Wednesday, November 25, 2020

সিলেটের পূণ্যভূমিতে যেভাবে এলো ইসলাম

মুনশী নাঈম:

আধ্যাত্মিক রাজধানী হিসেবে খ্যাত উত্তর-পূর্ব বাংলাদেশের একটি প্রধান শহর সিলেট। হিন্দু রাজ উৎখাত করে এ জেলায় মুসলিম শাসন কায়েম করেছিলেন হযরত শাহজালাল রহ. ও হযরত শাহ পরান রহ.। আধ্যাত্মিকতার হাওয়ায় এ জেলাকে সতেজ প্রাণ দিয়েছিলেন ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনের অন্যতম সিপাহসালার শাইখুল ইসলাম আল্লামা হোসাইন আহমদ মাদানি রহ.। জান্নাতি সুঘ্রাণে আমোদিত করেছেন আল্লামা মুশাহিদ বায়ামপুরী রহ.। সিলেট জেলাকে আলোকিত করেছেন আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী, শাইখুল হাদীস.আল্লামা হাফিজ নুরউদ্দিন আহমদ গহরপুরী, আল্লামা আব্দুল করিম শায়েখে কৌড়িয়ার মতো মহান মনীষীরা। একটা ধর্মীয় আবহাওয়া এ জেলার পরতে পরতে ছড়ানো। আলেম-উলামা, মসজিদ-মাদরাসা, মাজার-খানকা এ জেলাকে দিয়েছে আলাদা মাহাত্ম্য।

পুরনো কাগজপত্রে সিলেটকে বাংলায় শ্রীহট্ট লেখা। এই নামকরণের বিষয়ে একটি প্রচলিত কিংবদন্তী হলো, হযরত শাহজালাল যখন শ্রীহট্টের দিকে আগমন করেন তখন তৎকালীন হিন্দু রাজা গৌড়গোবিন্দ তার আগমন থামাতে শ্রীহট্ট সীমান্তে তার কথিত জাদু ক্ষমতার দ্বারা পাথরের দেয়াল বা পাহাড়ের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন। হযরত শাহজালালও তার অলৌকিক ক্ষমতা দিয়ে ‘শিল হট্’ বলতেই সেই শিল বা পাথরের প্রতিবন্ধক হটে যায় বা অপসারিত হয়। এ থেকেই এই ভূমির অন্য নাম হয়েছে শিল-হট থেকে সিলেট।

ভারতের সরকারি নথিপত্রে যেমন আসাম গেজেটিয়ারে (Assam District Gazetteers) বা অন্যত্র শ্রীহট্টকে ইংরেজিতেই প্রথম ‘সিলহেট’ (Sylhet) হিসেবে উদ্ধৃত হতে দেখা যায়। তৎকালীন ভারতবর্ষে শাসক হিসেবে আধিপত্যকারী ব্রিটিশদের নিজস্ব ইংরেজি উচ্চারণে অন্য অনেক বাংলা যুক্তশব্দের বিবর্তন প্রক্রিয়ার মতোই ‘শ্রীহট্ট’ শব্দটিও যে ভিন্নমাত্রিক ‘সিলহেট’ শব্দে বিবর্তিত হয়ে বর্তমান ‘সিলেট’-এ রূপান্তরিত হয়েছে, এই ব্যাখ্যাই যুক্তিসঙ্গত মনে হয়।

নামকরণের গল্পটি কিংবদন্তি হলেও এ থেকে সিলেটে মুসলিমর রাজ কায়েমের একটা ইতিহাস-আভাস পাওয়া যায়।

যেভাবে এলো ইসলাম

স্থলপথ জলপথ উভয় পথেই আরবগণ তাদের ব্যবসা পরিচলনা করতো। উটের সাহায্যে স্থলপথে এবং নৌযানের সাহায্যে তারা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে দেশ থেকে দেশান্তরে ভ্রমণ করতো। প্রাক ইসলামি যুগেই তারা একদিকে সমুদ্র পথে অবিসিনিয়া এবং অপরদিকে সুদূর প্রাচ্য চীন পর্যন্ত তাদের ব্যবসার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করেছিল। আরব থেকে চীনের মাঝপথে তাদের কয়েকটি ঘাঁটিও ছিল। এ পথে তাদের প্রথম ঘাঁটি ছিল মালাবার। মালাবার মাদ্রাজ প্রদেশের সমুদ্রতীরবর্তী একটি জেলা। তারা হরহামেশাই মালাবারের ওপর দিয়ে চট্টগ্রাম এবং সেখান থেকে সিলেট হয়ে চীন দেশ যাতায়াত করতেন। এ জায়গাগুলোকে তারা ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতো। এ থেকেই প্রতীয়মান হয় যে, প্রাক ইসলামি যুগেই মালাবার , চট্রগ্রাম. সিলেট প্রভৃতি জায়গায় আরবদের বসতি গড়ে উঠেছিল।

