রাকিবুল হাসান নাঈম:
নতুন কারিকুলামে রচিত হওয়া ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর বইগুলোতে মুসলিম ইতিহাসকে শুধু এড়ি্য়েই যাওয়া হয়নি, বরং মুসলিম ইতিহাসের প্রতি করা হয়েছে এক ধরণের বিষোদগার। বইগুলোতে মানা হয়নি ইতিহাস লেখার স্বতসিদ্ধ নিয়মও। ব্যবহার করা হয়নি তথসূত্র, দেয়া হয়নি শক্ত কোনো ঐতিহাসিকের রেফারেন্স। শিক্ষার্থীদের হাতে এমন বই থাকা ন্যায়ত ও আইনত অপরাধ।
পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস বিকৃতির প্রসঙ্গে এসব কথা বলেছেন দেশের ইতিহাস বিশেষজ্ঞরা। কোনো অদৃশ্য শক্তির ইঙ্গিতে বইগুলোতে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়ে শিশুদের মগজ ধোলাইয়ের চেষ্টা করা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন তারা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. এ কে এম শাহনেওয়াজ ফাতেহকে বলেছেন, ‘আমি এবারের ষষ্ঠ এবং সপ্তম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান : অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ের একেকটি পৃষ্ঠা মূল্যায়নের দৃষ্টিতে পড়ছি আর আতঙ্কিত হচ্ছি। এনসিটিবির বইয়ে এর আগে এতটা স্খলন আর কখনো হয়নি। বইটিতে ইতিহাস বিকৃতির ভয়ানক ছড়াছড়ি।’
দুই যুগ দুই চোখ
সপ্তম শ্রেণীর সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ১০৯ পৃষ্ঠাজুড়ে বেশ বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে পাল ও সেন যুগের ইতিহাস। বইয়ের বাকি ১৪ পৃষ্ঠায় তুলে ধরা হয়েছে সুলতান শাসনামলের ইতিহাস। তাও সংক্ষিপ্ত ও বিকৃতভাবে।
এ প্রসঙ্গে ড. শাহনেওয়াজ ফাতেহকে বলেন, ‘ইতিহাসের দুটি যুগ। প্রাচীন যুগ ও মধ্যযুগ। প্রাচীন যুগে পাল ও সেন বংশ মিলে বাংলা শাসন করেছে ছয়শ বছরেরও কম সময়। মধ্যযুগ মুসলিম শাসনামলে সুলতান ও মোঘলরা শাসন করেছে ছয়শ বছর। অথচ সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে প্রাচীন যুগের জন্য রাখা হয়েছে ১০৯ পৃষ্ঠা। আর মধ্যযুগের মুসলিম শাসনের জন্য রাখা হয়েছে মাত্র ১৪ পৃষ্ঠা। সংক্ষিপ্তভাবে আনতে গিয়ে ঘটিয়েছে বিকৃতি।’
তিনি আরও বলেন, ‘পাল ও সেনদের আলোচনা ১০৯ পৃষ্ঠায় করা হয়েছে বেশ বিস্তারিতভাবে। তাদেরকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বেশ উজ্জ্বলভাবে। তাদের দোষত্রুটি সামনে আনা হয়নি। কিন্তু অপরদিকে মুসলিম শাসনামল নিয়ে লিখতে গিয়ে লেখা হয়েছে সংক্ষিপ্তভাবে। তাও বিকৃত করে, দোষারোপ করে। এর থেকেই বুঝা যায়, দুই যুগকে দুইভাবে দেখা হয়েছে। মুসলমানদেরকে কলুষিত করা হয়েছে।’
যত দোষ নন্দ ঘোষ
