যি পরতে বললেন?’
‘হুম। গায়ে দাওতো দেখি, তোমাকে কেমন লাগে।’
মুজিব কোটটা গায়ে দিলেন। সদর সাহেব হুজুর বললেন, ‘দারুণ লাগছে তো।’
মুজিব বললেন, ‘সত্যি?’
সদর সাহেব হুজুর বললেন, ‘ এখন মনে হচ্ছে তোমাকে সত্যকারের জাতীয় নেতা।’
মুজিব বললেন, ‘তাহলে তো কোটটা নিয়ে যেতে হয়।’
সদর সাহেব হুজুর বললেন, ‘ ঠিক আছে কোটটা তোমাকে দিয়ে দিলাম। তুমি সব সময় এটা পড়ে মিটিং মিছিলে যাবে।’

আমৃত্যু এই কালো কোট ছিল মুজিবের নিত্য সঙ্গী। কোটটির নাম হওয়ার কথা ছিল সদর কোট। তা না হয়ে হয়েছে মুজিব কোট।

আজকের দৈনিকের প্রথম পাতায় পাশাপাশি দুটি খবর ছাপা হয়েছে। বারবার খবর দুটিতে চোখ বুলাচ্ছেন নুরুল আবছার। দুটোই দুঃসংবাদ। নুরুল আবছার বললেন, ‘কোন সংবাদটা আগে শুনবে আলম?’
আলম বললো, ‘আপনি যেটা শুনাবেন।’
নুরুল আবছার বললেন, ‘প্রথম সংবাদ মিয়ানমারের। তোমাদের মংডু শহরে একটা গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। মিয়ানমার সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইয়ের সূত্রে খবরটি ছাপা হয়েছে।’
‘গণকবরে কয়টা লাশ পাওয়া গেছে?’
‘সেটা বলা হয়নি খবরে। সেনাপ্রধান বলেছেন, এর সঙ্গে যদি সেনাবাহিনীর কারো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়, তাদের বিচার করা হবে।’
আলম শব্দ করে হেসে ফেললো। হাসি দিয়ে মনে হলো হাসি দেয়াটা তার ঠিক হয়নি। শত হোক সামনে স্যার বসা। সঙ্গে সঙ্গে সে ক্ষমাপ্রার্থনা করলো, ‘দুঃখিত স্যার।’
‘হাসলে কেন?’
‘সেনাপ্রধানের বিচারের কথা শুনে। ভূতের মুখে রাম রাম শুনা আর মিয়ানমার সেনাপ্রধানের মুখে রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচারের কথা শুনা একই কথা।’
‘কথাটা মন্দ বলো নাই।’
আলম বললো, ‘দ্বিতীয় সংবাদ কী?’
নুরুল আবছার বললেন, ‘দ্বিতীয় সংবাদ প্রথমটার চেয়ে একটু কম মারাত্মক। ‘আমরা কক্সবাজারবাসী’ নামের একটা সংগঠন গতকাল মানববন্ধন করেছে। তারা দাবি জানিয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এনজিওগুলোতে যেন তাদেরকে নিয়োগ দেয়া হয়।’
কপাল কুঁচকে আলম বললো, ‘তাহলে?’
‘চিন্তার কোনো কারণ নেই আলম। এমন কত মানববন্ধন হয়। যারা কিছু করতে পারে না, তারা মানববন্ধন করে। মানববন্ধন দেখেই বুঝা যায় মানুষ হয়েছে গুটিকয়েক। কিন্তু এখানে লিখেছে শত শত মানুষ জমা হয়েছে। মিথ্যা, সব মিথ্যা।’
আলমের মন খারাপ হয়ে যায়। ভেতরে ভেতরে সে লজ্জা অনুভব করে। নিজের মাতৃভূমি মিয়ানমারে চাকরির অধিকার হারিয়েও এত লজ্জা লাগেনি তার। তার মনে হতে থাকে, তারা এই দেশে না এলে এই মানববন্ধনটা হতো না। রোহিঙ্গারা তাদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিচ্ছে এই অপমানও শুনতে হতো না।
নুরুল আবছার বললেন, ‘আসো তোমাকে একটা টেকনিক শেখাই।’
‘কী টেকনিক?’
‘ছবি দেখে মানুষের উপস্থিতি অনুমান করার টেকনিক।’
আলম টেবিলে রাখা দৈনিকের পাতায় ঝুঁকলো।
‘কী দেখতেছো?’
‘মানববন্ধনে একটা ব্যানার ধরে আটজন মানুষ দাঁড়ানো।’
‘ছবিটা খুব কাছ থেকে তোলা হইছে। এজন্য দেখো ফ্রেমে কেবল আটজনই জায়গা পেয়েছে। আশপাশের একটা দৃশ্যও ছবিতে নাই। এটাই প্রমাণ লোক কম হইছে। বড় মানবন্ধন হইলে ছবিটা তুলতো দূর থেকে। ফটোগ্রাফারের চেষ্টা থাকতো যতবেশি মানুষ ফ্রেমে জায়গা দেয়া যায়।’
আলম পড়ালেখা জানে না। নিউজ না পড়তে পারলেও এখন থেকে এই টেকনিক ব্যবহার করে সে মানববন্ধনের খবর বুঝার চেষ্টা করবে। মানুষ কম, প্রতিবাদের মাত্রাও কম। মানুষ বেশি, প্রতিবাদের মাত্রাও বেশি।

নুরুল আবছারের সঙ্গে কুতুপালং ক্যাম্পের বি ব্লকে এসেছে আলম। ওখানে নাকি কি একটা কাজ আছে। কিন্তু এখানে এসেও আলম বুঝতে পারছে না কী সেই কাজ। তবে এখানের প্রায় সবাই নুরুল আবছারকে চেনে। তাকে শ্রদ্ধা করে। তার সঙ্গে আসায় আলম খানিকটা শ্রদ্ধা অনুভব করছে। মাঠে খিচুরি রান্না হচ্ছে। ভুনা খিচুরি। খিচুরির ঘ্রাণটা আর কিছুক্ষণ শুঁকলে জিভে জল চলে আসবে।
নুরুল আবছার বললেন, ‘খিচুরি খাবা আলম?’
আলম ইতস্তত করে বললো, ‘ঘ্রাণটা দারুণ।’
‘তার মানে খাবা। আচ্ছা, ব্যবস্থা হবে।’
‘খিচুরি কেন রান্না হচ্ছে? কোনো অনুষ্ঠান?’
‘না। এগুলো ক্যাম্পের বিভিন্ন স্কুলে বিতরণ করা হবে। প্রতি রোববারে এমন খিচুরি রান্না হয়।’
‘বাহ!’
‘এখন থেকে প্রতি রোববারে এখানে নিয়ে আসবো তোমাকে। পেটপুরে খিচুরি খাবা। খিচুরির প্রতি তোমার বিশেষ দুর্বলতা আছে।’
আলম কিছু বলে না। নুরুল আবছারের পেছনে পেছনে একটা বিল্ডিংয়ে এসে ঢুকে। টিনশেড বিল্ডিং। রুমের দেয়ালে খৃস্টধর্ম প্রবক্তা যিশুর ছবি এবং খৃস্টানদের নিশান ক্রুশের ছবি আঁকা। ছোট্ট সাউন্ডবক্সে বাজছে ধীরলয়ের একটি মিউজিক। চারপাশে অদ্ভুত নীরবতা, যিশুর ছবির সামনে রাখা কাঁচা গোলাপের সৌরভ।
‘স্যার, এটা চার্চ?’
‘না। এটা উপাসনালয়। মানুষ মনের প্রশান্তির জন্য এখানে আসে।’
‘আপনিও কি প্রশান্তির জন্য এখানে আসেন?’
‘হুম। যখন হাঁপিয়ে যাই এখানে আসি। মন ভালো হয়ে যায়।’
‘আমার মন খারাপ হলে পাহাড়ের ওপর গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। এক একা।’
‘একা একা দাঁড়িয়ে থাকবে না আর । একা একা থাকলে মন আরও খারাপ হয়। এখানে আসবে, সবার সঙ্গে কথা বলবে। মানুষের কাজকর্ম দেখবে।’

আলম ভাবে এখানে আর সে কখনোই আসবে না। খৃস্টানদের এখানে সে কী করবে। সে মুসলমান। এখানের খিচুরিও খাবে না। যতই মজা হোক। আর তার ক্যাম্প থেকে এই ক্যাম্প অনেক দূরে। এতদূরে আসার সময় নেই তার । কিন্তু নুরুল আলম সঙ্গে নিয়ে এলে তাকে আসতে হবে। এটা তার ডিউটি। না এলে চাকরি নট হয়ে যেতে পারে।

উপাসনালয়ের পাদ্রীর সামনে বসে আছে নুরুল অবছার এবং আলম। পাদ্রীর মুখ হাসি হাসি। মনে হয় তার জীবনে কোনো দুঃখ নেই। পাদ্রী বললেন, ‘আবছার সাহেবের মেহমানের নাম কী?’
নুরুল আবছার বললেন, ‘তার নাম আলম। তার হাতের চা দারুণ। মিয়ানমারে চায়ের দোকান দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে এখানে চলে আসতে  হলো। আমার অফিসে ছোট একটা কাজ দিয়েছি তাকে।’
পাদ্রী বললেন, ‘মেহমানকে আমাদের সুন্দর জগতে স্বাগতম।’
আলম বললো, ‘ধন্যবাদ।’
পাদ্রী বললেন, ‘দেশ কোনো বড় কথা না। বড় কথা হচ্ছে তোমার ভাগ্য উন্নত করার জন্য তুমি কী করছো। তোমার সামনে আসা সুযোগগুলো তুমি কাজে লাগচ্ছো কিনা।’
আলম বললো, ‘রোহিঙ্গাদের আবার ভাগ্য!’
পাদ্রী মুচকি হাসলেন, ‘আমাদের এখানে যারা প্রথম আসে, তাদের জন্য আমাদের এনজিওর পক্ষ থেতে কিছু উপহার আছে।’
পাদ্রী একটা প্যাকেট এগিয়ে দিলেন আলমের দিকে। প্যাকেট খুলে দেখালেন নুরুল আবছার। এখানে কয়েকটি বই। কিতাবুল মুকাদ্দাস, তৌরাত শরীফ, ইঞ্জিল শরীফ, নবিদের কিতাব ইত্যাদি।
আলম বললো, ‘আমি পড়তে পারি না।’
পাদ্রী বললেন, ‘পরিবারে কেউ পড়তে পারে না?’
‘পারে। আমার ছোট ভাই।’
‘তাকে বলবে পরিবারের সবাইকে পড়ে শুনাতে।’
‘জ্বি।’
‘আমাদের এনজিওর একটা ফরম আছে। এটা পূরণ করে দিয়ে যাও। তোমার সুবিধা অসুবিধায় আমরা পাশে থাকবো।’

নুরুল আবসার ফরমটা পূরণ করে দিলেন। ফরমে পূরণ করা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আগামী রোববার এসে তাকে এখানে দেখা করে যেতে হবে।

আলম নির্দিষ্ট একটা মুদিদোকান থেকেই সব সদাই কিনে। দোকান মালিকের নাম তাজু ফকির। এ ক্যাম্পের সবার পরিচিত দোকানি। কারো থেকে একটাকা বেশি নেয় না। পারলে এক টাকা কম নেয়। এক দোকান থেকে সবসময় জিনিস কেনার কারণে দোকানদারের সঙ্গে আলমের পরিচয় হয়ে গেছে। টাকা না থাকলেও বাকিতে সদাই আনতে পারে। সন্ধ্যায় কী একটা সদাই আনতে গিয়ে দেখে তাজু ফকির মোবাইলে একটা মিউজিক বাজিয়ে রেখেছে। এই মিউজিকটা সে খৃস্টানদের উপাসনালয়ে শুনেছে।
‘কী শুনছো তাজু ভাই?’
‘সুন্দর একটা সঙ্গীত। শুনবা  নাকি? পয়লা থেকে দিব?’
‘দাও। পয়লা থেকেই দাও।’
সঙ্গীত শুনতে শুনতে সদাই নেয়া হয়ে যায়। আলম বলে, ‘এটা আমার মোবাইলে দিতে পারবা?’
‘হুম। শুধু এটা না। আরও কিছু দিয়ে দিচ্ছি। একা একা শুনবা। না বুঝলে আমারে জিগাইবা।’
আলমের হাতে বাটন মোবাইল। এতে একটা আট জিবি মেমোরি আছে। তাজু ফকির অনেক্ষণ সময় ব্যয় করে এক জিবি পূর্ণ করে দিলো। আলম খুপরিতে না গিয়ে সোজা পাহাড়ে গিয়ে উঠলো। সন্ধ্যার শীতল বাতাস বইছে। ক্যাম্পগুলোতে জ্বলে উঠেছে সৌর বিদ্যুতের আলো। এই একটা জায়গা তার সবচে আপন মনে হয়। এখানে আসে সে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলতে। মাঝেমাঝে নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলতে হয়। বোঝাপড়া করতে হয়।

