Friday, November 27, 2020

তাঁরা সিলেটের গরবের ধন

মুনশী নাঈম:

হজরত শাহজালাল, শাহপরাণ ও শায়খুল ইসলাম সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানি রহ. এর স্মৃতিবিজড়িত সিলেটের পূণ্যভূমিতে জন্মগ্রহণ করেছেন অনেক মনীষী। যারা ইলম, আমল, তাকওয়া ও এখলাস দিয়ে দেশে দেশে সর্বসাধারণকে সত্যের রাহনুমায়ি করেছেন, নববি শিক্ষাদীক্ষার আলোর ধারায় হৃদয় তাদের সিঞ্চিত করেছেন। সিলেটের সেই গরবের ধনদের নিয়ে আজকের এই পর্ব। এই পূণ্যভূমিতে জন্মগ্রহণ করেছেন অসংখ্যা উলামায়ে কেরাম। তাদের সবার কথা বলতে গেলে বিরাট বইয়ের দরকার। এখানে উল্লেখযোগ্য দশজনের পরিচিতি তুলে ধরা হলো।

আল্লামা সাইয়েদ হুসাইন আহমদ মাদানি

ভারতবর্ষের মুসলমানের বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক পথনির্দেশক ছিলেন আল্লামা সাইয়েদ হুসাইন আহমদ মাদানি রহ.। তিনি ১৯ শাওয়াল ১২৯৬ হিজরিতে ১৮৭৯ ইং সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের ‘উন্নাও’ জেলার ‘বাঙ্গারমৌ’ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সাইয়েদ হাবিবুল্লাহ নাম রাখেন হুসাইন আহমদ। তবে তাঁর পারিবারিক নাম ছিল ‘চেরাগে মুহাম্মদ’। তিনি ছিলেন হুসাইন রাদি.-এর বংশধর। ইসলাম প্রচারের জন্য তাঁর পূর্বপুরুষরা মদিনা থেকে তিরমিজ হয়ে লাহোরে আসে এবং সেখান থেকে ভারতের ফয়জাবাদ জেলার এলাহাবাদে বসতি স্থাপন করে।

প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন। মাত্র ১৯ বছর বয়সে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি পরিবারের সঙ্গে মদিনায় হিজরত করেন এবং ১৮ বছর সেখানে অবস্থান করেন। মদিনায় অবস্থানকালে শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানি রহ. মসজিদে নববীতে হাদিসের দরস দিতেন।

শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানি রহ. ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিক্ষুব্ধ সময়ের ভেতরে বেড়ে উঠেছেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করলেও তাঁর রাজনৈতিক জীবনের নতুন যাত্রা শুরু হয় ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে। ঐতিহাসিক রেশমি রুমাল আন্দোলনের নেতা শায়খুল হিন্দ মদিনায় আগমন করলে শায়খুল ইসলাম রহ. প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে যোগদান করেন। হিজাজের পবিত্র ভূমিতেই তিনি শায়খুল হিন্দের সঙ্গে কারাবরণ করেন। পরবর্তী সময়ে তাঁদের মিসরের কারাগার হয়ে কুখ্যাত মাল্টা দ্বীপে নির্বাসনে পাঠানো হয়। তিন বছর সাত মাস নির্বাসনে থাকার পর ১৩৩৮ হিজরির (১৯২০ খ্রি.) রমজানে মুক্তি পান।

১৯২০ সালে শায়খুল হিন্দের নির্দেশে তিনি কলকাতার একটি মাদরাসার প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান করেন। ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯২১ ‘ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চাকরি করা হারাম’ ফতোয়া দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি এই পদে বহাল ছিলেন। দুই বছর কারাবাসের পর ১৯২৩ সালে তিনি মুক্তিলাভ করেন এবং মুহাদ্দিস হিসেবে সিলেটে আগমন করেন। পাঁচ বছর সিলেটে অবস্থানের পর ১৯২৮ সালে তিনি দেওবন্দের সদর মুদাররিস পদে যোগদান করেন। এরপর আজীবন এই পদে বহাল ছিলেন।

শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানি রহ.-এর আধ্যাত্মিক গুরু ছিলেন মুফতি রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি রহ.। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি গাঙ্গুহি রহ.-এর হাতে বাইআত গ্রহণ করেন এবং ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর কাছ থেকেই খেলাফত লাভ করেন। তবে তিনি হাজি এমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কি রহ.-এর সান্নিধ্যও লাভ করেন। মাদানি রহ.-এর শিক্ষা আন্দোলন ও আধ্যাত্মিক কর্মকাণ্ডের অন্যতম ক্ষেত্র ছিল বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল। তাঁর প্রচেষ্টায় আসাম ও সিলেট অঞ্চলে অসংখ্য দ্বিনি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ১৯২৮ সালে দারুল উলুম দেওবন্দের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে তিনি সিলেট ত্যাগ করলেও ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের আগ পর্যন্ত প্রতি রমজানে সিলেটে ইতেকাফ করতেন এবং এই অঞ্চলের দ্বিনি শিক্ষা ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য নানা কর্মসূচিতে যোগদান করতেন। তাঁর সেই শ্রম ও প্রচেষ্টার প্রভাব এখনো সিলেট ও আসাম অঞ্চলের দ্বিনচর্চায় বিদ্যমান। বাংলাদেশ শায়খুল ইসলাম মাদানি রহ.-এর ৫০ জন খলিফা রয়েছেন যাঁদের উল্লেখযোগ্য অংশই বৃহত্তর সিলেটের।

তার উল্লেখযোগ্য রচনাবলী হলো: নকশে হায়াত, সালাসিলে তাবিয়্যাহ, মাকতুবাতে শায়খুল ইসলাম (৪খণ্ড), ফাতাওয়ায়ে শায়খুল ইসলাম, আসীরে মাল্টা , মুত্তাহেদায়ে ক্বাওমিয়া আওর ইসলাম, সিয়াসী মাক্বালাত (২ খণ্ড), তাক্বরিরে বোখারী, তাক্বরিরে তিরমিযি, মাকতুবাতে তাসাউফে মাদানী, শিহাব আস-সাক্বিব।

৫ ডিসেম্বর ১৯৫৭ সালে বরেণ্য এই মনীষীর মৃত্যু হয়। শায়খুল হাদিস যাকারিয়া রহ. তাঁর জানাজার নামাজের ইমামতি করেন এবং দারুল উলুম দেওবন্দের ঐতিহ্যবাহী ‘কাসেমি’ কবরস্থানে প্রিয় শিক্ষক মাহমুদ হাসান দেওবন্দির পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

হুসাইন আহমদ মাদানীর রহ.-এর স্মৃতি ধরে রাখতে ২০১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সিলেট নগরের ঐতিহ্যবাহী নয়াসড়ক পয়েন্টের নতুন নামকরণ করে মাদানী চত্বর রাখা হয়েছে। সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ‘মাদানী চত্বরে’ স্থাপিত মিনারের উদ্বোধন করেন।

আল্লামা মুশাহিদ আহমদ বায়ামপুরী

আল্লামা মুশাহিদ আহমদ বায়ামপুরী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের একজন খ্যাতিমান আলেম, রাজনীতিক, সমাজ সংস্কারক ও লেখক ছিলেন। হাদিস বিশারদ হিসেবে উপমহাদেশে তার ব্যাপক খ্যাতি রয়েছে। ১৩২৭ হিজরি মোতাবেক ১৯০৭ সালে মহররম মাসে শুক্রবার দিনে সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার বায়ামপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বায়মপুর বর্তমান কানাইঘাট পৌরসভার অন্তর্গত। তার বাবার নাম কারী আলিম বিন কারী দানিশ মিয়া। আর মাতার নাম হাফেজা সুফিয়া বেগম।