ইসলাম আসার পর আরব বণিকদের মাধ্যমেই মালাবারে ইসলামের প্রচার হয়। মুসলমান ব্যবসায়ীদের সাহচর‌্য ও সান্নিধ্য এ অঞ্চলের অমুসলিমদেরকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করে। তারা দলে দলে মুসলমান হয়। মালাবার হিজরি প্রথম শতকেই ইসলামের ছোঁয়া পেয়েছিল। তবে চট্টগ্রাম এবং সিলেট কি সমসাময়িক কালেই সেই স্পর্শ পেয়েছিল নাকি আরও পরে এ নিয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য দেয়া কঠিন। তবে অষ্টম-নবম শতকে চট্টগ্রামের সঙ্গে আরব বণিকদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠে এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

সিলেট ইসলামের আলো আগে পেলেও এতে মুসলিম বিজয় সূচিত হয় চৌদ্দশ শতাব্দীতে। তবে এর পূর্বে ১২১২ সালে কৈলাসগড়ে এবং ১২৫৪ সালে আজমিরিগঞ্জে মুসলিম শাসকগণ ব্যর্থ আক্রমণ করেছেনে। সফলতা আসে চৌদ্দশ শতাব্দীর অভিযানে।

মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা

খ্রিস্টিয় দশম শতকে শ্রীহট্ট লাউড়, জয়ন্তীয়া ও গৌড় নামে তিনটি স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত ছিল। উক্ত রাজ্যগুলোর মধ্যে গৌড় অন্যতম রাজ্য হিসেবে বিবেচিত ছিল। এ রাজ্যে প্রাচীন সীমা রেখা বিস্তৃত ছিল বর্তমান মৌলভীবাজার জেলাসহ হবিগঞ্জ জেলার কিয়দংশ নিয়ে। গৌড়ের অধিপতি ছিল গোবিন্দ। তাই তাকে বলা হতো গৌড় গোবিন্দ। সে ছিল জালিম হিন্দু রাজা ,অত্যন্ত বদমেজাজী এবং জাদু বিদ্যায় পারদর্শী। তার রাজ্যে গরু জবেহ করা ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সময়টা ১৩১৩ খৃ.।

গৌড় রাজ্যের টুরটিকর অধিবাসী বুরহান উদ্দীন নামক জনৈক মুসলমান নিজ ছেলে গুলজারে আলমের আকিকা উপলক্ষে গরু জবাই করে গৌড়ের হিন্দু রাজা গৌড় গোবিন্দের কাছে অপরাধী সাব্যস্ত হন। এ কারণে, গোবিন্দ বুরহান উদ্দীনের শিশু ছেলেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। ছেলে হত্যার দৃশ্য দেখে হযরতের স্ত্রী জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন যা আর কোন দিন ফেরেনি। স্ত্রী-ছেলে দাফন করে রাতের অন্ধকারে হয়রত বুরহান উদ্দিন পায়ে হেটে রওয়ানা দেন সোনারগাঁওয়ের উদ্দেশ্যে। উনি চলে আসার পর বাকী মুসলমানদের রাজা গৌর গোবিন্দ নৃশংসভাবে হত্যা করেন। সে সময় সোনারগাঁওয়ের শাসনকর্তা ছিলেন শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ্। বুরহান উদ্দিনের মুখে রাজা গৌর গোবিন্দের অত্যাচারের কাহিনী শুনে তাকে শায়েস্তা করার জন্য সিকান্দার শাহকে সেনাপতি করে একদল সৈন্য প্রেরণ করেন সিলেট অভিমুখে। কিন্তু গোবিন্দের যাদু বিদ্যার কারণে অভিযান ব্যর্থ হয় এবং অনেক সৈন্য মৃত্যুবরণ করেন।

