রাকিবুল হাসান নাঈম:
সুদ থেকে বাঁচার জন্য ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সুদি ব্যাংক থেকে সরে ইসলামি ব্যাংকগুলোর দিকে ঝুঁকছে বেশি। প্রচলিত ব্যাংকে আমানত রাখলে যে পরিমাণ সুদ পাওয়া যায়, ইসলামি ব্যাংকগুলো সচরাচর তারচেয়ে বেশি মুনাফা দেয় না, তবুও। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে সাধারণ গ্রাহকরা সবচেয়ে বেশি আমানত রেখেছেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডে। শুধু তাই নয়, করোনাভাইরাসের কারণে ব্যাংক খাতে যখন টাকার সংকট, তখন প্রথম ব্যাংক হিসেবে ইসলামী ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। এমনকি আমানতের হিসাবে শীর্ষ পাঁচটি ব্যাংকের মধ্যে তিনটিই ইসলামি ধারার ব্যাংক।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে প্রচলিত ব্যাংক ও ইসলামি ব্যাংকের তুলনা-প্রতিতুলনায় তৈরী হয়েছে বিতর্ক। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের নামে যা হচ্ছে, তা একটা কৌশলমাত্র। এগুলোর কার্যক্রম প্রচলিত ব্যাংকের চেয়ে খুব একটা ভিন্ন নয়। দেখা যায়, প্রচলিত ব্যাংকগুলো যে প্রকল্পে অর্থায়ন করছে, একই প্রকল্পে ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোও বিনিয়োগ করছে। বলা হচ্ছে, ইসলামি ব্যাংকগুলো ইসলামি ব্যাংকিংয়ের নিয়ম-কানুন ঠিকঠাক পালন করছে না। বরং যতটুকু ইসলামি আবহাওয়া ছিল, সেটাকেও দিনকে দিন সংকুচিত করা হচ্ছে।
শুভংকরের ফাঁকিটা কোথায়?
চলতি সপ্তাহে প্রকাশিত হয়েছে অর্থনৈতিক বিশ্লেষক মোহাইমিন পটোয়ারির বই ‘ইসলামি ব্যাংক ব্যবস্থার শুভংকরের ফাঁকি’। বইটিতে লেখক মোটাদাগে দেখানোর চেষ্টা করেছেন, ইসলামি নামের আড়ালে কোথায় ফাঁকিটা দিচ্ছে ইসলামি ব্যাংকগুলো। বইটি প্রকাশের আগ-পর মিলিয়েই তৈরী হয়েছে বিতর্ক।
প্রতিবেদকের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয় অর্থনৈতিক বিশ্লেষক মোহাইমিন পটোয়ারির। তিনি বলেন, ‘আমি শরিয়া বোর্ডের নির্বাহী কর্মকর্তা, সেন্ট্রাল শরিয়া বোর্ডের সদস্য-সহ আরও বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছি। তারা স্বীকার করেছেন, প্রচলিত ব্যাংকগুলো থেকে ইসলামি ব্যাংকে খুব একটা পার্থক্য নেই। এখানে কৌশলে কার্যোদ্ধার করছে। কিন্তু একটা সিস্টেম চালু হয়ে গেছে। এটা এভাবেই চলবে।’
মোটাদাগে ইসলামি ব্যাংকের ফাঁকিটা জানতে চাইলে তিনি সাতটি পয়েন্ট তুলে ধরেন।
১. মুরাবাহা, বাইয়ে মুআজ্জাল সহ বিভিন্ন লেনদেনে ব্যাংকগুলো শরিয়াসম্মত শর্তগুলো পালন করছে না। সুদের নিমিত্তে অনেক ক্ষেত্রেই বাহানা তৈরী করছে।
২. ইসলামি ব্যাংকগুলো নিজেদেরকে সুদি কারবার বলে না। তারা বলে আমরা ব্যবসা করছি। ব্যবসায় লাভ-লস দুটোরই ভাগ নিতে হয়। কিন্তু ব্যাংকগুলো লাভ-লসে ভাগ নেয়ার বিষয়টি (মুরাবাহা) ক্রমশ সংকুচিত করে একেবারে নাই করে ফেলছে। অর্থাৎ, তারা কেবল লাভটাই নিতে চায়।
৩. ঋণ নিয়ে অল্প সময়ে পরিশোধ করলে ছাড় দেওয়া হয় এবং বেশি সময় পর দিলে জরিমানা দিতে হয়। এই ছাড় ও জরিমানার হার সুদের বাজার দরের সমান।
৪. যারা ডিপোজিট করে, তাদেরকে ব্যবসায়িক লাভের ভাগ ঠিকমতো দেওয়া হয় না। অথচ ব্যাংক দেউলিয়া হলে পুরা দায় চাপিয়ে দেয় ডিপোজিটকারীর উপর। অর্থাৎ, তাদের টাকার পরিমাণ শূণ্য হয়ে যায়।
৫. ডিপোজিটররা কোনদিন টাকা রেখে লস করে না। কিন্তু প্রতিটি ব্যবসাতেই লস আছে।
৬. ইসলামি ব্যাংক অন্য ব্যাংকের মতো ফ্র্যাকশনাল রিজার্ভ সিস্টেমে টাকা তৈরী করে। তারা নিজেরাই ওয়েবসাইটে তা স্বীকার করেছে।
৭. ইসলামি ব্যাংকগুলো পরিচালনার জন্য নেই স্বাধীন শরিয়া বোর্ড। দেখা যায়, শরিয়া বোর্ডগুলো থাকে ব্যাংকের এমডির অধীনে। কোনো কোনো ডিরেক্টর শরীয়া বোর্ডের সদস্য। ফলে শরিয়া বোর্ডের সিদ্ধান্ত নিজেদের মতো করেই নেয়া হয়। স্বাধীনভাবে নেয়ার সুযোগ থাকে না। তাছাড়া ইসলামি ব্যাংকগুলো পরিচালনার জন্য প্রয়োজন ইসলামি ব্যাংকিং আইন। সবমিলিয়ে ব্যাংকগুলো শরিয়াসম্মত চলছে কিনা, তা নিয়ে কারো কোনো তদারকি নেই।
কী বলছেন সংশ্লিষ্টরা?
