Wednesday, August 31, 2022

মধুপুর গড়াঞ্চল : যেভাবে গারোরা খৃস্টান জনগোষ্ঠীতে পরিণত হল

মুনশী নাঈম:

টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলার মধুপুর গড়াঞ্চলে বসবাসরত গারো সম্প্রদায়ের শতভাগ সদস্য খৃস্টান মিশনারীদের হাতে খৃস্টধর্ম গ্রহণ করেছে। মধুপুর গড়াঞ্চলে মোট জনগণের ৩২.৫৭% খৃস্টান ধর্মের অনুসারী। সেখানে গারোদের সংখ্যা ১৩,৫৯৯। খৃস্টধর্ম গ্রহণ করার পর তাদের সামাজিক রীতি-নীতিতেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। তারা এখন আর তাদের ঐতিহ্যবাহী ধর্ম ও সমাজ-সংস্কৃতিকে খুব বেশি মূল্যায়ন করে না। শুধু সেগুলোকেই মূল্যায়ন করে যেগুলো খ্রিস্ট ধর্মের সাথে সাংঘার্ষিক নয়। যেগুলো খ্রিস্টধর্মের সাথে দ্বন্ধ ও বৈরিতা সৃষ্টি করে সেগুলোকে তারা বর্জন করেছে। গারো জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানেও দেখা যায় খ্রিস্টীয়করণের প্রভাব। এসব উৎসবে ঐতিহ্যের কিছু বিষয় টিকে থাকলেও সব পালিত হয় খ্রিষ্টীয় রীতিতে।

সেভ বাংলাদেশ মিশনের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খৃস্টান মিশনারীদের কার্যক্রমের অন্যতম একটা এরিয়া হচ্ছে টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলার মধুপুর গড়াঞ্চল। ব্রিটিশ আমল থেকে মিশনারীরা গারোদের মাঝে কার্যক্রম শুরু করে। ভারতে ধর্মান্তরিত গারো খৃস্টানদের মাধ্যমে মূলত বাংলাদেশের গারোদের মাঝে তারা কার্যক্রম চালায়। মিশনারীদের কার্যক্রমের ফলে গারো সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের আদি সাংশারেক ধর্ম ছেড়ে প্রায় ৯৯.১০% গারো এখন খৃস্টান ধর্মের অনুসারী।

ইতিহাস ঘেঁটে জানা গেছে, বাংলাদেশে বসবাসরত গারো সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীরা মঙ্গোলীয় বংশদ্ভূত। এদের আদিনিবাস চীনের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের সিন-কিয়াং প্রদেশে। পরবর্তীতে বিভিন্ন সমস্যায় পতিত হয়ে দেশত্যাগ করে তারা তিব্বতে দীর্ঘদিন বসবাস করে। এরপর ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের পার্বত্য এলাকায় এবং বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের কিছু এলাকায় তারা বসবাস করে। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড় এবং বাংলাদেশের মধুপুর গড়ের বনাঞ্চলকে কেন্দ্র করে মূলত গারোদের নিবাস গড়ে উঠেছিল। বর্তমানে গারো সম্প্রদায়ের অধিকাংশ জনগণের বসবাস ভারতের মেঘালয়ের গারো পাহাড়ে। এছাড়া বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের মধুপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, জামালপুর, গাজীপুরে এদের বিশাল বসবাস রয়েছে।

ফাদার ইউজিন: মিশনারীদের মূলহোতা

মধুপুরে গারো সম্প্রদায়কে খৃস্টান বানানোর পেছনে সবচে বড় ভূমিকা ফাদার ইউজিন হোমরিকের। তার ধর্মান্তর কার্যক্রমের মাধ্যমে মূলত গারো জনগোষ্ঠী সাংশারেক ধর্ম থেকে খৃস্টান ধর্মে রূপান্তরিত হয়। ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের এই ধর্মপ্রচারক ১৯৫৯ সালে মধুপুরে ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে আসেন।