আজ অবশ্য নিজের সঙ্গে কথা বলার কিছু নেই। সে তাজু ফকিরের দেয়া সঙ্গীত শুনবে। আলোচনা শুনবে। বুকের ভেতর বইবে সুখের সমীরণ। সেই নির্জন সন্ধ্যায় একাকী পাহাড়ে সঙ্গীত শুনতে শুনতে আলমের তন্দ্রা এসে গেলো। আধো ঘুম আধো জাগরণে সে দেখলো তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে জাফর কাওয়াল। একসময় যিনি কাওয়ালি গেয়ে রোহিঙ্গাদের দুঃখ-দুর্দশা ফুটিয়ে তুলতেন। বার্মিজ সরকারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের পক্ষে সর্বপ্রথমত বিদ্রোহ করেছিলেন তিনিই। তাকে দেখে আলম উঠে বসলো।
জাফর কাওয়াল বললেন, ‘কী শুনছো?’
ইতস্তত করে আলম বললো, ‘সঙ্গীত।’
‘মুসলিম হয়ে খৃস্টানদের সঙ্গীত শুনছো?’
‘এটা খৃস্টানদের সঙ্গীত?’
‘হুম।’
‘তাহলে আর শুনবো না।’
‘তুমি খৃস্টান উপাসনালয়ে আর যাবে না।’
‘কেন?’
‘মুসলমানদের প্রধান শক্তি ঈমান। অর্থের লোভ দেখিয়ে, রঙিন স্বপ্নের মোহে আসক্ত করে খৃস্টান মিশনারীরা তোমাদের খৃস্টান বানাতে চায়। ঈমান চলে গেলে আর কখনো তোমরা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। নিজেদের মাতৃভূমি ফিরে পাওয়া তো দূরের কথা।’
‘ওখানে না গেলে যদি চাকরি নট হয়ে যায়?’
‘হতে পারে , আবার না-ও হতে পারে। কিন্তু তোমার এই ভয়টাকে পুজি করেই তারা তোমাকে ফাঁদে ফেলবে। যেমন আর সকল রোহিঙ্গাদের ফাঁদে ফেলছে।’
‘আমি ফাঁদে পড়বো না। ইনশাআল্লাহ।’
‘তোমার ওপর তোমার ভরসা আছে?’
‘জানি না।’
‘তুমি একটা ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছো। অর্থচিন্তা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, সাংসারিক বিষয় নিয়ে তুমি অস্থিরতায় আছো।’
‘অস্থিরতা কমাবো কী করে?’
‘মাতৃভূমিতে ফিরে যাওয়া ছাড়া এই অস্থিরতা কমবে না। শরণার্থী জীবন অথৈ সমুদ্রের মতো। কখন  ঢেউ উঠবে, কখন ঘূর্ণিঝড় উঠবে কেউ বলতে পারবে না।’
‘তাহলে?’ ভ্রু বাঁকালো আলম।
‘মাতৃভূমিতে ফিরে যাবার জন্য কাজ করতে হবে। কারো সঙ্গে আপোষ করা যাবে না। মুসলমানদের বিরুদ্ধে সবাই এক। চাই সে বৌদ্ধ হোক, খৃস্টান হোক, ইহুদি হোক। বার্মায় মুসলিমদের সর্বপ্রথম ‘বহিরাগত’ বলে অভিহিত করেছিল ব্রিটিশরা। বার্মার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের স্লোগান ছিল ‘বার্মা বর্মীদের জন্য’। কিন্তু ব্রিটিশরা  প্রচার করে বার্মা বৌদ্ধদের জন্য।’

জাফর কাওয়াল আলমের মাথায় হাত রাখেন। আলম শীতল একটা স্পর্শ অনুভব করে। খুব শীতল। তার ইচ্ছে হয় এই শীতল হাত তার মাথায় থাকুক মৃত্যু অব্দি। কতদিন সে এমন একটা স্পর্শ পায় না। সর্বশেষ তার মাথায় এম শীতল স্পর্শমাখা হাত রেখেছিল তার বাবা।
আলম বললো, ‘আমার সঙ্গে একটু কোলাকুলি করবেন?’
জাফর কাওয়াল বললেন, ‘আসো।’
আলম বুকে একটা চাপ  অনুভব করে। এই চাপে তার চোখ খুলে যায়। সে কি এতক্ষণ স্বপ্নে ছিল নাকি বাস্তবে? কেমন বিভ্রমের মতো মনে হয় তার। স্বপ্ন আর বাস্তব গুলিয়ে যেতে থাকে। দিকশূন্য লাগে সবকিছু। জীবনের জটিল এক আবর্তে তার নৌকাটা দুলছে। সে পাড় খুঁজে পাচ্ছে না। রাত বিদীর্ণ করে তার চিৎকার করতে ইচ্ছে করে।

খুপরিতে এসে রাতের খাবার না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে আলম।

 

যতদিন এগুচ্ছে, ফাতেমার অস্বস্তি বাড়ছে। এতটুকু খুপড়িতে তার দমবন্ধ হয়ে আসে। নাজিয়া ইউনিসেফের ক্লাবে যায়, মা গলিতে জুটিয়ে নিয়েছে গল্প করার সঙ্গী, রফিক স্কুলে যায়, আলম কাজে যায়। সবাই বাইরে যায়, কিন্তু বাইরে যাওয়া নিষেধ কেবল তার জন্য। সেই যে কবে কেন্দ্রে চেকাপ করতে গেছে,  তার পর আর তেমন বাইরে যাওয়া হয়নি। প্রথম মাসের বেতন দিয়ে ফাতেমার জন্য একটা চার্জার ফ্যান কিনে এনেছে রফিক। নয়তো অবস্থা আরও খারাপ  হয়ে যেতো।
ইদানিং ফাতেমা একাকী সময় কাটায় হামিদুলের সঙ্গে কথা বলে। কথাটা হয় মনে মনে। খুপরির আলো আধারিতে।
ফাতেমা বলে, ‘মাঝে মাঝে মনে হয় তুমি বাইচা নাই।’
হামিদুল বলে, ‘কেন এমন মনে হয়?’
‘জানি না। কিন্তু বড্ড কষ্ট হয়। বুকে সবসময় ব্যথা করে।’
‘আমার কষ্ট হয় না?’
‘সেটা আমি কি করে বলবো?’ ফাতেমা মুচকি হাসে।
‘বলতে পারা উচিত।’
‘কেন? একজন মানুষ আরেকজন মানুষের বুকের গোপন ব্যথা জানতে পারে?’
‘পারে তো।’
‘কখন?’
‘মানুষ যখন ভালোবাসে, ভালোবাসার মানুষের শুধু বুকের গোপন কথা না, পাঁজরের হাড্ডির ভেতরের কথাও জানতে পারে। তখন সবকিছু বলে দিতে হয় না। ভালোবাসার শক্তিতে আবিষ্কার করে নিতে হয়। সৃষ্টিকর্তা ওপরে বসে এই আবিষ্কার আবিষ্কার খেলা দেখেন আর হাসেন। তাদের দুজনের মাঝে আবিষ্কারের নেশা আরও বাড়িয়ে দেন।’
ফাতেমা মুখ ভ্যাঙচায়, ‘এই খেলা তো তোমাকে একদিনও খেলতে দেখিনি।’
আলম ফাতেমাকে ছুঁয়ে দেয় আলতো করে, ‘এখানে জেলের ভেতরে একটাই কাজ আমার । তোমাকে নিয়ে ভাবা। প্রতিনিয়ত তোমাকে আবিষ্কার করা।’

তারপর ফাতেমা হামিদুলের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। পলক পড়ে না। বরং সে ইচ্ছে করেই পলক ফেলে না। তার মনে  হয় পলক ফেললেই যদি হামিদুল চলে যায়। পলক ফেলে সে নিঃসঙ্গতা ডেকে আনতে চায় না।
হামিদুল বলে, ‘আমাদের সন্তানের নাম কী রাখবা?’
ফাতেমা বলে, ‘তুমি যা বলবা তাই।’
‘তোমার ইচ্ছা কী?’
‘আমার ইচ্ছাকে তোমার বুকের ভেতর দাফন দিছি। এখন তোমার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা। তোমার সন্তান, তোমার দায়িত্ব আছে না? জেলের ভেতর তো কাজ নাই। বইসা বইসা সুন্দর সুন্দর নাম ভাববা।’
‘আচ্ছা। নাজিয়ার কি খবর?
‘নাজিয়া ভালো আছে।’
‘নাজিয়ার বিয়ের বয়স হইসে। কিছু ভাবছো?’
‘তোমর এসব ভাবতে হবে না। এসব ভাবনা এখন নিষিদ্ধ। আগামি একমাস কেবল তুমি তোমার সন্তানের নাম ভাববা। আমি যখন কথা বলতে চাই , সঙ্গে কথা বলবা। অজুহাত দিবা না।’
হামিদুল ফাতেমার হাত একটু চেপে ধরে বলে, ‘খুব নিঃসঙ্গ লাগে?’
‘হুম। সবার মাঝে থেকেও নিঃসঙ্গ লাগে। এই নিঃসঙ্গতার কথা কাউকে বলা যায় না। বুঝানো যায় না। মাঝে মাঝে মনে হয় চিৎকার করি।’
‘কদিন পর আর নিঃসঙ্গ লাগবে না।  তখন তোমার কোলজুড়ে থাকবে আমাদের ফুটফুটে সন্তান। তখন তো আমি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়বো। তুমি ব্যস্ত থাকবা।’
ফাতেমা বললো, ‘তুমি নামক যে নিঃসঙ্গতার অসুখ আমার  হয়েছে, তা কখনও সারবে না। তুমি কাছে এলেই কেবল সারতে পারে।’

নাজিয়া খুপরিতে ঢুকে বললো, ‘আপা, তুমি কার সঙ্গে কথা বলছো?’
ঝট করে নিজেকে সামলে নিয়ে ফাতেমা বললো, ‘কারো সঙ্গে না। কেমন গেলো দিন তোর?’
‘খুব ভালো। নুরি বেগম আসছিলো?’
‘হুম। দুপুরে আসছিলো।’
‘কী বললো?’
‘এমনিতেই কথা বললো, গল্প করলো।’
খোপা থেকে ভ্যানটা খুলতে খুলতে নাজিয়া বললো, ‘আরেকবার চেকাপ করাতে যাবা?’
ফাতেমা বললো, ‘নুরি বেগম বললেন ওসবের দরকার নেই। দুদিন পর পর তিনি আসবেন।’
নাজিয়া বললো, ‘এই এক নুরি বেগম পারেনও বটে। একদম মাদার তেরেসা।’

একটি বিষয়ে নাজিয়া সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে  অনেকদিক ভাবতে হচ্ছে। নাজিয়া নিজেও আশ্চর্য হয়ে গেছে এতদিকের ভাবনা তো তার কখনো হয়নি! তাহলে সে কি বড় হয়ে যাচ্ছে? বেশি ভাবা বড় হওয়ার লক্ষণ। মানুষ যখন বড় হয়, তার ভাবনার পরিধি বড় হয়, দৃষ্টির পরিসীমা  বিস্তৃত হয়। তখন নিজের সিদ্ধান্ত কেবল নিজেকে ঘিরে আবর্তিত হয় না। চারপাশের আরও অনেক কিছু তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।

নাজিয়ার চিন্তার কারণ হচ্ছে আরিয়ান। প্রথম যেদিন ক্লাবে যায়, সেদিনই তার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময়। পরে দৃষ্টির বাইরে বাক্য বিনিময় হয়েছে। আরিয়ান কক্সবাজারের স্থায়ী বাসিন্দা। তিনমাস আগে এই ‘কিশোর-কিশোরী ক্লাবে’ চাকরি নিয়েছে। আরিয়ান তার মতো শ্যামলা একটা উদ্বাস্তু মেয়ের প্রতি কেন দুর্বল, তার কারণ অস্পষ্ট।
আরিয়ান সরাসরি তাকে প্রপোজ করে ফেলেছে। নাজিয়া কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। বুশরা পাশে বসে মিটিমিটি হাসছে। নাজিয়া বিরক্ত হয়ে বললো, ‘বোকার মতো হাসছিস কেন?’
বুশরা বললো, ‘বোকা তো আমি না, বোকা তুই।’
‘আমি কেন বোকা?’
‘প্রপোজ তো অনেকেই করবে। বাজারে যতদিন ফুল আছে, ততদিন সবাই তোকে প্রপোজ করবেই।  সবাইকে নিয়ে তাই বলে চিন্তা করতে হবে?’
‘হুম।’
‘হুম কি? তুই আবার তার প্রতি দুর্বল নাকি?’
‘আমি কেন দুর্বল হতে যাব?’
‘দুর্বল না হলেই ভালো। প্রিয়তম মানুষটার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। প্রিয়তম মানুষটা যখন  আসবে, তখন এত চিন্তা করতেও ইচ্ছে করবে না। এত বেশি চিন্তা করার মানেই হলো এখনো সময় আসেনি।’
‘তাহলে?’
‘তুই না করে দে। আমরা হলাম জলে ভাসা পদ্মের মতো। ভূমি নাই, শরণার্থী। বিলাসিরা আমাদেরকে মাড়িয়ে যেতে চায়। আরিয়ান তো সামান্য এক কর্মকর্তা।’
‘যদি কোনো সমস্যা করে?’
‘এখানে সমস্যা করা এত সোজা না। বিচার গেলেই চাকরি নট। আর কনসালটেন্ট মেমের সঙ্গে তো তোর পরিচয় আছেই।’
দেড়মাস আগে এক ভোরে জাকিরের চেপে ধরার দৃশ্যটা তার মনে পড়ে। গা গুলিয়ে উঠে। ক্ষোভে দাঁত কিড়মিড় করে। সে সিদ্ধান্ত নেয়, আরিয়ানকে না বলে দিবে। যা হবার তাই হোক। দরকার হলে সে আর ক্লাবে আসবে না। মেয়েরা যেখানে সুরক্ষিত নয়,  সেখানে সে কোনোদিন যাবে না বলে নিজেকে প্রতিজ্ঞা করেছে।

আরিয়ানকে ‘না’ করে দিয়েছে নাজিয়া। সে কোনো প্রতিবাদ করেনি। এতটুকু বলেছে, বিষয়টা নিয়ে এখানেই ইতি টানছি। তবে যখন দরকার হবে, আমাকে ডাকবে। আমি সাড়া দিব। এদেশে তোমরা নির্যাতিত হতে আসোনি। এসেছো একটু শান্তির খোঁজে। তোমাদের শান্তি নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব।

নাজিয়া যেদিন আরিয়ানকে ‘না’ করে দিয়েছে, সেদিন তারিখ ২০১৭ এর ১৭ নভেম্বর। ঠিক একই দিন মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর জোট ওআইসির আহ্বানে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের থার্ড কমিটিতে ভোটাভুটির আয়োজন করে জাতিসংঘ। এতে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর সামরিক অভিযান বন্ধের প্রস্তাব পাশ হয়। সেই ভোটাভুটিতে চীন ও রাশিয়া মিয়ানমারের পক্ষে ভোট দেয়। ভারত ও জাপান ভোট দেয়া থেকে বিরত থাকে।

