মওলবি আশরাফ:
মোকদ্দমা
বিবাদী দেবেন্দ্রনাথ-পুত্র রবীন্দ্রনাথের নামে বিদেশি সাহিত্য থেকে চুরি ও নকলের দায়ে ‘পাঠকের আদালতে’ দায়ের করা মোকদ্দমায় আমরা দুই ধরনের বিচারক পাই : একদল রবীন্দ্রনাথকে ‘চোর, কপিবাজ, লেখকই না’ ইত্যাদি বিশেষণের বিষমাখা খঞ্জর দিয়ে তীব্র আক্রমণ করে, আর অপর দল কেবল স্বীকার করে নেন রবীন্দ্রনাথ চুরি করেছেন। তৃতীয় আরেক দল (বিচারক না বলে উকিল বললেই বেশি খাপসই হবে) যারা প্রথম দলের ওপর ড্রামাটিক সুরে ‘অবজেকশন ইয়োর অনার’ বলবে, তাদের সন্ধান এখনতক প্রবন্ধকার পাননি, তাই তিনি দীর্ঘদিনের লাল গাউন ফেলে নিজেই কালো গাউন পরে দরবারে হাজির হয়েছেন। ইয়োর অনার, আমার মত ও অমত প্রকাশে আপনার অনুমতি প্রার্থনা করছি।
প্রথমেই স্বীকার নিচ্ছি রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আজকের দিন পর্যন্ত চর্চা ও বাকবিতণ্ডা সাহিত্যক্ষেত্রে আমাদের দৈন্যতাকেই বারবার সামনে এনে হাজির করে। সলিমুল্লাহ খান যখন বলেন রবীন্দ্রনাথকে তিনি আক্রমণ করেন এইজন্য যে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে শক্তিশালী কাউকে তার নজরে পড়ে না, আর নিজের শক্তিমত্তার পরীক্ষা তো আরেকজন শক্তিশালীর সাথে দৈতযুদ্ধেই হয়— আমরা তখন দ্বিমত পোষণ করতে পারি না। রবীন্দ্রনাথকে বলা যায় রাঘব বোয়াল, তার সামনে কোনো পুটিমাছই টিকে থাকেনি, তার নানামুখী শক্তিমত্তা এত বেশি যে, ‘রবীন্দ্রনাথ কে’ এই প্রশ্নের উত্তর আমরা এক শব্দে দিতে পারি না, কেননা শিল্প-সাহিত্যের এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ দিক নেই যেখানে তিনি হাত দেননি। যেখানে আর সব শিল্পীদের শিল্পের শ্রেষ্ঠত্ব প্রথম যৌবনেই ফুরিয়ে যায়, সেখানে রবীন্দ্রনাথ যত বুড়ো হয়েছেন তাঁর শিল্পত্বের রোশনাই উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছে। জীবদ্দশায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে অভিজাতকূল শ্রীমতী নারীরূপে উপস্থাপন তো করেছিলেনই, মৃত্যুর পরেও রেখে গেছেন বৃহস্পতিতুল্য প্রভাববলয়। এটা আমাদের জন্য বেদনাদায়ক বৈ অন্য কিছু নয়। মৃত্যুর আশি বছর পরেও তার চেয়ে মহান কারুর সময়কে প্রতিনিধিত্ব না করাই প্রমাণ করে আমরা এক জায়গায় আটকে আছি, থেমে আছে ঘড়ির কাঁটা প্রায় এক শতক ধরে, আমাদের প্রগতিশীলতার পরম্পরা অবিচ্ছিন্ন রয়নি। একথার সাথে সুর মিলিয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও, শেষের কবিতায় তিনি বলেন, ‘কবিমাত্রের উচিত পাঁচ-বছর মেয়াদে কবিত্ব করা…
