রাকিবুল হাসান:
২০১১ সালে মরক্কোর সংসদীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ইসলামি দাওয়াতি আন্দোলন ‘আত-তাওহিদ ওয়াল ইসলাহ’ থেকে জন্ম নেয় ‘জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি’। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে সরকার গঠনের সুযোগ পায় দলটি। ২০১৩ সাল পর্যন্ত এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন দলটির সেক্রেটারি আবদেল ইলাহ বেনকেরান। ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রীত্ব অর্পণ করা হয় সাদুদ্দিন উসমানির হাতে।
মরক্কোয় জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির এই বিজয়কে অনেকেই ইসলামি রাজনীতির বিজয় হিসেবে দেখছেন। কেননা মরক্কোর ইসলামি আন্দোলনের ইতিহাসে এই প্রথম তারা সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করেছে।
রাজনীতির চাদর গায়ে জড়িয়ে ইসলামি দাওয়াতি আন্দোলনের এই অর্জনকে অনেকে বিজয় বলে অভিহিত করলেও মরক্কোর প্রসিদ্ধ আলেম ড. ফরিদ আনসারী এটিকে পরাজয় হিসেবেই দেখেছেন। তিনি বলেন, রাজনৈতিক সফলতা এবং পত্রিকার বয়ান দেখে সবাই ভাবছে ইসলামি রাজনীতি মরক্কোয় আগের চেয়েও আজ ভালো অবস্থানে আছে। অথচ বিষয়টি এমন নয়। বরং আগের চেয়ে আরও পিছিয়ে পড়েছে। ইসলামি দাওয়াতি আন্দোলনে ইসলামের সবকিছু নিয়ে কাজ করার প্রতিশ্রুতি ছিল। যেমন—সংস্কৃতি, সমাজ, অর্থনীতি, মিডিয়া, ব্যবসা, রাজনীতি। কিন্তু এই রাজনীতির সংস্পর্শে এসে এই আন্দোলন এখন রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। এখন রাজনীতিটাই মুখ্য, বাকি সব গৌণ। আন্দোলনের কর্মীরা মনে করছেন, আগে ক্ষমতায় যেতে হবে, রাষ্ট্র কায়েম করতে হবে, তারপর অন্যকিছু। রাজনীতি ছাড়া বাকিগুলোকে এতটাই গৌণ করে দিয়েছে, ওগুলো এখন আর তাদের মনোযোগ টানে না। আগে আন্দোলন দৃঢ় বিশ্বাস ও ইয়াকিনের সাথে কাজ করত। এখন কাজ করে দোদুল্যমান হয়ে এবং সন্দেহ নিয়ে। সবসময় তৎপর থাকতে হয় ক্ষমতা অক্ষুণ্ন রাখার প্রয়াসে। এখানেই ইসলামি দাওয়াতি আন্দোলনের পরাজয়। বড় একটি স্বপ্ন ছোট হতে হতে মিশে যাওয়ার উপক্রম।
ইসলামি দাওয়াতি আন্দোলনের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়া নিয়ে যেহেতু বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তাই মরক্কোয় ইসলামি আন্দোলনের উৎসটা একটু জানা দরকার। তাহলে স্পষ্ট হবে কোন পরিস্থিতিতে এবং কিভাবে ও কেন জন্ম ইসলামি আন্দোলনের।
মরক্কোয় ইসলামি আন্দোলনের বিকাশ
গত শতকের ষাটের দশকের শুরুতে যুবকদের মননে মার্কসবাদী চিন্তার জোয়ার বইছিল। ড. আহমাদ রাইসুনি বলেন, ‘এই সময়টা আমি প্রত্যক্ষ করেছি। ১৯৭৩ সালে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, তখন সেখানে ধর্মতত্ত্বের বিষয় হিসেবে ছিল শুধু মার্কসবাদ ও নাস্তিক্যবাদ। ইসলামি ধর্মতত্ত্ব নিয়ে যারা পড়ত বা এই মনোভাব লালন করত, তাদের অনেক সংকট ও সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হতো।’
