Monday, November 28, 2022

ইহুদি আইনের ওপর উদারতাবাদের জয়: ইজরাইল কেন সমকামীদের গন্তব্য হলো?

রাকিবুল হাসান নাঈম:

ইজরাইল এখন মধ্যপ্রাচ্যের সমকামী সম্প্রদায়ের কাছে সবচেয়ে উন্মুক্ত দেশ। সমকামীদের জন্য উন্মুক্ততার কারণে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ শহর তেলআবিব। শহরটি সমকামীদের জন্যে সমুদ্র-সৈকত, নৈশক্লাব এবং প্রকাশ্য নগ্নতার জন্যে বিখ্যাত। আমেরিকান এয়ারলাইন্সের সহযোগিতায় একটি সমকামী ওয়েবসাইট দ্বারা পরিচালিত বিশ্বব্যাপী এক জরিপে দেখা গেছে, ৪৩ শতাংশ সমকামী মানুষের প্রিয় শহর তেল আবিব।

১৯৮৮ সালে দেশটিতে সমকামিতা আইনগতভাবে বৈধতা পায়। ১৯৯২ সালে সমকামী ব্যক্তিদেরকে সামাজিক নিরাপত্তা দিয়ে আইন পাশ করা হয়। ১৯৯৪ সালে সমকামী যুগলদের বিয়ে ছাড়াই একত্রবাসের অনুমতি দেয় দেশটি। ইসরায়েলী সামরিক বাহিনীতে সমকামীদের যোগদানের অনুমতি দেয়া হয় ১৯৯৩ সালে। ২০০৮ সালে সম-লিঙ্গের যুগলদের সন্তান দত্তক নেওয়ার অনুমতি দেয় উচ্চবিচারালয়। ইসরায়েলের সমাজের অধিকাংশ মানুষ যৌনতার ব্যাপারে খুবই উদার এবং তারা সম-লিঙ্গের মানুষের মধ্যে বিয়ে সমর্থন করে। ২০১৭ সালে পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায়, ৭৯ শতাংশ ইজরাইলি সমকামী বিয়েকে সমর্থন করে।

এমনকি তেল আবিব ছাড়িয়ে ইজরাইল-কর্তৃপক্ষ সমকামীদের সমাবেশ ঘটাচ্ছে ফিলিস্তিনের দখলকৃত এলাকাতেও। এক্ষেত্রে হাইফা অঞ্চলে অবস্থিত হারিশের কথা বলা যায়। শহরটি যদিও কট্টর ইহুদিদের, তবুও সমকামীরা সেখানে বেশ সমাদর পাচ্ছে। ইহুদিরা ধর্মীয়ভাবে রক্ষণশীল। তবুও সমকামীতার ক্ষেত্রে তাদের এত অতি উদারতার রহস্য কী?

সমকামীদের আশ্রয় ইজরাইল

দখলদার রাষ্ট্র ইজরাইল যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন এটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের প্রণীত আইন উত্তরাধিকার সূত্রে পায়। তাতে সেই সময়ে বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশের মতো ইজরাইলেও সমকামিতাকে নিষিদ্ধ করা হয়। এর দুই দশক পর প্রথম সমকামী বার তেল আবিবের একটি ব্যক্তিগত অ্যাপার্টমেন্টে খোলা হয়। পশ্চিমা দেশগুলোতেও তখন সমকামিতা ছড়িয়ে পড়েছে। ১৯৭৫ সালে সমকামী অধিকার রক্ষার জন্য প্রথম ইসরায়েলি সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৮ সালকে বলা হয় ইসরায়েলে সমকামী বিপ্লবের বছর। এ বছর বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য নিষিদ্ধ করে সমকামিতাকে বৈধ করার আন্দোলন শুরু হয়। এবং এই আন্দোলন সফলও হয়।

সমকামীরা এরপর সেনাবাহিনীতে অনুমতি পায়। তারা কেবল সেনাবাহিনীতেই আটকে থাকেনি, ইসরায়েলি নেসেটে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রেও পৌছে যায়। উজি এভিন সমকামীদের জন্য প্রথম ইসরায়েলি আইনপ্রণেতা হিসাবে নিযুক্ত হন ২০০২ সালে। ২০২০ সালে যে নেসেট গঠিত হয়, তাতে বিভিন্ন দলের ৬ জন সমকামী মন্ত্রী ছিল। তাতে একজন ছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন লিকুদ পার্টির। অথচ লিকুদ চরমপন্থী ইহুদি গোষ্ঠীর সাথে ঘনিষ্ঠ একটি রক্ষণশীল দল।

ইজরাইল সবসময় কর্তৃত্ববাদী এবং ধর্মীয়ভাবে রক্ষণশীল শাসকদের দ্বারা শাসিত। কিন্তু তারা আরব অঞ্চলে একমাত্র উদারপন্থী দেশ হওয়ার কার্ড খেলছে। তারা আরব বিশ্বের যৌন নিপীড়িত যুবকদের আকৃষ্ট করার জন্য একটি কার্ড হিসাবে তার যৌন উদারতা ব্যবহার করছে। কিছু আরব যুবক ইতিমধ্যে ইজরাইলকে যৌন স্বাধীনতার মরূদ্যান হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। এই যৌন উদারতার মাধ্যমে মূলত তারা তাদের শাসনের ঔপনিবেশিক চেহারা লুকিয়ে রাখে।

