ইবরাহীম জামিল:
মহিত শেখ এতো জোরে মায়া বলে চিৎকার করে উঠেছিল যে, সামনে যে পাহাড়ের চূড়াটা দেখা যায় ওই পাহাড়ের বাসিন্দারা পর্যন্ত চমকে গিয়েছিলো। ডাক দিয়ে মহিত শেখ অনেক্ষণ কান পেতে রইল। আওয়াজ একটা ফিরে এলো বটে, কিন্তু সেটা তার নিজেরই চিৎকারের প্রতিধ্বনি। মায়ার কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না। মহিত শেখ নিচের দিকে তাকালো, অনেক নিচে ছোট ছোট পাহাড়ের পিঠে দুধের সরের মতো জমে থাকা মেঘ দেখা যায়, সেখানে মায়ার কোনো চিহ্ন নেই।
সেই ভোর সকাল হতে মহিত শেখ মায়া মায়া বলে চেচাচ্ছে। পাড়ার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে একবার বলতে এসেছিলো, মহিত মিয়া! ওই রকম হাম্বা হাম্বা করছো কেনো? গরু বুঝি কারো হারিয়ে থাকে না?
মহিত চোখ গরম করে বলেছে, গাই তোদের না আমার? ওই গাইয়ে আমার সংসার চলে। তোমরা আমার সমস্যা বুঝবে না।
কেউ টিপ্পনি কেটে বলল, কেন, ধর্ম আরেকটা পাল্টালেই তো হয়! মহিত শেখ হাতের লাঠি হাতে তেড়ে যেতেই সবাই পড়িমরি করে ছুটে পালালো। বুড়োকে না রাগালেই ভালো। বয়সকালে তার নাকি খুনোখুনির স্বভাব ছিলো।
দুপুর যখন গড়াচ্ছে মহিত শেখ তখন সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলল। পাহাড় বেয়ে নিচের ওই গ্রামটাতে নামবে সে। নিচের লোকগুলো বড্ড ত্যাদড়। মাঝে মাঝে এটা ওটা চুরি করে নিয়ে যায়। সেবার রমেশের শুকরের গোয়ালে হানা দিয়েছিলো নিচের পাড়ার কারবারির ছোট ছেলেটা। নাম গদাই না কী যেন। নিচে নেমে গদাইটাকে যদি পায় তবে একটা গোলমাল সে বাধাবে। গায়ের চামড়া বুড়িয়ে গেছে বলে শেষ হয়ে গেছে নাকি, যার ইচ্ছা গরু চুরি করে নিয়ে যাবে?
পাহাড় বেয়ে নামার সময় মহিত শেখের চোখে পানি এসে গেলো। একেবারে ছেলেবেলায়, সে যে কতকাল আগে মহিত শেখ ঠিক বলতে পারবে না। একদিন তার দাদুর কাঁধে চড়ে এই পাহাড়ে উঠেছিলো। সাথে তার মা, তার দাদীমণি, তাদের প্রিয় দুটো শুকর ছানা। সবই ছিলো। কোনো এক লোকালয়, এই পার্বত্য চট্টগ্রামেরই কোনো এক পাহাড়ী অঞ্চল ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে তারা এখানে এসে উঠেছিল। তারপর কত কত বছর কেটে গেছে! দাদা বিগত হয়েছেন, দাদীমণিও দেহত্যাগ করেছেন, সে শুকর ছানা দুটোর নাতিপুতিতে ভরে গেছে এই পাহাড়ী অঞ্চলটা। শুধু একটি পরিবার থেকে এই পাহাড়ের চূড়াটি হয়ে উঠেছে একটি লোকালয়।
লোকালয়টির নাম আগুনখেয়া। আগুনখেয়ার সবচেয়ে প্রাচীণ নাগরিক এখন মহিত শেখ। দাদা পাহাড় আবাদ করায় মহিত শেখই এখানকার বর্তমান কারবারি। সমস্যা হল, মহিত শেখের স্বভাবে খানিকটা পাগলাটে ভাব আছে। যে কারণে কেউ তাকে কারবারির যোগ্য মর্যাদাটা দেয় না। অবশ্য মর্যাদা অমর্যাদা মহিত শেখ বোঝে না। বুঝলে কবেই একটা হৈ চৈ বেধে যেতো!