তবে এই সময়ে কয়েকজন প্রসিদ্ধ ইসলামি ব্যক্তিত্ব অবশ্যই ছিলেন। যেমন—মরক্কোর মুহাদ্দিস আবু শোয়াইব দাক্কালি, মুহাম্মদ বিন আরাবি আলাভি, শায়খ মুহাম্মদ তকিউদ্দিন হেলালি। কিন্তু তাদের কার্যক্রম কেবল ইলমি পরিমণ্ডলেই সীমাবদ্ধ ছিল। আন্দোলন গড়ে তোলায় বিশেষ পরিকল্পনা ছিল না তাদের।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তখন ইসলামি এবং মার্কসবাদী ছাত্রদের মধ্যে বৈরী মনোভাব তৈরি হয়। মার্কসবাদ এবং নাস্তিক্যবাদের চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় তখন ইসলামি মনোভাবাপন্ন ছাত্রদের একটি সংঘ ও সংগঠনের প্রয়োজন দেখা দেয়। প্রয়োজনটা প্রাকৃতিক নয়, বরং মার্কসবাদের সঙ্গে লড়াই করার জন্য। কিন্তু মার্কসবাদের বিরুদ্ধে কোনো শক্তি তখনো প্রস্তুত হয়নি। তাই প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে সেই ষাটের দশকের শুরুতে ইসলামি ভাবধারার ছাত্ররা অন্যান্য ছাত্রদের ইসলামি শিক্ষার প্রতি দাওয়াত দিতে শুরু করে।
ঠিক সেই সময়ে, ১৯৬৪ সালে তাবলিগ জামাতের একজন আমির শায়েখ হামদাভি মরক্কোয় তাবলিগ জামাতের একটি শাখা প্রতিষ্ঠা করেন। এবং তিনি হন তার প্রধান। এরপর থেকেই দলে দলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাবলিগ জামাতে শরিক হতে থাকে। এই তাবলিগ জামাতটিই ছিল মরক্কোয় ইসলামি আন্দোলনের সূতিকাগার। আহমদ রাইসুনি বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে ইসলামি অন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছি তাবলিগ জামাতের কল্যাণে।’ ফরিদ আনসারীর বয়ান অনুসারে মার্কসবাদীরা তখন তাবলিগ জামাতের এই সরগরম কার্যক্রম দেখে বিস্মিত হয়ে পড়েছিল। তাবলিগ জামাতে যুক্ত হওয়া এই ছাত্ররাই ছিল মার্কসবাদী ধারার বিরুদ্ধে প্রথম চ্যালেঞ্জ গ্রহণকারী।
ফরিদ আনসারী বলেন, ‘১৯৮১ সালে যখন আমি মরক্কোর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হই, তখন নাস্তিকতার ঢেউ বইছে চারদিকে। ইসলামি ভাবধারার ছাত্র এতটাই কম, তারা সবসময় ভয়ে চুপসে থাকত। মার্কসবাদ ছিল সর্বেসর্বা। সত্তরের দশকের শেষদিকে যখন ইসলামি ভাবধারার ছাত্ররা ক্যাম্পাসে আজান দেয়ার উদ্যোগ নেয়, তখন মার্কসবাদী এবং নাস্তিকরা হামলে পড়েছিল তাদের ওপর।’
১৯৬৯ সালে মসজিদুল আকসায় আগুন দেয়ার প্রতিক্রিয়ায় সত্তরের দশকের শুরুতে মরক্কোর রাবাত শহরে অনুষ্ঠিত হয় সর্বপ্রথম ইসলামি সম্মেলন। এই সম্মেলনের পরেই ইসলামি কাজের জন্য বিভিন্ন নামে বিভিন্ন সমিতি, সংগঠন তৈরি হয়। এদের মধ্যে আহমদ রাইসুনির নেতৃত্বে ‘ইসলামিক সোসাইটি’, আবদুল করিম মুতির নেতৃত্বে ‘যুব সমিতি’ অন্যতম। এ সময় উস্তাদ আবদুল করিম মুতি, ড. শাহেদ বুশাইখি, ড. আবদুস সালাম হাররাস-সহ এমন আরও অনেক ইসলামি আন্দোলনের নেতার উন্মেষ ঘটে। একসময় এই বিভক্ত দলগুলো নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামি দাওয়াতি আন্দোলন ‘আত-তাহরিক ওয়াল ইসলাহ’। এই দল থেকে পরবর্তীতে জন্ম নেয় ‘জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি’। যারা আজ মরক্কোর শাসন ক্ষমতায়।
