Wednesday, August 31, 2022

মধুপুর গড়াঞ্চল : যেভাবে গারোরা খৃস্টান জনগোষ্ঠীতে পরিণত হল

মুনশী নাঈম:

টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলার মধুপুর গড়াঞ্চলে বসবাসরত গারো সম্প্রদায়ের শতভাগ সদস্য খৃস্টান মিশনারীদের হাতে খৃস্টধর্ম গ্রহণ করেছে। মধুপুর গড়াঞ্চলে মোট জনগণের ৩২.৫৭% খৃস্টান ধর্মের অনুসারী। সেখানে গারোদের সংখ্যা ১৩,৫৯৯। খৃস্টধর্ম গ্রহণ করার পর তাদের সামাজিক রীতি-নীতিতেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। তারা এখন আর তাদের ঐতিহ্যবাহী ধর্ম ও সমাজ-সংস্কৃতিকে খুব বেশি মূল্যায়ন করে না। শুধু সেগুলোকেই মূল্যায়ন করে যেগুলো খ্রিস্ট ধর্মের সাথে সাংঘার্ষিক নয়। যেগুলো খ্রিস্টধর্মের সাথে দ্বন্ধ ও বৈরিতা সৃষ্টি করে সেগুলোকে তারা বর্জন করেছে। গারো জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানেও দেখা যায় খ্রিস্টীয়করণের প্রভাব। এসব উৎসবে ঐতিহ্যের কিছু বিষয় টিকে থাকলেও সব পালিত হয় খ্রিষ্টীয় রীতিতে।

সেভ বাংলাদেশ মিশনের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খৃস্টান মিশনারীদের কার্যক্রমের অন্যতম একটা এরিয়া হচ্ছে টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলার মধুপুর গড়াঞ্চল। ব্রিটিশ আমল থেকে মিশনারীরা গারোদের মাঝে কার্যক্রম শুরু করে। ভারতে ধর্মান্তরিত গারো খৃস্টানদের মাধ্যমে মূলত বাংলাদেশের গারোদের মাঝে তারা কার্যক্রম চালায়। মিশনারীদের কার্যক্রমের ফলে গারো সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের আদি সাংশারেক ধর্ম ছেড়ে প্রায় ৯৯.১০% গারো এখন খৃস্টান ধর্মের অনুসারী।

ইতিহাস ঘেঁটে জানা গেছে, বাংলাদেশে বসবাসরত গারো সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীরা মঙ্গোলীয় বংশদ্ভূত। এদের আদিনিবাস চীনের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের সিন-কিয়াং প্রদেশে। পরবর্তীতে বিভিন্ন সমস্যায় পতিত হয়ে দেশত্যাগ করে তারা তিব্বতে দীর্ঘদিন বসবাস করে। এরপর ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের পার্বত্য এলাকায় এবং বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের কিছু এলাকায় তারা বসবাস করে। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড় এবং বাংলাদেশের মধুপুর গড়ের বনাঞ্চলকে কেন্দ্র করে মূলত গারোদের নিবাস গড়ে উঠেছিল। বর্তমানে গারো সম্প্রদায়ের অধিকাংশ জনগণের বসবাস ভারতের মেঘালয়ের গারো পাহাড়ে। এছাড়া বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের মধুপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, জামালপুর, গাজীপুরে এদের বিশাল বসবাস রয়েছে।

ফাদার ইউজিন: মিশনারীদের মূলহোতা

মধুপুরে গারো সম্প্রদায়কে খৃস্টান বানানোর পেছনে সবচে বড় ভূমিকা ফাদার ইউজিন হোমরিকের। তার ধর্মান্তর কার্যক্রমের মাধ্যমে মূলত গারো জনগোষ্ঠী সাংশারেক ধর্ম থেকে খৃস্টান ধর্মে রূপান্তরিত হয়। ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের এই ধর্মপ্রচারক ১৯৫৯ সালে মধুপুরে ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে আসেন।

তিনি মধুপুরের জলছত্র ও পীরগাছায় গিয়ে প্রথমে সেখানকার গারোদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার জন্য কাজ করেছেন। তিনি শিক্ষার গুরুত্ব এবং শিশুদের শিক্ষিত করার প্রয়োজনীয়তা অভিভাবকদের কাছে গিয়ে বলতেন। জনগণের নৈতিক গুণাবলীর বিষয়েও তিনি আলোচনা করতেন। সুখে-দুঃখে মানুষের পাশে থাকাতে তিনি সে এলাকার জনপ্রিয় ব্যক্তি হয়ে উঠেন। এছাড়াও তিনি স্থানীয় পোশাক এবং সংস্কৃতির আলোকে জীবন পরিচালনা করতেন। সেখানকার মানুষের সাথে মিশে যেতেন। এভাবে তিনি সেখানে ধর্মপ্রচার ও ধর্মান্তরের জন্য একটা অনুকূল পরিবেশ প্রথমে সৃষ্টি করেছিলেন। তারপর ধর্মপ্রচারের ফলে ধর্মান্তরের মিশন শুরু করেন।

তার ধর্মান্তরের ক্ষেত্রে নীতি ছিল, কোনো জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে ধ্বংস না করে সেই সংস্কৃতির মধ্যেই তাকে ধর্মান্তর করা। ফলে তিনি গারো জনগোষ্ঠীকে তাদের সংস্কৃতির মধ্যেই ধর্মান্তর করেছিলেন। তারপর তাদের যেসব সংস্কৃতির বিষয়গুলো খৃস্টান ধর্মের বিশেষত ক্যাথলিকদের সাথে সাংঘার্ষিক সেগুলোর মধ্যে খৃস্টান সংস্কৃতি ঢুকিয়ে টিকিয়ে রাখতেন। এভাবে তিনি তার ধর্মান্তর ও সংস্কৃতির সমন্বয় করতেন।

ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের গারো আদিবাসীদের খৃস্টান ধর্মে ধর্মান্তরকরণে এবং খৃস্টান হওয়ার পরবর্তীতে পুরো জনগোষ্ঠীর সমাজ ও সংস্কৃতিতে ক্রিস্টানাইজেশনের প্রক্রিয়ার সাথে তিনি জড়িত ছিলেন। ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি এ কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। মধুপুরের আগে তিনি ময়মনসিংহ অঞ্চলের গারো জনগোষ্ঠীর ধর্মান্তর্করণে কাজ করেন।

গারোদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় মিশনারী

চিকিৎসা সেবা প্রদানের মাধ্যমে মূলত খৃস্টান মিশনারীরা মধুপুরের গারো জনগোষ্ঠীর মাঝে কার্যক্রম শুরু করে। সেখানে তারা দুইটি হাসপাতাল, একাধিক আশ্রম ও চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। তারমধ্যে অন্যতম যক্ষা ও কুষ্ঠ হাসপাতাল এবং ডাক্তার এডরিক বেকারের হাসপাতাল। তারা চিকিৎসা সেবা দিয়ে মানুষদেরকে খৃস্টান ধর্মে আকৃষ্ট করছে। তাছাড়া পীরগাছা, মাগস্তিনগরসহ কয়েকটি জায়গায় আশ্রম আছে। এসন আশ্রমেও তারা চিকিৎসা সেবা প্রদান করে। জলছত্রে অবস্থিত মাদার তেরেসা চ্যারিটিতে অন্যান্য সেবার পাশাপাশি মানুষকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করে থাকে। এর বাইরেও গর্ভবতীদের চিকিৎসা, প্রসূতি মায়ের সেবা প্রদান, বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান, গরীব-দুঃস্থদের খাদ্য ও পোষাক দিয়েও সাহায্য করে থাকে।

তবে মিশনারীরা চিকিৎসার পাশাপাশি বেশি জোর দিয়েছে শিক্ষায়। সেভ বাংলাদেশ মিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মধুপুরে ৬৫ টি এনজিও স্কুল আছে। এগুলোর অধিকাংশই মিশনারীদের স্কুল। মাধ্যমিক স্কুল ২টি, সেমিনারী স্কুল ১ টি, শিশু পল্লী ১ টি, প্রতিবন্ধী স্কুল ১ টি এবং প্রায় ৪৫ এর অধিক প্রাথমিক স্কুল আছে। মিশনারী হিউজিন হোমরিক একাই ৩০ এর অধিক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল করেছিলেন।

মধুপুর গড়াঞ্চল সরেজমিন পরিদর্শন করে সেভ  বাংলাদেশ মিশন প্রতিবেদনটি তৈরী করেছেন কেরামত আলী। তিনি ফাতেহকে বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মধুপুরে তিন ধরনের ক্যাটাগরির শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেখা যায়। প্রাথমিক স্কুল, মাধ্যমিক স্কুল ও সেমিনারী ভুল। মধুপুরে খৃস্টান মিশনারীরা প্রাইমারি শিক্ষার প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। গারো বসবাসরত প্রায় প্রতিটি গ্রামেই মিশনারী (প্রাইমারি) স্কুল আছে। যেসব গ্রামে খৃস্টান মিশনারীদের একাধিক সম্প্রদায়ের (যেমমন: ক্যাথলিক, ব্যাপটিস্ট চার্চ অব বাংলাদেশ ইত্যাদি) কার্যক্রম ও জনগণ আছে, সেসব গ্রামে একাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। তবে অন্ততপক্ষে ন্যূনতম একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় গারো বসবাসরত গ্রামগুলোতে আছে।

তিনি আরও বলেন, মাধ্যমিক স্কুল আছে দুটি। একটি জলছরে কর্পাস খ্রীষ্টি হাই স্কুল এবং অন্যটি পীরগাছায় অবস্থিত সেন্ট পৌলস মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়। উভয় স্কুলে গারো, বাঙ্গালি, খৃস্টান, হিন্দু ও মুসলিম সবাই পড়াশোনা করতে পারে। বর্তমানে মাধ্যমিক স্কুলগুলো সরকারী এমপিও ভুক্ত হয়েছে। আগে খৃস্টান শিক্ষক থাকলেও আধা-সরকারী হওয়ার ফলে এখন খ্রিষ্টানের পাশাপাশি অন্য ধর্মের বাঙ্গালি শিক্ষক ও নিযুক্ত আছে। তবে খৃস্টান না হলে স্কুলের হোস্টেল সুবিধা পাওয়া যায় না।

ধর্মীয় বিষয়ে পড়াশোনা করানো এবং ধর্মযাজক তৈরী করার লক্ষ্যে মধুপুরে আছে সেমিনারী স্কুল । মধুপুরের জলছত্রে সেভেন্থ এডভেন্টিস্ট সেমিনারী এন্ড স্কুল এবং সেন্ট পলস মাইনর সেমিনারী স্কুল দুটি সেখানে খ্রিষ্টীয় ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান ও ধর্ম যাজক তৈরীতে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সেমিনারী স্কুলে একমাত্র খৃস্টানরাই পড়তে পারে। ময়মনসিংহ ধর্মপ্রদেশের বর্তমান বিশপ পরেন পল কবি এটার প্রথম পরিচালক ছিলেন। বর্তমানে এর পরিচালক ফাদার উৎপন রিচি। ২০২০ সালের মধ্যে এ সেমিনারী থেকে ১৫ জন ধর্মযাজক হয়েছেন। এবং ৩ জন ডিকন ধর্মযাজক হওয়ার পথে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারী স্কুল বা মুসলিম মালিকানাধীন বেসরকারী স্কুল খুবই কম। অনেক গ্রামে কোন স্কুল নেই। যা আছে মিশনারীদের প্রাইমারি স্কুল। এদিক থেকেও একটা সংকট দেখা দিচ্ছে। সেখানকার অনেক মুসলিমদেরকে বাধ্য হয়ে মিশনারীদের স্কুলে পড়াশোনা করতে হচ্ছে। খৃস্টান মিশনারীদের শিক্ষাক্ষেত্রে কার্যক্রমের ফলে মধুপুরের গড়াঞ্চলে বাঙ্গালি সমাজের তুলনায় গারো খৃস্টানরা শিক্ষার দিক থেকে অনেক অগ্রসর। শিক্ষার দিক থেকে গারোরা ৭৮.৭৫% হলেও বাঙ্গালির শিক্ষার হার মাত্র ৫৮.৬২% ।

গারোদের পর হিন্দু-মুসলিম টার্গেট

সেভ বাংলাদেশ মিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মধুপুরে খৃস্টান মিশনারীদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কার্যক্রম চলছে। তারমধ্যে রোমান ক্যাথলিক, ব্যাপটিস্ট, সেভেন্টথ ডে এডভেনটিস্ট, চার্চ অব বাংলাদেশ, গারো ব্যাপটিস্ট কনভেনশন অন্যতম। খৃস্টান মিশনারী সংস্থাগুলোর ধর্মান্তরের কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন এনজিও যেমন কারিতাস, ওয়ার্ল্ড ভিশন, ওয়াইএমসিএ, সালোম ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান, সেবা, ও উন্নয়নমূলক কাজ করে থাকে।

সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট এন্ড হিউম্যান ডেপেলপমেন্ট এক জরিপে বলেছে, মধুপুর গড়াঞ্চলে ইসলাম ধর্মে ৫৯.৪৬%, খৃস্টান ধর্মে ৩২.৫৭% হিন্দু ধর্মের ৭.৮৮% এবং গারোদের আদিধর্ম সাংসারেক ধর্মের ০.০১% অনুসারি। ঐ এলাকায় কর্মরত খৃস্টান মিশনারী ও তাদের সংস্থাগুলো গারো জনগোষ্ঠীকে খৃস্টান বানিয়ে তাদেরকে খৃস্টান ধর্মে ধরে রাখার পাশাপাশি এখন মুসলিম ও হিন্দুদেরকেখৃস্টান বানানোর পরিকল্পনা নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ৫ টি ইউনিয়নের ৪৪ টি গ্রামে ইতোমধ্যে ১৪৫ জন বাঙ্গালি হিন্দু ও মুসলিমকে মিশনারীরা খৃস্টান বানিয়েছে।

খৃস্টান মিশনারীরা শুধুমাত্র ধর্মান্তর ও ধর্মান্তরিতদের দিয়ে খৃস্টান ধর্ম পালন করানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই বরং বিভিন্ন ধর্ম ও জনগোষ্ঠী থেকে খৃস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়া জনগণের ক্ষমতায়ন নিয়েও কাজ করে থাকে। বরং এটাকে গুরুত্বের সাথে তারা বিবেচনা করে থাকে। ক্ষমতায়নের জন্য তারা ঐ এলাকার গারো খৃস্টানদের দিয়ে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে থাকে। এতে তারা যে কোন বিষয় নিয়ে আন্দোলন করতে পারে। যেকোন বিষয়ের প্রতিবাদ করতে পারে। যেকোন ইস্যুতে সংগঠনগুলোকে কাজে লাগানো যেতে পারে। লোকাল সংগঠনের মধ্যে রয়েছে জয়েনশাহী আচিকমিকি, আজিয়া আবিদা ইত্যাদি। এছাড়াও দেশব্যাপী গারোদের সংগঠনের মধ্যে বাগাছাস গাছে, বিজিও রয়েছে।

কর্মসংস্থান দিচ্ছে মিশনারীরা

খৃস্টান মিশনারীদের মধুপুরে কার্যক্রমের অন্যতম একটা অংশ হচ্ছে কর্মসংস্থান প্রকল্প। শিল্প-কারখানা থেকে শুরু করে সিল্ক তৈরী, হস্তশিল্প ও আয়মূলক কাজে জড়িত করে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকুরি দিয়ে কৃষিকাজের জন্য লোন দিয়ে তারা উক্ত এলাকায় কর্মসংস্থানের জন্য কাজ করে থাকে। বিশেষ করে যারা খৃস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয় তারা এ সুবিধা ভোগ করে। তাছাড়াও অনেককে এ ধরনের সুবিধা দিয়ে থাকে খৃস্টান বানানোর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে।

সেভ বাংলাদেশ মিশনের প্রতিবেদক কেরামত আলী বলেন, মধুপুরে খৃস্টান মিশনারীদের একটি প্রকল্প হলো কারিতাস সিল্ক। সেখানে গারো ও বাগানি উভয় কাজ করতে পারে। আরেকটি হচ্ছে কারিতাসের মান্ড এন্ড ইন্ড্রাস্ট্রি। এ দুইটা ইন্ড্রাস্টি মধুপুরের অরণখোলা ইউনিয়নের জলাহরে অবস্থিত। মধুপুরের পীরগাছা গ্রামে আছে নকরেকনি জুমাং তাঁতশিল্প। এছাড়াও মধুপুরে খৃস্টান বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও এনজিওগুলোতে গারো খৃস্টান জনগোষ্ঠী কাজের সুযোগ পায়। এতে অনেকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। গারো শিক্ষিতরা বিভিন্ন এনজিওতে কাজের সুযোগ পাচ্ছে। ফলে সেখানকার গারো খৃস্টান অর্থনৈতিক অবস্থা মুসলিম সমাজের তুলনায় অনেক ভালো।

গারো জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য খৃস্টান মিশনারীদের বিভিন্ন সংস্থা, যেমন: কারিতাস, ওয়ার্ল্ড ভিশন, গারো ব্যাপটিস্ট কনভেনশন, সালোম, ওয়াইএমসিএ সহ বিভিন্ন এনজিও কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বেশকিছু প্রজেক্টও চালু আছে গারো জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য। গারো শিশুদের উন্নয়নের জন্য ওয়ার্ল্ড ভিশনের শিশু উন্নয়ন প্রকল্প, মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া শিশু উন্নয়ন প্রকল্প বর্তমানে প্রচলিত আছে। এছাড়াও ইউএনডিপি, এডিপি, আইপিডিএসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন প্রকল্প মধুপুরে গারো জনগোষ্ঠীর মাঝে কাজ করে থাকে। খৃস্টান মিশনারী সংস্থা বা তাদের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত এনজিওগুলো মধুপুরে গারো জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করে থাকে।

গারো সমাজে খৃস্টান সংস্কৃতির প্রভাব

ধর্মান্তরের ফলে গারো সমাজে খৃস্টান সংস্কৃতির প্রভাব বেশ প্রকটভাবে বদ্ধমূল হচ্ছে দিনকে দিন। তারা এখন আর তাদের ঐতিহ্যবাহী ধর্ম ও সমাজ-সংস্কৃতিকে খুব বেশি মূল্যায়ন করে না। শুধু সেগুলোকেই মূল্যায়ন করে যেগুলো খ্রিস্ট ধর্মের সাথে সাংঘার্ষিক না। যেগুলো খ্রিস্ট ধর্মের সাথে দ্বন্ধের বৈরিতা সৃষ্টি করে সেগুলোকে তারা বর্জন করেছে।

গারো জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানেও দেখা যায় খ্রিস্টীয়করণের প্রভাব দেখা যায়। তাদের অন্যতম একটি উৎসব ওয়ানগালা। বর্তমানে ওয়ানগালা উৎসবে তাদের সাংশারেক ধর্মের বিষয়গুলো উহ্য করে সেখানে খৃস্টান ধর্মের কিছু বিষয় সংযোজন করা হয়েছে। ধর্মীয় উৎসবের ক্ষেত্রে গারোরা বড়দিন ইস্টার সানডে ও ছোটদিন পালন করে থাকে। এখন গারোদের জন্ম-মৃত্যু ও বিয়েকেন্দ্রিক বিভিন্ন উৎসবে-অনুষ্ঠানে ধর্মযাজকের প্রয়োজন পড়ে। নাম রাখা থেকে শুরু করে মৃত্যার পর শেষকৃত্যও পালিত হয় খৃস্টান ধর্মের আলোকে। গারোদের ছিল মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। এখন তাদের মাঝে মাতৃতান্ত্রিকতা আর আগের মতো কার্যকর নেই। তাদের সমাজে আইন ও বিচারব্যবস্থা থেকে শুরু করে পরিবার পরিচালনা, পরিবারের মূল সিদ্ধান্ত প্রণয়ন সমাজ কাঠামো ইত্যাদিতে বর্তমানে পুরুষের ভূমিকাই বেশি।

তাছাড়া আগে বিয়ের পর গারো সমাজে নারীরা পুরুষদের জামাই হিসেবে বাপের বাড়ি নিয়ে আসতো। কিন্তু বর্তমানে বেশিরভাগ পুরুষরা জামাই হিসেবে শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে না এবং তারা বউদের নিজেদের বাড়িতে এনে বসবাস করছে। আগেকার গারো সমাজে একমাত্র নারীরাই সম্পদের মালিকানা পেত। এখন নারী-পুরুষ সবাই সম্পতি পায়। গারোরা আগে অন্য সম্প্রদায়ের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে লিপ্ত হতো না। কিন্তু এখন অনেক গারোই বাঙ্গালি হিন্দু বা মুসলিম থেকে ধর্মান্তরিত খৃস্টানদের সাথে বিবাহে আবদ্ধ হচ্ছে। তবে খৃস্টান ধর্মের বাইরে অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে তাদের সমাজে একেবারে নিষিদ্ধ। যদি কেউ খৃস্টান ধর্মের বাইরে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় তাহলে তাকে পরিবার, সমাজ ত্যাগ করতে হয়। চার্চ থেকে ধর্মযাজক তার নাম কেটে তাকে মৃত ঘোষণা করে।

মধুপুরে মুসলিম দায়ীদের কার্যক্রম

মধুপুরে খৃস্টধর্মের দাওয়াত যতটা আয়োজন করে দেয়া হয়েছে, ইসলাম ধর্মের দাওয়াত ততটা দেয়া যায়নি। খৃস্টান মিশনারীদের প্রবল জোয়ারের সামনে বেশ কয়েকটি মুসলিম সংস্থা কাজ শুরু করেছিল। তাদের মধ্যে অন্যতম—নিউ মুসলিম এজেন্সি, আঞ্জুমানে খাদেমুন, আহলে হাদিস ইত্যাদি। বিশেষ করে নিউ মুসলিম এজেন্সির দাওয়াতে টিকলি গ্রামে অনেকেই মুসলিম হয়৷ বর্তমানেও ওই গ্রামের ১২০০ মানুষের মধ্যে ৫০০ জন মুসলিম।

