Friday, January 21, 2022

মদিনা হুজুর: সুন্নত পালনে আপসহীন অভিযাত্রী

মুহাম্মদ হেলাল উদ্দিন:

বহুগুণে গুণান্বিত মানুষ ছিলেন আমাদের প্রাণপ্রিয় উসতাদ মাওলানা আব্দুর রব রহ. (মদিনা হুজুর)। শত বিপদে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা, ইবাদতের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব নিষ্ঠা, কুরআন তেলাওয়াতের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ, হাদীসে নববীর প্রতি অতুলনীয় ভক্তি, মেহমানদারির বিষয়ে ইবরাহিম আ.-এর অনুসরণ, মাদ্রাসার কানুনের উপর পূর্ণ শ্রদ্ধা, ছাত্রদের প্রতি নিটোল স্নেহ ও ভালবাসা এবং পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর যত্ন ও মনোযোগ সহ ইত্যাদি হরেক রকমের ঈমানী গুণে গুণান্বিত ছিলেন তিনি। এতসব গুণ ভাষায় প্রকাশ করে, কাগজে লিখে শেষ করা অসম্ভব। তবুও পয়েন্ট আকারে হুজুর সম্পর্কে কিছু গুণ তুলে ধরবো।

১. আল্লাহর প্রতি মানুষের কী পরিমাণ আস্থা ও বিশ্বাস বদ্ধমূল থাকে তা অনুমান করা অসম্ভব। তবে মানুষের বাহ্যিক কর্মকাণ্ড দেখে কিছুটা অনুমান করা যায়। হুজুরও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। আমরা দেখেছি, যত বড় বিপদ হোক না কেন, হুজুর কখনো ঘাবড়াতেন না । বরং তিনি আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা রাখতেন। বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য শেষ রাতে নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেন। কখনো বিচলিত হতেন না।

২. নামাজের প্রতি ছিল তার অগাধ ভক্তি ও ভালোবাসা। জামাতের সময় হলেই সঙ্গে সঙ্গে জামাতবদ্ধ হয়ে নামাজ আদায় করে নিতেন। বিশেষ কোন জরুরত ব্যতিত জামাত ছাড়তেন না। জুমাবারে লালবাগ শাহী মসজিদে দশটা ত্রিশ মিনিট থেকে এগারোটার মধ্যেই সবার আগে উপস্থিত হতেন। খতীব সাহেব মিম্বরে বসার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন আমলে মশগুল থাকতেন। যার সাক্ষী শাহী মসজিদের খাদেমগণ সহ অন্যান্য মুসল্লিরা।

৩. দোয়ার বিষয়ে হুজুরকে মুসতাজাবুদ দাওয়াহ মনে করা হয় । এর বাস্তবতাও দেখা গেছে। এর কারণে সর্বদাই হুজুরের রুমে দোয়ার জন্য সাধারণ মানুষের আনাগোনা ছিল চোখে পড়ার মতো।

৪. হুজুর ছিলেন সুন্নতে নববীর প্রকৃত আশেক । সুন্নত ছোট হোক কিংবা বড় , কোনটিই হুজুর অবহেলা করতেন না। সুন্নত ছেড়ে দেয়া হুজুরের পক্ষে ছিল অসম্ভব। হুজুরের সামনে কোনো ছাত্র সুন্নত পরিপন্থী কোনো কাজ করবে, তা ছিল দুঃসাধ্য। বিশেষ করে চুল, দাঁড়ি, জামা-সেলাওয়ার সুন্নত পরিপন্থী দেখলে হুজুরের গোস্বার কোন সীমা থাকতো না।

লালবাগ মাদ্রাসায় প্রতি সপ্তাহে মজলিসে আকাবির অনুষ্ঠিত হয় । প্রতি বুধবার জামিয়ার প্রবীণ কোন মুহাদ্দিস ছাত্রদের উদ্দেশ্যে নসিহত করতেন। মদীনা হুজুর যে নসীহত করতেন, তার সিংহভাগজুড়ে তিনি সুন্নত নিয়ে আলোচনা করতেন। আলোচনায় প্রায় বলতেন, দাঁড়ি খাটো করে চুল বড় (হাত দিয়ে ইঙ্গিত করে বলতেন) রেখে মদীনার নবীর সামনে চেহারা কীভাবে দেখাবি? এসব বলে আহ্ আহ্ শব্দ করে দীর্ঘ সময় ধরে কাঁদতেন।

