আহমাদ সাব্বির :
মহান রবের সাথে বান্দার প্রেম নিবেদনের সর্বোত্তম মৌসুম রমজান মাস৷ রবের নৈকট্য অর্জনের যে অবারিত সুযোগ বান্দা এই মাসে পেয়ে থাকে তা আর অন্য কোনো সময়ে সে পায় না৷ কুরআন অবতরণের মাস এই রমজান৷ রহমাত, বারাকাত ও ক্ষমা লাভের মাস এই রমজান৷ এই মাস আধ্যাত্মিকতার চর্চা ও ইবাদাত বন্দেগীর এক বসন্তকাল৷ আর তাই যুগে যুগে খোদাপ্রেমিকেরা রমজানকে দেখেছেন অন্য চোখে৷ রমজানকে নিয়ে ভাবিত হয়েছেন ভিন্ন ভাবনায়৷ এই মাসকে নিয়ে, এই মাসের কার্য তালিকা নিয়ে, এই মাসের দিন-সপ্তাহ-পক্ষগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে প্রস্তুতি নিয়েছেন বহু সময় নিয়ে; যেমন গুরুত্বপূর্ণ সফরের প্রারম্ভে প্রস্তুত হয় মুসাফির পক্ষাধিককাল পূর্ব থেকে৷
প্রাথমিক যুগের আল্লাহ প্রেমিকদের কথা নাইবা বলি; নিকট অতীতে যে সকল বুজুর্গ ছিলেন তাদের কারও কারও কথা জনা যায়— ঈদের চাঁদ ওঠার পর থেকেই তারা পরবর্তী রমজানের অপেক্ষা শুরু করে দিতেন৷ রমজানুল মুবারক আসতেই তাদের হৃদয়ে যেন ঝড় উঠে যেত৷ তারা প্রায় বছরভর মাসটির অপেক্ষায় প্রতীক্ষার প্রহর গুনতেন৷ আর কেনইবা প্রতীক্ষায় থাকবেন না, এ তো রহমাতে ভরপুর এমন এক মাস বান্দা যে মাসে পূরণ করবার সুযোগ লাভ করে তার মনের তাবৎ বাসনা! এ মাসেরই পূর্ণ সদ্ব্যবহারের পরিণামে তার নসীবে জুটে যেতে পারে স্বয়ং মাওলা! রমজান এলেই তাই তাদের চোখে-মুখে যেন ভেসে উঠতো এই পংক্তিদুটির দ্যূতি—
“মন মাতানো শরাব আজি পিলাও আমায়, বন্ধু সাকী!
এমন ফুলের বসন্তকাল নিত্য কভু আসে নাকি?”
২,
খোদাপ্রেমিক এই কাফেলার একজন ছিলেন শাইখুল হাদীস মাওলানা যাকারিয়া রহমাতুল্লাহি আলাইহি৷
এই মহান মনীষার খানকাহতে রমজানজুড়ে চলতো খোদাপ্রেমের অপার আয়োজন৷ রমজানুল মুবারক আসতেই তাই তাঁর খানকার চিত্র যেত পাল্টে৷ সারা বছর যারা খানকার বাসিন্দা ছিল তারা তো থাকতোই; দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসতো অসংখ্য ভক্ত মুরিদান৷ যেভাবে লোহা ছুটে আসে চুম্বকের আকর্ষণে কিংবা পতঙ্গ ছুটে যায় প্রদীপ পানে৷ মাসব্যাপী খানকাজুড়ে নামাজ, তিলাওয়াত ও অন্যান্য নফল ইবাদাতে সবাই এমনই মুখর থাকতো যেন তাদের জীবনের এই একটি মাত্র কাজ : স্রষ্টার ইবাদাতে মশগুল থাকা, এটা ছাড়া তাদের জীবনের ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য নেই৷ এবং মনে হতো এটাই তাদের জীবনের শেষ রমজান৷ ক্ষমা লাভের জন্য দ্বিতীয় রমজানের দেখা তারা পাবে না আর৷
পরিবেশ এমন হয়ে উঠতো, যে বান্দাই কিছু সময়ের জন্য এসে পড়তো এই পরিবেশে সে বেমালুম ভুলে বসতো পৃথিবী ও পৃথিবীর অন্য তাবৎ আয়োজন৷ মৃত প্রাণ লাভ করতো নব জীবন৷ হতাশাক্লিষ্ট ফিরে পেতো বেঁচে থাকবার আশা৷ বিদ্যুৎ তরঙ্গায়িত হতো যেন প্রাণে প্রাণে৷ আধ্যাত্মিকতার এই মহড়া স্বচক্ষে দেখবার সৌভাগ্য যারই হতো তার মন বলে উঠতো— আল্লাহ প্রেমিকদের এই আধ্যাত্মিক সাধনা, আল্লাহকে আপন করে পাবার এই সকাতর আকুতি, পার্থিব স্বার্থ ও ভোগ বিলাস ভুলে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করবার এমন সম্মিলিত প্রয়াস যতদিন থাকবে পৃথিবীর বুকে ততদিন আর যাই হোক, পৃথিবী ও তার জনপদবাসীর জন্য ধ্বংসের ফায়সালা হতে পারে না৷
৩,
ফার্সী কোনো এক কবি উচ্চারণ করেছিলেন (অনুবাদ)—
“বাগান দেখেই বুঝে নাও, বন্ধু!
