রাকিবুল হাসান:
বাংলাদেশ এবং ভারত উভয় দেশের সংবিধানই এখন ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে। বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয় ১৯৭২ সালের ৪ ডিসেম্বর। মৌলিক নীতি হিসেবে সংবিধানে উল্লেখ করা হয় জাতীয়তা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার। যদিও গবেষকদের মতে ধর্মনিরপেক্ষতা মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রতিশ্রুতিতে বর্ণিত ছিল না। অন্যদিকে ভারতের সংবিধানে ১৯৭৬ সালে ৪২ তম সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মনিপেক্ষতা যুক্ত হয়। এই ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ সংবিধানের মৌলিক অধিকারমালার মধ্যে ব্যক্তিমানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া।
ভারত-বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার স্বরূপ
ইংরেজি Secularism শব্দের বাংলারূপ হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা, আরবীতে যাকে বলা হয় ‘আলআলমানিয়্যাহ’। যদিও এই অনুবাদ নিয়ে অনেক গবেষক প্রশ্ন তুলেন। তাদের মতে নিরপেক্ষতার চেয়ে ধর্মহীনতাই Secularism মূল মর্ম।
২০১২ সালে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী সাহেবের সম্পাদনায় প্রকাশিত বাংলা একাডেমীর ইংলিশ-বাংলা ডিকশনারীতে বলা হয়েছে—Secular-(অর্থ) পার্থিব, ইহজাগতিকতা, জড়, জাগতিক। Secular State ‘গীর্জার সঙ্গে বৈপরিত্যক্রমে রাষ্ট্র’। এ অর্থ অনুযায়ী মুসলিম দেশে এর ব্যাখ্যা হবে মসজিদের সঙ্গে বৈপরিত্যক্রমে রাষ্ট্র। Secularism নৈতিকতা ও শিক্ষা ধর্মকেন্দ্রিক হওয়া উচিৎ নয়-এই মতবাদ। জাগতিকতা, ইহবাদ।
স্যাকুলারিজম অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতার এইসব অর্থের দিকে তাকালে বাংলাদেশ ও ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতা ইসলামের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়। ইসলাম যেমন এই অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতাকে তার বিরোধী এবং বিপক্ষ মনে করে, তেমনি ধর্মনিরপেক্ষতাও মূলত ইসলামকেই বিরোধী মনে করে। ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে প্রকৃতপক্ষে সবাই ইসলামকেই তাড়াতে চায়। কেননা ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্মে রাষ্ট্র ও রাজনীতি সম্পর্কে বিস্তারিত নীতিমালা নেই, একই কারণে অন্য ধর্মগুলো ইসলামের মতো ধর্মনিরপেক্ষতার সমালোচনাও করে না। উদাহরণ হিসেবে ভারতের সংবিধানের দিকে তাকানো যায়।
ভারতের সংবিধানে সব ধর্মের সমান অধিকারের কথা বলা হলেও আইন ব্যবস্থা হিন্দুধর্মাবলম্বীদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট। যেমন সংবিধানের ১৫ (৪) এবং ১৬ (৪) ধারায় পিছিয়ে পড়া শ্রেণীদের জন্য শিক্ষা ও চাকুরীতে যে সংরক্ষণের অধিকার আছে, সরকারি নীতিতে এবং আইনে তা শুধু হিন্দু হিন্দুধর্মাবলম্বীদের জন্যই প্রয়োগ করা হয়, পিছিয়ে পড়া মুসলিম বা খ্রিস্টানদের জন্য তা প্রয়োগ করা হয় না। হিন্দুধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা রয়েছে, অথচ মুসলিমদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে সেরকম অনুদানের কোনও বিধি নেই। আবার অবিভক্ত হিন্দু পরিবারের জন্য আয়কর আইনে কয়েকটি বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে, যা অন্য ধর্মের মানুষের ক্ষেত্রে নেই। সর্বশেষ নাগরিকত্ব আইনে সব ধর্মের লোকদের সুবিধা দেয়া হলেও বাদ দেয়া হয়েছে মুসলিমদের। বাংলাদেশেও এমন বৈষম্য হচ্ছে কোথাও কোথাও।
অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতা বলতেই যেন আজ শুধু ইসলামহীন এক মতবাদ। উইকিপিডিয়ায় স্যাকুলারিজমের এক ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে ‘এন্টি ইসলাম’। সুতরাং এন্টি ইসলাম ইক্যুয়েল টু স্যাকুলারিজম।
আল মাসিরীর বিকল্প প্রস্তাব