সদর সাহেব জামে মসজিদে জোহর পড়েছে আদনান হক। জোহর পড়ে ইমাম সাহেব দুপুরের খাবার খেতে যান। আজ তার খেতে ইচ্ছে করছে না। তাই নামাজের পর মসজিদ থেকে সবাই বেরিয়ে গেলে মসজিদেই তিনি সটান শুয়ে পড়লেন। পৃথিবীর সবচে আরামের ঘুমটা হয় মসজিদের ফ্লোরে। কাথা লাগে না, বালিশ লাগে না, কম্বল লাগে না। হাতের ওপর মাথা রেখে শরীরটা এলিয়ে দিলেই হলো। শ্রাবণের বৃষ্টির মতো তরতর করে চোখে নেমে আসে ঘুম।
আজ চোখ বন্ধ করার সুযোগ পেলেন না। আদনান হক এসে গল্প জুড়ে দিয়েছে। ইমাম সাহেব তাকে ব্যক্তিগতভাবে না চিনলেও তার ব্লগের কথা হালকা শুনেছেন। আলোচনার শুরুতেই আদনান হক বললো, ‘আজ যা কথা হবে , সব গোপন থাকতে হবে।’
ইমাম সাহেব চমকে উঠলেন, ‘কী কথা?’
‘ক্যাম্পে খৃস্টানদের কার্যক্রম নিয়ে।’
ইমাম সাহেব মনোযোগী হয়ে বললেন, ‘ওয়াদা করছি সব গোপন থাকবে।’
আদনান হক বলে চললো এক গভীর ষড়যন্ত্রের আখ্যান। খৃস্টান মিশনারীরা কোমর বেঁধে নেমেছে রোহিঙ্গা মুসলিমদের খৃস্টান বানাতে। এ কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছে ‘ঈসায়ী চার্চ বাংলাদেশ’ (আইসিবি) নামের একটি এনজিও। এই এনজিওকে অর্থায়ন করে নেদারল্যান্ডস, আমেরিকাসহ কয়েকটি উন্নত রাষ্ট্র। এই দেখুন আমার অনুসন্ধান। সব ডকুমেন্ট আছে এখানে।
ডকুমেন্ট দেখে বিদ্যুৎচ্চমকের মতো চমকে উঠেন ইমাম সাহেব। অনুসন্ধানে যা তুলে এনেছে এই রোহিঙ্গা আন্ডারগ্রাউন্ড সাংবাদিক, তা বিস্ময়কর। ইমাম সাহেব বললেন, ‘আমি কি করতে পারি এখন?’
‘আমি বা আমরা কিছু করতে পারবো না। আমরা অন্যের খাই, অন্যের পরি।’
‘তাহলে?’ ইমামের মুখে চিন্তার ছাপ।
‘আমি পর্যবেক্ষণ করেছি, মিশনারীরা ধর্মান্তরের জন্য টার্গেট করে বয়স্কদের। শিশুদের টার্গেট করে চেন্তা চেতনা বদলানোর জন্য। ক্যম্পে শিশুদের ইসলামি শিক্ষার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু বয়স্কদের নেই। ব্যাপরটা আশঙ্কাজনক। তাই বয়স্কদের ইসলামি শিক্ষার ব্যবস্থা করা দরকার।’
‘বাচ্চাদের পড়িয়েই তো আমরা কুলোতে পারি না। বড়দের পড়াব কখন?’
‘হাটহাজারি নুরানি বোর্ডকে আমরা একটা চিঠি লিখব। তাদেরকে এখানের ক্যাম্পে বয়স্কদের জন্য কুরআন প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে বলবো।’
আদনান হকের পরামর্শটা মনপুত হয় ইমাম সাহেবের। তিনি হেসে বললেন, ‘সাংবাদিক তো দেখি পাকা।’
আদনান বললো, ‘আপনাদের দোয়ায়। ২০১২ সালে আমি এদেশে এসেছি। তারপর থেকেই গোপনে কাজ করে যাচ্ছি। হাটহাজারির খবরটা পেয়েছি নেট থেকে।’
ইমাম বললেন, ‘আপনার কি মনে হয় এটা গোপন থাকবে?’
আদনান বললো, ‘ধর্মান্তরকরণের বিষয়টা অলরেডি অনেকে জেনে গেছে। ক্যাম্পের বাইরের কেউ বললে সমস্যা নেই। কিন্তু আমরা বললে সমস্যা আছে।’
‘তা ঠিক।’ ইমাম সাহেব মাথা নাড়লেন।
আদনান হক বললো, ‘বাংলাদেশের ইসলামি রাজনৈতিক দল ইসলামি ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামির একটা বিবৃতি দেখলাম। বিবৃতিতে তিনি চার্চভিত্তিক মিশনারীদের এনজিওর বিরুদ্ধে দরিদ্র ও অনাহারক্লিষ্ট রোহিঙ্গাদের ধর্মান্তরিত করার অভিযোগ তুলেছেন। সেখানে তিনি ক্যাথলিক ও প্রোটেস্টাইন  চার্চ ভিত্তিক  মিশনারীদের এনজিওর মর্যাদা বাতিলের দাবি জানিয়েছেন।’
ইমাম সাহেব বললেন, ‘তার কাছে আপনার অনুসন্ধানের একটা কপি পাঠানো যায় না?’
‘পাঠাবো?
‘পাঠাতে পারেন।’
‘আচ্ছা।’

সদর সাহেব জামে মসজিদের ইমাম নুরুল হক খসখস করে একটা চিঠি লিখছেন। চিঠিটা লিখছেন হাটহাজারি মাদরাসার উস্তাদ ও হাটহাজারি নুরানি বোর্ডের মহাসচিব মুফতি জসিমুদ্দিনের কাছ।

মুহতারাম,
সবিনয় সালাম জানবেন। আমি কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের ২৯ নং ক্যাম্পের সদর সাহেব জামে মসজিদের ইমাম। গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে, এক সাংবাদিক ভাইয়ের পরামর্শে আপনার কাছে লিখছি। সাংবাদিকের নাম জানানো নিষেধ।
পরসমাচার,
রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে শিশুদের আরবি পড়ার জন্য মকতব  আছে। কিন্তু বয়স্কদের আরবি পড়ার কোনো মাধ্যম নেই। খৃস্টান মিশনারীরা টার্গেট করে বয়স্কদের। ভুলিয়ে ভালিয়ে তাদেরকে ধর্মান্তরিত করে ফেলে। অথচ তাদেরকে ইসলামি শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা নেই। গোপন সূত্রে খবর পেয়েছি, এই কুতুপালং ক্যাম্পেই সাতান্ন পরিবার, বালুখালি ক্যাম্পে চব্বিশ পরিবার, থাইংখালি ক্যাম্পে বিয়াল্লিশ পরিবার, টেকনাফের মুছনি পাড়ায় বারো পরিবার, জাদিমোরা নার্সারি এলাকায় পয়তাল্লিশ পরিবার খৃস্টান হয়ে গেছে। আরও ভয়ংকর হলো, তারা মুসলিম নাম ধারণ করেই চলাফেরা করছে। কৌশলে আলাভোলা মুসলমানদেরকে বিপথে নিচ্ছে।

ক্যাম্পগুলোতে যদি আপনারা কয়েকটি প্রশিক্ষণ কর্মশালা করতে পারেন, তাহলে আমাদের উপকার হবে। বিষয়টি অতীব জরুরী হয়ে পড়েছে। আমরা কুলিয়ে উঠতে পারি না। আপনাদের সাহায্য কামনা করছি।
ইতি
রোহিঙ্গা ইমাম
নুরুল হক
বিঃদ্রঃ চিঠির বিষয়টি গোপন রাখার অনুরোধ রইলো। আমার প্রাণনাশের আশংকা আছে।

অফিসে আসার পর থেকেই আনমনা হয়ে আছে আলম। জাফর কাওয়ালের কথাগুলো তার কানে এখনো ভাসছে। তাকে চার্চে নিয়ে যাওয়ার পেছনে নুরুল আবছারের কি কোনো দুরভিসন্ধি আছে? তিনিও তো মুসলমান। তাহলে জাফর কাওয়ালের কথাগুলো এমন ছিল কেন?
আলমের আনমনা ভাব চোখ এড়ালো না নুরুল আবছারের। তিনি ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে বললেন, ‘আলমের কি মন খারাপ?’
আলম জোর করে হেসে বললো, ‘জ্বি না।’
‘তাহলে?’ ভ্রু কুচকালেন নুরুল আবছার।
‘বোনটা অসুস্থ। নতুন মেহমান আসছে। তাই নিয়ে একটু টেনশন।’
‘টেনশন নিয়ো না। আমরা আছি তো।’
‘জ্বি।’
‘এক কাপ চা দাও। চা টা খেয়েই আজ ওখানে যাবো।’
আজ রোববার। আলম জানে, তাকে খৃস্টানদের উপাসনালয়ে নিয়ে যাবে নুরুল আবছার। মনেপ্রাণে সে প্রার্থনা করছে, এমন কিছু ঘটুক, যেন ওখানে না যাওয়া হয়। ঝড় আসুক, বন্যায় ভেসে যাক। কিন্তু এমন কিছুই ঘটলো না। তারা সুন্দরভাবেই পৌঁছে গেলো উপাসনালয়ে। আজকে পৌঁছতে পৗঁছতে খিচুরি রান্না শেষ। প্যাকেট করা হয়েছে। একটি খিচুরির প্যাকেটের সঙ্গে আজ দেয়া হচ্ছে একটি করে স্কুল ব্যাগ।
পাদ্রী জিজ্ঞেস করলেন, ‘সপ্তাহ কেমন গেলো আলম?’
আলম বললো, ‘ভালো।’
নুরুল আবছার বললেন, ‘আলম কিন্তু সত্য বলে নাই। তার কথায় একটু মিথ্যা আছে। তার মনটা আজকে খারাপ।’
পাদ্রী বললেন, ‘কেনো?’
নুরুল আবছার বললেন, ‘আলমের বোনের সন্তান হবে। এই নিয়ে একটু টেনশনে আছে। খরচপাতি, চিকিৎসা ইত্যাদি নিয়ে।’
পাদ্রী হাসলেন, ‘এটার জন্য টেনশন? আমাদের প্রসূতি মায়ের একটা ফান্ড আছে। ফান্ড থেকে তোমাকে কিছু সাহায্য করবো। ঠিক আছে?’
আলম বললো, ‘টাকা লাগবে না।’
পাদ্রী বললো, ‘লাগতেও তো পারে। বলা যায় না। তাই টাকাটা কাছে রাখা ভালো। এই টাকা তো মায়ের জন্যই।’
গুণে গুণে আলমের হাতে পাঁচ হাজার টাকা দেয়া হলো। টাকা হাতে পাওয়ার পর আলমের শক্তপ্রাণটা একটু নরম হয়ে গেলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে বলে ফেললো, ‘আপনাদের ধন্যবাদ।’
পাদ্রী বললো, ‘আমাকে সমস্যার কথা জানাবে। আমাদের এখানে বিভিন্ন ফান্ড আছে। সমস্যার কথা না বললে জানবো কি করে।’
আলম বললো, ‘আচ্ছা।’
টাকাটা পেয়ে নিজেকে খানিক হালকা লাগছে আলমের। ফাতেমার কোলে নতুন মেহমান আসার সময় হয়ে আসছে। খরচের একটা ব্যাপার আছে। বাবা থাকলে তার জন্য যা করতো, আলম তা সবই করবে। ভাগিনা ছেলের চেয়ে কম নয়। বরং এখন ছেলের চেয়ে অনেক বেশি।

নুরানি বোর্ড থেকে জবাবি চিঠি এসেছে। চিঠিটা এসেছে আদনান হকের মেইলে।
মুহতারাম,
ইতিপূর্বেই বিষয়টি আমরা অবগত হয়েছি। আমরা কাজ করছি। আপনারাও যেহেতু জানালেন, কৃতার্থ হলাম। ইনশাআল্লাহ, আমরা অচিরেই ৪০ দিনের একটি কুরআন প্রশিক্ষণ কর্মশালা নিয়ে আপনাদের মসজিদে আসছি। আপনারা এখন থেকেই সবাইকে জানিয়ে রাখতে পারেন।
ইতি
বান্দা জসিমুদ্দিন
মহাসচিব, নুরানি বোর্ড

বিকেল তিনটা। ৩০ নভেম্বর, ২০১৭, বৃহস্পতিবার। আকাশে পেজা তুলোর মতো উড়ছে শাদা শাদা মেঘ। বিরাট বিরাট মেঘের চাকা খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যাচ্ছে ছত্রভঙ্গ মিছিলের মতো। মেঘের সেই খণ্ডগুলোকে মনে হচ্ছে কোনো নিপুণ শিল্পীর রং তুলির ছোঁয়া। আলম এবং রফিক দাঁড়িয়ে আকাশের ক্যানভাসে আকা শিল্পকর্ম দেখছে। তাদের মন অস্থির। তারা খুপরির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। একটু আগেই খুপরিতে প্রবেশ করেছেন ধাত্রী আম্বিয়া বেগম।
রফিক আকাশের দিকে ইশারা করে বললো, ‘দেখ তো ভাইয়া।’
আলম আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কী?’
‘কিছুই দেখতে পাচ্ছো না?’
‘না তো।’
‘খেয়াল করে দেখো ঐ মেঘখণ্ডটাকে। মনে হচ্ছে মেঘখণ্ড নয়, যেন একটা রাজকীয় ঘোড়া। সামনের পা দুটো উঁচু করে দৌড়াচ্ছে। তার উপর বসে আছে এক রাজপুত্র।’
‘বাহ। সত্যিই  তো। এত খেয়াল করে দেখিনি তো আগে।’
‘খেয়াল করলে ওই মেঘগুলো দিয়ে মনে মনে অনেক কিছু বানানো যায়। মিনার, রেহাল, ভেলা, ঘর। এটাকে বলে মেঘখেলা। মেঘখেলা খেললে মনের অস্থিরতা কমে।’
আলমের মনের অস্থিরতা না কমলেও ঘোড়ার ওপর রাজপুত্রের ছবিটা তার মনে গেঁথে গেলো। তাদের ঘর আলো করে আজ রাজপুত্র আসছে, এটা কি তারই ইঙ্গিত? আলমের মনটা বাকবাকুম করতে লাগলো। ইমাম নুরুল হককে বলে রাখা হয়েছে। খুপরির ভেতর থেকে খবর আসার পরই তিনি ছুটে আসবেন। রাজপুত্রের কানে মধুর সুরে আজান দিবেন। আলমের গলার সুর সুন্দর হলে আলমই আজান দিত। মুসলিম সন্তান জন্মের পর তার কানে আজান  দিলেই হয়। সুন্দর সুরের আজান শর্ত না। কিন্তু আলম চাচ্ছে পৃথিবীতে এসেই যেন তার ভাগিনা সুন্দর একটা সুর শুনতে পায়। এই সুর তার রক্তে মিশে যাবে। স্নায়ুতে সুন্দরের বিজ বপন করবে।

