Sunday, November 6, 2022

খাদ্যে ঝুঁকি বাড়ছে : হালাল স্টান্ডার্ড বাস্তবায়নে জোর দিচ্ছেন আলেমরা

রাকিবুল হাসান নাঈম:

ভেজাল খাদ্যের কারণে মানুষের দেহে ক্যান্সার, কিডনিসহ বড় বড় জটিল রোগগুলো এখন দ্বিগুণ হারে বাড়ছে। ‘নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩’ প্রণীত হলেও আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় খাদ্যপণ্য উৎপাদক ও বিক্রেতারা জনস্বাস্থ্য ও আইনগত শাস্তির কোনো তোয়াক্কা করছে না। ফলে খাদ্যে ঝুঁকি বেড়েই চলেছে।

পয়লা নভেম্বর এক সভায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেকও বলেছেন, ভেজাল খাদ্যে ছেয়ে গেছে বাজার। হোটেল-রেস্তোরাঁ, দোকান ও হাটবাজারে ভেজাল খাবার বিক্রি হচ্ছে। এতে নানা রোগব্যাধি যেমন বাড়ছে, বিপরীতে ওষুধের ব্যবসাও বেড়ে গেছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুস্থ জীবন দিতে হলে এই ভেজাল কারবারিদের এখনই থামিয়ে দিতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

এ প্রেক্ষিতে দেশের আলেম সমাজ হালাল স্টান্ডার্ড বাস্তবায়নে জোর দিয়ে বলছেন, ভেজালের বিপরীতে খাদ্যে হালাল স্টান্ডার্ড বাস্তবায়ন করলে ঝুঁকি কমবে। মুসলিম দেশ হিসেবে আমাদের দেশে স্বভাবতই হালাল খাবারের ব্যবস্থাপনাই সর্বত্র। তবে এক্ষেত্রে হালাল স্ট্যান্ডার্ড বাস্তবায়ন করলে খাদ্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বাড়বে।

আলেমরা যা বলছেন

এ বিষয়ে কথা হয় ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের ডেপুটি-ডিরেক্টর ড. আবু সালেহ পাটোয়ারীর সঙ্গে। হালাল স্টান্ডার্ড মানে কি জানতে চাইলে তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘ফুড সেফটি ও নিউট্রিশনের পূর্ণ সমন্বয় হলো হালাল ব্র্যান্ড, যেখানে শরীরের জন্য ক্ষতিকর কোন কিছু থাকবে না। এখানে ইসলামিক সংস্কৃতি এবং বিজ্ঞান একসঙ্গে কাজ করে। দীর্ঘদিন ধরে ইসলামিক দেশগুলোর মানদন্ড মেনে সনদ দেওয়ার প্রক্রিয়া পরিচালনা করে আসছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। যেখানে ইসলামিক রীতিনীতি মেনে পণ্য উৎপাদনে কাঁচামাল, উৎপাদন প্রক্রিয়া, সংরক্ষণ, পরিবহনসহ ভোক্তার কাছে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সকল প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করা হয়। মান যাচাইয়ের প্রয়োজনে বিএসটিআই, ওষুধ প্রশাসনের লোকজনও থাকেন হালাল সার্টিফিকেট প্রদানের ক্ষেত্রে। পণ্য তৈরিতে কোনো প্রকার হারাম ও ক্ষতিকর উপদান না থাকলেই ফাউন্ডেশন এই সনদ প্রদান করে।

তিনি বলেন, ভেজাল রোধে সবচে উত্তম একটি মাধ্যম হতে পারে হালাল স্টান্ডার্ড বাস্তবায়ন। কারণ, স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর কোনো পণ্য উপাদান না থাকা, ইসলামে নিষিদ্ধ এমন কোন উপাদান যুক্ত না করে মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদনই হালাল খাদ্যের মূল বিষয়।

মুসলিম জনগোষ্ঠীর কাছে হালাল পণ্য শারীরিক ও মানসিক স্বস্তির বিষয় মনে করেন হালাল সনদ প্রদানের সঙ্গে জড়িত মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ। বাংলাদেশ বিমানের খাদ্যসেবা (কেটারিং) দিচ্ছে যে প্রতিষ্ঠান, ২০১৫ সাল থেকে সে প্রতিষ্ঠানের হালাল সনদ দিচ্ছেন তিনি। তিনি বলেন, খাবার তো সঠিক প্রক্রিয়াতেই তৈরী হয়। তবে হালাল সনদ থাকলে মনে স্বস্তি লাগে যে, ভাল একটা জিনিস খাচ্ছি। তাই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে না হলেও প্রাকৃতিক ও জীবনের প্রয়োজনেও হালাল স্টান্ডার্ড বাস্তবায়ন করা জরুরী।

