Friday, April 3, 2020

হেফাজত ও তেরো দফা : সরল বোঝাপড়া

ইফতেখার জামিল 

গত দশকে হেফাজতের উত্থান বাংলাদেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এর পর্যালোচনা ছাড়া কোনভাবেই দ্বিতীয় দশককে ব্যাখ্যা করা যাবে না। বিশেষত হেফাজতের উত্থান সমকালীন ইসলাম প্রশ্নের প্রধান উপাদান ও অনুষঙ্গ। তবে হেফাজতের উত্থানের সাত বছর পূর্ণ হতে চললেও এর নানামাত্রিক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ পাওয়া যায় না। এতে একদিকে যেমন অপ্রপচার-অপব্যাখ্যায় বিভ্রান্ত হচ্ছে অনেকে, তেমনি অবহেলায় বিস্মৃতও হচ্ছে সমকালীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইসলামী আন্দোলন।

এই লেখায় আমরা হেফাজতের দার্শনিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক সিলসিলা অনুসন্ধানের চেষ্টা করবো। এই অনুসন্ধানের কেন্দ্রে থাকবে হেফাজতের তেরো দফা। হেফাজত কীভাবে চিন্তা করে, কীভাবে সিদ্ধান্ত ও পর্যালোচনা গ্রহণ করে, তার খোঁজ নেবার চেষ্টা করবো। পাশাপাশি হেফাজতের চিন্তার সিলসিলার সাথে কীভাবে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা সংযুক্ত, সেটাও বুঝার চেষ্টা করবো। তাতে একদিকে যেমন প্রান্তিক-অপব্যাখ্যা থেকে বাঁচা যাবে, তেমনি বাঁচা যাবে অতিশয়োক্তি-অলৌকিক বয়ান থেকেও।

পাকিস্তান : ইসলামী রাষ্ট্রের স্বপ্ন ভঙ্গ

বাংলা অঞ্চলের মুসলমানরা বিপুল আবেগে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্রগঠনের স্বপ্ন দেখলেও তাতে বেশকিছু রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক প্রশ্নের সমাধান হয়নি। কীভাবে শাসক নির্ধারিত হবে, ক্ষমতাসীনদের দায়বদ্ধতা-জবাবদিহিতা কীভাবে নিশ্চিত করা হবে এবং সর্বোপরি কীভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে – এই প্রশ্নগুলোর কোন সরল ও স্বীকৃত সমাধান মুসলিম চিন্তাবিদরা উপস্থাপন করতে পারেননি। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের তেইশ বছরের ইতিহাসে ধারাবাহিক সাংবিধানিক বৈধতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।

যার প্রতিক্রিয়ায় ইসলামী রাষ্ট্র বলতে ঠিক কী বুঝায়, সেটা আরও অস্পষ্ট হয়েছে। এই অস্পষ্টতার পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে মুসলিম পরিচয়ে দেশবিভাগের বিরোধিতাকারী জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থী শক্তি। যারা শুধু সাংবিধানিক বৈধতা ও স্থিতিশীলতাই নয়, এর পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ও দার্শনিক সংস্কারের দাবী তুলেছে। বাংলাদেশের সাধারণ মুসলমানরা এই বাম জাতীয়তাবাদী অংশকে সবসময় ইসলামবিদ্বেষী ও ভারতপন্থী আখ্যা দিয়ে এসেছে। এই অভিযোগ অনেকাংশে সত্য ; এই ধারা কখনোই সাধারণ মুসলমানদের বিশ্বাস অর্জন করতে পারেনি। ইসলাম প্রশ্নের স্বীকৃতি ও সমাধানের চেষ্টা করেনি।