মহিত শেখের একটা ছেলে হয়েছিল। বিরাট তাগড়া জোয়ান। নাম কঙ্কা। কঙ্কাবতি। আগুনখেয়ার বাসিন্দারা ভেবেছিল, এবার একটা যোগ্য কারবারি পাওয়া যাবে। শুধু বুড়োটা গেলেই হয়। কিন্তু বুড়োটা গেল না। গেল তার তাগড়া জোয়ান ছেলেটা।
পাহাড়ের আদি সংঘাতের মতো আগুনখেয়ায়ও একদিন দুঃখ এসেছিলো। দূরের রাফা পাহাড়ের খাদ্য উর্বরতা কমে গেলে এবং পানির একমাত্র ঝরণাটি শুকিয়ে গেলে ওখানকার বাসিন্দারা এই পাহাড়ে হানা দিয়েছিল। সবগুলো মারমা। জাত হিংস্র। সেদিন সন্ধ্যায় ঢাক সানাই বাজিয়ে যুদ্ধ শুরু হল। ঢাল সড়কির অসম যুদ্ধ। এমন যুদ্ধের মুখে কখনো যেন না পড়তে হয় সে জন্যই মহিতের দাদা এই দুর্গম পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু এক প্রজন্ম যেতে না যেতেই মানুষের প্রয়োজনের হাত এই পাহাড়ের চূড়ায় এসে ঠেকেছে।
মহিত শেখ জানতো, কঙ্কা রগচটা ছেলে। আগুনখেয়ার যুবকদেরকে ডাক দিলে সবাই হৈ হৈ করে লড়াইয়ে নেমে পড়বে, কিন্তু এর পরিণাম ভালো হবে না। কারণ মহিত জানে, আগুনখেয়ার মানুষ ঝগড়াটা পারলেও যুদ্ধটা পারে না। মহিত লম্বা দম নিল, পাহাড়ের তাজা বাতাসের সাথে খানিকটা সাহস যেন বুকে জড়ো করতে চাইল। কঙ্কার কাছে গিয়ে বলল: কঙ্কা! চল পালিয়ে যাই!
– কোথায় পালাবো?
– মিতিঙ্গা পাহাড়ে
– সেখানে ওরা হানা দিলে?
– অন্য কোথাও যাবো
– সেই অন্য কোথাও দস্যুরা যখন আক্রমন করবে তখন আমাদের সন্তানেরা কোথায় যাবে? তোমরা তো রাফা পাহাড় ছেড়ে এই পাহাড়ে এসেছিলে।
মহিত শেখ কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। চিতাবাঘের মতো জ¦লছে কঙ্কার চোখ। মহিত বুঝে ফেললো, এই ছেলেকে ঠেকানো যাবে না। অস্পূট স্বরে তবু বলল, লড়াই ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনে।
কঙ্কা বল্লম হাতে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল। ওর যাওয়ার পথের দিকে শংকিত চোখে তাকিয়ে রইল মহিত শেখ। তার মনে অচেনা কী যেন কুহু কুহু ডাকছে। বুকের ফাঁকা জায়গায় এখন আর সাহস নেই, শুধু ভয় আর ভয়।
কঙ্কাবতী আগুনখেয়ার যুবকদেরকে নিয়ে মারমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। দাদার ভিটে রক্ষা করতে হবে। এক প্রহর না যেতেই ওদের তিন তিনটে লাশ পড়ে গেল। রাত্রির পাহাড়ী আঁধার নেমে আসার আগেই কঙ্কারা ওদেরকে হটাতে সক্ষম হল। শুধু লড়াইয়ের শেষ মুহূর্তে, শত্রুরা যখন পাহাড় বেয়ে নেমে যাচ্ছে তখন, সন্ধ্যার আবছায়া আঁধারে কঙ্কার ঊঁরুতে একটি মল্ল এসে বিঁধল। সাতদিন বিছানায় শুয়ে কাটা শুকরের মতো চেঁচাতে চেঁচাতে আটদিনের মাথায় কঙ্কা মরে গেল। কঙ্কা যেদিন দ্বি-প্রহরে মারা গেল সেদিন গভীর রাতে কঙ্কার বউ সৌদা একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিল। কঙ্কার পুত্র।