বসন্তটি কেমন আমার”
যার খানকার চিত্র ছিল এমন, যা দেখে মৃত প্রাণ উঠতো জেগে স্বয়ং সেই ‘খানকাওয়ালা’র রমজান যাপন কেমন ছিল! না বললেও কল্পনা করে ওঠা তেমন কঠিন কিছু নয়৷ কল্পনাটা আরেকটু সহজ করবার জন্য একটা ছোট্ট গল্প বলি৷ গল্পটি শাইখুল হাদীস নিজে তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন—
হাকীম তৈয়্যব সাহেব রামপুরীর সাথে শাইখুল হাদীসের ছিল পুরাতন খান্দানী সম্পর্ক৷ তারা পারস্পরিক মেলামেশাতেও ছিলেন খুবই আন্তরিক৷ এই রামপুরী সাহেব কোনো এক রমজানে এলেন শাইখুল হাদীসের সাথে দেখা করতে৷ কিন্তু শায়েখের খাদেমেরা কিছুতেই সাক্ষাৎ করতে দিল না৷ তাদের কথা— রমজানের এই চরম ব্যস্ততার সময় হজরতের কথা বলার ফুরসত নেই৷ অনুমতিও নেই কারোর ভেতরে যাবার৷
শাইখুল হাদীস মাওলানা যাকারিয়া রহিমাহুল্লাহর যাপিত জীবন ছিল রুটিনে বাঁধা৷ সময়ানুবর্তিতার এক উজ্জ্বল নমুনা ছিলেন তিনি৷ রমজান এলে রুটিনবদ্ধতা আরও কঠোরভাবে মেনে চলতেন৷ মুহূর্তখানিক সময় রুটিনের বাইরে যেতেন না৷ সেজন্য সাক্ষাতপ্রার্থীদের সাথে এই মাসে দেখা সাক্ষাত করতেন না; আপ্যায়নের ছলে দীর্ঘ সময় সদালাপে থেকে রমজানের মহামহিম সময় হারিয়ে যাবে— এই ছিল তাঁর ভয়৷
সাক্ষাতপ্রার্থীদের জন্য বরাদ্দকৃত সময়ে যখন হাকীম সাহেবের সাথে দেখা হলো তাঁর হাকীম সাহেব কিছুটা অভিমান দেখালেন হয়তবা৷ বললেন—
“ভাইজান! আসসালামু আলাইকুম৷ কথা বলতে চাই না, কেবল এটুকুই বলতে চাই, রমজান আল্লাহ তালার অনুগ্রহে আমাদের ওখানেও আসে৷ কিন্তু এভাবে ‘জ্বরের’ মতো আসে না৷ আসসালামু আলাইকুম৷ আসি তাহলে!”
