Friday, June 25, 2021

আব্দুল মুত্তালিব

মুহাম্মদ মাসুম মুনতাসির:

দরজায় কড়া নাড়লেন হাশিম। হাশিম মক্কার কুরাইশ গোত্রপতি। তার সুনাম সর্বত্র। দুহাতে মানুষকে দান করেন। অনাহারীর জন্য সবসময় তার দুয়ার থাকে উন্মুক্ত।
গ্রীষ্মকালীন বাণিজ্য শেষে আজই তিনি সিরিয়া থেকে ফিরলেন। ক্লান্তিতে পথচলা দুষ্কর। তাই ইয়াসরিবের বনু নাজ্জারের সরদার বন্ধুবর আমরের গৃহে এসে থামলেন বিশ্রামের জন্য। প্রতিবারই সিরিয়ায় আসা-যাওয়ার পথে বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে আসেন হাশিম। আমরও ইয়েমেন সফরে গেলে হাশিমের বাড়ি হয়েই যান।
আবারও নক করলেন হাশিম। না, এত দেরি তো কখনও হয় না- আনমনে বিড়বিড় করতে লাগলেন তিনি।

দরজায় প্রথম টোকা পড়তেই দৌড়ে এসেছিল সালমা। কিন্তু দোটানায় পড়ে গেছে সে, লোকটাকে কেমন চেনা চেনা লাগছে; আবার অচেনা। বেশ কিছুক্ষণ ধরে উশখুশ করছে সে, খুলবে কি খুলবে না। যাক, খুলে দেখি কী বলে? এই ভেবে দরজা খুললো সে।

খট করে দরজা খোলার শব্দ হলো। ফিরে তাকালেন হাশিম। আচমকা চেহারায় জড়ো হওয়া একরাশ বিরক্তি হাওয়ায় উড়ে গেল। অসম্ভব এক ভালোলাগা হাশিমের হৃদয়ে নৃত্য তুললো। কিছুক্ষণ নীরবতা বিরাজ করলো দুজনের মাঝে। নৈঃশব্দ ভেঙে সালমা-ই প্রথম বলে উঠল, ভিতরে এসে বসুন! হাশিম পা বাড়াতেই সালমার দৌড়ে ভিতরে চলে গেলো। তার নুপুরের রিনিঝিনি শব্দে সারাঘর নেচে উঠলো।

একটু হেলান দিয়ে বসতেই দুচোখে ঘুম চলে এলো হাশিমের। বাইরে পায়ের আওয়াজ শুনে আবার শান্তির একপশলা ঘুম উবে গেল। দরজায় এসে দাঁড়ালো সে।
– আরে বন্ধু যে, আজই ফিরলে না কি? হাশিমকে দেখে বললেন আমর।
– হ্যাঁ বন্ধু, তোমার অপেক্ষাতেই বসে আছি!
– তো বন্ধু এবার ব্যবসা-বাণিজ্য কেমন হলো?
– ভালোই বন্ধু, ওসব কথা পরে বলা যাবে।
– আচ্ছা তাহলে তুমি কিছু খেয়ে একটু ঘুমাও, আমরা পরে কথা বলি।
দুজনের কথা শেষ হতেই সালমা এসে দুয়ারে দাঁড়ালো।
– এই তো মা খাবার নিয়ে এসে গেছে। এসো মা, এসো! বন্ধুর সামনে এনে রাখো, কত দূর সফর করে এসেছে।
লাজরাঙা ঠোঁটে মুচকি হেসে হাশিমের সামনে খাবারগুলো রেখে আবার ভিতরে চলে গেল সালমা।
হাশিম খেতে লাগলেন। এদিকে তার হৃদয়ে তোলপাড় শুরু হলো। বিষয়টা তিনি চেষ্টা করেও মন থেকে সরাতে পারছেন না। নাছোড় চিন্তাটা বারবার ডুব দেয়া হাঁসের মতো মাথা জাগিয়ে তুলছে। না, আর অপেক্ষা করা যায় না, বন্ধুকে বলেই দেখি বিষয়টা- মনে মনে স্থির করলেন তিনি।
বসা থেকে উঠতে যাচ্ছিল আমর। হাশিম বললো, কোথায় যাচ্ছো বন্ধু? তোমার সাথে একটু আলাপ আছে!
– তুমি খেয়ে নাও, পরেই না হয় বলো!
– না , আমি এখনই বলতে চাই!
– আচ্ছা বলো , কী বলবে?
– আমি তোমার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই!
– সত্যি বলছো?
সম্মতি সূচক মাথা নাড়ালেন হাশিম।
– সে তো ভালো কথা! আমার মেয়ে মক্কার রানী হবে এরচে সৌভাগ্যের আর কী আছে?