ভালো লাগার এভোল্যুশন আছে। পাঁচ বছর পূর্বেকার ভালো-লাগা পাঁচ বছর পরেও যদি একই জায়গায় খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে তা হলে বুঝতে হবে, বেচারা জানতে পারে নি যে, সে মরে গেছে। একটু ঠেলা মারলেই তার নিজের কাছে প্রমাণ হবে যে, সেন্টিমেন্টাল আত্মীয়েরা তার অন্ত্যেষ্টি-সৎকার করতে বিলম্ব করেছিল, বোধ করি উপযুক্ত উত্তরাধিকারীকে চিরকাল ফাঁকি দেবার মতলবে।’
রবীন্দ্রনাথ একই সাথে সব্যসাচী আবার ছিলেন খুব উর্বর ও প্রভাবশালী। অনেক বাদীর ক্ষোভের পেছনে এই কারণটি থাকতে পারে। তারা হরেক পদ্ধতিতে হরহামেশাই চান রবীন্দ্র-বলয় ডিঙাতে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে আরো মহান বানাতে এর প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি, কিন্তু তাই বলে রবীন্দ্রনাথকে ইনকার করে রবীন্দ্র-বলয় ডিঙানোর জরুরত নেই। তারপরও বাদীপক্ষের অভিযোগ আমরা শুনব, নাহলে কোনো ফয়সালায় পৌঁছা সম্ভব হবে না ইয়োর অনার।
বলা হয় রবীন্দ্রনাথ একসময় ‘দ্বিতীয় চ্যাটার্টন’ হবার ‘চেষ্টায় প্রবৃত্ত’ হয়েছিলেন। রাসেল রায়হান লিখেন : টমাস চ্যাটার্টন ছিলেন জনৈক ইংরেজ কবি। এই ভদ্রলোক প্রাচীন গ্রিক কবিদের নকল করে কবিতা লিখতেন। ১৭ বছর বয়সে তিনি আত্মহত্যা করলেও তার সময়ে বেশ খ্যাতি লাভ করেছিলেন। চ্যাটার্টনের এই নকল করার ঘটনাটা রবীন্দ্রনাথকে খুব স্পর্শ করল। তিনি তখন মৈথিলী ভাষার কিছু প্রাচীন কবিতা-টবিতা আগ্রহ নিয়ে পড়েছেন। প্রাচীন কবিদের লেখা পড়তে পড়তে হঠাৎ দু–একটি ‘কাব্যরত্ন’ চোখে পড়ে, সে আবিষ্কারে তিনি অন্ধকারে মাণিক্য তুলে আনার আনন্দ পান। চ্যাটার্টনের গল্প শুনে হঠাৎ বালক রবীন্দ্রনাথের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। এক বর্ষার দুপুরে খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে ওই মৈথিলী কবিতার অনুকরণে লিখে ফেলেন কয়েক লাইন কবিতা। নিজের কৃতিত্বে তখন দারুণ খুশি তিনি। কয়েক দিনের মধ্যেই লেখা হতে থাকল আরও কয়েকটি। এবার লেখকেরও তো একটা নাম দিতে হয়। তাই নিজেই নাম ঠিক করলেন—ভানুসিংহ। পরবর্তীতে এই কবিতার সংকলনই হয় রবীন্দ্রনাথের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’
কৈশোরের ব্যাপারস্যাপার সহনীয় চোখে দেখা যায়, কিন্তু বাঙালির গর্ব নোবেল পদক পাওয়া যেই কাব্যগ্রন্থ নিয়ে, গীতাঞ্জলির ইংরেজি তর্জমা The song offerings-এর বিভিন্ন কবিতায় বাইবেলের Songs of Solomon-এর মধ্যে খুল্লামখোল্লা মিল পান, মিল পান বেশ কিছু খ্রিষ্টীয় গানেও, তখন রবীন্দ্রমোল্লাদের মুখের বাত্তি ডিম হয়ে যায়, বলার কোনো কথাই পান না।
এছাড়াও ‘চিত্রা’ কাব্যের ‘এবার ফিরাও মোরে’ এবং ‘মানসী’ কাব্যের ‘বধূ’ কবিতা দুটির ভাব ও কাঠামো ইংরেজ কবি শেলি ও ওঅর্ড্স্ওঅর্থের কবিতার নকল বলে অনেকে অভিমত প্রকাশ করেছেন। এডগার এলান পো ও ন্যাথানিয়েল হর্থনের গল্পের মিল রয়েছে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গল্পে। এরমধ্যে ‘রবিবার’ গল্পটি এলান পো’র ‘দ্য এথিস্ট’ গল্পের হুবহু কপি।
