রাকিবুল হাসান নাঈম:
যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১৩ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়ার পর আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে শাহবাগ মোড়ে আন্দোলনে নামে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের একটি দল। তারা কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দাবির সঙ্গে সঙ্গে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষেদ্ধেরও দাবি জানায়। পাশাপাশি ইসলাম ও মুসলমানদের ধর্মীয় নিদর্শন টুপি-দাড়িকে কটাক্ষ করে তৈরী করতে শুরু করে কন্টেন্ট। এমনকি আন্দোলনের নেতৃত্বদের মধ্য থেকে কারও কারও কলমে উঠে আসে মহানবি হজরত মুহাম্মদ সা.-এর প্রতি বিদ্বেষ ও কটুক্তি।
তাদের অব্যাহত ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী দাবির প্রেক্ষিতে ইসলাম ও মুসলমানদের ঈমান-আকিদা রক্ষায় আন্দোলনে নামে হেফাজতে ইসলাম। হেফাজত আন্দোলনে নামার পরপরই ধীরে ধীরে মিইয়ে আসে শাহবাগ আন্দোলন।
সেই ফেব্রুয়ারিতে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও ইসলামি নিদর্শন কটাক্ষ করে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার দশ বছর পূর্তি হল গত রবিবার। এরই মধ্যে ‘যুদ্ধাপরাধী’ শিরোনামে কারও কারও বিচার সম্পন্ন হয়েছে। কারও কারও বিচার প্রক্রিয়া এখনও চলছে।
তবে দেশের ইসলামি চিন্তকরা বলছেন, শাহবাগ দীর্ঘ এই এক দশকে তাদের ভাবমূর্তি হারিয়েছে। মিডিয়া তাদের উজ্জ্বল মুখের যে ক্যানভাস এঁকেছিল, তা মলিন হয়েছে দিনদিন।
ইসলাম বিরোধিতাই ছিল উপজীব্য
এক দশক পূর্তিতে শাহবাগ নেতৃত্বের অভিযোগ হলো, রাষ্ট্র তাদের আন্দোলনের চেতনা ধারণ করতে ব্যর্থ। রাষ্ট্র মৌলবাদীদের চেতনাকে আনুকূল্য দিচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে কথা হয় আলেম লেখক ও অধ্যাপক ড. অ ফ ম খালিদ হোসেনের সঙ্গে। ফাতেহকে তিনি বলেন, ‘শাহবাগ আন্দোলন নির্দিষ্ট একটি দলের বিরুদ্ধে মাঠে নামলেও মূলত তাদের মূল ভিত্তি ছিল ইসলামবিরোধিতা। এই বিরোধিতা থেকেই তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইসলামকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। অথচ ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কখনও বিরোধী নয়। বরং মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন অনুষঙ্গে ইসলাম যে প্রণোদনা ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় মুক্তিযোদ্ধাদের চিঠি ও ডায়রিতে। বেতার কেন্দ্রও তার প্রমাণ।’
এ প্রসঙ্গে কথা হয় আলেম লেখক ও চিন্তক কবি মুসা আল হাফিজের সঙ্গে। তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘আমরা যদি শাহবাগের আন্দোলনকে লক্ষ করি, কতিপয় উপাদান পাওয়া যাবে। প্রথমত, তারা রাষ্ট্র ও সমাজের সেকুলার চরিত্র কামনা করেছিল। সেকুলারিজম রূপান্তরিত হয়ে উঠেছিল এন্টি ইসলামে। এর পেছনে কাজ করেছিল দুটি দিক। একটি হলো, ওয়ার অন টেররিজম। যেটা গ্লোবালি চলছিল ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ’ নামে, সেটার অভিঘাত এসে লেগেছিল শাহবাগ আন্দোলনে। অন্যদিকে ভারতীয় মনুবাদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উল্লম্ফনও অভিঘাত করেছিল। সেটাও ইসলাম বিরোধিতাকে উপজীব্য করে তার বয়ান দাঁড় করায় এবং ঘৃণার চর্চা করে। এ দুটি জিনিস শাহবাগ আন্দোলনকে প্রণোদিত করেছিল।’