কারো ডাকে তাদের দুজনের চমক ভাঙলো। আম্বিয়া বেগম দাঁড়িয়ে আছেন। তার কোলে ফেরেশতার মতো একটা মাখন শিশু। তারা দুজন দৌড়ে কাছে গেলো।
আম্বিয়া বেগম মুচকি হেসে বললেন, ‘রাজপুত্রের মতো একদম। মাশাল্লাহ।’
তারা দুজনেই বললো, ‘মাশাল্লাহ। ফাতেমা কেমন আছে?’
‘ভালো আছে। তবে অজ্ঞান হয়ে গেছে। একটু পর জ্ঞান ফিরবে।’
‘ডাক্তার ডাকতে হবে?’
আম্বিয়া বেগম বললেন, ‘ না। মুআজ্জিন ডাকেন। আজানের ব্যবস্থা করেন।’
রফিক শিশুটাকে কোলে নিল। ইমাম সাহেব মধুর সুরে আজান দিলেন। আজানের শব্দ শুনে মনে হচ্ছে শিশুটা বিস্মিত। সে চোখ মেলে সুন্দর সুরের মানুষটাকে দেখতে চাইছে। এতদিন অন্ধকারে থাকার কারণে সে এই প্রবল আলোতে চোখ মেলতে পারছে না। তবে সে তার গুলু গুলু চোখের পাতায় কাঁপন সৃষ্টি করে জানান দিচ্ছে, আজানটা তার পছন্দ হয়েছে।
আজানের শব্দ শুনে খুপরির সামনে ভীড় করেছে অনেকে। তাদের মুখে হাসি। তারা বলছে আরও জোরে আজান দেন। আরও জোরে। আসমান ফাটায়া আজান দেন। তাদের মনে দুঃখ জমাট বাঁধে। তারা তাদের মাতৃভূমিতে থাকার সময় শিশুর কানে আজান দেবার অধিকারটুকু পায়নি। এমন খোলা জায়গায় উচ্চস্বরে আজান দেয়ার মহিমাটাই আলাদা। কিন্তু শিশুর কানে তাদের আজান দিতে হতো গোপনে, ঘরের কোনে। অনিচ্ছাকৃতভাবে মাঝেমধ্যে আওয়াজ উঁচু হয়ে গেলে কেউ এসে মুখ চেপে বলতো, ‘গলা নামিয়ে আজান দে। এখনই মগরা চলে আসবে।’

এমন  আনন্দের দিনে সবাইকে মিষ্টি খাওয়ানোর কথা। কিন্তু আলমদের সেই সামর্থ্য নেই। চার্চের ফান্ড থেকে যে টাকা পেয়েছিল, তা শিশুর জন্য, শিশুর মায়ের বিভিন্ন জিনিস কিনতেই শেষ হয়ে গেছে। বাকি যা আছে,  তাতে মিষ্টি খাওয়ানো যাবে না। তাই ‘সুপার বিস্কুট’ কিনে এনেছে। সবার হাতে দুইটা করে বিস্কুট তুলে দেয়া হলো। সুপার বিস্কুট বিলাতে বিলাতে আলম বললো, ‘আমার ভাগিনার জন্য দোয়া করবেন।’

রোহিঙ্গা শিবিরে জন্ম নেয়া নতুন এই মেহমানের জন্য বড় কোনো আয়োজন না  হলেও ভ্যাটিকান সিটি থেকে আসা পোপ ফ্রান্সিসের জন্য তখন বাংলাদেশের বিমানবন্দরে বিরাট আয়োজন চলছে। পোপ বাংলাদেশে আসার আগে মিয়ানমারে গেছেন। রোহিঙ্গা বিষয়ে মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু কোনো বৈঠকে তিনি একবারও ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ করেননি। কেন করেননি? এই নিয়ে তার প্রতি মানবাধিকার সংগঠনগুলো নাখোশ। ১৩০ কোটি খৃস্টান ক্যাথলিক  জনগোষ্ঠির ধর্মীয় গুরু তিনি। তিনি কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব না হলেও পৃথিবীর যেখানেই যান, সেখানেই পান রাষ্ট্রীয় মর্যাদা। রোহিঙ্গাদের জাতিসত্তার পরিচয়টুকু তাদের ভূমিতে দাঁড়িয়ে তিনি স্বীকার করতে পারলেন না?

তিনি স্বীকার করেন আর না করেন, তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়ায় কোনো কমতি করা যাবে না। ২০১৩ সালের মার্চে তিনি ২৬৬ তম পোপ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। তারপর এই প্রথম তিনি বাংলাদেশে আসছেন। তাকে বহনকারী বিমানটি যখন বাংলাদেশের মাটি স্পর্শ করলো, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনেসের একটি বিমান থেকে একুশবার তোপধ্বনি দিয়ে তাকে স্বাগত জানানো হলো। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বিনীত হয়ে এগিয়ে গেলেন। হাত বাড়িয়ে অভ্যর্থনা জানালেন, ‘বাংলাদেশে আপনাকে স্বাগত। এই ভূমিতে আপনার আগমন শুভ হোক।’

পোপ বিমানবন্দর থেকে প্রথমেই যান সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে। সেখানে তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর কড়া নিরাপত্তা দিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ধানমণ্ডির বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে। পথে যেতে যেতে পোপ দেখেন, তিনি যে সড়ক অতিক্রম করছেন, সে সড়কগুলোর যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। সড়কের চারপাশে মোতায়েন করা হয়েছে বিপুল সংখ্যক আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। প্রধান সড়কগুলো সজ্জিত করা হয়েছে তার ছবি দিয়ে। তিনি সাদা কাপড় পরিহিত। তার গলায় ঝুলছে কাঠের ক্রুশ। মাথায় টুপিসম শাদা কাপড়। পোপকে জাদুঘরের সংগ্রহশালা ঘুরে ঘুরে দেখান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট মেয়ে শেখ রেহানা।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সিংহভাগ শরণার্থীর পোপকে নিয়ে বিপুল সন্দেহ আছে। তারা তাকে চেনে না। তবে বাংলাদেশে তার জন্য বিরাট আয়োজন দেখে তারা এতটুকু বুঝতে পারছে , তিনি অবশ্যই বড় কেউ।
‘পোপ কে?’
‘মনে হয় বড় কোনো হুজুর। দেখিস না মাথায় টুপি।’
‘নাহ, হজুর না।’
‘কেন? পরনে পাঞ্জাবিও আছে।’
‘কিন্তু গলায় যে ক্রুশ। এটা খৃস্টানরা গলায় দেয়।’
‘তিনি মনে হয়  বড় রাজনীতিবিদ।’
‘হতে পারে।’
‘অথবা ধনী কোনো রাজাও হতে পারেন। রাজাদের জন্য এতবড় আয়োজন হয়।’
‘তিনি কি আমাদের জন্য কিছু করতে আসছেন?’
‘জানি না। আসতেও পারে। কিন্তু মিয়ানমার তার কথা শুনবে?’
তারা কোনো সিদ্ধান্তে পেীঁছতে পারে না। তাদের সন্দেহমূলক প্রশ্নোত্তর চলতেই থাকে। সবকিছু ছাপিয়ে তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে তাদের নিয়ে কিছু করার প্রসঙ্গটি। বড় কেউ বাংলাদেশে এলেই তাদের মনে আশা জাগে, তদের নিয়ে হয়তো কিছু করতে এসেছে। এবার হয়তো তাদের পক্ষে কেউ জোর গলায় কথা বলবে। হয়তো আরেকটু ত্বরান্বিত হবে তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যাওয়ার কার্যক্রম। কিন্তু তারা জানে না , তাদের মাতৃভূমি সফর করে এসেছেন পোপ। তাদের পক্ষে তেমন কোনো জোরালো কথাও বলতে পারেননি তিনি।

আলম অফিসে মিষ্টি নিয়ে এসেছে। নুরুল আবছারকে খাওয়াবে। আজ তার মুখ থেকে হাসি নিভছেই না। নুরুল আবছার একটা মিষ্টি মুখে দিয়ে বললেন, ‘ভাগিনা কেমন আছে?’
আলম হাসিটা আরও বিস্তৃত করে বললো, ‘ভালো আছে আলহামদুলিল্লাহ।’
‘ভাগিনার নাম রাখলা কি?’
‘নাম এখনো রাখি নাই।’
‘কবে রাখবা?’
‘নামটা রাখবো দুই তারিখ। ঈদে মিলাদুন্নবির দিন। ভাগিনার বয়স হবে তখন তিনদিন।’
‘পোপ ফ্রান্সিস বাংলাদেশে এসেছে জানো?’
‘জ্বি।’
‘পোপ কে?’
‘ক্যাথলিক খৃস্টানদের ধর্মগুরু।’
‘তোমার সাধারণ জ্ঞান ভালো।’
‘একটু একটু।’
‘তাইলে বলো দেখি পোপ তার উপদেশবাণী  এবং বিবৃতিতে কোন শব্দটি বেশি ব্যবহার করেন?’
‘জানি না।’ জিভ কাটলো আলম।
নুরুল আবছার বললেন, ‘এটা তোমার জানার কথা না। পত্রিকা না পড়লে এটা জানা যায় না। তবুও জেনে রাখা ভালো। একটি ইতালীয় সংবাদপত্রের বিশ্লেষণ অনুসারে পোপ তার উপদেশবাণী  এবং বিবৃতিতে সবচে বেশি ব্যবহার করেন ‘আনন্দ’ (জয়) শব্দটি।’
‘কিন্তু আমাদের জীবনে  সবচে কম ব্যবহৃত শব্দ হলো ‘আনন্দ’। এই শব্দটা কদাচিৎ আমরা ব্যবহার করতে পারি।’
‘আরেকটা প্রশ্ন। পারলে পুরস্কার।’
‘সহজ করে করবেন।’
‘পরিবেশ দূষণকে পোপ কী বলেন?’
‘খারাপ।’ আন্দাজে ঢিল ছুড়লো আলম।
নুরুল আবচার মুচকি হেসে বললেন, ‘পোপ পরিবেশ দূষণকে পাপ বলেন। সব খারাপ আর পাপ এক না।’
‘রক্ত পরিবেশ দূষণ করে?’
‘করে।’
‘পরিবেশ দূষণ পাপ। ভাবছি রক্ত বোধহয় পরিবেশ দূষণ করে না। কারণ বৌদ্ধ খৃস্টানরা যখন মুসলিমদের রক্ত ঝরায়, তাদের কেউ বাধা দেয় না। বরং সমর্থন জানায়। পাপ হলে তো খৃস্টান এবং বৌদ্ধ ধর্মগুরুরা বাধা দিতেন। রাখাইনে মুসলিমদের গণহত্যায় সবচে বেশ উসকানি দিয়েছেন বৌদ্ধ পুরোহিত সংঘের প্রধান অশিন ভিরাথু। তাকে সবাই বলে কসাই ভিরাথু।’
‘সব ধর্মেই হত্যা রক্তপাত নিষিদ্ধ। পার্থক্য হলো, পাপ করলে কেউ বাধা দেয়, কেউ দেয় না।’
আলম আর কোনো কথা বলে না। চুপ করে থাকে। উত্তর সঠিক না হওয়ায় সে পুরষ্কার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। মন খারাপ না হলেও তার আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আজ অনেক বেশি বলে ফেলেছে। নুরুল আবছার তার দিকে একটি কাগজ বাড়িয়ে দিলেন। কাগজে ১৮ জনের নাম লেখা । কাগজে ১৪ নম্বর নামটি তার।
চমকে উঠে আলম, ‘কিসের কাগজ এটা? আমার নাম কেন?’
‘তুমি আজ রাতের গাড়িতে ঢাকা যাচ্ছো।’
‘কেন?’
‘রোহিঙ্গাদের সঙ্গে দেখা করবেন পোপ। পোপের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের দেখা করার এই ব্যবস্থা করে দিচ্ছে ক্যাথলিক খৃস্টানদের একটি সাহায্য সংস্থা কারিতাস। তোমাদেরকে নিয়ে যাবে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আই ও এম এবং জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর। তোমার নামটি প্রস্তাব করেছেন পাদ্রী নিজেই।’
‘আমাকে?’
‘হুম। পোপ তোমদের কাছে গণহত্যার গল্প শুনবেন। পোপ চা খান না, কফি খান। তোমার চা খেলে অবশ্য তিনি কফি বাদ দিয়ে চা খাওয়া ধরতেন।’

আলম হাসে। লজ্জা পায়। এতবার নিজের চায়ের প্রশংসা শুনে আত্মবিশ্বাসের বদলে তার সন্দেহ হতে শুরু করে। আসলেই কি তার চা স্বাদ হয়?