সে রাতেই বিয়ে হয়ে যায় হাশিম আর সালমার। পরদিন সকালে নববধূকে নিয়ে হাশিম ফিরে আসেন মক্কায়। এরপর বেশ ক’মাস কেটে যায়…

দুই.

শীতকালীন বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আবারো শামে যাত্রা করলেন হাশিম। পথিমধ্যে ইয়াসরিবে সালমাকে বাবার বাড়িতে রেখে এসেছেন। সালমা এখন সন্তানসম্ভবা।
যাবার বেলায় কতো করে বলেছিলো- এবার না হয় নাই গেলে, নতুন মেহমান আসছে কিছুদিন বাদে!
‘সোনামানিক আসতে আরও মাসখানেক, ততদিনে আমি ফিরে আসব আবার তোমার কাছে!’ এতোটুকু বললেই চলে এসেছিল হাশিম। এখন সে সিরিয়ার বেশ কাছাকাছি।

ওদিকে সালমা চিলেকোঠার জানালা খুলে তাকিয়ে আছেন বিরান বালুচরে। হঠাৎ তার দৃষ্টি আটকে গেল। দূর থেকে মনে হলো, কোন ঘোড়সওয়ার এদিকেই আসছেন। হ্যাঁ তাইতো, তিনি তো বেশ কাছে চলে এসেছেন এবং খুব দ্রুত ছুটছেন। তবে কি হাশিম ফিরে আসছে নাকি কোন দুঃসংবাদ? সালমার মনে এক অজানা আতঙ্ক দানা বেঁধে উঠল। তার কপালের ভাঁজে প্রশ্নবোধক চিহ্ন ফুটে উঠল।

আগন্তুক এসে বাড়ির আঙ্গিনায় ঘোড়া থামালেন। দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলেন সালমা। একসাথে দু’ধাপ করে নামতে গিয়ে হোচট খেয়ে পড়লেন। ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠলেন। একজন পরিচারিকা এসে তাকে তুললেন, বেগম সাহেবা, আপনি প্রসূতি সে কথা ভুলে যাবেন না, আপনার কোন ক্ষতি হলে?
সালমা বললেন, না না, আমি ঠিক আছি। তুমি আগন্তুককে ডেকে পাঠাও!

একজন মাঝবয়েসী লোক ঘরে ঢুকলো। গাঁয়ে ঢিলেঢালা পোষাক। ডান হাতে ধরা ছোট্ট একটা চিরকুট। সালমা বললেন, কোন সংবাদ নিয়ে এসেছেন বুঝি?
– হ্যাঁ, এই চিরকুটটা!
– কী আছে ওটাতে, দেখি!
লোকটার হাতে কাগজটা নিলেন সালমা। হাতের মুঠোয় রেখে কিছুক্ষণ চোখ বুজে রইলেন। খুলবেন কিনা মনস্থির করতে পারছেন না। আস্তে আস্তে তিনি পাপড়ি মেললেন। চোখের সামনে কাগজটি ধরলেন। লেখাটা দেখার সাথে সাথে এক চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন তিনি।

তিন.

বিকেলের রোদ ঝিমিয়ে এসেছে। চিলেকোঠার জানালায় এসে দাঁড়ালেন সালমা। কয়েকটা খেজুরডাল এসে জানালা ছুঁয়েছে। দক্ষিণে আজওয়া খেজুরগাছে একটা নীল পাখি এসে বসেছে। কেমন যেন করুণ সুরে ডেকেই যাচ্ছে। পাখির ডাকে বিকালের সুনসান নীরবতা শব্দমুখর হয়ে উঠছে। শিশু শায়বা তখনও ঘুমে। ওর বয়স মাত্র দুদিন। কপালের কাছে দু-তিনটে সাদা চুল ঝুলে আছে, তাই আদর করে সালমা ওর নাম রেখেছে শায়বা (শুভ্র কেশগুচ্ছ)।

