Saturday, November 12, 2022

দাদা হুজুর: মুফতি শফির একান্ত শাগরেদ হলেন যেভাবে

এহসানুল্লাহ জাহাঙ্গীর

বাংলাদেশের এক যুবক—বি-বাড়িয়ার। দেহাবয়বে ছোটোখাটো হলেও সৌম্যদীপ্ত চেহারা। মুখে সারল্যের চাপ; অথচ হৃদয়ের চেতনার পারদ। উজ্জ্বল সুন্দর রং। দেখতে কেমন মায়াময়। তেজোদীপ্ত হৃদয়ের হয়েও দুরুদুরু বুকে চলছেন—মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী থেকে দাওরায়ে হাদীস শেষ করে পাকিস্তানের দারুল উলুম করাচির পথে। সেখানে হালের শ্রেষ্ঠ মুফতি থাকেন। পাকিস্তানের মুফতিয়ে আজম। দারুল উলুম দেওবন্দের সাবেক প্রধান মুফতি। আমরা যাকে বিখ্যাত তাফসির ‘মাআরেফুল কুরআন’র গ্রন্থকার হিসেবে চিনি—মুফতি শফী রহ.। তিনি তার পরশ পেতে চান। ফিকহের গভীর জ্ঞানে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে চান। তার আদর্শের বিভায় একজন আদর্শবান আলেম হতে চান। হ্যাঁ, সেদিনকার সেই দুরুদুরু বুকের যুবকটির আমাদের উস্তাদে মুহতারাম, আমাদের মহিরুহসম মুরুব্বি, হাজারো বিজ্ঞ মুফতি গড়ার কারিগর, জ্ঞানের নীরব সাধক মুফতি সাদেকুল ইসলাম ( আমাদের দাদা হুজুর)।

তিনি তখন শুধু দারুল উলুম করাচিতে সুযোগ পেয়েছিলেন, তাই নয়; বরং তিনি হয়ে উঠেছিলেন মুফতি শফী রহ.-এর একজন আস্থাভাজন ব্যক্তি। মুফতি শফী রহ.-এর তত্ত্বাবধানে দুই বছরের ইফতা কোর্স সম্পন্ন করার পর মুফতি শফী রহ. কর্তৃক নানুকুয়াড়া মাদরাসার প্রধান মুফতি হিসেবেই নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে যান। নানুকুয়াড়া মাদরাসা ছিল মুফতি শফী রহ. তত্ত্বাবধানে পরিচালিত আরেকটি মাদরাসা। এটা ছিল এক বিস্ময়কর ব্যাপার! এত এত কোর্স সম্পন্নকারী মুফতি থেকে কেন তিনি বাংলাদেশের কর্মজীবনের অনভিজ্ঞ এক যুবককেই বেচে নিলেন নিজের মাদরাসার জন্য। সহজ কথায় বলতে গেলে বলব, ‘স্বর্ণকার খাঁটি সোনা চিনতে কখনো ভুল করেন না।’ মুফতি শফী রহ. ছিলেন হালের শ্রেষ্ঠ ফকিহ। মুফতিয়ে আজম। তিনি তো নিঃসন্দেহে এই ফনের স্বর্ণকার ছিলেন। তার নির্বাচন কী আর ভুল হতে পারে। পরবর্তী জীবনে আমাদের দাদা হুজুর অবশ্য সেই কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। এজন্যই তো দেখা গেছে, যাত্রাবাড়ীর মতো ঢাকার শ্রেষ্ঠ একটি মাদরাসায় আমৃত্যু প্রধান মুফতির দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।