সন্তানের মায়া সৌদাকে টানতে পারেনি। স্বামীর শোক তাকে পাগল বানিয়ে দিয়েছিল। পুত্র জন্মের তিন পক্ষ পর সৌদা পাগলী আগুনখেয়া পাহাড়ের কোনো এক গিরিপথ ধরে হেঁটে চলে গেছে। আর কোনোদিন ফিরে আসেনি। কঙ্কার পুত্র মানুষ হয়েছে মহিতের কাছে। তাকে মানুষ করতেই মহিতকে বেছে নিতে হয়েছে অদ্ভূত এক পেশা। পেশাটার কথা মনে আসতেই মহিত হেসে ফেলল। এখনো সে পাহাড় বেয়ে নামছে। পেশিতে আগের মত জোর নেই। পাহাড় বেয়ে উঠতে নামতে ঘন্টা দুই লেগে যায়। জোয়ানকালে এই পাহাড় বেয়ে কতবার তরতর করে উঠেছে আর তরতর করে নেমেছে! এখন বারবার জিরোতে হয়।
মহিত যখন পাহাড়ের আধাআধি নেমে এলো তখনই পাহাড়ের পশ্চিম দিক থেকে মায়ার ডাক শোনা গেল। তার থেকে প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশ হাত উপরে। মহিত কপালের শিরা চেপে ধরে বসে পড়ল। এমন একটা আশংকা তার মনে কয়েকবার উঁকি দিয়ে গেছে। গাইটা যদি পশ্চিম দিকে পড়ে থাকে তবে তাকে টেনে তোলার সাধ্য কারো নেই। এই পাহাড়টা পূব থেকে সরলরেখায় উপরে উঠতে উঠতে মহিতের ঘরের পিছনে এসে থেমেছে। তারপর ধীরে ধীরে সোজা সামনের দিকে না গিয়ে হুড়ুশ করে খাড়াভাবে নেমে গেছে উনিশ শো ফুট নিচে। পশ্চিমের এই খাড়া পাশটার গায়ে ঝোঁপঝাড় জন্মে বুনো জঙ্গল হয়ে গেছে। ওখানে নেমে কেউ গাছ কাটতে পারে না বলে কোনো কোনো গাছ বৃক্ষ ছাড়িয়ে মহিরূহে রূপ নিয়েছে। গাইটা বোধহয় পশ্চিম থেকে পা পিছলে পড়ে কোনো একটা গাছের ডালে বা শিকড়ে আটকে গেছে।
মহিতের পাহাড়ের উপরে ফিরে আসতে বিকেল পড়ে এলো। এর মধ্যে মায়া কয়েকবার ডেকে উঠেছে। মহিত বাড়ির কাছে আসতেই কঙ্কার ছেলে ছড়া কাটতে কাটতে দাদার কাছে ছুটে এলো:
“ডারামায় থায়াচুমু হালাপ বারা অবারোই
হালাপ বারা অথায়ৈ…. ”
মহিত শেখ কপাল কুঁচকালো। ছড়াটা বড়দের। এই পুচকেটাকে কে যে এগুলো শেখায়! সে কটমট চোখে একবার নাতীর দিকে তাকিয়ে কয়েক লাফে পাহাড়ের পশ্চিম কোণে ছুটে এলো। ছোটখাট একটা ভীড় জমেছে এখানে। মায়ার ডাক শুনে সবাই গাইটাকে দেখতে এসেছে। মহিত সবাইকে সরিয়ে খাদের কিনারে এসে দাঁড়ালো, অনেক নিচে তারই সমবয়সী যে রাবার গাছটা পাহাড়ের পিঠ ফুঁড়ে একান্ত অনিচ্ছায় বেড়ে উঠেছে তার গোড়ায় আটকে গেছে মায়া। মাথা উঁচু করে গাইটা বারবার উপরের দিকে তাকাতে চাচ্ছে, পারছে না। মাথাটা শরীরের তুলনায় নিচে পড়েছে।
মহিত শেখ কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে জটলা থেকে বেরিয়ে এলো। কেউ কিছু বলেনি। সবাই ওর দিকে সমবেদনার চোখে তাকিয়েছে। তবু মহিত শেখ যেন স্পষ্ট শুনতে পেলো, ওরা বলাবলি করছে, ‘মহিত শেখের ধর্ম পাল্টানোর উৎসব হবে রে! সবাই থেকো গো!