কানাইঘাট ইসলামিয়া মাদরাসা, যা বর্তমানে দারুল উলুম কানাইঘাট সেখান থেকে মাত্র ১০ বছর বয়সে তিনি প্রাথমিক পড়াশোনা সম্পন্ন করেন। মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনাও এখানেই সম্পন্ন করেন। এরপর কিছুদিন লালারচক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। পরে তিনি স্কুলের চাকরি ছেড়ে চলে যান ভারতে। সেখানে রামপুর আলিয়া মাদরাসায় পাঁচ বছর এবং মিরাঠ আলিয়া মাদরাসায় দুই বছর পড়াশোনা করেন। এই সাত বছরে তিনি হাদিস, তাফসির, ফেকাহ, আকাইদ, দর্শন প্রভৃতি শাস্ত্রে বিশেষ পাণ্ডিত্ব অর্জন করেন। ভারতে পড়াশোনা শেষ করে আবার দেশে ফিরে আসেন। সেই লালারচর রহমানিয়া মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন। কিন্তু তিনি এতে তৃপ্তি পাচ্ছিলেন না। উচ্চশিক্ষার স্পৃহা তাকে অদৃশ্য থেকে টানছিল। চাকরি ছেড়ে ১৯৩৬ সালে ভর্তি হন বিশ্ববিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলূম দেওবন্দে। সেখানে প্রায় দেড় বছর অত্যন্ত সুনাম ও সুখ্যাতির সঙ্গে হাদিসের ওপর সর্বোচ্চ ডিগ্রি গ্রহণ করেন। মেধা তালিকায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি রেকর্ডসংখ্যক নম্বর অর্জন করেন। কয়েকটি বিষয়ে মোট নম্বরের চেয়েও বেশি নম্বর লাভের গৌরব তিনি অর্জন করেন। তার বোখারি শরিফের পরীক্ষার খাতা দেওবন্দ মাদরাসা কর্তৃপক্ষ সংরক্ষণ করে রেখেছিল দীর্ঘকাল।

দারুল উলূম দেওবন্দে লেখাপড়া শেষ করার পর বেশ কয়েক বছর ভারতের বদরপুর ও রামপুর আলিয়া মাদরাসায় ইলমে হাদিসের ওপর পাঠদান করেন। সিলেটবাসীর অনুরোধে পরে ফিরে আসেন দেশে। যোগ দেন সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসায় শাইখুল হাদিস হিসেবে। সিলেটের গাছবাড়ী জামিউল উলুম কামিল মাদরাসায়ও তিনি শাইখুল হাদিসের দায়িত্ব পালন করেছেন। তার শিক্ষকতাকালে গাছবাড়ী মাদরাসাকে ‘দ্বিতীয় দারুল উলূম দেওবন্দ’ হিসেবে অভিহিত করা হতো। তবে সেই মাদরাসা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ১৯৫৩ সালে চলে আসেন নিজ জন্মস্থান কানাইঘাটে। যোগ দেন কানাইঘাট ইসলামিয়া মাদরাসায়। এই প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘দারুল উলূম কানাইঘাট’। সেখানে তিনিই ১৯৫৪ সালে চালু করেন দাওরায়ে হাদিসের ক্লাস। একাধারে সেই মাদরাসার পরিচালক ও শাইখুল হাদিস ছিলেন আল্লামা বায়ামপুরী রহ.। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত এখানেই তিনি হাদিসের সুমহান খেদমত করে গেছেন।

পূর্ব সিলেটের সব মাদরাসাকে এক প্লাটফর্মে নিয়ে আসতে ১৯৫৩ সালে তিনি গঠন করেন ‘পূর্ব সিলেট আযাদ দীনি আরবী মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড’। তিনি আজীবন এই বোর্ডের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে ওই বোর্ডের অধীনে প্রায় ১৭৫টি মাদরাসা পরিচালিত হচ্ছে।

তিনি সিলেটের আনাচে-কানাচে মানুষের মধ্যে ওয়াজ-নসিহত করে বেড়াতেন। সামাজিক নানা অসঙ্গতি, কুসংস্কার ও অনাচারের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। ধর্মীয় ও বিজ্ঞানভিত্তিক তার জ্ঞানগর্ভ আলোচনা সর্বমহলে জনপ্রিয় ছিল। রমজানে সিলেটের বন্দরবাজার জামে মসজিদে তারাবির পর থেকে সাহরি পর্যন্ত তাফসির ও ওয়াজ নসিহত করতেন। শত শত মুসল্লি রাত জেগে তার উপভোগ্য ও জ্ঞানগর্ভ আলোচনা শুনতেন। অনেকে দূরদূরান্ত থেকে এসে হোটেলে অবস্থান নিতেন তার বয়ান শোনার জন্য। শিক্ষার্থীরা খাতা-কলম নিয়ে তার বয়ান শুনতে বসতো। তার সেই মজলিস হতো সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য উন্মুক্ত এক পাঠশালার মতো।

রাজনীতিতে তিনি ছিলেন তার উস্তাদ ও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মহান নেতা মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী রহ.-এর অনুসারী। শিক্ষকের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে তিনি জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি তিনবার জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সর্বপ্রথম ১৯৬২ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পাকিস্তানের পার্লামেন্ট নির্বাচনে চেয়ার প্রতীকে নির্বাচন করে বিপুল ভোটে এমএনএ (মেম্বার অব ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি) নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ সালেও তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে গোলাপফুল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন। ১৯৭০ সালে তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের দলীয় প্রতীক খেজুর গাছ নিয়ে নির্বাচন করেন। প্রথমবার বিজয়ী হলেও শেষ দুইবার সামান্য ভোটে পরাজিত হন।

রাষ্ট্রের নামকরণে পাকিস্তান প্রজাতন্ত্রের পরিবর্তে ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তান’ লেখায় তার ভূমিকা ছিল। কোরআন-সুন্নাহ বিরোধী কোনো আইন করা যাবে না এই আইন তিনি পাকিস্তানের সংসদে উত্থাপন করেছিলেন। তার দাবির মুখে একটি অর্ডিন্যান্স থেকে ইসলামবিরোধী ধারা বাতিল করতে বাধ্য হয় আইয়ূব সরকার। জাতীয় শিক্ষাপদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন এবং ইসলামি ভাবধারা প্রতিষ্ঠার জোর দাবি তিনি পার্লামেন্টে তুলে ধরেন। পূর্ব পাকিস্তানে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি তিনিই প্রথম করেন। তিনি কোরআন-সুন্নাহভিত্তিক শোষণমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে গেছেন আজীবন।

দ্বীনের বিভিন্ন অঙ্গনে অবদানের পাশাপাশি লেখালেখির লাইনেও তার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তার রচিত ‘ফাতহুল কারীম ফি সিয়াসাতিন্নাবিয়ীল আমীন’ রাজনীতি বিষয়ে একটি অমর গ্রন্থ। ১৯৪৮ সালে ভারতের রামপুর থেকে কিতাবটি মুদ্রিত হয়। পরবর্তী সময়ে ‘ইসলামের রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক উত্তরাধিকার’ নামে বইটির অনুবাদ ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত হয়। তার রচিত ‘আল-ফুরক্বান বাইনাল হক্বে ওয়াল বাতিল ফি ইলমিত তাসাউফে ওয়াল ইহসান’ গ্রন্থটি তাসাউফ সংক্রান্ত। তার আরও কয়েকটি গ্রন্থ হচ্ছে: আল ফুরক্বান বাইনা আউলিয়াইর রহমান ও আউলিয়াইশ শাইতান, সত্যের আলো (দুই খণ্ডে), ইসলামে ভোট ও ভোটের অধিকার, সেমাউল কোরআন, ইজহারে হক্ব, আল লাতাইফুর রাব্বানিয়্যাহ ফি সূরাতি তাফসীরিল ফাতিহা। এছাড়া কিছু বই অপ্রকাশিত থেকে যায়।

আল্লামা বায়ামপুরী রহ. প্রথমে হাকীমুল উম্মত হজরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ.-এর সঙ্গে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। তবে নিজ উস্তাদ হোসাইন আহমদ মাদানী রহ.-এর কাছ থেকেও আধ্যাত্মিক লাইনে উপকৃত হন। পরবর্তী সময়ে তিনি মাওলানা ইয়াকুব বদরপুরী রহ.-এর কাছে বায়াত হন এবং তার খেলাফত লাভ করেন।

আল্লামা বায়াামপুরী রহ. ছিলেন ১১ সন্তানের জনক। ১৩৯০ হিজরী ১০ জিলহজ মোতাবেক ১৯৭১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ঈদুল আজহার রাতে মৃত্যুবরণ করেন। ঈদুল আজহার দিন আসরের পর তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় ইমামতি করেন তারই ছোটভাই আল্লামা মুজাম্মিল রহ.৷ তার হাতেগড়া প্রিয় প্রতিষ্ঠান কানাইঘাট দারুল উলুম মাদরাসার সামনেই তাকে সমাহিত করা হয়।

আল্লামা বায়ামপুরী রহ.কে দাফনের পর কয়েক দিন পর পর্যন্ত কবর থেকে সুগন্ধি বের হয়। মাঝে বিরতি দিয়ে তিন মাস পর আবার এই সুগন্ধি অনুভব করেন এলাকাবাসী। ইন্তেকালের ৪০ বছর পর ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে আবারও তার কবর থেকে সুগন্ধি বের হতে থাকে। এই সুগন্ধি লাভের জন্য দেশের নানা প্রান্ত থেকে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ ভিড় করেন। সর্বশেষ ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরেও তার কবর থেকে সুগন্ধি বের হয়।