ইসলামি আন্দোলনে ফরিদ আনসারীর অংশগ্রহণ
ইসলামি আন্দোলনের ইতিহাস পড়ে এতটুকু অবশ্যই জানা যায়, এই আন্দোলন গড়ে ওঠার সময় থেকেই তিনি স্বশরীরে যুক্ত। বলতে গেলে তাঁদের হাতেই গড়ে উঠেছে সব। কিন্তু এই ইসলামি জাগরণ ও ইসলামি আন্দোলনে তিনি কতটুকু বিকশিত হয়েছেন, তিনি তাকে তিনটি পর্বে বিভক্ত করেছেন।
এক. বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার আগে তিনি কেবল ইসলামি আন্দোলনের নামই শুনেছেন। যেহেতু তাঁর জন্ম ১৯৬০ সালে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ভর্তি হন, ছাত্রদের মাঝে এ নিয়ে বিতর্ক, নিন্দা, ডিফেন্স, অ্যাটাক শুনে শুনে তিনি আগ্রহী হয়ে ওঠেন ইসলামি আন্দোলন নামটির সাথে।
দুই. এই পর্বে তিনি ইসলামি আন্দোলনে তিনি সরাসরি যুক্ত হয়ে যান। মার্কসবাদীদের বিরুদ্ধে ইসলামি ভাবধারার ছাত্রদের মুখে মুখে তখন এই শ্লোগান—ইসলাম দীন এবং রাষ্ট্র। কোরআন এবং শাসন। রাজত্ব কেবল আল্লাহর।
এই পর্বের অভিজ্ঞতা শুনাতে গিয়ে তিনি বলেন, এই পর্বে আমি মুমিনের গুণের চেয়ে বেশি উকিলের গুণ অর্জন করেছিলাম। মার্কসবাদ, নাস্তিক্যবাদের মুকাবিলা করছি, রাজনীতি করছি। আমি দেখলাম, আমি মানুষের সঙ্গে বেশি সময় কাটাচ্ছি, আল্লাহর সঙ্গে সময় কাটাচ্ছি না। তখনকার মনোভাব ছিল এমন—আগে রাষ্ট্র কায়েম করি, তারপর অন্যসব। আসলে এই ভাবনাটা কর্মীদের দোষ না, বরং রাজনীতির দোষ। কলুষিত রাজনীতির আবহাওয়ায় তারা এমন ভাবতে বাধ্য হয়।
তিন. এই পর্বে ফরিদ আনসারী একটু নতুন দৃষ্টিতে তাকান ইসলামি আন্দোলনের দিকে। পুনরায় বিচার করতে শুরু করেন ইসলামি আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। তিনি যখন দেখলেন রাজনীতির ছোঁয়ায় ইসলামি আন্দোলন তাদের লক্ষ্য থেকে আপাতত দূরে এসে আরকিছুতে ব্যস্ত, তখন তিনি ইসলামি আন্দোলন ছেড়ে দেন। কোরআন-হাদিসের পাঠ ও পাঠদানে মনোনিবেশ করেন। তাজকিয়া, ইবাদাত এবং ইলম চর্চাকে তিনি ইসলামি রাজনীতির ওপর গুরুত্ব দিতে শুরু করেন।
মরক্কোয় ইসলামি আন্দোলনের সমালোচনায় ফরিদ আনসারীর গ্রন্থ
মরক্কোয় ইসলামি আন্দোলনের সমালোচনায় ফরিদ আনসারী বেশ কয়েকটি গ্রন্থ লিখেছেন। তারমধ্যে চারটি গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিচ্ছি।
১. আল-আখতাউস সিত্তাতু লিল হারাকাতিল ইসলামিয়্যাহ