স্যাকুলারিজমের যে অর্থ ও সংজ্ঞা উপরে বর্ণিত হয়েছে, মিসরের বিখ্যাত চিন্তাবিদ আবদুল ওহহাব আল মাসিরী তারচেয়েও বিস্তৃত অর্থ ও সংজ্ঞা বর্ণনা করেছেন। তার মতে, উপরে যা বর্ণিত হয়েছে, তা মূলত স্যাকুলারিজমের শাস্ত্রীয় অর্থ ও সংজ্ঞা। কিন্তু মনে রাখতে হবে, একটি শব্দ যখন কালপরিক্রমায় ব্যাপকতা লাভ করে, তখন শব্দের অর্থও ব্যাপকতা লাভ করে। তাই ‘রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করে দেওয়া’/ ‘নৈতিক শিক্ষা ধর্মের ভিত্তিতে না হওয়া’ স্যাকুলারিজমের এই সংজ্ঞাগুলোও ঠিক থাকবে না।
কারণ কালপরিক্রমায় স্যাকুলারিজমের অর্থেও প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। শব্দটি এখন আর রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে আলাদা করার সাথেই সীমাবদ্ধ না। বরং বরং তার অর্থ আরও বিস্তৃত, আরও সংগঠিত, আরও পরিপাটি হয়েছে। সুতরাং পুরোনো দৃষ্টিভঙ্গি ঝেড়ে ফেলে ধর্মনিরপেক্ষতার দিকে এখন নতুন দৃষ্টিতে তাকাতে হবে। নতুন সংজ্ঞা এবং নতুন অর্থ ও ক্ষেত্র খুঁজে বের করতে হবে।
দুটি কারণে মূলত আল মাসিরী ধর্মনিরপেক্ষতার দিকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাকিয়েছেন। আসলে তাকাতে বাধ্য হয়েছেন।
ক) ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্টের আশ্রয়েই ধর্মনিরপেক্ষতার জন্ম। কিন্তু এই এনলাইটেনমেন্টের আলোয় জন্ম নেয়া ধর্মনিরপেক্ষতা মানুষের মনে এবং প্রাত্যহিক জীবনে শান্তির বদলে আরও অস্থিরতা তৈরী করেছে। স্যাকুলারাইজেশন প্রক্রিয়ার অধীনে আস্থার সংকট, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, নন-আদর্শিক মূল্যবোধ-সহ আরও অনেক জিনিস মানুষের দুর্দশা কেবল বাড়িয়েছে, কমায়নি। কারণ এখানে সেবার চেয়ে স্বার্থটা বেশি।
খ) ম্যক্স হর্কিহিমার ‘এনলাইটেনমেন্ট বিতর্ক’ বইয়ে বলেছেন, এনলাইটেনমেন্ট এটা একটা জ্ঞানীয় বৃত্তের বাইরে গিয়ে একটা মতাদর্শে পরিণত হয়েছে। যেই মতাদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করেছে মেকি অভিনয়ের সিনেমা, রেডিও এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রোগ্রাম। এই বিষয়টি মাসিরীকে সন্দেহবাতিক করে তুলেছে—ধর্মনিরপেক্ষতা হলো যা ধর্ম নিরপেক্ষ হবে। কিন্তু এনলাইটেনমেন্টের তৈরী এই ধর্মনিরপেক্ষতা তো রাজনীতি থেকে ধর্মকে আলাদাই করে দিচ্ছে। এ যেন আরেক স্বৈরাচার। ধর্মহীন মানুষের ধর্মবাসনা।
এই বিষয়গুলোর কারণেই মূলত আল মাসিরী ধর্মনিরপেক্ষতার নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন। নতুন এক প্রস্তাব রেখেছেন পুরো বিশ্বের সামনে।
ধর্মনিরপেক্ষতার প্রকার
স্যাকুলারিজম অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতার শুধু ব্যাপকতা নিয়ে আলোচনা করেননি আল মাসিরী, বরং ধর্মনিরপেক্ষতার ভাগ ও পুনঃনামকরণ করেছেন তিনি। অর্থের ব্যাপকতার কারণেই তিনি এই ভাগ করেছেন।
ধর্মনিরপেক্ষতার দুটো ভাগ করেছেন তিনি। ১. আংশিক ধর্মনিরপেক্ষতা। ২. পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষতা। ‘রাষ্ট্র কিংবা অর্থনীতি থেকে ধর্মকে আলাদা করা’ হলো আংশিক ধর্মনিরপেক্ষতা। আর পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষতায় জড়িয়ে আছে একটি মানুষের পুরো লাইফস্টাইল। অর্থাৎ শুধু রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে নয়, বরং ব্যক্তিগত জীবনেও যদি ধর্মের আইনকে উপেক্ষা করে, চারিত্রিক পবিত্রতা নষ্ট করে, তাকেই পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষতার কাতারে ফেলা হবে। যেমন কেউ আমেরিকান মুভি দেখে, ডেশিং টি শার্ট পরে, যৌন উদ্দীপক বিজ্ঞাপন দেখে, এমনকি পর্ণগ্রাফির বিজ্ঞাপনও যদি দেখে, সেই প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ বা পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ।