বিশ্বে ব্যাংক ব্যবস্থা ৬০০ বছর আগে যাত্রা শুরু করলেও ইসলামি ধারার ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু হয় ১৯৬৩ সালে। বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিং চালু হয় ১৯৮৩ সালে। দেশি-বিদেশি উদ্যোগ ও সরকারি-বেসরকারি মালিকানায় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশে ইসলামি ব্যাংকিং শুরু।
ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ৪০ বছর পার হলেও পরিপূর্ণ শরিয়াসম্মত নীতি চলার পরিবেশ তৈরী করতে পারেনি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)-এর অধ্যাপক ড. শাহ মো. আহসান হাবীব বলেন, ‘ইসলামি ব্যাংক প্রফিট-লস শেয়ারিং বা মুশারাকা পদ্ধতি বলে যে ব্যাংকিংয়ের কথা বলে, বাস্তবে তেমনটি দেখা যায় না। ইসলামি ব্যাংক কখনও লসের ভাগ নিয়েছে বলে এখন পর্যন্ত শুনিনি।’
তিনি উল্লেখ করেন, ‘এটা শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়, বিশ্বের কোনও ইসলামি ব্যাংকিং সিস্টেমেই প্রফিট-লস শেয়ারিং দেখা যায় না। ইসলামি ব্যাংক যেভাবেই চলুক না কেন, মানুষ মনে করে ইসলামসম্মত ব্যাংকিং করে। সুদমুক্ত থাকার জন্য সেখানে তারা টাকা রেখে আসে। এই ব্যাংকের ডিপোজিট কালেকশনের জন্য কোনও মার্কেটিংও করতে হয় না। ইসলামি ব্যাংকগুলো মূলত রেট ফিক্সড না করে বলতে চায়, তারা সুদমুক্ত। বাদবাকি সবই সাধারণ ব্যাংকের মতোই।’
ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাংক নিজেদের লাভটাই দেখে বলে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মুনিরুল মওলা। তিনি বলেছিলেন, ‘সচেতন ব্যবসায়ীরা সব সময় লাভ করার পরিকল্পনাই করেন। আমরাও দেখেশুনে বিনিয়োগ দেই। দেখা যায়, ৯৫ থেকে ৯৬ শতাংশ প্রকল্পই লাভে থাকে। ৩-৪ শতাংশ হয়তো লোকসানে পড়ে। অর্থাৎ গড় হিসেবে ব্যাংকের লাভই বেশি। যে কারণে লোকসানের ভাগ নেওয়ার পরও ব্যালেন্স শিটে সেটার প্রভাব পড়ে না।’
ইসলামি ব্যাংকের সেবা কতটুকু বিস্তৃত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চলতি বছরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা দেশে অন্তত সাড়ে ৫ হাজার শাখা-উপশাখায় ইসলামি ব্যাংকিং পরিচালিত হচ্ছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে সরকারি-বেসরকারি মোট ৩৩টি ব্যাংক কোনও না কোনোভাবে ইসলামি ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করেছে।
এর মধ্যে পুরোপুরি ইসলামি ধারায় আছে ১০টি। ব্যাংকগুলো হলো— ইসলামী ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটিজ ইসলামী ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক।
আরও ৯টি ব্যাংক তাদের ৪০টি শাখায় ইসলামি ব্যাংকিং পরিচালনা করছে। এর বাইরেও ১৪টি ব্যাংক তাদের ১৯৪টি শাখায় ‘ইসলামি ব্যাংকিং উইন্ডো’ খুলেছে।
আরও জানা গেছে, গত সাত বছরে ইসলামি ব্যাংকিং সেবা দেওয়ার কেন্দ্র বেড়েছে অন্তত সাড়ে পাঁচগুণ। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯০০টি শাখায় চলেছে ইসলামি ব্যাংকিং। এখন হচ্ছে ৫ হাজার ১২৩টি শাখায়।
দেখা যায়, বেসরকারি খাতের অন্য কোনও ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকের ধারেকাছেও নেই। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আমানত রয়েছে পূবালী ব্যাংক লিমিটেডের। ২০২১ সাল শেষে ব্যাংকটির আমানত দাঁড়িয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকায়। অর্থাৎ দ্বিতীয় সর্বোচ্চর চেয়ে ইসলামী ব্যাংকের আমানত তিনগুণেরও বেশি।
আগামীকাল পড়ুন: অভিযোগগুলো কিভাবে দেখছেন ইসলামি অর্থনীতিবিদরা
The post ‘শুভংকরের ফাঁকি’ : বিতর্কের মুখে ইসলামি ব্যাংকিং appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%b6%e0%a7%81%e0%a6%ad%e0%a6%82%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%ab%e0%a6%be%e0%a6%81%e0%a6%95%e0%a6%bf-%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%95%e0%a7%87%e0%a6%b0/
No comments:
Post a Comment