তবে বর্তমানে এসব কার্যক্রম আর চালু নেই। সরেজমিন অভিজ্ঞতায় কেরামত আলী বলেন, আওমান খাদেমুন এবং আহলে হাদিসের কার্যক্রম প্রথমে সবাইকে মুগ্ধ করলেও সেটা বেশিদিন টিকে থাকেনি। প্রথমদিকে ভালো কার্যক্রম করলেও কিছু কিছু নেতিবাচক ঘটনা এলাকাবাসীকে হতাশ করে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ অর্থনৈতিক কেলেংকারীর সাথে জড়িয়ে পড়েছিল। তাছাড়া আহলে হাদিস ও কওমি হুজুরদের মধ্যে মসজিদে বাড়াবাড়ি ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছিল। এদের নেতিবাচক কার্যক্রমের জন্য মধুপুরে ইসলামী দাওয়াতী মিশন সম্পর্কে বদনাম ছড়ায়। যার ফলে বর্তমানেও ইসলাম সম্পর্ক খৃস্টান গারো জনগোষ্ঠীর মধ্যে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। বর্তমানে সেই এলাকায় পরিকল্পনা নিয়ে ইসলামি দাওয়াতের কার্যক্রম পরিচালনা করলে সফলতা লাভ করা যাবে। এতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনামাফিক কাজ করতে হবে। নাহলে খৃস্টান মিশনারিদের কার্যক্রমের ফলে অদূর ভবিষ্যতে এ এলাকার মুসলিম জনগোষ্ঠীও খৃস্টান ধর্ম ধর্মান্তরিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।

The post মধুপুর গড়াঞ্চল : যেভাবে গারোরা খৃস্টান জনগোষ্ঠীতে পরিণত হল appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%ae%e0%a6%a7%e0%a7%81%e0%a6%aa%e0%a7%81%e0%a6%b0-%e0%a6%97%e0%a7%9c%e0%a6%be%e0%a6%9e%e0%a7%8d%e0%a6%9a%e0%a6%b2-%e0%a6%af%e0%a7%87%e0%a6%ad%e0%a6%be%e0%a6%ac%e0%a7%87-%e0%a6%97%e0%a6%be/

Tuesday, August 30, 2022

স্কুলে ছাত্র নেই, নূরানী মাদরাসা বন্ধে চাপ বাড়ছে রাউজানে

রাকিবুল হাসান নাঈম:

চট্টগ্রাম রাউজান থানার নূরানী মাদরাসাগুলো বন্ধ করে দিতে মাদরাসার সভাপতি, সেক্রেটারি এবং মুহতামিমদেরকে চাপ দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। মাদরাসা বন্ধ না করলে দেখানো হচ্ছে প্রশাসনের ভয়ও। চলতি বছরের শুরু থেকেই একের পর এক উপর মহল থেকে চাপ আসছে। বিভিন্ন সময় ডাকা হচ্ছে মিটিং, মুহতামিমদের শাসাচ্ছেন প্রাইমারি শিক্ষাকর্মকর্তারাও।

রাউজান থানার বিভিন্ন মাদরাসার মুহতামিমদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। তারা বলছেন, চাপটা দেয়া হচ্ছে মৌখিক, ভয়টাও দেখানো হচ্ছে মৌখিক। উপর মহলের লিখিত কোনো নির্দেশনা তাদেরকে দেখানো হয়নি। মিটিংয়ে কর্মকর্তাদের মুখের ভাষা দিনকে দিন শালীনতার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

স্থানীয় আলেমদের তথ্য হলো, রাউজান থানায় প্রায় একশত মাদরাসা রয়েছে।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধির চাপ

এ প্রসঙ্গে কথা হয় রাউজান থানার হলুদিয়া ইউনিয়নের এক নূরানী মাদরাসার পরিচালকের সঙ্গে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই মুহতামিম ফাতেহকে জানান, ‘নূরানী মাদরাসা বন্ধের চাপটা শুরু হয় বছরের শুরুতে, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে। তখন স্থানীয় চেয়ারম্যান ইউনিয়ন অফিসে মাদরাসার মুহতামিমদের ডাকেন।’

চেয়ারম্যানের বক্তব্য কী ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তিনি বলেছেন, প্রাইমারি স্কুলে ছাত্রছাত্রী কম। নূরানী মাদরাসায় বেশি। অথচ স্কুল সরকার অনুমোদিত, মাদরাসা সরকার অনুমোদিত নয়। তার নির্দেশনা ছিল, আমরা যেন নূরানীর ছাত্রদেরকে স্কুলে দিয়ে আসি। মাদরাসায় বাংলা-ইংরেজি পড়ানো চলবে না। চলবে শুধু মক্তব।’

শিক্ষা অফিসারের চাপ

ইউনিয়ন পরিষদে ডেকে নিয়ে চেয়ারম্যানের নির্দেশনার পর বিষয়টি নিয়ে তেমন আর উচ্চবাচ্য হয়নি। সর্বশেষ গতমাসে জুলাইয়ে ইউনিয়ন পরিষদে আবারও মিটিং ডাকা হয়। এতে নূরানী মাদরাসার সঙ্গে ডাকা হয় কেজি স্কুলের কর্ণধারদেরও। প্রতিটি মাদরাসার পক্ষ থেকে ডাকা হয় মাদরাসার সভাপতি, সেক্রেটারি এবং মুহতামিমকে। এই মিটিংয়ে নূরানী মাদরাসা বন্ধের নির্দেশনা দেন উপজেলা শিক্ষা অফিসার আবদুল কুদ্দুস।

এ প্রসঙ্গে হলুদিয়া নূরানী মাদরাসার মুহতামিম বলেন, ‘মিটিংয়ে বেশ কড়াভাবে কথা বলেন এই শিক্ষা অফিসার। তিনি বলেন, আগামীকাল থেকে নূরানী মাদরাসা বন্ধ করবেন। নয়ত প্রশাসনের ভয়ও দেখান তিনি।’

উপস্থিত প্রতিনিধিদের কেউ সেখানে কথা বলেনি? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদেরকে কথা বলার সুযোগই দেয়া হয়নি। আমাদের একজন কিছু বলতে যাচ্ছিলো। শিক্ষা অফিসার মুখের ভাষা খারাপ করে বললেন, ‘আপনাকে ত সন্ত্রাসের মতো দেখায়।’ ভাষা খারাপ করার কারণে আর কেউ কথা বলার সাহস করেনি।

স্থানীয় আলেমদের উদ্যোগ

দ্বিতীয়বার মিটিংয়ের পর বেশ চাপে পড়ে যায় স্থানীয় নূরানী মাদরাসাগুলো। করণীয় নির্ধারণে আশু মিটিং ডাকে রাউজান থানার আঞ্চলিক কওমি শিক্ষাবোর্ড জমিয়াতুল উলামা। মিটিংয়ে ৬০টি মাদরাসার মুহতামিম উপস্থিত হন।

মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, নূরানী মাদরাসার বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় এমপির সাথে আলেমরা মতবিনিময় করবে। এরজন্য একটি কমিটিও গঠন করে দেয়া হয়। কিন্তু এমপির সঙ্গে পরবর্তীতে আর আলেমদের মতবিনিময় হয়নি।

মতবিনিময় না হওয়া প্রসঙ্গে জমিয়াতুল উলামার মহাসচিব ফাতেহকে বলেন, ‘এপমির সঙ্গে আলাপে যদি হিতে বিপরীত হয়, তাই আর আলোচনা করা হয়নি। বিষয়টি যেভাবে আছে, সেভাবেই রেখে দেয়া হয়েছে।’

চট্টগ্রাম নূরানী শিক্ষাবোর্ড কী বলছে

জমিয়াতুল উলামার পক্ষ থেকে যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তারমধ্যে অন্যতম একটি সিদ্ধান্ত হলো, চট্টগ্রাম নূরানী শিক্ষাবোর্ডে বিষয়টি জানানো। এবং তাদেরকে আশু পদক্ষেপ গ্রহণে জোর দেয়া। পরবর্তীতে বিষয়টি নূরানী শিক্ষাবোর্ডের মহাসচিব মুফতি জসিমুদ্দিন সাহেবকে অবহিত করা হয়।

নূরানী বোর্ডের প্রতিক্রিয়া কী ছিল জানতে চাইলে জমিয়াতুল উলামার মহাসচিব বলেন, ‘মুফতি জসিমুদ্দিন সাহেব বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা যেন স্থানীয় এবং উপজেলা পর্যায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের কাছে যাই এবং তাদেরকে বুঝাই। তারপর বিষয়টি নিয়ে কী করা যায়, বোর্ড ভাববে।’

বেশি চাপ পাহাড়ের নূরানী মাদরাসায়

জুলাইয়ে শিক্ষা কর্মকর্তার নির্দেশনার পর আরও দেড়মাস পেরিয়ে গেছে। শহরের মাদরাসাগুলোতে এখন চাপ নেই। তবে পাহাড়ের নূরানী মাদরাসাগুলো বন্ধে এখনও যথেষ্ট চাপ বিদ্যমান বলে জানিয়েছেন জমিয়াতুল উলামার মহাসচিব।

তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘আমাদের সরব হবার কারণে হয়ত আমাদের উপর এখন চাপ নেই। তবে পাহাড়ি নূরানী মাদরাসাগুলোতে যথেষ্ট চাপ আছে। আমাকে সেখানের আলেমরা বলেছেন, তাদেরকে মাদরাসা বন্ধ করে দিতে চাপ দেয়া হচ্ছে। প্রশাসনের ভয় দেখানো হচ্ছে। পাহাড়ের এই নূরানী মক্তবগুলোও চট্টগ্রাম নূরানী শিক্ষাবোর্ডের অধীনে।’

তবে পাহাড়ের নূরানী মাদরাসাগুলোতে এখন চাপ নেই বলে জানিয়েছে নূরানী শিক্ষাবোর্ডের কর্মরত আলেম মাওলানা আনিসুল ইসলাম।

নূরানী শিক্ষাবোর্ড পরিদর্শনে গোয়েন্দারা

আজ, ৩০ আগস্ট নূরানী বোর্ড পরিদর্শনে এসেছেন ডিজিএফআই, এনএসআই, ডিআইজিসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। পরিদর্শন শেষে তারা সার্বিক পরিস্থিতি বিষয়ে সন্তুষ্টিও প্রকাশ করেছেন।

এ প্রসঙ্গে আনিসুল ইসলাম বলেন, ‘তারা এসেছিল নূরানী মাদরাসায় কী পড়ানো হয় তা জানতে। আমরা তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রদের হস্তলিপি, ইংরেজি পড়া উপস্থাপন করেছি। তারা মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন।’

নূরানী মাদরাসা বন্ধ প্রসঙ্গে গোয়েন্দারা কী বলেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তারা নিশ্চয়তা দিয়েছেন, মাদরাসা বন্ধ হবে না। তারা সরকারের উচ্চমহলে জানাবেন। মাদরাসা চালু রাখার জন্য যা করা দরকার করবেন।’

এর আগে নূরানী শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তারা প্রশাসনের সঙ্গে মাদরাসা বন্ধ করা প্রসঙ্গে কথা বলেছেন বলেও জানান তিনি।

The post স্কুলে ছাত্র নেই, নূরানী মাদরাসা বন্ধে চাপ বাড়ছে রাউজানে appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%95%e0%a7%81%e0%a6%b2%e0%a7%87-%e0%a6%9b%e0%a6%be%e0%a6%a4%e0%a7%8d%e0%a6%b0-%e0%a6%a8%e0%a7%87%e0%a6%87-%e0%a6%a8%e0%a7%82%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a7%80-%e0%a6%ae/

Monday, August 29, 2022

তাবিজ-তদবির-রুকইয়া : প্রতারণার ফাঁদে পড়ছে মানুষ

রাকিবুল হাসান নাঈম:

তাবিজ-তদবির-রুকইয়াকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটি প্রতারক চক্র। তাদের মনোহারী বিজ্ঞাপন, চটকদার ভাষায় মোহিত হয়ে শরিয়াসম্মত চিকিৎসা নিতে গিয়ে বিভ্রান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। নিজের অজান্তেই জড়িয়ে পড়ছে শিরক ও বিদআতে। সংশ্লিষ্টগণ বলছেন, এই প্রতারক চক্রের সহজ শিকার হচ্ছেন তারা, ধর্মীয় জ্ঞান সম্পর্কে যারা অনভিজ্ঞ।

রাকিদের ভাষ্যমতে, ইসলামি শারিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে রুকইয়া হলো— কুরআনের সুরা বা আয়াত, হাদিসের দুআ এবং সালাফদের থেকে কোনো দুআ ইত্যাদির প্রয়োগ করে ফুঁ দেওয়া। রুকইয়ার সাথে কিছু সাপ্লিমেন্ট আছে, যা রোগীর কেইস ভেদে অতিব জরুরী, যেসব সাপ্লিমেন্ট ছাড়া রুকইয়ার অনেক কেইস যথাযথ সম্পন্ন হয় না। তার মধ্যে অন্যতম হলো—জমজম পানি, আজওয়া খেজুর, বরই ফুলের মধু, হিজামা, কালোজিরা দানা, যাইতুন তেল, ইন্ডিয়ান কস্টাস, সোনাপাতা, বরইপাতা ইত্যাদি। কিন্তু প্রতারক চক্র রুকইয়ার নামে শিরকি তাবিজ-কবজ, জ্বিন দিয়ে চিকিৎসা-সহ আরও বিভিন্ন ব্ল্যাক ম্যাজিকের মাধ্যম ব্যবহার করে৷

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই চক্রটি ফেসবুকে বেশ সক্রিয়। রুকইয়া সম্পর্কিত বিভিন্ন গ্রুপে তাদের পদচারণা থাকে হরদম। তারা চটকদার ভাষায় পোস্ট করে, রুকইয়ার গুরুত্ব ও নিজেদের সফলতার গল্প শোনায়। গ্রুপে কেউ পরামর্শ চাইলে তাকে বাগে আনার চেষ্টা চলে আপ্রাণ। তাদের ভাষা ও রোগ আরোগ্যের আত্মবিশ্বাস দেখে বিভ্রান্ত হয় মানুষ।

কারা প্রতারক

রাকির পরিচয় ও জাদুকরের পরিচয় সম্পর্কে জানা না থাকার কারণে মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে বলে মনে করেন উরফা হেলথ কেয়ারের সিইও এবং সিনিয়র কনসালটেন্ট রাকি মাওলানা উসামা হারুন। ফাতেহকে তিনি বলেন, অনেক কবিরাজ, প্রতারক ও ধান্দাবাজ নিজেদেরকে রাকি পরিচয় দিচ্ছে নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য। সেসব ভন্ড, প্রতারক , তান্ত্রিক , যাদুকর রাকি নামধারী কবিরাজের কাছে সরলমনা ও সোজাসাপ্টা মানুষগুলো প্রতারিত হচ্ছে। যার ফলে রুকইয়া ও রাকিদের বদনাম হচ্ছে। অন্যান্য পেশেন্টরা রুকইয়া ও রাকিদের সম্পর্কে ভয় পাচ্ছে। এর মূল কারণ হলো রাকির পরিচয় ও জাদুকরের পরিচয় সম্পর্কে জানা না থাকা।

প্রতারক রাকির চিহ্নগুলো কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা রোগী ও তার মা-বাবার নাম জানতে চাইবে। নিজেকে জ্বীন হুজুর পরিচয় দিবে। রোগীর কাছে তারা নিজের ব্যবহৃত কাপড়, চুল, পায়ের নিচের মাটি, শরীরের ময়লা , মৃত মানুষের মাথার খুলি, সাপের দাঁত, ফাঁসির রশি ইত্যাদি আরো অনেক কিছু চাইবে। পাশাপাশি রোগীর ছবি চাইবে। হাঁস-মুরগি, ছাগল -গরু জবাই করতে বলবে। তিন বা চার রাস্তার মাথায় খাবার দিতে বলবে। রোগীকে একা রুমে কিছু সময় থাকতে বলবে। কেউ কেউ নামাজ ও আমলের কথাও বলেন, পাশাপাশি তাবিজ কবজ দিয়ে থাকেন। তারা তুলারাশি দিয়ে কাজ করে বা তার উপর জ্বিন হাজির করে তথ্য নিবে ও চিকিৎসা করবে। এছাড়াও বিভিন্ন পদ্ধতিতে হাজিরা দেখবে । যেমন পানি, বদনা বা লোটা, সুতা , তাগী , কাইতন, বা কোনো পাত্রের পানিতে নাম দিয়ে। এছাড়াও আরো বিভিন্ন ধরনের গোপন ও গোনাহের বিষয় ও কাজের কথা বলতে পারে।

মানুষ প্রতারিত হয় কিভাবে

এ বিষয়ে কথা হয় সুকুন-লাইফের ফাউন্ডার এবং ইবাদা রুকইয়া সেন্টারের সিনিয়র কনসালটেন্ট মাওলানা মারুফ তাকির সঙ্গে। রাকিদের কাছে মানুষ প্রতারিত হবার বেশ কয়েকটি কারণ তুলে ধরেন তিনি।

১. রাকিরা নিজের ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার জন্য সাধারণ মেডিকেল ও মানসিক সমস্যাকে রুকইয়ার সমস্যা বলে চালিয়ে দেয়। কিছুটা কবিরাজের মতো, কেউ গেলেই তাকে জিনের বা নজরের রোগী বলে অভিহিত করে। এ-কথা অনস্বীকার্য, অনেক রোগী এমন আছেন যাদের রোগের সূত্রপাত এ জাতীয় সমস্যা থেকে হলেও পরবর্তী সময়ে তা বাস্তবে শারীরিক সমস্যায় রূপ নিয়েছে। তখন এই দুইয়ের সমন্বয় ছাড়া সুস্থতা সম্ভব হয় না।

২. কিছু রাকি মূলত কবিরাজি প্রেক্টিস করে। মানুষ যেহেতু নতুনভাবে রুকইয়ার প্রতি ঝুঁকছে তাই তারা এটাকে অপব্যবহার করে৷ জিনের কাছে সাহায্য চায়, আবার কখনো বিভিন্ন হারাম ও শিরকি মাধ্যমে চিকিৎসা করে। এই সময় তারা রোগী, তার স্বামী বা পিতার নাম জিজ্ঞেস করে। কখনো নিজস্ব জ্বিন রোগীর শরীরে ঢুকিয়ে ভেল্কিবাজি দেখায়।

৩. রাকিদের কাছে প্রতারিত হওয়ার আরেকটি বড় কারণ, যার কাছে রুকইয়া করছে তার ব্যাকগ্রাউন্ড না জানা। ইদানীং জেনারেল থেকে দীন প্রেক্টিস করা অনেক ভাই হালাল ইনকাম সোর্স ভেবে রুকইয়া ফিল্ডে কাজ করছেন। যাদের উলুমুশ শরীয়াহ সম্পর্কে কোনো জ্ঞান নাই, সনদ নাই এবং তাদের কোরআন তেলাওয়াতও অনেক সময় শুদ্ধ হয় না।

৪. রাকিদের মধ্যকার কিছু ঝামেলা দেখে মানুষ প্রতারিত হয়। বাস্তবে টেকনিক্যালি মতপার্থক্য তাদের ভিতর। কেউ বিদআতে হাসানা নামে নতুন উদ্ভাবিত জিনিস প্রেক্টিস করছে যা মাঝেমধ্যে ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত। অন্যদল কেবল সুন্নাহ ও সালাফগণের আমলের উপর সীমাবদ্ধ থাকার চেষ্টা করছে৷ তাই রোগীরা এই দুইয়ের মাঝে ধোকায় পরে।উভয় দলের সমস্যাকে ইখতিলাফি মাসালা না ভেবে কখনো দেখা যায় তারা রুকইয়া-ই ছেড়ে দিচ্ছে।

প্রতারণা থেকে বাঁচব কিভাবে

তাবিজ-তদবির-রুকইয়া সঠিক হওয়ার সর্বপ্রথম মাপকাঠি শরিয়ত। এই মাপকাঠির নিক্তিতেই সবকিছু মাপতে হবে। না মাপতে পারার কারণেই অনেকে প্রতারিত হন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

রাজধানীর প্রসিদ্ধ একটি রুকইয়া সেন্টারের ডিরেক্টর ফাতেহকে বলেন, প্রতারণা থেকে বাঁচতে সর্বপ্রথম রুকইয়া সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। জিনিসটা মূলত কী, চিকিৎসা কিসের মাধ্যমে হয়। দ্বিতীয়ত, অভিজ্ঞ কনসালটেন্টের সাথে সবসময় পরামর্শ করতে হবে। তৃতীয়ত, রুকইয়ার লক্ষণগুলো জানা থাকতে হবে। সন্দেহ হলে লক্ষণগুলো মেলাতে হবে। এ তিনটা জিনিস ঠিক থাকলে প্রতারিত হবার সুযোগ অনেকাংশে কমে যাবে।’

The post তাবিজ-তদবির-রুকইয়া : প্রতারণার ফাঁদে পড়ছে মানুষ appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%9c-%e0%a6%a4%e0%a6%a6%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%b0-%e0%a6%b0%e0%a7%81%e0%a6%95%e0%a6%87%e0%a7%9f%e0%a6%be-%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a4%e0%a6%be/

Sunday, August 28, 2022

বন্যায় বিপর্যস্ত পাকিস্তানকে সহায়তার ঘোষণা এরদোগানের

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

প্রবল বন্যায় বিপর্যস্ত পাকিস্তানকে সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে তুরস্ক।

তুরস্কের তথ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, পাকিস্তানে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে তুর্কিয়ের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সাথে টেলিফোনআলাপ করেছেন।

এসময় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট বলেন, বরাবরের মতো এই কঠিন সময়েও আমরা পাকিস্তানের জনগণকে সব ধরনের সাহায্য করতে প্রস্তুত। তিনি বন্যায় নিহতদের মাগফিরাত ও আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন।

সূত্র : জিয়ো নিউজ

The post বন্যায় বিপর্যস্ত পাকিস্তানকে সহায়তার ঘোষণা এরদোগানের appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%ac%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%a4-%e0%a6%aa%e0%a6%be%e0%a6%95%e0%a6%bf%e0%a6%b8%e0%a7%8d/

