Friday, January 21, 2022

মদিনা হুজুর: সংক্ষিপ্ত জীবনী

মাওলাানা আবু বকর:

জন্ম

মাওলানা আব্দুর রব মদীনা হুজুর রহ. ১৯২৯ সালে কুমিল্লা জেলার বরুড়া থানাধীন নলুয়া চাঁদপুর গ্রামে সম্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মুন্সী আব্দুল ফাত্তাহ রহ.। দীর্ঘ একশত দশ বছর বট বৃক্ষের সুশীতল ছায়া হয়ে হুজুরের পিতা বেঁচে ছিলেন। মায়ের স্নেহময় মমতার আঁচল আট বছর বয়সে হারিয়ে ফেলেন তিনি।গ্রামের নির্মল পরিবেশেই বেড়ে উঠেন পিতা-মাতার একমাত্র আদরের দুলাল যুগশ্রেষ্ঠ এই কীর্তিমান মহান মুহাদ্দিস ।

প্রাথমিক শিক্ষা

নয় বছর বয়সে ১৯৩৮ ইং সনে নিজ গ্রামের অদূরে বরুড়া থানার অন্তর্গত রহমতগঞ্জ গ্রামে বাংলার প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি বিদ্যাপীঠ ইহইয়াউল উলুম মাদরাসায় তার শিক্ষা জীবনের সূচনা হয়। আরবী বর্ণমালা আলিফ, বা, তা থেকে জামাতে শরহে বেকায়া পর্যন্ত এখানে পড়েন। তারপর ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি বিদ্যাপীঠ কুমিল্লা জেলার বরুড়া থানাধীন দারুল উলুম বরুড়া মাদরাসায় জলালাইন জামাত পর্যন্ত পড়ে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করেন। এর মাঝে কিছুসময় দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসায় পড়াশুনা করেন। আর তখন থেকেই তিনি নিজ এলাকায় অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ও মান্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। নবীন-প্রবীণ নির্বিশেষে সকলের নিকট পরিচিত হয়ে উঠেন মাওলানা সাহেব নামে।

উচ্চশিক্ষা

তৎকালীন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা সমাপনের পর উচ্চ শিক্ষার জন্য মাত্র ২১ বছর বয়সে ১৯৪৯ ঈসায়ী সন মােতাবেক ১৩৭১ হিজরী সনে ভারতের প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাজাহেরুল উলুম সাহারানপুরে গমন করেন। সেখানে তিনি জামাতে হেদায়া থেকে তাকমীল জামাত পর্যন্ত পড়েন। সেখানে তিনি তার শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করেন ১৯৫২ ঈসায়ী ১৩৭৪ হিজরী সনে।

সাহরানপুরে শিক্ষাকালে তিনি তাঁর উস্তায যুগশ্রেষ্ঠ আলেম, শাইখুল হাদীস জাকারিয়া সাহেব রহ.-এর বিশেষ সান্নিধ্যলাভে ধন্য হন। শায়খ জাকারিয়া রহ.-এর সাথে হুজুরের হৃদয়ের বন্ধন ও হুজুরের প্রতি সুদৃঢ় আস্থা এমন ছিল যে , দাওরায়ে হাদিসে আবু দাউদ পরীক্ষায় নাম্বার কম পাওয়ার কারণে হুজুর খুব ব্যথিত হন এবং অনেক কান্নাকাটি করেন। তখন শায়খুল হাদিস আল্লামা জাকারিয়া রহ. হুজুরকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘তুম আবু দাউদ পারহাউগে।’ যার প্রতিফলনে হুজুর লালবাগে প্রথম থেকেই আবু দাউদ শরীফ কিতাবের দরস দান করেন। হজরত জাকারিয়া রহ. যখন বাংলাদেশে আসেন তখন হুজুরের বাড়িতে মেহমান হিসেবে আতিথ্য গ্রহণ করেন।

বর্ণাঢ্য কর্মজীবন

ইখলাস, ইত্তেবায়ে সুন্নাত আর উস্তাদদের নেকনজরের কল্যানে শিক্ষা জীবনেই তিনি অন্য সবার চেয়ে নিজেকে অনন্য করে তুলেন। যার ফলশ্রুতিতে ফারাগাতের পরই হযরতের প্রিয় উস্তায উপমহাদেশের প্রখ্যাত শাইখুল হাদীস জাকারিয়া সাহেব কান্ধলভী রহ. তাঁকে সাহারানপুর মাদরাসার খেদমতে থেকে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু ইতোমধ্যে দেশ থেকে তাঁর বাবার চিঠি চলে আসায় জাকারিয়া সাহেব কান্ধলভী রহ. তাঁকে দেশে প্রত্যাবর্তনের অনুমতি দেন। আর বলে দেন –
اگر جی چاہے تو پھر آجانا
আগার জী চাহে তাে ফের আ জা না; যদি ইচ্ছে হয় আবার ফিরে এসাে।