ঢাকায় খৃস্টানদের প্রধান গির্জা বিশপ হলে ১৮ জন রোহিঙ্গা বসে আছে। তাদের সবার গায়ে পুরাতন কাপড়। নতুন কাপড় দেয়া হয়নি। পোপের সঙ্গে দেখা করে যাবার পর এক হাজার টাকা এবং একটি করে নতুন কাপড় দেয়া হবে। পুরাতন কাপড়ে একটা বিধ্বস্ত বিধ্বস্ত ভাব ফুটে থাকে, মনটাও নরম থাকে। তাই তাদেরকে পুরাতন কাপড়ই পড়তে বলা হয়েছে। তাদেরকে বলা হয়েছে, পোপ যখন তাদের সামনে আসবেন, তার যেন সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে যায়।

পোপ সামনে আসার পর সবাই দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আছিমুদ্দিন ঠিকমতো দাঁড়তে পারছে না। সে দাঁড়িয়েছে কুঁজো হয়ে। পোপ বুঝলেন তার দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। তাকে জিজ্ঞস করলেন,  ‘তোমার কী  হয়েছে?’
আছিমুদ্দিন বললো, ‘কোমরে কোপ দিয়েছে বৌদ্ধরা। তারপর থেকে দাঁড়াতে কষ্ট হয়।’
‘পরিবারের সবাই এসেছে?’
‘বাবা আসতে পারেনি। তাকে বন্দী করা হয়েছে আগেই।’
হালিম তার শার্ট খুলে দেখালো। এক পলক দেখেই পোপ চোখ বন্ধ করে ফেললেন। হালিমের বাহুতে গুলির যখম এখনো শুকায়নি। কেমন তরতাজা লাগছে। পোপ বিড়বিড় করে বললেন, ‘ঈশ্বর তোমাকে সুস্থ করুন।’
হালিম শার্টে ঢেকে নিলো তার বাহু।
হাজেরা নামের এক মহিলাকে কাছে ডাকলেন পোপ। মহিলা বোরকায় আবৃত। শুধু মুখটা খোলা। মহিলার বয়স চল্লিশ বেয়াল্লিশ হবে। পোপ বললেন, ‘কেমন আছো?’
হাজেরা বললো, ‘এখন ভালো আছি।’
‘কী দেখেছ তুমি?’
‘আমি দেখিনি, নিজেই শিকার। আমি নাকি বাঙালি। তাই  আমাকে আমার স্বামীর সামনে রাতভর ধর্ষণ করেছে সাত আটজন সেনা।’
পোপ মুখ ফিরিয়ে নিলেন।
হাজেরা বললো, ‘তারপর আমার স্বামীকে আমার সামনে জবাই করেছে।’
পোপ বললেন, ‘তবুও বেঁচে থাকাটা ইশ্বরের করুণা। এত কষ্ট আর নির্যাতন সয়ে মানুষ বাঁচতে পারে না।’
আলম এগিয়ে গেলো। পোপ তার চোখে চোখ রেখে বললেন, ‘তোমাদের ওপর নির্যাতনের বর্ণনা আমি আর শুনতে পারছি না। আমাকে ক্ষমা করো। এখন তোমরা কী চাও? কী হলে মিয়ানমারে ফেরত যাবে?’
আলম বললো, ‘যদি আমাদেরকে রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়, আমাদের পূর্ণ মানবাধিকার নিশ্চিত করা হয়, তাহলে  আমরা ফিরে যাব। নয়তো যাব না।’
পোপ বললেন, ‘আমি তোমদেরকে রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকার করি। তোমদেরকে তোমাদের ভূমিতে ফিরে নেয়ার জন্য আমি মিয়ানমারকে বলেছি। তারা বলেছেন ফিরিয়ে নিবেন। ধৈর্য ধরো।’
রোহিঙ্গাদের সঙ্গে দেখা করার পর পোপ মিডিয়ার সামনে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি এই প্রথম উচ্চারণ করলেন। তিনি বললেন, ‘আজ রোহিঙ্গাদের মাঝেও সৃষ্টিকর্তার উপস্থিতি রয়েছে।’

রফিক অপেক্ষা করছিলো শক্ত কিছু বলবেন পোপ। তিনি কিছুই বললেন না। অচ্ছা, পোপের আগমন তাদের জন্য কোনো উপকার বয়ে আনতে পারবে? পুরো পৃথিবীর সামনে এতবড় একটা মুসলিম গণহত্যা চালালো মিয়ানমার, অথচ প্রতিবাদ করতে এখনো সবাই ইতস্তত করছে। মনখুলে কেউ বিচার চাইছে না। রফিক ফেসবুব ওপেন করে। ‘দ্য আর্ট গার্ডেন অফ রোহিঙ্গা’ পেইজে একটি কবিতা লিখতে শুরু করে–

এমন এক ভূমিতে আমার বাস
জীবন যেখানে সাদা-কালো
হৃদয়ের উনুনে জ্বলন্ত স্বপ্ন
টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যাওয়া ইচ্ছে
নোটবুকে দমবন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছে সব পরিকল্পনা
মনের আঙিনায় বিষাদ
জীবনের ঝুলিতে প্রত্যাখ্যান
গায়ে লেগে আছে গণহত্যার চিহ্ন
আলো থেকে অন্ধকার গুহায় ঢুকে পড়েছি আমরা
তবুও সবুজ মায়ো পাহাড় আমায় ফিসফিসিয়ে বলে-
তোমার স্বপ্ন পূরণ হবে
তোমার জীবন আলো পাবে
ঠিক আমার মতো একটু ধৈর্য‌ ধরো!

১০

অদ্ভুত সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখে ঝট করেই ঘুম থেকে জেগে উঠেছে হামিদুল। স্বপ্নের ঘোর এখনো লেগে আছে চোখে মুখে। সে দেখেছে তার কোলে ছোট একটা শিশু খেলছে। জেলে থাকতে থাকেতে তার বড় হয়ে যাওয়া চুল ধরে টানছে। হামিদুল জিজ্ঞেস করলো, ‘বাবু তোমার মা কই?’
শিশুটি সুন্দর করে বললো, ‘বাংলাদেশে।’
‘তোমার বাবা কই?’
‘আমার বাবা তো আপনি?’ শিশুটি খলখল করে হেসে বললো।
শিশুর খলখল হাসি শুনে ঘুম ভেঙে গেছে হামিদুলের। সে ঠিক বুঝতে পারছে ফাতেমার কোল আলো করে তাদের আদরের পুতলির জন্ম হয়েছে। তার খুব ইচ্ছে করছে তাকে দেখতে। চৈত্রের পিপাসার মতো প্রবল হাহাকার জেগেছে মনে। হামিদুল চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ে। মনে মনে কথা বলতে চেষ্টা করে ফাতেমার সঙ্গে।
‘বাবুর কী নাম রাখবা?’
‘তোমাকে না নাম চিন্তা করতে বলেছি।’
‘কবে নাম রাখবা?’
‘আজকে ঈদে মিলাদুন্নবি। আজকেই রাখবো। জলদি নাম বলো।’
‘আমাদের নবির নামে নাম রাখবো। মুহাম্মদ।’
‘বাহ, সুন্দর নাম। এরচে সুন্দর নাম হতেই পারো না। জেলে বসে চিন্তা করা শিখে গেছো।’
‘হুম। আরেকটা জিনিস এইমাত্র চিন্তা করেছি।’
‘কী সেটা?’
‘আজকে ঈদে মিলাদুন্নবি। বাংলাদেশের রাজধানীতে এই দিন জসনে জুলুসের শোভাযাত্রা বের হয়। কিন্তু পোপের কারণে এবার শোভাযাত্রা নিষেধ। পোপ বিভিন্ন জায়গায় যাবেন। শোভাযাত্রা বের হলে তার  নিরাপত্তার ব্যাঘাত ঘটতে পারে।’
‘কিন্তু গবেষক হামিদুল, আমরা কি আমরা আমাদের ভূমিতে ফিরতে পারবো? এই ব্যাপারে আপনার কোনো গবেষণা আছে?’
‘এই নিয়ে আমি গবেষণা করতে চেয়েছি। কিন্তু মাথায় কিছু আসে না। সব ধোঁয় ধোঁয়া লাগে। তবে আরকটা গবেষণা করেছি। জেলে নিয়মিত পত্রিকা আসে। সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা ‘গ্লোবাল নিউ লাইট অফ মিয়ানমার’। এক বন্দী প্রফেসর আমাদেরকে  খবরগুলো পড়ে শুনান। আমি খেয়াল করলাম, গত অক্টোবরে গণহত্যার পর থেকে রোহিঙ্গাদেরকেই অপরাধী হিসেবে দেখিয়েছে পত্রিকাটি। খবরে বলা হয়েছে, এরা নিজেরাই নিজেদের ঘরে আগুন লাগিয়েছে। তবে পত্রিকাটির কোথাও  আমদেরকে ‘রোহিঙ্গা’ বলা হয়নি। বরং বলা হয়েছে ‘বাঙালি সেটলার’।
‘তোমার ছেলে বাংলাদেশে জন্ম গ্রহণ করেছে। সে কি বাংলাদেশি।’
‘উহু। আমার ছেলেও রোহিঙ্গা। আমার ছেলের ইতিহাস ঐতিহ্য মিশে আছে আরাকানের গভীর ভূমিতে।’
‘তোমার ছেলে রোহিঙ্গা হলেও জন্ম নিয়েছে শরণার্থী হয়ে। বাংলাদেশের হাওয়ার গন্ধ তার গা থেকে মুছে ফেলতে পারবে?’
‘পারবো না। তবে সন্তানকে এতটুকু বলবো, ‘বাংলাশের কোনো মানুষকে কখনো অসম্মান করিস না।’

হামিদুল আর কথা বলতে পারে না। হাজিরার সময় হয়ে গেছে। হাজিরা দেবার জন্য এখন তাকে যেতে হবে হাজিরার রুমে।

সদর সাহেব জামে মসজিদে ৪০ দিনের একটি কুরআন প্রশিক্ষণ কোর্স শুরু হয়েছে। তাতে বেশ সাড়া পড়েছে। বয়স্ক অনেকেই এতে অংশগ্রহণ করেছে। কোর্সটি উদ্বোধন করেছেন নুরানি বোর্ডের মহাসচিব মুফতি জসিমুদ্দিন। বোর্ড থেকে দুজন শিক্ষক দেয়া হয়েছে। মাওলানা আবছার কামাল এবং মাওলানা আজিজুল হক।
ইমাম নুরুল হক আলমকে কোর্সে অংশগ্রহণ করতে বলেছেন। কিন্তু আলম সময়ের অজুহাত দিয়ে কেটে পড়তে চেয়েছে। ইমাম সাহেব বললেন, ‘দিনে অফিস। রাতে এসে কুরআন পড়ো।’
আলম বললো, ‘তখন ক্লান্তি লাগে।’
‘ক্লান্তি তো লাগবেই। কিন্তু কুরআন না শিখলে হবে?’
‘জ্বি না।’
‘তোমরা না শিখলে ঘরের মেয়েদের শেখাবে কে? ক্যাম্পে মহিলাদের জন্য কুরআন শিক্ষার প্রশিক্ষণ তো খোলা যাচ্ছে না। তোমরা শিখে ঘরের মহিলাদের শেখাবে।’
‘জ্বি।’
‘তাহলে কাল থেকে কোর্সে আসো। রফিক তো গতকাল থেকেই আসছে।’
‘আমি চেষ্টা করবো।’
‘বলো ইনশাআল্লাহ।’
‘ইনশাআল্লাহ।’

আলম সে রাতে ঘুমিয়ে তার বাবাকে স্বপ্নে দেখলো। তার বাবা তার ওপর খানিক রুষ্ট। তার সঙ্গে কথা বলছেন না। বাবার সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। আলম বললো, ‘বাবা, কী অপরাধ করেছি?’
বাবা বললেন, ‘তুই আমাকে ভুলে গেছিস।’
‘আমি ভুলিনি বাবা।’
‘একদিন আমার জন্য সূরা ইয়াসিন পড়ে দোয়া করেছিস?
‘আমি সূরা ইয়াসিন পড়তে পারি না।’
‘পড়ার চেষ্টাও তো করিস না।’
‘কাল থেকে পড়ার চেষ্টা করবো বাবা।’
‘মনে থাকবে?’
‘জ্বি।’

আলমের ঘুম ভেঙে যায়। খুপরির ভেতর ভ্যাপসা গরম। একবার ঘুম ভেঙে গেলে আর ঘুম আসতে চায় না। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে ফাতেমা, আছিয়া বেগম। ফাতেমার বুকের সঙ্গে লেগে আছে মুহাম্মাদ। আস্তে করে আলম বাইরে বেরিয়ে আসে। পাহাড়ের ওপর এসে দাঁড়ায়। নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হয়, বড্ড নিঃসঙ্গ। একটা গোপন দীর্ঘশ্বাস তার বুক চিড়ে বেরিয়ে যায়। তার কাছে মনে হয় রাতগুলো এমন হাজার মানুষের দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে আছে। এই রোহিঙ্গা শিবিরে যতগুলো খুপরি, ততগুলো দীর্ঘশ্বাসের গল্প। কিন্তু কেউ কারো খবর রাখে না। আচ্ছা পাদ্রী কি তার খবর রাখার চেষ্টা করছেন? তিনি কেন তার খবর রাখতে যাবেন? সে তো পাদ্রীর কেউ না। তাহলে? স্বার্থ ছাড়া কেউ কি কারো জন্য কিছু করে?