সুতরাং ধর্মনিরপেক্ষতা কেবল রাজনীতি ও অর্থনীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর পাশাপাশি ব্যক্তি জীবনে হস্তক্ষেপ করাও এর এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্র এত বিশাল ও বিপুল হয়ে উঠেছে যে, রাষ্ট্র থেকে ধর্মীয় বিশ্বাস পৃথক রাখা দূরে থাক, এখন ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্রকে আলাদা করা যাচ্ছে না। ব্যক্তি চাইলেও স্বাধীনভাবে ধর্মবিশ্বাস পালন করতে পারছে না। যেমন কিছু কিছু ব্যবস্থা বস্তুবাদী সেকুলার দার্শনিক কাঠামোতেই গড়ে ওঠে, যাকে নাস্তিক্যবাদ বলা যায়। দৃষ্টান্ত হিসেবে জার্মানির নাৎসি শাসনব্যবস্থা, ইতালির ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা এবং রাশিয়ায় স্টালিনবাদী শাসনব্যবস্থার কথা বলা যায়।
এজন্যই আল মাসিরী দুটো ভাগ করেছেন। প্রথম ভাগে রেখেছেন ধর্মনিরপেক্ষতার পুরোনো অর্থ। অর্থাৎ রাজনীতি ও অর্থনীতি থেকে ধর্মকে আলাদা করা। দ্বিতীয় ভাগে রেখেছেন তার নতুন প্রস্তাবকে। এখানে তিনি দেখিয়েছেন, ধর্মনিরপেক্ষতা কেবল রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ না, বরং ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি আচরণের সঙ্গেই এটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
ইসলামপন্থী এবং ধর্মনিরপেক্ষদের সমালোচনা
কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার এই দিকটি একজন ইসলামি লোক যেমন জানে না, তেমনি একজন ধর্মনিরপেক্ষ লোকও জানে না। দুদল ধর্মনিরপেক্ষতাকে একই অর্থে দেখে; সেই পুরোনো অর্থ, পুরোনো সংজ্ঞা। ইসলামিরা ভাবে, ধর্মনিরপেক্ষতা ইসলামের বিরোধী। ধর্মনিরপেক্ষরা ভাবে, ধর্মনিরপেক্ষতাই গণতন্ত্র, উন্নতি ও সমৃদ্ধির মাধ্যম। এই দুদলের পুরোনো দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়ে আল মাসিরী তৃতীয় একটি দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণ করেছেন। আর তা হলো—ধর্মনিরপেক্ষতা কেবল রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং রাজনীতির বাইরেও যাবতীয় বিষয়ের সঙ্গে জড়িত আছে। যা তার ব্যক্তিগত জীবনে খুব সুক্ষ্ম প্রভাব ফেলে। যেমন পর্ণ দেখা; এটা রাজনীতির কোনো বিষয় না। কিন্তু তবুও আল মাসিরীর কাছে এটা ধর্মনিরপেক্ষতা। কারণ এটা মানুষের পবিত্রতা নষ্ট করে। মানুষকে বস্তুবাদী, প্রবৃত্তিপূজারী বানিয়ে ফেলে। এতে মানুষ ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডকে নৈতিক বিচারে বিচারের প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে ফেলে।
সমাজবিজ্ঞানীরাও তাদের বইয়ে এই বিষয়টি কখনো উল্লেখ করে না। আংশিক এবং পুরোনো দৃষ্টিভঙ্গিকেই তারা ফুটিয়ে তুলে। এর বাইরে যে আমাদের বিস্তৃত জীবনে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা করছি অজান্তে, তা তারা বরাবরই লুকিয়ে যায়। লুকিয়ে বড় একটি সত্য ঢেকে ফেলার এই প্রচেষ্টা মারাত্মক ভয়ংকর। সত্যটা সামনে না আসার কারণেই ইসলামপন্থীরা মনে করে, ধর্মনিরপেক্ষতার ষড়যন্ত্র কেবল সংবিধান ও সংসদেই সীমাবদ্ধ। অথচ তারা ব্যক্তিগত জীবনেও যে এর শিকার, এই সম্পর্কে উদাসীন।
শেষকথা
আল মাসিরী ধর্মনিরপেক্ষতার নতুন এই দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন, যেন আমরা ধর্মনিরপেক্ষতার ভয়াবহতা সম্পর্কে আরও সচেতন হই। আরও তৎপর এবং সাবধানী হই। তার কাছে রাষ্ট্র থেকে ধর্ম আলাদা করার ঘোষণার নামই কেবল ধর্মনিরপেক্ষতা নয়। বরং কখনো এমন হতে পারে একটি সংগঠনের নাম ইসলামি। কিন্তু দেখা গেলো সংগঠনের কাজ ও কর্মীদের অধিকাংশই ধর্মনিরপেক্ষ। কখনো এমন হতে পারে একটি সংগঠনের নাম অনৈসলামি। কিন্তু সংগঠনের কর্মীরা অধিকাংশই ধর্মনিরপেক্ষ নয়। তাই চিন্তার দুয়ার উন্মুক্ত হওয়ার জন্যই আল মাসিরীর বিকল্প এই চিন্তা।
The post ভারত ও বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার তর্ক: আল মাসিরীর বিকল্প প্রস্তাব appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%ad%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a6%a4-%e0%a6%93-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6%e0%a7%87-%e0%a6%a7%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ae%e0%a6%a8%e0%a6%bf%e0%a6%b0-2/
No comments:
Post a Comment