হযরত মাওলানা আতহার আলী

হযরত আতহার আলী রহ. ১৮৯১ সন মোতাবেক ১৩০৯ হিজরী সিলেটের বিয়ানীবাজার থানার গোঙ্গাদিয়া গ্রামের এক ধর্মপরায়ণ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নিজ এলাকাতেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার পর মুরাদাবাদের কাসেমিয়া মাদরাসায় ও রামপুর মাদরাসায় বিভিন্ন শাস্ত্রে জ্ঞান অর্জন করেন। অতঃপর সাহারানপুর ও পরে বিশ্ববিখ্যাত দারুল উলূম দেওবন্দে শিক্ষাগ্রহণ করেন। তঁর উস্তাদদের মধ্যে ছিলেন আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী, পাকিস্তানের অন্যতম প্রবক্তা মাওলানা শাব্বীর আহমাদ উসমানী ও জাফর আহমাদ উসমানীর মত প্রমুখ মনীষীগণ। শিক্ষা সমাপ্তির পর আতহার আলী রহ. উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী সংস্কারক, আধ্যাত্মিক সাধক ও হাজারের অধিক গ্রন্থ প্রণেতা মাওলানা আশরাফ আলী থানবীর রহ. কাছে আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ লাভ ও রূহানী তাযকিয়াহ তারাক্কি অর্জন করেন এবং তার থেকে খেলাফতপ্রাপ্ত হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।

দেশে ফিরে আল্লামা আতহার আলী ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি সিলেট এবং কুমিল্লার জামিয়া মিল্লিয়া (বর্তমানে কাসেমুল উলূম) ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া ইউনুসিয়াসহ একাধিক মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন। অতঃপর কিশোরগঞ্জের একটি মাদরাসায় শিক্ষকতা ও পরে ঐতিহাসিক শহীদী মসজিদের ইমাম নিযুক্ত হন এবং একজন পীর হিসাবে ইসলামের যাবতীয় শিক্ষা আদর্শ প্রচার করতে থাকেন। তখন তিনি ইসলামী আন্দোলন তথা রাজনীতির ফাউন্ডেশন বা প্রাথমিক স্তর বিনির্মাণে আত্মনিয়োগ করেন।

আতহার আলী রহ. ১৯৪৫ সনে বঙ্গীয় ওলামা-মাশায়েখদেরকে নিয়ে নিখিল ভারতীয় ওলামা কনফারেন্সের আয়োজন করেন। ২৫ মে কলিকাতা মোহাম্মাদ আলী পার্কে আল্লামা আযাদ সোবহানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মহাসম্মেলনে মাওলানা শাববীর আহমাদ উসামানীকে প্রধান করে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম গঠিত হয়। এই ঐতিহাসিক মহাসম্মেলন আয়োজনে আরো যেসব বঙ্গীয় ওলামায়েকেরামের অনবদ্য অবদান রয়েছে, তারা হলেন মাওলানা নেসার উদ্দীন আহমাদ (পীর সাহেব শর্ষীনা), মাওলানা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দীন, মুফতী দ্বীন মুহাম্মাদ খাঁ ও মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ.।

অতঃপর আল্লামা আতহার আলী পৃথক মুসলিম আবাসভূমি তথা পাকিস্তান কায়েমের লক্ষ্যে সমগ্র ভারতবর্ষ চষে বেড়ান ও প্রধান প্রধান শহরসমূহে সভা-সম্মেলনের আয়োজন করেন, বক্তৃতা দিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন এবং মুসলমানদের মাঝে ঐক্যের প্রাচীর তৈরি করেন। তিনি মুসলিম লীগের ঐতিহাসিক সিমলা কনফারেন্স ও বাংলার প্রতিনিধিত্বকারী নেতৃবৃন্দের অন্যতম ছিলেন। যাদের মধ্যে ছিলেন শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক, মাওলানা আকরম খাঁ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিমুদ্দীন ও তাজুদ্দীন খান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবে শেরে বাংলা এ.কে ফজলুক হক কর্তৃক পঠিত প্রস্তাব প্রণয়নে তার অবদান ছিল সিংহভাগ। এবং তা তিনি করেছিলেন মুর্শিদ মাওলানা আশরাফ আলী থানবীর রহ. বিশেষ ইঙ্গিতে। লাহোর প্রস্তাব ঘোষণার ঐতিহাসিক সেই ছবিতে শেরে বাংলার পাশেই আল্লামা আতহার আলী ছিলেন।

আতহার আলী রহ.-এর একান্ত প্রচেষ্টা এবং মাওলানা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দীন রহ.-এর সহযোগিতায় ১৯৫০ সনের ১৮, ১৯ ও২০ ফেব্রুয়ারী ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার মাছিহাতায় (মাওলানা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দীন রহ.-এর নিজ বাড়ীতে) সাবেক পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কাউন্সিল এবং ওলামা কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত কনফারেন্সে শর্ষিনার মরহুম পীর সাহেব মাওলানা নেসার উদ্দীন রহ. ও আল্লামা আতহার আলী রহ.-কে যথাক্রমে সভাপতি ও কার্যকরী সভাপতি এবং মাওলানা শেখ আব্দুর রহীম (প্রফেসর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)-কে মহাসচিব করে ৫২ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তের কমিটি গঠন করা হয়।

৫০ থেকে ৫২-এর ভেতরে সিলেট ও করাচিতে দুটি জাতীয় পর্যায়ের ইসলামী কনফারেন্সের আয়োজন করেন। যা থেকে পরবর্তীতে প্রণয়নকৃত ইসলামী সংবিধানের ২২ দফা রূপরেখা বা প্রস্তাবনা পেশ করা হয়েছিল। সর্বোপরি ৫২ সনের মার্চের ১৮, ১৯, ও ২০ তারিখে কিশোরগঞ্জে পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তের কনফারেন্স আহবান করে আতহার আলী রহ.। দেশের গণমানুষের দাবি ও শ্লোগান ‘আমরা চাই নেজামে ইসলাম’ অনুসারে নেজামে ইসলাম পার্টি গঠন করেন। প্রথম সভাপতি ও সেক্রেটারী নির্বাচিত হন আল্লামা আতহার আলী রহ. নিজে এবং তার অন্যতম সহযোগী মাওলানা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দীন রহ.।

৫০ সনে মাছিহাতার, ৫১ সনে করাচীতে, ৫২ সনে হয়বতনগরে (কিশোরগঞ্জে), ৫৩ সনে ঢাকায় ইসলামী কনফারেন্সগুলো অত্যন্ত সফলভাবে আয়োজন করে আল্লামা আতহার আলী দেশের সর্বস্তরের আলেম-ওলামা, শিক্ষাবিদ ও ইসলামী বুদ্ধিজীবিদের নিয়ে ইসলামী শাসনতন্ত্রের ২২ দফা মূলনীতি প্রকাশ করেন। শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টি, মাওলানা ভাষানীর আওয়ামী মুসলিম লীগ, (সোহরাওয়াদী) ও খেলাফতে রাব্বানী পার্টি নিয়ে ৫৪ সনে ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠন করেন। ৫৪-এর সাধারণ নির্বাচনে ‘হক- আতহার-ভাষাণী’ ফ্রন্টের কাছে পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগ শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে

পক্ষান্তরে যুক্তফ্রন্ট বিপুল ব্যবধানে বিজয় হয়। সে নির্বাচনে নেজামে ইসলাম পার্টির প্রাদেশিক পরিষদে লাভ করে ৩৬টি আসন এবং কেন্দ্রে পায় ৪টি। পূর্ব পাকিস্তানে শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের কোয়ালিশন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। পক্ষান্তরে ভাষাণী, সোহরাওয়ার্দী বিরোধী দলে অবস্থান নেয়। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রী সভায় নেজামে ইসলাম পার্টির পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন যথাক্রমে আশরাফ উদ্দীন চৌধুরী শিক্ষামন্ত্রী, অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দীন আহমাদ আইনমন্ত্রী এবং অ্যাডভোকেট ফরিদ আহমাদ কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী। সংসদে নেজামে ইসলাম পার্টির আসন সংখ্যাধিক্যের হিসাবে তেমন বেশী না হলেও আল্লামা আতহার আলী রহ.-এর ব্যক্তিত্বের দরুন সেখানে নেজামে ইসলাম পার্টির প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