ফরিদ আনসারী-রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে সবচে কঠোর ভাষায় লেখা এই বইটি। ইসলামি আন্দোলন নিয়ে ইতিপূর্বে কেউ এমন কঠিন ভাষায় লেখার সাহস করেননি। ইসলামি আন্দোলনের সবচে বড় ভুল হিসেবে এতে আখ্যায়িত করা হয়েছে রাজনীতির সঙ্গে সংযুক্তি এবং রাজনৈতিক দল গঠন। তাঁর মতে যে স্বপ্ন দেখেছিল ‘আত-তাওহিদ ওয়াল ইসলাহ’, সে স্বপ্ন রাজনীতির সংস্পর্শে এখন নাই হয়ে যাওয়ার পথে।
ইসলামি আন্দোলনের ছয়টি ভুলের কথা তিনি এই গ্রন্থে বলেছেন। সংক্ষেপে ভুলগুলো হলো—
ক. দলগঠন করা। আনসারী বলেন, বাড়াবাড়ি না হলে আমি বলব, রাজনৈতিক দলগঠন ছিল ইসলামি আন্দোলনের সবচে বড় ভুল।
খ. কোনো বিবেচনা ছাড়াই ট্রেড ইউনিয়নে প্রবেশ করা। কারণ এটি নৈতিক ও ধর্মীয় ভারসাম্য বজায় রাখে শ্রেণিসংগ্রাম ও মার্কসবাদী অর্থনৈতিক চিন্তাধারা অনুসারে।
গ. নেতৃত্বের ব্যক্তিত্বকরণ। এর ফলে দল ইলমি এবং শরিয়তের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পরিচালিত হয় না।
ঘ. দলকে যান্ত্রিক সংস্থায় পরিণত করা।
ঙ. মুসলিম যুব সমিতির প্রতিষ্ঠাতা জনাব আবদুল করিম মুতির মানসিকতা লালন করা। কেননা সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক দিক থেকে ইসলামিক ইস্যু মুকাবিলায় কৌশল এবং প্রতারণার আশ্রয় নেয়ার উপর ভিত্তি করেই এর পথচলা।
চ. সালাফি প্রবণতায় হাম্বলি মাজহাব গ্রহণ করা। তিনি বলেছেন, মাজহাবের পাথর তো সালাফিদের চিন্তাধারাকে চূর্ণ করে দিয়েছে। এরপরও দলটি সালাফি প্রবণতা গ্রহণ করে মরক্কোর মাজহাবি বৈশিষ্ট্যকে অপমান করেছে। কারণ মরক্কোয় মালেকি মাজহাবের কোনো বিশেষ আনুসরণ নেই।
২. আল-ফুজুরুস সিয়াসি ওয়াল হারাকাতুল ইসলামিয়্যাতু বিল মাগরিব
মুসলমি সমাজে চেপে বসা অনৈতিকতা নিয়ে লেখা এই গ্রন্থ। এতে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন ইসলামি আন্দোলন কিভাবে গুরুত্বপূর্ণ গঠনতন্ত্র থেকে সরে গেছে এবং কিভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে পড়েছে।
৩. আল-বয়ান আদ-দাওয়া।
২০০৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে গ্রন্থটি। এটিকে ধরা হয় ‘আল-ফুজুরুস সিয়াসি’র সিক্যুয়েল।
৪. আল-ফাতরিয়্যাহ
ইসলামি আন্দোলন ছেড়ে দেবার পর ফরিদ আনসারীর যেসব অভিজ্ঞতা হয়েছে, যেসব চিন্তার বিনির্মাণ ঘটেছে, তারই একটি সারসংক্ষেপ এই বই। খোলাখুলিভাবে আনসারী বলেছেন, যান্ত্রিক পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে ব্যাপক এবং উন্মুক্ত দাওয়াতের দিকে মনোযোগী হতে হবে।
The post ধর্মীয় রাজনীতি ‘ইসলামের ক্ষতি করছে’, মরক্কোর ফরিদ আনসারীর বিকল্প ব্যাখ্যা appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%a7%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ae%e0%a7%80%e0%a7%9f-%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%a4%e0%a6%bf-%e0%a6%87%e0%a6%b8%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a7%87%e0%a6%b0/
No comments:
Post a Comment