৫. ছাত্রদের কোন দুঃখ-কষ্ট হুজুর সহ্য করতে পারতেন না। কোন ছাত্র কোন বিপদে পড়লে হুজুর যথাসাধ্য সহযোগিতা করতেন। পাশে থাকতেন। তার জন্য বিশেষ ভাবে দোয়া করতেন।

৬. ছাত্রদের ফারাগাতের পর মাদ্রাসায় খেদমত করাকে সর্বাধিক পছন্দ করতেন। কারো ব্যাপারে যদি শুনতেন, সে মাদ্রাসায় খেদমত করে, তাহলে যারপরনাই খুশি হতেন। দোয়া দিতেন।

এমন একটি ঘটনা আমার আব্বুর সঙ্গে ঘটেছিল। তখন আমার বড় ভাই লালবাগে পড়াশোনা করেন। সেই সুবাদে আব্বু বড় ভাইয়ার (মুফতি সালাহ উদ্দিন। নাজেম ও মুহাদ্দিস জেলা কোর্ট মসজিদ মাদ্রাসা গোপালগঞ্জ) সঙ্গে দেখা করতে এলে হুজুরের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেতন। একদিন সাক্ষাতে আব্বু বললেন, হুজুর, মেয়েকে তো বিয়ে দিয়েছি। হুজুর জানতে চাইলেন,জামাই কী করে? উত্তরে আব্বু বললেন , ইমামতি করে। এ কথা শোনামাত্র হুজুর বললেন, তাহলে মেয়েকে পড়িয়ে কী করলেন? আব্বু হুজুরের কথাটা তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারেননি। একটু পর বুঝতে পেরে তিনি বললেন, হুজুর, জামাই মাদ্রাসায়ও খেদমত করে । তখন হুজুর বললেন, এবার ঠিক আছে।

এর পরই আব্বু আমাদের চার ভাইকে বলে দিয়েছেন, যেভাবেই হোক মাদ্রাসায় খেদমত করতে হবে। হয়েছেও তাই। আলহামদুলিল্লাহ!

৭. মেহমানদারিতে হুজুর ছিলেন উদার হস্ত। কেউ সাক্ষাতে এলে সর্বপ্রথম হুজুর তাকে নাস্তা দিতেন। এরপর কথাবার্তা বলতেন।

৮. আলেম হিসেবে হুজুর কেমন ছিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু এতটুকুই পূর্ণ আস্থার সঙ্গে বলতে পারি, হুজুরের ন্যায় যোগ্য ও মুত্তাকী আলেম বর্তমানে মেলা ভার।তিনি মুহাদ্দিস হিসেবে ছিলেন অসাধারণ। লালবাগে আবু দাউদ শরীফ পুরাটা একাই পড়াতেন। মতবিরোধ পূর্ণ অধ্যায়ের ক্ষেত্রে প্রথমে ইমামগণের দলীল- আদিল্লা আলোচনা করতেন। মাজহাবে হানাফিয়্যাকে দালীলিকভাবে প্রাধান্য দিতেন। এরপর ঐ মাসআলার ব্যাপারে জলীলুল কদর মুহাদ্দিস আল্লামা খলীল আহমদ সাহারানপুরীর মন্তব্য তুলে ধরতেন। সবশেষে ঐ মাসআলার ব্যাপারে নিজের রায় বলতেন। এতটুকু নিশ্চয়ই ইলমে হাদীসের উপর হুজুরের অগাধ পাণ্ডিত্বের পরিচয় বহন করে।

৯. ক্লাসে ছাত্রদের অনুপস্থিত থাকাটা হুজুরের মেজাজের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিলো। কোন ছাত্র অনুপস্থিত থাকলে হুজুর চটে যেতেন। ক্লাসে অনুপস্থিতির ব্যাপারে হুজুর নিজের জীবনের একটা ঘটনা প্রায় বলতেন।

হুজুর বলেন, সাহারানপুরে দাওরা পড়ার সময় এক পরীক্ষার খেয়ারে আমি মুতায়ালার জন্য আবু দাউদ শরীফ নিয়ে জঙ্গলে যাই। যেদিন জঙ্গলে যাই, ঠিক সেদিন শায়খুল হাদীস মাওলানা জাকারিয়া রহ. দাওরার দরসে আসেন এবং হাজিরা ডাকেন। জাকারিয়া রহ. কখনো দরসে হাজিরা নিতেন না। মাদ্রাসায় এসে যখন জানতে পারলাম, শায়খুল হাদীস রহ. দরসে হাজিরা নিয়েছেন, তখন মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো।আমি দরসে কখনো অনুপস্থিত থাকি না। আজকে অনুপস্থিত আর আজকেই হাজিরা! দ্বিতীয়দিন জাকারিয়া রহ. দরসে এলেন। হাজিরায় যখন আমার নাম ডাকলেন, আমি লাব্বাইক বলে উপস্থিতি নিশ্চিত করলাম। তখন জাকারিয়া রহ. আমার দিকে মাথাটা উঁচু করে একবার তাকালেন। কিন্তু কিছুই বললেন না।