পরদিন ঘুম থেকে উঠে অদ্ভুত একটা পরিবর্তন লক্ষ করে আলম। কুতুপালং ক্যাম্পে সবার মাঝেই কেমন এক অস্থিরতা। জটলা বেঁধে সবাই কীসব গুঞ্জন তুলছে। বিষয়টি স্পষ্ট করে দিলো রফিক। মোবাইলটি আলমের সামনে ধরে বললো, ‘এই দেখো।’
আলম বললো, ‘কী’
‘দেখো তো ছবি দেখে চিনতে পারো কিনা?’
‘এটা তো তাজু ফকির।’
‘হা, তাজু ফকির । সবাই তাকে নিয়েই আলোচনা করছে।’
‘কেন?’
‘তাকিয়ে দেখো, ছবিটা একটা বিয়ের । এ বিয়ের বর-কণে তার ছেলে এবং পুত্রবধু। বিয়েটা হচ্ছে খৃস্টান রীতিতে। ছবিটা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে।’
‘রোহিঙ্গার বিয়ে খৃস্টান রীতিতে?’
‘এটাই তো সবার প্রশ্ন। তার মানে তাজু ফকির খৃস্টান হয়ে গেছে। কিন্তু ওপরে ধারণ করে আছে মুসলিম নাম।’
আলম ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠে। তার মেমোরিতেই তো আলম খৃস্টীয় সঙ্গীত দিয়ে দিয়েছিলো। সঙ্গে দিয়েছিলো তৌরাত-যাবুরের আলোচনা। তাজু কি তাকেও টানতে চেয়েছিল তার দলে? আলম সঙ্গে সঙ্গে তার মোবাইল থেকে তাজুর দেয়া জিনিসগুলো ডিলেট করে ফেলে। কথাগুলো কাউকে বলা যাবে না। বললেই বিপদ।
তাজু ফকিরের ঘটনাটি ক্যাম্পের নিস্তরঙ্গ জলে ঢেউ তুলে দিল। কে বা কারা ছবিটা প্রকাশ করলো, কেউ টের পেলো না। তবে সবাই সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠলো। পাশের মানুষটির দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো এই মানুষটি ঠিক আছে তো? গোপনে গোপনে সে আবার কাম সেরে ফেলেনি তো?

আলমের সামনে এসে দাঁড়ালো আদনান হক। সচকিত হয়ে আলম বললো, ‘নকীব ভাই, দেখলেন কী ঘটলো?’
আদনানা হক বললো, ‘আমার নাম নকিব না, আদনান হক।’
‘তার মানে?’
‘তার মানে হলো আপনাকে আমি মিথ্যা বলেছি। সত্যি বললে প্রতিনিয়ত আপনি আমার থেকে লুকিয়ে বেড়াতেন।’
‘কেন লুকিয়ে বেড়াতাম?”
‘কারণ, আপনিও চার্চে যেতেন।’
আলম ভড়কে গিয়ে বললো, ‘আপনি কিভাবে জানেন?’
মুচকি হেসে আদনান বললো, ‘আপনার খুপরিতে খুঁজলে এখনো কিতাবুল মুকাদ্দাস পাওয়া যাবে। পাদ্রী আপনাকে দিয়েছিলেন।’
‘আপনি কিভাবে জানলেন , বলুন।’
‘কিভাবে জেনেছি, সেটা বলতে পারবো না। তবে তারচে ভয়ংকর তথ্য আছে। আপনি চমকে যাবেন।’
আলম সটান হয়ে দাঁড়ালো। আদনানের হাত ধরে বললো, ‘বলুন। এখনই আমার ভয় করছে।’
আদনান বললো, ‘ভয়টা একটু বাড়ুক।’
‘আর ভয় বাড়াবেন না।’ মিনতির সুরে বললো আলম।
আদনান বললো, ‘আপনার বস নুরুল আবছারও একজন খৃস্টান। দুই বছর আগে তিনি খৃস্টান হয়েছেন। কিন্তু মুসলিম নামটা রেখে দিয়েছেন।’
আলমের কপাল কুঞ্চিত হয়ে গেলো। হাত দুটো কচলাতে কচলাতে সে বললো, ‘জেনে বলছেন সব?’
আদনান বললো, ‘জেনেই বলছি। খৃস্টান হয়ে যাওয়া কিছু রোহিঙ্গাকে ধর্মান্তরকরণ কাজে নিয়োগ দিয়েছে মিশনারী। তাদের মধ্যে একজন নুরুল আবছার।’
আলম চমকে উঠে বললো, ‘ইন্না লিল্লাহ।’

আলম আর কিছু বলতে পারে না। তার চোখজুড়ে নেমে আসে অন্ধকার । তার কানে ভাসে জাফর কাওয়ালের কণ্ঠস্বর। বাবার ধমকের সুর। ধীরপায়ে সে খুপরিতে ফেরে। টুপি মাথায় দিয়ে মসজিদে যায়। গিলাফ খুলে চুমু খায় কুরআনে। তারপর ভাঙা ভাঙা শব্দে সে পড়তে শুরু করে ইয়া-সি-ন। ও-য়া-ল-কু-র-আ-নি-ল-হা-কি-ম।

The post শরণার্থী (উপন্যাসিকা) appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%b6%e0%a6%b0%e0%a6%a3%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%a5%e0%a7%80-%e0%a6%89%e0%a6%aa%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a6%bf%e0%a6%95%e0%a6%be/

একজন মাতালের গল্প

 মূল: মুস্তফা লুতফী আল মানফালুতী

অনুবাদ:  ইবরাহীম জামিল:

জীবনের মুহূর্তগুলো কত দীর্ঘ অথচ জীবন কত ক্ষুদ্র!

কতটা বছর পিছনে ফেলে এলাম! কিন্তু অতীতের দিকে তাকালে মনে হয়- একটি বছর মাত্র জীবন পেয়েছি। যুগ-নক্ষত্রের মত। যা রাতের আঁধারে শুধু একবার চমকে উঠে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায়। জীবনের শুরুর ভাগ কেটেছে একজন সতীর্থ খুঁজে খুঁজে, যে বন্ধুর পানে পণ্যের দিকে তাকানো বণিকের মতো অথবা হালের বলদের দিকে তাকানো কৃষকের মতো লোভ-চকচকে দৃষ্টিতে তাকাবে না। এমন বন্ধু খুঁজে পেতে জীবনের আঠারোটি বসন্ত পার হয়ে গেছে। তারপর যাকে পেয়েছি তার মতো চমৎকার বন্ধু আরেকটি হতে পারে না। একজন মানুষের মধ্যে যতটুকু বিশ্বস্ততা  থাকতে পারে তা তার মধ্যে আছে। একজন মানুষের মুখে মানবীয় পূর্ণতা যতটুকু দ্যুতি ছড়াতে পারে তার সবটুকু তার চেহারায় ঝলমল করে। আমি তাকে লুফে নিয়ে হৃদয়ের এমন জায়গায় বসিয়েছি, যেখানে আর কেউ কখনো প্রবেশ করেনি। আমার আর তার বন্ধুত্বের মাঝে কোনো পঙ্কিলতার স্পর্শ ছিল না। কিন্তু জীবনের প্রয়োজন মানুষকে স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে দেয় না। কায়রো থেকে আমাকে মাসকটে পাড়ি জমাতে হল। কায়রোর কোনো কিছু ছেড়ে আসতে আমার দুঃখবোধ হয়নি, শুধু প্রিয় বন্ধুটিকে ছেড়ে আসতে আমার ভিতরটা হুঁ হুঁ করে কেঁদেছে।

দীর্ঘদিন পর্যন্ত তার সাথে আমার পত্র আদানপ্রদান চলেছে। এক সময় সচকিত হয়ে দেখি,  সে অনেক দিন পর্যন্ত আমার পত্রের জবাব দেয় না। তারপর লক্ষ্য করি, সে আমার আর কোনো পত্রের জবাব দেয় না। কোনো পত্রও পাঠায় না। আমি ভীষণ দুঃখ পেলাম। মনে মনে ভাবলাম, তার বিশ্বস্ততার মধ্যে হয়তো খাঁদ ছিলো। মাঝে মাঝে মনে হতো, কায়রো গিয়ে দেখে আসি সে কেমন আছে। কিন্তু যাই যাই করেও যাওয়া হয়নি।

অনেক বছর পর আমি কায়রোতে ফিরে  গিয়েছিলাম। কায়রোর মাটিতে পা রেখেই মনে হল, বন্ধুকে দেখতে যেতে হবে।  সেদিন সন্ধ্যার পর আমি তার বাড়িতে গেলাম কিন্তু  সেখানে যা দেখতে পেলাম তার জন্য ক্ষমাহীন অনুতাপ আজো আমার বুকের সাথে লেপ্টে আছে।

এ বাড়িতো ছিল এক টুকরো ফেরদাউস জান্নাত। যেখানে রংবেরঙের সুখেদের উড়াউড়ি ছিল। এ বাড়ির বাসিন্দাদের চেহারায় সুখ আর সৌন্দর্য্য ঝিলমিল করতো। আজ যখন এখানে পা রেখেছি, মনে হচ্ছে আমি যেন কোন অচেনা গোরস্থানের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। কারো কথা বলার শব্দ নেই। বাড়ির পাশে জনমানুষের চিহ্ন নেই। আঙিনায় আলো জ্বালানোর ব্যবস্থা নেই। মনে হল, পথ হারিয়ে কোনো পরিত্যক্ত বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছি বোধহয়। ফিরে আসার কথা ভাবছিলাম, হঠাৎ একটি শিশুর কান্নার আওয়াজ পেয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম। জানালার ওপাশে টিমটিমে একটুখানি আলো জ্বলছে । বোধহয় বাড়িতে কেউ আছে। আমি এগিয়ে গিয়ে দরজায় করাঘাত করলাম। ভিতর থেকে সাড়া এলো না। আবার করাঘাত করলাম। এবার দেখতে পেলাম কুপি হাতে একটি ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে। একটু পরেই ধুলোমলিন পোশাক আচ্ছাদিত একটি শিশুর অবয়ব  ভেসে উঠল। কুপির আলোয় আমি তার চেহারা পাঠ করলাম।  চেহারায় বাবার টান দেখতে পেয়ে বুঝতে পারলাম, এই সেই  সুন্দর শিশু,  যে ইতিপূর্বে এ বাড়ির শোভা ও কেন্দ্রবিন্দু ছিল। তার কাছে তার বাবার কথা জানতে চাইলাম।  সে ইশারায় আমাকে আসতে বলে কুপি হাতে একটি ধুলিধূসরিত ঘরে প্রবেশ করল। বসার জায়গাটিতেও ধুলোর আস্তরণ জমে গেছে। হাতের রেখার মতো কিছু আঁকিবুকি দেয়ালে ভেসে না উঠলে আমি বুঝতেই পারতাম না, এটিই সেই ঘর যেখানে আমি সুখময় বারোটি বসন্ত পার করেছি।

এখানে বসেই ছেলেটির সাথে সামান্য কথা হল, সে জেনে নিল আমি কে। আমিও জানতে পারলাম তার বাবা এখন অবধি ঘরে ফেরেনি। খুব তাড়াতাড়ি ফিরবে। তারপর সে আমাকে বসিয়ে রেখে কিছুক্ষণের জন্য ভিতরে গেলো। ফিরে এসে বলল,  তার আম্মিজান বাবার ব্যাপারে কিছু বলতে চায়। আমি খানিকটা শংকিত হলাম। অনুমান করলাম খারাপ কিছু ঘটেছে কিন্তু কী ঘটেছে তা ঠাওর করতে পারলাম না। কালো চাদরে ঢাকা একজন মহিলা দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আমাকে অভিভাদন জানালো। আমি প্রতিউত্তর করলাম।  সে বলল, কালের দুর্বিপাকে আপনার বন্ধু কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে আপনি কি জানেন? বললাম, জানি না। সাত বছর পর আজই প্রথম এই শহরে পা রেখেছি। সে বলল, আপনি যদি তাকে ছেড়ে না যেতেন তাহলেই বোধহয় ভাল ছিল। কারণ আপনি তার আশ্রয় ছিলেন। তাকে পতনের হাত থেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। আপনি চলে যাওয়ার পর একদল শয়তান চতুর্পাশ থেকে তাকে ঘিরে ফেলেছে। আপনি তো জানতেন, সে ছিল সহজ-সরল ভালো মানুষ।  শয়তান তাকে মন্দের পথে নিতে নিতে এমন গহ্বরে নিয়ে ফেলেছে যে, আমরাও দুর্দশায় পড়েছি। আমি জানতে চাইলাম, কী ধরণের মন্দের সাথে সে জড়িয়েছে? কারা তাকে নষ্ট করেছে?  সে বলল, আমি আপনাকে খুলে বলছি। একটু ধৈর্য্য নিয়ে শুনুন!