তিনি মধুপুরের জলছত্র ও পীরগাছায় গিয়ে প্রথমে সেখানকার গারোদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার জন্য কাজ করেছেন। তিনি শিক্ষার গুরুত্ব এবং শিশুদের শিক্ষিত করার প্রয়োজনীয়তা অভিভাবকদের কাছে গিয়ে বলতেন। জনগণের নৈতিক গুণাবলীর বিষয়েও তিনি আলোচনা করতেন। সুখে-দুঃখে মানুষের পাশে থাকাতে তিনি সে এলাকার জনপ্রিয় ব্যক্তি হয়ে উঠেন। এছাড়াও তিনি স্থানীয় পোশাক এবং সংস্কৃতির আলোকে জীবন পরিচালনা করতেন। সেখানকার মানুষের সাথে মিশে যেতেন। এভাবে তিনি সেখানে ধর্মপ্রচার ও ধর্মান্তরের জন্য একটা অনুকূল পরিবেশ প্রথমে সৃষ্টি করেছিলেন। তারপর ধর্মপ্রচারের ফলে ধর্মান্তরের মিশন শুরু করেন।

তার ধর্মান্তরের ক্ষেত্রে নীতি ছিল, কোনো জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে ধ্বংস না করে সেই সংস্কৃতির মধ্যেই তাকে ধর্মান্তর করা। ফলে তিনি গারো জনগোষ্ঠীকে তাদের সংস্কৃতির মধ্যেই ধর্মান্তর করেছিলেন। তারপর তাদের যেসব সংস্কৃতির বিষয়গুলো খৃস্টান ধর্মের বিশেষত ক্যাথলিকদের সাথে সাংঘার্ষিক সেগুলোর মধ্যে খৃস্টান সংস্কৃতি ঢুকিয়ে টিকিয়ে রাখতেন। এভাবে তিনি তার ধর্মান্তর ও সংস্কৃতির সমন্বয় করতেন।

ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের গারো আদিবাসীদের খৃস্টান ধর্মে ধর্মান্তরকরণে এবং খৃস্টান হওয়ার পরবর্তীতে পুরো জনগোষ্ঠীর সমাজ ও সংস্কৃতিতে ক্রিস্টানাইজেশনের প্রক্রিয়ার সাথে তিনি জড়িত ছিলেন। ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি এ কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। মধুপুরের আগে তিনি ময়মনসিংহ অঞ্চলের গারো জনগোষ্ঠীর ধর্মান্তর্করণে কাজ করেন।

গারোদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় মিশনারী

চিকিৎসা সেবা প্রদানের মাধ্যমে মূলত খৃস্টান মিশনারীরা মধুপুরের গারো জনগোষ্ঠীর মাঝে কার্যক্রম শুরু করে। সেখানে তারা দুইটি হাসপাতাল, একাধিক আশ্রম ও চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। তারমধ্যে অন্যতম যক্ষা ও কুষ্ঠ হাসপাতাল এবং ডাক্তার এডরিক বেকারের হাসপাতাল। তারা চিকিৎসা সেবা দিয়ে মানুষদেরকে খৃস্টান ধর্মে আকৃষ্ট করছে। তাছাড়া পীরগাছা, মাগস্তিনগরসহ কয়েকটি জায়গায় আশ্রম আছে। এসন আশ্রমেও তারা চিকিৎসা সেবা প্রদান করে। জলছত্রে অবস্থিত মাদার তেরেসা চ্যারিটিতে অন্যান্য সেবার পাশাপাশি মানুষকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করে থাকে। এর বাইরেও গর্ভবতীদের চিকিৎসা, প্রসূতি মায়ের সেবা প্রদান, বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান, গরীব-দুঃস্থদের খাদ্য ও পোষাক দিয়েও সাহায্য করে থাকে।

তবে মিশনারীরা চিকিৎসার পাশাপাশি বেশি জোর দিয়েছে শিক্ষায়। সেভ বাংলাদেশ মিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মধুপুরে ৬৫ টি এনজিও স্কুল আছে। এগুলোর অধিকাংশই মিশনারীদের স্কুল। মাধ্যমিক স্কুল ২টি, সেমিনারী স্কুল ১ টি, শিশু পল্লী ১ টি, প্রতিবন্ধী স্কুল ১ টি এবং প্রায় ৪৫ এর অধিক প্রাথমিক স্কুল আছে। মিশনারী হিউজিন হোমরিক একাই ৩০ এর অধিক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল করেছিলেন।