তবে একথা এড়িয়ে যাবার জো নেই যে, বাদীপক্ষের কারো কারো মোকদ্দমায় হিংসার হলদে অনল নিশ্চিতরূপে ছিল, নয়তো কালীপ্রসন্ন বিদ্যাবিশারদ তার ‘মিঠেকড়াতে’ এভাবে লিখতে পারতেন না— “রবীন্দ্রনাথ মোটেই লিখতে জানতেন না, স্রেফ টাকার জোরে ওর লেখার আদর হয়। পাঁচকড়ি বাবু একথাও বহুবার স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের প্রায় যাবতীয় সৃষ্টিই নকল। বিদেশ থেকে ঋণ স্বীকার না করে অপহরণ।”
মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম লিখেন, “বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেসব কবিতা লিখেছেন তার অধিকাংশই অন্য কবির কবিতা থেকে চুরি করে লিখেছেন।”
জবানবন্দি
তো আমি আজকের সভায় বিচারকের সামনে উপস্থাপন করব রবীন্দ্রনাথের কাব্যধর্মী উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’। কারো কাছে উপন্যাসটি যেমন ‘নেহাৎ মামুলি একটি গল্প শব্দবিন্যাসের জোরে জমানা উতরে গেছে’ মনে হয়, আবার কারো জবানে ‘ক্লাসিক, মনস্তাত্ত্বিক, কালজয়ী, অনন্য শিল্পকর্ম’ বিশেষণে আদৃত। বাংলাভাষীদের সাহিত্যচর্চার সর্বোচ্চ পর্যায়ের একটি আখড়ায় যুক্ত হওয়ার সময় ভাইভাবোর্ডে ‘শেষের কবিতা’ থেকে প্রশ্ন করা হয়, তারা মনে করেন ‘এখন পর্যন্ত যিনি শেষের কবিতা পড়েননি, বাংলাসাহিত্যের দরজার চৌকাঠে তার পা পড়েনি।’ তো আসল কথা হলো— এমন সুপ্রসিদ্ধ একটি উপন্যাসে খোদ রবীন্দ্রনাথই অমিত রায় চরিত্রের মুখ দিয়ে দিয়েছেন তার চুরির জবানবন্দি!
ঘটনা অনেকটা এমন : অমিত রায় খুবই ব্যতিক্রমী এক চরিত্র। একদিন ওদের বালিগঞ্জের এক সাহিত্যসভায় রবি ঠাকুরের কবিতা ছিল আলোচনার বিষয়। অমিতের জীবনে এই সে প্রথম সভাপতি হতে রাজি হয়েছিল… একজন সেকেলেগোছের অতি ভালোমানুষ ছিল বক্তা রবি ঠাকুরের কবিতা যে কবিতাই এইটে প্রমাণ করলেন। দুই-একজন কলেজের অধ্যাপক ছাড়া অধিকাংশ সভ্যই স্বীকার করলে, প্রমাণটা একরকম সন্তোষজনক। সভাপতির আলোচনার পালা এলে অমিত রায় রবীন্দ্রনাথকে আক্রমণ করে নানা কথার ফাঁকে একথাও বলেন—
‘… রবি ঠাকুরের বিরুদ্ধে সব চেয়ে বড়ো নালিশ এই যে, বুড়ো ওঅর্ড্স্ওঅর্থের নকল করে ভদ্রলোক অতি অন্যায়রকম বেঁচে আছে।’
একদম সরল স্বীকারোক্তি। তবু সওয়াল ওঠে, একজন শিল্পী বা সাহিত্যিক চুরি করে নকল করে কেবল স্বীকারোক্তি দিলেই কি বেকসুর খালাস?