৪,
বলছিলাম শাইখুল হাদীস যাকারিয়া রহিমাহুল্লাহর রুটিনে বাঁধা জীবনের কথা৷ ১৩৯৫ হিজরীর রমজান মাসের সময়সূচী জানা যায় তাঁর ‘আপবীতী’ থেকে৷ তিনি লিখেছেন—
“মাগরিবের নামাজান্তে আওয়াবীনের নামাজে দুই পারা (তেলাওয়াত)৷ তারপর চা পান৷ ইস্তেনজা ইত্যাদী৷ তারপর রাত আটটা থেকে সাড়ে আটটা পর্যন্ত মজলিস৷ এরই মধ্যে বাইয়াত ও আলাপ আলোচনা৷ ইশা রাত নয়টা থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত৷ তারপর ইয়াসীন খতম ও দুআ৷ তারপর ফাযায়েলে রমজান সোয়া এগারোটা পর্যন্ত৷ বিদায়ী মুসাফাহা সেরে বারোটায় দরোজা বন্ধ৷ তিনটা বাজতেই দরোজা খোলা ও সাহরীর ব্যবস্থা৷ তাহাজ্জুদে দুই পারা (তেলাওয়াত)৷ ফজরের নামাজান্তে সকাল নয়টা পর্যন্ত বিশ্রাম৷ তারপর দেখে দেখে দুইপারা তেলাওয়াত এগারোটা পর্যন্ত৷ দুপুর একটা পর্যন্ত অন্যান্য কাজ৷ জোহরের নামাজান্তে খতমে খাজেগান ও জিকির৷ দুই পারা মুখস্থ শেনানো৷ বাদ আসর উপস্থিত মুসল্লিদের সাথে কিছু মুজাকার৷ (আত্মশুদ্ধিমূলক বয়ান)
শাইখুল ইসলাম মাওলানা যাকারিয়া রহিমাহুল্লাহর অন্যতম খলীফা ছিলেন মাওলানা মুনাওয়ার হোসেন বিহারী মাযাহেরী রহিমাহুল্লা৷ তার বয়ানে শায়েখের রমজানের দিন যাপন নিয়ে আরেকটু বিস্তার জানতে পাই৷ তিনি কথা বলেছেন শায়েখের ১৩৮৫ হিজরীর রমজান যাপন নিয়ে৷ তিনি বলেন—
লোকজন যখন সাহরী খেতে উঠতো হজরত শায়েখ তখন লিপ্ত হতেন নফল নামাজে৷ একেবারে সাহরীর শেষ সময়ে এসে দু একটা ডিম খেতেন আর পান করতেন এক পেয়ালা চা৷ তারপর ফজরের জামাআত পর্যন্ত বালিশে হেলান দিয়ে লোকজনের দিকে মুখ করে বসতেন৷ মেহমানেরা মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকতো তার স্নিগ্ধ কোমল চেহারার দিকে৷ ফজরের পর আরাম করতেন প্রায় নয়টা পর্যন্ত৷ তারপর প্রাত্যহিক কিছু কাজ শেষে দুপুর পর্যন্ত নফল নামাজে লিপ্ত থাকতেন৷ রমজানেও তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ডাক আসতো৷ দুপুরের পর সেগুলো দেখতেন এবং প্রয়োজনীয় পত্রাদির উত্তর লিখতেন জোহর নামাজ পর্যন্ত৷
তারপর নামাজ পড়তেন৷ জোহরের নামাজ পড়েই শুরু করতেন কুরআনুল কারীমের তিলাওয়াত৷ আসর পর্যন্ত তা চলতো৷ মেহমানদের প্রতি নির্দেশ ছিল এই সময়টাতে কায়োমনোবাক্যে জিকিরে মশগুল থাকার৷ আসরের পূর্ব পর্যন্ত এভাবেই চলতো৷ কেউ জিকিরে ব্যস্ত থাকতো আর কেউবা সময় কাটাতো কোরআনুল কারীমের তেলাওয়াতে৷ আসরের নামাজের পর হজরত নিজে কুরআন শরীফ শোনাতেন৷ অধিকাংশ মেহমান হজরতের তেলাওয়াত শুনতেন আর কিছু মগ্ন থাকতেন নিজেদের আমলে৷ এভাবে চলতো ইফতারের সামান্য সময় পূর্ব পর্যন্ত৷ ইফতারের যখন কিছু সময় বাকী তখন শায়েখ নিশ্চুপ মুরাকাবায় বসতেন৷ ধ্যানমগ্ন হয়ে কাটাতেন সময়টুকু৷