মুসা আল হাফিজ আরও বলেন, ‘এর পেছনে দেশীয় একটা মাত্রা ছিল, যা এখানকার স্থানীয় বাস্তবতার মধ্যে ঐতিহাসিক নানা ঘটনাকে নিজস্ব আদলে বিশ্লেষণ করে আদারায়ন তথা পরকে আপন করে জাতিকে আমি-তুমিতে বিভক্ত করে ফেলে। এই বিভাজনের তাত্ত্বিক বয়ানের উপর শাহবাগের রাজনীতি দাঁড়িয়ে ছিল। আরেকভাবে বলা যায়, শাহবাগ রাজনীতিহীনতার ফসল। এদেশে নানাভাবে রাজনীতিকে দূর করার চেষ্টা করা হয়েছিল। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা হয়েছিল। ফলে অনির্বাচিত স্বৈরাচারের প্রশ্রয় ও সহযোগিতায় শাহবাগ আন্দোলন বেড়ে উঠে।
বিভাজনকে বানিয়েছে রণক্ষেত্র
শাহবাগ আন্দোলনের চিন্তকদের দাবি, এই এক দশকে দেশের তরুণদল দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে। হেফাজত ও শাহবাগ। তাদেরকে মুখোমুখি করে চিন্তকরা বলছেন, ভবিষ্যত জানাবে, তাদের মধ্যে কে জিতবে।
এই বিভাজন তত্ত্বের উপরই শাহবাগী আন্দোলন দাঁড়িয়ে আছে বলে মন্তব্য করেন মুসা আল হাফিজ। ফাতেহকে তিনি বলেন, ‘বিভক্তির বিষয়টা বাস্তব। সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক দিক দিয়ে বিভক্তি আছে। একটি দেশে আদর্শিক বিভাজন থাকতে পারে। কিন্তু সেই বিভাজন যদি হয়ে উঠে যুদ্ধ, আদর্শিক রণক্ষেত্র এবং সহিংসতা, সেটা শুভলক্ষণ নয়। বিভক্তি সত্ত্বেও যারা জাতি গঠনে কাজ করে যাবে, যারা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে আদর্শিক ও বাস্তবিক দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করবে, সৃজনশীলতার মধ্য দিয়ে চিন্তা ও কর্মে পরবর্তী প্রজন্মকে আপন করে নিতে পারবে, তারাই সকলের চেয়ে এগিয়ে যাবেন।’
১০ বছরে কতটুকু সফল?
ড. অ ফ ম খালিদ হোসেনের মতে, শাহবাগ আন্দোলন যে দাবিতে শুরু হয়েছিল, সে দাবিতে তারা সফল। কাদের মোল্লার ফাঁসি হয়েছে। তবে দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ফাঁসিতে ঝুলানোর নজিরবিহীন দৃষ্টান্তও তৈরী হয়েছে। এই ঘটনা আমাদের ইতিহাসে বারবার ঘটতে পারে। শাহবাগের বাটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেলো।
কবি মুসা আল হাফিজ বলেন, ‘শাহবাগ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার পেছনে কাজ করে মিডিয়া। মিডিয়া এই আন্দোলনকে জাতীয় রূপ দেয়ার চেষ্টা করে। এটাকে মূলধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস চালায়। এমনকি আমরা এটাকে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ বলার মতো নির্লজ্জ প্রচেষ্টাও দেখেছি। কিন্তু মিডিয়া যেমন বড় মুখে এটাকে ফুটিয়ে তুলেছিল, সেই বড় মুখ তারা ধরে রাখতে পারেনি। মুখ থুবড়ে পড়েছে। এবং পরবর্তীতে শাহবাগী একটা গালি হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে। এখন শাহবাগী প্রবণতা বলতে চিহ্নিত করা হয় ইসলামবিদ্বেষ, সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতি বৈরিতা, ক্ষমতাসীন-বিদেশীদের পদলেহন এবং দেশের স্বার্থের বিরোধিতা। তবে তারা একটা কাজ করেছিল। তা হলো—তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শিরোনামকে ভিত্তি করে আন্দোলন