এদিকে তরফে হিন্দু নেতার রাজ্যে বাস করতেন নুরুদ্দিন নামক এক মুসলমান। তিনি নিজের ছেলের বিয়ে উপলক্ষে গরু জবাই করেন। হিন্দু রাজা তাকে হত্যা করেন। নুরুদ্দিনের ভাই কিছুদিন দিল্লিতে ছিলেন। এই ঘটনার পর তিনি দিল্লি এসে সম্রাটকে সবকিছু খুলে বলেন। অন্যদিকে বুরহানুদ্দিনও দিল্লিতে আসেন অভিযোগ নিয়ে। এ সময় দিল্লির আসনে সমাসীন ছিলেন আলাউদ্দিন-খিলজি (শাসন কাল:১২৯৬-১৩১৬)। তিনি ছিলেন খিলজি বংশের দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে শক্তিশালী শাসক।

আলাউদ্দিন খিলজি রাজা গৌর গোবিন্দকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের জন্য ভাগিনা সিকান্দার গাজীকে সেনাপতি করে সিলেট অভিমুখে এক সৈন্য বাহিনী প্রেরণ করেন। ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরের কাছে আসলে বর্ষা শুরু হয়। সৈন্যবাহিনী অধিকাংশ সৈন্য ছিলেন তুর্কী। আবহাওয়াগত কারণে অধিকাংশ সৈন্য জ্বর, সর্দি ও আমাশয় এ আক্রান্ত হন এবং অনেকেই মৃত্যুমুখে পতিত হন।

প্রথম দফায় অভিযান ব্যর্থ হলে সম্রাট দক্ষ সেনাপতি নির্বাচনের জন্য ঐ সময়ের প্রখ্যাত মজ্জুবদের নিকট পরামর্শ গ্রহণ করে সৈয়দ নাসির উদ্দিনকে সেনাপতি নির্বাচন করেন। নাসির উদ্দিন সেনাপতির দায়িত্ব পেয়ে উনার পীরজাদা হযরত নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার কাছে যান দোয়া চাইতে। সেখানে দেখতে পান হযরত শাহজালাল মুজররদ পীর ইয়ামেনী রহ.কে। তিনি তার অনুসারীদের নিয়ে নিজাম উদ্দিন রহ. এর দরবারে অবস্থান করছেন। নিজাম উদ্দিন রহ. এর নিকট থেকে বিদায় নিয়ে সৈয়দ নাসির উদ্দিন যুদ্ধের জন্য যাত্রা করেন। সাথে বুরহান উদ্দিন এবং ২৪০ জন সঙ্গীসহ হজরত শাহ জালাল। পথে পথে শাহ জালালের শিষ্য বর্ধিত হতে লাগল । ত্রিবেণী থেকে বিহার প্রদেশে আসার পর আরো কয়েকজন অনুষঙ্গী হলেন। যাদের মধ্যে হিসাম উদ্দীন, আবু মোজাফর উল্লেখযোগ্য। এখান থেকে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের আনিত এক হাজার অশ্বারোহী ও তিন হাজার পদাতিক সৈন্যসহ শাহ জালাল নিজ সঙ্গীদের নিয়ে সোনারগাঁ অভিমুখে সিকান্দর গাজীর সাথে মিলিত হওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।

শাহ জালাল সোনারগাঁ আসা মাত্রই শাহ সিকান্দর গাজীর সাথে সাক্ষাৎ ঘটল। সিকান্দর গাজী শাহ জালালকে সসম্মানে গ্রহণ করলেন । শাহ জালাল তার সঙ্গী অনুচর ও সৈন্যসহ শাহ সিকান্দরের শিবিরে সমাগত হয়ে সিকান্দর হতে যুদ্ধ বিষয়ে সব বিষয় অবগত হন। সিকান্দর শাহ জালালের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শিষ্যগ্রহণপূর্বক সিলেট অভিমুখে যাত্রা করলেন। এভাবে শাহ জালালের শিষ্য সংখ্যা বেড়ে ৩৬০ জনে পৌঁছায়। এদিকে গৌড় গৌবিন্দ নিজস্ব চর দ্বারা শাহ জালালের সমাগম সংবাদ পেয়ে; নতুন এ দল যাতে ব্রহ্মপুত্র নদী পার না হতে পারেন, সে জন্য নদীর সমস্ত নৌ-চলাচল বন্ধ করে দেয়। শাহ জালালের ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে, তিনি তার শিষ্যদের নিয়ে বিনা বাধায় জায়নামাজের সাহায্যে ব্রহ্মপুত্র নদী অতিক্রম করেন।