চালের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার

ফাতেহ ডেস্ক:

চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমদানি শুল্ক মওকুফ করা হয়েছে। পাশাপাশি রেগুলেটরি ডিউটি বা নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৫ শতাংশ করা হয়েছে। আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে।

এর আগে গত ২৪ জুন চালের ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছিল। এখন আরও ৫ শতাংশ কমিয়ে দেয়া হলো।

রোববার (২৮ আগস্ট) জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা রহমাতুল মুনিমের সই করা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ এক প্রজ্ঞাপনে এসব সিদ্ধান্তের কথা জানায়।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, এ সিদ্ধান্ত অবিলম্বে কার্যকর হবে যা চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বহাল থাকবে।

নতুন আদেশ অনুযায়ী চাল আমদানিতে এখন রেগুলেটরি ডিউটি বা নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৫ শতাংশ, আগাম আয়কর ৫ শতাংশ এবং অগ্রিম কর ৫ শতাংশসহ মোট ১৫. ২৫ শতাংশ শুল্ক-কর দিতে হবে।

এই আদেশ অটোমেটেড চাল ছাড়া সব ধরনের চাল আমদানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, এই সময়ের মধ্যে চাল আমদানির আগে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তার অনুমোদন নিতে হবে।

The post চালের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%9a%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%86%e0%a6%ae%e0%a6%a6%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%bf-%e0%a6%b6%e0%a7%81%e0%a6%b2%e0%a7%8d%e0%a6%95-%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a4%e0%a7%8d/

বাংলাদেশের সমৃদ্ধির বড় বাধা ৫ প্রাকৃতিক ‍দুর্যোগ: জাইকা

ফাতেহ ডেস্ক:

বাংলাদেশে পাঁচ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়মিত হয় বলে মনে করে জাপান সরকারের উন্নয়ন সংস্থা ‘জাইকা’। বন্যা, শহরের পানি বেড়ে সৃষ্ট বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন ও ভূমিকম্পসহ কয়েকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ এ দেশের নিত্যসঙ্গী। একইসঙ্গে ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও এ পাঁচ দুর্যোগ বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

রোববার (২৮ আগস্ট) বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এক সেমিনারে এসব তথ্য প্রকাশ করে জাইকা। এসময় উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম, জাইকা প্রেসিডেন্ট আকিহিকো তানাকার, জাইকার আবাসিক প্রতিনিধি ইয়ো হায়াকাওয়া প্রমুখ।

জাইকার জরিপে দেখা গেছে, নদীর কাছাকাছি থাকা জেলা বা শহরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি রয়েছে সিলেট শহর, যা সুরমা নদীর তীরে। চট্টগ্রাম শহর ও এর আশপাশের এলাকা যা কর্ণফুলী ও সাঙ্গু নদীর কারণে বন্যার ঝুঁকিতে আছে। এছাড়া অত্যন্ত ঝুঁকিতে থাকা আরও দুটি শহর হলো কক্সবাজার ও মহেশখালী এলাকা। এ শহরগুলো মাতামুহুরি ও বাঁকখালী নদীর তীরে অবস্থিত।

অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকিতে উপকূলীয় কয়েকটি এলাকা অর্থনৈতিকভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ। বেশ কয়েকটি এলাকায় অর্থনৈতিক অঞ্চলও গড়ে তোলা হচ্ছে। মাতারবাড়ি ও মহেশখালী ডেভেলপমেন্ট এরিয়া ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকিতে থাকলেও এসব এলাকায় পাওয়ার প্ল্যান্টস, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক ও উন্নয়নকাজ চলছে।

উপকূলীয় এলাকাগুলোর মধ্যে উচ্চঝুঁকিতে থাকা চট্টগ্রাম ও মিরসরাই এলাকায় বেশ কয়েকটি শিল্পপার্ক ও অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠেছে। এছাড়া এসব এলাকায় সেবা খাতের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে।

তবে নোয়াখালীর দক্ষিণাঞ্চলে জনসংখ্যা বাড়তে থাকায় তাদেরও একটি বড় সম্ভাবনা রয়েছে। দুর্যোগপূর্ণ আঞ্চলিক হাব হিসেবে বরিশাল ও ভোলা এলাকায় আলাদা করে অর্থনৈতিক গুরুত্ব তৈরি হচ্ছে। এটি ওই অঞ্চলের অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।

উপকূলীয় এলাকাগুলোতে জাইকার অর্থায়নে কয়েকটি প্রকল্প চলমান আছে বলে জরিপে উল্লেখ করা হয়। এরমধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড প্রজেক্ট, ডিজাস্টার রিস্ক ম্যানেজম্যান্ট প্রজেক্ট, ঢাকা ও রংপুরে রাডার সিস্টেম উন্নয়নে প্রকল্প ইত্যাদি। এ প্রকল্পগুলো ২০১৫ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত চলছে।

প্রতিষ্ঠানটি বলছে, উপকূলীয় উন্নয়ন এলাকাগুলোতে দুর্যোগ পূর্ববর্তী বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, যাতে দুর্যোগ মোকাবিলা করা যায়। চলমান অবকাঠামোগুলোর গুণগত মান উন্নত করা আবশ্যক। তবে বাংলাদেশে এখনো অনেক কম পরিমাণে মেইনটেইনেন্স বাজেট হয়। ফলে প্রকল্পগুলো তৈরি হওয়ার পর বেশিদিন টিকে না।

ভূমিকম্প ঝুঁকিতে থাকা এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকা। এখানে ভূমিকম্প হলে জনসংখ্যার পাশাপাশি শিল্প ও সেবা খাতের বিশাল ক্ষয়ক্ষতি হবে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঝুঁকি রয়েছে চট্টগ্রাম শহর। ভূমিকম্প হলে ঢাকায় যেসব ক্ষতি হতে পারে, চট্টগ্রামেও একই ধরনের ক্ষতি হওয়ার শঙ্কা দেখছে প্রতিষ্ঠানটি।

এছাড়া সবেচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা শহরের মধ্যে রয়েছে সিলেট ও ময়মনসিংহ এলাকা। ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ মোকাবিলায় এসব এলাকায় জাইকার অর্থায়নে ১০ বছর মেয়াদি পাঁচটি প্রকল্প চলছে।

The post বাংলাদেশের সমৃদ্ধির বড় বাধা ৫ প্রাকৃতিক ‍দুর্যোগ: জাইকা appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%b8%e0%a6%ae%e0%a7%83%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%a7%e0%a6%bf%e0%a6%b0-%e0%a6%ac%e0%a7%9c-%e0%a6%ac/

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করতে পারছে না মুসলিম প্রতিষ্ঠানগুলো

রাকিবুল হাসান নাঈম:

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রকাশ্য ও নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারছে না মুসলিম প্রতিষ্ঠানগুলো। সংশ্লিষ্টগণ বলছেন, নানা শর্ত ও নিয়মের বেড়াজালে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে সেবামূলক কাজ। দেখানো হচ্ছে এনজিও ব্যুরোর অনুমোদন না থাকার অজুহাত। ২০১৭ সালে এমন অজুহাতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বেশ কয়েকটি ইসলামি এনজিওর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছিল সরকার। এরমধ্যে রয়েছে, আল মারকাজুল ইসলামি, মুসলিম এইড বাংলাদেশ, ইসলামিক রিলিফ এবং আল্লামা ফয়জুল্লাহ ফাউন্ডেশন।

এনজিওগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হলেও সেটা না তোলার মতোই। নিষেধাজ্ঞা তোলার প্রক্রিয়াটি একেকজনের সঙ্গে একেকরকম। কাউকে সরাসরি কক্সবাজারেরর ক্যাম্পগুলোতেই কাজ করার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। কাউকে কক্সবাজারে কাজ করার অনুমোদন দেয়া হয়নি। বরং ভাসানচরের ক্যাম্পগুলোতে নির্দিষ্ট কিছু খাতে কাজ করার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। কেউ কেউ অনুমোদন ছাড়াই গোপনে কাজ করছে।

কাজ করতে হয় গোপনে

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন মওসুম ও প্রয়োজনে সেবাদান করে পিপলস্ ইমপ্রুভমেন্ট সোসাইটি অফ বাংলাদেশ (পিসব)। ক্যাম্পে কাজ করার জন্য সংস্থাটির এনজিও ব্যুরোর অনুমোদন নেই। তাই গোপনেই কাজ করতে হয় তাদের।

এ প্রসঙ্গে সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মাওলানা ইমরান হুসাইন হাবিবি ফাতেহকে বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন মওসুমে কাজ করি। যেমন বন্যায়, অগ্নিকাণ্ডের সময়, খাবার সঙ্কটে। অনুমোদন নেই বলে গোপনেই কাজটা করতে হয়।’

নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি (?)

২০১৭ সালে ক্যাম্পে কাজ করতে গিয়ে নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছিল আল্লামা ফয়জুল্লাহ ফাউন্ডেশন। সংস্থাটি পরে অনুমোদন পেয়েছে বলে জানিয়েছেন সেবাপ্রতিষ্ঠানটির কর্মী এবং চট্টগ্রাম ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার হারুনুর রশিদ। ফাতেহকে তিনি বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে একটা ভুল বুঝাবুঝি তৈরী হয়েছিল। পরে সেটা ঠিক হয়েছে। সরকার এখন আমাদেরকে ক্যাম্পে কাজ করার অনুমোদন দিয়েছে।

কী কী প্রকল্পে কাজ চলছে জানতে চাইলে তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘এখন শেল্টার তৈরী এবং খাদ্য বিতরণের প্রকল্প চলছে।’

নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছিল আল মারকাজুল ইসলামিও। পরে তাদেরকে কক্সবাজারে কাজ করার অনুমোদন দেয়া না হলেও ভাসানচরে কাজ করার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সংস্থার জেনারেল সেক্রেটারী মুফতি এনামুল হক ফাতেহকে বলেন, ‘আমাদের উপর নিষেধাজ্ঞা আসলে সেই অর্থে তুলে নেয়া হয়নি। আমাদেরকে ডেকে নিয়ে বলা হয়েছে, আমরা যেন ভাসানচরে কাজ করি। বিশেষ করে গ্যাস সিলিন্ডার বিতরণ করি। সেখানে আমরা ৬ হাজারের অধিক সিলিন্ডার বিতরণ করেছি।’

কক্সবাজারে আর কাজ হয়নি? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, আর কাজ করা হয়নি। এখন ভাসানচরেই সিমিত আকারে কাজ করছি।’

ধর্মীয় প্রকল্পে কাজ হচ্ছে না

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ধর্মীয় প্রকল্প, যেমন মক্তব-মাদরাসার কাজ ইসলামি এনজিওগুলো তেমন করতে পারছে না। সংশ্লিষ্টগণ বলছেন, নিরাপত্তা ও ডোনেশন এখানে বড় একটি ভূমিকা পালন করে।

ক্যাম্পে সংস্থার কোনো মক্তব প্রকল্প আছে কিনা জানতে চাইলে পিসবের পরিচালক মাওলানা ইমরান হুসাইন হাবিবি বলেন, ‘মক্তব-মাদরাসা প্রকল্প তো আছে। তবে সেটা আমরা প্রকাশ্যে করতে পারি না। সমস্যা হয়। তবে প্রকল্প আছে, কাজও চলছে।’

দাতারা যে কাজের জন্য ডোনেশন দেয়, কেবল সে কাজই করে আল্লামা ফয়জুল্লাহ ফাউন্ডেশন। ধর্মীয় প্রকল্পে তাদের কাজের কথা জানতে চাইলে লেকচারার হারুনুর রশিদ ফাতেহকে বলেন, ‘আমরা কাজ করি ডোনেশনভিত্তিক। এখন শেল্টার নির্মাণ ও খাদ্য বিতরণের ডোনেশন আছে। দাতারা এটার জন্যই দান করেছেন। ধর্মীয় প্রকল্পে ডোনেশন আসে না, তাই কাজ করা হয় না।’

ভাসানচরেও খুব সীমাবদ্ধতা নিয়ে কাজ করে আল মারকাজুল ইসলামি। ধর্মীয় প্রকল্পে কাজ করার সুযোগ হয় না। এ প্রসঙ্গে মুফতি এনামুল হক বলেন, ‘আমাদেরকে কেবল গ্যাস সিলিন্ডার বিতরণ করতে বলা হয়েছে। সেটাই করতে হয়। কোনো ধর্মীয় প্রকল্পে কাজ করতে পারি না। তবে প্রতিটি বিল্ডিংয়ে মসজিদ আছে, সেখানে মক্তব চালু আছে। মসজিদ ছাড়াও কিছু জায়গায় দেখেছি, রোহিঙ্গারা নিজস্ব উদ্যোগে মক্তব চালু করেছে। সেটা খুবই সংক্ষিপ্ত পরিসরে।’

The post রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করতে পারছে না মুসলিম প্রতিষ্ঠানগুলো appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%b0%e0%a7%8b%e0%a6%b9%e0%a6%bf%e0%a6%99%e0%a7%8d%e0%a6%97%e0%a6%be-%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a7%8d%e0%a6%aa%e0%a7%87-%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%9c-%e0%a6%95%e0%a6%b0/

Friday, August 26, 2022

‘সূর্যাস্তের আগে’ : বালাকোট আন্দোলনের শেষ দিনগুলো

খাজা হাসান মুঈনুদ্দীন

বালাকোট পরিচিতি

 

পাকিস্থানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের খাইবার-পাতুনওয়ার হাযারা প্রদেশে অবস্থিত মেনসেরা জেলা থেকে ৩৮ কি: মি: পূর্ব-উত্তরে অবস্থিত বালাকোট শহর। শহরটি আয়তনে তেমন বড় নয়। তবে কোলাহল মুক্ত ও ছিমছাম। দু’দিকে আকাশছোঁয়া কালুখান আর মেট্টিকোট পর্বত। মাঝ দিয়ে কুলকুল শব্দে বয়ে গেছে কুনহার নদী। উত্তরদিকের ‘মূসা কা মুছাল্লা’ পর্বতের বরফঢাকা চূড়া উপত্যকার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। নদীর দু’পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছে শহরটি। প্রায় লক্ষাধিক মানুষের বসবাস এই উপত্যকায়। কাগান ভ্যালির লুলুসার ঝিলের বরফগলা পানি থেকে উৎপত্তি ল কুনহার নদী অবশেষে আযাদ কাশ্মীরের ঝিলাম নদীতে গিয়ে মিশেছে। বড় বড় পাথরে ভরা নদীটি অসাধারণ সুন্দর। ভয়ংকর স্রোত আর বরফশীতল পানি। পাথরের ফাঁক গলিয়ে সগর্জনে যে তীব্রতায় পানির স্রোত ধেয়ে আসে তাতে এটি নদী নয় বরং শক্তিশালী পাহাড়ী ঝরণা ভেবে ভ্রম হয়। চারিদিকে টিলাঘেরা দূর্গম এই ঐতিহাসিক শহরটি আকর্ষণীয় পর্যটনস্থল হিসাবে বেশ প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। শহরটি কাগান উপত্যকার প্রবেশমুখ। লুলুসার লেক থেকে উৎসারিত কুনহার নদী এই শহরের পাশ দিয়ে বয়ে পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরে ঝিলাম নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। জনৈক বালাপীরের নামানুসারে এই অঞ্চলের নামকরণ করা হয় বলে জানা যায়। প্রাচীন বালাকোটে যেখানে ঐতিহাসিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তা ছিল পার্শ্ববর্তী মেটিকোট টিলা ও ঝরণা এলাকায়। উল্লেখ্য, ২০০৫ সালের ৮ই অক্টোবর এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে শহরটি প্রায় ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল। নিহত হয়েছিল প্রায় ২০ হাজার মানুষ। পরবর্তীতে সৌদি আরব, আরব আমিরাত ও পাকিস্তান সরকারের যৌথ সহযোগিতায় শহরটি আবার নতুন করে গড়ে উঠেছে।

পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী এই ভূমিকম্পে লক্ষাধিক মানুষ নিহত হয়েছিল কাশ্মীর ও খাইবার-পাখতুনখোয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে। বর্তমানে গোটা বালাকোট শহর স্থানান্তর করে নিউ বালাকোট সিটি নির্মাণ প্রক্রিয়া চলছে ২৫ কি.মি. দূরবর্তী বিকরাল এলাকায়। কেননা বর্তমান বালাকোট শহরটি ভূমিকম্পের দু’টি মারাত্মক ফল্ট লাইনের উপর সরাসরি পড়েছে। তাই যেকোন সময় বার ভূমিকম্পের সম্ভাবনা প্রবল।

যুদ্ধের পটভূমি:

পাক-ভারতে প্রত্যাগমন করে ১৮২৩ খ্রীষ্টাব্দের প্রথমভাগে সাইয়েদ সাহেব আত্মনিয়োগ করলেন শিখদের বিরুদ্ধে অভিযানে। মুজাহিদ ও অর্থসংগ্রহ করতে তিনি ব্যতি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তিনি দেশের প্রত্যেক ধর্মনেতার নিকট পত্র পাঠালেন যেন তারা ফরজ হিসেবে জিহাদের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ও জিহাদের জন্য সর্বতোভাবে সাহায্য করে। এভাবে ভারতের প্রত্যেক অংশে জিহাদের প্রস্তুতি ও প্রচারণা শেষ করে সাইয়েদ আহমদ শহীদ ১৮২৬ খ্রীষ্টাব্দে রায়বেরেলী ত্যাগ করেন। তারপর জীবনের বাকী ছয় বৎসর ধরে চলল আল্লাহর সত্য মহিমা প্রচারের ও পাঞ্জাবে নির্যাতিত মুসলিমদের উদ্ধারের জন্য বিরামহীন প্রত্যক্ষ সংগ্রাম।

গ্যনী কাবুল ও পেশোয়ার পার হয়ে বাহিনী নওশেরায় হাজির হলে পর শিখদের প্রকাশ্যে আহ্বান জানানো হলো ইসলাম গ্রহণ করতে, অথবা বশ্যতা স্বীকার করতে অথবা যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে শীঘ্রই এক নৈশযুদ্ধে মাত্র নয়শত মুজাহিদবাহিনী এক বৃহৎ শিখ বাহিনীকে এমন অনায়াসে পরাস্ত করল যে, সারা সীমান্ত প্রদেশ তাদের প্রশংসায় মুখর হয়ে উঠল। অতঃপর বহু স্থানীয় সরদার বিশেষ করে ইউসুফজায়ীরা সাইয়েদ সাহেবের সঙ্গে যোগ দিল।

কিছুদিন পর শের সিংহ ও একজন ফরাসী জেনারেলের অধীনে প্রায় তিরিশ হাজার শিখ সৈন্য পেশোয়ারের মোহাম্মদ খাঁ ও ভ্রাতাদের নিকট কর দাবী করল। খুবী খাঁ মনপুরী আক্রমণ করতে শিখবাহিনীর সাহায্য চাইলেন, এবং তিন হাজার শিখ তাঁর সাহায্যার্থে অগ্রসর হল। কিন্তু মুজাহিদবাহিনী মনপুর গ্রসর হলে শিখরা পঞ্চতরে সরে পড়ল, এবং সেখান থেকেও খণ্ডযুদ্ধে পরাজিত হয়ে পলায়ন করল।

পেশোয়ারবাসীরা তাঁকে নওশেরায় ঘাঁটি করতে ও শিখদের বিরুদ্ধে সামগ্রিকভাবে অভিযান চালাতে আহ্বান জানাল। এই সময় প্রায় একলক্ষ মুজাহিদ সৈয়দ সাহেবের ঝাণ্ডার তলে জমায়েত হয়। কিন্তু শেখ সেনাপতি বুধসিংহের প্রলোভন পেশোয়ারের সরদারগণকে বশীভূত করে ফেলল। এমন কি তারা যুদ্ধের পূর্বে সাইয়েদ সাহেবকে গোপনে বিষ পান করিয়ে ফেলে। যা হোক, সাইয়েদ সাহেব তীব্র বমি করে আল্লাহর রহমতে রক্ষা পেলেন, এবং একরকম অচৈতন্য অবস্থাতেই হস্তী পৃষ্ঠে যুদ্ধক্ষেত্রে গমন করেন। কিন্তু সম্মুখ সমরেও পেশোয়ারের সরদারগণ শিখদের সঙ্গে যোগ দেয়, এবং এভাবে মনোবল হারিয়ে মুজাহিদরা শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে। তখন তাদেরকে তিনটি দুশমনের মুকাবেলা করতে হয়— শিখ, পেশোয়ারের বিশ্বাসঘাতক ‘সর্দারগণ ও হুন্দের দুর্গ-মালিক খুবী খাঁ।

এই সময়ের মধ্যে শিখদের সঙ্গে যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই থাকতো। তাতে বাংলা, বিহার ও মধ্যপ্রদেশের হালকা গঠনের মুজাহিদরা বেশ কৃতিত্বের সঙ্গেই শক্তিমত্তা প্রকাশ করত। খিও বিশ্বাসঘাতক পাঠান গোত্রগুলি সমানভাবে তাদের হাতে মার খেত। পেশোয়ারের দুররানী সরদারেরা এরপর প্রকাশ্যভাবেই শিখদের সঙ্গে যোগ দিল, কারণ শিখদের টাকাকড়ির লোভ তারা দমন করতে পারল না। তারা বারে বারে মুজাহিদদের বিরুদ্ধে হামলা চালাত, কিন্তু প্রত্যেকবারই ভারা প্রতিহত হতো। খুবী খাঁ প্রকাশ্যে স্থানীয় লোকদের মুজাহিদদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে লাগলেন ।

সাইয়েদ সাহেব প্রথমে স্থির করলেন যে, খুবী খাঁকে শায়েস্তা করতে হবে। তিনি শাহ ইসমাইলকে মাত্র দেড়শত মুজাহিদ নিয়ে হুদ কিল্লাহ অধিকার করতে পাঠালেন। শাহ ইসমাইল রাত্রির অন্ধকারে অন্তরালে দুর্গদ্বারে উপস্থিত হলেন এবং প্রভাতে দ্বার খোলা হলেই নাটকীয়ভাবে প্রবেশ করে তিনি কিল্লাটা দখল করে ফেললেন। খুবী খাঁ নিহত হলেন। শাহ ইসমাইল দৃঢ়হাতে সব গোলযোগ দমন করলেন। অতঃপর সৈয়দ সাহেব কাশ্মীরে প্রধান ঘাঁটি স্থাপন করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন।

