Friday, April 24, 2020

ইসলামে রোজা-দর্শন : মুসলিম চিন্তকদের বিশ্লেষণ

আবদুল্লাহিল বাকি : 

রোজার মর্মকথা

মানব গঠনের মাঝে, সৃষ্টিগতভাবে দুটি নির্যাস বিদ্যমান। দেহ ও আত্মা, বাহ্য পদার্থ ও বায়বীয় পদার্থ। দেহ গঠিত হয়েছে মৃত্তিকায়। আর মৃত্তিকায় বিদ্যমান রয়েছে আয়রন, তামা, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেন। আর আত্মা সৃজিত হয়েছে আল্লাহর রূহের ফুৎকারে। বস্তুগত উপাদান ও শাঁসের মাঝে যখন আত্মার অধিষ্ঠান হল, তখন তা আর নিছক বস্তু থাকলো না। পরিণত হল বিশ্বের আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা জীবে।

দেহ ও আত্মা– উভয়েরই রয়েছে আপন গঠনানুযায়ী মৌলিক কিছু চাহিদা। মানবদেহেরও রয়েছে অন্যান্য প্রাণীর দেহের মত কিছু বৈশিষ্ট্য ও চাহিদা। বৃদ্ধি-হ্রাস, শক্তি-দুর্বলতা, গ্রহণ-বর্জন– তার মৌলিক কিছু বৈশিষ্ট্য। আপন গঠন ও বৈশিষ্ট্য ধরে রাখার জন্য তার জন্য প্রয়োজন কিছু ভিত্তিমূলের, যার উপর সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। অর্থাৎ খাদ্য, বস্ত্র ও নিরাপদ বাসস্থান। কিন্তু আত্মা স্বভাবগতভাবেই কোন বস্তুগত উপাদানের মুখাপেক্ষী নয়। সে সম্মান-মর্যাদা, পূর্ণতার গুণাবলী, বস্তু-প্রকৃতির বাইরের রহস্য, আল্লাহর গূঢ়তত্ত্ব অনুধাবনে আগ্রহী।

আত্মা সর্বদা স্বভাবগতভাবেই পূর্ণতা, উচ্চতা, মানব অভিজ্ঞতায় চূড়ায় পৌঁছতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু… অধিকাংশ মানুষ আত্মার অসীম যাত্রায় পিছিয়ে পড়ে। তার লক্ষ্যের পাদুকা আটকে যায় কামনার কর্দমায়। উড়ন্তমুখর রূহকে বেধে ফেলে প্রবৃত্তির বিছানো জাল।

দেহ ও আত্মার পারস্পারিক সম্পর্ক হলো তুলাদণ্ডের দুই পাল্লার মত। এক পাল্লা যখন ভারি হয়ে উঠবে তখন আবশ্যিকভাবেই আরেকপাল্লা নেতিয়ে পড়বে। তেমনিভাবে মানুষ যখন প্রবৃত্তিপ্রবণ, বস্তুতান্ত্রিক ও ভোগবাদ-সর্বস্ব হয়ে উঠে, তখন আত্মা কৃশকায় হয়ে যায়। হৃদয়ের গুণাবলী তখন ঔজ্জ্বল্য হারায়। কিছু মানুষ আবার ক্লান্তিহীন আত্মার পরিচর্যা করতে করতে দেহের শক্তি হারায়। মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে যায়।

উভয়ই ডুবে রয়েছে ভুলের মাঝে। দেহ ও আত্মার পারস্পারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রয়োজন ভারসাম্য ও সামঞ্জস্যের। যে সার্বক্ষণিক আপন দেহের পূজায় নিমগ্ন থেকে প্রবৃত্তিকে ফুলে ফেঁপে উঠার সুযোগ দিচ্ছে, সে ক্রমশ একটা পশুর কাছাকাছি চলে যাচ্ছে। গলা চিপে মেরে ফেলছে নিজের মনুষত্যের অঙ্গীকার। আর আত্মাকে দমন করার পেছনে যার সকল প্রচেষ্টা ব্যয়িত হচ্ছে, তার দেহের অধিকার আদায়ে ঘাটতি থাকবে– এটাই স্বাভাবিক। পৃথিবীতে আল্লাহর যে সার্বজনীন নিয়ম শৃংখলা বিদ্যমান– তার আত্মিক সাধনা এর লংঘন হিসেবে বিবেচিত হবে। এজন্য দেহ ও আত্মা– উভয়েরই হক ও অধিকার সমানভাবে আদায় করা ইসলামের দর্শন।

