মুসান্না মেহবুব :
বাংলাদেশের ইসলামি ঘরানায় ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা কমবেশি হচ্ছে। কেউ এই মতবাদের ভুল ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে, কেউ-বা একে ‘প্রকারান্তরে ইসলামি মতবাদ’ আখ্যা দিয়ে এর পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন এবং একে ঢালাওভাবে সমর্থন করছেন। আবার উল্লেখযোগ্য একটি অংশ সরাসরি এই মতবাদ সমর্থন না করলেও, মতবাদটির বিভিন্ন রীতি-রেওয়াজ তাঁরা পালন করছেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব রীতি-রেওয়াজকে ইসলামাইজেশনেরও চেষ্টা করছেন। তবে ইসলাম বিষয়ে বিশেষজ্ঞ উলামায়ে কেরাম বরাবরই এই প্রবণতার বিরোধিতা করে আসছেন। তাঁরা ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদকে ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হিসেবেই দেখে থাকেন।
কিন্তু তারপরও বাংলাদেশের প্রচলিত ধারার ইসলামি রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকে ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাপারে অনেকটাই শিথিল। এই শিথিলতা থেকে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন থেকেও দূরে সরে যাচ্ছেন অনেকে। ধর্মনিরপেক্ষতার মতবাদে প্রভাবিত হয়ে ধর্ম ও মতাদর্শের উর্ধ্বে উঠে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা করছে একটি গোষ্ঠী। গত কিছু দিন আগে জামায়াতের দলছুট একজন নেতা এ রকম একটি দল গঠনের নিজস্ব প্রক্রিয়ার কথা জানিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য মহৎ থাকলেও তাঁর এই প্রক্রিয়াটা স্পষ্টতই ধর্মনিরপেক্ষতার চিন্তা থেকে অনুপ্রাণিত, মন্তব্য বিশ্লেষকদের।
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের বিভিন্ন কাজ, কর্মসূচি এবং মতবাদটির তৈরি সম্মানিত স্থানগুলো নিয়েও ইসলামি মহলের রাজনৈতিক ঘরানায় সবিশেষ আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব কর্মসূচি ও সম্মানিত স্থানকে ইসলামিকরণেরও চেষ্টা করা হচ্ছে। গত একুশে ফেব্রুয়ারিতে একটি ইসলামি রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন প্রভাত ফেরিতে শহিদ মিনারে ফুল অর্পণের বদলে কুরআন তেলাওয়াতের আয়োজন করে। কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় তাদের নেতাকর্মীরা শহিদ মিনারের সামনে বসে প্রভাত ফেরিতে কুরআন তেলাওয়াত করে। এ ছাড়া শহিদ মিনারে একই সংগঠনের নেতাকর্মীদের জামাতের সাথে নামাজ আদায়ের একটি ছবিও সেসময় ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়েছিল অনলাইনে। সমালোচকরা বলেন, ওই রাজনৈতিক দলের এসব কর্মসূচি মূলত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের কার্যক্রমকে ইসলামিকরণের নামান্তর, যা মূলত একধরনের হীনমন্যতার পরিচায়ক।
ইসলামি মহলে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের প্রভাব এতোটাই বিস্তৃতি লাভ করেছে যে, কিছুদিন আগে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসার একটি মাহফিলে ধর্মনিরপেক্ষতার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে একজন আলেম কসম খেয়ে বলেন, ধর্মহীনতার নীতি কুফরি মতবাদ, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি কুফরি মতবাদ নয়, বরং এটাই ইসলামি মতবাদ।
তবে তাঁর এ বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেছেন দেশের অনেক ওলামায়ে কেরাম। এ ছাড়া বিজ্ঞ আলেমদের বিভিন্ন বক্তব্য, রচনা ও বয়ানে ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে ইসলামের সম্পর্কীহনতার কথা বারবার আলোচিত হয়েছে এবং হচ্ছে। উচ্চতর ইসলামি আইন ও গবেষণা কেন্দ্র মারকাযুদ দাওয়াহ আল ইসলামিয়া ঢাকা’র মুদীর মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মদ আবদুল্লাহ তাঁর এক বক্তব্যে ধর্মনিরপেক্ষতার আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, ইসলামে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে কিছু নেই। ইসলামের মূল ভিত্তি হল আল্লাহর কালাম কুরআন মজীদ।
তিনি বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মহীনতা সমার্থবোধক। এবং এর সবচেয়ে হালকা ব্যাখ্যাদাতারও দাবি হল, রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডের সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক থাকবে না। যা সুস্পষ্ট কুরআন-সুন্নাহ পরিপন্থী বক্তব্য। (ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধান ও ইসলাম; মাসিক আল কাউসার, ফেব্রুয়ারি, ২০১৪)