এদিকে তৎকালীন পেশোয়ারের সুলতান মুহাম্মাদ খাতেনের ষড়যন্ত্রে ইসলামী হুকুমতের ক্বাযী, তহসিলদারসহ বহু কর্মচারীর গণহত্যার ঘটনায় সাইয়েদ আহমাদ অত্যন্ত মর্মাহত হন এবং তিনি দ্বিতীয় দফা হিজরত করার মানসে কাশ্মীর অভিমুখে যাত্রা করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সাইয়েদ আহমাদ শহীদ রহ. যে পাঞ্জতার নামক স্থানে অবস্থানরত মুজাহিদ গোত্র ত্যাগ করেন এবং হাযারা জেলার উচ্চভূমির দিকে গমন করেন, তার উদ্দেশ্য ছিল কাশ্মীরের দিকে অগ্রসর হয়ে সেখানে কেন্দ্র স্থাপন করে উপমহাদেশকে বিধর্মী ও বিদেশীদের জবর দখল হতে মুক্ত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা। কাশ্মীরের দিকে অগ্রসর হবার প্রস্ত্ততি গ্রহণে সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান ছিল এই বালাকোট, সেকারণ এখানেই সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। অবশ্য প্রথম দিকে প্রধান সামরিক ঘাঁটি রাওয়ালপিন্ডিতে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল।

সাইয়েদ আহমাদ শহীদ তাঁর দীর্ঘ চার বছরের পাঞ্জতার ঘাঁটি ছেড়ে কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে যাত্রার সময়টি ছিল ডিসেম্বরের বরফঢাকা শীতকাল। সাইয়েদ আহমাদ কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে যে এলাকাটি ত্যাগ করেছিলেন শিখরা শীঘ্রই সে এলাকাটি দখল করে তথাকার জনগণের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন করল।

এ সময় কাশ্মীর গমনের পথে বিভিন্ন এলাকার খান ও সামন্তগণ যেমন- মুজাফ্ফরাবাদের শাসনকর্তা যবরদস্ত খান, খুড়া অঞ্চলের সামন্ত নাজা খান, দেরাবা অঞ্চলের সামন্ত মানসুর খান ও গাঢ়ী অঞ্চলের সামন্ত হাবীবুল্লাহ খান প্রমুখ সাইয়েদ আহমাদ শহীদের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করলেন। সাইয়েদ আহমাদ এই আবেদনে সাড়া দিয়ে যবরদস্ত খানের সাহায্যার্থে মৌলবী খায়রুদ্দীন শেরকুটীর নেতৃত্বে একদল মুজাহিদ মুযাফ্ফরবাদে প্রেরণ করলেন। এদিকে শিখ সেনাপতি রনজিৎ সিংহ-এর পুত্র শেরসিংহ বিরাট বাহিনী নিয়ে নখলী নামক স্থানে পৌঁছে যায়। ফলে সাইয়েদ আহমাদ উক্ত বাহিনী কোন দিকে অগ্রসর হয় তার গতিপথ নির্ণয় করে পরবর্তী করণীয় স্থির করাকে সমীচীন মনে করলেন। এ সময় তিনি মূল গন্তব্য কাশ্মীরের দিকে অগ্রসর হওয়ার নিমিত্তে শের সিং-এর বাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত না হয়ে এগিয়ে যেতে পারতেন, কিন্তু তা তিনি করেননি। কারণ হাযারাবেলাতে অবস্থানকারী সাইয়েদ আহমাদ-এর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে সম্পৃক্ত খানদের শিখ সেনারা অত্যাচারের শিকার বানাত। তাই তিনি তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত হাযারাতেই থেকে গেলেন। পরে যখন তিনি শুনতে পেলেন যে, শের সিংহ ভূগাড়মুঙ্গ গিরিপথ আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছে, তখন তিনি নিজে রাজদারওয়ান নামক স্থান হতে সারচুল নামক স্থানে পৌঁছান এবং শাহ ইসমাঈল শহীদকে বালাকোট পাঠিয়ে দিলেন। তারপর যখন তিনি জানলেন যে, শের সিং বালাকোট আক্রমণ করতে পারে তখন তিনি ভুগাড়মুঙ্গের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে নিজেই বালাকোটে চলে গেলেন। আর সেই সময় শের সিং-এর বাহিনী কুনহার নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত সোহাল নাজাফ খান গ্রামের সম্মুখে ময়দান নামক স্থানে শিবির স্থাপন করে।

শাহ ইসমাইল রাহ. বালাকোটে অবস্থানরত অবস্থায় কাশ্মীরের একটি প্রতিনিধি দল মাওলানার সাথে দেখা করে এ মর্মে আবেদন পেশ করে যে, বালাকোটে মুসলিম বাহিনীর আগমনে আমরা অত্যন্ত খুশী হয়েছি। এখান থেকে কাশ্মীর মাত্র তিন মনজিলের পথ। আমরা দুআ করছি যে, আল্লাহ তাআলা মুসলিম বাহিনীকে সত্বর আমাদের দেশে নিয়ে আসুন, যাতে আমরাও কাফিরদের জোর-জুলুমের হাত থেকে নাজাত পাই এবং আমীরুল মুমেনীনের নেতৃত্বাধীন ইসলামী হুকুমতের ছত্রচ্ছায়ায় স্বাধীনভাবে ইসলামী বিধি-বিধান ও কুরআন সুন্নার অনুসরণ করে চলতে পারি। এ প্রেক্ষিতে শাহ ইসমাইল কাশ্মীর অভিযানের অভিপ্রায়ের কথা সুচনে অবাস্থানরত সাইয়েদ সাহেবকে জানান। সাইয়েদ সাহেব সুচনের সরদার হাসান আলী খান ও হাবীবুল্লাহ খানের সঙ্গে পরামর্শ করলে তাঁরা বললেন যে, আপনি কাশ্মীর যেতে ইচ্ছা করলে অনায়াসে যেতে পারবেন। কিন্তু যদি এখানকার শিখ বাহিনীকে পরাস্ত করে না যান, তাহলে আপনাদের চলে যাওয়ার পর শিখরা এ অঞ্চলের জনগণের উপর এই অভিযোগ এনে সীমাহীন নির্যাতন চালাবে যে, তোরাই পথ দেখিয়ে মুজাহিদ বাহিনীকে এখানে নিয়ে এসেছিস এবং কাশ্মীরে পৌঁছার পথ তৈরি করে দিয়েছিস। আর যুদ্ধ করে শিখদের পরাস্ত করে কাশ্মীরের দিকে অভিযান করলে আমরাও আপনাদের সঙ্গে যেতে পারব।

বালাকোটের পাহাড়ী এলাকাতে শিখদের মারধর, জুলুম-নির্যাতনে তছনছ হবার কারণে অত্যন্ত অস্থির ও অনিশ্চিত অবস্থা বিরাজ করছিল। শিখেরা এই এলাকার আমীর-ওমারা ও উপজাতীয় সর্দারদের পরস্পরের সঙ্গে লড়াই বাধিয়ে দিত। কতক সর্দারকে তাদের নিজস্ব এলাকা ও রাজ্য থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। অতঃপর এই সব লোক সাইয়েদ সাহেবের সাথে এসে মিলিত হয়। কাশ্মীরকে হস্তগত ও তার উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য এবং তাকে জিহাদী দাওয়াতের কেন্দ্রভূমি বানাবার জন্য এইসব শক্তির মধ্যে ঐক্য ও সংহতির প্রয়োজন ছিল। বালাকোট যা কাগান উপত্যকার নিকটেই অবস্থিত এবং তিনদিক পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত ছিল, এতদুদ্দেশ্যে চলাচলের অতি উত্তম কেন্দ্র হতে পারত। প্রকৃতি তাকে একটি সুদৃঢ় দূর্গের রূপদান করেছিল। অতএব এ জায়গাটিকেই মুজাহিদ বাহিনীর কেন্দ্র বানানোর পক্ষে সিদ্ধান্ত গৃহীত হল।

বালাকোটের পথে:

সে সময় পাখলী ও কাগান উপত্যকার অভিজাত ও এলাকাবাসীদের শাসনকর্তৃত্ব- কতকাংশ শিখদের হামলার ফলে আর কতকাংশ পারস্পরিক তিক্ত সম্পর্কের কারণে নড়নয়ে হয়ে গিয়েছিল। এরা সবাই ছিলো হযরত সাইয়েদ আহমদ শহীদ রহ. এর সাহায্য ও সহযোগিতা প্রার্থী। অধিকন্তু তাদের রাজ্যগুলো কাশ্মীর যাবার পথেই পড়ে। এগুলোকে সৈয়দ সাহেব নিজের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চাচ্ছিলেন। দ্বিতীয় দফার এই হিজরতও সেই দিকেই হতে চলেছিল। তাদের সবাইকে সাহায্য করা, তাদের সহযোগিতা ও সামরিক শক্তির সহায়তা লাভ করা এবং কাশ্মীরের দিকে অগ্রসর হবার প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান ছিল বালাকোট। এটি কাগান উপত্যকার দক্ষিণ মুখে অবস্থিত। এখানে পৌঁছে উপত্যকাকে পাহাড়ী প্রাচীর বন্ধ করে দিয়েছে। কুনহার নদীর উৎসমুখ ব্যতীত দ্বিতীয় কোন রাস্তাও বালাকোটে প্রবেশের নেই । পাহাড়ের দু’ধারী প্রাচীর সমান্তরাল রেখায় এগিয়ে গেছে। মাঝখানে উপত্যকা ভূমি। এর প্রশস্ততা আধা মাইলের বেশি নয়। এর মাঝখান দিয়েই কুনহার নদী প্রবাহিত। বালাকোটের পূর্বদিকে কালুখানের সুউচ্চ চূড়া এবং পশ্চিমে মাটিকোট পর্বতশিখর অবস্থিত।

হিজরতের এ দ্বিতীয় সফরটিও ছিল অত্যন্ত কষ্টকর, দুঃসাধ্য ও বিপদজনক। পাহাড়ের শিখর দেশ এবং উপত্যকা ভূমি ছিলো বরফ দ্বারা আচ্ছাদিত। রাস্তা ছিলো আঁকা-বাঁকা ও উঁচু-নিচু। রাস্তায় রসদপত্র ও মাল সামানের বাহনেরও কোন ব্যবস্থা ছিল না। এ সফরও ছিল তাঁর সুউচ্চ মনোবল, দৃঢ় চিত্ততা, সঙ্গী-সাথীদের সহনশীলতা, ঈমানী কুওয়াত, ধৈর্য-স্থৈর্য ও স্বীয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রতি সীমাহীন প্রীতির একটি উজ্জ্বল নিদর্শন। তিনি পাঞ্জেতার থেকে বিভিন্ন স্থান হয়ে সচুন নামক স্থানে পৌঁছেন। সেখান থেকে বালাকোট অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। সচুন থেকে ১২৪৬ হিজরীর যিলকদ মাসের ৫ তারিখে মুতাবিক ১৮৩১ খৃস্টাব্দের ১৭ই এপ্রিল রওয়ানা হয়ে বালাকোট প্রবেশ করেন।

শের সিং গড় থেকে প্রথমে মুজাফফরাবাদের দিকে রওয়ানা হয়। মুজাফফরাবাদ থেকে পুনরায় গড়ে প্রত্যাবর্তন করে বালাকোটে যাওয়ার রাস্তা তালাশ করে। এ জন্য সে বাহিনীও প্রস্তুত করতে থাকে। ইতিমধ্যে দূত মারফত শাহ ইসমাইল জানতে পারলেন যে, শের সিং ভুগাড়মাঙ্গ উপত্যকা অভিমুখে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছে। তিনি সাইয়েদ সাহেবকে পত্র মারফত এ সংবাদ জানিয়ে বলেন যে, যেহেতু আপনি সেদিকে আছেন সুতরাং সে সেদিকে যেতে পারে। তবে যদি যুদ্ধের আভাস পান তাহলে দূত পাঠিয়ে দ্রুত আমাদেরকে সংবাদ দিবেন, যাতে আমরা আমাদের বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হয়ে যুদ্ধে শরীক হতে পারি। কিন্তু শের সিং এই পরিকল্পনা ত্যাগ করে গড়ে ফিরে আসে। শাহ ইসমাইল অন্যান্যদের সাথে পরামর্শ করে রাতের বেলায় শিখদের গড়ে একটি অতর্কিত হামলার পরিকল্পনা তৈরি করেন। ইতিমধ্যে সুচনে চলে আসার জন্য সাইয়েদ সাহেব তার কাছে জরুরি তলবনামা পাঠান। অগত্যা আক্রমণের পরিকল্পনা ত্যাগ করে তিনি সুচনে গিয়ে উপস্থিত হন।

১২৪৬ হিজরীর জিলকদ মাসে সময় বালাকোটের দায়িত্বশীল হাবীবুল্লাহ খানের পক্ষ থেকে এ মর্মে পত্র আসে যে, শের সিং তার বাহিনী নিয়ে বালাকোট থেকে আড়াই ক্রোশ দূরে কুনহার নদীর দক্ষিণ পাড়ে এসে তাঁবু ফেলেছে বলে জানা গেছে। সুতরাং আপনি আপনার বাহিনী নিয়ে অতিসত্ত্বর বালাকোটে চলে আসুন । এ চিঠি পেয়ে সাইয়্যিদ সাহেব বালাকোটের পথে রওয়ানা হওয়ার সংকল্প গ্রহণ করেন। যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণের পর ১২৪৬ হিজরীর ৫ই জিলহজ্জ মুজাহিদদের সঙ্গে নিয়ে তিনি বালাকোটের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। পাহাড়ী পথ মাড়িয়ে আল্লাহর রাহের এই মুসাফিররা এগিয়ে চললেন।

মেঘে ঢাকা অন্ধকার রাতে পূর্বপ্রস্তুতি:

বালাকোটে পৌঁছেই বালাকোটের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে তিনি জোরদার করেন এবং যে যে পথে শিখদের আগমনের সম্ভাবনা ছিল সব দিকেই পাহারা মোতায়েন করেন। মোল্লা লাল মোহাম্মদকে মাটিকোটের সেই পাহাড়ী সরু পথটির পাহারায় নিয়োগ করা হয়েছিল। পরে তাকে পরিবর্তন করে মির্জা আহমদ বেগকে সেখানে মুতায়েন করা হয়। শের সিংহের বাহিনী কুনহার নদীর পূর্ব-দক্ষিণ দিকে বালাকোট থেকে দুই-আড়াই ক্রোশ দূরে অবস্থান নিয়েছিল। সাইয়্যিদ সাহেব কুনহার নদীর উপর দিয়ে দক্ষিণ পূর্বদিকের এলাকায় গমনের জন্য গাছ দিয়ে একটি পুল তৈরি করিয়ে ছিলেন। শিখরাও পশ্চিমে আসার জন্য একটি পুল নির্মাণ করেছিল। কাঠের পুল নির্মাণের দুই একদিন পরই গুপ্তচর এসে সংবাদ দিল যে, শিখ বাহিনী নদী পার হয়ে এদিকে না এসে অন্যদিকে যেন চলে যাচ্ছে। কিন্তু তার পর দিন যোহরের পরই মাটিকোট পাহাড়ের উপর গুলির আওয়াজ শোনা গেল। গোয়ালাদের লোকজন চিৎকার করে বলতে লাগল যে, শিখ বাহিনী এসে গেছে।

সাইয়েদ সাহেব সে দিকে কিছু সৈন্য আহমদ বেগের সহযোগিতার জন্য পাঠালেন এবং বলে দিলেন যে, সেই পাহাড়ে তাদেরকে বাধা না দিয়ে আহমদ বেগ যেন তাঁর বাহিনী নিয়ে নিচে নেমে আসে। দিনের মাত্র দেড় ঘণ্টা বাকী, এ সময় সুলতান নযফ খানের কাছে থেকে একটি চিঠি আসে। চিঠিতে সে সাইয়েদ সাহেবকে যে পরামর্শ দেয়, শিখদের তোপখানা আক্রমণ করা হোক। আবার কেউ কেউ পরামর্শ দেয় যে, বালাকোট থেকে সরে গিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে এসে যান। এর ফলে আক্রমণরত বাহিনী নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনে কামিয়াব হতে পারবে না। এসব শুনে তিনি বললেন, এখন কাফিরদের উপর অতর্কিত আক্রমণ করা আমার ইচ্ছা নয়। আমি এই বালাকোটের পাদদেশেই তাদের সাথে লড়াই করব। মনে রেখো, এই ময়দানই লাহোর আর এখানেই বেহেশত এবং বেহেশতকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এমনই উত্তম জিনিস বানিয়েছেন যে, সমগ্র দুনিয়ার রাজত্বও তার সামনে কোন গুরুত্বই রাখে না।

যুদ্ধের এক পর্যায়ে এমন একটি সময় অবশ্যই আসে যে, চূড়ান্ত যুদ্ধ ও দৃঢ়তা প্রদর্শনের প্রয়োজন হয়। সাইয়েদ সাহেবও এক্ষেত্রে পুরোপুরি মুকাবিলার সিদ্ধান্তই নেন। বাহ্যত বালাকোট পরিত্যাগ করে চলে যাবার পরামর্শ বোধগম্য ও যুক্তিপূর্ণ বলেই মনে হয়। কিন্তু অধিকতর গভীর দৃষ্টি এবং একজন তেজস্বী বীর বাহাদুরের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে এ পরামর্শ গ্রহণযোগ্য এবং এ কৌশল কার্যকরী ছিল না। এর পরিণতি শুধু এই হতো যে, আপাতত ও সাময়িকভাবে সৈন্য বাহিনীর জীবন বেঁচে যেত, কিন্তু শিখেরা বালাকোটের গোটা বস্তি ধূলোয় মিশিয়ে দিতো এবং নিরীহ ও নিষ্পাপ অধিবাসীদেরকে তলোয়ারের তলায় নিক্ষেপ করত। তাই তিনি সকল স্থান থেকে পাহারারত মুজাহিদদেরকে তলব করে তাঁর কাছে নিয়ে আসলেন। তখন সকল গাযীদের সম্বোধন করে বললেন, ভাইয়েরা আমার! আজকের রাতটা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে পরিপূর্ণ ইখলাসের সথে তওবা ও ইস্তিগফার করো এবং নিজেদের গুনাহর জন্য ক্ষমা চাও। এটাই বিদায়ের লগ্ন। কাল ভোরে কাফিরদের সঙ্গে মুকাবিলা। আল্লাহই জানেন, আমাদের ভেতর কে জীবিত থাকবে আর কার ভাগ্যে শাহাদাত জুটবে।

যখন এ কথা দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার হয়ে গেল যে, শিখ সৈন্যবাহিনী মাটিকোট থেকে অবতরণ করেই বালাকোটের উপর হামলায় উদ্যত হবে তখন একটি কার্যকর ও ফয়সালামূলক যুদ্ধের জন্য যাবতীয় ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করা হয়। কসবার অবস্থানস্থল এবং যুদ্ধের ময়দানের প্রাকৃতিক অবস্থা মুজাহিদ বাহিনীর অনুকূলে ছিল। এ থেকে পুরোপুরি ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করা হয়। হামলাকারীরা মাটিকোট থেকে অবতরণ করতেই এবং কসবার উপর হামলা করবার পূর্বেই (যা উচ্চে অবস্থিত ছিল) এই নীচু ময়দানের মুখোমুখি পড়তে হতো যা ছিল টিলা এবং কসবার মাঝখানে অবস্থিত। নীচু ময়দানে ছিল ধানের ক্ষেত। সাইয়েদ আহমদ শহীদ রহ.-র নির্দেশে সেখানকার ঝরণার পানি ছেড়ে দেওয়া হয় যেন সমতল ময়দান দলদলে ভূমিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়, যা পার হওয়া এবং সেখানে যুদ্ধ ব্যবস্থাপনা কায়েম রাখা হামলাকারীদের জন্য কঠিন ও দুঃসাধ্য হয়। এর বিপরীতে মুজাহিদ বাহিনী কসবার উচ্চতার উপর পজিশন নিয়েছিলে যেন দুশমনের উপর হামলা করা সহজসাধ্য হয় এবং হামলাকারীরা যেন অতি সহজেই তাদের গুলীর আওতায় এসে যায় ।

রাজকুমার শেরসিংহ (যে বীর পিতা রঞ্জিত সিংহ কর্তৃক মুজাহিদ বাহিনীর সাথে শেষ শক্তি পরীক্ষার অভিযানে আদিষ্ট হয়েছিলো যখন জানতে পায় যে, সৈয়দ সাহেব তাঁর সাথীদের নিয়ে বালাকোটে অবস্থান করছেন, তখনই সে শিখদের একটি বিরাট বাহিনীসহ কুনহার নদীর পূর্ব তীরে বালাকোট থেকে দু আড়াই ক্রোশ দূরে ছাউনী ফেলে এবং ধীরে ধীরে অতি সন্তর্পণে বালাকোটের কাছে গিয়ে পৌঁছে।

রাজকুমার শের সিং বালাকোটের এরূপ প্রাকৃতিক অবস্থা দেখে একে অবরোধ করার পরিকল্পনা সম্পর্কে হতাশ ও নিরাশ পড়ে এবং প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছে করতে থাকে। ঠিক এমনি মুহূর্তে স্থানীয় অধিবাসীদের কেউ পল্লীতে পৌছুতে পথ প্রদর্শকের ভূমিকা দেয়।

সেই রাত এত ভয়াবহ ছিল যা বর্ণনার বাইরে। আকাশ ছিলো মেঘে ঢাকা আর বৃষ্টি হচ্ছিলো গুড়ি গুড়ি। সন্ধ্যা থেকে ভোরবেলা পর্যন্ত জীবজন্তু ও পশু-পাখি শোরগোলে মাতিয়ে তোলে। সেই বস্তির লোকেরা বলছিল যে, আমরা একের পর এক ভয়াবহ অন্ধকার রাতও দেখেছি। কিন্তু এমন উদাস ও ভয়াবহ রাত কখনও দৃষ্টিগোচর হয়নি ।