ইসলাম যেহেতু দেহ ও আত্মার অধিকার ও ব্যবস্থাপনায় সমতা চায়, তাই আমাদের জীবনের জন্য এমন বিধি-বিধান প্রদান করেছে, যাতে দুই দিকেরই নিক্তি সমান থাকে। দেহের অধিকার আদায়ের জন্য এর যে সকল মানবিক চাহিদা রয়েছে, তা পূরণের জন্য আদেশ দিয়েছে। সাথে সাথে আত্মিক সুস্থতা রক্ষা ও অধিকার আদায়ের জন্য আদেশ দিয়েছেন বেশ কিছু এবাদত আরাধনার। তার মধ্যে অন্যতম হলো রোজা। ইসলাম যে পঞ্চস্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে, তার মধ্যে রোজা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি।

প্রত্যেক বছর রমজান মাসে সকল সুস্থ সবল প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানের উপর আল্লাহ রোজা রাখা ফরজ করেছেন। কোন উদ্দেশ্য সামনে রেখে করেছেন, তা আমাদের জ্ঞানের অতীত। এর মধ্যে বিশ্বাসী মুসলমানগণ যদি কোন উদ্দেশ্য বা উপকার-উপযোগিতা বুঝতে নাও পারে, তবুও রোজা রাখা তার উপর আবশ্যকীয়। এক্ষেত্রে কোন ছাড় নেই। অর্থাৎ কেবলমাত্র আল্লাহর আদেশের দরুণই আমরা রোজা রাখতে বাধ্য।

কিন্তু ইসলাম যেহেতু যুক্তি ও উক্তির মাঝে সমন্বয়কারী ধর্ম, তাই মানুষের স্বার্থ ও উপকারের উদ্দেশ্য ব্যতীত কোন আদেশ সে মানুষকে প্রদান করে না। সকল বিধি বিধানের পেছনে একটা মহৎ উদ্দেশ্য লুকায়িত। অনেক ক্ষেত্রে কোরান ও হাদিসে বিভিন্ন হুকুম আহকাম বর্ণনার সময় তার ফায়দা উল্লেখ করা হয়েছে, যেন দুর্বল বান্দা বিধি বিধান পালনে আগ্রহ বোধ করে। মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিকগণও আল্লাহ-প্রদত্ত জ্ঞানের আলোকে বিভিন্ন বিধি বিধানের উপযোগিতা ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করার প্রয়াস চালিয়েছেন। উদ্দেশ্য ছিল, মুসলমানদেরকে বিধি বিধান পালনে আগ্রহী করে তোলা আর অবিশ্বাসীদের মনে বিশ্বাসের আলো মেলে ধরা।

বিভিন্ন বিধি বিধানের উদ্দেশ্য বর্ণনার ক্ষেত্রে অনেকে প্রান্তিকতার সম্মুখীন হয়েছেন। ইসলামের মৌলিক ও সামগ্রিক ধারণার বাইরে গিয়ে তারা উদ্দেশ্যের ব্যাখ্যা করেছেন। এতে ভুল বোঝাবুঝির সংকট তৈরি হয়েছে। মূলধারার আলেমগণ সাধারণত ইসলামের সামগ্রিক দিক, মৌলিক রূহ ও মেজায রক্ষা করেই উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন।

সালাফ বলতে আমরা পারিভাষিক অর্থে যাদেরকে বুঝি, অর্থাৎ- সাহাবা, তাবেঈন, তাবে’ তাবেঈন– তারা কখনোই শরীয়ার বিভিন্ন হুকুম আহকামের উদ্দেশ্য ও উপযোগিতা বর্ণনা করতে অতি আগ্রহী হননি। তারা এটাকে অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণে আশংকাজনক বিষয় হিসেবে দেখেছেন।