আমাদের দিন ভালোই চলছিল, হঠাৎ শহর প্রধানের সাথে আমার স্বামীর পরিচয় হয়, তারপর বন্ধুত্ব, তারপর সে তার একান্ত সহচর হয়ে ওঠে। শহর প্রধান তার জন্য ভাতা ঠিক করেছে। তাই সব সময় আমার স্বামী তার পাশে দরবারে থাকে, সকাল সন্ধ্যা সেখানেই তার যাওয়া আসা। তখন থেকেই সে  কেমন যেন পাল্টে গেছে। স্ত্রী সন্তানের দেখাশোনা প্রায় ছেড়ে দিয়েছে। শেষ রাতের আগে বাড়ি ফেরে না। শুরুর দিকে শহরপ্রধানের কাছে তার এ নৈকট্য অর্জনে আমি বেশ গর্বিত ছিলাম।  আমি ভেবেছিলাম, এ পথ ধরে আমাদের বাড়িতে অফুরন্ত সুখশান্তির অনুপ্রবেশ ঘটবে। তার অধঃপাতে যাওয়ার বিষয়টি আমি তখন ঠাওর করতে পারিনি। কারণ সে প্রায় বাড়ির বাইরে থাকতো। তার সাথে দেখা হতো খুবই কম।

হঠাৎ একরাতে সে ভীষণ রকম টলতে টলতে,  ভয়ানক ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে বাড়ি ফিরল। আমি তার মুখের কাছে মুখ নিয়ে মাদকের গন্ধ পেলাম। সেদিন আমার সামনে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমি বুঝতে পেরেছি যে, এইসব নেতারা তাদের নেতৃত্বগুণে মানুষকে ভালোর পথেও নিতে পারে আবার খারাপের পথেও নিতে পারে। আমার সহজ-সরল স্বামীটাকে খারাপের পথে নেয়া হয়েছে। সে তাকে প্রকৃত বন্ধু বানায়নি, বরং মদ্যপানের সঙ্গী বানিয়েছে। পরিচিত সবার মাধ্যমে আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। দু’টি চোখ যতটুকু অশ্রু ঝরাতে পারে, তার সামনে আমি সবটুকু অশ্রু ঝরিয়েছি। আশা ছিলো হয়তো সে আগের জীবনে ফিরে আসবে,  যেখানে স্ত্রী-পুত্রদের সাথে সুখের একটি সংসার ছিল। কিন্তু তাকে আমি তার জায়গা থেকে এক বিন্দু নড়াতে পারিনি।

এরপর একদিন শুনতে পাই, যে হাত সুরার দিকে এগিয়েছিলো  সে হাত এখন জুয়ার দিকে প্রসারিত। আমি অবাক হইনি। কারণ আমার জানা আছে যে, পাপের পথ একটিই। এর মাথার কাছে দাঁড়ালে নামতে নামতে পায়ের কাছে পৌঁছে যেতে হয়।  সেই ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন অভিজাত যুবকটি, যে গতকাল পর্যন্ত  কোনো অষুধের মধ্যে এ্যালকোহলের গন্ধ পেলে তা ছুড়ে ফেলতো, যে পথে মদ্যপায়ীদের চলাফেরা সে পথ কোনোদিন মাড়াতো না, সেই যুবকটি এখন নাম-পরিচয়হীন মাতাল, জুয়াড়িদের সাথে উঠাবসা করতে একটুও দ্বিধান্বিত হয় না। গতকালও যে সন্তানদের কষ্ট দেখতে পারতো না, স্ত্রীর মলিন মুখ সহ্য করতে পারতো না আজ সে হৃদয়হীন বাবা ও স্বৈরাচারী স্বামীতে পরিণত হয়েছে। কাছে ঘেষলেই সন্তানদেরকে প্রহার করে, চোখের সামনে পেলেই স্ত্রীকে ধমকাতে থাকে। যে মানুষ অত্যন্ত ব্যক্তিত্ববান ছিল, নিজের মর্যাদার ব্যাপারে সীমাহীন সতর্ক ছিলো, এখন কোনো কোনো রাতে মাতাল বন্ধুদেরকে নিয়ে বাড়ি ঢুকে পড়তে তার বিবেকে বাঁধে না। আমি ও আমার সন্তানেরা যে ফ্লাটে থাকি, হৈ হৈ করে তারা সে ফ্লাটে ঢুকে পড়ে। একটি রুম দখল করে সেখানে হল্লা করে মদপান করে । তাদের  চিৎকার চেচামেচিতে বাড়ির পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। তারপর সারা বাড়িতে একজনের পিছনে আরেকজন দৌড়াতে থাকে। এক সময় তারা আমার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। কেউ আমার মুখে থাপ্পড় মারে। কেউ ওড়না টেনে নিতে চায়। আমার স্বামীর চোখের সামনেই। সে কিছুই বলে না। সামান্য  সংকোচবোধও করে না। আমি তাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য এ ঘর থেকে ও ঘরে ছুটতে থাকি। তারা পাশব চিৎকারে আমার পিছু ধাওয়া করে। কখনো এমন হয়েছে যে, আমি আমার ঘর থেকে পালিয়ে বের হয়ে এসেছি, অথচ আমার গায়ে এক সুতো কাপড় নেই। অন্ধকারের চাদরে নিজেকে জড়িয়ে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। সেখানেই ভয়ানক আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি।

তার কথার আওয়াজ কান্নার আড়ালে চাপা পড়ে গেলো। সে মাথা নিচু করে গুমরে কাঁদতে লাগলো। আমিও কান্না আটকে রাখতে পারলাম না। এক সময় সে মাথা তুলে আবার বলতে শুরু করল-

অল্পদিনের মধ্যেই তার হাতের সব অর্থ নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। এরপর ঋণ করা ছাড়া গতি রইলো না। যখন ঋণের বোঝাও ভারি হয়ে গেলো তখন ঘরের জিনিসপত্র বন্ধক রাখতে শুরু করল। এরপর যখন বন্ধক নিতেও কেউ রাজি হল না তখন সে সবকিছু বেঁচে দিলো। এমনকি আমরা যে ঘরে বাস করছি সে ঘরটিও বিক্রি হয়ে গেছে। এরপর তার হাতে কেবল সামান্য পরিমাণ মাসিক ভাতা রইলো। অবশ্য সেটাও ক্ষণিক সময়ের জন্য। সেই টাকাও খানিকবাদে হয় পাওনাদারের হাতে চলে যেতো নয়তো জুয়ার টেবিলে নিঃশেষ হয়ে যেতো। কালের কঠোর হাত তাকে এভাবেই থাপ্পড় মেরেছে।

আর আমাদের সাথে যা ঘটেছে তা হল, সংসার চালাতে গিয়ে এক বছর ধরে অলংকার বিক্রয় করতে করতে আমি আমার শেষ অলংকারটিও বিক্রি করে ফেলেছি। সুদী মহাজন বা বন্ধকীদের ঘরে গিয়ে দেখুন, আমার কাপড়-চোপড় ও ঘরোয়া জিনিসে তাদের ঘর পূর্ণ হয়ে আছে। একজন হতদরিদ্র সৎ প্রতিবেশি যদি তার সংসার থেকে বাঁচিয়ে মাঝে মাঝে সামান্য খাবার না দিতো তাহলে আমি ও আমার সন্তানেরা না খেয়ে মারা যেতাম।

এই হতভাগা মানুষটিকে তার অভিশপ্ত জীবন থেকে বের করে আনতে আপনি আমাকে সাহায্য করতে পারেন। আপনার সাথে তার যে হৃদ্যতা ছিল, তার উপর ভরসা করে বলতে পারি, সবাই ব্যর্থ হয়েছে। আপনি নিশ্চয়ই ব্যর্থ হবেন না। যদি আমাদের জন্য এটা করেন তাহলে আপনার অনুগ্রহের কথা আমরা মৃত্যু অবধি ভুলবো না।

মহিলাটি সালাম দিয়ে চলে গেলেন। আমি বালকটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার পিতাকে এ বাড়িতে কখন পাবো? সে বলল, সকালে সে বের হওয়ার আগেই আপনি বাসায় আসুন। আমি বাড়ি ফিরে এলাম, কিন্তু এমন একটি কষ্ট সাথে করে নিয়ে এলাম যা আমাকে সারারাত ঘুমাতে দিল না। কতক্ষণ শুয়ে, কতক্ষণ বসে, কতক্ষণ অস্থিরভাবে পায়চারি করে রাত কাটলো। আহা কী দীর্ঘ একটি রাত!

পরের দিন  প্রত্যুষে আমি পুরোনো বন্ধুর সাথে সাক্ষাতের জন্য বের হয়ে পড়লাম। গতকাল যখন এই শহরে পা রাখি তখনও তার বন্ধুত্বের প্রতি আমার কী বিপুল আস্থা ছিল, কিন্তু এখন আমি অনুমানও করতে পারছি না, তার সাথে আমার বন্ধুত্বের পরিণতি কী হবে!

যে যুদ্ধে সবকিছু নিঃশেষ হয়ে গেছে সে যুদ্ধের মাঠে পুনরায় প্রবেশের আগে যে অনুভূতি হয়  আমার ভিতরে সে অনুভূতি কাজ করছে। এ যুদ্ধে আমি সবকিছু পুনরুদ্ধার করতে পারি  অথবা  শেষ সম্ভাবনাটুকুও খুঁইয়ে বসতে পারি।

এখন আমি বুঝতে পারি মুখ হল মনের আয়না। মনের আলোয় মুখ উজ্জ্বল হয় আর মনের অন্ধকারে মুখ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।  সাত বছর আগে আমি তাকে শেষবারের মত দেখেছিলাম। এখন তার আগের চেহারাটা মনেও করতে পারছি না। চেহারা মনে করতে গেলে স্মৃতিতে কেবল একটি লাবণ্যময় দীপ্তি ভেসে উঠছে। ব্যক্তিত্ব ও আভিজাত্বের দীপ্তি, যার সামনে সূর্যের আলোও ম্লান হয়ে যায়। এখন যখন তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি, তার চেহারায় ব্যক্তিত্বের সেই দীপ্তি, আভিজাত্যের সেই উজ্জ্বলতা আর খুঁজে পাচ্ছি না। আমি যেন ভিন্ন কারো মুখের দিকে তাকিয়ে আছি, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি যেন সেই মানুষ নয়, যাকে আমি চিনতাম। লাবণ্যময় সুন্দর চেহারার সেই যুবকটিকে আর খুঁজে পেলাম না, যার মুখের প্রতিটি বিন্দুতে লাবণ্যময় হাসি ঝিলমিল করতো। তার পরিবর্তে আমি আমার সামনে বিপর্যস্ত উদভ্রান্ত একটি লোকের মুখ দেখতে পেলাম, বার্ধক্যের আগেই যে বুড়িয়ে গেছে। বয়স ত্রিশ না পেরোতেই ষাটে পৌঁছে গেছে। দৃষ্টি লক্ষ্যহীন, কপাল ও ভ্রুতে ভাঁজ পড়ে গেছে। কুঁজো মানুষের মতো দুই কাঁধ উঁচুতে উঠে গেছে আর মাথা  নেমে গেছে নিচের দিকে। প্রথম যে কথাটি আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো তা হল, ‘বন্ধু! তোমার সবকিছু বদলে গেছে, এমনকি মুখটাও। সম্ভবত সে আমার মনের ভাব ধরে ফেলেছে। অথবা বুঝে ফেলেছে যে, আমি তার সব কথা জেনে গেছি। তাই এমনভাবে মাথা নিচু করে ফেলল যেন মাটি ফুঁড়ে ভিতরে ঢুকে যেতে পারলে বাঁচে। সে শুধু চুপ করে রইল। আমি তার কাঁধে হাত রেখে বললাম, আল্লাহর শপথ! আমি বুঝতে পারছি না তোমাকে কী বলবো। আমি কী তোমাকে নসীহত করবো? অথচ কিছুদিন আগে তুমিই আমাকে নসীহত করতে। তুমি ছিলে এমন নক্ষত্র যার আলোয় পথ দেখে দেখে আমি জীবনের অন্ধকার পথ পাড়ি দিয়েছি। আমি কী তোমাকে তোমার দায়িত্ব সম্পর্কে জ্ঞান দেবো? অথচ আমি যা কিছু জানি তার সবকিছু তুমিও জানো। আমি কি তোমার অসহায় পুত্র ও হতভাগা স্ত্রীর জন্য অনুতাপ প্রকাশ করবো, যাদের তুমি ছাড়া কোনো আশ্রয় কিংবা অবলম্বন নেই? যারা দূরের তাদের প্রতিও তোমার হৃদয় ছিল বিগলিত, যারা কাছের আজ তাদের প্রতি একটুখানি সদয় হও!

হে বন্ধু! এই যে জীবন পার করছো তা তোমাকে কেবল নিস্ফল অশ্রুই দিতে পারে। কিন্তু অশ্রুর আড়ালে জীবনের সব অপরাধ লুকিয়ে ফেলা যায় না। তুমি তো দুনিয়ার উপর কোনো প্রতিশোধ নিচ্ছো না বা তার কোনো ক্ষতি করতে পারছো না। তাহলে কেনো কবরের পথে হাঁটা শুরু করলে? কেনো রিক্ত নিঃস্ব অবস্থায় দুনিয়া থেকে বের হয়ে যেতে চাচ্ছো? আমাকে ক্ষমা করো! যদি তুমি এই জীবনের লাভের সাথে আগের জীবনের ক্ষতিকে তুলনা করো তাহলে সে ক্ষতিটাকেই বেশি লাভজনক মনে হবে। তখন ধনী ছিলে এখন দরীদ্র হয়ে গেছো। তখন সুস্থ ছিলে এখন অসুস্থ হয়ে পড়েছো। তখন সম্মানিত ছিলে এখন অবহেলিত হয়ে গেছো। এতকিছুর পরও যদি তুমি মনে করো তুমি সুখী তাহলে এই পৃথিবীতে হতভাগা মানুষ আর একটিও নেই। এই জীবনের কাছে একটি জিনিসই তুমি চাইতে পারো তাহলো মৃত্যু । তুমি একটি কাজ করো। এক পেয়ালা বিষ চেয়ে নিয়ে এক ঢোকে খেয়ে ফেলো। এতে তুমি প্রতিদিন একটু একটু করে মরার চেয়ে, যাতে কষ্টও বেশি, পাপও বেশি, সহজে মরবে। আর ওভাবে মরলে দুনিয়ায় এ জীবনে যে আযাব হবে তা পরজীবনের আযাবের চেয়ে কম নয়।

এক জীবনে নিয়তি আমাদের কপালে যত কষ্ট লিখে রাখে তা-ই অনেক। নতুন করে কষ্ট কুড়াবার প্রয়োজন হয় না।

বন্ধু! হাত বাড়িয়ে দাও। শপথ করো তুমি আগের জীবনে ফিরে আসবে। দুজনে মিলে আমরা আগে কত সুখি ছিলাম। যখন আলাদা হলাম তখনই দুর্ভাগ্য নেমে এলো। আজ আমরা আবার একত্রিত হয়েছি। এসো সম্মান ও মর্যাদায় ঘেরা সুখের জীবনে আমরা আবার ফিরে আসি।

আমি তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু সে দেখি আমার দিকে হাত বাড়াচ্ছে না। আমি দ্বিধাস্থ গলায় বললাম, তুমি কেনো হাত বাড়াচ্ছো না? সে কেঁদে ফেলে বলল, হাত বাড়াচ্ছি না, কারণ আমি মিথ্যাবাদী বা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী হতে চাই না। বললাম, প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে বাঁধা কোথায়? সে বলল, আমি আসলে দুর্ভাগা। সৌভাগ্যবানদের সুখে আমার কোনো অধিকার নেই। আমি বললাম, তুমি যদি নিজেই নিজের দুর্ভাগ্য ডেকে আনতে পারো তাহলে এখন সুখ আনতে সমস্যা কোথায়?  সে বলল, সুখ হল দূরের আকাশ আর দুঃখ হল কাছের মাটি। আকাশে উঠার চেয়ে মাটিতে নেমে যাওয়া সহজ।