অতঃপর তিনি উস্তাদদের দিল উজাড় করা দু’আ আর ভালােবাসার আবেশে জড়ানাে অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় নিয়ে স্বীয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। দেশে ফেরার পর যে ইহইয়াউল উলুম থেকে মদীনার মিরাস ইলমে নববী অর্জনের সূচনা করেছিলেন, সে প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবনের সূচনা করেন। আলােকিত জীবনের আলাে ছড়িয়ে আলােকিত করেন বহু তালিবুল ইলমকে। কিন্তু এই ইলমের মিরাস ও উদ্ভাসিত জীবনের আলাের হকদার যে বাংলার আরাে অগণিত মানুষ। তাই একই প্রতিষ্ঠানে কিংবা একটি এলাকায় জীবন কাটিয়ে দেয়ার সুযােগ হয়নি জাতীয় এ রাহবারের। সময়ের সাথে সাথে জীবনের পট পরিবর্তন করতে হয়েছে। শৈশবে বেড়ে উঠা আর শিক্ষা জীবনের সূচনালগ্নে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করা প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠান ইহইয়াউল উলুমকে বিদায় বলতে হয় সময়ের প্রয়ােজনে। অতঃপর গমন করেন যশােরের রেলষ্টেশন মাদরাসায়। জীবনের কিছু সময় আপন রুহানী ফয়েয ও ফয়যানে এবং ইলমে নববীর মিরাস বন্টনে সৌভাগ্যমণ্ডিত করেন যশােরবাসীকে।

এরপর পুনরায় ফিরে আসেন কুমিল্লায়। তবে এবার রহমতগঞ্জে নয়, এবার যােগদান করেন যুগশ্রেষ্ঠ আরেক মহান সংস্কারক মাওলানা আখতারুজ্জামান রহ. প্রতিষ্ঠিত পাহাড়পুর মাদরাসায়। এই পাহাড়পুরেই তিনি পেয়ে যান তার শিক্ষকতার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র, এই বাংলার বহু সংস্কারমূলক কাজকর্মের তত্ত্বাবধায়ক মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী রহ.-কে। যে ছাত্রের আলােচনায় হুজুর আবেগাপ্লুত হয়ে বলতেন, ‘যদি কেয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে আটকি যাই ,তাইলে আব্দুল হাইরে ধইরা কমু আল্লাহ এইডা আমার ছাত্র।’

ইলমে আমলে আলােকিত এই সেতারার স্নিগ্ধ পরশের প্রয়ােজন ছিলাে বাংলার আরাে বহু অঞ্চলের ও বহু মানুষের। তাই তিনি ছুটে যান সময়ের প্রয়ােজনে বিভিন্ন নগরীতে বিভিন্ন তৃষ্ণাতুর মানুষের কাছে। পাহাড়পুর মাদরাসায় দীর্ঘদিন খেদমতের পর গমন করেন ফরীদপুরের নন্দনশার মাদরাসায়। সেখানে অত্যন্ত সুনাম ও দক্ষতার সাথে দীর্ঘ একযুগের বেশী সময় মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করেন। তারপর গমন করেন চাঁদপুরের মাহামায়া কর্দি মাদরাসায়। এখানে কিছুদিন খেদমত করার পর চলে যান চাঁদপুর আখনের হাট মাদরাসায়। এখানে তিনি দরস তাদরীসের পাশাপাশি দীর্ঘদিন শিক্ষাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন। চাঁদপুরের মাটি ও মানুষের কাছে তিনি নাযেম সাহেব নামে পরিচিতি লাভ করেন। উলামা-ত্বলাবা, ছাত্র -জনতা সকলের নিকট তিনি প্রিয় নাযেম সাহেব নামে বেঁচে আছেন আজ-অব্দি।