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বিষয়ে একই বক্তব্য দেশের শীর্ষস্থানীয় মুফতী মাওলানা মিজানুর রহমান সাঈদেরও। এক আলাপচারিতায় তিনি ফাতেহ টুয়েন্টি ফোরকে বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ আলাদা একটি মতবাদ, ইসলামের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। অনুরূপ এই মতবাদের কার্যক্রমের সঙ্গে ইসলামি রীতিনীতিকে সংশ্লিষ্ট করা উচিত হবে না।
শহিদ মিনারে ফুল অর্পণের বদলে কুরআন তেলাওয়াত ও নামাজ আদায়কে এ দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি বৈধ নয় বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, দেশের শীর্ষস্থানীয় এ মুফতি বলেন, শহিদ বা মৃতব্যক্তির জন্য তাদের কবর জিয়ারতে গিয়ে কুরআন তেলাওয়াত করে সওয়াব রেসানি করা যায়, অথবা ঘরে বসেও করা যায়। এটা ইসলাম সমর্থিত। কিন্তু শহিদ মিনারে গিয়ে, যেখানে শহিদদের কোনো কবর নেই, সম্মান ও স্মরণের জন্য এম্নিতেই একটি স্তম্ব বানিয়ে রাখা হয়েছে, ইসলামের সঙ্গে যার কোনো সাযুজ্য নেই, সেখানে গিয়ে আয়োজন করে শহিদদের স্মরণে কুরআন তেলাওয়াত, এটা ইসলামের দৃষ্টিতে আপত্তিজনক বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে আমার কাছে। কারণ, শহিদ মিনারে গিয়ে শহিদদের স্মরণ করার রেওয়াজ বিধর্মীদের কাছ থেকে এসেছে। আর বিধর্মীদের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ কাজ করা ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী আপত্তিজনক।
মুফতী মিজানুর রহমান সাঈদ আরও বলেন, শহিদ মিনারে ঘটা করে নামাজ আদায়ের ব্যাপারেও একই কথা। এটা বাড়াবাড়ি। শহিদদের স্মরণের জন্য আলাদা স্তম্ভ বা জায়গা নির্দিষ্ট করার রেওয়াজ ইসলামে নেই। একই সঙ্গে সেই নির্দিষ্ট জায়গাকে নামাজ-কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে ইসলামিকিকরণেরও কোনো জরুরত নাই।
ইসলামি মহলে সরাসরি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের পক্ষাবলম্বনকারী লোকজনের সংখ্যা অল্প থাকলেও, এই মতবাদের প্রভাবে প্রভাবিত মানুষের সংখ্যা কম নয় এবং এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বলছেন ইসলাম বিষয়ক লেখক ও আলোচক মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ। ফাতেহ টুয়েন্টি ফোরের সঙ্গে বিশেষ এক আলাপচারিতায় তিনি বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের চর্চা ব্যাপক হবার কারণে এই চর্চায় ইসলামি ঘরানার তরুণ শ্রেণি নিজেদের জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে শরিক হচ্ছেন। আপাতদৃষ্টিতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ভালো যে দিকগুলো, সেগুলোকে তারা ইসলামাইজেশন করছেন, এবং এটাকেই ইসলাম হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন। এই প্রবণতাটা দিন দিন কিন্তু বাড়ছে। বিশেষত তরুণ শ্রেণির মধ্যে।
তরুণ শ্রেণিকে এ থেকে ফেরাতে ইসলাম ও পুঁজিবাদী মতবাদগুলোর মধ্যে পার্থক্য ও সংঘাত বিষয়ে ওলামায়ে কেরামকে আরও স্পষ্ট ও গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা ও বয়ান পেশ করা দরকার বলে মনে করেন মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ। তিনি বলেন, তরুণ শ্রেণির বড় একটি অংশের মধ্যে ইসলামের চর্চা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু পাশ্চাত্য উদ্ভাবিত মতবাদগুলোর বাহ্যিক চাকচিক্যের বেড়াজালে পড়ে তারা নানা ধরনের ভ্রান্তির শিকার হচ্ছে। ওলামায়ে কেরাম এসব চাকচিক্যের ফাঁদগুলো সম্পর্কে এই শ্রেণিকে আরও বেশি করে সচেতন করা সময়ের দাবি।
The post ইসলামি মহলে ধর্মনিরপেক্ষতা: আলেমরা যেভাবে দেখেন appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%87%e0%a6%b8%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a6%bf-%e0%a6%ae%e0%a6%b9%e0%a6%b2%e0%a7%87-%e0%a6%a7%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ae%e0%a6%a8%e0%a6%bf%e0%a6%b0%e0%a6%aa%e0%a7%87%e0%a6%95%e0%a7%8d-2/
No comments:
Post a Comment