আব্দুস সুবহান:
কুরবানী ঈদ। আমাদের স্থানীয় ভাষায় ‘বকরী ঈদ’। বরাবরই ‘বকরী ঈদ’ আমাকে বেশি আনন্দ দেয়। দশদিন আগে ঈদের চাঁদ ওঠে। প্রথম দিন দেখতে না পেলেও দ্বিতীয় দিন থেকে প্রতি সন্ধ্যায় সমবয়সীরা দল বেঁধে চাঁদ দেখি। দিনেদিনে চাঁদ বড় হয়। ঈদের দিন এগিয়ে আসে। হৃদয়ের আনন্দ বাড়ে টগবগিয়ে।
রোজার ঈদের মতো নতুন জামায় কুরবানী ঈদের আনন্দ আটকে থাকে না। কুরবানী ঈদে আসল আনন্দের বস্তু হলো কুরবানীর পশু।
আমার যখন ছোটবেলা, কুরবানী করার মতো আর্থিক সঙ্গতি তখন আমাদের নেই। নানার বাড়িতে প্রতি বছর কুরবানী হয়। নানা একাই এক গরু কুরবানী করেন। ঈদের দু-পাঁচ দিন আগেই কেনা হয় নানাদের গরু। গরু কেনার দিন আমিও হাটে যাই। গরুর সাথে চলে যাই নানার বাড়ি। ঈদ করি সেখানেই।
ঈদের আগ পর্যন্ত সারাদিন ব্যস্ত থাকি গরু নিয়ে। ঘাস-পানি খাওয়াই। সুযোগ পেলে রাস্তায় নিয়ে যাই। মাঠ থেকে একটু ঘুরিয়ে চড়িয়ে আনি। জমানো টাকা ভেঙে কাগজের মালা দিয়ে গরুর গলা পিঠ সাজাই। এ কয়দিনে বেশ একটা সখ্যতা গড়ে উঠে গরুর সাথে!
ঈদের আগের দিন রাত। আমরা বলি চাঁন রাইত। এ চাঁন রাইত আসলেই চাঁদের হাট বসে বাড়ির উঠোনে। আমরা সমবয়সীরা দল বেঁধে কানামাছি খেলি। খোশগল্প করি। গালগল্প করি। সেসব আজিব গল্প। ভয়ের গল্প, জয়ের গল্প। সাধারণ গল্প, অসাধারণ গল্প। বিশ্বাস্য গল্প, অবিশ্বাস্য গল্প। একবার এক মমাতো ভাই বলে, চাঁন রাইতে কুরবানীর পশু কাঁদে! স্বপ্নে সে ছুরি-চাপাতি দেখতে পায়! স্বজনদের বিচ্ছেদ বুঝতে পারে! মৃত্যুর কথা টের পায়! আমরা অবাক হয়ে শুনি। সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের কথা ভাবি না।
ঈদের দিন সকালবেলা। পাল্লা দিয়ে গোসল করি। সেজেগুজে ঈদগাহে যাই। নামাজ শেষে ঈদগাহ হতে ফিরি। এখন হবে আসল ঈদ। শুরু হয় জবাইয়ের তোড়জোড়।
চার-পাঁচজন মিলে গরুটা শুইয়ে দিয়ে চেপে ধরে। পাড়ার মসজিদের ইমাম সাহেব আল্লাহু আকবার বলে গরুর গলায় ছুরি চালান। দু’তিন পোঁচ দিতেই পাশে থাকা কসাই এগিয়ে যায়। জবাইয়ের বাকী কাজ সম্পন্ন করে। কিছুক্ষণ নড়াচড়া করে নিস্তেজ হয়ে যায় পশুটা। কদিনে প্রিয় হয়ে ওঠা পশুটা অসাড়-নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে থাকে। রক্তে রঞ্জিত তার চারিধার। কেমন একটা কষ্ট লাগে। ভেতরে ভেতরে হাহাকার লাগে। কদিনে তৈরি হওয়া মোহ-মায়াটা বিগলিত অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ে। আল্লাহ খুশি হবেন– এই আশায় এ মায়াটুকু ত্যাগ করার নামই কুরবানী। এখানেই কুরবানী ঈদের স্বার্থকতা।
একটু পরে সব ভুলে যাই। গোশত কাটায় শরীক হই। আনন্দ আহ্লাদে মেতে উঠি। সত্যিকারের আনন্দে-আনন্দে কেটে যায় ঈদ। আহ! আমার ছোটবেলা! আমার নির্ভাবনার শৈশব!