হাফেজ্জী হুজুর রহ. যখন জীবন-সন্ধ্যায় উপনীত, তখন হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রহ.-এর মুখে হুজুরের প্রশংসা শুনে তিনি ভাবলেন, চাঁদপুরের নাযেম সাহেবের খেদমতের কিছু অংশের মুখাপেক্ষী দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যাপীঠ জামেয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগের তালিবুল ইলমরাও। হাফেজ্জী হুজুর চিঠি লিখে হুজুরকে লালবাগ জামেয়ায় তাশরীফ আনার জন্য আহ্বান জানালেন। কিন্তু চিরনির্মোহ নিভৃতচারী এই নীরব সাধক তাওয়াযু আর বিনয় দেখিয়ে বড়দের পদচারণা মুখর এই জামেয়ায় আগমন থেকে নিজেকে বিরত রাখেন । কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরও ছাড়বার পাত্র নন। তিনি আবার চিঠি লিখলেন। দ্বিতীয় চিঠিকে হুজুর আর ফিরিয়ে দিতে পারলেন না। তিনি হাফেজ্জী হুজুরের জীবনের শেষ সময়ে ১৯৮৬ সনে চলে এলেন লালবাগ জামেয়ায়।

হুজুর শিক্ষক জীবনের শুরু থেকে আবু দাউদ শরীফের ‘ওয়া বিহী কালা হাদ্দাসানা’র সাথে সাথে পড়িয়েছেন দরসে নেযামীর সব কিতাব। শিক্ষক জীবনের শুরুতে এক উস্তাদের কাছে তিনি বিনয়ের সুরে নিজের আশঙ্কা প্রকাশ করলে তিনি হুজুরকে বলেছিলেন, ‘তুমি যে কিতাব পড়েছে তা পড়াবে এবং যে কিতাব তুমি পড়ােনি তাও পড়াবে।’ তার বাস্তব প্রতিফলন হলো, সারা জীবনই হুজুর পড়িয়েছেন দরসে পড়া না পড়া সকল কিতাবই। ইলমে হাদীস, ইলমে নাহু, ইলমে ফিক্বহ সহ প্রায় সকল বিষয়ে ছিল নিপুণ দখল।

তাসাউফ ও আধ্যাত্মিকতা

আধ্যাত্মিকতার জগতে তিনি ছিলেন একজন প্রবাদপ্রতিম বিরল ব্যক্তিত্ব। অনাড়ম্বর সাদাসিধে নির্মোহ নীরব সাধনার এক নিপুণ বৈশিষ্ট্যে সাজিয়েছেন তিনি জীবনকে। প্রচারবিমুখ এই সাধকপুরুষ তাসাউফের প্রথম সবক গ্রহণ করেছিলেন হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রহমতুল্লাহি আলাইহি এর খলীফা মসীহুল্লাহ খান জালালাবাদী রহ.- এর হাতে । এরপর হারদূঈ হযরত মাওলানা আবরারুল হক সাহেব রহ.-এর খলীফা ফকীহুল মিল্লাত মাওলানা আব্দুর রহমান সাহেব রহ.- এর নিকট থেকে এজাজতপ্রাপ্ত হন। তাসাউফের প্রতিটি স্তরে ছিলাে তাঁর নীরব পদচারণা। আরােহণ করেছেন মাহবুবে হাক্কীকীর প্রেমের ভুবনে।

ইন্তেকাল

বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন অসুস্থতা সত্বেও চলে যাওয়ার দু’দিন আগ পর্যন্ত স্বাভাবিক সুস্থ ছিলেন হুজুর। শেষ দুদিন অসুস্থতা আর দুর্বলতায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। আকারে ইঙ্গিতে প্রকাশ করতে থাকেন চির প্রস্থানের প্রস্তুতি। এরমধ্যে রয়েছে, লালবাগ জামেয়ার যাবতীয় কার্যক্রম হতে অব্যহতি গ্রহণ, জামেয়ার সদরে শূরার দায়িত্ব থেকে ইস্তফা। তবে জামেয়ার উস্তাদদের অনুরােধে শেষপর্যন্ত মাদরাসাতেই থেকে যান। অবশেষে ৭ই জানুয়ারী, ২০২১ খ্রীষ্টাব্দে, জুম’আ রাত ৯টায় সকলকে শােকের সাগরে ভাসিয়ে আল্লাহর নামের জিকির করতে করতে রাব্বে কারীমের সান্নিধ্যে গমন করেন।

The post মদিনা হুজুর: সংক্ষিপ্ত জীবনী appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%ae%e0%a6%a6%e0%a6%bf%e0%a6%a8%e0%a6%be-%e0%a6%b9%e0%a7%81%e0%a6%9c%e0%a7%81%e0%a6%b0-%e0%a6%b8%e0%a6%82%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%b7%e0%a6%bf%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%a4-%e0%a6%9c%e0%a7%80/

No comments:

Post a Comment