গৌড় রাজ্যের দক্ষিণ সীমাভূমি নবীগঞ্জের দিনারপুর পরগণার পাশে রাজা গোবিন্দের চৌকি ছিল। শাহ জালাল তারসঙ্গীদের নিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদী পার হয়ে প্রথমত সেখানে অবস্থান করেন। এখানে গৌড়ের সীমান্ত রক্ষীরা অগ্নিবাণ প্রয়োগ করে তাদেরকে প্রতিহত করতে চায়; কিন্তু মুসলমান সৈন্যের কোন ক্ষতি করতে পারেনি। গোবিন্দ সমস্ত বিষয় অবগত হয়ে উপায়ান্তর না পেয়ে বরাক নদীতে নৌকা চলাচল নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে। শাহ জালাল পূর্বের মতো জায়নামাজের সাহায্যে বরাক নদী পার হন। বরাক নদী পারাপারে বাহাদুরপুর হয়ে বর্তমান সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলায় ফতেহপুর নামক স্থানে রাত্রিযাপন করেন। উল্লিখিত তথ্য-সম্বলিত প্রাচীন গ্রন্থ তোয়ারিখে জালালীতে উল্লেখ আছে:

চৌকি নামে ছিল যেই পরগণা দিনারপুর
ছিলটের হর্দ্দ ছিল সাবেক মসুর
সেখানে আসিয়া তিনি পৌছিলা যখন
খবর পাইলা রাজা গৌবিন্দ তখন ।
এপারে হজরত তার লস্কর সহিতে
আসিয়া পৌছিলা এক নদীর পারেতে
বরাক নামে নদী ছিল যে মসুর
যাহার নিকট গ্রাম নাম বাহাদুরপুর।
যখন পৌছিলা তিনি নদীর কেনার
নৌকা বিনা সে নদীও হইলেন পার।

সর্ব প্রকার কলাকৌশল অবলম্বন করে রাজা গৌড়গোবিন্দ যখন দেখলেন সকল প্রয়াসই বিফল হচ্ছে, তখন শেষ চেষ্টা করার লক্ষে জাদুমন্ত্রসহ এক প্রকাণ্ড লৌহধনুক শাহ জালালের কাছে প্রেরণ করে; যার শর্ত ছিল যদি কেহ একা উক্ত ধনুকের জ্যা ছিন্ন করতে পারে তখন গোবিন্দ রাজ্য ছেড়ে চলে যাবে। শাহ জালাল তার দলের লোকদের ডেকে বললেন, যে ব্যক্তির সমস্ত জীবনে কখনও ফজরের নামাজ কাযা হয়নি বা বাদ পড়েনি একমাত্র সেই পারবে গোবিন্দের লৌহ ধনুক ‘জ্যা’ করতে। অতপর মুসলিম সৈন্যদলের ভেতর অনুসন্ধান করে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনকে উপযুক্ত পাওয়া গেল এবং তিনিই ধনুক ‘জ্যা’ করলেন।

উত্তর-পূর্ব ভারতের বরাক নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করার সময় সুরমা ও কুশিয়ারা নদীতে বিভক্ত হয়ে যায়। সিলেট বিভাগের বেষ্টনী হিসেবে ধর্তব্য এ নদীগুলো প্রাচীন কালে প্রবল স্রোতে প্রবাহিত হত। বর্ষাকালের দৃশ্য প্রায় সাগরের মত দেখাতো। ঐতিহাসিক পর্যটক ইবন বতুতা সুরমা নদীকে নহরি আজরফ বলে আখ্যায়িত করেছেন । শাহ জালাল ফতেপুর হতে যাত্রা করে যখন সুরমা তীরে অবস্থান নিলেন, এ নদী পার হয়েই গৌড়ের রাজধানী। শাহ জালাল আউলিয়ার কেরামতি ও আলৌকিক বিভিন্ন ঘটনায় রাজা গোবিন্দ বীতশ্রদ্ধ হন। গোবিন্দ শক্রবাহিনীকে কিছু সময় ঠেকিয়ে রাখার জন্য সুরমা নদীতে নৌকা চলাচল নিষিদ্ধ করেন। তা সত্ত্বেও শাহ জালাল নদী পার হন।