যেই দুই বছর তিনি মুফতি শফী রহ. এর তত্ত্বাবধানে ইফতা পড়েছিলেন, সেই সময় আমাদের দাদা হুজুরের ফতোয়ার তামরীন চূড়ান্ত পর্যায়ে এই মনীষীই দেখতেন। দেখতেন তার ফিকহি প্রবন্ধগুলো। এসব দেখে তিনি বরাবরই তৃপ্তির হাসি হাসতেন। হয়তো ভাবতেন, এক বাঙালি যুবক ফিকহের এমন গভীরতা কীভাবে অর্জন করল! মাঝেমধ্যেই তিনি দাদা হুজুরের উচ্চ প্রশংসা করতেন। বলতেন, ‘মৌলভী সাদেক তো খুব ভালো লেখেন।’ হালজমানার শ্রেষ্ঠ মুফতি থেকে এমন প্রশংসা পাওয়া চাট্টিখানি কথা ছিল না। এই প্রশংসা যে কতটুকু যুক্তিযুক্ত ছিল—এর প্রমাণ রাখলেন তিনি কর্মজীবনের প্রথম বছরেই। নানুকুয়াড়ার প্রধান মুফতি হলেন। এত বড় এক ইফতা তিনি একাই সামলাতে লাগলেন।

সেই সময়ের টুকরো টুকরো অনেক স্মৃতি আছে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় করাচি থেকে সমস্ত বাঙালিকে দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। কিন্তু মুফতি শফী রহ. বললেন, মৌলভী সাদেক এই সিদ্ধান্তের বাহিরে থাকবে। শুধু তাই নয়—এমনকি বলা হয়েছিল, মৌলভী সাদেক যার জন্য বিশেষ সুপারিশ করবেন, সেও এই সিদ্ধান্তের বাহিরে থাকবে। ভাবা যায়, কত বড় মর্যাদা। সেই কঠিন মুহূর্তে—যখন বাঙালিদের নিয়ে সরকারের উপর্যুপুরি চাপ, তখন এমন মর্যাদা। মুফতি শফী রহ. বিভিন্ন সময়ে দাদা হুজুরের কাজের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে তাকে পুরস্কৃত করতেন। একবার দাদা হুজুরের এক ফতোয়ার ওপর সন্তুষ্ট হয়ে এক টাকা পুরস্কার দিয়েছিলেন—কেন জানি এই ঘটনাটা দাদা হুজুর প্রায়শই বলতেন। তাছাড়া বিখ্যাত তাফসির গ্রন্থ ‘তাফসিরে মাআরেফুল কুরআন’-এ তিনি কার্যত অংশগ্রহণ করেছিলেন। মুফতি শফী রহ. এর কামরায় যে কোনো সময় যে কারো যাওয়ার অনুমতি ছিল না। কিন্তু আমাদের দাদা হুজুরকে তিনি সেই অনুমতি দিয়ে রেখেছিলেন।

মুফতি রফি উসমানী, তকি উসমানীর সঙ্গেও দাদা হুজুরের বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। মুফতি রফি উসমানী হাফি.-এর কাছে দাদা হুজুর সিরাজী কিতাব পড়েছিলেন। সেই সুবাদে উস্তাদ হলেও রফি সাহেব সবসময়ই দাদা হুজুরকে তার মহব্বতের কথা বলতেন। দাদা হুজুর অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় ফারায়েজ যেন আরেকটু বেশিই বুঝতেন। তার ফারায়েজের জ্ঞান দেখে রফি উসমানী সাহেব পুরস্কৃত করেছেন বহুবার— অনেকের কাছে শুনেছি। মুফতি তকি উসমানী হাফি.র কাছে দরসান কোনো কিতাব না পড়লেও ইংরেজির একটা কোর্স করেছিলেন—বলে দাদা হুজুর নিজেই বলেছিলেন। এজন্য দাদা হুজুরকে বেশ তৃপ্তির সঙ্গে একথাও বলতে শুনেছি—তকি উসমানী সাহেব আমার উস্তাদ। একবার দাদা হুজুরকে এক ছাত্র জিজ্ঞেস করল, হুজুর—ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ব্যাপারে তো মুফতি তকি উসমানী সাহেব অনেক বেশি ছাড় দেন। আবার এদিকে আব্দুস সালাম চাটগামীকে দেখি, ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার ঘোর বিরোধী। তখন দাদা হুজুর উত্তর দিয়েছিলেন, দেখো—তকি উসমানী সাহেব একজন মুহাক্কিক আলেম। তিনি বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গবেষণা করে উম্মতের জন্য সহজ করেন। তবে আব্দুস সালাম চাটগামীর অবস্থানই বেশি যথার্থ। যদি উনারটা মানা যায়, তাহলেই ভালো। তবে যদি কেউ অপারগ হয়, সেক্ষেত্রে তকি উসমানী সাহেবের মতামত অনুযায়ী আমল করতে পারে।