ড. শাহনেওয়াজের মতে, প্রাচীন যুগে বাংলা বেশ উন্নত হয়েছে শিক্ষায়-দীক্ষায়-সভ্যতায়৷ কিন্তু তাদের পর সেনরা এসে মানুষকে অতিষ্ঠ করে তুলে। পালরা ছিল বৌদ্ধ। সেনরা ছিল আর্য। সেনরা পালদের উপর চড়াও হয়, তাদের উপর কঠোরতা আরোপ করে, হত্যাযজ্ঞ চালায়। সেনরা সমাজে বর্ণপ্রথা চালু করে। তারা হিন্দুদের চার শ্রেণীতে ভাগ করে। এরমধ্যে তিন শ্রেণির শিক্ষার অধিকার কেড়ে নেয়। বাংলা ভাষার অধিকার কেড়ে নেয়। কিন্তু সুলতানরা এসে সেনদের তাড়িয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে। তারা বঞ্চিত হিন্দুদের উন্নতির সুযোগ দেয়। আজকাল যে হিন্দুরা কৈর্বত, নাপিত, তার সুযোগ দিয়েছিলেন সুলতানরা। বাংলার স্বাধীন সুলতানদের শাসনামলেই বাংলার মূল সমৃদ্ধি ঘটে। তারা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়।
এ প্রসঙ্গে ড. শাহনেওয়াজ ফাতেহকে বলেন, ‘কিন্তু পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছে। সেনদের উপর আরোপিত অভিযোগগুলো চাপিয়ে দেয়া হয়েছে সুলতানদের উপর। বলা হয়েছে, সুলতানরা নাকি বর্ণপ্রথা প্রচলন করেছে। এটা তো করেছে সেনরা। সুলতানরা হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেছে। সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের ইতিহাস পড়লেই সব স্পষ্ট হয়ে যাবে। তিনি রামায়ন অনুবাদের জন্য অনুদান দিয়েছেন। মন্দির নির্মাণের জন্য অনুদান দিয়েছেন। তার সময়ে বড় বড় পদে হিন্দুরা আসীন ছিল। কিন্তু তাদের সে ইতিহাস লুকানো হয়েছে।’
খিলজির ওপর অনৈতিক ক্ষোভ
পাঠ্যবইয়ে খিলজিকে বলা হয়েছে দখলদার, অত্যাচারী। বলা হয়েছে, তিনি ধ্বংস করেছেন কয়েকটি বিহার। হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছেন বৌদ্ধদের উপর।
এ প্রসঙ্গে ড. শাহনেওয়াজ ফাতেহকে বলেন, ‘বইয়ে খিলজির ওপর এত মারাত্মক অভিযোগ আনা হলো, তার কোনো সূত্রই ব্যবহার করা হলো না। অথচ ইতিহাস বলে ভিন্নকথা। খিলজি যখন লক্ষণসেনকে তাড়ানোর জন্য আসেন, তখন বিহার হয়ে আসেন। তিনি বাংলায় ঢুকার সময় বিহারে একটি দুর্গের মতো দেখতে পেয়ে ভাবলেন, এটা দুর্গ। কিন্তু হামলা করে বুঝতে পারলেন বৌদ্ধদের লাইব্রেরি। তিনি তখনই ফিরে আসেন। এটা ছিল ওদন্তপুর বিহার। অথচ পাঠ্যপুস্তকে বলা হয়েছে, তিনি কয়েকটি বিহার ধ্বংস করেছেন। তিনি কেন বিহার ধ্বংস করবেন? বৌদ্ধদের সঙ্গে তো তার লড়াই ছিল না। বরং লামাতারানাথ তার এক বইয়ে লিখেছেন, ‘স্বয়ং বৌদ্ধরা খিলজিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘দ্য এশিয়াটিক সোসাইটির মধ্যযুগের ইতিহাসে বখতিয়ার খিলজিকে নিয়ে কয়েকটি অধ্যায় আছে। সেখানে আমিও কাজ করেছি। সূত্রসহ সেখানে সব উল্লেখ আছে। সব যুগের বাস্তবতা এক না। তখনকার বাস্তবতা ছিল, যুদ্ধ করেই দেশ জয় করতে হতো। যুদ্ধ করাকে তখন অপরাধ মনে করা হতো না। বর্তমানের বাস্তবতায় সেই যুগের বাস্তবতা বিবেচনা করলে তো হবে না।’
ইতিহাস লেখার নিয়ম মানা হয়নি