করছিল। যদিও তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিকৃত করছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন শাহবাগ আন্দোলনের দশ বছর পূর্তিতে তারা যদি বলে তারা সফল, তাহলে সেটা বলা যাবে না৷ কারণ, তখনকার বাস্তবতায় তাদেরকে যেভাবে বড় করে দেখানো হয়েছিল, পরবর্তীতে তারা আর তেমন বড় থাকতে পারেনি। তাদের ইমেজ বারবার ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। কিন্তু একেবারে ব্যর্থও বলা যাবে না। কারণ, এখনও ওয়ার অন টেরর আছে, স্বৈরাচার আছে, মিডিয়া তাদের সমর্থন দিচ্ছে, সিভিল সোসাইটি, সমাজ ও রাষ্ট্রের চালকদের ছত্রছায়া বহাল আছে। তারা যেসব দাবি করতো, ঐতিহাসিক যে বয়ান তারা দাঁড় করাতো, সেগুলো এখনও সবলে উপস্থাপিত হচ্ছে। যেমন পুঠ্যপুস্তক রচনা করছেন এমন লোক, যারা ছিল শাহবাগের পৃষ্ঠপোষক।’
শাহবাগ-হেফাজত তুলনা
শাহবাগ পরবর্তী সময়ে তুলনায় হেফাজতকে এগিয়ে রাখছেন কবি মুসা আল হাফিজ। তিনি বলেন, ‘তাদের যে জোয়ার এসেছিল, তা থেমে গেছে হেফাজতে ইসলামের কারণে। হেফাজত তখন এসেছিল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে। তার কোনো পৃষ্ঠপোষকতা ছিল না, পরিকল্পনা ছিল না। তবে ছিল ধর্ম ও জাতিসত্তা এবং নিজস্ব তাহজিব তামাদ্দুনের প্রতি অঙ্গিকার ও আবেগ। নগরের মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত শ্রেণী এ আন্দোলন করেনি। এই আন্দোলন করেছে তৃণমূলের গণমানুষ। যারা প্রধানত উলামায়ে কেরাম। যারা বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর চিরায়ত জীবনবোধ, বিশ্বাসের প্রতিনিধিত্ব করছিল। পরে নানা ঘটনায় হেফাজতের দাবিতে রূপান্তর ঘটেছে। কিন্তু মূল জায়গায় তারা ঠিক ছিল। যার ভিত্তি ছিল আত্মপরিচয়ের সুরক্ষা। এখনও হেফাজতের নেতৃত্বে যারা রয়েছেন, তারা কথা বলছেন। পাঠ্যপুস্তক ইস্যুতে কথা নলেছেন৷ তখনও তাদের যে দাবি ছিল, এখনও তারা সেসব দাবিতে অটল। তারা প্রেশার ক্রিয়েট করছেন।’
শাহবাগের ব্যর্থতা তুলে ধরে তিনি বলেন, `শাহবাগ তাদের আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিল মিডিয়া ও ভাষা সাহিত্য। এমনকি এগুলো ব্যবহার করে তারা তাদের ‘স্পার্ক ইমেজ’ও তৈরী করেছিল। কিন্তু শাহবাগ পরবর্তী সময়ে তারা সেই ইমেজ ধরে রাখতে পারেনি। বারবার আহত-বিক্ষত হয়েছে। তারা তাদের সাহিত্যে সৃজনশীলতার নতুন কোনো মাত্রা যুক্ত করতে পারেনি। অপরদিকে শাপলা পরবর্তী সময়ে ইসলামপন্থীদের ইতিবাচক রূপান্তর ঘটেছে। তারা সমাজের মূলধারায় মিশেছে। আগে দূরে থাকলেও শাপলা পরবর্তী সময়ে তারা ভাষা সাহিত্যে ব্যাপক উন্নতি করেছে। তারা যদি সুপরিকল্পিত ও বাস্তসম্মতভাবে গঠনমূলক কাজ করে, তাহলে সাফল্য তাদের দিকেই ঝুঁকবে। তাই তাদের উচিত, এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো।’
The post শাহবাগের দশ বছর : যেভাবে দেখছেন আলেমসমাজ appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%b6%e0%a6%be%e0%a6%b9%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%97%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%a6%e0%a6%b6-%e0%a6%ac%e0%a6%9b%e0%a6%b0-%e0%a6%af%e0%a7%87%e0%a6%ad%e0%a6%be%e0%a6%ac%e0%a7%87-%e0%a6%a6%e0%a7%87/
No comments:
Post a Comment