মধুপুর গড়াঞ্চল সরেজমিন পরিদর্শন করে সেভ  বাংলাদেশ মিশন প্রতিবেদনটি তৈরী করেছেন কেরামত আলী। তিনি ফাতেহকে বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মধুপুরে তিন ধরনের ক্যাটাগরির শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেখা যায়। প্রাথমিক স্কুল, মাধ্যমিক স্কুল ও সেমিনারী ভুল। মধুপুরে খৃস্টান মিশনারীরা প্রাইমারি শিক্ষার প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। গারো বসবাসরত প্রায় প্রতিটি গ্রামেই মিশনারী (প্রাইমারি) স্কুল আছে। যেসব গ্রামে খৃস্টান মিশনারীদের একাধিক সম্প্রদায়ের (যেমমন: ক্যাথলিক, ব্যাপটিস্ট চার্চ অব বাংলাদেশ ইত্যাদি) কার্যক্রম ও জনগণ আছে, সেসব গ্রামে একাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। তবে অন্ততপক্ষে ন্যূনতম একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় গারো বসবাসরত গ্রামগুলোতে আছে।

তিনি আরও বলেন, মাধ্যমিক স্কুল আছে দুটি। একটি জলছরে কর্পাস খ্রীষ্টি হাই স্কুল এবং অন্যটি পীরগাছায় অবস্থিত সেন্ট পৌলস মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়। উভয় স্কুলে গারো, বাঙ্গালি, খৃস্টান, হিন্দু ও মুসলিম সবাই পড়াশোনা করতে পারে। বর্তমানে মাধ্যমিক স্কুলগুলো সরকারী এমপিও ভুক্ত হয়েছে। আগে খৃস্টান শিক্ষক থাকলেও আধা-সরকারী হওয়ার ফলে এখন খ্রিষ্টানের পাশাপাশি অন্য ধর্মের বাঙ্গালি শিক্ষক ও নিযুক্ত আছে। তবে খৃস্টান না হলে স্কুলের হোস্টেল সুবিধা পাওয়া যায় না।

ধর্মীয় বিষয়ে পড়াশোনা করানো এবং ধর্মযাজক তৈরী করার লক্ষ্যে মধুপুরে আছে সেমিনারী স্কুল । মধুপুরের জলছত্রে সেভেন্থ এডভেন্টিস্ট সেমিনারী এন্ড স্কুল এবং সেন্ট পলস মাইনর সেমিনারী স্কুল দুটি সেখানে খ্রিষ্টীয় ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান ও ধর্ম যাজক তৈরীতে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সেমিনারী স্কুলে একমাত্র খৃস্টানরাই পড়তে পারে। ময়মনসিংহ ধর্মপ্রদেশের বর্তমান বিশপ পরেন পল কবি এটার প্রথম পরিচালক ছিলেন। বর্তমানে এর পরিচালক ফাদার উৎপন রিচি। ২০২০ সালের মধ্যে এ সেমিনারী থেকে ১৫ জন ধর্মযাজক হয়েছেন। এবং ৩ জন ডিকন ধর্মযাজক হওয়ার পথে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারী স্কুল বা মুসলিম মালিকানাধীন বেসরকারী স্কুল খুবই কম। অনেক গ্রামে কোন স্কুল নেই। যা আছে মিশনারীদের প্রাইমারি স্কুল। এদিক থেকেও একটা সংকট দেখা দিচ্ছে। সেখানকার অনেক মুসলিমদেরকে বাধ্য হয়ে মিশনারীদের স্কুলে পড়াশোনা করতে হচ্ছে। খৃস্টান মিশনারীদের শিক্ষাক্ষেত্রে কার্যক্রমের ফলে মধুপুরের গড়াঞ্চলে বাঙ্গালি সমাজের তুলনায় গারো খৃস্টানরা শিক্ষার দিক থেকে অনেক অগ্রসর। শিক্ষার দিক থেকে গারোরা ৭৮.৭৫% হলেও বাঙ্গালির শিক্ষার হার মাত্র ৫৮.৬২% ।

