Wednesday, November 16, 2022

পাঠ্যপুস্তকে হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি: মুসলিমবান্ধব পাঠ্যক্রম দাবি মাদরাসা শিক্ষকদের

রাকিবুল হাসান নাঈম:

২০২৩ সালে শুরু হতে যাওয়া নতুন কারিকুলামের পাঠ্যপুস্তক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আলিয়া মাদরাসার শিক্ষকরা। তারা বলছেন, ওইসব পাঠ্যপুস্তকে সন্নিবেশিত অধিকাংশ ছবি, শব্দ, বাক্য, তথ্য-উপাত্ত ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মর্মাহত এবং তাদের সস্তানদের ভবিষ্যৎ শিক্ষা নিয়ে শংকিত করে তুলেছে। তাই তারা এসব বই মাদরাসায় পড়াতে পারবেন না। মাদরাসার জন্য আলাদা পাঠ্যসূচি নির্ধারণের দাবিও জানিয়েছেন তারা।

চলতি মাসের ১৬ নভেম্বর কুরআন-সুন্নাহ ও মুসলিম ঐতিহ্য অক্ষুন্ন রেখে মাদরাসার পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নসহ ১৩টি দাবি জানিয়ে মানববন্ধ করেছে মাদরাসা শিক্ষকদের সর্ববৃহৎ সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সবগুলো জেলায় মাদরাসার শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং ওলামা-মাশায়েখ এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন। একইসাথে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ১৩ দফা দাবি সম্বলিত স্মারকলিপিও প্রদান করেন তারা।

জানা গেছে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর ধারাবাহিকতায় চলতি বছর ৬২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এনসিটিবির ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণির ৯টি বই (বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, গণিত, শিল্প সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, জীবন জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, বিজ্ঞান) পরীক্ষামূলকভাবে পাঠদান করা হয়। ২০২৩ সাল থেকে ওই বইগুলো সমস্ত স্কুল ও মাদরাসার বাধ্যতামূলকভাবে পড়ানোর নির্দেশনা দিয়েছে এনসিটিবি। শিক্ষকরা বলছেন, এই পাঠ্যপুস্তক মাদরাসা শিক্ষার জাতীয় লক্ষ-উদ্দেশ্য (জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০১০ এ বর্ণিত) এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট উপেক্ষা করে রচিত হয়েছে।

কী আছে পাঠ্যপুস্তকে?

শিক্ষকরা বলছেন, এসব পাঠ্যপুস্তকে সন্নিবেশিত অধিকাংশ ছবি, চিত্র, শব্দ, বাক্য, তথ্য ও উপাত্ত ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মর্মাহত এবং তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ শিক্ষা নিয়ে সঙ্কিত করে তুলবে। যেমন ৬ষ্ঠ শ্রেণির ৯টি বইয়ের মধ্যে কুরআন, সুন্নাহ, সাহাবায়ে কেরাম, আহলে বাইত, মুসলিম মনীষী, বিজ্ঞানী, কবি, সাহিত্যিকদের বাণী, উদ্ধৃতি, নীতি-নৈতিকতা সৃষ্টিকারী কোন বিষয় স্থান পায়নি। উপরন্ত আপত্তিজনক বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে। যেমন বিজ্ঞান বইয়ে ১১ জন উলঙ্গ নারী-পুরুষের ছবি দিয়ে তাদের লজ্জাস্থানের পরিচয় দেয়া হয়েছে। ৯টি বইয়ে শতশত মেয়ের বেপর্দা ছবি ছাপানো হয়েছে। হিন্দু মহিলার শাঁখা পরা ছবি রয়েছে। ইংরেজি বইয়ে কুকুর ও নেকড়ে বাঘের ২৪টি ছবি ছাপানো হয়েছে, যা ইউরোপীয় সংস্কৃতির অংশ বিশেষ।

তারা আরও বলছেন, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ডারউইনের বিবর্তনবাদ (মানুষ সৃষ্টি হয়েছে বানর থেকে), দেব-দেবীর নগ্ন ও অর্ধনগ্ন ছবি এবং দেবতাদের পরিচয় দেয়া হয়েছে। জীবন জীবিকা বইয়ে ইশপের গল্প, প্রণাম, গানশোনা, নাচ, বাঁশি, হারমোনিয়াম, তবলা, গিটার ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের পাশ্চাত্য ও মূর্তিপূজার সংস্কৃতি চর্চার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়াও দূর্গাপুজা, গীতাঞ্জলী, কিশোর-কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন অত্যন্ত লজ্জাজনকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। বইগুলোতে মানুষের যেসব নাম ব্যবহৃত হয়েছে, একটি মুসলিম দেশে তা সত্যিই আপত্তিকর। যেমন: আনিকা, লিটল, রাড, প্লাবন, রতন, দীপক, নন্দিনী, এন্তি, মিসেল, মনিকা চাকমা, ডেবিট, প্রিয়াঙ্কা, মন্দিরা ইত্যাদি। সামগ্রিক বিবেচনায় ৯২ শতাংশ মুসলমানের দেশে পাশ্চাত্য, দেব-দেবীর বিশ্বাস ও তাদের আরাধনার শিক্ষা-সংস্কৃতির আদলে তৈরি বইগুলো স্কুলের জন্যও উপযোগি নয়।

