রাকিবুল হাসান নাঈম:
কওমি মাদরাসার ছাত্রদের মধ্যে মূল কিতাবের বাইরে গাইড নির্ভরতা বেড়েছে। যেকোনো কওমি মাদরাসাতে গেলেই চোখে পড়ে গাইড বইয়ের ছড়াছড়ি। বছর কয়েক ধরে বোর্ড পরীক্ষার জামাতগুলোর জন্য নতুন একধরনের বই এসেছে বাজারে। বোর্ডের বিগত বছরগুলোর পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর সম্বলিত এসব বই ব্যাপকভাবে সংগ্রহ করছেন সংশ্লিষ্ট জামাতের পরীক্ষার্থীরা। বিভিন্ন মাদরাসায় বাংলা সহায়কগ্রন্থ অধ্যয়ন একসময় কড়াভাবে নিষিদ্ধ থাকলেও সে নিষেধাজ্ঞার ওপর এখন শিথিলতা এসেছে। বোর্ডে ভালো রেজাল্টের জন্য দুর্বল ছাত্রের পাশাপাশি মেধাবী ছাত্ররাও এখন সংগ্রহ করছেন পরীক্ষার প্রশ্নোত্তর সম্বলিত এসব গাইড বই।
কওমি মাদরাসার নিচের জামাতগুলোর তুলনায় দাওরায়ে হাদিস অর্থাৎ হাইয়াতুল উলয়ার পরীক্ষার্থীদেরকে ব্যাপকভাবে দেখা গেছে এ ধরনের গাইড বইয়ের আশ্রয় নিতে। তাকমিল শিক্ষার্থীদের মেধা ও যোগ্যতার মান বিবেচনা করে দুই ধরনের গাইড বই বাজারে ছড়ানো হয়েছে। একটা আরবি, আরেকটা বাংলা। বাংলাবাজারের ধর্মীয় পুস্তক প্রকাশকরাই প্রধানত এই গাইডগুলো ছাপে। দাওরায়ে হাদিসের জন্য তৈরি বৃহৎ কলেবরের বাংলা গাইডের নাম আওনুল মুগিস। আর আরবি গাইডের নাম আত-তাসহিল। এছাড়াও রয়েছে মুঈনুল ইমতেহান ও ওরাকাতুল ইসলামিয়্যাহ নামে প্রসিদ্ধ দুটি প্রকাশনীর গাইড। দেশের বিভিন্ন মাদরাসায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাইআতুল উলয়ার প্রায় প্রত্যেক পরীক্ষার্থীর সংগ্রহেই আওনুল মুগিস অথবা আত-তাসহিল গাইডটি রয়েছে।
রাজধানীর কয়েকটি মাদরাসার ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গাইডে বেফাকের একদম শুরুর পরীক্ষা থেকে সব বছরের প্রশ্ন এবং এর উত্তর সংযুক্ত থাকায় কিতাবের প্রায় সব বিষয়ই চলে এসেছে। পরীক্ষার সময় মূল কিতাব না পড়ে গাইড পড়ে গেলেই ভালো নম্বর ওঠানো যায়। ফলে বছরের শুরু থেকেই অনেকে গাইড নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। ক্লাসে হুজুরদের দেওয়া তাকরিরে যেমন তাদের গুরুত্ব থাকে না, তেমনি মূল কিতাব কিংবা ব্যাখ্যাগ্রন্থ অধ্যয়নের মানসিকতাও তাদের নষ্ট হয়ে যায়।
আত-তাসহিল, আউনুল মুগিস-সহ আর কয়েকটি গাইড ঘেঁটে দেখা গেছে, এগুলোতে প্রচুর পরিমাণ প্রুফজনিত ভুল রয়েছে। এত পরিমাণ ভুল যে, শিক্ষার্থীদের যারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল, তারা প্রায়ই এ ভুলগুলো ধরতে পারবে না এবং বিভ্রান্তির শিকার হবে।
তবে শুরু থেকেই কওমি মাদরাসায় গাইড বই নিরুৎসাহিত করে আসছে কওমি শিক্ষাবোর্ড বেফাক। আগে তেমন সতর্ক না হলেও সম্প্রতি তারা সতর্ক হয়েছে এবং বোর্ড পরীক্ষার প্রশ্নেও এনেছে পরিবর্তন। এ প্রসঙ্গে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মাওলানা যুবায়ের আহমাদের সঙ্গে কথা হয়। তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘প্রশ্নপত্র যেন গাইডের ধরনের বাইরে থেকে করা হয় এ বিষয়ে বোর্ডের সভাপতি আমাদের শুরু থেকেই বলে এসেছেন। গত পরীক্ষায় বিষয়টি লক্ষ্য রাখা হয়েছে। এতে করে কিছু শিক্ষার্থীর হয়তো কষ্ট হয়েছে, কিন্তু সার্বিকভাবে বিষয়টি প্রশংসিত হয়েছে। দেখা গেছে, যারা গাইডভিত্তিক পড়াশোনা করেছে, তারা ভালো রেজাল্ট করতে পারেনি। ফলে ছাত্রদের মাঝেও এই অনুভুতি এসেছে যে গাইড থেকে বেরিয়ে এসে মিল কিতাবের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে হবে।