ঘাড় ঘুরিয়ে কিছুক্ষণ নিষ্পলক ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন সালমা। ছেলেটা দেখতে একেবারে বাবার মতো হয়েছে। স্বামীর অনুপস্থিতিতে ওর মুখ দেখেই আমাকে বেঁচে থাকতে হবে, এই ভেবে শক্তি সঞ্চয় করলেন তিনি। হাশিম যে এভাবে সন্তানের মুখ না-দেখেই চিরবিদায় নিবে সালমার মনের দেয়াল ডিঙিয়েও আসেনি কোনদিন এমন কোন চিন্তা। সালমা মনে মনে ভাবলেন- শায়বা বড় হলে, ওকে নিয়ে একদিন ফিলিস্তিনের গাজায় যাব- হাশিমের কবর যিয়ারতে।

চার.

জনতার ভিড় ঠেলে সাত বছর বয়সী এক বালক এসে মাঠে দাঁড়ালো। মায়াবি চেহারা আর কপালের সামনে ঝুলতে থাকা একগুচ্ছ সাদা চুলে ওকে অপরূপ লাগছে। উৎসুক দর্শকদের দৃষ্টি তখন ওর দিকে। সবার দৃষ্টিতে এক অপূর্ব মুগ্ধতা। অনেকে ফিসফিস করে বলছে, এতটুকুন ছেলে তীর ছুড়বে, পারবে তো?

আয়োজকদের একজনকে সামনে আসতে দেখা গেল। তিনি বালকটির হাত উঁচু করে ধরে বললেন, এ হচ্ছে ইয়াসরিবের সরদার আমরের একমাত্র দৌহিত্র। আজকের প্রতিযোগিতায় ও সর্বকনিষ্ঠ প্রতিযোগী। দেখা যাক তীর খেলায় ও কেমন পারদর্শিতা দেখায়।

জনতার চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল। একপা দুপা করে বালকটির তূণীরের কাছে এলো। নানা রঙের তীর থেকে সাদা একটি তীর উঠিয়ে লক্ষ্যে তাক করলো। দুপা এগিয়ে নিশানা লক্ষ্য করে ছুড়ে মারলো। জনতার মাঝে মুহুর্মুহু ধ্বনি উঠলো- মারহাবা! মারহাবা! সাবাস বালক সাবাস!

মক্কার এক কাফেলা এ পথেই সিরিয়া থেকে মক্কা ফিরছিলেন। পথিমধ্যে ছেলেদের হৈ-হুল্লোড় ও আনন্দ-উৎসব দেখে কিছুক্ষণ যাত্রাবিরতি দিলেন। কাফেলার আমির কী ভেবে যেন সামনে এগিয়ে গিয়ে বালকটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার নাম কী?
বালকটি মুষ্টিবদ্ধ হাত উর্ধ্বে তুলে বলল, হাশিম বিন আবদে মানাফের পুত্র শায়বা।
উত্তর শুনে দেরি না করে ঘোড়া নিয়ে মক্কা অভিমুখে ছুটলেন লোকটি।

পাঁচ.

হাশিমের মৃত্যুর পর তারই সহোদর ভাই মুত্তালিব মক্কার সর্দার হন। ভাইয়ের সব দায়-দায়িত্ব নিজেই কাঁধে তুলে নেন। অন্যান্য গোত্রের সরদারদের সাথে পরামর্শ করে মক্কার বিভিন্ন আশয়-বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন। আজও তেমনি একটি পরামর্শ-সভার জন্য অন্যান্য গোত্রপতিদের নিয়ে তিনি কাবার চত্বরেই বসা ছিলেন। হঠাৎ ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি শুনে ফিরে তাকালেন, আরে বনু হারিসের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী যে! কেমন আছেন? সিরিয়া থেকে কবে ফিরলেন? আগন্তুককে দেখে বলে উঠলেন মুত্তালিব।
– সেসব কথা পরেও বলা যাবে, আমি আপনাকে একটা বিষয় জানানোর জন্য বাজপাখির গতিতে ছুটে এসেছি।
– কী সেই বিষয়, যা জানানোর জন্য আপনি এত মরিয়া হয়ে উঠেছেন?
– সিরিয়া থেকে আসার পথে আমি কজন বালককে তীর খেলতে দেখেছি, তাদের মধ্যে হাশিমপুত্র শায়বাও ছিল। আমার কাছে তাকে মদিনায় রাখা ভালো মনে হয়নি, তাই আপনাকে জানাতে এসেছি!
– আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনি আপনার উটটি দিতে রাজি হলে, আমি এখনই মদিনায় যেতে চাই!