এ ঘটনা বর্ণনা করে মদিনা হুজুর বলতেন, এই একদিন দরসে অনুপস্থিত থাকার কারণে আল্লাহর কাছে কত শতবার তাওবা করেছি তার কোন হিসেব নেই। কিন্তু এখনো মনে ইতমীনান হয় না যে, আমাকে আল্লাহ ক্ষমা করেছেন।

আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গেও হুজুরের সম্পর্ক ছিলো সুগভীর। লালবাগ মাদ্রাসার নিয়ম হলো, জামাতে তাইসির থেকে কাফিয়া পর্যন্ত ছাত্ররা ছাত্রাবাসে থাকবে। শরহেজামী থেকে তাকমীল পর্যন্ত লালবাগ শাহী মসজিদের সঙ্গে সংযুক্ত ভবনে। ভাইয়ার কাফিয়া জামাত শেষ হলো। নিয়ম অনুযায়ী বছরের শুরুতে ছাত্রাবাস থেকে বিদায় নিলেন। একদিন হঠাৎ করে মদিনা হুজুর মাদ্রাসার মূল ভবনে আসলেন। ভাইয়াকে ডেকে নিয়ে বাবা হুজুরের (মাওলানা মুজিবুর রহমান র:) কাছে নিয়ে গেলেন। বাবা হুজুরকে বললেন ওকে চিনেন? ওর নাম আবু সালেহ। ওকে দেখে রাখবেন। খেয়াল রাখবেন।

এরপর থেকে বাবা হুজুরের সাথে বড় ভাইয়ার সম্পর্ক দিন দিন বৃদ্ধি পেতে লাগলো। আমি একদিন বাবা হুজুরকে বললাম যে, সালাহউদ্দিন আমার আপন ভাই। একথা শুনে বাবা হুজুর আমাকে নাতি বলে সম্বোধন করলেন। আর বললেন, তাহলেতো তুই আমার নাতি !

আবু দাউদ শরীফের ইবারত প্রায় আমাকে পড়তে হতো। অনেক সময় অস্থির লাগতো। একদিনের ঘটনা। আমি প্রতি বছরই প্রত্যেক জামাতে হুজুরদের সিনা বরাবর বসতাম। এ হিসেবে দাওয়ার বছরেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। একদিন হুজুরের সামনে থেকে আবু দাউদের ইবারত না পড়ার উদ্দেশ্যে তেপায়ার একেবারে কর্ণারে গিয়ে বসলাম। একটু পর লক্ষ্য করলাম, চেহারাটা মলিন করে পলকহীন আমার দিকে তাকিয়ে আছেন । তখন আমার বুঝতে আর বাকি রইল না যে, হুজুর আমার প্রতি রাগ করেছেন। হুজুরের সঙ্গে আমার এই আচরণ প্রায় আমাকে ব্যথিত করে। এ কথা মনে হলে অন্তরটা কাঁপতে থাকে।

আরেকদিনের ঘটনা। হুজুর দরসে আসছেন। মসনদে বসেছেন। আমাকে উঠে বাইরে চলে যেতে দেখে পাশের এক ছাত্রকে বললেন, হেতিরে ধরি নি আয়! হুজুরের একথা শুনে আমি আমার জায়গায় ফিরে আসলাম।

এই দুই ঘটনা দ্বারা আমি পরবর্তীতে বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমার প্রতি হুজুরের আলাদা একটা টান আছে।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবার প্রিয় মদিনা হুজুরের অপরাধগুলো ক্ষমা করে তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। আমীন।

The post মদিনা হুজুর: সুন্নত পালনে আপসহীন অভিযাত্রী appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%ae%e0%a6%a6%e0%a6%bf%e0%a6%a8%e0%a6%be-%e0%a6%b9%e0%a7%81%e0%a6%9c%e0%a7%81%e0%a6%b0-%e0%a6%b8%e0%a7%81%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a8%e0%a6%a4-%e0%a6%aa%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a6%a8%e0%a7%87/

No comments:

Post a Comment