গারোদের পর হিন্দু-মুসলিম টার্গেট

সেভ বাংলাদেশ মিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মধুপুরে খৃস্টান মিশনারীদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কার্যক্রম চলছে। তারমধ্যে রোমান ক্যাথলিক, ব্যাপটিস্ট, সেভেন্টথ ডে এডভেনটিস্ট, চার্চ অব বাংলাদেশ, গারো ব্যাপটিস্ট কনভেনশন অন্যতম। খৃস্টান মিশনারী সংস্থাগুলোর ধর্মান্তরের কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন এনজিও যেমন কারিতাস, ওয়ার্ল্ড ভিশন, ওয়াইএমসিএ, সালোম ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান, সেবা, ও উন্নয়নমূলক কাজ করে থাকে।

সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট এন্ড হিউম্যান ডেপেলপমেন্ট এক জরিপে বলেছে, মধুপুর গড়াঞ্চলে ইসলাম ধর্মে ৫৯.৪৬%, খৃস্টান ধর্মে ৩২.৫৭% হিন্দু ধর্মের ৭.৮৮% এবং গারোদের আদিধর্ম সাংসারেক ধর্মের ০.০১% অনুসারি। ঐ এলাকায় কর্মরত খৃস্টান মিশনারী ও তাদের সংস্থাগুলো গারো জনগোষ্ঠীকে খৃস্টান বানিয়ে তাদেরকে খৃস্টান ধর্মে ধরে রাখার পাশাপাশি এখন মুসলিম ও হিন্দুদেরকেখৃস্টান বানানোর পরিকল্পনা নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ৫ টি ইউনিয়নের ৪৪ টি গ্রামে ইতোমধ্যে ১৪৫ জন বাঙ্গালি হিন্দু ও মুসলিমকে মিশনারীরা খৃস্টান বানিয়েছে।

খৃস্টান মিশনারীরা শুধুমাত্র ধর্মান্তর ও ধর্মান্তরিতদের দিয়ে খৃস্টান ধর্ম পালন করানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই বরং বিভিন্ন ধর্ম ও জনগোষ্ঠী থেকে খৃস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়া জনগণের ক্ষমতায়ন নিয়েও কাজ করে থাকে। বরং এটাকে গুরুত্বের সাথে তারা বিবেচনা করে থাকে। ক্ষমতায়নের জন্য তারা ঐ এলাকার গারো খৃস্টানদের দিয়ে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে থাকে। এতে তারা যে কোন বিষয় নিয়ে আন্দোলন করতে পারে। যেকোন বিষয়ের প্রতিবাদ করতে পারে। যেকোন ইস্যুতে সংগঠনগুলোকে কাজে লাগানো যেতে পারে। লোকাল সংগঠনের মধ্যে রয়েছে জয়েনশাহী আচিকমিকি, আজিয়া আবিদা ইত্যাদি। এছাড়াও দেশব্যাপী গারোদের সংগঠনের মধ্যে বাগাছাস গাছে, বিজিও রয়েছে।

কর্মসংস্থান দিচ্ছে মিশনারীরা

খৃস্টান মিশনারীদের মধুপুরে কার্যক্রমের অন্যতম একটা অংশ হচ্ছে কর্মসংস্থান প্রকল্প। শিল্প-কারখানা থেকে শুরু করে সিল্ক তৈরী, হস্তশিল্প ও আয়মূলক কাজে জড়িত করে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকুরি দিয়ে কৃষিকাজের জন্য লোন দিয়ে তারা উক্ত এলাকায় কর্মসংস্থানের জন্য কাজ করে থাকে। বিশেষ করে যারা খৃস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয় তারা এ সুবিধা ভোগ করে। তাছাড়াও অনেককে এ ধরনের সুবিধা দিয়ে থাকে খৃস্টান বানানোর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে।