এই সওয়ালের জবাব দেওয়ার আগে আমাদের জানতে হবে সাহিত্যে ও শিল্পে চুরি বা নকল অনৈতিক কিনা। বুড়ো সক্রেটিসকে কি যদি আবার আদালতে হাজির করি, তিনি প্লেটোর মুখ দিয়ে বলবেন, ‘যথাযথ শাসিত একটি রাষ্ট্রে কবি ও শিল্পীদের প্রবেশকে নিষিদ্ধ করাই সঠিক সিদ্ধান্ত।’ কী কারণে কবি ও শিল্পীদের ওপর এমন দয়ামায়াহীন রায়, যদি এই প্রশ্ন করি, প্লেটোর মুখ দিয়ে সক্রেটিস তখন বলবেন, ‘উত্তমত্ব এবং মন্দত্বের প্রশ্ন যখন আসে, তখন অনুকৃত-জিনিস অনুকরণকারী সৃষ্টি করে, তার ব্যাপারে তার যেমন কোনো ধারণা থাকে না, তেমন সত্য অভিমতও থাকে না।…
কবি যখন সৃষ্টি করে, তা কি ভালো, না মন্দ, তা না জেনেই কবিতা রচনা করে যেতে থাকে : আর যে অনুকৃতি তিনি সৃষ্টি করেন, তা হয় নাদান আমজনতার রুচিতুষ্টিকারী জিনিস।… কেননা অনুকরণ সবসময় সত্য থেকে দুই কদম দূরে অবস্থিত।’ (প্লেটোর রিপাবলিক, দশম পুস্তক, অনুবাদ : আমিনুল ইসলাম ভুইয়া)
এই বক্তব্য যুগ যুগ মানুষদের ভাবিয়েছে, ক্রিটিকেরা আলোচনা-সমালোচনা করেছে, অবশেষে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়েছে যে, একজন শিল্পীর কাজ নয় আদর্শের জন্য কবিতা লেখা, তবে তারা চাইলে পারে কবিতায় শিল্পে কোনো আদর্শকে উপস্থাপন করতে, কিন্তু সৃষ্টির ব্যাপারে তারা স্বাধীন। একজন কবি যখন শব্দ দিয়ে কিছু আঁকেন, একজন চিত্রশিল্পী যখন তার ক্যানভাসে কবিতা বুনন করেন, তখন তারা নির্মাণ করেন আপন গতিপথ, আপন ধর্ম।
একজন শিল্পীর শিল্পচেতনা জন্ম নেয় প্রকৃতি কিংবা সামাজিক বাস্তবতা কেন্দ্র করেই, কিন্তু শিল্পীর জন্য জরুরি নয় সামাজিক-রীতিনীতি অনুশাসন অনুসরণ করা।
শিল্পী কোনো নীতি-নৈতিকতার প্রচারক বা নবী নয়। শিল্পী যদি নিরাবরণ শরীরকে পবিত্রতার প্রতীকী বানায়, তবে তা-ই সই। কারণ শিল্পী স্রেফ সৌন্দর্যের পূজারী, আর সত্যকেই কেবল সুন্দর হতে হবে এমন কোনো কথা নেই, মিথ্যাও সুন্দর হতে পারে। মিথ্যাও মানুষকে তৃপ্ত করতে পারে, আবার তৈরি করতে সত্যকে গ্রহণ করার নতুন যৌক্তিকতা।মিথ্যা না থাকলে সত্য সত্যই-বা হবে কি করে
তাছাড়া নীতিনির্ধারকের ছাঁকনিতে ঢালার আগে যেকোনো জিনিসই সত্য কিংবা মিথ্যা হওয়ার গুণসম্পন্ন থাকে। এখন যদি আইন করা হয় কোনো মিথ্যা সৌন্দর্য সৃষ্টি করা যাবে না, তাহলে গোটা সৃষ্টিশীলতার পথই রুদ্ধ হয়ে যাবে, যা কিছুতেই উচিৎ নয়। কোনটা উত্তম কোনটা মন্দ, কোনটা গ্রহণীয় কোনটা অগ্রহণযোগ্য— সেটা নাহয় নির্ধারণ করবে রাষ্ট্র বা ধর্ম। কিন্তু শিল্প চিরকাল স্বাধীন। এবং শিল্পের ওপর এই বিধিনিষেধ আরোপ করাও সম্ভব নয়।
একটু আবেগী হয়ে প্লেটো-সক্রেটিসে চলে গেলেও আমাদের মাথার ওপরে কিন্তু এখনও এই প্রশ্ন ঝুলছে— ‘শিল্পে চুরি বা নকল কি জায়েজ?’
ইতোমধ্যে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়েছে, ‘কবি বা শিল্পী প্রচলিত নৈতিকতা দ্বারা পরিচালিত হন না, বরং তারা নিজেরাই সৃষ্টি করেন নয়া নয়া নীতি।’ শিল্পে ও সাহিত্যে চুরি বিষয়ে তাদের নীতি হলো এটি বিনাপ্রশ্নে জায়েজ!