কিন্তু পরবর্তীতে ইসলামের বিশ্বাস ও বিধি বিধানের উপর যিন্দিক, নাস্তিক ও গ্রীকপন্থী দার্শনিকদের হামলার কারণে এপথে এগুতে বাধ্য হয়েছেন পরবর্তী মুসলিম আলেমগণ। বিশ্বাসের উত্তর প্রদান ও উপযোগিতা বর্ণনার জন্য ইলমে কালামের অস্তিত্ব হলো। আর বিধি বিধানের উদ্দেশ্য বর্ণনার জন্য গঠিত হল ‘মাকাসিদুশ শারিয়া’।

সে যুগে যিন্দিকদের মুখ বন্ধ করার জন্য যেভাবে আলেমগণ লিখে গিয়েছেন। তেমনিভাবে বর্তমান যুগেও পাশ্চাত্য শিক্ষিত সংশয়বাদী শ্রেণীকে আশ্বস্ত করার জন্য আধুনিক মুসলিম তাত্ত্বিকগণও কলম ধরার প্রয়োজন বোধ করেছেন। ইসলামের রোজা-দর্শন বুঝতে হলে তাদের বিশ্লেষণের দিকে ফিরে তাকানো জরুরী।

ইমাম গাজ্জালীর বিশ্লেষণ

ইমাম আবু হামেদ আল গাজ্জালী (১০৫৮-১১১১ ঈ.) তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ইহয়াউল উলুম’-এ লিখেছেন,

“রোজার স্তর তিনটি। ১. সর্বসাধারণের রোজা। এতে উদর ও গোপনাঙ্গের নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকতে হয়। ২. বিশিষ্ট আল্লাহর বান্দাদের রোজা। আর তা হল– কান, চোখ, মুখ, হাত, পা-সহ অন্যান্য সকল অঙ্গকে পাপ থেকে দূরে রাখা। ৩. আল্লাহর অতি নিকটস্থ বান্দাদের রোজা। আর তা হল, অন্তরকে সকল মন্দ গুণাবলী, পার্থিব চিন্তা, এমনকি আল্লাহ ছাড়া অন্য সকল কিছুর চিন্তা থেকে বাঁচিয়ে রাখা।”

ইমাম গাজ্জালীর বক্তব্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি, রোজার সর্বোচ্চ স্তর ও চূড়ান্ত লক্ষ্য হল– এক কথায় তাকওয়া। দৈহিক রোজাকে অতিক্রম করে মানুষ যখন স্পর্শ করতে পারবে আত্মিক রোজার মহত্বকে, তখন তার রোজার পূর্ণতা ঘটবে।

ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি আরো বলেছেন,

“রোজা পালনের উদ্দেশ্য, যথাসম্ভব আল্লাহর গুণাবলীকে নিজের মাঝে ধারণের প্রচেষ্টা। প্রবৃত্তি থেকে দূরে থাকার ক্ষেত্রে পবিত্র ফেরেশতাদের অনুসরণ করা।

মানুষের স্তর প্রাণীর চেয়ে ঊর্ধ্বে, কারণ বিবেকের আলোয় সে প্রবৃত্তিকে দমন করতে পারে। কিন্তু ফেরেশতাদের স্তরের নীচে, কারণ কখনো কখনো প্রবৃত্তির জাল তাকে বেঁধে ফেলতে পারে। এজন্যই মানুষের মাঝে অনন্তের প্রতিযোগিতা। প্রবৃত্তির মাঝে ডুবে গেলেই সে তলিয়ে যাবে নিকৃষ্ট প্রাণীদের স্তরে। প্রবৃত্তিকে দমন করে যতই ঊর্ধ্বে উঠতে পারবে ততই সে পৌঁছে যাবে ফেরেশতাদের দিগন্তরে।”

হাফেজ ইবনুল কায়্যিমের বিশ্লেষণ

শামসুদ্দিন আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আবি বকর ইবনুল কায়্যিম আল-জাওযিয়াহ (১২৯২ – ১৩৫০ ঈ.) লিখেছেন ‘যাদুল মাআদ’ গ্রন্থে,