শাহ‌ জালাল বিসমিল্লাহ বলে সকল মুরিদকে নিয়ে জায়নামাজে করে, অনায়াসে গেলেন চলে নদীর ওপারে। গোবিন্দ গড়দুয়ারস্থিত রাজবাড়ি পরিত্যাগ করে পেচাগড়ের গুপ্তগিরি দুর্গে আশ্রয় নেন। এরপর থেকে তার আর কোন হদিস মেলেনি। শাহ জালাল তিন দিন সিলেটে অবস্থান করার পর, মিনারের টিলায় অবস্থিত রাজবাড়ি প্রথমে দখল নিলেন। সিলেট শহরে সর্বপ্রথম হযরত শাহজালাল এর আদেশে সৈয়দ নাসিরুদ্দিন সিপাহসালার আজান দেন। সিলেটে কায়েম হয় মুসলিম রাজ।

শাহ‌ জালাল রহ. এর আধ্যাত্মিক ক্ষমতার প্রভাবে ও তার অনুসারী ৩৬০ জনের মাধ্যমে আরো অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। পরবর্তীতে তা দেশের অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়ে। তার দরগাহ সিলেটের একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়। একসময় তার নামানুসারে এ অঞ্চল জালালাবাদ নামে পরিচিত হয় । হযরত শাহ পরান ও শাহ কামাল কাহাফানের সান্নিধ্যে এসেও অনেকে বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল।

বর্তমান সিলেটের জনসংখ্যা

২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী সিলেট মহানগরের জনসংখ্যা ছিল ৫৩১,৬৬৩ জন। (সিটি কর্পোরেশন এলাকার জনসংখ্যা ছিল ৪৭৯৮৩৭ জন), যা জাতীয় মোট জনসংখ্যার ২.২৫%। এর মধ্যে ২৮৫,৮৯২ জন পুরুষ এবং ২৪৫,৮২১ জন নারী। নারী ও পুরুষের লিঙ্গ অনুপাত ১০০:১১৬, যেখানে জাতীয় লিঙ্গ অনুপাত হল ১০০.৩ এবং জাতীয় শহুরে লিঙ্গ অনুপাত হল ১০৯.৩। ২০১১ সালে তথ্য অনুযায়ী স্বাক্ষরতার হার ৬৭.৬%, যেখানে জাতীয় শহুরে স্বাক্ষরতার হার ৬৬.৪% এর চেয়ে বেশি। সিলেট শহরে ১০৬,১০৭টি খানা বা পরিবার রয়েছে।

শহরের জনংখ্যার ৮৭.৭৭% মুসলমান, ১২.৬৩% হিন্দু, ০.০৯% খ্রিস্টান, ০.০৬% বৌদ্ধ এবং ০.০৭% অন্যান্য ধর্মের অনুসারী। বাংলাদেশ ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র হওয়ায় এখানে নাস্তিক বা ধর্মহীনদের কোন পরিসংখ্যানগত তথ্য নেই।

সিলেট মহানগরী সিলেট সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক শাসিত হয়। সিলেট সিটি কর্পোরেশন ২৭টি ওয়ার্ড ও ২৩৬টি মহল্লায় বিভক্ত। সিটি কর্পোরশেন এলাকার আয়তন ২৬·৫০ বর্গ কিলোমিটার। ২০০১ সালের ৯ এপ্রিল সিলেট শহরকে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের অধীন করা হয়। সিলেট শহর হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেটের বিভাগীয় শহর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সিলেট সিটি কর্পোরেশন মূলত সিলেট শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, রাস্তা নির্মাণ, ট্রাফিক পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ, নিবন্ধনসহ আরো অনেক কাজে সংশ্লিষ্ট কাজ সম্পাদন করে। কর্পোরেশনের মেয়র ও ২২জন কমিশনার পুরো শহরের সব ধরনের উন্নয়নের কাজ করে থাকেন।

ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপনা ও নিদর্শন

ভূমিকম্পের কারণে সিলেটের অনেক উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপনা ধ্বংস হয়ে গেছে। তারপরও কালের সাক্ষী হয়ে যেগুলো দাঁড়িয়ে আছে, তারমধ্যে কয়েকটি হলো:

১. হজরত শাহজালালের দরগাহ। আম্বরখানা থেকে সরকারী আলিয়া মাদরাসা পর্যন্ত ব্যাপ্ত এলাকা জুড়ে তার মাজার। একে দরগাহ বলে। তার মাজার এলাকা সহ পার্শ্ববর্তী বেশ কিছু অঞ্চল দরগাহ গেইট নামে পরিচিত।