ইজরাইলের দিকে আকৃষ্ট হওয়া সবচেয়ে বিখ্যাত আরব মুখের মধ্যে একটি হল মাহমুদা রিয়াদ। তিনি ১৯৪০ এর দশকে দশকে গ্যালিলে একটি আরব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তারপর ইস্রায়েলে ভ্রমণ করেছিলেন। সত্তরের দশকে তিনি জেন্ডার পরিবর্তন করে নিজের আরবি নাম পরিবর্তন করে হিব্রু নাম নাওমি রাখেন। গত জুনে ইসরায়েলি নেসেটের একটি অফিসিয়াল কমিটির সামনে একদল ফিলিস্তিনি সমকামী আশ্রয় চায়। এর কিছুদিন পরই ৯০ জন ফিলিস্তিনি সমকামীকে ইসরায়েলে অস্থায়ী আশ্রয়ের অনুমতি দেয় কর্তৃপক্ষ। প্রথম প্রথম ফিলিস্তিনি সমকামীদের তথ্য ও ভিডিও সংগ্রহ করে তাদের ব্ল্যাকমেইল করতো ইসরায়েলি নিরাপত্তা ও সামরিক গোয়েন্দারা।

সমকামী এবং ট্রান্সজেন্ডার অধিকারকে সমর্থন করার দায়ে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ‘আল-কাওস’ সংগঠনকে নিষিদ্ধ করে ২০১৯ সালে। তখনই আরব সমকামীদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র খোলার পরিকল্পনা করে ইজরাইল। অবশেষে গত ফেব্রুয়ারিতে ইসরায়েলি ভূখণ্ডে সমকামী এবং ট্রান্সজেন্ডার ফিলিস্তিনিদের জন্য প্রথম আশ্রয়স্থল খোলা হয়।

সমকামিতা ইস্যুতে রাষ্ট্র যেভাবে সমর্থন দেয়

২০২২ সালের জুনে কয়েক হাজার ইসরায়েলি এবং বিদেশী সমকামী মিটজপ রমন শহরে একট পদযাত্রায় অংশ নিয়েছিল। তাদের হাতে ছিল রংধনু পতাকা। পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়েছিল দখলদার পুলিশের সুরক্ষায়। নতুবা চিত্রটি এতটা সহজ ছিল না। কারণ, ইজরাইলে সমকামীদের বিরুদ্ধে সর্বাধিক চরমপন্থী ইহুদি গোষ্ঠীগুলোর সুস্পষ্ট হুমকি আছে। এই ইহুদি গোষ্ঠীগুলো মনে করে, উন্মুক্ত যৌনতা দেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করে। শুধু তাই নয়, ২০০৯ সালের আগস্টে তাদের আক্রমণে দুজন সমকামী নিহত হয়। তেল আবিবের একটি সমকামী যুব কেন্দ্রে বন্দুকধারীর গুলিতে ২০১৫ সালের জুলাই মাসে নিহত হয় ১৬ বছরের একটি মেয়ে। সে তার সমকামী বন্ধুদের সমর্থনে জেরুজালেম প্রাইড প্যারেডে অংশ নিতে এসেছিল।

ইজরাইলে সমকামীদের সুরক্ষা দেয় ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ এবং বিশিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা। যেমন ইসরায়েলি নেসেটের স্পিকার মিকি লেভি এক সমকামী সমাবেশে জনতাকে সম্বোধন করে বলেছিলেন, ‘আপনি যাকে চান তাকে ভালবাসার অধিকার আপনার আছে। আপনার অধিকার আছে আপনি যাকে ভালোবাসেন তাকে বিয়ে করার। আপনার অধিকার আছে অন্য সবার মতো পরিবার গড়ে তোলার। এগুলো কোনো সুযোগ-সুবিধা নয়, প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার।’

গত কয়েক বছরে সমকামীদের পক্ষে নতুন প্রকল্প নেয়া হয়েছে ইজরাইলে। সমকামী বা ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের প্রতি স্কুলশিক্ষার্থীদের আচরণ কেমন হবে, নির্দেশিকা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে ইজরাইলের শিক্ষামন্ত্রণালয়। ২০১৬ সাল থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বৈদেশিক কর্মকর্তাদের মাধ্যমে যৌন অভিযোজন এবং লিঙ্গ পরিচয়ের উপর বিভিন্ন কোর্স নিজেদের খরচে আয়োজন করছে। চলতি বছরের শুরুতে সমকামী দম্পতিদের জন্য সারোগেসির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে। ১৯৬৩ সাল থেকে এই ইহুদি রাষ্ট্রে সারোগেসি নিষিদ্ধ ছিল।