সেভ বাংলাদেশ মিশনের প্রতিবেদক কেরামত আলী বলেন, মধুপুরে খৃস্টান মিশনারীদের একটি প্রকল্প হলো কারিতাস সিল্ক। সেখানে গারো ও বাগানি উভয় কাজ করতে পারে। আরেকটি হচ্ছে কারিতাসের মান্ড এন্ড ইন্ড্রাস্ট্রি। এ দুইটা ইন্ড্রাস্টি মধুপুরের অরণখোলা ইউনিয়নের জলাহরে অবস্থিত। মধুপুরের পীরগাছা গ্রামে আছে নকরেকনি জুমাং তাঁতশিল্প। এছাড়াও মধুপুরে খৃস্টান বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও এনজিওগুলোতে গারো খৃস্টান জনগোষ্ঠী কাজের সুযোগ পায়। এতে অনেকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। গারো শিক্ষিতরা বিভিন্ন এনজিওতে কাজের সুযোগ পাচ্ছে। ফলে সেখানকার গারো খৃস্টান অর্থনৈতিক অবস্থা মুসলিম সমাজের তুলনায় অনেক ভালো।

গারো জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য খৃস্টান মিশনারীদের বিভিন্ন সংস্থা, যেমন: কারিতাস, ওয়ার্ল্ড ভিশন, গারো ব্যাপটিস্ট কনভেনশন, সালোম, ওয়াইএমসিএ সহ বিভিন্ন এনজিও কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বেশকিছু প্রজেক্টও চালু আছে গারো জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য। গারো শিশুদের উন্নয়নের জন্য ওয়ার্ল্ড ভিশনের শিশু উন্নয়ন প্রকল্প, মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া শিশু উন্নয়ন প্রকল্প বর্তমানে প্রচলিত আছে। এছাড়াও ইউএনডিপি, এডিপি, আইপিডিএসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন প্রকল্প মধুপুরে গারো জনগোষ্ঠীর মাঝে কাজ করে থাকে। খৃস্টান মিশনারী সংস্থা বা তাদের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত এনজিওগুলো মধুপুরে গারো জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করে থাকে।

গারো সমাজে খৃস্টান সংস্কৃতির প্রভাব

ধর্মান্তরের ফলে গারো সমাজে খৃস্টান সংস্কৃতির প্রভাব বেশ প্রকটভাবে বদ্ধমূল হচ্ছে দিনকে দিন। তারা এখন আর তাদের ঐতিহ্যবাহী ধর্ম ও সমাজ-সংস্কৃতিকে খুব বেশি মূল্যায়ন করে না। শুধু সেগুলোকেই মূল্যায়ন করে যেগুলো খ্রিস্ট ধর্মের সাথে সাংঘার্ষিক না। যেগুলো খ্রিস্ট ধর্মের সাথে দ্বন্ধের বৈরিতা সৃষ্টি করে সেগুলোকে তারা বর্জন করেছে।

গারো জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানেও দেখা যায় খ্রিস্টীয়করণের প্রভাব দেখা যায়। তাদের অন্যতম একটি উৎসব ওয়ানগালা। বর্তমানে ওয়ানগালা উৎসবে তাদের সাংশারেক ধর্মের বিষয়গুলো উহ্য করে সেখানে খৃস্টান ধর্মের কিছু বিষয় সংযোজন করা হয়েছে। ধর্মীয় উৎসবের ক্ষেত্রে গারোরা বড়দিন ইস্টার সানডে ও ছোটদিন পালন করে থাকে। এখন গারোদের জন্ম-মৃত্যু ও বিয়েকেন্দ্রিক বিভিন্ন উৎসবে-অনুষ্ঠানে ধর্মযাজকের প্রয়োজন পড়ে। নাম রাখা থেকে শুরু করে মৃত্যার পর শেষকৃত্যও পালিত হয় খৃস্টান ধর্মের আলোকে। গারোদের ছিল মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। এখন তাদের মাঝে মাতৃতান্ত্রিকতা আর আগের মতো কার্যকর নেই। তাদের সমাজে আইন ও বিচারব্যবস্থা থেকে শুরু করে পরিবার পরিচালনা, পরিবারের মূল সিদ্ধান্ত প্রণয়ন সমাজ কাঠামো ইত্যাদিতে বর্তমানে পুরুষের ভূমিকাই বেশি।