রাতে মহিতের ঘুম হলো না। বারবার গাইটা ডেকে উঠে রাতের নিস্তব্ধতাকে ভেঙ্গে দিচ্ছে। যতবার গাইটা ডেকে উঠছে মহিত শেখ শোয়া থেকে উঠে বসে পড়ছে। তার পুত্র কঙ্কাও মৃত্যুর আগে এরকম চিৎকার করেছে। শঙ্কু ওঝা এসে আদা ঝাড়া পাদা ঝাড়া দিয়ে গিয়েছিল। কোনো কাজ হয়নি। শঙ্কুর ঝাড় ফুঁকে অবশ্য কখনোই খুব একটা কাজ হয় না। তবু এই পাহাড়ের বাসিন্দাদের জন্য ওই প্রথম এবং শেষ ভরসা।
গাইটা আবারও ডেকে উঠলো। মহিত শেখও আবার বিছানা ছেড়ে উঠে বসল। এভাবে ডাকতে ডাকতে গাইটা এক সময় মারা যাবে। কঙ্কাবতির মতো। সে কিছুই করতে পারবে না। অসহায়ের মতো মহিত শেখ পাশে শোয়া সেবাগীর দিকে তাকাল। কঙ্কার পাঁচ বছরের পুত্র। বাঁশের দেয়ালের ফাঁক গলে জোছনা এসে সেবাগীর গায়ে ডোরা-কাটা দাগ এঁকে দিয়েছে। মহিত শেখ উঠে জানালার পাল্লা উঠিয়ে দিতেই একগাদা জোছনা হুড়মুড় করে ঢুকে সেবাগীর পুরো শরীর দখল করে নিল।
জানালার ওই পাশে বিরাট আকাশ। থৈ থৈ নীল দরিয়া। আকাশের কোথাও এক ফোঁটা মেঘ নেই। মেঘেরা আরো নিচে। রাত্রীর সাথে পাল্লা দিয়ে ওরা সমগ্র পাহাড়টাকে সাদা চাদরে ঢেকে ফেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভোর সকালে পশ্চিমের খাঁদটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালে দেখা যাবে, আশপাশের সবগুলো পাহাড় মেঘ মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়েছে।
ভোরের আলো ফোটার আগে মহিত শেখের ঘুম ভেঙ্গে গেল। এখন শীতকাল নয়, তবু রাতের শেষে বেশ জাঁকিয়ে শীত নামে। সেবাগীর সাথে ভাগাভাগি করে গায়ে দেয়া চাদরের পুরোটুকু ওর গায়ে জড়িয়ে দিয়ে মহিত ঘর থেকে বের হয়ে এল। মাঝরাত থেকে গাইটা আর ডাকছে না। মহিত শেখ পশ্চিমের খাদটার পাশে এসে দাঁড়াল। সকাল হবে বলে জোছনার আলো কেটে গেছে। আবার রাত শেষ হয়নি বলে প্রভাতের আলোটিও ফোটেনি। দুই আলোর মাঝখানের অদ্ভূত এক অন্ধকার পুরো পাহাড়টাকে ঘীরে রেখেছে।