“রোজা হল– মুত্তাকী বান্দাদের জন্য মহান মালিকের পক্ষ থেকে আনুগত্যের লাগাম, নফসের বিরুদ্ধে সংগ্রামীদের বেহেশত, পূণ্যবান ব্যক্তিদের উদ্যান। ইসলামে যত ইবাদত বন্দেগী রয়েছে, তার মধ্যে রোজাই কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য। তা আল্লাহ ও তার বান্দার মাঝে গোপন সেতুবন্ধন। কেননা, খানা-পিনা, দৈহিক আমোদ-প্রমোদ ত্যাগ করাটা কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যই। অন্য কারো জন্য নয়। এ ব্যাপারে লুকোচুরি করলে অন্য কোন মানুষ বুঝতেও পারবে না। আর এটাই হল রোজার তাৎপর্য।”

হাফিয ইবনুল কাইয়ুম আরো বলেছেন,

“রোজার উদ্দেশ্য হল, প্রবৃত্তি থেকে নফসকে আবদ্ধ রাখা। প্রিয় জিনিস থেকে হৃদয়কে বারণ করা। যেন প্রবৃত্তিগত শক্তির সংস্কার হয়। মানুষের সামর্থের বাইরে যে সুখ ও সৌভাগ্য তার জন্য অপেক্ষা করছে, সেটার জন্য প্রস্তুত হওয়া। ক্ষুধার্তদের বুভুক্ষার যন্ত্রণা অনুধাবন করতে শেখা। খানাপিনা সীমিতকরণের মাধ্যমে, শিরায় শিরায় শয়তানের চলাচলের ক্ষেত্র সীমিত করা। দেহের বর্ধিত অংশ সংস্কার করা।”

শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর বিশ্লেষণ

শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী রহ (১৭০৩–১৭৬২ ঈ.) তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’তে লিখেছেন,

“প্রত্যেক মানুষের ভিতর ধীরে ধীরে কিছু বিষবাষ্প জন্ম নেয়। জমাটবদ্ধ হতে থাকে। সঠিক সময়ে সুরাহা না করা হলে এর বিরাট আকার ধারণ করে। রোজা হল এই জমাটবদ্ধ বিষের অব্যর্থ মহৌষধ।

মানুষের অন্তরের ভিতর সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম লতিফা রয়েছে। তারমধ্যে ফেরেশতাগুণের সমাহার ঘটায় রোজার সাধনা।”

আবুল হাসান আলী নদভী’র বিশ্লেষণ

বিখ্যাত মুসলিম চিন্তাবিদ ও দায়ী সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী (১৯১৩ – ১৯৯৯ ঈ.) ‘আরকানে আরবাআ’ গ্রন্থে রোজার তাৎপর্য সম্পর্কে লিখেছেন,

“বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে আল্লাহ নবী রাসূল প্রেরণ করেছেন। বস্তুতান্ত্রিকতায় লুটোপুটি খেতে থাকা মানবতাকে রক্ষা করেছেন তারা। ফিরিয়ে এনেছেন আধ্যাত্মিকতা ও নৈতিকতা। প্রবৃত্তির পূজা থেকে মুক্ত করে মানুষের হৃদয়ে দিয়েছেন সুখের অনুভূতি। মানবজীবনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ন‍্যায়ের দাঁড়িপাল্লা। মানুষকে যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে, তার জ‍ন‍্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছেন। আর তা হল ইবাদাত। আর আকাঙ্ক্ষিত পূর্ণতায় পৌঁছনোর জন‍্য দান করেছেন ‘ওলায়াত’। আর পৃথিবীতে মানুষের চূড়ান্ত লক্ষ‍্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন‍্য প্রদান করেছেন ‘খেলাফত’।

আর এই এক স্তরের পর আরেক স্তরে পৌঁছা সম্ভব নয় ফেরেশতাদের আত্মিকতা ও প্রাণীদের ঐহিকতার পথে। এজন‍্যই আদেশ দেয়া হয়েছে রোজার। যেন মানুষ মুক্তি পায় উদরপূর্তির জাগতিকতা থেকে। প্রাণে ফিরে আসে ঐশ্বরিক রুহের ফুৎকারের সঞ্জীবনী, উদ্দীপনা, ঈমানের প্রচন্ড শক্তি। এর মাধ্যমে সে পারবে প্রবৃত্তির যোদ্ধাদের মোকাবেলা করতে।