এ প্রসঙ্গে জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের মহানগর সাধারণ সম্পাদক ড. মাওলানা ঈসমাইল নোমানী ফাতেহকে বলেন, মাদরাসার ষষ্ঠ শ্রেণির বইয়ে বাংলাদেশের হাজার বছর ধরে চলে আসা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী বহু জিনিস আছে। এমনকিছু নগ্ন ও অশ্লিল ছবি সেখানে সংযুক্ত করা হয়েছে যা বাংলাদেশের কৃষ্টি-কালচার বিরোধী। আমরা বিশ্বাস করি, প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারও এই দর্শন ও চিন্তায় বিশ্বাস করেন না। কোন কুচক্রিমহল সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য, নির্বাচনের পূর্বে সরকারকে বিতর্কিত করার জন্য, সুকৌশলে জাতির বৃহত্তর অংশকে মাদরাসা বা দ্বীনি শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত বিশেষজ্ঞদের অন্ধকারে রেখে হঠাৎ করে এসব বই শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে। আমরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে সেই কুচক্রিমহলের হীন প্রচেষ্টার প্রতিবাদ করছি, প্রতিরোধ করছি।

১৩ দফা দাবি শিক্ষকদের

পাঠ্যপুস্তকের চলমান সংকট নিরসনকল্পে ১৩ দফা দাবি জানিয়েছেন শিক্ষকরা। তারা বলছেন, মাদরাসা শিক্ষার জন্য এ সরকারের প্রণীত ও জাতীয় সংসদে গৃহীত জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০১০-এ বর্ণিত মাদরাসা শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণের উপযোগী স্বতন্ত্র শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবই রচনা করতে হবে। আর সে লক্ষ্যেই এনসিটিবি, মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড ও জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের বিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ আলেমদের সমন্বয়ে একটি কমিটি করতে হবে। আর দাবীকৃত শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পাঠ্যবই প্রণয়নের পূর্বপর্যন্ত প্রচলিত পঠ্যপুস্তকসমূহ পাঠদান অব্যাহত রাখা হবে।

স্মারকলিপিতে শিক্ষকরা আরও বলেন, সাধারণ শিক্ষায় এসএসসি পরীক্ষা দশটি বিষয়ে ১০০০ নম্বরের অনুষ্ঠিত হবে। মাদরাসা শিক্ষার দাখিল পরীক্ষার জন্য মূল বিষয় ঠিক রেখে সমন্বয় সাধন করে ১০০০ নম্বর নির্ধারণ করতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ন্যায় স্বতন্ত্র ও সংযুক্ত ইবতেদায়ী শিক্ষার্থীদেরকে উপবৃত্তি, টিফিনসহ সুযোগ সুবিধা প্রদান করতে হবে। মহিলা কোটা শিথিল ও সংশোধনপূর্বক যোগ্য ও মেধাবী শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। আরবি প্রভাষকগণের উচ্চতর পদে আসীন হওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী অনুমোদিত ২০১৮ সালে প্রণিত স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসার নীতিমালা শতভাগ বাস্তবায়ন করারও আহ্বান জানান শিক্ষকরা।

পাঠ্যপুস্তক মুসলিমবান্ধব করার দাবি

ঢাকা মহানগরের জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সেক্রেটারি অধ্যক্ষ মাওলানা আবু জাফর মো. ছাদেক হাছান মনে করেন, বর্তমান সরকারের সাফল্য ম্লান করতে এনসিটিবিতে ঘাপটি মেরে বসে থাকা কিছু ব্যক্তি মাদরাসা, ইসলাম শিক্ষা ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে কারিকুলাম তৈরি করেছেন। তিনি ফাতেহকে বলেন, তারা তাদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সরকারকে বিতর্কিত করতে চায়। অবিলম্বে এদেরকে চিহ্নিত করে অপসারণ করতে হবে এবং মাদরাসার জন্য স্বতন্ত্র শিক্ষাক্রম তৈরি করতে হবে। যেটা হবে মাদরাসা ও ইসলাম বান্ধব। আমরা একটি সুন্দর শিক্ষা ব্যবস্থা উপহার দিতে চাই। যে শিক্ষা ব্যবস্থায় ইসলামী শিক্ষার সাথে সাধারণ, বিজ্ঞান শিক্ষার সমন্বয় করে একটি নীতি-নৈতিকতা সম্পন্ন আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। আমরা খাটি ওয়ারিসাতুল আম্বিয়া তৈরি করতে পারবো। এদেশে মুসলমান ও ইসলামী আকিদা অনুযায়ী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই।

দাবি পূর্ণ না হলে এদেশের ইসলামপ্রিয় জনগণ, পীর-মাশায়েখদের নিয়ে বৃহত্তর কর্মসূচি পালন করার কথাও বলেন তিনি।

আলেমরা বলছেন, খুব দ্রুত দেশের বরেণ্য আলেমদের অংশগ্রহণে একটি যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপ ও তদারকি এখন সময়ের দাবি। যুগের চাহিদা পূরণে শিক্ষা ব্যবস্থার শিক্ষাক্রম পরিবর্তন, পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন করা নিয়ে কারো দ্বিমত নেই। কেবল একটি মুসলিম দেশের পাঠ্যক্রম অমুসলিম দেশের মতো উপাদান দিয়ে ঢেলে সাজানোতে দ্বিমত।

The post পাঠ্যপুস্তকে হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি: মুসলিমবান্ধব পাঠ্যক্রম দাবি মাদরাসা শিক্ষকদের appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%aa%e0%a6%be%e0%a6%a0%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%aa%e0%a7%81%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%95%e0%a7%87-%e0%a6%b9%e0%a6%bf%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a6%e0%a7%81%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%be%e0%a6%a8/

No comments:

Post a Comment