আওয়ামীলীগ এই বাম জাতীয়তাবাদীদের সাথে সম্পর্ক রাখলেও সবসময় জনপ্রিয়তাপন্থী রাজনীতি করেছে। তাই দেখা যায়, সত্তরের নির্বাচনে ইসলাম বিরোধী আইন না করার অঙ্গীকার করা হয়। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পরে সিরাজ শিকদার হত্যা ও জাসদের সাথে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্বপ্নের সমাপ্তি ঘটে। তবে স্বপ্নের সমাপ্তি ঘটলেও আওয়ামীলীগের মধ্যে বাম জাতীয়তাবাদী প্রভাব ও সম্পর্ক সবসময় জারি ছিল। এই দ্বৈততা শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজীবনীর মধ্যেও স্পষ্টভাবে পাওয়া যাবে।

মুক্তিযুদ্ধ : বাংলাদেশে ইসলাম প্রশ্ন

বাংলাদেশের ইসলামপন্থীরা সত্তরের নির্বাচনের পর আওয়ামীলীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে একমত ছিলেন। তবে ছাব্বিশে মার্চ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গণহত্যা শুরু হলে তাদের অনেকের মধ্যে ভাবান্তর শুরু হয়। আওয়ামীলীগকে এককাট্টা ‘ইসলামবিদ্বেষী ও ভারতপন্থী’ আখ্যা দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে আওয়ামীলীগের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। একটা অংশ যুদ্ধাপরাধেও জড়িয়ে যায়। বাকী নব্বই শতাংশের মধ্যে তৈরি হয় আত্মদ্বন্ধ। তারা পাকিস্তানের জুলুমকেও সমর্থন করেনি, পাশাপাশি গৃহযুদ্ধ আখ্যা দিয়ে আওয়ামীলীগকেও সরাসরি সাহায্য করেননি ; প্রায় সবাই অসক্রিয় থেকেছেন।

শেখ মুজিব হত্যার পর জিয়াউর রহমানের হাত ধরে মুক্তিযুদ্ধের বিকল্প বয়ান প্রতিষ্ঠিত হয়। যার সাথে ইসলামপন্থীদের একাত্তর ব্যাখ্যার কিছু মৌলিক মিল আছে। বাম জাতীয়তাবাদ ও ভারতপন্থার বিরোধিতার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ছিল জিয়াউর রহমানের মধ্যে। সাংবিধানিক বৈধতা ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মুসলিম মূল্যবোধ, রাজনীতি ও ধর্মের এমন সমন্বয়ে তিনি ইসলাম প্রশ্নের উত্তর দিতে চেয়েছেন। শেখ মুজিবের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় সেনাবাহিনীর নেতৃত্বের পর্যায়ে থাকায় তার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বৈধতার সঙ্কটও ছিল না।

উল্লেখিত প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে বাংলাদেশের সক্রিয় ইসলামপন্থীরা সাধারণভাবে বিএনপিকে সমর্থন করেন, যেমন বাম জাতীয়তাবাদীরা সাধারণভাবে আওয়ামীলীগে আস্থা রাখেন। বিএনপি কখনোই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়নি, যেমন আওয়ামীলীগ বাম জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়নি। তবে দুই হাজার নয় সালের নির্বাচনে পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপির প্রভাব কমে যায়। আবার আওয়ামীলীগ, বাম জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থীদের ত্রিমুখী সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠে।

ছয় দফা : শাহাবাগের স্বরূপ সন্ধানে

দুই হাজার ছয়-সাত সাল থেকে বাম জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর মধ্যে একাত্তরের যুদ্ধপরাধের বিচার বাস্তবায়ন নিয়ে বিশেষ সক্রিয়তা শুরু হয়। দুই হাজার বারো সালের ফেব্রুয়ারিতে কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দানের প্রেক্ষিতে শাহাবাগে বাম জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী জমায়েত করা শুরু করে এবং ছয় দফা দাবী জানায়। যার মধ্যে তিনটি দাবী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

* ‘ধর্মকে ঢাল হিসেবে সামনে রেখে ঘাতক-দালালরা দেশ-ধ্বংসের যে রাজনীতি করে সেই রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। দেশে গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহ করা এসব কুলাঙ্গারদের গ্রেফতার করে অবিলম্বে কঠোরতম শাস্তি দিতে হবে।’