আল্লাহর আখলাকের ছিটেফোঁটা তার মাঝে চলে আসবে। এর মাধ্যমে সে সৌভাগ্যবান হবে এবং উচ্চ মর্যাদায় সমাসীন হবে। ঊর্ধ্ব জগতের ফেরেশতাদের সাথে তার সম্পর্ক স্থাপিত হবে। এভাবেই সে প্রবেশ করবে এমন এক আনন্দের আলয়ে—খানাপিনা, আমোদ-প্রমোদে যে শান্তি সে কোনদিন খুঁজে পায়নি।”

বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসীর বিশ্লেষণ

তুরস্কের বিখ্যাত সংস্কারক ও ধর্মতাত্ত্বিক বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসী (১৮৭৭ – ১৯৬০) ‘রাসায়েলে নূর’এর ‘মাকতুবাত’ গ্রন্থে রমজান ও রোজা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। সেখানের একটি স্থানে তিনি বলেছেন,

“রমজানের রোজা ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি স্তম্ভ। ইসলামের প্রধানতম একটি বৈশিষ্ট্য।

রমজানের রোজার মাঝে অসংখ্য তাৎপর্য লুকায়িত রয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশই হলো, মহান আল্লাহ তাআলার প্রতিপালন ও রুবুবিয়াত প্রকাশ সম্বন্ধীয়। এছাড়াও রোজার মাঝে আছে মানুষের সামাজিক, ব্যক্তিগত অনেক উপযোগিতা। এর মাধ্যমে নফসের দীক্ষা প্রদান ও সংস্কার সাধন হয়। আল্লাহর নিয়ামতের সামনে শুকরিয়া আদায় করা হয়।

রোজার অসংখ্য হিকমতের মাঝে একটি মাত্র তাৎপর্য উল্লেখ করছি। রোজার মাধ্যমে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের রুবুবিয়াত ও প্রতিপালনের গুণ সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয় মানুষের সামনে।

কারণ— তিনি পৃথিবীর উপরিভাগকে বানিয়েছেন সকল প্রাণীর জন্য অসংখ্য নিয়ামতে পরিপূর্ণ একটি অলৌকিক দস্তরখানা। এর মাধ্যমে তিনি প্রকাশ করেছেন যে, সকল প্রাণীর প্রতিপালন, করুণা প্রদান করেন তিনিই।

কিন্তু মানুষ আপন গাফিলতি ও উদাসীনতার দরুন অনুধাবন করতে পারে না। কখনো বা উপলব্ধি করতে পারলেও তা ভুলে যায় পরক্ষণেই।

কিন্তু রমজান মোবারকের সকল মুমিন যেন একটি সংঘবদ্ধ সৈন্যদলের আকার ধারণ করে। সকলেরই নিয়মানুগ কাজ রয়েছে। আর তা হল আল্লাহর ইবাদত ও দাসত্ব করা। যখনই মাগরিবের আযানের মাধ্যমে আল্লাহর অদৃশ্য আওয়াজ আমাদের কাছে পৌঁছে, ‘এখন তোমরা নেয়ামতের দস্তরখানে বসো’, তখন আমরা অনুধাবন করতে পারি— আমরা সকলে তার নেয়ামত ও রহমতের সম্মানিত মেহমান। সারাটা দিন আল্লাহর সৈনিক হয়ে উপোস যাপন করার উপঢৌকনস্বরূপ আপ্যায়ন যেন এটা।

একটু ভেবে দেখো, যারা কোন ওজর ব্যতীত এই নিয়মাবদ্ধ ইবাদতের মধ্যে অংশীদারিত্ব গ্রহণ করল না, এবং এরপরে আল্লাহর দেয়া উপঢৌকন ফিরিয়ে দিল— তাদের জন্য ‘মানুষ’ নামটি প্রয়োগ করা কি সমীচীন?”