শাহাদতের প্রত্যুষে:

৬ই মে ১৮৩১ মোতাবেক ২৪ শে যিলকদের (১২৪৬ হিজরী) সুবহে সাদিক। ফজরের আযান হল। সকলেই ওজু করে অস্ত্র সজ্জিত অবস্থায় হাজির হল। সাইয়েদ আহমদ শহীদ রহ. ইমামতি করলেন। এরপর তিনি অনুমতি দিলেন, যে যার জায়গায় গিয়ে সতর্ক ও হুশিয়ার থাকবে। তিনি নিজেও নিজের ডেরায় এসে ওযীফা পাঠে মশগুল হয়ে গেলেন। সূর্য উঠার পর তিনি সালাতুল ইশরাক দু’রাকাত আদায় করলেন। কিছুক্ষণ বিলম্ব করার পর উর্দূ করে চোখে সুরমা এবং দাঁড়িতে চিরুণী লাগান। এরপর পোশাক পরিধান করে অস্ত্রসজ্জিত হয়ে মুসজিদ অভিমুখে রওয়ানা হন। সে সময় শিখবাহিনী পাহাড় থেকে মাটিকোটের দিকে অবতরণ করছিল। লোকজন এর প্রতি ইঙ্গিত করে সাইয়েদ আহমদ শহীদ রহ.-এর নিকট আরজ জানায় যে, শিখ বাহিনী পাহাড় থেকে অবতরণ করছে। তিনি বললেন, তাদের নামতে দাও। অতঃপর তিনি মসজিদে প্রবেশ করেন এবং এর সম্মুখভাগের ছাদের নীচে বসেন। এক-এক, দুই-দুই করে বহু সাথীই সেখানে জমায়েত হয়। এটা ছিলো সেই মুবারক মুহূর্তে যখন জান্নাত সুসজ্জিত হয়ে চোখের সামনে ধরা দেয়। এমন মনে হচ্ছিল যে, তাদের চোখের সামনে থেকে পর্দা উঠে গেছে আর বালাকোটের পাহাড়ের পেছনে থেকে বেহেশতের খোশবু তাদের শরীর মনের প্রতিটি তন্ত্রীকে সুবাসিত করে তুলছে।

ইলাহী বখশ রামপুরী বলেন যে, আমাদের জামাআতে পাতিয়ালার সৈয়দ চেরাগ আলী নামে এক ব্যক্তি ছিল। সে তখন ক্ষীর পাকাচ্ছিল। তার কাঁধে ছিলো কুরাবীন (চওড়া মুখওয়ালা ছোট বন্দুক)। শিখবাহিনী মাটিকোট থেকে নীচে অবতরণ করছিল। আর সে তার ক্ষীর চামচ দিয়ে জোরে জোরে নেড়ে চলছিল, আবার শিখদের দিকে তাকাচ্ছিল। এ সময় তার অবস্থাই ছিল অন্য রকম। একবার আসমানের দিকে তাকিয়ে বলল, ঐ দেখো! একজন হুর কাপড় পরে চলে আসছে। কিছুক্ষণ দেরী করার পর বলতে থাকে, দেখো! একজন পোশাক পরে আসছে, এই বলেই সে চামচ ডেকচীর উপর জোরে আঘাত করে বলে ওঠে এখন তোমাদেরই হাতের খানা খাব। এই বলে সে শিখবাহিনীর অভিমুখে ছুটে যায়। পেছন থেকে অনেকেই বলে উঠল, মীর সাহেব। থামুন, আমরাও যাব। কিন্তু সে কোনদিকেই বিন্দুমাত্রও ভ্রুক্ষেপ করলো না এবং যেয়েই শিখদের জমায়েতের ভেতর ঢুকে পড়ে ও অত্যন্ত বীরত্বের স্বাক্ষর রেখে শহীদ হয়ে যায়।

এদিকে সাইয়েদ আহমদ শহীদ রহ. মসজিদের সম্মুখভাগের তলা থেকে উঠে দাঁড়ান এবং সবাইকে বলেন যে, তোমরা এখানেই থাকো। আমি একলা গিয়ে দুআ করছি। আমার সাথে কেউ যেন না আসে। অতঃপর সমস্ত লোক-লশকর হাতিয়ার বাঁধা অবস্থায় যে যেখানে ছিলো দাঁড়িয়ে থাকে। তিনি মসজিদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন এবং দরোজা-জানালা বন্ধ করে দুআতে মশগুল হয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পর মসজিদের প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে তিনি বালাকোটের পাদদেশের দিকে অবতরণ করতে থাকেন আর সকল লোকই ছিল তাঁর পেছনে। নীচে বালুর দিকে একটি মসজিদ ছিল, গাযীদের একটি বাঁকও এর ভেতরে ছিলো। তিনি এতে তশরীফ নেন ।

যখন তিনি নীচের দিকে অবস্থিত মসজিদের দিকে আসেন সেখানে তখন শিখদের গুলী বৃষ্টিধারার ন্যায় বর্ধিত হচ্ছিল। আধঘণ্টা খানেক মসজিদে অবস্থান করে তিনি সাইয়েদ আবদুল হাসানকে বললেন যে, নিশান নিয়ে আগে যাও। অতঃপর উচ্চস্বরে তকবীর ধ্বনি উচ্চারণ করতে করতে তিনি আক্রমণোদ্যত হন। সে সময় আরবাব বাহরাম খান সাইয়েদ আহমদ শহীদ রহ.-এর সামনে ঢালস্বরূপ আগে আগে চলছিলেন। শিখ বাহিনীর গোলাগুলী বৃষ্টিধারার ন্যার বর্ধিত হচ্ছিল। তিনি অগ্রসর হয়ে তকবীর ধ্বনি করেন এবং দুশমনের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। বাঘ যেমনি শিকারের উপর ক্ষিপ্র ও তীব্রগতিতে গিয়ে পড়ে, ঠিক তেমনি ক্ষিপ্র ও তীব্রগতিতে তিনি অগ্রসর হচ্ছিলেন। পঁচিশ-তিরিশ কদম দূরে একটি বড় পাথরখণ্ড মাটি খুড়ে বেরিয়েছিল, তিনি তারই আড়ালে গিয়ে থামেন। তিনি ও তাঁর সাথী গাথীবৃন্দ বন্দুক-পিস্তলের গুলী বৃষ্টিধারার ন্যায় ছুঁড়তে থাকেন। এরূপ নিক্ষেপের ফলে অসংখ্য দুশমন প্রাণ হারায় এবং ছত্র-ভঙ্গ হয়ে পাহাড়ের দিকে পিছু হটতে থাকে। মুজাহিদ বাহিনী পাহাড়ের পাদদেশে গিয়ে উপস্থিত হয়। দুশমনের ঠ্যাং ধরে ধরে টেনে নীচে নামাতে থাকে এবং তলোয়ারের আঘাতে নির্মূল করতে থাকে ।

হাফিয ওয়াজীহুদ্দীন সাহেব বলেন যে, আমি বন্দুক চালনা করতে করতে একটি ঝরণার ধারে গিয়ে পৌঁছি। দেখতে পাই যে, কতিপয় লোকের সঙ্গে সৈয়দ সাহেব কিবলামুখী বসে বন্দুক চালাচ্ছেন। সে সময় তিনি আমার বরাবর নিজের বুকের ডান ছাতির উপর বন্দুক চেপে ফায়ার করেন। আমি দেখতে পেলাম, ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙুলে কিংবা তার পাশের অনামিকায় তাজা খুন। আন্দাজ অনুমানে জানতে পেলাম সম্ভবত সৈয়দ সাহেবের কাঁধে গুলী লেগেছে। বন্দুক ছাতির উপর রাখতে গিয়ে তারই খুন তাঁর আঙুলে লেগে গেছে । ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি বললেন যে, ভাইয়েরা। ঐ দুষ্কৃতিকারীদের তাক করে গুলী মারো।

সে সময় আসমান ছিলো পরিষ্কার। মেঘ যেমন ছিল না, তেমনি ছিল না ধূলো-বালি কিংবা রৌদ্র। কিন্তু বারুদের ধোয়ার কারণে অন্ধকার এরূপভাবে ছেয়ে যায় যে, কাছের মানুষ চিনতেও কষ্ট হচ্ছিল। শিখদের কার্তুজের কাগজ এমনিভাবে উড়ছিলো মনে হচ্ছিলো যেমন – পঙ্গপাল উড়ছে। সময়টা অত্যন্ত ভয়াবহ ও উদাস প্রকৃতির মালুম হচ্ছিল। সকল মুজাহিদ ছোট বন্দুক ও সাধারণ বন্দুক গলায় লটকিয়ে তলোয়ার হাতে নেয় এবং সমস্বরে ‘আল্লাহু আকবার’ ‘আল্লাহু-আকবার’ বলে আক্রমণোদ্যত হয়। সে সময় যুদ্ধের অবস্থা ও প্রকৃতি এমনি ছিল যে, শিখবাহিনী পেছপা হয়ে পাহাড়ের উপর আরোহণ করছিল আর মুজাহিদ বাহিনী পাহাড়ের পাদমূলে গিয়ে পৌঁছে শিখদের ঠ্যাং ধরে ধরে টানছিল এবং তালোয়ারের আঘাত সাবাড় করছিল। উভয় পক্ষ থেকে পাথরও বর্ধিত হচ্ছিল। লোকজন সেখানে ফিরে দেখতে পায় যে, সাইয়েদ আহমদ শহীদ রহ. দৃষ্টি বহির্ভূত। শাহ ইসমাঈল সাহেবকে লোকেরা বন্দুক গলায় ঝুলানো অবস্থায় দেখেছিল। তাঁর হাতে ছিল তলোয়ার, কপাল ছিল রক্তাক্ত আর তিনি সে রক্ত হাত দিয়ে মুছে ফেলছিলেন। সে সময় কেউ কারো সন্ধান রাখার মতো অবস্থা ছিল না। মুজাহিদ বাহিনীকে এই যুদ্ধে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। এরই ভেতর শাহ ইসমাঈল শাহাদাত লাভ করেন। বীরত্ব ও সাহসিকতা, শাহাদত লাভের প্রতি প্রবল আগ্রহ ও দুনিয়ার প্রতি চরম ঘৃণা ও বিতৃষ্ণা এবং ইমামের প্রতি মহব্বত ও আনুগত্যের এমনিই সব আশ্চর্যজনক ঘটনা এ যুদ্ধে দৃষ্টিগোচর হয়, যা ইসলামের প্রাথমিক শতাব্দীগুলোর স্মৃতিকেই জীবন্ত করে তোলে এবং সেই সব পুরনো দিনগুলো আর একবার ফিরে আসে। তিনি তপ্ত খুনে লালিত হয়েছিলেন এবং সেভাবেই সাধ্য-সাধনা ও জিহাদের এই দীর্ঘ ও অব্যাহত পবিত্র জীবনের সমাপ্তি হয়। এর ভেতর সম্ভবত একদিনের তরেও অবসর কিংবা আরাম, এক রাতও অলস মুহূর্তে কিংবা সুখ নিদ্রায় তাঁর বায়িত হয়নি।

ইত্যবসরে সাইয়েদ আহমদ শহীদ রহ. লোকজনের দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে যান। মুজাহিদ বাহিনীর মনে এরূপ প্রতীতি জন্মাতে থাকে যে, সম্ভবত তিনি শহীদ হয়ে গেছেন। সাইয়েদ আহমাদ শহীদ মেটিকোটের ঝরনার মধ্যে শাহাদত বরণ করেন। মুজাহিদগণের একটি বড় দল সাইয়েদ আহমাদ শহীদের শাহাদত বরণের বিষয়টি উপলব্ধি করতে না পারায় তাঁর সন্ধানে ঘুরে ঘুরে শাহাদত বরণ করলেন। এছাড়া মুজাহিদদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করতে করতে শাহাদত বরণ করেন। এই যুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল কমপক্ষে দুই ঘণ্টা। এই যুদ্ধে তিনশতেরও বেশি মুজাহিদ যাঁদের নিজ নিজ এলাকার সার-নির্যাস ও মগজ-সদৃশ বলা যেতে পারে শাহাদত লাভে ধন্য হন। তাঁদের একই জয়গায় শহীদী দাফনগাহে চিরবিশ্রাম লাভ ঘটে।

 

বালাকোট বিপর্যয়ের কারণ:

সাইয়েদ আহমদ শহীদের নেতৃত্বে ভারতে ইসলামি আযাদীর প্রবর্তনের যে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন এবং যে আন্দোলন সাফল্যের দুয়ার পর্যন্ত এগিয়েও কেন ব্যর্থতার সম্মুখীন হল? তার কারণ অবশ্যই অনুসন্ধান করে দেখা উচিত। কারণ অতীত ইতিহাসের চুলচেরা বিচার ও পরীক্ষা নিরীক্ষায় ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সঠিকভাবে নির্ণীত হতে পারে। চিন্তাশীল মনীষীগণ উপরোক্ত আন্দোলনের ব্যর্থতার যে কারণসমূহ বর্ণনা করেছেন তা সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক।

১. আল্লাহর পথে জিহাদ পরিচালনার জন্যে যে কর্মীবাহিনীর প্রয়োজন, তাদের প্রত্যেকের চরিত্র হতে হবে নির্ভেজাল ইসলামী আদর্শে গড়া। তাদেরকে হতে হবে আল্লাহর পথে উৎসর্গীকৃত। সাইয়েদ সাহেব বাইরে থেকে যে মুজাহিদ বাহিনী সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন, নিঃসন্দেহে তাঁরা উক্ত চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। এবং তাঁরাও অনুরূপ চরিত্রে চরিত্রবান ছিলেন, যাঁরা জেহাদ চলাকালে বাংলা, বিহার, মধ্য প্রদেশ প্রভৃতি অঞ্চল থেকে একমাত্র খোদার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আত্মীয়স্বজন, আপন ঘরদোর, ক্ষেত-খামার ছেড়ে সাইয়েদ সাহেবের মুজাহিদ বাহিনীতে গিয়ে যোগদান করেছিলেন। কিন্তু এঁদের সংখ্যা এক থেকে দু’ হাজারের মধ্যেই ছিল সব সময়ে সীমিত। জিহাদের জন্যে সাইয়েদ সাহেবের জ্বালাময়ী ভাষণ শুনে এবং প্রথমদিকে শিখদের উপরে অপ্রত্যাশিত বিজয়লাভ দেখে দলে দলে পাঠানরা সাইয়েদ সাহেবের দলে যোগদান করে। কিন্তু তাদের সত্যিকার কোন ইসলামি চরিত্র ছিল না। তাদের মধ্যে ইসলামি প্রেরণা ও জোশ ছিল প্রচুর। কিন্তু তাদের অধিকাংশই ছিল দরিদ্র, অজ্ঞ, অর্থলোভী এবং বহুদিনের পুঞ্জীভূত কুসংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ। যারা সরদার অথবা গোত্রীয় শাসক ছিল, তারাও অত্যন্ত স্বার্থপর ও সুবিধাবাদী ছিল। কোন কোন সময়ে মুজাহিদ বাহিনীর সংখ্যা তিন লক্ষ পর্যন্ত পৌঁছেছে। এরা প্রায় সবই বিভিন্ন পাঠান গোত্রের লোক। এরা অর্থলোভে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, চরম মুহূর্তে প্রতিপক্ষ শিখ সৈন্যদের সংগে যোগদান করেছে। অথবা মুজাহিদ বাহিনীর সাথে যুদ্ধকালীন শুধু গনিমতের মাল লুণ্ঠনে লিপ্ত হয়ে বাহিনীর মধ্যে শৃংখলা ও নিয়মতান্ত্রিকতা ভংগ করেছে। অন্ধ ব্যক্তিস্বার্থ ও অর্থলোভের প্রবল প্লাবনে তাদের জলবুদবুদসম ইসলামী প্রেরণা ও জোশ ভেসে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

২. স্থানীয় মুসলিমদের বিশ্বাসঘাতকতা। যেসব সামন্ত ও খানরা শিখবাহিনীর হাত থেকে তাদেরকে রক্ষার জন্য সাইয়েদ আহমাদকে আহ্বান করেছিল তারা পরবর্তীতে মুসলমানদের সাহায্য না করে গোপনে শিখদের সাথে হাত মেলায়। শিখবাহিনী যখন মেটিকোটে আরোহণের চেষ্টা করছিল তখন সেখানে পাহারায় থাকা মুজাহিদ বাহিনীতে অনুপ্রবেশকারী কিছু স্থানীয় মুসলিম তাদেরকে গোপন পথ বাতলে দেয়। এই সাহায্য না পেলে শিখবাহিনী মেটিকোটে প্রবেশ করতে পারত না। সাইয়েদ আহমাদের সাথে চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা করে হাযারার এক উপজাতীয় প্রধান শিখদেরকে বালাকোটের সাথে সংযুক্ত পাহাড়ের উপরিভাগে ওঠার গোপন পথের সন্ধান দেয়।

৩. বিশ্বাসঘাতক ও চরিত্রহীন পাঠানদের প্রতি পূর্ণমাত্রায় আস্থা স্থাপন করাও ঠিক হয়নি। যে সুলতান মুহাম্মদ খাঁ এবং তার ভ্রাতৃবৃন্দ সাইয়েদ সাহেবের চরম বিরোধিতা করত, সেই সুলতান মুহাম্মদের উপরে পেশাওরের শাসনভার অর্পণ করাও ঠিক হয়নি। সুলতান মুহাম্মদই শেষ পর্যন্ত আন্দোলনের উপর চরম আঘাত করে এবং একই রাতে এক সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সাইয়েদ সাহেবের কয়েকশ’ বাছা বাছা মুজাহিদের প্রাণনাশ করে। যার ফলে সাইয়েদ সাহেবকে পেশাত্তর থেকে পশ্চাদপসরণ করতে হয়।

৪. স্থানীয় পাঠানদের আল্লাহর পথে জীবন দানের চেয়ে জীবন বাঁচিয়ে পার্থিব স্বার্থলাভই উদ্দেশ্য ছিল। তাই যুদ্ধকালে তারা সত্যিকার মুজাহিদগণকে পুরোভাগে থাকতে বাধ্য করতো এবং নিজেরা যথাসম্ভব নিশ্চেষ্ট থাকতো এবং লুণ্ঠনের সুযোগ সন্ধান করতো।

৫. স্বয়ং সাইয়েদ সাহেব ও শাহ ইসমাইল দুর্ধর্ষ বীরযোদ্ধা ও রণকৌশলী থাকা সত্ত্বেও গোটা মুজাহিদ বাহিনীকে তৎকালীন যুদ্ধ বিদ্যায় তেমন প্রশিক্ষণ ছিল না। আধুনিক রণকৌশল সম্পর্কেও ছিল না সচেতনতা।

পরিশেষে:

সাময়িকভাবে এ আন্দোলন ব্যর্থ হলেও এর প্রতিক্রিয়া ছিল সুদূর প্রসারী। সাইয়েদ আহমদ শহীদ যে খুনরাঙা পথে চলার দুর্বার প্রেরণা দিয়ে গেলেন ভারতীয় মুসলমানদেরকে; বাংগালী, বিহারী, পাঞ্জাবী, সিন্ধি, পাঠান নির্বিশেষে ভারতীয় মুসলমানগণ সে খুনরাঙা পথে অবিরাম চলেছে প্রায় শতাব্দীকাল পর্যন্ত। জেল-জুলুম, ফাঁসি, দ্বীপান্তর, স্থাবর, অস্থাবর সম্পদের বাজেয়াপ্তকরণ, অমানুষিক ও পৈশাচিক দৈহিক নির্যাতন ক্ষণকালের জন্যেও তাদেরকে এ পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি।

মুজাহিদদের এই আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। তাদের কুরবানী স্বাধীনতার চেতনাকে করেছে বেগবান। যুগে যুগে যুগিয়েছে স্বাধীনতার চেতনা। বালাকোটের রণাঙ্গণে বেঁচে যাওয়া মুজাহিদরা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে স্বাধীনতার আন্দোলনকে করেছে সক্রিয় ও গতিশীল। বালাকোটের আত্মত্যাগই আমাদেরকে পরবর্তী সময়ে আন্দোলন ও সংগ্রামের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।

 

উৎসগ্রন্থ:

১. ঈমান যখন জাগলো , আবুল হাসান আলী নাদভী

২. ওলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাযী, মুহাম্মাদ মিঞা

৩. দেওবন্দ আন্দোলন ইতিহাস ঐতিহ্য অবদান, মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাঃ ইয়াহইয়া

৫. ইসলামী বিশ্বকোষ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ

৬. দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস, ডাব্লিউ. ডাব্লিউ. হান্টার

৭. বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, আব্বাস আলী খান

৮. ওয়াহাবী আন্দোলন, আবদুল মওদুদ

৯. চেতনার বালাকোট, শেখ জেবুল আমিন দুলাল

The post ‘সূর্যাস্তের আগে’ : বালাকোট আন্দোলনের শেষ দিনগুলো appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%b8%e0%a7%82%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%86%e0%a6%97%e0%a7%87-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%95%e0%a7%8b%e0%a6%9f/

‘ভারত এখন দারুল হারব’ : যেভাবে শুরু হয় তরিকায়ে মোহাম্মদিয়া

জহুরুল ইসলাম

বৃটিশদের শ্যেনদৃষ্টি:

সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুভাগে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি উপমহাদেশে প্রথম তাদের বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে। এরপর দিনে দিনে এ-অঞ্চলে বাণিজ্যিক অবস্থান সুদৃঢ় করার পাশাপাশি অর্থনীতির লাগামও তারা হাত করে নেয়।

ধন-ধান্য-পুষ্পে ভরা এই উপমহাদেশকে ইংরেজরা চিরদিন লুণ্ঠনের অবাধ উপনিবেশ হিসেবেই দেখেছে। তাই বণিক সেজে এসেও শুধু বাণিজ্যিক মুনাফাতে তারা সন্তুষ্ট থাকেনি। বরং হা করে গিলতে চেয়েছে এ-অঞ্চলের সর্বময় কর্তৃত্ব।