আতহার আলী রহ. আইয়ূব খানের ইসলামবিরোধী পারিবারিক আইনসহ যাবতীয় ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড ও মৌলিক গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলেন। এর জেরে আইয়ূব খানের নির্দেশে তাকে কারাবরণও করতে হয়। কিন্তু আওয়ামী কর্তৃপক্ষও আইয়ূব খানের মত মাওলানা আতহার আলীকেই সবচেয়ে বড় হুমকি মনে করল। ফলে তাকে বিনা কারণে ৭১ থেকে ৭৪ পর্যন্ত প্রায় তিন বছর কারা ভোগ করতে হয়। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। অতঃপর প্রায় দুই বছর বার্ধ্যক্যজনিত রোগ ভোগের পরে ৭৬ সনের ৫ অক্টোবর ইহজগত ত্যাগ করেন।

মাওলানা বদরুল আলম শায়খে রেঙ্গা

আল্লামা সায়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.-এর যেসকল খলীফাদের মধ্যে অন্যতম হলেন, শায়খুত তাফসীর আল্লামা বদরুল আলম ( শায়খে রেঙ্গা) রহমাতুল্লাহি আলাইহি। ১৩১৯ বাংলার ১ লা বৈশাখ / ১৯১২ ঈসায়ী সনের ১৪ এপ্রিল, রোজ রবিবার, তিনি সিলেটের দক্ষিণসুরমা উপজেলার রেঙ্গা পরগনায় হরিনাথপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত আলেম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শায়খ আরকান আলী এবং মাতার নাম আবিদা খাতুন। তাঁর পিতা তৎকালীন সিলেটের অন্যতম আলেম, প্রচারবিমুখ বুযুর্গ এবং ঐতিহ্যবাহী জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।

হযরত শায়খ রহ. সর্বপ্রথম তাঁর পিতার নিকট কুরআন শরীফ শিক্ষা গ্রহণের মধ্য দিয়ে তাঁর শিক্ষা জীবনের সূচনা করেন। অতপর ১৯১৯ সালে পার্শবর্তী কান্দিগ্রাম স্কুলে লেখা পড়া করেন। ১৯২০ সালে ভর্তি হন তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠিত তৎকালীন জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গায়। এখানে হেদায়াতুন নাহু পর্যন্ত পড়েন। ১৯৩০ সালে ভর্তি হন সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসায় এবং সেখান থেকেই তিনি কামিল পাশ করেন। ১৯৩৬ সালে সিলেট সরকারি আলিয়ার পড়াশোনা শেষ করে আরো উচ্চতর ইলমের তামান্না নিয়ে ভর্তি হন বিশ্ববিখ্যাত ইসলামি বিদ্যাপীঠ, দারুল উলূম দেওবন্দ মাদ্রাসায়। সেখান থেকে প্রথমে দাওরায়ে হাদীস অতপর তাখাসসুস ফিত তাফসীর সমাপ্ত করেন।

হযরত শায়খে রেঙ্গা রহ. দেওবন্দ থাকাকালীন ১৯৩৭ সালের জানুয়ারি মাসে শায়খুল ইসলাম, আল্লামা হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.-এর কাছে বায়াত হন। অতপর, হযরত মাদানী রহ. নির্দেশনা মোতাবেক রিয়াজত ও মোজাহাদায় আত্মনিয়োগ করেন। পরে হযরত মাদানী রহ. পক্ষ থেকে খেলাফত ও ইজাযত লাভ করেন। তার থেকে খেলাফত লাভকারী কয়েকজন হলেন ; শায়খুল হাদীস আল্লামা কমর উদ্দিন রহ., শায়খুল হাদীস আল্লামা আবদুল বারী রহ.শাহাদতপুরী, শায়খ সিকান্দর আলী রহ., শায়খুল হাদীস আল্লামা তাফাজ্জুল হক রহ. হবিগঞ্জী, শায়খ ফখরুদ্দীন রহ.গলমুকাপনী, মুফতি আব্দুল গনী রহ., হযরত মাওলানা জিয়াউর রহমান রহ. প্রমুখ।

দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে শিক্ষা সমাপনীর পর দেশে ফিরে তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠিত জামেয়া রেঙ্গায় প্রথমে শিক্ষক নিযুক্ত হয়ে পর্যায়ক্রমে মুহতামিমের দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। মাদরাসা পরিচালনা, শিক্ষকতা ও বিভিন্ন সামাজিক খেদমতের পাশাপাশি তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ও নিয়মিত মিশন ছিলো ‘তাফসীরুল কুরআন’। তিনি সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে বৃহত্তর রেঙ্গা এলাকা, সিলেট সদর, ফেঞ্ছুগঞ্জ, বালাগঞ্জ, ওসমানী নগর ইত্যাদি এলাকায় নিয়মিত সাপ্তাহিক তাফসীর করতেন।

হযরত শায়খে রেঙ্গা রহ. পর্যায়ক্রমে চারটি বিবাহ করেন। তিনি তিন স্ত্রীর গর্ভে মোট ২৩ জন সন্তান লাভ করেন। যাদের অনেকেই শিশুকালে মৃত্যু বরন করেন। আর যারা জীবিত ছিল, তাদের সবাইকে তিনি আলেম হাফেজ ও সুযোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন।

১১রজব,১৪০৫ হিজরী / ২রা এপ্রিল, ১৯৮৫ ঈসায়ী, রোজ মঙ্গলবার, দুপুর ১২ টা ১০ শে, আল্লাহ আল্লাহ বলতে বলতে তিনি ইহজগত ত্যাগ করেন। জামেয়া রেঙ্গার ময়দানে তৎকালীন সময়ের সর্ববৃহৎ জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। তাঁর জানাজার নামাজে ইমামতি করেন তাঁরই সুযোগ্য সন্তান হযরত মাওলানা শামসুল ইসলাম খলীল সাহেব। অতপর জামেয়ার মাঠের দক্ষিণ পাশে দাফন করা হয়।

শায়খে কৌড়িয়া

দারুল উলুম দেওবন্দ যে ক’জন মনীষীর জন্ম দিয়েছিলো শায়খে কৌড়িয়া রহ. ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তিনি সিলেট জেলার উত্তর বিশ্বনাথের কৌড়িয়া পরগণার খাজাঞ্চী ইউনিয়নের গমরাগুল গ্রামে ১৯০১ ঈসায়ী সনে এক ধার্মিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

হযরত শাহজালাল মুজাররাদে ইয়ামনী রহ.-এর নেতৃত্বে আগত ৩১৩ জনের ইয়ামনী কাফেলার একজন হচ্ছেন সায়্যিদ বাটাউক রহ.। তাঁর ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন সায়্যিদ মুতিউর রহমান ও সায়্যিদ আতাউর রহমান। হযরত শায়খে কৌড়িয়া রহ. হচ্ছেন তাঁদের বংশের অধস্তন কীর্তিমান পুরুষ। তাঁর পিতার নাম আল্লামা আব্বাস আলী। আব্বাস আলী রহ. একাধারে পীর, সমাজ সংস্কারক, ওয়ায়েজ, মুবাল্লিগ, মুনাযির, রাজনীতিবিদ, লেখক ও সাহেবে কারামত বুযুর্গ ছিলেন। তার মাতা ছিলেন একজন আবিদা, সালিহা ও শিক্ষিতা মহিলা।

পারিবারিক শিক্ষা সমাপ্ত হলে তাঁর পিতা পার্শ্ববর্তী হাজীগঞ্জ কওমী মাদরাসায় তাঁকে ভর্তি করে দেন। কিছুদিন পর মাদরাসাটি সরকারিকরণ হয়ে গেলে তিনি তাঁর পুত্রকে ফুলবাড়ি কওমী মাদরাসায় ভর্তি করে দেন। ফুলবাড়ি মাদরাসাও সরকারিকরণ হয়ে গেলে তাঁকে করিমগঞ্জের ঝড়ো কওমী মাদরাসায় ভর্তি করে দেন। এখানে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে শিক্ষা সমাপ্ত করে ভারতের জামিয়া ইসলামিয়া আমরোহা মাদরাসায় চলে যান। সেখানে তিনি আল্লামা কাসিম নানুতুবী রাহ.-এর অন্যতম শিষ্য শায়খুল হাদীস আল্লামা হাফিয আবদুর রহমান আমরোহী রাহ.-এর নিকট বুখারী ও তিরমিযী শরীফ অধ্যয়ন করে ১৯২৩ খৃস্টাব্দে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।