আলিয়া আলী ইজেতবেগোভিচের বিশ্লেষণ

ড. আলিয়া আলি ইজেতবেগোভিচ (১৯২৫ – ২০০৩) ‘Islam between East and West’ গ্রন্থে রোজার হাকিকত সম্পর্কে লিখেছেন,

“কলেমা বিশ্বাসের স্বীকারোক্তি, যার মাধ্যমে ইসলামের দীক্ষা নেওয়া হয়। এখানেও দ্বৈততা কাজ করছে। একদিকে স্বীকারোক্তির মাধ্যমে একটি আধ্যাত্মিক সম্প্রদায়ে যোগদান করা হয়, যার জন্যে কোন সাক্ষীর প্রয়োজন নেই, অপরদিকে সামাজিক রাজনৈতিক সম্প্রদায় হিসেবে ইসলামে দীক্ষা নেওয়া হয় কলেমা পাঠের মাধ্যমে, আনুষ্ঠানিকতা সহকারে। এখান থেকে সুস্পষ্ট হয় যে, নবদীক্ষিত ব্যক্তি শুধু নৈতিক নয়, আইনগত বাধ্যবাধকতার‌ও অধীন।

একই ব্যাপার লক্ষণীয় সিয়াম সিয়াম সাধনার ক্ষেত্রেও। এটা শুধু তাত্ত্বিক আদেশ পালন বা ব্যক্তিগত ধর্মাচরণ নয়, এখানেও সামাজিক অনুষঙ্গ আসছে। একজন দরিদ্র কৃষকের ঘরে যেমন, তেমনি দেশের কর্ণধারের প্রাসাদ, দার্শনিক বা শ্রমিকের ঘরেও সমানভাবে পালিত হচ্ছে সিয়াম।”

মুস্তফা সাদিক রাফেয়ীর বিশ্লেষণ

আরবি ভাষার সমকালীন সময়ের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক, যাকে বলা হয় ‘হুজ্জাতুল আদাবিল আরাবী’— মোস্তফা সাদিক রাফেয়ী (১৮৮০ – ১৯৩৭) ‘ওহিউল কলম’ গ্রন্থের ‘ফালসাফাতুস সিয়াম’ প্রবন্ধে লিখেছেন,

“রোজা অর্থ হল তাকওয়া। রোজার মাধ্যমে মানুষ উদরসর্বস্ব প্রাণীর থেকে পৃথক হয়ে যায়। আর তা না হলে উদরের নিক্তিতে সে দুনিয়ার সবকিছুকে পরিমাপ করে। রোজার মাধ্যমে সমাজ মানুষের পক্ষ থেকে মানবিকতা ও মহানুভবতার উপঢৌকন লাভ করে। এভাবেই সামাজিক নিশ্চয়তা তৈরি হয় মানুষের মাঝে।

তাছাড়া মনোবিজ্ঞানের একটি তত্ত্ব হলো, যন্ত্রণা থেকে মানুষের মনে দয়া জাগ্রত হয়। রোজার ক্ষেত্রে এই তত্ত্বটি অনেক বেশি বাস্তবিক ও সামাজিক। এর মাধ্যমেই মানুষ অন্য দরিদ্রদের দুঃখ বেদনা ও ক্ষুৎপিপাসার যন্ত্রণা অনুধাবন করতে পারে।”

সাইয়েদ কুতুবের বিশ্লেষণ

মিশরের ইসলামী আন্দোলনের অগ্রপথিক ও দায়ী সৈয়দ কুতুব আপন তাফসীরগ্রন্থ ‘ফি যিলালিল কুরআন’-এ লিখেছেন,

“রোজার মৌলিক উদ্দেশ্য হল তাকওয়া ও আল্লাহ ভীতি। তাকওয়া মানুষের মনে জাগ্রত হলে সকল গুনাহ থেকে তাকে দূরে রাখে এবং পুণ্যের কাজে উদ্বুদ্ধ করে। তাকওয়া ব্যতীত কোন কাজে আল্লাহর জন্য করা সম্ভব নয়। তাকওয়ার মাধ্যমেই মানুষ রোজা পালন করে আল্লাহ তাআলার আনুগত্যের স্বীকৃতি দিতে পারে। তাকওয়া ব্যতীত পাপহীন রোজা আদায় করা এক কথায় অসম্ভব।”

মোহাম্মদ কুতুবের বিশ্লেষণ

ইখওয়ানুল মুসলিমিনের একজন গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক মুহাম্মদ কুতুব ‘ফিন-নাফসি ওয়াল মুজতামাঈ’ গ্রন্থে লিখেছেন,