এই দফায় ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবী জানানো হয়। ধর্মীয় রাজনৈতিক সক্রিয়তা ও প্রতিবাদকে রাষ্ট্রদ্রোহ ঘোষণার দাবী করা হয়। বিশেষত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে পাকিস্তান আমলের মতো সাংবিধানিক বৈধতার সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে কোন ইসলামবিদ্বেষী ও চরমপন্থী দল ছাড়া অন্য কারো পক্ষে এমন দাবী তুলা অসম্ভব।

** যুদ্ধাপরাধীদের বিভিন্ন ব্যবসায়ী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানকে নিষিদ্ধ করতে হবে।

এই দফায় শুধু আইনি বিচারই নয়, এর পাশাপাশি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে নিশ্চিহ্ন করার দাবী জানানো হয়। এর সাথে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পরবর্তী জাতীয়করণের তুলনা দেওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ জাসদ যেমন বাম জাতীয়তাবাদী বিপ্লবের স্বপ্ন দেখত, শাহবাগের প্রবক্তারা তার কাছাকাছি স্বপ্নই দেখত। তবে দেশে সাংবিধানিক বৈধতার সঙ্কটের প্রেক্ষিতে আওয়ামীলীগের মাধ্যমে তারা এই বিপ্লব আয়োজন করতে চাইছিল। আবুল বারাকাতের Economics of Fundamentalism এর ভাল দৃষ্টান্ত।

*** যেসব রাজনৈতিক দল, শক্তি, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার চেষ্টা করছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করছে এবং তাদের সঙ্গে আঁতাত করছে, তাদেরও আইনের আওতায় এনে বিচার করতে হবে।

এই দফায় শুধু ইসলামপন্থীরাই নয়, তার পাশাপাশি ইসলামমনাদেরকেও টার্গেট বানানো হয়। যাতে বিএনপির পাশাপাশি কওমি মাদরাসা ও জাতীয়পার্টির মতো দলগুলোও অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। অর্থাৎ শাহাবাগীরা আওয়ামীলীগের কাঁধে সাওয়ার হয়ে তাদের অসমাপ্ত বাম জাতীয়তাবাদী প্রকল্প বাস্তবায়নে বাঁধা হতে পারে, এমন সব দলকেই নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে। কোন ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠী ছাড়া কারো পক্ষে এমন দাবী জানানো সম্ভব নয়। আবুল বারাকাতের Political Economy of Madrassa Education এর ভালো দৃষ্টান্ত।

তেরো দফা : ভেতর-বাহির

তেরো দফা শাহাবাগ আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় দেওয়া হয়েছে, সেটা প্রথম দেখাতেই বুঝা যাবে। তবে একে নিছক প্রতিক্রিয়া বললে ভুল হবে, তেরো দফা বাংলাদেশের আলেম সমাজের ইসলামী আন্দোলনের ধারাবাহিকতা, তাই এখানে গুরুত্বপূর্ণ সকল দাবী স্থান পেয়েছে। কিছু দাবীর শুরু পাকিস্তান আমল থেকেই, কিছু কয়েক দশকের দাবী ও কিছু সাম্প্রতিক সংযুক্তি।

* প্রথম, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও দশম দফা আলেমদের সর্বকালীন মৌলিক দাবী

‘সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপন এবং কোরআন-সুন্নাহবিরোধী সব আইন বাতিল করা।’

‘ইসলামবিরোধী নারীনীতি, ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাতিল করে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা।’

‘সরকারিভাবে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা এবং তাদের প্রচারণা ও ষড়যন্ত্রমূলক সব অপতৎপরতা বন্ধ করা।’

‘পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত এনজিও এবং খ্রিষ্টান মিশনারিগুলোর ধর্মান্তকরণসহ সব অপতৎপরতা বন্ধ করা।’