মাদানী রহ. নয়াসড়ক মসজিদে আব্বাস আলী রহ.কে দিয়ে মাঝে মধ্যে বয়ান করাতেন। স্বীয় পিতার মাধ্যমে মাদানী রহ.-এর সাথে কৌড়িয়া রহ. এর প্রাথমিক সম্পর্কের সূত্রপাত হয়। শায়খুল ইসলাম মাদানী রহ. ১৯২৪ থেকে ১৯২৮ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত সিলেটের নয়াসড়কস্থ খেলাফত বিল্ডিং এ হাদীসের দারস প্রদান করেন। ১৯২৮ সালে দারুল উলুম দেওবন্দ কর্তৃপক্ষ তাঁকে দেওবন্দের শায়খুল হাদীস পদে নিয়োগ প্রদান করলে তিনি খেলাফত বিল্ডিং থেকে চলে যান। শায়খে কৌড়িয়া রহ. ও উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে তাঁর সাথে দেওবন্দ গমন করে ১৯২৯ সালে দাওরায়ে হাদীসে ভর্তি হন। ১৯২৯-১৯৩১ ইংরেজী তিন বছর সেখানে হাদীস ও ফুনুনাতের বিভিন্ন বিষয় অধ্যয়ন করে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। দারুল উলূম দেওবন্দে অধ্যয়নরত অবস্থায় ক্বারী তায়্যিব রহ.তাঁকে দারুল উলূম মসজিদের নাইবে ইমাম নিযুক্ত করেন। শায়েখ রাহ. বলেছেন- হাকীমুল ইসলাম ক্বারী তায়্যিব রহ., শায়খুল আদব আল্লামা এযায আলী রহ., হযরত ইবরাহীম বলিয়াভী রহ.সহ অন্যান্য আসাতিযায়ে কেরামের উপস্থিতিতে তিনি কয়েকবার জুমআর নামাযে ইমামতি করেছেন।

দেওবন্দ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর স্বীয় পিতার নির্দেশে ১৯৩৩ সালে জামিয়া ইসলামিয়া রাজাগঞ্জ, কানাইঘাটে প্রধান হাফিয ও পরিচালক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬২ ঈসায়ী পর্যন্ত প্রায় ৩০ বছর রাজাগঞ্জ জামিয়ার সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৫৩ ঈসায়ী সালে হযরত শায়খের আব্বা আব্বাস আলী রহ. ইন্তেকাল করেন। ইন্তেকালের পূর্বে তিনি স্বীয় পুত্রকে রাজাগঞ্জ থেকে বাড়িতে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন এবং বাড়িতে একটি মাদরাসা করে দিলেন। এটিই কৌড়িয়া মাদরাসা নামে পরিচিত।

হযরত শায়খে কৌড়িয়া রহ. শায়খুল ইসলাম মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. এরর নিকট বায়আত গ্রহণ করে ইজাযাত প্রাপ্ত হন। তার খলিফাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন: শায়খুল হাদীস মাওলানা রিয়াছত আলী চৌঘরী রহ., হযরত মাওলানা আশরাফ আলী বিশ্বনাথী রহ., শায়খুল হাদীস মাওলানা ওয়ারিছ উদ্দীন হাজিপুরী রহ., হযরত মাওলানা তাহির আলী তৈপুরী রহ., হযরত মাওলানা শফিকুল হক আকুনী রহ., প্রমুখ।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করলে হযরত কৌড়িয়া রহ. জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তের সভাপতি নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দীর্ঘদিন জমিয়তের রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ ছিল। পরবর্তীতে ১৯৭৪ ঈসায়ী সালে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ গঠন করা হয়। তখন থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত কখনো তিনি সভাপতি, উপদেষ্টা কিংবা অন্য কোনো দায়িত্ব আঞ্জাম দেন। ১৯৮৪ সাল থেকে ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত সবকটি কাউন্সিলে তিনি সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতি নির্বাচিত হন।

শায়খুল ইসলাম মাদানী রহ.-এর নির্দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ কওমী মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড ‘আযাদ দ্বীনী এদারায়ে তালীম বাংলাদেশ’। শায়খে কৌড়িয়া রহ. দীর্ঘ প্রায় পঞ্চাশ বছর আযাদ দ্বীনী এদারার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

এক স্ত্রী ইন্তেকালের পর আরেকজন, এভাবে পর্যায়ক্রমে তিনি পাঁচটি বিয়ে করেন। শায়খ রাহ.-এর প্রথম শ্বশুরবাড়ি ছিলো কুলাউড়া থানার বরমচাল ইউনিয়নের নন্দেনগর। দ্বিতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্বশুরবাড়ি রাজাগঞ্জের মাস্টার বাড়ি এবং তৃতীয় শ্বশুরবাড়ি গোলাপগঞ্জের চৌঘরী গ্রামে ছিলো। তাঁর মোট সন্তানাদি চব্বিশ।

১২ নভেম্বর ২০০১ ঈসায়ী দ্বিপ্রহরের সময় পরিবারের সবার সামনে কালিমা পড়তে পড়তে মাওলায়ে হাকীকির ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে পাড়ি দেন শায়খ রাহ.। পরদিন আলিয়া মাদরাসা ময়দানে সুযোগ্য পুত্র হাফিয মুহসিন আহমাদের ইমামতিতে জানাযার নামায অনুষ্ঠিত হয় এবং পৈত্রিক নিবাস ইসলামাবাদে তাঁকে আপন পিতা শায়খ আব্বাস আলী সাহেবের কবরের পাশে সমাহিত করা হয়।

অল্লামা নূর উদ্দিন আহমদ গহরপুরী

নূর উদ্দিন আহমদ গহরপুরী উপমহাদেশের প্রখ্যাত শায়খুল হাদিস। সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলার শিওরখাল মোল্লাপাড়া গ্রামে ১৯২৪ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা মাওলানা জহুর উদ্দিন এবং মাতা ছুরেতুন্নেসা।

ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত নিজ পরিবারেই তার প্রাথমিক শিক্ষার শুরু। এক সময় তাকে স্থানীয় সুলতানীয়া মক্তবে ভর্তি করা হয়। এরপর তিনি ইছামতি মাদ্রাসা ও পুর্বভাগ জালালপুর মাদ্রাসায় কিছুদিন লেখাপড়া করেন। এরপর শায়খুল ইসলাম শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানীর খলিফা বৃহত্তর সিলেটের বিখ্যাত বুযুর্গ বাঘার শায়েখ মাওলানা বশির উদ্দিনের মাদরাসায় ভর্তি হন। শিশু নূর উদ্দিন লেখাপড়ার পাশাপাশি হযরত শায়খে বাঘার খেদমতে নিয়োজিত থাকতেন। এখানেই তিনি হিফযুল কুরআন সমাপ্ত করেন। এরপর ভর্তি হন দারুল উলূম দেওবন্দ মাদ্রাসায়। ইতিমধ্যে ভারত স্বাধীন হয়ে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। ভারত এবং পাকিস্থান। রেফারেন্ডারের মাধ্যমে সিলেট পুর্ব পাকিস্থানের সাথে যুক্ত হয়। গহরপুরী ১৯৫০ সালে মাত্র ২৬ বছর বয়সে দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে দাওরায়ে হাদিস ১ম বিভাগে ১ম স্থান অর্জন করেন।

দেওবন্দ থাকাকালীন তিনি উপমহাদেশের প্রখ্যাত শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানীর নৈকট্য হাসিল করতে সক্ষম হন। ইলমে হাদিসের প্রতি ছিল তার বিশেষ অনুরাগ। ফলে দাওরা পাশ করে তিনি আরো এক বছর হাদিস ও ফিকাহ শাস্ত্র গবেষণায় অতিবাহিত করেন। শায়খুল ইসলাম মাদানী ছাড়াও তিনি দেওবন্দের যেসব জগৎ বিখ্যাত মনীষ দের শির্ষত্ব লাভ করেন তারা হলেন-ক্বারী তৈয়্যব , শায়খুল আদব মাওলানা এজাজ আলী আমরুহী, মাওলানা ইব্রাহিম বলিয়াভী , মাওলানা মেরাজুল হক , মাওলানা ফখরুল হাসান মুরাদাবাদী।

১৯৫২ সালে স্থায়ী পীর ও উস্তাদ মাদানী ও শায়খুল আদব এজাজ আলী রহ. এর নির্দেশে মাওলানা গহরপুরীকে শায়খুল হাদীস পদে বরিশালের পাঙ্গাসিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় প্রেরণ করা হয়। ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত পাঙ্গাসিয়ায় সুনামের সাথে শায়খুল হাদিসের দ্বায়িত্ব পালনের পর ২বছর বালিয়া মাদ্রাসায় শায়খুল হাদিস হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর তিনি তার নিজ গ্রামে চলে আসেন। এবং গহরপুর জামেয়া প্রতিষ্টা করেন। এ প্রতিষ্ঠানটি ছিল ব্যতিক্রম ধারার। প্রথমে দাওরায়ে হাদিস, এরপর মিশকাত বা ফজিলত জামাত এমনি করে অন্যান্য শ্রেণী খোলা হয়। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই তিনি মাদ্রাসার মোহতামিম ও শায়খুল হাদিসের দ্বায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে দেশের সর্ববৃহৎ কওমী মাদ্রাসার শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসীল আরাবিয়ার চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করা হয় এবং মৃত্যু অবধি তিনি এ গুরু দায়িত্ব সফল সাথে পালন করেন।