তাছাড়া আগে বিয়ের পর গারো সমাজে নারীরা পুরুষদের জামাই হিসেবে বাপের বাড়ি নিয়ে আসতো। কিন্তু বর্তমানে বেশিরভাগ পুরুষরা জামাই হিসেবে শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে না এবং তারা বউদের নিজেদের বাড়িতে এনে বসবাস করছে। আগেকার গারো সমাজে একমাত্র নারীরাই সম্পদের মালিকানা পেত। এখন নারী-পুরুষ সবাই সম্পতি পায়। গারোরা আগে অন্য সম্প্রদায়ের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে লিপ্ত হতো না। কিন্তু এখন অনেক গারোই বাঙ্গালি হিন্দু বা মুসলিম থেকে ধর্মান্তরিত খৃস্টানদের সাথে বিবাহে আবদ্ধ হচ্ছে। তবে খৃস্টান ধর্মের বাইরে অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে তাদের সমাজে একেবারে নিষিদ্ধ। যদি কেউ খৃস্টান ধর্মের বাইরে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় তাহলে তাকে পরিবার, সমাজ ত্যাগ করতে হয়। চার্চ থেকে ধর্মযাজক তার নাম কেটে তাকে মৃত ঘোষণা করে।

মধুপুরে মুসলিম দায়ীদের কার্যক্রম

মধুপুরে খৃস্টধর্মের দাওয়াত যতটা আয়োজন করে দেয়া হয়েছে, ইসলাম ধর্মের দাওয়াত ততটা দেয়া যায়নি। খৃস্টান মিশনারীদের প্রবল জোয়ারের সামনে বেশ কয়েকটি মুসলিম সংস্থা কাজ শুরু করেছিল। তাদের মধ্যে অন্যতম—নিউ মুসলিম এজেন্সি, আঞ্জুমানে খাদেমুন, আহলে হাদিস ইত্যাদি। বিশেষ করে নিউ মুসলিম এজেন্সির দাওয়াতে টিকলি গ্রামে অনেকেই মুসলিম হয়৷ বর্তমানেও ওই গ্রামের ১২০০ মানুষের মধ্যে ৫০০ জন মুসলিম।

তবে বর্তমানে এসব কার্যক্রম আর চালু নেই। সরেজমিন অভিজ্ঞতায় কেরামত আলী বলেন, আওমান খাদেমুন এবং আহলে হাদিসের কার্যক্রম প্রথমে সবাইকে মুগ্ধ করলেও সেটা বেশিদিন টিকে থাকেনি। প্রথমদিকে ভালো কার্যক্রম করলেও কিছু কিছু নেতিবাচক ঘটনা এলাকাবাসীকে হতাশ করে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ অর্থনৈতিক কেলেংকারীর সাথে জড়িয়ে পড়েছিল। তাছাড়া আহলে হাদিস ও কওমি হুজুরদের মধ্যে মসজিদে বাড়াবাড়ি ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছিল। এদের নেতিবাচক কার্যক্রমের জন্য মধুপুরে ইসলামী দাওয়াতী মিশন সম্পর্কে বদনাম ছড়ায়। যার ফলে বর্তমানেও ইসলাম সম্পর্ক খৃস্টান গারো জনগোষ্ঠীর মধ্যে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। বর্তমানে সেই এলাকায় পরিকল্পনা নিয়ে ইসলামি দাওয়াতের কার্যক্রম পরিচালনা করলে সফলতা লাভ করা যাবে। এতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনামাফিক কাজ করতে হবে। নাহলে খৃস্টান মিশনারিদের কার্যক্রমের ফলে অদূর ভবিষ্যতে এ এলাকার মুসলিম জনগোষ্ঠীও খৃস্টান ধর্ম ধর্মান্তরিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।

The post মধুপুর গড়াঞ্চল : যেভাবে গারোরা খৃস্টান জনগোষ্ঠীতে পরিণত হল appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%ae%e0%a6%a7%e0%a7%81%e0%a6%aa%e0%a7%81%e0%a6%b0-%e0%a6%97%e0%a7%9c%e0%a6%be%e0%a6%9e%e0%a7%8d%e0%a6%9a%e0%a6%b2-%e0%a6%af%e0%a7%87%e0%a6%ad%e0%a6%be%e0%a6%ac%e0%a7%87-%e0%a6%97%e0%a6%be/

No comments:

Post a Comment