এনজিও-খৃস্টান মিশনারীদের অপতৎপরতা ও কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণার দাবী আলেমরা পাকিস্তান আমল থেকেই জানিয়ে আসছেন। পাশাপাশি সংবিধানে কোরআন-সুন্নাহবিরোধী সব আইন বাতিল করার দাবীও পাকিস্তান আমল থেকেই ইসলামপন্থীদের প্রধান দাবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। এর সাথে যোগ হয়েছে সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপনের দাবী। বস্তুত ইসলামপন্থীদের অনেকের মতে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন করলে দেশ ইসলামী
রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ইসলাম বিরোধী আইন প্রণয়ন না করলে রাষ্ট্রের মুসলিম পরিচয় টিকে থাকে।

নারী-শিক্ষানীতি বিরোধী আন্দোলন শুরু করেছে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি। দুই হাজার এগারো সালে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির অধীনে হেফাজতে ইসলাম নারী-শিক্ষানীতি বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। আন্দোলনের প্রেক্ষিতে নারী-শিক্ষানীতি আপাত দৃষ্টিতে স্থগিত হলেও আওয়ামীলীগের নেতাদের বক্তব্যে পরস্পর বিরোধী মতামত উঠে আসছিল। তেরো সালে হেফাজত তাই এই দুই দাবী সংযুক্ত রাখে। বিশেষত নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডো) প্রায় প্রত্যেক মুসলিম রাষ্ট্রেই বিতর্কিত পলিসি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

** দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা এই আন্দোলনে নতুনভাবে সংযুক্ত হয়েছে

‘আল্লাহ, রাসুল ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস।’

‘শাহবাগ আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী স্বঘোষিত নাস্তিক এবং রাসুল এর নামে কুৎসা রটনাকারী ব্লগার ও ইসলামবিদ্বেষীদের সব অপপ্রচার বন্ধসহ কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করা।’

মূলত এই দুই দফায় ইসলামবিদ্বেষকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে আখ্যা দিয়ে আইন পাশ করার আহ্বান জানানো হয়। পাশাপাশি শাহাবাগী নেতৃত্বকে ইসলাম বিদ্বেষী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আমরা জানি, সন্ত্রাস বিরোধী যুগের প্রেক্ষাপটে ইসলামবিদ্বেষ অত্যন্ত গুরতর বিষয়। ইউরোপ-আমেরিকা তো বটেই, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে ইসলামবিদ্বেষ মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় আকারে হাজির হয়েছে। ফলে হেফাজতের এই দাবীকে ব্লাসফেমী হিসেবে না দেখে ইসলামবিদ্বেষ বিরোধী আইন প্রণয়নের দাবী হিসেবে দেখাই অধিক যৌক্তিক।

*** চতুর্থ, সপ্তম ও নবম সহযোগী দফা

‘ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বালনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা।’

‘মসজিদের নগর ঢাকাকে মূর্তির নগরে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করা।’

‘রেডিও-টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দাড়ি-টুপি ও ইসলামি কৃষ্টি-কালচার নিয়ে হাসিঠাট্টা এবং নাটক-সিনেমায় নেতিবাচক চরিত্রে ধর্মীয় লেবাস-পোশাক পরিয়ে অভিনয়ের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মনে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব সৃষ্টির অপপ্রয়াস বন্ধ করা।’

এই তিনদফায় জনপরিসরে অমুসলিম সংস্কৃতির ব্যাপক প্রসার ও ইসলাম বিদ্বেষ রোধ করার দাবী জানানো হয়েছে। এই তিনদফাকে আলেম সমাজ ও ইসলামপন্থীদের মৌলিক দাবীর অংশ হিসেবেও আখ্যা দেওয়া যায়, আবার শাহাবাগের প্রতিবাদে ইসলামবিদ্বেষের সাংস্কৃতিক প্রসার রোধ হিসেবেও চিহ্নিত করা যেতে পারে। মোটকথা এই তিনদফা মূলত সহযোগী ধারা।

**** অষ্টম, একাদশ, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট ধারা

‘জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সব মসজিদে মুসল্লিদের নির্বিঘ্নে নামাজ আদায়ে বাধাবিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা অপসারণ এবং ওয়াজ-নসিহত ও ধর্মীয় কার্যকলাপে বাধাদান বন্ধ করা।’