কান টানলে মাথা আসে। আর মাথা এলে শরীর নিয়েই আসে। ভূখণ্ড করতলগত করতে চাইলে বুদ্ধিতে জাতিকে হারিয়ে তাদের সংস্কৃতিকে ধসিয়ে দিতে হবে—এই কূটবুদ্ধি ইংরেজরা জাতিগতভাবে প্রাপ্ত। তাই ছলে-বলে-কৌশলে শাসকবর্গ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সবখানে তারা পুশ করেছে তাদের পশ্চিমা সংস্কৃতির বিষ।

উম্মাহর দীনি ও সাংস্কৃতিক বিপর্যয় দেখে নির্লিপ্ত থাকা জাতির প্রকৃত দরদী ওলামায়ে কেরামের ধর্ম নয়। জাতির এই সংকটকালে কুটকৌশলী ইংরেজদের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক অস্ত্র ধরলেন উম্মাহর সূর্যপুরুষ শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবি রহ.। তিনি ক্ষুরধার কলমে রচনা করলেন অনেক গ্রন্থ। তার লিখনীতে ফুটে উঠল দীনের মৌলিক বিষয়াদি ও ইসলামি তাহযিব-তামাদ্দুনের যথার্থতা। তার এই লেখাগুলো ছিল ইংরেজদের আগ্রাসনের মূলে এক কঠিন আঘাত।

এরই অব্যবহিত পরেই যখন স্পষ্ট হলো, এ-জাতি ভিনদেশীদের মায়াজাল জড়িয়ে পড়েছে আষ্টেপৃষ্ঠে, তখনই এই শিকল ভাঙ্গার আহ্বানে প্রথম সরব হয়ে ওঠেন এ-মাটিরই আরেক সূর্যসন্তান শাহ আবদুল আজিজ দেহলবি রহ.।

নতুন কর্মপন্থা:

ভারতবর্ষে দুইশ বছরের সুদীর্ঘ সময়ে ইংরেজরা যে কূটজাল তৈরি করেছিল, তা থেকে বেরিয়ে আসা খুব সহজ ছিল না। তারা অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি—সবদিক থেকে এই মানচিত্রকে সাপ্টে ধরেছিল। তাই তাদের ধারালো নখর থেকে ভূখণ্ডকে মুক্ত করার জন্য প্রয়োজন ছিল নানামাত্রিক উদ্যোগ-অভিযানের। এই বাস্তবতাকে সামনে রেখেই শাহ আবদুল আজিজ দেহলবি রহ. নানারকম কর্মপন্থা গ্রহণ করেন।

মুসলমান মাত্রই আল্লাহকে বিশ্বাস করে এবং আল্লাহর কুদরত ও শক্তির শ্রেষ্ঠত্বকে স্বীকার করে। তবু কখনো ঈমান ঝিমিয়ে এলে তাকে উজ্জীবিত করার জন্য একটি ‘নারায়ে তাকবির’ স্লোগানের প্রয়োজন পড়ে। এটা একটা জাগতিক বাস্তবতা। শুরুযুগ থেকেই পৃথিবীর যেখানে ইসলামের শরীরে জরা ধরার অবস্থা তৈরি হয়েছে, তা সারিয়ে তোলার জন্য দীনের মৌলিকত্বকে ঠিক রেখে বিশেষ বিশেষ সংস্কারের পন্থা গ্রহণ করা হয়েছে এবং তাকে সুগঠিত ও সুচালিত করার জন্য বিশেষ শিরোনামেরও ব্যবহার করা হয়েছে। দীন হেফাজতের জন্য এই পন্থা গ্রহণের ধারা প্রাচীন। উপমহাদেশে দীনের পুনরুজ্জীবনের জন্য শাহ আবদুল আজিজ দেহলবি রহ. যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তার নাম ‘তরিকায়ে মোহাম্মাদিয়া’।

তরিকায়ে মোহাম্মদিয়ার পরিচয়:

তরিকায়ে মোহাম্মাদিয়া উনিশ শতকের প্রথম দিকে সংঘটিত মুসলিম পুনর্জাগরণী আন্দোলন। নবীজি হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শিত পথ প্রতিষ্ঠা করাই ছিল এ আন্দোলনের লক্ষ্য। আন্দোলনের কার্যক্রম মূলত কয়েকটি ধারায় বিভক্ত ছিল।

প্রথমত, শিরক ও বিদআতের উচ্ছেদ। কারণ, হিন্দু ধর্মসহ অন্যান্য ধর্মের বাতিল আকিদা-বিশ্বাস ইসলামি আকিদার ওপর দিন দিন প্রভাব বিস্তার করে চলছিল। ইংরেজদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পাশাপাশি এসব ভ্রান্ত মতবাদও ইসলামের চলার পথে বাধা তৈরি করছিল। তাই এগুলোর মূলোৎপাটন ছিল সময়ের দাবি।

দ্বিতীয়ত, তরিকায় মোহাম্মদিয়াকে আন্দোলনে রূপ দেয়ার জন্য প্রয়োজন ছিল একদল নিষ্ঠাবান কর্মীর, যারা নিঃস্বার্থভাবে আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার জন্য চেষ্টা-পরিশ্রম করবে। শাহ সাহেব এমন ক’জন উপযুক্ত কর্মী পেয়েও গিয়েছিলেন। কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তার কেন্দ্রীয় পরিষদ ছিল। পরিষদের আমির ছিলেন শাহ মুহাম্মদ ইসহাক রহ.। সংগ্রাম বিভাগের আহ্বায়ক ও আমির ছিলেন সাইয়েদ আহমদ শহিদ রহ. এবং তার প্রধান সহকর্মী ছিলেন শাহ ইসমাইল শহিদ ও মাওলানা আবদুল হাই রহ.। শাহ আবদুল আজিজ রহ.—এর পর এঁরাই মূলত তরিকায় মোহাম্মদিয়ার কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যান।

আন্দোলনের আরেকটি মৌলিক পদক্ষেপ ছিল গণজাগরণ তৈরি করা। যে কোন বিরাট সংস্কারকাজে হাত দেয়ার আগে ব্যাপকভাবে গণজাগরণ ও সচেতনতা তৈরির বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে শাহ আবদুল আজিজ দেহলবি রহ. দিল্লির কুচাচিলান মাদরাসায় প্রতি সপ্তায় দু’বার করে জনসভা করতে শুরু করেন। এতে বিরাট সংখ্যক লোকের সমাগম ঘটতে থাকে এবং এর মাধ্যমে শাহ সাহেবের আন্দোলনের চেতনা জনগনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

নিখিল বাংলায় এই তরিকায়ে মোহাম্মদিয়া ছিল ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টিকারী আন্দোলন। হাজি শরিয়তুল্লাহর ফরায়েজি আন্দোলন, তিতুমীরের আন্দোলন— এসবই তরিকায়ে মোহাম্মদিয়া দ্বারা প্রভাবিত এবং এগুলো তরিকায় মোহাম্মদিয়ারই অনিবার্য ফল।

সাইয়েদ সাহেবের সম্পৃক্ততা

সাইয়েদ আহমদ শহিদ রহ.–এর জন্ম রায়বেরেলিতে, ১৭৮৬ সালে। বাল্যকাল থেকেই তিনি হকপন্থী ও সোচ্চার মানসিকতার অধিকারী। আঠারো বছর বয়সে এক কাফেলার সঙ্গে জীবিকার সন্ধানে তিনি লখনৌ যান। মাত্র চার মাস না যেতেই তার শাহ সাহেবের সান্নিধ্য গ্রহণের প্রবল বাসনা তৈরি হয় এবং তিনি দিল্লিতে শাহ সাহেবের দরবারে উপস্থিত হন। সেখানে হযরতের একান্ত সান্নিধ্যে পাঁচটি বছর কাটিয়ে তার দেয়া শিক্ষা-দীক্ষা, দিলের তড়প ও মিশন নিয়ে রায়বেরেলি ফিরে আসেন।

এরপর থেকে সাইয়েদ সাহেবের আন্দোলনের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। তার আখলাক ও চেতনায় মুগ্ধ হয়ে দলে দলে মানুষ তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে থাকে। ১৮২১–এর দিকে তিনি প্রায় সাতশ শিষ্যের বিরাট কাফেলা নিয়ে হজে যান। সাইয়েদ সাহেবের জীবনে এই হজ এক স্মরণীয় ঘটনা। এই সফর তার দাওয়াতি চিন্তা ও সংস্কারি চেতনাকে অনেকগুণে বাড়িয়ে দেয়।

হজ থেকে ফিরে তিনি আন্দোলনকে আরো জোরদার করেন। এই পবিত্র আন্দোলন তার মন-মস্তিষ্কে মিশে যায় এবং ভারতবর্ষের আজাদির অভিপ্রায়ে তিনি সর্বাত্মক জিহাদের প্রস্তুতি শুরু করেন।

জিহাদের এই মোবারক ধারাতে একেক করে পরিচালিত হয় নানা অভিযান এবং এই সূত্রেই গাঁথা হয় ঐতিহাসিক বালাকোট আন্দোলন।

বালাকোট আমাদের হৃদয়ের গহীনে থাকা এক স্ফুলিঙ্গের নাম। বালাকোট আমাদের ইতিহাস, আমাদের রক্তের আখরে লেখা এক আজাদির উপাখ্যান। বালাকোট আমাদের চেতনা, আমাদের খুনে আঁকা একখণ্ড রক্তিম মানচিত্র।

 

 

তথ্যসূত্র :

• সিরাতে সাইয়েদ আহমদ শহিদ : আবুল হাসান আলি নদবি রহ.

• সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস : আবুল হাসান আলি নদবি রহ.

• বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস : আব্বাস আলী খান

• দেওবন্দ আন্দোলন, ইতিহাস ঐতিহ্য অবদান : আবুল ফাতাহ মুহা. ইয়াহইয়া রহ.

• চেতনায় বালাকোট : শেখ জেবুল আমিন দুলাল

 

The post ‘ভারত এখন দারুল হারব’ : যেভাবে শুরু হয় তরিকায়ে মোহাম্মদিয়া appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%ad%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a6%a4-%e0%a6%8f%e0%a6%96%e0%a6%a8-%e0%a6%a6%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%81%e0%a6%b2-%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a6%ac-%e0%a6%af%e0%a7%87%e0%a6%ad%e0%a6%be%e0%a6%ac/

উনিশ শতকের উপমহাদেশ : টানাপোড়েনে আলেমসমাজ

রাকিবুল হাসান নাঈম

আঠারো শতকের শেষভাগ এবং ঊনবিংশ শতকের প্রথমভাগে ভারতবর্ষ রাজনৈতিক, ধর্মীয়, নৈতিক তথা চারিত্রিক দিক দিয়ে অবনতি ও অধঃপতনের শেষ সীমায় গিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলো। তাওহীদ, রেসালাত ও আখেরাত-ভিত্তিক ইসলামী জীবনধারা থেকে বিচ্যুতির ফলে যেমন পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে মুসলমানরা দুর্বল ও বিদেশী দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ হয়েছিল, তেমনি ভারত উপমহাদেশেও তারা মোগলপতন যুগে প্রথমে শিখ-মারাঠা কর্তৃক পির্যস্ত ও পরে ইংরেজদের দাসত্বশৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। সম্রাট আলমগীর আওরঙ্গজেবের পর থেকেই উপমহাদেশের মুসলমানদের শাসন ক্ষমতায় পতনের সূচনা ঘটে। আওরঙ্গজেবের তিরোধানের পর তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে যারা দিল্লীর মসনদে আসীন হয়েছিলেন, তাদের বেশীর ভাগই ছিলেন অযোগ্য ও দুর্বল শাসক। ধর্মীয়, চিন্তাগত, নৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে পতন দেখা দিয়েছিলো, তা রোধ করার মতো ক্ষমতা তাদের মোটেই ছিল না। কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শাসকগণ নিজেদেরকে নামেমাত্র দিল্লীর অধীন বলে প্রকাশ করলেও কার্যত তারা স্বাধীন শাসনকর্তা হিসাবেই সংশ্লিষ্ট এলাকাসমূহ শাসন করতেন।

উপমহাদেশের মুসলিম শাসন ক্ষমতার এ দুর্বলতা লক্ষ্য করেই বণিক হিসাবে আগত ইংরেজরা এদেশের শাসক হবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। পরিণামে, পলাশীযুদ্ধে ইংরেজদের হাতে মুসলমানদের বিপর্যয় ঘটে। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার শাসক নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে মুনাফিকদের ষড়যন্ত্রে ইংরেজরা পরাজিত ও হত্যা করে। এভাবে ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দের যুদ্ধে বাংলা দখল করার মধ্য দিয়েই ইংরেজদের সেই স্বপ্নসাধ পূর্ণ হতে থাকে।

হিন্দুদের দৃষ্টিতে বহিরাগত মুসলমানদের পরিবর্তে জবরদখলকারী খৃস্টানদের শাসনে খুব একটা পার্থক্য ছিল না। স্থানীয় হিন্দুরা উপমহাদেশের খৃস্টান শাসনকে সহজভাবে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু বৃটিশরা ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিল যে, মুসলমানরা এত সহজে বৃটিশ শাসন মেনে নেবে না। মুসলমানদের অসহযোগী মনোভাব আর হিন্দুদের অনুগত সমর্থন এ দুই নিয়েই শুরু হয় বৃটিশ শাসন। মুসলমানরা এ পরিবেশকে ‘দারুল হরব বা শত্রু কবলিত এলাকা বলে ঘোষণা করে। শুরু হয় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন।

১৭৫৭ সালের পর থেকে পুরো একশতকেরও অধিককাল মুসলমানেরা আন্দোলন চালিয়ে যায়। ১৭৬৫ সালের ফকির বিদ্রোহ দিয়ে এ সংগ্রাম অধ্যায়ের সূচনা। মাঝখানে ১৮৫৮ সালের সিপাহি বিদ্রোহ, তিতুমীরের বিদ্রোহ, হাজী শরীয়তুল্লাহ ও দুদুমিয়ার আন্দোলন, সৈয়দ আহমদ বেরলভির অভ্যুদয় ও বালাকোটের যুদ্ধ, পাটনায় শাহ এনায়েত আলীর সংগঠন ও তার তৎপরতা, সিত্ত্বানা, মূল্কা ও পাঞ্জাবের যুদ্ধসমূহ প্রভৃতির মাধ্যমে এর বিস্তৃতি এবং ১৮৬৪ সালের সীমান্ত অভিযান ও সর্বশেষ পাটনা, অমলার ষড়যন্ত্র মামলার মাধ্যমে সে সংগ্রাম অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে।

১৮ শতকের শেষদিকে রাজনৈতিক অবস্থা

তৎকালীন উপমহাদেশের মুসলমানগণ সত্যের পথ থেকে বহু দূরে সরে যায়। আরাম-আয়েশ এবং হীন মনোবৃত্তি চরিতার্থ করার উপকরণ সংগ্রহ করা ব্যতীত আমীর ওমরাদের আর কোন কাজ ছিল না। এর পরিণাম সম্পর্কে তারা ছিল সম্পূর্ণ উদাসীন। মোগল শক্তি তখন প্রায় বিভক্ত। আড়াইশত বছরের আপ্রাণ চেষ্টা সাধনার পর করে একটু একটু যে বিশাল সাম্রাজ্য গঠন করেছিল, কাবুল থেকে আসাম, আরাকান এবং কারাকোরাম থেকে কুমারিকা অন্তরীপ, ভোগ বিলাস, গৃহবিবাদ, এবং অরাজকতার মাধ্যমে এক একটি রাজ্য কেন্দ্র থেকে বিচিছন্ন হয়ে যাচ্ছিল। এর মধ্যে যে কয়জন সচেতন ভাষাপ্রাণ এই নিরাশার অন্ধকারকে দূর করে আশার আলো জ্বালাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন হায়দার আলী এবং টিপু সুলতান ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। মহীপুরের হায়দার আলী যে নতুন শক্তির পত্তন করলেন টিপু সুলতান তার শিরায় শিরায় ইসলামের তাজা রক্ত প্রবাহিত করেন। কিন্তু বিরোধ এবং স্বার্থপরতার কারণে তারা তেমন কিছু করতে পারেননি।

এই সময় মোগল সাম্রাজ্যের এক বিরাট অংশে মারাঠাগণ হাঁটু গেড়ে বসে। একবার মোগল সিংহাসনই প্রায় তাদের দখলে চলে গিয়েছিল। পানি পথের যুদ্ধে আহমদ শাহ্ আব্দালী মারাঠাদের উপর চরম আঘাত হানেন। এরপর যদিও মারাঠাগণ ৪০/৫০ বছর টিকে ছিল, কিন্তু পূর্বাবস্থা আর ফিরে পায়নি এবং ক্রমে ক্রমে তারা ধ্বংস হয়ে যায়। পাঞ্জাবে রনজিৎ সিং শক্তি সঞ্চয়ের মাধ্যমে তথাকথিত একটি রাষ্ট্রের নামে ত্রাস সৃষ্টিকারী এক বাহিনী গঠন করে। রনজিৎ সিং-এর মৃত্যুর চার পাঁচ বছরের মধ্যে তা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সিন্ধুর শাসন ক্ষমতা চার জন আমীরের অধীনে ছিল। অযোধ্যায় শুজাউদ্দৌলা, দাক্ষিণাত্যে নিযাম, এবং বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় নবাব আলীবর্দী খান। এদের ধারণা ছিল, সম্পূর্ণ উপমহাদেশ মুসলমানদের অধীনে না থাকলেও অন্ততঃপক্ষে নিজেদের এলাকাগুলো থাকলেই যথেষ্ট। পরবর্তী সময়ে সায়াদাত আলী খান লোভের বশবর্তী হয়ে অযোধ্যার অধিকাংশই ছেড়ে দিলেন। বাকী অংশও পরে তার বংশধরদের হস্তচ্যুত হয়ে যায়।

অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং অরাজকতার দরুন ক্ষয়প্রাপ্ত হতে হতে দাক্ষিণাত্যের সীমানাও প্রায় অর্ধেক হয়ে যায়। নবাব আলীবর্দী খাঁন ইন্তেকালের এক বছরের মধ্যেই বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা ইংরেজদের হাতে চলে যায়। উপমহাদেশে ইংরেজ রাজত্বের ভিত্তিপ্রস্তর এখানেই স্থাপিত হয়। পরে ইংরেজগণ মারাঠা এবং নিযামের সাথে মিলিতভাবে মহিশুরের পতন ঘটায়। একাজ শেষ করে অল্প দিনের মধ্যেই মারাঠা, নিযাম এবং অযোধ্যাকে সাহায্যকারী হিসেবে শৃংখলাবদ্ধ করে বাকী সকলকে পুতুলে পরিণত করে। এর পরপরই উপমহাদেশের কেন্দ্রস্থল দিল্লী হস্তগত করে ইংরেজগণ জেঁকে বসে।

এসময় মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিলো অবনমিত, তাদের কোন নেতা ছিলো না, ছিলো না কোন শৃংখলা। তাদের দুর্বল ও অসহায় পেয়ে নানা ফেতনা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।

১৮ শতকের শেষদিকে ধর্মীয় অবস্থা

তখন ভারতবর্ষের বুকে মুসলমানদের নৈতিক ও চারিত্রিক অবক্ষয় এমন পর্যায়ে নেমে গিয়েছিলো যে, তারা তাদের অন্যায়, অহংকারী কথাবার্তা এবং আচার-আচরণ নিয়ে প্রকাশ্যে গর্ব ও অহংকার করতো। মদ্যপান অবাধে চলতো। আমোদ-প্রমোদ ও ভোগ-বিলাসের ছিলো চারিদিকে ছড়াছড়ি। আমীর-উমাবা এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে শুরু করে গরীব ও নিঃস্ব শ্রেণী পর্যন্ত সবাই ছিলো এ সমাজ ব্যবস্থারই শিকার। শিরক ও বেদআত মুসলমানদের মধ্যে অধিক পরিমাণেই শেকড় গেড়ে বসেছিলো। কবর ও কবরবাসীদের সম্পর্কে একটি স্বতন্ত্র শরীয়তই অস্তিত্ব লাভ করেছিলো। বুযর্গানে দীন সম্পর্কে এমন সব আকীদা ও ধারণা অন্তর-মানসে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, যেগুলোর জন্য খৃস্টান, য়াহুদী এবং আরবের মুশরিক ও পৌত্তলিকেরা নিন্দিত তথা বদনামের ভাগিদার।

সবচে ভয়ংকর হলো, হিন্দু ও শী’আ সম্প্রদায়ের অধিকাংশ আচার-আচরণ ও প্রথা-পদ্ধতি আহলে সুন্নত ওয়াল জামা’আতের সমাজ জীবনের অংগীভূত হয়ে গিয়েছিলো। রাসুল সা. -এর বাস্তব জীবনাদর্শ (সুন্নত) শরীয়তকে তারা ভুলতে বসেছিলো। ইসলামী রীতিনীতি উঠেই যাচ্ছিলো। বহু ভালো ভালো দীনদার ও জ্ঞানী-গুণী পরিবারেও কুরআনুল করীম ও হাদীছ পাকের বিধি-বিধানের প্রতি কোনরূপ তোয়াক্কা করা হতো না। বিধবাদের পুনর্বিবাহ, মীরাছ (উত্তরাধিকার)-এর ক্ষেত্রে মেয়েদের অংশ দেয়া, সালাম দেয়া ইত্যাদিকে অনেক স্থানে দূষণীয় মনে করা হতো। ঠিক তেমনি হজের ন্যায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী রুকনকে রাস্তার কষ্ট-ক্লেশ ও নিরাপত্তার অভাব ইত্যাদি অজুহাত খাড়া করে এর ফরজিয়তকে রহিত করা হয়েছিলো।