এনসিটিবির মাধ্যমিক ও নিম্নমাধ্যমিক পর্যায়ের বইয়ের পাঠ্যসূচি প্রণয়ন ও বই লেখায় অতীতে একাধিকবার যুক্ত ছিলেন ড. শাহনেওয়াজ। তার মতে, এমন সব ভুলের অবকাশ থাকারই কথা নয়। অতীতে এমন তথ্যগত ভুল থাকার কথা আমরা তেমন শুনতাম না। ।
ড. শাহনেওয়াজ ফাতেহকে বলেন, ‘বিশেষজ্ঞরা যদি নতুন গবেষণার ফলাফলে প্রচলিত ইতিহাসের ধারণায় কোনো পরিবর্তন আনেন এবং তা সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের পণ্ডিতদের মাধ্যমে সমর্থিত হয়, তবে তা গ্রন্থবদ্ধ করা যেতে পারে। দীর্ঘদিন প্রামাণ্যভাবে ইতিহাসের কোনো ঘটনা প্রতিষ্ঠিত থাকলে তাকে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষ তথ্য-প্রমাণ ছাড়া উল্টে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন না। তা হয়ে পড়ে ইতিহাস বিকৃতি ও তথ্য বিভ্রাটের নামান্তর। আর এনসিটিবি কর্তৃক প্রকাশিত ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বইয়ে তেমনই ভয়ংকর স্বেচ্ছাচারিতা করা হয়েছে। কোনো এক অদৃশ্য শক্তির অঙ্গুলিহেলনে যেন মগজ ধোলাইয়ের চেষ্টা করা হয়েছে শিশু শিক্ষার্থীদের।’
তিনি আরও বলেন, ‘এমন বইয়ে সংশোধনী দিয়ে পার পাওয়া যাবে না। অমন বই শিক্ষার্থীদের হাতে থাকা ন্যায়ত ও আইনত অপরাধ হবে বলে আমি মনে করি।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রফেসর ড. এ টি এম আতিকুর রহমান ফাতেহকে বলেন, ‘বইগুলো সংশোধন করতে হবে। এগুলোতে ভুল রয়েছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সহকারী অধ্যাপক শাহিদুল হাসান ফাতেহকে বলেন, ‘বইগুলো পড়ে দেখিনি। তবে বইগুলোতে ভুল না হলে তো এত কথা হচ্ছে না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আসিফ নজরুল পাঠ্যবইয়ে মুসলিম ইতিহাস বিকৃতিকে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ বলে অভিহিত করেছেন। পাঠ্যপুস্তক সংক্রান্ত এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছেন, ‘৭ম শ্রেণীর ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান বইয়ের রচয়িতাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভুল তথ্য দিয়ে হলেও ব্রিটিশ শাসনপূর্ব মুসলিম শাসকদের হেয় করা, অন্য ধর্মের শাসকদের তুলনায় তাদের নীচু করা। এটি সুস্পষ্ট সাম্প্রদায়িকতা। এই বইয়ের কন্টেন্ট সংশোধনের দাবী জানাচ্ছি এবং যে সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিরা এটি রচনা করেছে তাদের তীব্র নিন্দা করছি।’
The post পাঠ্যক্রমে ইতিহাস বিকৃতি: প্রতিবাদ করছেন ইতিহাস বিশেষজ্ঞরাও appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%aa%e0%a6%be%e0%a6%a0%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%ae%e0%a7%87-%e0%a6%87%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%b8-%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%95%e0%a7%83%e0%a6%a4-3/
No comments:
Post a Comment