‘রাসুলপ্রেমিক প্রতিবাদী আলেম-ওলামা, মাদ্রাসার ছাত্র রাসুলপ্রেমিক জনতার ওপর হামলা, দমন-পীড়ন, নির্বিচার গুলিবর্ষণ এবং গণহত্যা বন্ধ করা।’

‘সারা দেশের কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক, ওলামা-মাশায়েখ ও মসজিদের ইমাম-খতিবকে হুমকি-ধমকি, ভয়ভীতি দানসহ তাঁদের বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র বন্ধ করা।’

‘অবিলম্বে গ্রেপ্তারকৃত সব আলেম-ওলামা, মাদ্রাসাছাত্র ও রাসুলপ্রেমিক জনতাকে মুক্তিদান, দায়ের করা সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং আহত ও নিহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণসহ দুষ্কৃতকারীদের বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি প্রদান।’

বাংলাদেশে জনপরিসরে অব্যাহত ইসলামবিদ্বেষের প্রেক্ষিতে দুই হাজার এগারো, বারো ও তেরো সালে ব্যাপক নিরাপত্তা সমস্যা দেখা দেয়। অনেক আলেম ও মাদরাসার ছাত্র গ্রেফতার হন। অনেক ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠান প্রশাসনিক বিধিনিষেধের শিকার হয়। এসবের প্রেক্ষিতে আলেমরা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেন। শাহাবাগীদের প্রতিপক্ষ হিসেবে নির্ধারণ করে ইসলামবিদ্বেষকে এর প্রধান কারণ হিসেবে আখ্যা দেন।

তেরো দফা : সাধারণ পরিসংখ্যান

দাবীর প্রায় ত্রিশ শতাংশ নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট। হেফাজত বাংলাদেশের ধর্মীয় মহলের অভিভাবক হিসেবে নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি শাপলা চত্বরে লংমার্চের কর্মসূচী পালনের আগে অনেকে গ্রেফতার ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তেরো দফার চারটিতে তাই নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট দাবী জানানো হয়েছে।

প্রায় পনের শতাংশ দাবী ইসলামবিদ্বেষ সংশ্লিষ্ট। এই পনের শতাংশই মূলত হেফাজতের আন্দোলনের মূল ফোকাস। শাহাবাগ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ইসলামবিদ্বেষ মোকাবেলার আহ্বান জানানো হয়। এর সাথে সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট জড়িত, পাশাপাশি বিএনপির দুর্বলতায় জাতীয় রাজনীতিতে মুসলিম আত্মপরিচয় ক্রমাগতভাবে হুমকির মুখোমুখি হয়ে যাওয়ার বিষয়টিও এখানে উল্লেখযোগ্য।

তেইশ শতাংশকে সাংস্কৃতিক ও সহযোগী দাবী হিসেবে আখ্যা দেওয়া যায়। এতে যদিও সরাসরি নিরাপত্তা, ইসলামবিদ্বেষ বা মুসলিম রাষ্ট্রের প্রশ্ন হাজির নেই, তবে তেইশ শতাংশ সাংস্কৃতিক দাবীর সাথে ইসলাম বিদ্বেষ ও মুসলিম রাষ্ট্রের দাবীর বিশেষ সম্পর্ক আছে। পাশাপাশি মূলত সাংস্কৃতিক বিদ্বেষ থেকেই নিরাপত্তা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে এই তেইশ শতাংশকে বিচ্ছিন্ন ভাবলে হবে না।

বাকী ত্রিশ শতাংশ মুসলিম রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট দাবী। এগুলো আলেমদের সর্বকালীন দাবী। ইসলামী আইন বাস্তবায়ন করতে হবে, বা অন্তত, ইসলাম বিরোধী আইন পাশ করা যাবে না। যার অংশ হিসেবে কাদিয়ানীদের নিষিদ্ধ ঘোষণা ও খ্রিস্টান মিশনারীদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের দাবী জানানো হয়। পাশাপাশি সাম্প্রতিক নারী ও শিক্ষানীতির ধর্মবিরোধী ধারা বাতিলের আহ্বান জানানো হয়।