তবে জ্ঞানগত, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিকতার দিক দিয়ে এ যুগটি একেবারেই তমসাচ্ছন্ন ছিল না। তখনও উপমহাদেশে মক্তব ও মাদরাসা জালের ন্যায় ছড়িয়ে ছিলো । অলিতে-গলিতে খানকাও ছিলো। উলামায়ে কেরাম উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশে ও শহরগুলোতে ইলম ও দীনের ব্যাপক প্রচার ও প্রসারে ছিলেন নিরন্তর ব্যাপৃত এবং গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশনায়ও ছিলেন তারা মশগুল। খ্যাতনামা মুদাররিস ও তরীকতপন্থি সূফীদের প্রত্যেকেরই স্বতন্ত্র আবাদকৃত মাদরাসা ও খানকা ছিলো। কিন্তু আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যাবার কারণে কমতে কমতে দ্রুত অবলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো মাদরাসাগুলো।

ত্রাণকর্তা হয়ে এলেন ‘তিনি’

উপমহাদেশের মুসলমানদের করুণ এই সময়ে ত্রাণকর্তা হয়ে এলেন হজরত সৈয়দ আহমদ শহীদ রহ.। তিনি তৎকালীন নৈতিক-রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থা ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন, যে ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে উপমহাদেশ অগ্রসর হচ্ছে, সর্বশক্তি দিয়ে এর প্রতিরোধ না করলে এ অঞ্চলে না থাকবে ইসলাম আর না থাকবে মুসলমান। তৎকালীন উপমহাদেশে কাদেরিয়া, চিশতিয়া এবং নকশবন্ধিয়া এই তিনটি বাইয়াত গ্রহণের তরীকা প্রচলিত ছিল। সৈয়দ সাহেব এসব তরীকা বাদ দিয়ে মুহাম্মদী তরীকায় বাইয়াত গ্রহণ করা শুরু করলেন। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, মুহাম্মদ সা. হলেন সবচেয়ে বড় পীর। তাঁর উপর কোন পীর নেই। তাঁর তরীকা বাদ দিয়ে অন্য কারুর তরীকা শ্রেষ্ঠ হতে পারে না। জীবনের প্রত্যেকটি কাজ আল্লাহর সমষ্টি হাসিলের উদ্দেশ্যে মুহাম্মদ সা.-এর তরীকা বা পদ্ধতি অনুযায়ী সমাধা করা, যেমন শ্রম দেয়ার উদ্দেশ্য হচেছ নিজের ও পরিবারের ভরণ পোষণের জন্য হালাল উপার্জন, রাতে ঘুমানোর উদ্দেশ্য শেষ রাতে জেগে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করা এবং ওয়াক্তের প্রথম দিকে ফজরের নামাজ আদায় করা, পানাহার করার উদ্দেশ্য হচেছ শরীর সুস্থ রেখে আল্লাহর আহকাম পালন করা, রোজা, নামাজ, হজ্ব আদায় করা এবং প্রয়োজন বোধে জিহাদ করার শক্তি সঞ্চয় করা। মোটকথা জীবনের প্রতিটি কাজকর্ম, কথা-বার্তা, চলা-ফেরা, আদান-প্রদান, মুহাম্মদ সা. প্রদর্শিত পদ্ধতি বা তরীকা অনুযায়ী শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে হতে হবে। কুসংস্কারাচ্ছন্ন মুসলিম সমাজকে হযরত মুহাম্মদ সা.-এর মূল শিক্ষার দিকে ফিরে আসার আহ্বান জানাতেন বিধায় সৈয়দ সাহেবের নীতিসমূহ তরীকায়ে মুহাম্মদী বা রসুল সা.-এর মৌলবাদ হিসেবে ইতিহাসে খ্যাতি অর্জন করে। সৈয়দ আহমদ কর্তৃক গৃহীত নীতিসমূহের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন প্রসিদ্ধি পায় ‘তরীকায়ে মুহাম্মদী আন্দোলন’ নামে।

 

সাইয়েদ আহমদ শহীদ আধ্যাত্মিক শক্তি সঞ্চয়ের জন্যে তার শত শত কর্মীকে নিয়ে ১৮১৯ খৃষ্টাব্দে পবিত্র হজ পালনের লক্ষ্যে মক্কা শরীফ গমন করেন। হজের যাত্রাপথে তিনি বিভিন্ন স্থানে নোঙ্গর করে হাজার হাজার মানুষের বায়াত গ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে ওয়ায-নসিহত করেন। আর অসংখ্য মানুষের দাওয়াত গ্রহণ করেন এবং তাদের নযরানা গ্রহণ করেন। এখানে একটি কথা বলে রাখতে হয়, অর্থ-সামর্থের দিক থেকে সৈয়দ সাহেবের উপর হজ ফরজ ছিল না। তারপরও প্রধানত দুটি উদ্দেশ্যে তিনি হজ করার নিয়ত করেন। প্রথমত, ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ শুরু করার পূর্বে ইসলামের কেন্দ্রভূমি এবং খোদার ঘর জিয়ারত করাকে জরুরী মনে করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, উপমহাদেশে সে সময়ে হজে যাওয়ার ব্যাপারে একটা ভুল ধারণা প্রচলিত ছিল যে- হজে যাওয়া বিপদজনক এবং জীবনের নিরাপত্তা নেই; অতএব উপমহাদেশের কোন লোকের হজে যাওয়া ফরজ নয়। এই ভুল ধারণা দূর করে উপমহাদেশে হজের উপযুক্ত ব্যক্তিদেরকে উৎসাহ প্রদান করার জন্যই সৈয়দ আহমদ বহু প্রচার প্রচারণা করে হজে গমন করেন। তার উভয় উদ্দেশ্যই সার্থক হয়েছিল। ইসলামের কেন্দ্রভূমি পবিত্র মক্কা এবং হযরত মুহাম্মদ সা.-এর রওজা মোবারক জেয়ারত করা হলো। হজের উদ্দেশ্যে সৈয়দ সাহেবের রওয়ানা হওয়ার কথা শুনে হজের উপযুক্ত বহু লোক উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তার সফরসঙ্গী হয়েছিল।

১৮১৯ খৃষ্টাব্দে তিনি ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন। স্বদেশে ফিরে তিনি ইসলামী আন্দোলনকে লক্ষ্যে পৌঁছাবার জন্যে জেহাদের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তার দলের প্রতিটি মোজাহিদকে তিনি ইসলামের সোনালী যুগের আন্দোলনের কর্মী সাহাবীদের আদর্শে গঠন করতে চেষ্টা করেন। প্রস্তুতি পর্বে সাইয়েদ সাহেব দেশের প্রভাবশালী মুসলমানদের সাথেও যোগাযোগ করেন। নবাব সোলায়মান জা’কে লিখিত তার একটি পত্র পাওয়া যায়। ঐ পত্র থেকে তার আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। পত্রটি হলো: ‘আমাদের দুর্ভাগ্য, হিন্দুস্থান কিছুকাল হয় খৃষ্টানদের শাসনে এসেছে এবং তারা মুসলমানদের উপর ব্যাপকভাবে জুলুম নিপীড়ন শুরু করেছে। বেদআতে দেশ ছেয়ে গেছে এবং ইসলামী আচার-আচরণ ও চালচলন প্রায় উঠে যাচ্ছে। এসব দেখে আমার মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে। আমি জেহাদ অথবা হিজরত করতে মনস্থির করেছি।’

শরীয়াতুল্লাহ ও তিতুমীরের আন্দোলন

সৈয়দ আহমদের আন্দোলন চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশের ফরিদপুর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ‘ফারায়েজী আন্দোলন’ নামে অপর একটি ইসলামী সংস্কার আন্দোলন চলছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন হাজী শরীয়াতুল্লাহ। এ আন্দোলনটি তরীকায়ে মুহাম্মদী আন্দোলনের মতোই ছিল। বাংলার মাটিতে যখন হাজী শরীয়াতুল্লাহ ইংরেজবিরোধী বিদ্রোহের বীজ বপন করছিলেন, সৈয়দ আহমদ বেরলভির বিপ্লবাত্মক আন্দোলন তখন উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের আকাশ মাটি তোলপাড় করছিল। তখন উপমহাদেশের পূর্ব প্রান্তে আর একজন মর্দে মুজাহিদ বিপ্লবের আগুন জ্বালিয়ে ছিলেন, নাম তার সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীর। ১৭৮২ খ্রীষ্টাব্দে চব্বিশ পরগণা জেলার চাঁদপুর গ্রামে তিতুমীর জন্মগ্রহণ করেন। সৈয়দ আহমদ বেরলভি যখন মক্কায় হজ্জ্ব করতে যান, ঘটনাচক্রে তিতুমীরও সেবার মক্কা শরীফ গিয়েছিলেন। তিতুমীর সেখানে সৈয়দ সাহেবের সান্নিধ্য পান এবং তার দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে ১৯২৭ খ্রীষ্টাব্দে দেশে ফিরে ইসলামী সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন। তিতুমীরের এ সংস্কার আন্দোলন চব্বিশ পরগণা, ফরিদপুর ও নদীয়া জেলায় জোরদার হয়েছিল। ওদিকে আন্দোলনের চূড়ান্ত সফলতার পূর্বেই ১৮৪০ সালে হাজী শরীয়তুল্লাহ ইন্তেকাল করেন। আর তিতুমির ইন্তেকাল করেন ১৮৩১ সালে, বালাকোট যুদ্ধের ১১ দিন পর এক ইংরেজবিরোধী যুদ্ধে।

হজের সফরে যে সমস্ত বিখ্যাত ব্যক্তি সৈয়দ সাহেবের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেন, তাদের তালিকায় মাওলানা ঈমাম উদ্দীন বাঙ্গালীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলার অধিবাসী ছিলেন তিনি। সৈয়দ সাহেবের খুবই অনুরক্ত ছিলেন। বাইয়াত গ্রহণের পর থেকে জীবনের শেষ পর্যন্ত সৈয়দ সাহেবের সাথী ছিলেন। সৈয়দ সাহেবের হজ গমন উপলক্ষে মাওলানা ঈমাম উদ্দীন বাঙ্গালী নোয়াখালী সফর করেন এবং প্রায় ত্রিশ চল্লিশ জন নোয়াখালীবাসীকে সাথে করে নিয়ে আসেন। পরবর্তী সময়ে তারা সকলেই সৈয়দ সাহেবের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেন এবং তরীকায়ে মুহাম্মদী আন্দোলনের কর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

এছাড়া বাংলার এক সম্রান্ত ব্যক্তি মুন্সী আমিন উদ্দীন আহ্মদ সৈয়দ সাহেবের হজে যাওয়ার সময় বাইয়াত গ্রহণ করেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর সাথী ছিলেন। মৌলবী ওয়ারেস আলী বাঙ্গালী নামের আর একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব প্রথমদিকে আন্দোলনের প্রাথমিক সদস্য হিসেবে নাম লিখালেন। কিছুদিন কাজ করার পর সঠিক অর্থে আন্দোলন বুঝতে পেরে নিজের ভাগ্যকে আন্দোলনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ফেললেন এবং সৈয়দ সাহেবের হিজরতের সময় তিনিও নিজের জন্মভূমি এই সুজলা-সুফলা বাংলাদেশ ত্যাগ করে সীমান্তের পাহাড়িয়া এলাকার পাঞ্জাতারে বসতি স্থাপন করেন। এই আন্দোলনের নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে আরেকজন বাংলাভাষী মুসলমানের নাম পাওয়া যায়। তিনি হচেছন শেখ বুরহানুদ্দীন বাঙ্গালী। ইনিও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সৈয়দ সাহেবের সাথী ছিলেন।

বালাকোট ও তার প্রভাব

তরিকায়ে মুহাম্মাদিয়া আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ কালপর্বে, ১৮৩১ সালে ঘটে যায় বালাকোট যুদ্ধ। এ যুদ্ধে বালাকোট নামক স্থানে শিখদের সঙ্গে তার প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে খুবি খাঁ নামক এক পাঠানের বিশ্বাসঘাতকতায় সাইয়েদ আহমদ বেরলভী ও মওলানা শাহ ইসমাইল দেহলভী শাহাদাত করেন।

সাইয়েদ সাহেব তার শাহাদাতের পূর্বে নিজেই বালাকোটের রণাঙ্গণ থেকে তার বিশিষ্ট খলীফা মওলানা বেলায়েত আলী আজীমাবাদীকে ভারতের অভ্যন্তরে আন্দোলনের উপকরণ সংগ্রমের কাজে নিয়োজিত থাকতে পাঠিয়েছিলেন। বালাকোটের মর্মান্তিক খবর প্রাপ্তির সময় মওলানা বেলায়েত আলী ছিলেন হায়দ্রাবাদে। এ ছাড়া ঐ সময় সাইয়েদ সাহেবের অপর যে একজন বিশিষ্ট খলীফা ছিলেন, তিনি হলেন মওলানা মুহাম্মদ আলী। তিনি বালাকোট ঘটনার সময় মোজাহেদ রিক্রুটিংয়ের কাজে নিয়োজিত ছিলেন মাদ্রাজে। আজাদী সংগ্রামের মহা নায়কের শাহাদাতের খবরে সাময়িখ ভাবে তারা ব্যথায় ভারাক্রান্ত হলেও হতোদ্দম হননি। আন্দোলন ছেড়ে দেননি। এ ঘটনার পর মওলানা বেলায়েত আলী তাবলীগ ও জেহাদের নতুন কর্মসূচী গ্রহণ করলেন। তার ছোট ভাই মওলানা এনায়েত আলীকে বাংলা দেশে পাঠান। মওলানা জয়নুল আবেদীন ও মওলানা মুহাম্মদ আলী হায়দ্রাবাদে কাজ করে যান। এ ভাবে অন্যান্য সহচর ও বন্ধু-বান্ধবদেরকে তিনি ভারতের বিভিন্ন এলাকায় প্রেরণ করেন।

বালাকোট আন্দোলন সাময়িকভাবে ব্যর্থ হলেও তা সম্পূর্ণ ব্যর্থ বলা যায় না। বালাকোটের পরও মুসলমানেরা চুপ থাকেননি। পরে জেলজুলুম, ফাঁসি, দ্বীপান্তর, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত, জঘন্য নিত্য নির্যাতন ইত্যাদি তাদের ঈমানকে টলাতে পারেনি। একদিকে তারা সীমান্তে ইয়াগিস্তানে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন, অপর দিকে শাহ ওয়ালিউল্লাহর সুযোগ্য বংশধর ও সাইয়েদ সাহেবের মন্ত্রশিষ্য মওলানা শাহ ইসহাক সাহেবের নেতৃত্বে পূর্ব থেকে ভারতের অভ্যন্তরে ইংরেজদের চক্ষু এড়িয়ে শিক্ষা-সংস্কৃতির চর্চা ও জেহাদের অনুকূলে কাজ চলতে থাকে। তারা সতর্কতার সহিত সে কাজ চালিয়ে যেতেন। মুক্তিযোদ্ধারা স্থানে স্থানে মাদ্রাসা কায়েম ও ধর্মীয় সভাসমিতির মাধ্যমে ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ টিকিয়ে রাখার কাজ করতেন। এ সঙ্গে খুব সন্তর্পণে জিহাদী প্রচারণা ও ইসলামী জাগরণকে উপমহাদেশে টিকিয়ে রাখার জন্য তারা আপ্রাণ চেষ্টা চালান।

সে প্রচেষ্টা ও পরিকল্পনার অংশ হিসাবেই আমরা বিশ্ব বিখ্যাত উচ্চ দ্বীনি শিক্ষা কেন্দ্র দারুল উলুম দেওবন্দ বিশ্ব-বিদ্যালয়ের মত প্রতিষ্ঠানসমূহ দেখতে পাই। এগুলোকে কেন্দ্র করে পরবর্তী পর্যায়ে আরও অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং উপমহাদেশে ভবিষ্যতের জন্যে ইসলামী পুনর্জাগরণের পথ উন্মুক্ত হয়। উত্তরকালে ‘অসহযোগ আন্দোলন’ ও ‘খেলাফত আন্দোলন’কে উপলক্ষ্য করে মুসলমানদের মধ্যে আযাদী আন্দোলনের যে সাড়া জাগে এবং ১৯৪৭ সালে ইসলামের নামে পাকিস্তান নামক যে রাষ্ট্রটি অর্জিত হয়, এই প্রত্যেকটি কাজেই ঐসব প্রতিষ্ঠানের অপরিসীম অবদান রয়েছে।

পলাশি থেকে বালাকোট এবং তার পরবর্তী পুরো কালপর্বটিকে পাঁচ ভাগে বিভক্ত করা যায়। এক. শাহ ওয়ালিউল্লাহর তিরোধানের পর তার সুযোগ্য পুত্র শাহ আবদুল আজিজ দেহলভী থেকে নিয়ে বালাকোট প্রান্তরে সাইয়েদ আহমদ শহীদ ও মওলানা ইসমাইল শহীদের শাহাদাৎ পর্যন্ত (সন ১৮৩১ খৃ.)। দুই. বালাকোট থেকে নিয়ে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত। তিন. ১৮৫৭ সাল থেকে ১৮৬৬/৬৭-তে প্রতিষ্ঠিত দারুল উলুম দেওবন্দ কেন্দ্রীক আন্দোলন পর্যন্ত। চার. দেওবন্দ থেকে নিয়ে ইংরেজ বিতাড়তের মধ্য দিয়ে আজাদী হাসিল পর্যন্ত। পাঁচ. আজাদী হাসিল থেকে বর্তমানের বাংলা-পাক-ভারতে পরিচালিত ইসলামী আন্দোলন পর্যন্ত।

The post উনিশ শতকের উপমহাদেশ : টানাপোড়েনে আলেমসমাজ appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%89%e0%a6%a8%e0%a6%bf%e0%a6%b6-%e0%a6%b6%e0%a6%a4%e0%a6%95%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%89%e0%a6%aa%e0%a6%ae%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6-%e0%a6%9f%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%be/

ফজলে রসুল বাদায়ুনীর চোখে বালাকোট : বিকৃতি ও অপব্যাখ্যা

খালিদ মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ

ফজলে রাসুল বাদায়ুনী ১২১৩ হি. সফর মাস মোতাবেক ১৭৯৮ সালে ভারতের বাদায়ুন অঞ্চলে জন্মগ্রহন করেন। বাবা আব্দুল হামিদ এবং দাদা আব্দুল মাজিদ থেকে নাহু-সরফ সহ প্রাথমিক তালিম সম্পন্ন করেন। বাড়তি পড়াশোনার জন্য ১২ বছর বয়সেই তিনি লাখনো চলে যান এবং সেখানে ফিরিঙ্গি মহলের আলেম মৌলভী নুরুল হক থেকে বিভিন্ন শাস্ত্রে দক্ষতা হাসিল করেন। পিতার আহবানে সাড়া দিয়ে গ্রামে ফিরে এসে কাদেরিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি অনবরত পিতার হাতে বাইয়াত লাভের জন্য আবেদন করলেও ইজাযত মেলে নি; আখের তিনি বুঝলেন যে, দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে নতুবা ইজাযত মিলবে না। নিজেকে জাগতিক চাহিদা ও খায়েশ থেকে অবমুক্ত করে হাজির হলেন বাবার সামনে। পিতা আব্দুল হামিদ তাকে ফুসুসুল হিকাম এবং মাসনবীয়ে রুমির পাঠ দিয়ে উপযুক্ত করে বাইয়াত প্রদান করেন। ফজলে রাসুল বাদায়ুনী ছিলেন বেরেলভী মাসলাকের একজন একনিষ্ঠ অনুসারী । ওয়াজ, দরস-তাদরিস এবং লেখালেখির মাধ্যমে বেরেলভী চিন্তাকাঠামোকে হেফাজত করার চেষ্টা চালিয়েছেন; তাঁর রচিত ‘সাইফুল জাব্বার’ এবং ‘বাওয়ারেকে মুহাম্মাদিয়া’ এই ধারার বিশেষ সংযোজন। ৮ আগস্ট ১৮৭২ সালে তিনি ওফাত লাভ করেন। ১

তার ব্যাপারে রাজিউদ্দিন বাদায়ুনী একটি চমৎকার ঘটনা বর্ণনা করেছেন- একবার ফজলে রাসুল মশহুর দরবেশ কুতুবুদ্দিন কা‘কী রহি. এর কবরের পাশে ছিলেন, হঠাৎ মদিনায় রওজায়ে আতহার জিয়ারতের আগ্রহ জাগল, তিনি খরচপাতির চিন্তা না করে তাৎক্ষণিক পায়ে হেঁটে রওনা দিলেন। সপ্তম দিনে মুম্বাই পৌছে সফরের ইজাযত চেয়ে তিনি বাবাকে চিঠি লিখলেন, পিতা খুশি হয়ে অনুমতি দিলেন। ২ অতপর তিনি পায়ে হেটেই রওনা করেন। সবকিছুর পরও এ কথা সত্য যে, নজদি আন্দোলনের প্রতি অতি-বিদ্ধিষ্ট মনোভাব তাকে চিন্তা প্রকাশে বেশকিছু ক্ষেত্রে প্রান্তিক অব্স্থানে ঠেলে দিছে। বিশেষত বিদ্যমান নিবন্ধে বালাকোট আন্দোলনের ব্যাপারে তার থেকে প্রকাশিত বিকৃতি দেখিয়ে সত্য সঠিক অবস্থান প্রকাশ করব।

ওহাবী তাহরিক বইয়ে ফজলে রাসুল বাদায়ুনী শাহ ঈসমাইল শহীদ এবং আহমদ বেরেভীর জিহাদি আন্দোলনের ব্যাপারে মন্তব্য করে বলেন, “এই নব্য-ধর্ম নতুন রুপ ধারণ করেছে, মৌলভী ঈসমাইল যুদ্ধের জন্য ওয়াজ আরম্ভ করল, কথাগুলো সাধারন মুসলিমদের মনপুত হলে তারা জানমাল নিয়ে তার খেদমতে হাজির হয়, তারপর ঈসমাইল শহীদ তাদের জমা করে আফগানের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সে সাইয়েদ আহমদকে আমীরুল মুমিনিন ঘোষণা করে। এবং বিভিন্ন কারামতের কথা বলে এবং দেখিয়ে মানুষকে দলে ভিড়ায়।… ৩ ফজলে রসুল আরো বলেন, বর্তমানে সাইয়েদ আহমদের অনুসারীরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে গেছে- কেউ মনে করে সাইয়্যেদ আহমদ পুনরায় ফিরে আসবেন, তার প্রদত্ত ওয়াদা পুরণ করবেন। কেউ বলে, তিনি পাহাড়ে দুনিয়ার মানুষ থেকে গোপন হয়ে জীবিত আছেন, সাইয়্যেদ আহমদের অধিকাংশ অনুসারী মনে করেন তিনি ফিরে আসবেন। কেউ তো বিশ্বাস করে যে তার ফিরে আসার কথা অস্বীকার করা কুফুরি। যারা অস্বীকার করে তারা কাফের। সাইয়েদ আহমদ শহীদ এবং ইসমাইলের ইন্তেকালের পর এই নব্য-ধর্মের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়। তাকবিয়াতুল ঈমান কিতাবটিও লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায়। স্বর্বোপরি এই ছিল ওহাবীদের হালত, যা আমি তুলে ধরলাম। ৪

ফজলে রসুল বাদায়ুনীর উপরোক্ত বরাতে মোটাদাগের ৩ টি আলাপ আছে – প্রথমত, শাহ আহমদ শহীদের আন্দোলনকে জাদিদ দ্বীন বা নব্য-ধর্ম হিসাবে বিবেচনা। দ্বিতীয়ত, শহীদ ঈসমাইলের অনুসারীরা তার পুনরুজ্জীবনে বিশ্বাস রাখে বলে দাবি । তৃতীয়ত, বালাকোট তথা: আহমদ শহীদ এবং শাহ ঈসমাইল শহীদের আন্দোলন কি ওহাবী আন্দোলন ছিল ?