১৯৬৮ সালে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের পক্ষ থেকে আয়োজিত ‘ইসলামিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব পাকিস্তান’-এর কনফারেন্সে প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নেতা হিসেবে তিনি খেজুরগাছ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।

৬ এপ্রিল ২০০৫ সালে তিনি মারা যান। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। তিনি চার স্ত্রী, একমাত্র ছেলে মুসলেহুদ্দীন রাজু ও ৪ মেয়েসহ অসংখ্য গুনগ্রাহী রেখে গেছেন।

আল্লামা আব্দুল লতিফ ফুলতুলী

আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ১৩২১ বাংলার ফাল্গুন মাসে অর্থাৎ ১৯১৩ সালের প্রথম দিকে সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার ফুলতলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মুফতি আব্দুল মজিদ। তিনি হযরত শাহ জালাল এর সফরসঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম হযরত শাহ কামাল-এর বংশধর ছিলেন।

শিক্ষাজীবনের প্রারম্ভে তিনি তার চাচাতো ভাই ফাতির আলীর নিকট লেখাপড়া করেন। অতঃপর ফুলতলী মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ১৩৩৮ বঙ্গাব্দে তিনি বদরপুর সিনিয়র মাদ্রাসায় উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপর রামপুর আলিয়া ও মাতলাউল উলুম মাদ্রাসায় হাদিস শাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেন। ১৩৫৫ হিজরীতে তিনি মাতলাউল উলুম মাদ্রাসায় ১ম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে হাদিস শরীফের সর্বোচ্চ সনদ অর্জন করেন। তার শিক্ষকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আল্লামা খলিলুল্লাহ রামপুরী ও আল্লামা ওয়াজিহুদ্দীন রামপুরী। এ ছাড়া তিনি শাহ আব্দুর রউফ করমপুরী ও শায়খুল কুররা আহমদ হেজাযী এর নিকট থেকে ইলমে কিরাতের সনদ অর্জন করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি শায়খুল কূররার নিকট থেকে ইলমে কিরাতের সর্বোচ্চ সনদ অর্জন করেন।

১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত তিনি বদরপুর আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। ১৯৫৪ সাল থেকে গাছবাড়ী জামেউল উলুম মাদ্রাসায় অধ্যাপনা করেন। এ সময় মাদ্রাসার উপাধ্যক্ষ ও অধ্যক্ষের দায়িত্ব পলন করেন। এরপর সৎপুর কামিল মাদরাসা, ইছামতি ও বাদেদেওরাইল ফুলতলী আলিয়া মাদ্রাসায় হাদিস শাস্ত্র অধ্যাপনা করেন। এ ছাড়া তিনি শুদ্ধভাবে কোরআন তিলাওয়াত শিক্ষাদানের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন দারুল ক্বিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট।

আল্লামা ফুলতলী ছিলেন তরীকায়ে কাদেরিয়া, চিশতীয়া, নক্সবন্দীয়া, মুজাদ্দেদিয়া ও মুহাম্মদিয়ার পীর। তিনি আজীবন উপর্যুক্ত তরিকা সমূহের প্রচার ও প্রসারে নিয়োজিত ছিলেন। তার লেখা অনেক উর্দু ও আরবি গ্রন্থ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবী বিভাগের পাঠ্যসূচিতেও তার অনেক গ্রন্থ রয়েছে।

তার হাতে জন্ম নিয়েছে অনেক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে কুরআন যথাযথভাবে পাঠের লক্ষে প্রতিষ্ঠিত একটি প্রতিষ্ঠান দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট। ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ আনজুমানে তালামীযে ইসলামিয়া। মাদ্রাসা শিক্ষা ও শিক্ষকদের জন্য ১৯৬৪ সালে তিনি প্রতিষ্টা করেন বাংলাদেশ আঞ্জুমানে মাদারিসে আরাবিয়া।

বিদেশে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তার দারুল হাদিস লতিফিয়া ইউকে, ওলামা সোসাইটি ইউএস, দারুল হাদীস লতিফিয়া নর্থ ওয়েস্ট, লতিফিয়া দারুল কিরাত সমিতি, ভারত অন্যতম।

আল্লামা ফুলতলী ১৬ জানুয়ারি ২০০৮ সালে সিলেট শহরে তার প্রতিষ্ঠিত শাহজালাল দারুচ্ছুন্নাহ ইয়াকুবিয়া কামিল মাদরাসা সংলগ্ন বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন। ঐদিন বিকাল ৪টা সময় তার গ্রামের বাড়ির পাশে অবস্থিত বালাই হাওরে জানাযার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। জানাযা শেষে তার প্রতিষ্ঠিত জামে মসজিদের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। তার ৭ ছেলে ও ৩ মেয়ে সন্তান রয়েছে।

আব্দুল গফফার শাইখে মামরখানী

১৯০৮ মতান্তরে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ, মোতাবেক ১৩১৫ বা ১৩২১ বাংলা সনের কোন এক শুভক্ষণে সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার মুন্সীবাজারের মামরখানী গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম ক্বারী আব্দুল মজিদ ও মাতা রহিমা খাতুন ছিলেন অত্যন্ত ধর্মভীরু ও পরহেজগার। ১৯১৬ সালে আট বছর বয়সে তাঁর পিতা বাড়ির পাশে নিজের প্রতিষ্ঠিত মক্তবে তাঁকে ভর্তি করান। ১৯১৯ সালে ১১ বছর বয়সে তাঁকে মুন্সীবাজার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করা হয়।

১৯২০ সালে তাঁর জীবনে নেমে আসে পিতৃ হারানোর বেদনা বিদুর অধ্যায়। এরপর মায়ের পরম আগ্রহে তাঁর বড় ভাই তাঁকে মুন্সীবাজার মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেন।এখানে মাত্র চার বছরের অধ্যয়নে তিনি আরবী, বাংলা, উর্দু ও ফার্সি ভাষার উপর বিশেষ পান্ডিত্য অর্জন করেন।

ইসলামী শিক্ষায় ব্যাপক বুৎপত্তি অর্জনের উদ্দ্যেশ্যে ১৯২৬ সালে তিনি ভারতের আসাম প্রদেশের হাইলাকান্দি মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ১৯২৭ সালে সিলেটের প্রাচীনতম শিক্ষাগার জামিউল উলূম গাছবাড়ী মাদ্রাসায় চলে আসেন । ১৯৩৫ সালে উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যে তিনি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন। সেখানে তিনি দাওরায়ে হাদীস পাশসহ হাদীস,তাফসির,ও ফিকাহর উপর গবেষণা করেন। দেওবন্দে যাদের সাহচর্য লাভে ধন্য হয়েছিলেন,তাঁদের মধ্যে কুতবে আলম হজরত মাওলানা সায়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. হজরত মাওলানা সায়্যিদ আসগর হুসাইন দেওবন্দী রহ. শাইখুল আদব হজরত মাওলানা এজায আলী রহ. এবং হজরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শফী রহ. সহ তৎকালীন জগদ্বিখ্যাত মনিষীদের কথা উল্লেখযোগ্য।

১৯৩৮ সালে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করে উপমহাদেশের অন্যতম রাহবার আল্লামা সায়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.-এর হাতে তাসাউফের বাইয়াত গ্রহণ করে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। সিলেট বিভাগের প্রাচীনতম ইসলামী বিদ্যাপীঠ ঢাকা উত্তর রানাপিং আরাবিয়া হুসাইনিয়া টাইটেল মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে তাঁর কর্ম জীবনের শুরু। এখানে প্রায় দুই বছর শিক্ষকতার পর স্বীয় মুর্শিদ আল্লামা সায়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.-এর নির্দেশে ১৯৪১ সালে ভারতের আসাম প্রদেশের ভাংগা ইসলামিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। তারপর তিনি ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতের হাইলাকান্দি টাইটেল মাদ্রাসায় শিক্ষা পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৪৭ সালের পাক-ভারত বিভক্তির সময় তিনি চলে আসেন নিজ মাতৃভূমি বাংলাদেশের জকিগঞ্জে। স্থানীয় গঙ্গাজল হাসানিয়া সিনিয়র মাদ্রাসায় সুদীর্ঘ নয় বছরকাল শিক্ষকতার পাশাপাশি শিক্ষা পরিচালকের ও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি জকিগঞ্জের মুন্সীবাজার মাদ্রাসার মুহতামিমের দায়িত্বভার গ্রহন করেন এবং মৃত্যু অবধি এ পদে অধিষ্ঠিত থেকে মাদ্রাসাকে বিন্দু থেকে সিন্ধুতে পরিণত করেন।

