রাকিবুল হাসান নাঈম:
মূর্তিপূজা ও পূজার শুভেচ্ছা জানানোর বিষয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের অবস্থান উল্লেখ করে পোস্ট দেয়ায় ইসলামী যুব আন্দোলন নোয়াখালী জেলা উত্তরের দফতর সম্পাদক ইয়াছিন রুবেলকে গ্রেফতার করেছিল জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। পহেলা সেপ্টেম্বর তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে দেশজুড়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রতিবাদ ও ইসলামী আন্দোলন নোয়াখালী জেলা নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় ৩ সেপ্টেম্বর তিনি জামিনে মুক্তি পান।
দলের পক্ষ থেকে বলা হয়, নোয়াখালীর চৌমুহনী শহরে বিগত বছরের মন্দির কেন্দ্রিক সাংঘর্ষিক প্রেক্ষাপটের কারণে ভুল বোঝাবুঝির বশবর্তী হয়ে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ তাকে উস্কানিমূলক তৎপরতার দায় দেখিয়ে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের রাতেই কারাগারে তাৎক্ষণিকভাবে যুবনেতা ইয়াছিন রুবেলের সাথে সাক্ষাৎ করেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ নোয়াখালী জেলার বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ। তারা প্রশাসনিক কর্মকর্তাদেরকেও রুবেলের সামাজিক স্বচ্ছ অবস্থান সম্পর্কে অবহিত করেন। এতে প্রশাসনিক ভুল বোঝাবুঝির অবসান হলে তাকে মুক্তি দেয়া হয়।
আইনবোদ্ধাগণ রুবেলের গ্রেফতার এবং জামিন নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। তারা বলছেন, যেখানে সংবিধান লঙ্ঘিত হয়নি, বরং রুবেল সংবিধানেরই অধিকার প্রয়োগ করছে, সেখানে তাকে গ্রেফতার করাই আইনত সঠিক হয়নি। তার গ্রেফতারে বরং আরও অস্থিতিশীলতা তৈরী হয়েছে। ধর্মীয় উসকানির অভিযোগ তুলে বিভিন্ন সময় এমন ঘটনা ঘটায় বিশ্বাস-অবমাননা নিয়েও প্রশ্ন বাড়ছে।
‘রুবেল সংবিধান লঙ্ঘন করেনি’
রুবেল সংবিধান লঙ্ঘন করেনি বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক জেলা জজ এবং বর্তমান বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবি জনাব মাসদার হোসেন। ফাতেহকে তিনি বলেন, ‘এখানে সংবিধানের কোনো আইন লঙ্ঘিত হয়নি। সংবিধানের আর্টিকেল ৩৯ অনুযায়ী, প্রত্যেকেরই বাক স্বাধীনতা রয়েছে। প্রত্যেকেই তার চিন্তা-আদর্শ প্রচার করতে পারবে। তবে তার কথা যেন অন্য কাউকে আঘাত না করে, অন্যের সম্মান যেন ক্ষুণ্ন না করে। রুবেল পূজা এবং পূজার শুভেচ্ছা সম্পর্কে যা বলেছে, তাতে অন্য কারো মনে আঘাত লাগার মতো কথা বলেনি। কাউকে কটাক্ষও করেনি। তার চিন্তা ও মতামত সে প্রকাশ করতেই পারে।’
ইসলামে পূজা হারাম এবং পূজায় শুভেচ্ছা জানানোও হারাম বলায় পত্রপত্রিকা বলছে, রুবেল দূর্গাপূজাকে কটাক্ষ করেছে। নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস প্রকাশ করলে যদি অন্য ধর্মাবলম্বীরা কটাক্ষ মনে করে, তাহলে তো নিরাপদ সহাবস্থান নিয়েও প্রশ্ন উঠে। সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবি বলেন, কটাক্ষ মনে করলেই তো হবে না। সংবিধানের আর্টিকেল ৪১ অনুযায়ী, প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রয়েছে। প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ও উপ-সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রয়েছে। কোন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে যোগদানকারী কোন ব্যক্তির নিজস্ব ধর্ম-সংক্রান্ত না হইলে তাহাকে কোন ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণ কিংবা কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা উপাসনায় অংশগ্রহণ বা যোগদান করতে হবে না। সংবিধানের এই বক্তব্য মতে, রুবেল যে পোস্ট দিয়েছে, তাতে সে তার ধর্মের প্রচার করেছে। তার ধর্মীয় ভাইদেরকে অন্যধর্মের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে নিষেধ করেছে। এখানে সে দূর্গা পূজাকে কটাক্ষ করলো কোথায়?’