*আহমদ শহীদের আন্দোলন কি নতুন ধর্ম ?

এই ধরনের আলোচনা পদ্ধতির মৌলিক সমস্যা হচ্ছে, প্রতিক্রিয়াশীলতা এবং বিদ্ধেষমুলক মানসিকতা; এটি যেকোন আলাপকে তার সীমার বাইরে নিয়ে যায়। এই টপিকে আমরা আলাপ করবো না, কারণ আমার মনে হয় না, বাদায়ুনীর চিন্তা-মতামতকে পছন্দ করেন, যোগাযোগ রাখেন এবং তার মাসলাকের সাথে সংযুক্ত আছেন এমন কেউ তার এই দাবীকে একালে মেনে নেবেন। আর যদি মেনে নেন, তাহলে দুঃখজনকভাবে তার চিন্তার ভ্রান্তি দূর করার ক্ষমতা আমার নাই। তাছাড়া আপনি তখন আসলে আলাপের মুলস্রোতে থাকছেন না। তখন আপনার সাথে আমাকে আলাপ করতে হবে কুফরের পরিচয় নিয়ে, ঠিক কি কারণে একজন মানুষ কাফের হয় তা নিয়ে এবং ঠিক কি কি বৈশিষ্ট্য থাকলে ইসলামের মধ্যে একটা দল ‘নতুন ধর্ম’ রুপে আবির্ভুত হতে পারে; কিন্তু সে আলাপের জন্য আপাতত এই প্রবন্ধে আমরা প্রস্তুত নই। এবং প্রতিশ্রুতিশীলও নই।

*শহীদ ঈসমাইলের অনুসারীরা কি তার পুনরুজ্জীবনে বিশ্বাস রাখে ?

এক্ষেত্রে ফজলে রসুল সাহেবের যে বিচ্যুতি ঘটেছে, তার পেছনে দুইটি প্রসঙ্গকে আমরা দায়ী করতে পারি- এক. সেকেন্ডারি কিছু তথ্যমতে বালাকোট প্রাঙ্গনে আহমদ শহীদের শাহাদতের পর তার কিছু কিছু ভক্ত ও অনুরক্ত মাজযুব হয়ে যান। তারা উদভ্রান্তের মতো হয়ে যান এবং বলতে থাকেন শাহ আহমদ আবার আসবেন এবং দেশ স্বাধীন করবেন। আদতে এই খন্ডিত ঘটনাকে সামগ্রিক চিত্র দিয়েছেন তিনি। দুই. আরেকটি সম্ভাবনা হচ্ছে- মাহদিবাদি আন্দোলন। অতিতেও মুসলিম উম্মাহ যখন বড় ধরনের জাতীয় সংকটে নিপতিত হয়েছে তখনই মাহদীবাদের ধারণা তাদের মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আব্বাসী শাসনের সূচনাকালে, তাতারীদের আক্রমনের মূখে, ১৯শ শতাব্দীর শেষভাগে সুদানে মুহম্মদ আহমদ এবং সবশেষে উপনিবেশিত ভারতেও কাদিয়ানী সহ অনেকে নিজেদের মাহদি দাবী করেছিল। ৫ সে সময়ে মাহদীবাদে প্রভাবিত মুসলমানদের মধ্যে কেউ তাকে মাহদী মনে করেছিল কি না, এ ব্যাপারেও বিশুদ্ধ বা অশুদ্ধ কোন ধরনের বরাত আমি পাই নি, সম্ভাবনা হিসেবে বললাম। তবে মৌলিকভাবে ফজলে রসুল বাদায়ুনীর এ দাবী ভিত্তিহীন।

* বালাকোট তথা: আহমদ শহীদ এবং শাহ ঈসমাইল শহীদের আন্দোলন কি ওহাবী আন্দোলন ছিল ?

সৌদি আরবের নজদ এলাকায় ১৭০৩ সালে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওহাব নজদী নামক ইতিহাসখ্যাত সংস্কারকের জ্ন্ম হয়। সে সময়ে আরবে বিভিন্ন বিদআত ও কুসংস্কারের প্রচলন ছিল। তিনি মুলত ইবনে তাইমিয়া এবং ইবনুল কাইয়ুমের চিন্তাধারায় প্রভাবিত ছিলেন। আবু যুহরা তার ইবনে তাইমিয়া বইয়ের শেষদিকে ওহাবী আন্দোলন সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেন, ইবনে তাইমিয়া এমন একজন লোক, জীবদ্দশা থেকেই যার পক্ষ-বিপক্ষ দুই ধরনের লোক ছিল, তার পক্ষের লোকেরাও তাকে নিছক একজন মুজতাহিদের চেয়ে বেশিকিছু মনে করতেন না – কিন্তু আঠারো শতকে মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওহাব নজদী সবচে আগ্রাসী কাজ করেছেন, তিনি দীর্ঘদিন তাদের কিতাবপত্র মুতালা করেন; ইবনে তাইমিয়াকে রীতিমতো আবু হানিফা, শাফিঈ, মালেক ও আহমদ রাহি. এর অবস্থানে এনে দাড় করান, এবং ইবনে তাইমিয়াকে ঘিরে গড়ে উঠে সালাফি / নজদী আন্দোলন। ফিকহ ও আকিদায় চার মাযহাব সহ উম্মাহর সকলকে ঠেলে দেওয়া হয় বিপরীত মেরুতে। ৬ মৌলিকভাবে এই হচ্ছে ‘ওহাবী আন্দোলন’।

কথা হচ্ছে, বৃটিশ শাসনে ওহাবী আন্দোলন সম্পর্কে বিচিত্র তথ্য ও সংবাদ হিন্দুস্থানের মুসলমানদের কাছে পৌছতো। সবমিলিয়ে তখন একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া বিরাজ করছিল উপমহাদেশে; এবং এই মিশ্র প্রতিক্রিয়া থেকে আলেম সমাজও প্রভাবমুক্ত ছিল না। ৭ ইংরেজরা যখন শাহ আহমদ শহীদ রাহি. এর তরিকায়ে মুহাম্মাদিয়ার ব্যাপকতা এবং দলে দলে মানুষের অংশগ্রহন দেখে ইংরেজ শাসক ভীতসন্ত্রস্থ হয়ে গেল, তারা তখন ওহাবী আন্দোলনের ব্যাপারে হিন্দুস্থানের এই মিশ্র আবহকে কাজে লাগিয়ে কর্মীদের উদ্দীপনাকে নিস্তেজ করার জন্য প্রথমত প্রচার করল যে, সৈয়দ সাহেব ইংরেজদের শুভাকাঙ্খি ও বন্ধু । দ্বিতীয়ত সৈয়দ সাহেবের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে তারা বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার চালালো এবং এই আন্দোলনকে ওহাবী বলে প্রচার চালালো। বিশেষত, উইলিয়াম হান্টার এ বিষয়টিকে আরও ধোয়াশাপূর্ণ করেছে তার দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস বইয়ে। ৮

হান্টারের দেওয়া তথ্যের নাকামি বোঝার জন্য আপনাদের জন্য একটা উক্তি তুলে ধরছি, সে লিখেছে “আব্দুল ওহাব সর্বপ্রথম এইসব জঘন্য কাজকর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠে। ক্রমান্বয়ে তার মতাবলী একটি ধর্মীয় মতবাদের রুপ ধারণ করে এবং ওহাবী মতবাদ নামে বিস্তার লাভ করে। ভারতীয় মুসলমানদের অধিকাংশ-ই এখন এ মতাবলম্বী। ৯ খেয়াল করেন, হালামলে সালাফি ইসলামের এতো বেশি প্রচারণা এবং সৌদি রাষ্ট্রের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতার পরও সালাফিরা উপমহাদেশে সংখ্যালঘু। দুইশো বছর আগে কিভাবে তারা ‘অধিকাংশ’ হয় ! সুতরাং বালাকোটকে ‘ওহাবী’ বলে হান্টার ঠিক কি ধরনের ওহাবী চিন্তার কথা বলছেন তা আমাদের বোধগম্য নয়। আদতে আমরা যতদূর অনুমান করতে পারি, তাতে মনে হয়- আরবে সৌদ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অভিজ্ঞতা থেকে হান্টারের একটা বদহজম হয়েছে, সে মনে করতে শুরু করছে যে, যেকোন বিপ্লবী ও আন্দোলনবাদি চিন্তাই ওহাবী চিন্তা।

মুলত হযরত ঈসমাইল শহীদ ছিলেন শাহ ওলীউল্লাহী খান্দানের লোক। ইমামে রাব্বানীর পর উপমহাদেশের অন্যতম মুজাদ্দিদ হচ্ছেন শাহ ওলীউল্লাহ রাহি.। এই অঞ্চলে হাদিসপাঠে ব্যাপকতা, কুরআনের ফারসি অনুবাদ, তাসাউফ, অর্থনীতি এবং মাযহাব সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে সংষ্কারমুলক মতামত ছিল তার; তার ব্যাপারেও (লা-মাযহাবী) মাযহাব বিরোধীতার গুজব তুলেছিল অনেকে, কুরআনের অনুবাদের জন্য অনেকে তাকে রীতিমতো কাফের আখ্যা দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তব কথা হচ্ছে- শাহ ঈসমাইল ওলীউল্লাহী খান্দানের একজন সদস্য হবার সুবাদে সংষ্কারমুলক বিপ্লবী চিন্তার উত্তরাধিকার বহন করেছিলেন, শিরক-বেদআত, কু-সংষ্কারের বিরুদ্ধে তাজদিদী প্রস্তাব পেশ করেছেন। অবশেষে দুঃখজনকভাবে তিনিও ওহাবী হিসেবে সমালোচিত হলেন। উবাইদুল্লাহ সিন্ধি সহ বেরেলভী ধারার একটা বড় অংশ তাকে এবং বালাকোট আন্দোলনকে ওহাবী হিসেবে সমালোচনা করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মাওলানা সিন্ধীর মতে, বালাকোট আন্দোলন সফল না হবার পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে- এতে শাওকানিয়াত, ওহাবিয়াত অথবা আরো পরিষ্কার করে বললে গায়ের মুক্বাল্লিদিয়াতের সংমিশ্রণ ঘটেছিল’।

মাওলানা সাইয়েদ সুলায়মান নাদভী মাওলানা সিন্ধীর এ মত সম্পর্কে বলেন, ‘এই আন্দোলনের ঝান্ডাবাহীদের মধ্যে ফিক্বহী ঝগড়া-ঝাটি অথবা জোরে আমীন ও রাফ‘উল ইয়াদায়েনের মাধ্যমে বিদ‘আত উৎখাতের চিন্তা কখনোই স্থান পায়নি। সাইয়েদ আহমাদ শহীদ, মাওলানা শাহ ইসমাঈল শহীদ ও অন্যান্য যারা আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন তাদের লেখা বই-পুস্তক, বক্তৃতা-বিবৃতি, তর্ক-বিতর্ক, পত্রাবলী ইত্যাদি মওজুদ আছে। সেসব থেকে দলীল দিতে হবে। জিহাদ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল আক্বীদা-বিশ্বাসের সংস্কার, আমল সংস্কার, তাওহীদের প্রচার-প্রসার, বাতিল খন্ডন, অবৈধ রসম-রেওয়াজের অবসান ঘটানো এবং ইসলামী বিধি-বিধান চালু করা। বাকী যেসব কথা তাদের নামে বলা হয় তা দু’একজনের কথা, যা এ ক্ষেত্রে দলীল হওয়ার উপযুক্ত নয়। … তবে এটা হ’তে পারে যে, এ আন্দোলন ইত্তেবায়ে সুন্নাতের যে জজবা সৃষ্টি করেছিল তার প্রভাবে হয়তো অনেকে ওহাবী আন্দোলনের সমর্থক হয়ে যায়। ১০ সুলাইমান নদভীর বিশ্লেষণ বাস্তবসম্মত ; এ ধরনের ফলাফল ইতিহাসে ঢের বেশি। নিকট অতিতে আজাদ সুবহানী, ওবাইদুল্লাহ সিন্ধীর চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়ে মাওলানা ভাসানী এবং আবুল হাশিমরা যে ধরনের কৃষক-শ্রমিক-প্রজাদের অধিকার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তা দিনশেষে মার্ক্সবাদী/ বামপন্থীদের অধিকারে চলে যায়, ইভেন ‘ইসলামের মর্মকথা’ বইয়ের লেখক আবুল হাশিমের ছেলে হয়ে উঠে প্রখ্যাত বদরুদ্দীন উমর। ভাসানীর ছেলেরা এখন বামপন্থী আন্দোলনের ক্রীড়নক। বালাকোট আন্দোলনে সুন্নতের ইত্তেবা, কুসংষ্কার দূরীকরণ, তাওহীদের প্রচার ইত্যাদি বিষয় ছিল মৌলিক প্রেরণা, যেখান থেকে তৎকালীন বহু আহলে হাদিস অনুসারীরাও শরিক হয়েছিল আন্দোলনে। এই ব্যাপারটা কিছু কিছু সালাফিদের নজরে এসেছে, অনেক ব্রেলভীদের লেখাও এই সত্য প্রকাশিত হয়েছে- মাসিক আত-তাহরীরে একটা প্রবন্ধে ‘বালাকোটে সালাফিদের অংশগ্রহন’ বিষয়ে আলাপ করতে এসে লেখক দেখাচ্ছেন যে, এছাড়া খালীক আহমাদ নিযামীও ওহাবী মুজাহিদদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ না নেওয়ার কথা যারা তুলেছেন তাদের দাবী প্রমাণসহ খন্ডন করেছেন। তিনি ‘১৮৫৭ সাল কা তারিখী রোযনামচা’ (১৮৫৭ সালের ঐতিহাসিক দিনলিপি) গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘আন্দোলনে (অর্থাৎ ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের আন্দোলনে) কার্যকরীভাবে অংশগ্রহণকারী অনেককেই সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রহঃ)-এর চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত বলে মনে হয়। বখত খাঁ আলেমদের সাথে যেভাবে সম্পর্ক ও যোগাযোগ রাখতেন তাতেও এটা ফুটে ওঠে যে, তিনি সাইয়েদ ছাহেবের আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। ১১ সালাফি ওয়েবসাইট মাজলিসুত তাহকিকিল ইসলামির ‘মুহাদ্দিস ফোরামে’ এক ব্যক্তির প্রশ্নের জবাবে বলা হয়েছে, বাবা-দাদা সুত্রেই শাহ ঈসমাইল শহীদ হানাফি ছিলেন। তিনি নিজেও একথা অকপটে স্বীকার করতেন। সমস্যা হচ্ছে, অনেকে রাফউল ইয়াদাইন এবং তাকলিদ সংক্রান্ত তার কিছু মতামত দেখে সংশয়ে পড়ে গেছে, কিন্তু বাস্তব কথা হচ্ছে উনি হানাফিই ছিলেন। ১২

ফতোয়ায়ে দারুল উলুমে এক লোকের সুআলের জবাবে বলেন, তিনি সুন্নতের অনুসারী অনেক বড় হানাফি আলেম ছিলেন। শাহ ওলিউল্লাহর নাতি ছিলেন এবং শাহ আব্দুল আজীজের ভাতিজা। গাইরে মুকাল্লিদরা অনেক সময় দাবি করেন যে, ঈসমাইল শহীদ হানাফি ছিলেন। কিন্তু এ তথ্য ঠিক না। ১৩ তাদের সম্পর্ক ছিল মুলত শাহ আব্দুল আজীজের সাথে। এ ব্যাপারে নদভী তার বইতে লেখেন, “আহমদ শহীদ হযরত শাহ আব্দুল আজীজের খেদমতে হাজির হন। সৈয়দ সাহেবের বুযুর্গদের সাথে বহু থেকেই রুহানী ও জ্ঞানগত সম্পর্ক ছিল। সৈয়দ সাহেবকে পেয়ে প্রথমে মুসাফাহা, কোলাকুলি ও পারষ্পরিক পরিচয়ের পর তিনি অত্যন্ত আনন্দ ও সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। অতঃপর তাকে আপন ভাই আব্দুল কাদিরের নিকট অবস্থান করার ব্যবস্থা করেন। হযরত শাহ আব্দুল আজীজ এবং শাহ আব্দুল কাদির এর সোহবত ও খেদমতে থেকে তিনি এরুপ আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভ করেন যা বড় বড় মাশায়েখে কেরামের বিরাট রিয়াজত ও মুজাহাদা দ্বারা হাসিল হয়ে থাকে। কিছুকাল পর শাহ আব্দুল আজীজের থেকে খেলাফত ও এজাযত নিয়ে তিনি নিজের জন্মস্থান রায়বেরেলিতে ফিরে আসেন।” ১৪

সর্বপরি, মুসলিম ইতিহাসে মুজাদ্দিদ বা সংষ্কারকদের একটা জিনিস খেয়াল করবেন, প্রায়ই তাদের উত্তরাধিকার নিয়ে পরবর্তীদের মধ্যে বিতর্ক জারি থাকে। প্রত্যেকেই তার সাথে এক ধরনের আত্মীয়তা অনুভব করেন। শাহ ওলীউল্লাহ দেহলভী এর বড় প্রমান; কারণ তাদের গোটা চিন্তাপ্রকল্পকে একত্রে ধারন করাবর মতো সক্ষম মানুষ পরবর্তীতে খুব কমই জন্মে। ফলে পরবর্তীতে তাদের চিন্তাকাঠামো ঘিরে গড়ে উঠে নানা মত ও পথ। তেমনি কিছু লোক থাকে যারা তাদের সংষ্কারকাঠামোকেই প্রশ্ন করতে উদ্দ্যত হয়।

তথ্যসূত্র:

১. নূর নূর চেহরে, ২৯৭ পৃ.

২. তাযকিরাতুল ওয়াসিলিন, মুহাম্মাদ রজিউদ্দিন বাদায়ুনি, ২৫২ পৃ.

৩. ওহাবী তাহরিক, গোলাম রাসুল বাদায়ুনী, ৫৪ পৃ.

৪. প্রাগুক্ত, ৫৫ পৃ.

৫. আল-মাহদি ওয়াল মাহদাবিয়া, আহমদ আমিন পৃ. ২৩

৬. ইবনু তাইমিয়া ফিকহুহু ওয়া আরাউহু, আবু যুহরা, ৪৩০ পৃ.

৭. এজন্য মওলানা মনজুর নোমানী ‘আব্দুল ওহাব কে খেলাফ প্রপাগান্ডে আওর ওলামায়ে দেওবন্দ মে উন কি আছারাত’ নামে একটি কেতাব লেখেন; এখানে তিনি বিশেষভাবে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওহাব নজদীর বিপরীতে যেসব অন্যায় অভিযোগ সমাজে এবং আলেমদের মধ্যে হাজির ছিল, সেগুলোর অপনোদন করেন।

৮. উইলিয়াম হান্টার লিখেছে, “ধর্মীয় নেতারা ১৮২২-২৩ সালে মক্কা সফরের পর অনাড়ম্বর নিষ্ঠাবান জীবনযাপনের নীতিমালা নিরুপিত ও প্রচারিত হয়। সফরকালে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন যে, পবিত্র নগরীতে মরুভূমির জনৈক বেদুঈনের প্রচেষ্টায় ব্যাপক সংস্কার প্রবর্তিত হয়েছে। তার নিজের চিন্তাধারার সঙ্গে এ সংস্কার নীতির মিল ছিল। … দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস, ৪৩ পৃ.

৯. দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস, উইলিয়াম হান্টার, ৪৫ পৃ.

১০. মাসিক মা‘আরিফ, আযমগড়, ফেব্রুয়ারী ১৯৪৩, পৃ. ৯৯

১১. মাসিক আত-তাহরির, আগস্ট ২০১৪

১২. মাজলিসুত তাহকিকিল ইসলামি, সালাফি ওয়েবসাইট

১৩. ফতোয়ায়ে দারুল উলুম, ৩/ ১৪৩২ পৃ.

১৪. ঈমান যখন জাগল, আবুল হাসান আলী নদভী, ২৮ পৃ.

The post ফজলে রসুল বাদায়ুনীর চোখে বালাকোট : বিকৃতি ও অপব্যাখ্যা appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%ab%e0%a6%9c%e0%a6%b2%e0%a7%87-%e0%a6%b0%e0%a6%b8%e0%a7%81%e0%a6%b2-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a6%be%e0%a7%9f%e0%a7%81%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%b0-%e0%a6%9a%e0%a7%8b%e0%a6%96%e0%a7%87/