সম্প্রতি ইসরায়েলের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদে আসীন হয়েছেন নিতজান হোরোভিটজ। তিনি মূলত সমকামীদের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক। আগে সমকামীরা ইজরাইলে রক্ত ডোনেট করতে পারতো না। কেউ রক্ত দিতে গেলে তাকে জিজ্ঞেস করা হতো, রক্ত দানের ১২ মাস আগ পর্যন্ত তার সমকামী সম্পর্ক ছিল কিনা কিন্তু হোরোভিটজ এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন। বলেন, রক্তের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।

এই যে সমকামিতার পক্ষে ইজরাইলে এত আয়োজন, তার পেছনে অর্থ ঢালছে ইজরাইল কর্তৃপক্ষ। সামাজিক সমতা মন্ত্রণালয় সমকামীদের সুবিধার জন্য এই বছর ২৬.৭ মিলিয়ন ইউএস ডলার বরাদ্দ করেছে। তারা পরিকল্পনা করছে, ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সমকামী প্রকল্প মেইর পার্কে একটি নতুন গে সেন্টার নির্মাণের জন্য ৯.২ মিলিয়ন ইউএস ডলার বরাদ্দ করবে৷

উপসংহার

ইহুদি-ধর্মে অত্যন্ত কঠোরভাবে সমকামিতা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাইবেলের পুরাতন নিয়ম বা তানাখে সমকামিতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘একজন পুরুষের অন্য একজন পুরুষের সঙ্গে স্ত্রীলোকের ন্যায় যৌন সম্পর্ক অবশ্যই থাকবে না। তা হলো ভযঙ্কর পাপ। যদি কোন পুরুষের অন্য এক পুরুষের সঙ্গে একজন স্ত্রীলোকের মত যৌন সম্পর্ক থাকে তবে এই দুজন পুরুষ এক ভযঙ্কর পাপ কার্যে লিপ্ত। তাদের অবশ্যই যেন মেরে ফেলা হয়। তারা তাদের নিজেদের মৃত্যুর জন্য দায়ী’ (লেভিকটাস ১৮:২২)।

ইহুদি ও খ্রিষ্টধর্মে সমকামিতা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আল্লাহর ক্রোধ ও গযবের কারণ। বাইবেলের ভাষ্য হল, মানুষ সমকামী হয়ে সৃষ্টি হয়নি, বরং পাপের কারণে সমকামী হয়। বলা হয়েছে, সেই কারণে ঈশ্বর, অশুদ্ধ যৌনাচারের প্রতি তাদের হৃদয়কে পাপপূর্ণ অভিলাষে সমর্পণ করলেন, যেন পরস্পরের দ্বারা তাদের শরীরের মর্যাদাহানি হয়। তারা ঈশ্বর-বিষয়ক সত্যের পরিবর্তে এক মিথ্যাকে মনোনীত করেছিল। তারা স্রষ্টার উপাসনা না করে সৃষ্ট বস্তুর উপাসনা ও সেবা করেছে—সেই স্রষ্টাই চিরতরে প্রশংসিত হোন। আমেন। এই কারণে, ঈশ্বর তাদের লজ্জাজনক রিপুর অধীনে সমর্পণ করেছেন। এমনকি, তাদের নারীরাও স্বাভাবিক শারীরিক সম্পর্ক পরিবর্তন করে অস্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। একইভাবে, পুরুষেরাও নারীদের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক ত্যাগ করে পরস্পরের প্রতি কামানলে প্রজ্বলিত হয়েছে। পুরুষেরা অন্য পুরুষদের সঙ্গে অশালীন কর্ম করেছে এবং তাদের বিকৃত আচরণের জন্য তারা যোগ্য শাস্তি লাভ করেছে’ (রোমীয় ১:২৪-২৭)।

ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইজরাইল যে গণহত্যার মতো নৃশংসতা চালাচ্ছে, সেই অপরাধ আড়াল করার অংশ হিসেবে তারা সমকামীদের অধিকার তুলে ধরছে। নিজেদেরকে মানবিকতার পক্ষে বলে প্রমাণের চেষ্টা করছে। পাশাপাশি যৌনতার উদারতার দৃশ্য দেখিয়ে আকৃষ্ট করছে বিশ্বব্যাপী সমকামী পর্যটকদের। যদিও সমকামীদের অধিকার রক্ষায় যে-কোনো আইন ইহুদি ধর্মের মূলমন্ত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, তবুও তারা সমকামীদের পক্ষেই কথা বলছে।

তথ্যসূত্র: আল জাজিরা

The post ইহুদি আইনের ওপর উদারতাবাদের জয়: ইজরাইল কেন সমকামীদের গন্তব্য হলো? appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%87%e0%a6%b9%e0%a7%81%e0%a6%a6%e0%a6%bf-%e0%a6%86%e0%a6%87%e0%a6%a8%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%93%e0%a6%aa%e0%a6%b0-%e0%a6%89%e0%a6%a6%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%ac%e0%a6%be/

No comments:

Post a Comment