২. পাঠান ও মুঘল আমলে সিলেটের তৈরী ঢাল বিখ্যাত ছিলো। সিলেটের লামাবাজারের পশ্চিমে ঢালকর পাড়ার তৈরী ঢাল সারা ভারতবর্ষে রপ্তানি হতো।

৩. প্রাচীন শিলালিপি: বালাগঞ্জের বুরুঙ্গা বাজারের পশ্চিমে তিলাপাড়া গ্রামে একটি প্রাচীন মসজিদ আছে। ইলিয়াস শাহি বংশের স্বাধীন সুলতান নাসিরুদ্দিন শাহ (১৪৪২) এর দৌহিত্র শামসুদ্দিন মুহাম্মদ ইউসুফ সাহ (১৪৮১) এর উজির মালিল উদ্দিন ওরফে মালিক সিকান্দার এই মসজিদ নির্মাণ করেন। ১৪৭৯ সালে নির্মিত এই মসজিদের নিচ থেকে একটি প্রাচীন শিলালিপি উদ্ধার হয়। শিলালিপিটি বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক শ্রী চৈতন্যের জন্মের ৬ বছর পূর্বের।

৪. চাঁদনি ঘাটের সিঁড়ি: বড়লাট নর্থব্রুক সিলেটে আসেন। বড়লাটকে অভিনন্দন জানাতে সুরমা নদীর চাঁদনীঘাটে দৃষ্টিনন্দন দীর্ঘ সিড়ি নির্মাণ করা হয়। এটিই চাঁদনী ঘাটের সিঁড়ি।

৫. ব্রাহ্মমন্দির: রাজা রামমোহন পরবর্তী সিলেটে ব্রাহ্ম সমাজ গড়ে উঠেছিল। তারাই বন্দর বাজারে ব্রাহ্ম মন্দির নির্মাণ করে ১৮২২ খৃস্টাব্দে। বর্তমান সিলেটে এই সম্প্রদায়ের অস্তিস্ত নেই।

৬. মুসলিম সাহিত্য সংসদ: সিলেট দরগা গেইট এলাকায় কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ অবস্থিত। ১৯৪৯ সালের ২৪ এপ্রিল এটা স্থাপিত হয়। তবে ১৯৩৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর এর প্রথম কমিটি গঠিত হয়। সম্প্রতি এই ভবন ভেঙে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এর উঠানে একটি প্রচীন শিলালিপি লম্বভাবে দণ্ডায়মান অবস্থায় দেখা যায়।

৭. ওসমানি জাদুঘর: নগরীর নাইওরপুলে এ জাদুঘর অবস্থিত। ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের অধীনে এই জাদুঘর উদ্বোধন হয়।

৮. প্রাচীনতম রাস্তা: সিলেট-শিলং রাস্তাটি প্রাচীনতম রাস্তা। বর্তমানে এটি সিলেট তামবিল সড়ক নামে পরিচিত।

৯. ক্বীন ব্রিজ: ১৯৩৬ সালে দক্ষিণ দিক থেকে সিলেটের প্রবেশদ্বারে এই ব্রিজ অবস্থিত। ইংরেজ গভর্নর মাইকেল ক্বীনের নামে নাম। দৈর্ঘ ১১৫০ ফুট,প্রস্থ ১৮ ফুট।

১০. মালনীছড়া চা বাগান: ইংরেজ সাহেব হার্ডসন ও তার ভাই ১৮৫৪ সালে এই বাগান তৈরী করেন। এটি সিলেটের প্রথম চা বাগান। বর্তমানে এর আয়তন ২৫০০ একর। শহরের কাছে বিমানবন্দরের পাশে অবস্থিত।

১১. সারদা হল: সুরমা নদীর তীরে ১৯১৬ সালে এটি প্রতিষ্ঠা হয়। এটি সিলেটের প্রথম মিলনায়তন।

১২. শাহজালাল সেতু: ১৯৮৪ সালে ১৯৩৮ ফুট দীর্ঘ এবং ৪৪ ফুট প্রশস্ত সেতুটি তৈরী হয়।

১৩. শাহ পরানের মাজার: এটি শাহজালালের অন্যতম সঙ্গী শাহ পরানের সমাধি। এটি সিলেট শহরের পূর্বদিকে খাদিমনগর এলাকায় অবস্থিত।