মেহমানদের প্রতি নির্দেশ থাকতো মসজিদের আঙিনায় বিছানো দস্তরখানে চলে যাবার আর তিনি একান্তে বসে থাকতেন পর্দার অন্তরালে৷ আজান কানে ভেসে আসা মাত্র ইফতার করে নিতেন৷ মুখে দিতেন মদীনার খেজুর আর এক পেয়ালা জমজম৷ ব্যস, এতটুকুই৷ মাগরিবের নামাজের পর মেহমানেরা আহারে বসতেন৷ আর শায়েখ দাঁড়িয়ে যেতেন নফল নামাজ আদায়ে৷ তাঁর নামাজ চলতো ইশার নামাজের পূর্বক্ষণ পর্যন্ত৷ এ সময় খাবার বলতে কেবল দু একটি ডিম মুখে দিতেন৷ আর এক পেয়ালা চা৷ এই ডিম-চা ও অনেক অনুরোধের পর খেতে শুরু করেছিলেন৷ আর ভাত-রুটি তো রমজানে মুখেই দিতেন না৷
ইশার আযানের আধঘন্টা পূর্বে পর্দা তুলে দেয়া হতো৷ হজরত মেহমানদের অভিমুখী হয়ে বসতেন৷ দৃৃশ্যটা ছিল মুগ্ধকর৷ সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সাথে মুসাফাহা করতেন; মেহমানদের হাল হাকিকত জিজ্ঞেস করতেন৷ তারপর ইশার আজান হতেই প্রত্যেকে নামাজের প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে যেতেন ইশা ও তারাবির নামাজে৷
রমজানের প্রারম্ভেই বলে রেখেছিলেন— তারাবির পর কিতাব পড়া হবে৷ হজরত নিজেই কিতাব থেকে তা’লীম করতেন৷ বিগত বছরগুলোতে এই সময়টাতে সামান্য নাস্তার ব্যবস্থা ছিল৷ সময়ের অপচয় হয় দেখে এবারে তা বন্ধ করে দিলেন৷ কিতাব পড়া শেষ হওয়া মাত্রই হজরত বলতেন— হজরতরা! এবার যান, সময়ের সদ্ব্যবহার করুন গিয়ে৷ হজরতের কথামতো অধিকাংশই তিলাওয়াত ও নফল ইবাদাতে প্রবৃত্ত হয়ে যেত৷ হজরত নিজেও লিপ্ত হয়ে পড়তেন আপন সাধনায়৷ শেষ রাতের দিকে কিছু সময়ের জন্য চোখ বুজতেন; তবুও সেটা হাদীসে বর্ণিত “আমার চোখই কেবল নিদ্রা যায়, অন্তর নয়” তদ্রুপ৷
৫,
এত বিস্তারিত বিবরণের দ্বারা আমাদের উদ্দেশ্য একজন আল্লাহ প্রেমিকের রমজান যাপনের পূ্র্ণ চিত্রটি আপনাদের সমুখে তুলে ধরা৷ কীভাবে রমজানের প্রতিটি মুহূর্ত তিনি ব্যয়িত করতেন আল্লাহ তাআলার আরও নৈকট্য অর্জনের জন্য৷ এ কারণেই প্রতি রমজানেই তাদের তাকওয়া উত্তোরোত্তর বৃদ্ধি পেতো৷ আর আমাদের অবস্থা বিপরীত৷ আমাদের জীবনেও রমজান আসে৷ কিন্তু তাদের মতো রমজানের সদ্ব্যবহার আমাদের দ্বারা হয়ে ওঠে না৷ ফলে কোনো পরিবর্তন আসেনা আমাদের নির্জীব জীবনে৷ আমাদের মৃত সরোবর আন্দোলিত হয়ে ওঠে না৷ আমরা গেয়ে উঠি না প্রাণবন্ত জীবনের জয়গান৷
মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের সুমতি দান করুন৷ এই রমজান থেকেই শুরু হোক আমাদের পরিকল্পিত রমজান যাপন৷ কে জানে— এটাই জীবনের শেষ রমজান কিনা! হতেও তো পারে !
The post শাইখুল হাদীস মাওলানা যাকারিয়া রহিমাহুল্লাহর রমজান যাপন appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%b6%e0%a6%be%e0%a6%87%e0%a6%96%e0%a7%81%e0%a6%b2-%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%80%e0%a6%b8-%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%93%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%be-%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%95/
No comments:
Post a Comment