প্রবৃত্তির গর্তে আমার পা পিছলে গেছে। এ গর্তের গহীন সীমানায় না পৌঁছা পর্যন্ত আমি কোনো কিছু আকড়ে ধরে পতন ঠেকাতে পারছি না। আমি তিক্ত জীবনের প্রথম ঢোক পান করে ফেলেছি। এ পেয়ালা খালি না হওয়া পর্যন্ত আমি থামতে পারছি না। একটি জিনিসই আমার পতন ঠেকাতে পারতো, তাহলো ওই প্রথম ঢোক পান না করা। কিন্তু আমি তো তা করে ফেলেছি। সুতরাং এখন নিয়তির কোলে নিজেকে ছেড়ে দেয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই। আমি বললাম, একটি মাত্র দৃঢ় সংকল্প তোমাকে এ পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে। সে বলল, সংকল্প বলা হয় এক ধরণের ইচ্ছাকে। আমার মধ্যে এখন ইচ্ছা অনিচ্ছা কোনোটাই নেই। নিয়তির ভেলায় চড়ে নরকের পথে সফর করছি। তুমি আমাকে আমার মতো ছেড়ে দাও। কপালে যা লেখা আছে তাই হবে। আর যদি কোনো হতভাগা পাপিষ্ঠের জন্য কাঁদতে তোমার অসুবিধা না হয় তাহলে তোমার পুরোনো বন্ধুর জন্য কেঁদো।

এরপর সে অঝোরধারায় কাঁদতে কাঁদতে উদভ্রান্তের মতো দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। আমিও ফিরে এলাম।

বুকের পাঁজরে যে কী পরিমাণ ব্যথা ও হতাশা নিয়ে ফিরলাম, আল্লাহই তার তার খবর জানেন।

সেই শহরপ্রধান বেশিদিন আর তার ‘পানসঙ্গী’কে সহ্য করতে পারলো না। তার কাজকর্মে অতিষ্ঠ হয়ে তাকে বরখাস্ত করল ও বেতন-ভাতা বন্ধ করে দিল। নিজের হাতে নষ্ট হওয়া মানুষটিকে বিপদে ফেলতে তার মন একবারও কাঁদলো না। চোখ দিয়ে একফোঁটা অশ্রুও ঝরল না।

আমার বন্ধু যার কাছে নিজের বাড়িটি বিক্রি করেছিল সে বেশিদিন সেই বাড়িতে থাকতে দিল না, পরিবার সমেত তাকে বের করে দিল। বন্ধুটি তার স্ত্রী-সন্তানদেরকে নিয়ে শহরের বাইরে একটি পরিত্যক্ত বাড়ির ছোট্ট কুটিরে গিয়ে উঠল। আমি প্রায়ই তাকে পানশালায় যেতে অথবা পানশালা থেকে ফিরতে দেখতাম। যখন পানশালায় যেতে দেখতাম তখন মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে নিতাম। আর যখন ফিরতে দেখতাম তখন তার মুখে লেগে থাকা মাটি ও ঘাম মুছে দিয়ে বাড়ি পর্যন্ত দিয়ে আসতাম। এভাবে দিন ও বছর কেটে যেতে লাগল। আর সেই বন্ধুটির মস্তিষ্ক ও শরীর একটু একটু করে ক্ষয়ে যেতে লাগল। এক সময় সে মানুষের কাছে অপসৃয়মাণ ছায়া অথবা প্রতিদিন দেখা দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে উঠল। সে দিশেহারা মাতালের মতো টলতে টলতে রাস্তা ধরে হেঁটে যেতো।  গাড়ি-ঘোড়া ধাক্কা মেরে চলে গেলেও সে কিছু টের পেতো না। চলতে চলতে হঠাৎ করে থমকে দাঁড়াতো, নিজের চারপাশে হারিয়ে যাওয়া কিছু খুঁজে ফিরতো। অথচ হারানোর মতো আর কিছুই বাকি ছিল না। সে বারবার নিজের জামা-কাপড়ের দিকে তাকিয়ে দেখতো, অথচ সেখানে ফাটা আর তালি ছাড়া কিছুই ছিল না। কেউ হেঁটে আসতে লাগলে তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাতো, যেন ভয়ানক কোনো শত্রুকে দেখছে, অথচ তার কোনো শত্রুও ছিল না, বন্ধুও ছিল না। কখনো কখনো পথের শিশুরা তার ঘাড় ধরে ঝুঁলে পড়ত। সে সামান্য আপত্তি করত যেন ঘুমন্ত মানুষকে জাগানো হচ্ছে। যখন তার পেট মদ থেকে খালি হয়ে যেত, মস্তিষ্ক স্বাভাবিক হয়ে উঠত তখন আবার সে পানশালায় দৌড়ে যেত। মদ পান করতে করতে আগের অবস্থা ফিরে আসলে পুনরায় রাস্তায়  নেমে পড়ত।

এভাবেই চলতে লাগল, অবশেষে গত কয়েক মাস ধরে নতুন যা ঘটছে তার বিবরণ হল;

স্ত্রী-লোকটির দৈনন্দিন খাবারের বন্দোবস্ত শেষ হয়ে গেছে। বাচ্চা দু’টি চোখের সামনে সর্বক্ষণ কাঁদতে থাকে। মুখের ভাষায় যা বলতে পারে না, চোখের পানিতে তা বলে ফেলে। অবশেষে বাধ্য হয়ে খাদ্য আহরণের প্রাচীন পথটি তাদেরকে বেছে নিতে হল। পুত্র ও সন্তানটিকে তিনি কোনো এক ধনাঢ্য লোকের বাড়িতে কাজের লোক হিসেবে পাঠিয়ে দিলেন। তারা সেখানে খায়। মায়ের জন্য খাবার নিয়ে আসে। খুব সামান্য সময়ের জন্য তিনি  পুত্র ও কন্যাটিকে দেখতে পান। স্বামীকে দেখতে পাওয়া আরো দুরুহ ব্যাপার। যেদিন রাতে রাস্তার পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাড়ি ঢুকতে পারে সেদিন সে বাড়িতে আসে। অবশ্য এ সুযোগ খুব কমই হয়। ফলত একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে স্ত্রী-লোকটি দীর্ঘ দীর্ঘ রাত, দীর্ঘ দীর্ঘ দিন একাকী পড়ে থাকে। একেবারে একা। অবশ্য মাঝে মাঝে একজন বৃদ্ধা প্রতিবেশি তাকে দেখতে আসে। একটুখানি গল্প করে যাওয়া। যখন সেও চলে যায়, সবকিছু একেবারে নিস্তরঙ্গ হয়ে পড়ে তখন সুখময় অতীত তার স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে। ব্যক্তিত্ববান স্বামী ও আকাশের নক্ষত্রের মত সুন্দর শিশুদেরকে নিয়ে কী চমৎকার জীবন তারা কাটিয়ে এসেছে। তারপর ভাবনায় এক এক করে আসতে থাকে, কী করে একজন নিরেট ভালো মানুষ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেল। সবার প্রিয় মানুষটি লাঞ্ছনার শেষ সীমানা স্পর্শ করে ফেলল। যেন একটি অতি মূল্যবান মুক্তার মালা ছিড়ে গেছে, তার দানাগুলো পথের ধুলোয় লুটোপুটি খায়, পথচারিরা পায়ের তলে পিষে চলে যায়। নারীটি চারপাশে অসীম শুন্যতার হাহাকার নিয়ে সর্বহারার  মত কাঁদতে থাকে।

অবাক ব্যাপার হল, যে লোকটির জন্য আজ তার এতো দুর্দশা, বাচ্চাগুলোর মুখের দিকে তাকানো যায় না, সেই মানুষটির প্রতি তার একটুও ক্ষোভ নেই। একবারও তাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা মনে মনেও ভাবে না। কারণ সে একজন আদর্শ নারী। আদর্শ নারীরা কখনো হতভাগা স্বামীদেরকে দাগা দেয় না। মমতাময়ী মা যেভাবে তার অবুঝ শিশুর ভুলগুলোকে দেখে, সেভাবেই সে তার স্বামীর পদস্খলনকে দেখে। স্বামীর প্রতি একটি অব্যক্ত মমতা সব সময়ই হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে রাখে। স্বামী যদি অসুস্থ হয় তাহলে সারারাত তার পাশে বসে শুশ্রুষা করে, যদি আঘাত পায় তাহলে জখম পরিস্কার করে ব্যান্ডেজ করে দেয়।

কোনো কোনো দিন টাকা না থাকলে মদের দোকানদার তার স্বামীকে ঘাড় ধরে বের করে দেয়। সে বাড়িতে এসে হিংস্র শাপদের মতো স্ত্রীর উপর চড়াও হয়। মদ কেনার টাকা চাইতে থাকে। স্ত্রী বেচারী বাধ্য হয়ে খাবারের টাকা অথবা ঘরের খাবার বেচে স্বামীর হাতে টাকা তুলে দেয়, যেন বেচারা অন্তত প্রাণে বেঁচে থাকে।

নির্মম নিয়তি তার পিঠে এতো বোঝা দিয়েও শান্ত হয়নি। নতুন আরেক ভার দিয়েছে। একদিন নিঃসঙ্গ সময়ে সে তার গর্ভাশয়ে প্রাণের স্পন্দন টের পায়। সে বুঝতে পারে এ অভাগা গৃহে আরেক অভাগার আগমন ঘটছে। সে চিৎকার করে বলে ওঠে- খোদা রহম করো! দুঃখে এ ঘর ভরে গেছে। আর এক ফোঁটা দুঃখ ধারণের জায়গা নেই।

দীর্ঘ নয় মাস  হতভাগা এ নারী রোগ, শোক ও গর্ভ-যন্ত্রণা ভোগ করার পর তার সন্তান প্রসবের মুহূর্তটি এসে গেল। তখন তার পাশে কেবল সেই বৃদ্ধা প্রতিবেশিনী ছিল। স্রষ্টার কৃপায় গর্ভপাতের কাজটি সেই সারল। কিন্তু গর্ভপাতের পর তার রক্তক্ষরণ আর বন্ধ হল না। ফ্রীতে চিকিৎসা করবে এমন ডাক্তারও খুঁজে পাওয়া গেল না। যে দেশে ডাক্তাররা রোগী মেরে ফেলে খুনের পারিশ্রমিক চাইতে লজ্জাবোধ করে না সে দেশে কেউ ফ্রীতে রোগী দেখে দেবে এমন আশা করা বোকামী। মৃত্যু নারীটির কাছে হামাগুড়ি দিয়ে আসতে আসতে এক সময় তাকে খপ করে ধরে ফেলল। যখন সে মারা যায়, পাশে কেউ ছিল না, শুধু সদ্য জন্ম নেয়া শিশুটি তার স্তনে মুখ  রেখে কাঁদছিল।

ঠিক সেই মুহুর্তে মাতাল স্বামীটি উন্মাদের মতো চিৎকার করতে করতে ঘরে এসে ঢুকল। ক্রুদ্ধ চোখে চারদিকে তাকিয়ে স্ত্রীকে খুঁজতে লাগল। তার এখন তার মদের পিপাসা। শিশুটি মায়ের পাশে শুয়ে কাঁদছিল। মাতাল স্বামী ভাবলো মহিলাটি বোধহয় ঘুমিয়ে আছে। কন্যা শিশুটিকে দূরে ছুড়ে ফেলে স্ত্রীকে ধরে ঝাঁকাতে লাগল। কিন্তু স্ত্রী লোকটি একটুও সাড়া দিল না। সে সন্দিহান হয়ে পড়ল। অজানা একটি ভয় তার শিরা বেয়ে মনের মধ্যে ঢুকে পড়ল। সে ঝুঁকে পড়ে স্ত্রীর মুখে সজোরে থাপ্পড় মারতে লাগল। চারপাশে ঘুরে ঘুরে তাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। হঠাৎ স্ত্রীর তাকিয়ে থাকা স্থির দুটো চোখ তাকে সচকিত করে তুলল। ভয়ে চিৎকার করে সে ঘর থেকে দৌড়ে বের হওয়ার সময় কন্যা শিশুটির বুক পা দিয়ে মাড়িয়ে দিল। মেয়েটি একবারের জন্য অস্ফূট একটি চিৎকার করে চিরদিনের জন্য নিরব হয়ে গেল। লোকটি বুঝতে পেরে কেঁদে ফেলল, হায় দুর্ভাগ্য! হায় নিয়তি!

লোকটি বাইরে বের হয়ে উন্মাদের মতো রাস্তা ধরে হাঁটছে, রাস্তার পাশের দেয়ালে, লাইটপোস্টের পিলারে সজোরে মাথা ঠুকছে। সামনে মানুষ বা প্রাণী যে আসছে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছে আর চিৎকার করে বলছে, হায় আমার কন্যা! হায় আমার স্ত্রী! ফিরে এসো! আমাকে ধরো। আমি আর চলতে পারছি না।

এক সময় সে পথের উপর লুটিয়ে পড়ল। বলি দেয়া শুকরের মতো চিৎকার করতে করতে সজোরে মাটিতে পদাঘাত করতে লাগল। চার পাশে মানুষের ভীড় জমে গিয়েছিল। তারা দুঃখ করতে লাগল। লোকটিকে চেনে বলে নয়, বরং লোকটির চেহারায় তারা দুর্ভাগ্যের শিলালিপি পাঠ করে ফেলেছিল।

এরপর যখন তার জ্ঞান ফিরল তখন বোঝা গেল, লোকটি চিরদিনের জন্য পাগল হয়ে গেছে। এখন সে পাগলা গারদে বাস করে। সব সময় শিকলে বাঁধা থাকে। আমি মাঝে মাঝে তার শহীদ স্ত্রী ও কন্যার কথা স্মরণ করে নিরবে অশ্রুপাত করি।

The post একজন মাতালের গল্প appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%8f%e0%a6%95%e0%a6%9c%e0%a6%a8-%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%97%e0%a6%b2%e0%a7%8d%e0%a6%aa/