“রোজা বাহ্যিকভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরজ ইবাদত, সন্দেহ নেই। কিন্তু রোজাকে শুধুমাত্র পরকালীন জীবনের সফলতার জন্য আবশ্যিক করা হয়নি। এই পৃথিবীতে তার নিজের স্বার্থ ও অন্যান্যদের স্বার্থ রক্ষার জন্য‌ও আবশ্যিক করা হয়েছে। কেননা, রোজার মাধ্যমে দেহ আত্মা, ছোট বড়, নারী পুরুষ— সকলেরই উপকার হয় একই সাথে। তাছাড়া রোজা হল জিহাদের জন্য বিরাট প্রশিক্ষণ। গরিব-দুঃখীদের জীবন-যাপন অনুধাবন করার একটি প্রশিক্ষণ।”

মুহাম্মদ দাওয়াসের বিশ্লেষণ

মুহাম্মদ দাওয়াস ‘ফালসাফাতুস সিয়াম’ গ্রন্থে লিখেছেন,

“রোজা হল একদিকে একটি মহৎ পরিশোধক যন্ত্র, যা মানুষের অন্তরকে পরিষ্কার করে। এবং অন্যদিকে মানুষকে সামাজিক জীব হিসেবে উন্নতি ঘটায়।”

নাজিব কিলানীর বিশ্লেষণ

মিশরের মুসলিম ঔপন্যাসিক নাজিব কিলানী (১৯৩১ – ১৯৯৫) আস-সাওমু ওয়াস সিহহাতু’ গ্রন্থে লিখেছেন,

“রোজা মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন শাস্তি নয়, নয় মানুষের উদ্দেশ্য পূরণের পথে প্রতিবন্ধক। রোজা হল সুস্থতা, প্রশিক্ষণ ও আনুগত্য। শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার প্রশিক্ষণ। আর যেকোনো সভ্যতার অগ্রগতির জন্য শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা অত্যন্ত জরুরী। পশ্চাত্পদ জাতি ও অগ্রগামী জাতির মাঝে পার্থক্যের মূল হেতু হলো, অগ্রগামী জাতি সর্বদা— জ্ঞান-গবেষণা, আচরণ উচ্চারণ, জীবনযাপন ও বিধিবিধানে, বেশ কিছু নিয়ম কানুনের অনুবর্তিতা বজায় রাখে।

এজন্যই তারা সকলের অগ্রে থাকে এবং অন্যান্যদের নেতৃত্ব দেয়। সামাজিক উন্নয়ন, আর্থিক সমৃদ্ধি সম্ভব হয়।

আর আমাদের সামনে রয়েছে ইসলামী সভ্যতা, যা সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা হলো, আমরা কোরআন সুন্নাহর বাইরে কখনোই অতিক্রম করি না। এরই একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, রমজানে আমাদের রোজা আদায়। আমাদের সভ্যতা সংস্কৃতির অগ্রগতি, ও ব্যক্তিগত জীবনের মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে রোজার গভীর প্রভাব রয়েছে।”

আরো অনেক মুসলিম চিন্তাবিদ, ধর্মতাত্ত্বিক ও দায়ী ইসলামের রোজা দর্শন সম্পর্কে বিভিন্ন মত ও বক্তব্য প্রদান করেছেন। সংক্ষিপ্ত পরিসরে সকলের বক্তব্য এখানে আনা সম্ভব নয়। আগত রমজানে আল্লাহ আমাদের সিয়াম সাধনাকে কবুল করে নিন— এই প্রার্থনা করি। আর রোজার মাঝে যেসব মহৎ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য লুকায়িত রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করার তৌফিক দান করুন।

The post ইসলামে রোজা-দর্শন : মুসলিম চিন্তকদের বিশ্লেষণ appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%87%e0%a6%b8%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a7%87-%e0%a6%b0%e0%a7%8b%e0%a6%9c%e0%a6%be-%e0%a6%a6%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%b6%e0%a6%a8-%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%b8%e0%a6%b2%e0%a6%bf%e0%a6%ae/

No comments:

Post a Comment