সিলেটের নয়াসড়ক মসজিদে শাইখুল ইসলাম আল্লামা হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.-এর সাথে এতেকাফে সুদীর্ঘ ১৩ বছরকাল পুরো রমজান মাস অতিবাহিত করেন। উম্মতের হেদায়াত, মুরিদানের আত্মিক প্রশিক্ষণ ও দিক নির্দেশনার জন্য সুদীর্ঘ আঠারো বছর খানকাহ পরিচালনা করেন। এর পূর্বে প্রায় বার বছর জকিগঞ্জের বালাউট মসজিদে মুরিদান সহ রমজানের শেষ দশ দিন এতেকাফ করতেন।

ছাত্র জীবন থেকেই তিনি রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। দারুল উলুম দেওবন্দে পড়াশোনা অবস্থায় তিনি তৎকালীন সময়ে আসাম প্রাদেশিক ছাত্র সংগঠনের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন। ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনে তিনি হজরত মাদানী রহ. এর সাথে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্টার পর তিনি হজরত শিব্বির আহমদ উসমানী রহ. মুফতি মাহমুদ রহ. প্রমুখের নেতৃত্বে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম সিলেট জেলায় সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. তাওবার রাজনীতির ডাক দিলে তিনি তাঁর নেতৃত্বে গঠিত খেলাফত আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত খেলাফত আন্দোলনের ব্যানারে তৎকালীন সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮৯ সালে শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ.-এর নেতৃত্বে ওলামা মাশায়েখ ও দ্বীনদার বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস গঠিত হলে তিনি তাতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এ সংগঠনের কেন্দ্রীয় অবিভাবক পরিষদ সদস্য ও সিলেট জেলা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ইন্তেকাল পর্যন্ত তিনি এ পদেই অধিষ্ঠিত ছিলেন।

আল্লামা আব্দুল গফফার শাইখে মামরখানী রহ. জীবনে চারটি বিবাহ করেন। প্রথম স্ত্রীর গর্ভে ২ ছেলে ও ৫ মেয়ে জন্মলাভ করেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে ৪ ছেলে ও ২ মেয়ে এবং তৃতীয় স্ত্রীর গর্ভে ৪ ছেলে ও ১ মেয়ে জন্মলাভ করেন।

২০০২ ঈসায়ী সালের ১৮ জুন,৫ আষাঢ় ১৪০৯ বাংলা,৬ রবিউস সানী ১৪২৩ হিজরী মঙ্গলবার দুপুর ১.১৫ মিনিটে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ কীর্তিমান মনীষী সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে তাঁর পরম প্রভুর সান্নিধ্যে চলে যান। মুনশী বাজার মাদ্রাসা মসজিদের সামনে তাঁকে দাফন করা হয়।

মাওলানা শফিকুল হক আকুনী

মাওলানা শফীকুল হক আকুনী ১৯০১ সালে সিলেট জেলার কানাইঘাট থানাধীন নিজধলই কান্দি (আকুনী) গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত ও আলেম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা মরহুম মাওলানা ইব্রাহিম আলী দেওবন্দী আজীবন দ্বীনের খেদমতে ছিলেন নিয়োজিত। তিনি ঐতিহ্যবাহী জামেউল উলুম গাছবাড়ী মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।

তিনি ঐতিহ্যবাহী জামেউল উলূম গাছবাড়ী মাদ্রাসায় মক্তবে ভর্তি হন। এ মাদ্রাসা থেকেই ১৩৪২ হিজরী সনে তাকমিল ফিল হাদীস (কামিল) পরীক্ষায় ১ম বিভাগে ১ম স্থান অধিকার করার গৌরব অর্জন করেন। এরপর উক্ত মাদ্রাসায়ই ২ বছর অধ্যাপনা করেন। এরপর উচ্চশিক্ষার্থে তিনি দারুল উলূম দেওবন্দ গমন করেন এবং ১৩৪৫ হিজরী সনে আবার দাওরায়ে হাদীস পরীক্ষা দিয়ে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। তাঁর উস্তাদগণের মধ্যে রয়েছেন-কুতবুল আলম শায়খুল ইসলাম সাইয়্যেদ হোসাইন আহমদ মাদানী র., আল্লামা ইদ্রীছ কান্দলভী র., আল্লামা আব্দুল হক হক্কানী র., আল্লামা আব্দুছ ছামাদ বাণীগ্রামী রহ., ফখরুল উলামা মুশাহিদ বায়মপুরী রহ., আল্লামা আহমদুল হক করিমগঞ্জী রহ., আল্লামা শফিকুল হক রহ. প্রমুখ।

কর্মজীবনে দেওবন্দ থেকে ফিরে এসে গাছবাড়ী জামেউল উলূম মাদ্রাসায় শিক্ষকতায় যোগদান করেন। এরপর আল্লামা বায়মপুরী রহ., এর প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী কানাইঘাট দারুল উলূম মাদ্রাসায় তিনি অতি দক্ষতা ও কর্মনিষ্ঠার সাথে দীর্ঘ ১২বছর ইলমে হাদীসের খেদমত আঞ্জাম দেন। এরপর শায়খুল হাদীস হিসেবে খরিলহাট মাদ্রাসায় ৮ বছর, দারুল উলূম মৌলভী বাজার মাদ্রাসায় ১বছর ও সুনামগঞ্জের দরগাপুর মাদ্রাসায় ১বছর হাদীসের দরস দেন। ১৩৬০ বাংলায় তিনি নিজ এলাকায় গাছবাড়ী মুজাহিরুল উলূম মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন।

তিনি আযাদী তথা বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে রেখেছেন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা । জমিয়তের উদ্যোগে তিনি পাকিস্তানের বিভিন্ন ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করেছেন এবং পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক অঙ্গনে সফর করেছেন। মুফতী মাহমুদ রহ. ও হাফীজুল হাদীস আল্লামা দরখাস্তী রহ. এর সাথে তাঁর রাজনৈতিক বৈঠক ও মতবিনিময় হয়েছে।

তিনি ১১ বার পবিত্র হজ্ব সম্পাদন করেন। তিনি কুতবুল আলম মাদানী রহ.-এর বিশিষ্ট খলীফা হাফিজ মাওলানা আব্দুল করিম শায়খে কৌড়িয়া রহ.-এর হাতে বাইআত গ্রহণ করেন। ১৯৮০ সালে স্বীয় পীরের কাছ থেকে এজাযত হাসিলে সক্ষম হন।

পারিবারিক জীবনে তিনি গড়াই গ্রামের মুন্সি আব্দুল হালিম রহ. এর ২য় কন্যা মারিয়া খাতুনের সাথে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ৩ পুত্র ও ৬ কন্যা সন্তানের জনক।

হাফিজ মাওলানা জাওয়াদ

তিনি ১৫ মার্চ, ১৯১৮ ইং.সালে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মস্থান সিলেট জেলাধীন কানাইঘাট থানার অন্তর্গত রাজাগঞ্জ ইউনিয়নের সুপ্রসিদ্ধ পারকুল গ্রামে, তাঁর পিত্রালয়ে। বাবার নাম জনাব আব্দুল বারী। দাদার নাম জনাব ইয়াসিন মিয়া। পরদাদার নাম সাধু চৌধুরী।

তৎকালীন সিলেটে ইলমে কেরাতে বিজ্ঞ ও বিদগ্ধ এবং আদর্শ ছাত্র গঠনে বিখ্যাত ছিলেন হাফেজ কারি আব্দুল হাই রহ.। জাওয়াদ রহ. তাঁর সোহবত-সাহচর্য ও শিষ্যত্বে নিজেকে সমর্পণ করেন। এবং অতি অল্প সময়ে কুরআন করিমের হিফয সমাপ্ত করেন। এরপর তিনি কানাইঘাট থানাধীন গাছবাড়ি জামিউল উলূম মাদরাসায় ভর্তি হন। গাছবাড়ির এই প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি সবকটি শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। ১৯৪৭ ঈ.সালের মাঝামাঝি সময়ে আসাম শিক্ষবোর্ডের অধীনে পরিচালিত মাদরাসা বোর্ডের পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে ফাজিল সমাপন করেন। এখানে তাঁর উসতাযগণের মধ্যে আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরি রহ.(১৩২৭-১৩৯০ হি.) এবং মাওলানা ফজলে হক ফাজিল সাহেব রহ. ছিলেন অন্যতম। এরপর আলিয়া ধারার সর্বোচ্চ স্তর ‘কামিল’ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার জন্য ১৯৪৭ এর শেষের দিকে আসাতিযা কেরামের পরামর্শে সিলেট আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন। ১৯৪৮ ইং. এর শুরুর দিকে সরকারি মাদরাসার শিক্ষাবোর্ডের ‘কামিল’ শ্রেণির বার্ষিক কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় তৃতীয় স্থান অধিকার করে কৃতিত্বের সাক্ষর রাখেন। সিলেট আলিয়া মাদরাসায় তাঁর আসাতিযা কেরামের মধ্যে আল্লামা সহুল উসমানি রহ. এবং আল্লামা মুহাম্মদ হুসাইন রহ.(জৈন্তা) ছিলেন অন্যতম।