তবে সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবি বলেন, ‘যদিও সংবিধান লঙ্ঘিত হয়নি, পূজার সময়ে ‘হারাম এবং কাফের’ শব্দ দুটি ব্যবহার মনে হয় সময়োপযোগী হয়নি। এখানে নিষিদ্ধ বা অন্য শব্দেও ব্যক্ত করা যেতো।
‘ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের অপব্যবহার হচ্ছে’
রুবেলকে এই পোস্টের জন্য গ্রেফতার করা ঠিক হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের প্রফেসর ড.এ এস এম আমানুল্লাহ। তিনি মনে করছেন, তাকে ডেকে এনে সতর্ক করা যেতো। পোস্টে সে যা বলেছে, তা ঠিক, ভুল বলেনি। কিন্তু এই পূজার সময়ে এভাবে বলাটা বেমানান। এসব স্পর্শকাতর বিষয়ে কথা বলার জন্য আলেমগণ আছেন। কিন্তু যে বলেছে, এ কথা বলার জন্য তার যোগ্যতা, পড়াশোনা এবং অথরিটি আছে কিনা দেখতে হবে। অথরিটি ছাড়া কথা বলা যাবে না।’
দেশে আইনের অপব্যবহারের উল্লেখ করে ড.এ এস এম আমানুল্লাহ বলেন, ‘দেশে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের অপব্যবহার হচ্ছে। এই আইন দিয়ে যাকে-তাকে ঘায়েল করা হচ্ছে। পাশাপাশি গণতান্ত্রিক এদেশে সঠিক গণতন্ত্র-চর্চাটা নেই। ফলে সহনশীলতাও কমে গেছে।’
তবে বর্তমানে সন্তানদেরকে রিসপনসিবল ডিজিটাল ট্রেইনিং দেয়া অবশ্যক বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। কখন কোথায় কিভাবে কথা বলতে হবে, কিভাবে মন্তব্য করতে হবে, শেখাতে হবে। ডিজিটার প্লাটফর্মে কিভাবে শান্তি ও সহনশীলতা বজায় রাখতে হবে, তা না জানলে বিপদ ঘটতে পারে বলেও জানান তিনি।
‘এটাকে ধর্মবিদ্বেষ বলা যায় না’
অভিযুক্ত রুবেলের পোস্টকে অনেকে হিন্দুধর্ম-বিদ্বেষ হিসেবে চালিয়ে দিলেও ইসলামিক স্কলারগণ তা মানতে নারাজ। তার বলছেন, বিরোধ ও সংঘাত এক জিনিশ। ঘৃণা, বিদ্বেষ ও ভীতি আরেক জিনিস। দুটোর মাঝে তফাৎ রয়েছে।
তরুণ বিশ্লেষক মাওলানা ইফতেখার জামিল বলেন, বিরোধ ও সংঘাতের সাথে ঘৃণা, বিদ্বেষ ও ভীতির পার্থক্য কোথায়—শব্দ থেকেই অনেকটা আন্দাজ করা যায়। বিরোধ ও সংঘাত সমাজের স্বাভাবিক ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সম্পর্কের অংশ। মানুষের মধ্যে দ্বিমত ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকে, সেই দ্বন্দ্ব থেকেই বিরোধ ও সংঘাতের তৈরি হয়। সে আদর্শিক বিরোধও হতে পারে, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংঘাতও হতে পারে। এটা সামাজিক সম্পর্কের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এতে অস্বাভাবিকতার কিছু নেই। অপরদিকে ঘৃণা, বিদ্বেষ ও ভীতি বিশেষ মানসিক অবস্থা; যখন দ্বিমত ও বিরোধ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মীমাংসা না হয় বা টিকে থাকতে না পারে, তখন তার অবদমিত ক্রোধ থেকে জন্ম নেয় বিশেষ মানসিক অবস্থা, তার থেকেই তৈরি হয় ঘৃণা, বিদ্বেষ ও ভীতি। ঘৃণা, বিদ্বেষ ও ভীতি অবদমিত ক্রোধের রুপান্তরিত রুপ। বস্তুত এই মানসিক অবস্থাগুলো স্থায়ীভাবে বিশেষ রূপ ও আকার পেলে অসুস্থতা হিসেবে বিবেচিত হয়।
বোদ্ধাগণ বলছেন, রুবেল পূজা সম্পর্কিত ইসলামের যে বিধান তুলে ধরেছে, তার সাথে হিন্দুদের ধর্মীয় বিরোধ রয়েছে। এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটা স্বাভাবিক থাকেনি। রুবেলের পোস্টকে বিদ্বেষ ও ভীতির পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যার ফল তাকে গ্রেফতার। এটাকে বলা হয় ইসলামফোবিয়া।
মাওলানা ইফতেখার জামিল বলেন, অমুসলিমদের দ্বিমত, ঘৃণা ও বিরোধকে মুসলমানরা অনেকক্ষেত্রে সাধারণভাবে এক শব্দে ইসলাম অবমাননা বা কটুক্তি শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করে থাকেন, তাতে আলাদাভাবে ইসলামোফোবিয়া বা ইসলামবিদ্বেষের কদর্যতা ঢাকা পড়ে যায়। তার প্রতিক্রিয়ায় অনেকে ইসলামোফোবিয়া বা ইসলামবিদ্বেষের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে বসেন।
The post ‘জামিনে মুক্ত রুবেল’ : বিশ্বাস-অবমাননা নিয়ে প্রশ্ন বাড়ছে appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%9c%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a6%bf%e0%a6%a8%e0%a7%87-%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%a4-%e0%a6%b0%e0%a7%81%e0%a6%ac%e0%a7%87%e0%a6%b2-%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%b6%e0%a7%8d%e0%a6%ac/
No comments:
Post a Comment