বেলা শেষে লাল আবির ছড়িয়ে অস্তাচলে ফিরছে সূর্য। একটু একটু করে পৃথিবীকে ঘিরে নিচ্ছে আঁধার। বাড়ির উঠানে বন্ধুদের সাথে বল খেলছিল শায়বা। খেলতে খেলতে একসময় বলটি বেশ দূরে চলে যায়। শায়বা বল কুড়িয়ে আনতে দৌড়ে যায়। মাটি থেকে বল তুলে মাথা উঁচু করতেই একজন অশ্বারোহীকে দেখতে পায়। আগন্তুকের চোখে চোখ পড়ে শায়বার। আগন্তুক বুঝতে পারেন, এই তার ভাই হাশিমের পুত্র শায়বা। তবুও অপরিচিতের মতো শায়বাকে পরিচয় জিজ্ঞাসা করেন, তোমার নাম কী খোকা?
– আমি মক্কার সরদার হাশিমের পুত্র শায়বা!
– আমি তোমার মায়ের সাথে দেখা করতে চাই!
– মায়ের সাথে কথা বলবেন? মা তো ওই ঘরেই আছেন, চলুন!

– আমি হাশিমের ভাই মুত্তালিব। ঘরে ঢুকে নিজের পরিচয় দিলেন আগন্তুক।
– কেমন আছেন? আপনার আগমন শুভ হোক!
– জি ভালো আছি। আমি শায়বাকে মক্কায় নিয়ে যেতে চাই, যদি আপনার অনুমতি হয়!
-না না, অনুমতির কী আছে? আপনি ওকে নিয়ে যেতে পারেন!

পরদিন ভরদুপুর। কাবার চত্বরে তখন অনেক মানুষের ঢল। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গোত্রে গোত্রে বিভক্ত হয়ে বসেছে গল্পের আসর। কোথাও হচ্ছে কবিতা প্রহর। কেউবা খেলা দেখিয়ে দর্শককে মাতিয়ে তুলছেন। এসময় শায়বাকে নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করেন মুত্তালিব। তার পিছনে অপরিচিত বালককে দেখে লোকেরা বলাবলি করতে লাগল, উটের পিছনে কে বসা?

শায়বার গায়ের পোশাকটি ছিল ধুলোমলিন, তাই মুত্তালিব সঠিক বিষয়টা বলতে কিছুটা সঙ্কোচ বোধ করলেন। তিনি বললেন, ও আমার গোলাম!
পরে তিনি শায়বাকে বাড়িতে নিয়ে গেলেন। তখন তার স্ত্রী খাদিজা বিনতে সাঈদও একই প্রশ্ন করলেন, তোমার সাথে এ বালকটি কে? কীইবা তার পরিচয়?
তিনি বললেন, এ আমার গোলাম।
এরপর তিনি শায়বাকে সুন্দর একজোড়া পোশাক পরিয়ে আবদে মানাফ গোত্রের মজলিসে মক্কার উপস্থিত হলেন। সেখানে তিনি তাদেরকে পুরো ঘটনা খুলে বললেন এবং শায়বাকে ভাতিজা বলে পরিচয় দিলেন।

কিন্তু প্রথম যেহেতু তিনি শায়বাকে তার গোলাম বলে পরিচয় দিয়েছিলেন, আর আরবে গোলামকে ‘আবদ’ বলা হয়। এজন্যই আরবের সবাই শায়বাকে আব্দুল মুত্তালিব বা মুত্তালিবের গোলাম বলে ডাকতেন। এটাই ছিল শায়বার আব্দুল মুত্তালিব হয়ে ওঠার গল্প। পরবর্তীতে এই আব্দুল মুত্তালিবই হয়ে ওঠেন কুরাইশের অবিসংবাদিত নেতা।

The post আব্দুল মুত্তালিব appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%86%e0%a6%ac%e0%a7%8d%e0%a6%a6%e0%a7%81%e0%a6%b2-%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%a4%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a6%bf%e0%a6%ac/

No comments:

Post a Comment