হালাল খাদ্যের ধারণা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ইসলামে হালাল পণ্য প্রস্তুত ও খাওয়ার নির্দেশনা মেনে পুষ্টিমানসম্পন্ন পণ্য প্রস্তুতই হালালের মূল ধারণা। দেশজুড়ে যদি হালাল স্টান্ডার্ড বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক করা হয় এবং তা ঠিকমতো বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা তদারকি করা হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারে যেমন আমাদের অংশগ্রহণ বাড়বে, তেমনি দেশের মানুষও সুস্থ থাকবে। খাদ্যে নিরাপত্তা তৈরী হবে।

যারা হালাল সনদ দিচ্ছে

এতদিন শুধু ইসলামিক ফাউন্ডেশন হালাল সনদ প্রদান করলেও গেল বছর থেকে হালাল পণ্যের সনদ দিচ্ছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। বিএসটিআই আগে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সঙ্গে মিলে কাজ করতো। বিএসটিআই বাজারজাতের অনুমোদন দিলেই কেবল ফাউন্ডেশন পণ্যটিকে হালাল সনদের বিবেচনায় আনতো। গেলো বছর নিজেরাই হালাল সনদ প্রদানের উইং খুলে বিএসটিআই। ইতোমধ্যে বিএসটিআই তিন পর্বে হালাল সনদ দিয়েছে।

বিএসটিআইয়ের হালাল সার্টিফিকেট বোর্ডে ১৪ কমিটির সদস্য রয়েছেন। এরমধ্যে খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, পরিবেশ অধিদপ্তর, কৃষি অধিদপ্তর, পানি সম্পদ অধিদপ্তর, মৎস্য অধিদপ্তর, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা রয়েছেন। শরিয়া দিকটি দেখার জন্য রয়েছেন দুজন শরিয়া এডভাইজর।

বর্তমানে মোট পাঁচ জাতীয় পণ্যে হালাল সনদ দিচ্ছে বিএসটিআই। পণ্যগুলো হলো: ১. খাদ্যপণ্য ও পক্রিয়াজাত পণ্য। ২. প্রাণীসম্পদ। এরমধ্যে মাংসজাতীয় জিনিসগুলো রয়েছে। ৩. মৎসজাতীয় পণ্য। ৪. প্রক্রিয়াজাত পঁচনশীল পণ্য। ৫. প্রসাধনী ও ফার্মাসিউটিক্যাল জাতীয় পণ্য।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৪০টি কোম্পানি হালাল পণ্যের সনদ নিয়েছে। এর মধ্যে খাদ্য পণ্য উৎপাদন ও বিপননের সঙ্গে জড়িত কোম্পানির সংখ্যা একশোর বেশি। এসব কোম্পানির উৎপাদিত হালাল ব্র্যান্ডের পণ্য রয়েছে প্রায় ৭০০টি।

নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩

এ প্রসঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিসের বিচারক মো. তাজুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, নিরাপদ খাদ্য ভোক্তার অধিকার বলে গণ্য হয়। পৃথিবীর প্রতিটি দেশ নিরাপদ খাদ্যকে ভোক্তার অধিকার হিসেবে নেয় এবং এর ব্যত্যয় সেসব দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ বিবেচিত হয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। আমাদের দেশে ২০০৯ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন প্রণীত হয় এবং নিরাপদ খাদ্যের জন্য যখন মানুষ দিশেহারা তখন খাদ্যে ভেজাল রোধ সংক্রান্ত সব আইন ও অধ্যাদেশ পর্যালোচনা করে ‘দ্য পিওর ফুড অর্ডিন্যান্স ১৯৫৯’- রহিত করে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩’ প্রণীত হয়। এতে রয়েছে ৯০টি ধারা, ১৩ টি অধ্যায়, ৩৩ টি খাদ্য ভেজাল ও খাদ্য সংক্রান্ত বিষয়ক সংজ্ঞা।

জরিমানা ও শাস্তির বিধান উল্লেখ করে তিনি বলেন, জীবননাশক বা মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোনো রাসায়নিক বা ভারী ধাতু বা বিষাক্ত দ্রব্য মিশ্রিত কোনো খাদ্যদ্রব্য উত্পাদন, আমদানি, প্রস্তুত, মজুদ, বিতরণ, বিক্রয় বা বিক্রয়ের অপচেষ্টা করলে অনূর্ধ্ব সাত বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে। পুনরায় একই অপরাধ করলে সাত বছর থেকে অনূর্ধ্ব ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা অন্যূন ১০ লাখ টাকা জরিমানা।

নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ আইনদ্বয়ে যেসব কাজ করার বিষয়ে বিধিনিষেধ অথবা যেসব কাজ অপরাধ গণ্য করা হয়েছে তা সব নাগরিককে জানতে হবে বলেও মন্তব্য করেন এই বিচারক।

The post খাদ্যে ঝুঁকি বাড়ছে : হালাল স্টান্ডার্ড বাস্তবায়নে জোর দিচ্ছেন আলেমরা appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%96%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a7%87-%e0%a6%9d%e0%a7%81%e0%a6%81%e0%a6%95%e0%a6%bf-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%a1%e0%a6%bc%e0%a6%9b%e0%a7%87-%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a6%be/

No comments:

Post a Comment