১৪. গাজী বুরহানুদ্দিনের মাজার: সিলেট পৌরসভার আওতাধীন কুশিঘাট এলাকায় গাজী বুরহানুদ্দিনের মাজার অবস্থিত। তাকে সিলেট বিভাগের প্রথম মুসলমান বলা হয়।

১৫. শাহী ঈদগাহ: সিলেট শহরের উত্তর সীমায় শাহী ঈদগাহ বা ঈদগাহ মাঠের অবস্থান। বাংলাদেশের প্রাচীনতম ঐতিহাসিক স্থাপনা সমুহের মধ্যে ১৭০০ সালের প্রথম দিকে নির্মিত সিলেটের শাহী ঈদগাহকে গণ্য করা হয়। ১৭০০ সালে প্রথম দশকে সিলেটের তদানীন্তন ফৌজদার ফরহাদ খাঁ নিজের ব্যক্তিগত উদ্যোগে, তদারকি ও তত্বাবধানে এটি নির্মাণ করেন। প্রতি বছর ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা উপলক্ষে এখানে বিশাল দুটি ঈদ জামাত অনুষ্টিত হয় এবং প্রায় দেড় থেকে দুই লাখ মুসল্লী এক সাথে এখানে ঈদের নামাজ আদায় করে থাকেন। উলেখ্য যে, সিলেট শহরের এ স্থানটি নানা কারণে মানুষের কাছে আকর্ষণীয় ও স্মরণীয়। ১৭৭২ সালে ইংরেজ বিরোধী ভারত – বাংলা জাতীয়তাবাদীর প্রথম আন্দোলন সৈয়দ হাদী ও মাদী কর্তৃক এই ঈদগাহ মাঠেই শুরু হয়েছিল।

১৬. জিতু মিয়ার বাড়ি: জিতু মিয়ার বাড়ি হল সিলেটের জায়গীরদার খান বাহাদুর আবু নছর মোহাম্মদ এহিয়া ওরফে জিতু মিয়ার আবাসস্থল। এটি সিলেটের অন্যতম প্রধান দর্শনীয় স্থাপনা। এই বাড়ীটি সিলেট নগরীর শেখঘাটে কাজীর বাজারে অবস্থিত। পূর্বে এটি বর্তমান কাজীর বাজার পশুর হাটের স্থলে অবস্থিত ছিলো যা ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ হলে ১৯১১ সালে বর্তমান স্থানে স্থানাস্তর ও সংস্কার করা হয়।

মূল বাড়ীটি জিতু মিয়ার বাবা মাওলানা আবু মোহাম্মদ আবদুর কাদির ১৮৮৬ সালে নির্মাণ করেন। ১৮৯৭ সালের প্রলয়ঙ্করকারী ভূমিকম্পে সিলেট ও আসামের অধিকাংশ স্থাপনার মতো এটিও ক্ষতিগ্রস্থ হলে ১৯১১ সালে জিতু মিয়া বাড়িটির সামনের অংশে একটি নতুন দালানটি নির্মাণ করেন; যা বর্তমানে মূল ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি একটি দ্বিতল ভবন, যা চুন ও সুরকি দিয়ে মুঘল আমলের মুসলিম স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। বাড়ীটির মোট ভূমির পরিমাণ ১ দশমিক ৩৬৫ একর।

তথ্যসূত্র:

১. বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি: সিলেট, বাংলা একাডেমি
২. শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত, পূর্ব্বাংশ, দ্বিতীয় ভাগ, শ্রী অত্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি প্রণীত, কলকাতা
৩. বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, আব্বাস আলী খান, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার
৪. biographical encyclopedia of sufis By N. Hanif
৫. শ্রীহট্টে ইসলাম জ্যোতি, মুফতি আজহারুদ্দিন সিদ্দিকী, উৎস প্রকাশন

The post সিলেটের পূণ্যভূমিতে যেভাবে এলো ইসলাম appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%b8%e0%a6%bf%e0%a6%b2%e0%a7%87%e0%a6%9f%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%aa%e0%a7%82%e0%a6%a3%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%ad%e0%a7%82%e0%a6%ae%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a7%87-%e0%a6%af%e0%a7%87%e0%a6%ad%e0%a6%be/

No comments:

Post a Comment