গাইড নিরুৎসাহিত করতে বেফাকের উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, যখন পরীক্ষার নিবন্ধনের জন্য প্রতিটি মাদরাসায় নির্দেশনা পাঠানো হয়, সেখানে লিখে দেয়া হয়, পরীক্ষায় গাইড থেকে কোনো প্রশ্ন করা হবে না। মূল কিতাবের সঙ্গে মিল রেখে প্রশ্ন করা হবে। সুতরাং সবাই যেন মূল কিতাব থেকে পড়ে।
পরীক্ষার প্রসঙ্গ বাদে এমনিতে মাদরাসাগুলোতে গাইড নিষিদ্ধ করে বেফাকের কোনো নির্দেশনা দেয়া আছে কিনা জানতে চাইলে মাওলানা যুবায়ের আহমাদ বলেন, এমন কোনো নির্দেশনা বোর্ডের পক্ষ থেকে নেই। তবে বিষয়টি আমরা ভেবে দেখব। মাদরাসা কর্তৃপক্ষ যদি সতর্ক হন, তারা যদি তদারকি করেন, তাহলে বিষয়টি নিযন্ত্রণ করা সম্ভব। আমরা বিষয়টি আলোচনায় তুলব।’
জামিয়া রাহমানিয়া আজিজিয়ার প্রিন্সিপাল ও কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকের মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক গাইডের ছড়াছড়ি বন্ধ করতে সম্মিলিত প্রচেষ্টার উপর জোর দিয়েছেন। তিনি ফাতেহকে বলেন, এই গাইডের ছড়াছড়ি বন্ধ করতে হলে সম্মিলিত প্রচেষ্টা লাগবে। যেমন শিক্ষাবোর্ডের দায়িত্ব হলো, কেন্দ্রীয় পরীক্ষাগুলোতে গাইডের বাইরে গিয়ে প্রশ্ন করা। বেফাকের সর্বশেষ পরীক্ষায় গাইডের বাইরে গিয়ে ভিন্নধারার প্রশ্ন করা হয়েছে। এতে যারা গাইডনির্ভর পড়াশোনা করেছে, তারা বিপদে পড়েছে। বোর্ডকে এই ধারাটা চালু রাখতে হবে।
তবে মূল চেষ্টাটা করতে হবে মাদরাসা কর্তৃপক্ষকে। শিক্ষক যেন মূল মতন থেকে পড়ান। মাদরাসা কর্তৃপক্ষ যেন গাইডের বিরুদ্ধে কঠিন থাকেন। ছাত্ররা যেন মাদরাসায় গাইড ব্যবহার করতে না পারে, তার তদারকিও করতে হবে। যেহেতু ছাত্ররা পরীক্ষা দিবে, পরীক্ষাতে কিভাবে প্রশ্ন হতে পারে, কিভাবে উত্তরপত্র লিখতে হবে, আলাদা সময় নিয়ে শিক্ষকরা যেন ছাত্রদেরকে বুঝিয়ে দেন।
গাইড প্রকাশকদের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, গাইড বইয়ের প্রকাশকদের সঙ্গে বসে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করা যায়। কওমি ধারা হলো নিরেট নির্ভেজাল একটি ধারা। নোট, গাইড বের করে ছাত্রদের যোগ্যতাহীন করে তোলার সুযোগ দেয়াটা খারাপ। তাদেরকে যদি বুঝানো যায়, বিষয়টা মন্দ হবে না। গাইড থাকবেই না, সেটা বলছি না। তবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যদি সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালানো হয়, গাইডের ছড়াছড়ি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
The post কওমি মাদরাসায় গাইড বইয়ের ছড়াছড়ি ! appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%95%e0%a6%93%e0%a6%ae%e0%a6%bf-%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a7%9f-%e0%a6%97%e0%a6%be%e0%a6%87%e0%a6%a1-%e0%a6%ac%e0%a6%87%e0%a7%9f%e0%a7%87%e0%a6%b0/
No comments:
Post a Comment