ইলমে দ্বীনের গভীর ব্যুৎপত্তি অর্জনের লক্ষ্যে ১৩৬৭ হিজরী মোতাবেক ১৯৪৮ ঈ. সালের মাঝামাঝি সময়ে দারুল উলূম দেওবন্দ গমন করেন। মুহাদ্দিস সাহেব রহ. যখন দারুল উলূম দেওবন্দ ভর্তি হন তখন ‘সদরুল মুদার্রিসীন এবং শায়খুল হাদিস ছিলেন শায়খুল ইসলাম সায়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানি রহ.(১২৯৬-১৩৭৭ হি.)। মুহাদ্দিস সাহেব রহ. সেখানেও পড়ালেখার প্রতি প্রত্যয়-প্রাণ প্রবণতা, আমলের প্রতি অপরিমেয় আগ্রহ, অনুপম আদর্শ এবং আসাতিযা কেরামের প্রতি অন্তরগত অকৃত্রিম অনুরক্তির ফলে তাঁদের একান্ত কাছের হয়ে ওঠেন।

বিশেষত হযরত মাদানি রহ. এর সাথে তাঁর সুনিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি শায়খুল ইসলাম মাদানি রহ. এর কাছেই বুখারি শরিফ এবং সুনানে তিরমিযি শরিফ অধ্যয়ন করেন। এছাড়া হাকিমুল ইসলাম কারি তায়্যিব রহ.(১৩১৫-১৪০৩ হি.) আল্লামাতুল মা‘কুল ওয়াল মানকুল ইবরাহিম বলয়াবি রহ.(১৩০৪-১৩৮৭ হি.) শায়খুল আদব ওয়াল ফিকহ আল্লামা এ‘জাজ আলী রহ.(১২৯৯-১৩৭৪ হি.) প্রমুখ আসাতিযা কেরামের সুপ্রিয় ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। তিনি দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে দাওরা হাদিস শেষ করেন ২১ শা‘বান ১৩৬৮ হি.মোতাবেক ‘১৮ জুন ১৯৪৯ ইং.তারিখে.(ফয়যানে শায়খুল ইসলাম নাম্বার)

আসাতিযা কেরামের বিশেষ আস্থা, সুদৃষ্টির সৌভাগ্য এবং তাঁদের হৃদয় খোলা দোআ নিয়ে অত্যন্ত সুনামের সাথেই ছাত্রজীবন শেষ করেন। তিনি কর্মজীবনে সর্বপ্রথম বগুড়া জামিল মাদরাসায় শায়খুল হাদিস পদে নিয়োজিত হন। এখানে তাকে পাঠান হযরত শায়খুল ইসলাম মাদানি রহ.। ১৯৪৯-১৯৫১ঈ.এর সংক্ষিপ্ত সময়ে জামিল মাদরাসার বাইরে নানা জায়গায় নানা প্রতিষ্ঠানে তাঁর দরসের, ইলমও আমলের, আখলাক ও আদর্শের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৫১-১৯৫২ ইং. শিক্ষাবর্ষে বৃহত্তর মোমেনশাহীর সুপ্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠান জামিয়া আরাবিয়া আশরাফুল উলূম বালিয়া মাদরাসায় দাওরা হাদিস চালু হয়।ফলে সেখানে হাদিস বিশেষজ্ঞ একজন শায়খুল হাদিসের প্রয়োজন দেখা দেয়। সেখানে দাওরা হাদিসের উদ্যেক্তা ছিলেন শায়খুল হাদিস আল্লামা যাকারিয়া কান্ধলবি রহ. (১৩১৫-১৪০২হি.) এর স্নেহভাজন ছাত্র আল্লামা দৌলত আলী রহ.(১৯০১-১৯৮৮ঈ.)। তিনি বালিয়া মাদরাসায় বুখারি শরিফের দরসের জন্য জাওয়াদ রহ.কে মনোনীত করেন। ১৯৫১ ইং.সালের মাঝামাঝি সময়ে জামিল মাদরাসায় ইস্তফা দিয়ে বালিয়া মাদরাসায় বুখারির মসনদে সমাসীন হন তিনি। ১৯৫১-১৯৫৩ ইং.পর্যন্ত তিনি বালিয়া মাদরাসায় বুখারি শরিফসহ আরও কয়েকটি হাদিসের কিতাবের দরস প্রদান করেন। এরপরে তিনি আসেন ১৯৫৪ ইং.সালে কিশোরগঞ্জের আনওয়ারুল উলূম হয়বতনগর মাদরাসায়। তার তাদরীসী খেদমতের চতুর্থ প্রতিষ্ঠান সিলেটের দেউলগ্রাম মাদরাসা। ১৯৫৯ ইং.সালে দেউলগ্রাম মাদরাসায় বুখারির মসনদ সূচনা করেন।

১৯৫৯-১৯৭১ ইং.সাল পর্যন্ত তিনি দেউলগ্রাম মাদরাসায় শায়খুল হাদিস ছিলেন। ১৯৭১ ইং. এ মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের আর সব প্রতিষ্ঠানের মত দেউলগ্রাম মাদরাসাও বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় তিনি নিজ এলাকার রাজাগঞ্জ মাদরাসায় শিক্ষতার দায়িত্ব আঞ্জাম দেন। এবং ব্যক্তি উদ্যোগে নিজ এলাকায় ইসলামি আবহ বিরাজ রাখার প্রয়াস পান।

হযরত রহ. এর তাদরীসী খিদমতের পঞ্চম প্রতিষ্ঠান ঢাকা উত্তর রানাপিং মাদরাসা। ১৯৭২ ইং. সালে তিনি এ প্রতিষ্ঠানে প্রথম সারির মুহাদ্দিস হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৮১ ইং.সালের শেষ পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত সুচারুরূপে তাঁর দায়িত্ব আঞ্জাম দেন। এরপর ১৯৮১ ইং.মোতাবেক ১৪০১ হিজরীতে রাজাগঞ্জ মাদরাসায় দাওরা হাদিসের সূচনা হয়। জাওয়াদ রহ. রাজাগঞ্জ মাদরাসার আলেম-ওলামা, মজলিমে আমেলা ও শূরা এবং সর্বসাধারণের আবদারে ১৯৮২ ইং. সালে বুখারি শরিফের দরস শুরু করেন। ১৯ মুহাররম ১৪১৭ হিজরি মোতাবেক ৭ জুন ১৯৯৬ ইং. মুহাদ্দিস সাহেবের দুনিয়ার জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত রাজাগঞ্জ মারাসাতেই শায়খুল হাদিস এবং দীর্ঘকাল মুহতামিম পদে নিয়োজিত ছিলেন।

দেওবন্দ পড়ালেখার প্রাতিষ্ঠানিকতা শেষে শায়খুল ইসলাম মাদানি রহ.এর হাতেই বাইআত হন। শায়খুল ইসলাম মাদানি রহ. এর ইন্তেকালের পর মুহাদ্দিস সাহেব আপন শায়খের দ্বিতীয় খলিফা হাজি আব্দুল বারি রহ. এর কাছে মুরাজাআত করে তাঁর হাতে বাইআত হন এবং পরবর্তীতে তাঁর থেকে খেলাফত লাভে ধন্য হন।

১৯ মুহাররাম ১৪১৭ হি.মোতাবেক, ৭ জুন ১৯৯৬ ইং. রোজ শুক্রবার তিনি ইন্তেকাল করেন।

তথ্যসূত্র:
১. উইকিপিডিয়া
২. কওমিপিডিয়া
৩. বাংলাপিডিয়া
৪. বিভিন্ন দৈনিক এবং জার্নাল

The post তাঁরা সিলেটের গরবের ধন appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%81%e0%a6%b0%e0%a6%be-%e0%a6%b8%e0%a6%bf%e0%a6%b2%e0%a7%87%e0%a6%9f%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%97%e0%a6%b0%e0%a6%ac%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%a7%e0%a6%a8/

No comments:

Post a Comment