মাদরাসায় যখন ভর্তি হই এ আনন্দে ভাটা পড়ে কিছুটা। আকাশে যখন জিলহজের বাঁকা চাঁদ, চারিদিকে ঈদের আমেজ, পথে পথে শোরগোল, এখানে সেখানে ‘বিরাট গরু ছাগলের হাট’, মাদরাসায় তখন পরীক্ষা। পরীক্ষা আর আনন্দ একসাথে হতে পারে– আমার কখনোই মনে হয় না।
পরীক্ষা চলে ঈদের পাঁচ দিন আগ পর্যন্ত। তবুও ভালো! আমরা যারা ছোট এরপর ছুটি হয়ে যায় তাদের। হৃদয় ভরা উচ্ছ্বাস-উল্লাস নিয়ে বাড়ি ফিরি। একে ঈদ দুয়ে ছুটি। একেই মনে হয় বলে ঈদের উপর শুক্রবার। একটা অন্যরকম আনন্দ।
তবে এ আনন্দটা আগের মতো না। আগে যেমন দল বেঁধে চাঁদ দেখার আনন্দ ছিল, হাঁটে যাবার আনন্দ ছিল, সারাদিন কুরবানীর জন্তু নিয়ে ব্যস্ত থাকার অনন্দ ছিল সেসব এখন নেই। এখন আছে দীর্ঘদিন পর বাবা-মা ভাই-বোনকে কাছে পাবার আনন্দ, গ্রামের বন্ধুদের কাছে শহুরে জীবনের গল্পবলার আনন্দ, ‘শহরে পড়াশুনা করে’– এই বিশেষণে অন্যদের মাঝে বিশিষ্ট হওয়ার আনন্দ।
ফাটা কপাল! এ আনন্দও বেশিদিন সয় না। সময় গড়িয়ে যায়। আমার হাত পা দেহ বাড়ে। আগের চেয়ে লম্বা হয়ে উঠি। থুতনিতে নাকের নিচে দাঁড়িগোঁফের কালো রেখা ঘন থেকে ঘনতর হয়ে উঠে। আমি আর ছোট থাকি না। গণ্য হতে থাকি বড় ছাত্রদের কতারে। আহ! এই বড় গণ্য হওয়া কিযে…!
পরীক্ষার পরে ঈদ করতে বাড়ি যাওয়ার যে ছুটি বড় হওয়ার অপরাধে তা বন্ধ হয়ে যায়। ঈদের দিনে চামড়া কালেকশনের জন্য মাদরাসায় থাকতে হয়। সেই থেকে শুরু হয় ঈদের কুরবানী!
এই থেকে যাওয়ার মধ্যে, কাজে অংশ নেয়ার মধ্যে কোন আনন্দ যে নেই তা বলা যায় না। এখানেও আনন্দ আছে। সে আনন্দ একটু ভিন্নরকম। একটু আলাদা। কিন্তু আনন্দ! অনাবিল আনন্দ!
ঈদের আগের সন্ধাগুলোয় হলরুমে ছাত্রদের মজলিস হয়। ‘ঈদ অনুষ্ঠান মালা’ নামে নানা অনুষ্ঠান ও প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়। একেকটা সন্ধ্যা হাসি-আনন্দে ভরে ওঠে। উজ্জ্বল-প্রোজ্জল হয়ে জায়গা করে নেয় স্মৃতির পাতায় পাতায়।
‘ছাত্রজীবন সুখের জীবন’- এই সময়টাতে এর সত্যতা খুব উপলব্ধি হয়! সারাদিন পড়াশোনা বিহীন! ক্লাস নেই। পরীক্ষা নেই। লেখাপড়ার প্যারা নেই। বন্ধুরা সব একসাথে আছি! অফুরন্ত অবসরে দিন কাটাচ্ছি! এই যে আনন্দ– তুলনাহীন!
রাতের বেলায় ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে পোস্টার লাগাতে যাই। সে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। এ্যডভেঞ্চারের অভিজ্ঞতা। ঢাকার শহরের মহল্লায় মহল্লায় কিছু জাঁদরেল কুকুর থাকে। রাত যত বাড়ে এরা তত চাঙ্গা আর চনমনে হয়ে ওঠে। পোস্টার লাগাতে এসে এদের পাল্লায় পড়লে সে রাতটা সত্যিকার ‘এ্যডভেঞ্চার রজনী’ হয়ে ওঠে। আহ! এমন কত রাত ঘুরছে স্মৃতির পথে প্রান্তরে।
The post কর্মব্যস্ত ঈদ আনন্দ appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ae%e0%a6%ac%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%a4-%e0%a6%88%e0%a6%a6-%e0%a6%86%e0%a6%a8%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a6/
No comments:
Post a Comment