পাকিস্তানের দারুল উলুম করাচিতে এক বছরের খেদমতের পর তিনি দেশে চলে আসেন। দেশে এসে বি-বাড়িয়ার জামিয়া ইউনুসিয়ায় খেদমতে নিয়োজিত হন। কিন্তু মাওলানা মাহমুদুল হাসান সাহেব—শায়েখে যাত্রাবাড়ী তাকে জামিয়া ইউনুসিয়া থেকে জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া যাত্রাবাড়ী বড় মাদ্রাসায় নিয়ে আসেন। তখন থেকেই তিনি আমৃত্যু যাত্রাবাড়ীতে খেদমত করে গেছেন। যাত্রাবাড়ী মাদরাসার ইফতা বিভাগ খোলার পর থেকেই তিনি এর প্রধান মুফতি। এমনকি মুফতি কামাল উদ্দিন আহমদ রাশেদি সাহেব যাত্রাবাড়ী ইফতা বিভাগের মুশরিফ থাকাকালীনও আমাদের দাদা হুজুর ছিলেন প্রধান মুফতি। তার জীবন ছিল এক বিস্তৃত সরোবর। সেখান থেকেই তিনি আজীবন ছাত্রদের জলের মতো ইলম বিলিয়ে গেছেন। দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন হাজার হাজার বিজ্ঞ আলেম। প্রজ্ঞাবান মুফতি। যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় যত বিজ্ঞ আলেম— তাদের প্রায় সবাই দাদা হুজুরের ছাত্র। যাত্রাবাড়ীর মুরব্বি উস্তাদরাও দাদা হুজুরের ছাত্র। এজন্যই মূলত তিনি ‘দাদা হুজুর’ নামে পরিচিত।

গতকাল হঠাৎ করেই এভাবে রবের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যাবেন—কে জানত। কত না জানা কথা ছিল তার কাছে। কত স্মৃতি, কত ইতিহাস—সবই তিনি নিয়ে চলে গেলেন নিজের সঙ্গে করে। গত সপ্তাহে তিনি মাদরাসায় এসেছিলেন। এবার কী মনে করে যেন আমাদের সবাইকে কাছে ডাকলেন। নিজের জন্য বিশেষভাবে দুয়া চাইলেন। একটা আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের কথাও হুজুরকে বলা হয়েছিল। হুজুর অনেকটাই সায় দিয়েছিলেন। হুজুরের আহলিয়া বাড়ি চলে যেতে চাপাচাপি করছিলেন। তাই মাদরাসায় থাকার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও থাকতে পারলেন না। এটাই যে মাদরাসার শেষ সফর ছিল—কে জানত। আল্লাহ আমাদের দাদা হুজুরকে জান্নাতবাসী করুন।

The post দাদা হুজুর: মুফতি শফির একান্ত শাগরেদ হলেন যেভাবে appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%a6%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a6%be-%e0%a6%b9%e0%a7%81%e0%a6%9c%e0%a7%81%e0%a6%b0-%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%ab%e0%a6%a4%e0%a6%bf-%e0%a6%b6%e0%a6%ab%e0%a6%bf%e0%a6%b0-%e0%a6%8f%e0%a6%95%e0%a6%be/

No comments:

Post a Comment