রাকিবুল হাসান নাঈম:
ইসলামফোবিয়ার দৃশ্যায়ন হিসেবে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রকল্পটি আলোচিত হচ্ছে গেলো ক’বছর ধরেই। বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রায়শই বিষয়টি নিয়ে তুমুল হৈচৈ হয়েছে। রাষ্ট্রীয় সেবকসংঘ কোনো রাখঢাক না রেখেই ভারতে জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার জন্য মুসলিমদের দায়ী করে সরকারকে তা নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছে। বিজেপির এমপি রাকেশ সিনহা ভারতীয় পার্লামেন্টে উত্থাপন করেছেন একটি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কথিত উন্নত রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি এবং মুসলমানদের প্রতি একপ্রকার ঘৃণ্য মনোভাব থেকে এই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ধারণার উদ্ভব। বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল বসতিগুলোতে এ ধারণা চাপিয়ে দেয়া হয়। বসতির কর্ণধাররা বিভিন্ন বিবেচনায় এ ধারণা বাস্তবায়ন করতে বাধ্য হন।
ভারতের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে মুসলিমভীতি
ভারতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের যে প্রকল্প, তা মুসলমানদের লক্ষ্য করেই আবর্তিত হচ্ছে। ভারতীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ক্ষমতাসীন জোটের শরিক দল আরএসএসপ্রধান মোহন ভাগবত চাচ্ছেন, যেকোন মূল্যে ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে। রাষ্ট্রীয় সেবকসংঘ কোনো রাখঢাক না রেখেই ভারতে জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার জন্য মুসলিমদের দায়ী করে সরকারকে তা নিয়ন্ত্রণের কথা বলছে। তারা বলছে, এভাবে মুসলমানদের সংখ্যা বাড়তে থাকলে একসময় মুসলমানরা হিন্দুদের ছাপিয়ে যাবে।
কিন্তু ভারতে ১০ বছর অন্তর অন্তর যে জনগণনা হয়, তার পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি ১০ বছরে মুসলিমদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ধাপে ধাপে কমে আসছে। ভারতের ২০১১ সালের রাষ্ট্রীয় জনগণনায় ১২১.০৯ কোটি মানুষের মধ্যে হিন্দু ছিল ৯৬.৬৩ কোটি (৭৯.৮ শতাংশ) এবং মুসলিম ছিল ১৭.২২ কোটি (১৪.২ শতাংশ)। ১৯৫১-৬১ সালে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ৩২.৪ শতাংশ, ১৯৬১-৭১ সালে ৩০.৯ শতাংশ, ১৯৭১-৮১ সালে ৩০.৭ শতাংশ, ১৯৮১-৯১ সালে ৩২.৮ শতাংশ, ১৯৯১-২০০১ সালে ছিল ২৯.৫ শতাংশ, ২০০১-২০১১ সালে ছিল ২৪.৬ শতাংশ।
তবে পিউ রিসার্চ সেন্টারের সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, ভারতে বড় ধর্মীয় জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে মুসলিমদের ভেতর উর্বরতার হার এখনো সর্বোচ্চ (২০১৫ সালের হিসেবে ২.৬)। এর পরই আছে হিন্দুরা (২.১)। আর জৈনদের মধ্যে উর্বরতার হার সবচেয়ে কম, মাত্র ১.২।
ভারতের ৯৫ শতাংশ হিন্দুই জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য মুসলমানদের দায়ী মনে করেন বলে জানিয়েছেন দেশটির ‘জনসংখ্যা সমাধা ফাউন্ডেশন’ প্রধান। তিনি আল-জাজিরাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, যখন আমরা দেশজুড়ে ভ্রমণ করি তখন ৯৫ শতাংশ লোক বলেছে, মুসলমানেরা ভারতের জনসংখ্যা বিস্ফোরণের জন্য দায়ী। হিন্দুরা আমাকে বলেছে, আমাদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে বলার কোনো মানে নেই, আপনার উচিত মুসলমানদের এ কথা বলা।
এনজিওটি দুই সন্তান নীতিকে সমর্থন করে। এটির ৪০০-এর বেশি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ১০ লাখ মানুষ যুক্ত আছে।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের দুটি কারণ
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পটি ইসলামফোবিক কিনা, এ প্রসঙ্গে কথা হয় প্রখ্যাত আলেম লেখক ও চিন্তক মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদের সঙ্গে। তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘কেবল ইসলামফোবিয়ার কারণে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, তা বলা যাবে না। কোনো কোনো দেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কয়েকটি কারণের মধ্যে একটি কারণ ইসলামফোবিয়া।’
আরেকটি কারণের ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, কথিত উন্নত রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি। তারা মনে করে, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল কিংবা শিক্ষা ও সংখ্যায় পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। তাই দুর্বল রাষ্ট্রগুলো যখন তাদের কাছে সাহায্য আনতে যায়, তারা জনসংখ্যা কমানোর মতো বিভিন্ন শর্ত দিয়ে বসে। এই শর্ত তখন রাষ্ট্রের কর্ণধারদের মেনে নিতে হয়। আবার কখনও শর্ত ছাড়াই পশ্চিমা রাষ্ট্রের ধারণাগুলো আমাদের রাষ্ট্র স্বেচ্ছায় লুফে নেয়। পশ্চিমাদেরও লাভ—এক ঢিলে দুই পাখি স্বীকার। জনসংখ্যাও কমলো, মুসলমানদের সংখ্যাও বাড়লো না।’
ভারতের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভারতের যে অঞ্চলগুলোতে মুসলমানদের দায়ি করে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে মুসলমানরা দুর্বল। এক জায়গায় খুব বেশী মুসলমান নেই। তাই তাদের পরিবারে যখন সন্তানের সংখ্যাধিক্য দেখা যায়, চারদিক থেকে তাদের উপর চাপ আসতে থাকে। হিন্দুরা ভাবতে থাকে, মুসলমানদের সংখ্যা বেড়ে গেলে হিন্দুদের জায়গাটা সংকুচিত হয়ে যাবে।’
বাংলাদেশের প্রসঙ্গ টেনে এই আলেম চিন্তক বলেন, ‘বাংলাদেশেও দেখেছি, ১৯৮০-৯০ সালের দিকে জন্মনিয়ন্ত্রণের বেশ প্রচারণা ছিল, ক্যাম্পেইন ছিল। এখন সময় বদলেছে, এখন আর জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রচারণা তেমন দেখা যায় না।’
একই কারণ উল্লেখ করেছেন স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যার সমস্যা নিয়ে কাজ করা মুম্বাইভিত্তিক এনজিও, পপুলেশন ফার্স্টের পরিচালক ডা: আল শারাদা। আল জাজিরাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, মুসলিমদের দায়ি করে জন্মনিয়ন্ত্রণের দাবি বিপজ্জনক ও অবিবেচনাপ্রসূত। এটা কর্তৃত্ববাদী, সুবিধাভোগী দাবি। এই উদ্দেশ্য হাসিলে সর্বদা দরিদ্র ও বঞ্চিতদের জন্য লক্ষ্যে পরিণত করা হয়।
The post জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রকল্পটি কেন ইসলামফোবিক appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%9c%e0%a6%a8%e0%a6%b8%e0%a6%82%e0%a6%96%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be-%e0%a6%a8%e0%a6%bf%e0%a7%9f%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a3%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0/
No comments:
Post a Comment