কেন এই নীতি? কারণ এই অমীয় বাণী : ‘এন কোল খাদাশ তাখাত হাশামেশ’— সূর্যের নীচে নতুন কিছুই ঘটে না। (אֵין כָּל חָדָשׁ תַּחַת הַשָּׁמֶשׁ —Hebrew bible, Old testament, Ecclesiastes, 1:9)
আরেকটু পষ্ট করে বলি, একই সূর্যের নীচে নতুন কিছু যদি ঘটে তাহলে শিল্পের জন্ম তো এভাবেই হবে যে, শিল্পী এখান থেকে একটু নিবে ওখান থেকে একটু নিবে তারপর সবগুলোর মিশ্রণ ঘটিয়ে সৃষ্টি করবে নতুন এক কিছু।
Art is a Mutation— শিল্প জিনিসটা হলো রূপান্তর। ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ার মতো রূপ বদলে বদলে একে শক্তিশালী হতে হয়। যত বেশি হোস্ট ধরতে পারবে আর শুষে নিতে পারবে শক্তি, ততই সে ক্ষমতাশালী হয়ে উঠবে। এই জন্যই আহমদ ছফা ব্রাত্য রাইসুকে রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এই যে বিভিন্ন জায়গা থেকে নিয়ে তালি দেওয়ার ক্ষমতা এটাই মানুষকে বড় করে।’
সাহিত্যে চুরি বা নকলকে বলা হয় প্রভাব। জর্মন কবি গ্যোয়েটে যেমন বলেন, “সাহিত্যে তালি মারা একটা আর্ট। একে (স্থূল অর্থে) চুরি বলা ঠিক না। কারণ বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশল এখানে খাটাতে হয়।”
ইংরেজিতে এর জন্য আলাদা টার্ম আছে, Plagiarism —এর অর্থ সাহিত্য ভাবনা চুরি বা অপহরণ। বাংলায় এর প্রতিশব্দ বানানো হয়েছে : কুম্ভীলকবৃত্তি। (বাদীপক্ষের রসকষহীন যেসব মনোবিজ্ঞানী লেখা চুরিকে মেন্টাল ডিজঅর্ডার অভিহিত করেছেন, তারা এর নাম দিয়েছেন— স্কাপিসট্রি।)
প্রভাব বিষয়ে বিভিন্ন লেখকদের টুকরো টুকরো অনেক কথা আছে। যেমন :
অস্কার ওয়াইল্ড বলেন, “অপরের ধারণা যুক্ত করে চূড়ান্ত সৃষ্টিশীল হয়ে ওঠা লেখকের অধিকারের মধ্যে পড়ে।”
আমেরিকান নাট্যকার উইলসন মিজনার বলেন, “একজনের লেখা বা ভাবনা অনুকরণ যদি দূষণীয় হয়, তবে দুজন বা ততোধিক লেখকের ধারণা বা ভাবনার অনুসরণ কী করে গবেষণার স্বীকৃতি পেতে পারে? তাহলে তো আর গবেষকদের ভাতই নেই। গবেষণা মাত্রই চুরি।”
তবে প্রভাব বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ ধারণা পাই নোবেলজয়ী সাহিত্যিক মঁসিয়ে অঁদ্রে জিদ থেকে। তিনি তার ‘সাহিত্যে প্রভাব’ প্রবন্ধে লিখেন ‘এমন কিছু কল্যাণকর প্রভাব আছে, যা সাধারণের চোখে ভালো মনে হয় না। অথচ প্রভাবকে চূড়ান্তভাবে ভালো বা মন্দ কোনোটাই বলা উচিত নয়। কারণ প্রভাবের যাচাই হয় যিনি প্রভাবিত হন তাঁর ভালো-মন্দের আপেক্ষিকতায়।’
অঁদ্রে জিদ আরও বলেন,
‘প্রভাবকে ভয় করে যাঁরা দূরে সরে থাকেন তাঁরা আত্মার দৈন্যকেই তুলে ধরেন। তাঁদের মাঝে নতুন কিছু খোঁজা বৃথা। কেননা নতুন কিছু অর্জনের প্রয়াস তাঁদের মাঝে নেই।’…
‘মহৎ ব্যক্তিরা হৃদয়ের সকল আকুতি দিয়ে প্রভাবকে স্বাগত জানিয়েছেন। কারণ মহৎ সৃষ্টির সম্ভাবনার প্রতীক্ষায় এঁরা নববধূর মতোই কম্পিত-বক্ষ। হৃদয়ের বিপুল সম্ভারকে এঁরা নিশ্চিতরূপে জানেন’…
(সাহিত্য ও নন্দনতত্ত্ব বিষয়ক তিনটি ফরাসি প্রবন্ধ, অনুবাদক : মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ)
ইয়োর অনার, হয়তো খেয়াল করেছেন যে, শিল্প ও সাহিত্যে চুরির বৈধতা দিতে গিয়ে বিভিন্ন তত্ত্ব আমিও চুরি করে জোড়াতালি লাগিয়ে উপস্থাপন করছি। পাবলো পিকাসো কতই-না চমৎকার বলেছেন, ‘ভালো শিল্পীরা নকল করেন আর মহান শিল্পীরা করেন চুরি!’
The post শেষের কবিতা ও অয়ং ভয়ং রবীন্দ্রনাথং appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%b6%e0%a7%87%e0%a6%b7%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%95%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a6%be-%e0%a6%93-%e0%a6%85%e0%a7%9f%e0%a6%82-%e0%a6%ad%e0%a7%9f%e0%a6%82-%e0%a6%b0%e0%a6%ac%e0%a7%80%e0%a6%a8/
No comments:
Post a Comment