তেরো দফা : দলগুলোর প্রতিক্রিয়া

আওয়ামীলীগ হেফাজতের দাবীসমূহ প্রকাশ্যে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে। বিএনপি আংশিকভাবে মেনে নেওয়ার ঘোষণা দিলেও কোন কোন দফা মানবে, সে নিয়ে কোন স্পষ্ট বক্তব্য দেয়নি। জাতীয়পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী সমর্থন জানালেও কয় দফা মানবে, সে নিয়ে কোন স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়নি বা বলা ভালো, তাদের ব্যাখ্যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক মেরুকরণের প্রেক্ষিতে খুব বেশী গুরুত্বপূর্ণও নয়।

তবে রাজনৈতিক চরিত্রের প্রেক্ষাপটের বিচারে আওয়ামীলীগ ও বিএনপি কারো পক্ষেই ইসলামী রাষ্ট্র তথা সংবিধান, আইন, কাদিয়ানী ও খৃস্টান মিশনারী সংশ্লিষ্ট দফাগুলো মানা সম্ভব নয়। বিএনপিতে সহসাই জিয়াউর রহমানের মতো কোন বিপ্লবী নেতা আসবেন না, ফলে তাদের ‘উদার গণতান্ত্রিক’ রাজনীতির বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। আবার ইতিহাস বলে আওয়ামীলীগের পক্ষেও পরিপূর্ণ বাম জাতীয়তাবাদী রাজনীতি করা সম্ভব নয়। বাহাত্তর সালে তার কিছু আলামত দেখা গেলেও শেখ মুজিব ধীরে ধীরে তার থেকে সরে এসেছেন।

ইসলামবিদ্বেষ সংক্রান্ত দাবীগুলো বিএনপি আইনগতভাবে না মানলেও কার্যত মেনে নিত, এটা অনেকেই বলছেন। তবে বর্ণবাদ বিরোধী আইনের মতো ইসলামবিদ্বেষ মোকাবেলায় আইন করা কি সম্ভব নয়? বড় কোন নেতৃত্ব না আসলে বিএনপির পক্ষে এই আইন করা সম্ভব নয়। তবে গত সাত বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেল, আওয়ামীলীগ প্রকাশ্যে ইসলামবিদ্বেষকে প্রশ্রয় দেয়নি, তবে বাম জাতীয়তাবাদের প্রভাবে আইনিভাবে কোন পদক্ষেপও নেয়নি।

শেষকথা

হেফাজত ও তেরো দফা আলেম সমাজের প্রথম বা শেষ আন্দোলন নয়, ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা দেখলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই আন্দোলনের শুরু হয়েছে এবং বাংলাদেশে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় থাকলে অনেকগুলো দাবী সবসময় প্রাসঙ্গিক থাকবে। এ কারণে হেফাজতের আন্দোলন ও তেরো দফাকে এককাট্টাভাবে সফল বা ব্যর্থ বলা যায় না। হেফাজত নিশ্চিত করেছে উপস্থিতি, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর পরিচয় ; নির্বাচন ব্যবস্থার কার্যকারিতা যখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেছে, শুরু হয়েছে সাংবিধানিক বৈধতার সঙ্কট, হেফাজতের আন্দোলনকে সে প্রেক্ষাপটে বলা যায় – শরীফ মুহাম্মদের ভাষায় – কান্না ও শেষ
আত্মচিৎকার !

The post হেফাজত ও তেরো দফা : সরল বোঝাপড়া appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%b9%e0%a7%87%e0%a6%ab%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a6%a4-%e0%a6%93-%e0%a6%a4%e0%a7%87%e0%a6%b0%e0%a7%8b-%e0%a6%a6%e0%a6%ab%e0%a6%be-%e0%a6%b8%e0%a6%b0%e0%a6%b2-%e0%a6%ac%e0%a7%8b%e0%a6%9d%e0%a6%be/

No comments:

Post a Comment