মায়া যেখানে পড়েছে ওখানে এখন গুহার আঁধার। ওদিকে তাকালে একটা অন্ধাকর শুধু পাক খেয়ে চোখের উপর ঘুরতে থাকে। তবে পশ্চিমের আকাশে লাল একটা নদী ভেসে উঠেছে। পাহাড়ের নিচ থেকে উদীয়মান সূর্য্যটা আকাশের দিকে তাকিয়ে পড়ায় পাহাড়ের আকাশে একটা আলোর নদী তৈরী হয়েছে। এই নদীটা অদ্ভূত! মহিত শেখ আগেও লক্ষ্য করেছে, সে যদি ভাবে নদীতে একটা সাম্পান ভাসছে, সেই সাম্পানে বৈঠা হাতে একটামাত্র মানুষ বসে আছে তাহলে দেখা যায় সত্যি সত্যি সেই নদীতে আবছায়া একটা সাম্পান ভাসছে। সেই সাম্পানে আরো অস্পষ্ট একটা মানুষ বসে আছে । যদি ভাবে দুইটা, তবে দুইটা দেখা যায়, যদি ভাবে তিনটা তবে তিনটা সাম্পান ভেসে ওঠে। যদি ভাবে অগণিত সাম্পান ভাসছে তাহলে দেখা যায় লাল রেখাটার এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত সাম্পানে সাম্পানে ভরে গেছে। এটা কেন হয়? স্রেফ মনের কল্পনা?
হঠাৎ হিসহিস একটা আওয়াজ শুনে মহিত শেখ পায়ের দিকে তাকিয়ে ‘মাগো রে!’ বলে লাফ দিয়ে তিন হাত পিছিয়ে এল। একটা চন্দ্রবোড়া সাপ নারকোলের খোলের মতো ফনা তুলে হিসহিস করছে। মহিত শেখ আস্তে করে সরে এল। ভাগ্যিস বাঁ-হাতে শঙ্কু ওঝার দেয়া মাদুলিটা ছিল। নইলে আজ এখানেই ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যেত। ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতের মাদুলিটা কচলাতে কচলাতে মহিত শেখ ঘরে এসে ঢুকল। ভেতরে সেবাগী নেই। ঘরটা খাঁ খাঁ করছে।
একটু একটু করে ভোরের আলো ফুটছে। সাপ, ব্যাঙ, ইঁদুর- যা হোক একটা ধরতে হবে। আজ গাই নেই। মানে দুধও নেই। ঘরে চাল ফুরিয়েছে গত পরশু। একটু বেলা হলে কোন শিকারই ধরা যাবে না। ওদিকে শেবাগীটাকেও খুঁজতে হবে। ছেলেটা যা জ্বালাতন করে!।
মহিত শেখ মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে ওঠে, এইসব করে বেড়ানো কি মদ্দ লোকের কাজ? কাজ করবে মেয়েরা। পুরুষরা বসে গুড়গুড় করে হুক্কা টানবে। অথচ মুহিত শেখের নিস্তার নেই। পুচকেটার পিছনেই খেটে মরতে হচ্ছে। রাগ বেশী হলে নাতিকে মা-বাপ তুলে গালিগালাজ করে বসে বুড়ো কারবারি। পরক্ষণে মায়া লাগে। মনে হয়, এই শিশুটিই তো তাঁর সব। তার বংশের একমাত্র উত্তরপুরুষ। আগুনখেয়ার ভবিষ্যৎ কারবারি। ও আছে বলেই এই বুড়ো বয়সেও মহিত শেখের হাতড়ে পাতড়ে বেঁচে থাকা। ছলচাতুরির বেসাতি খুলে বসা।
মহিত শেখের অনেকদিন আগের কথা মনে পড়ে যায়, সেই যে একবার সংসারে খাদ্যের অভাব নেমেছিলো, মুলি বাঁশের গোড়া সেদ্ধ সেবাগী খেতে পারছিলো না, দুইদিন পাহাড়ী বনে ঘুরে ঘুরেও মহিত শেখ একটি বন্য জন্তু শিকার করতে পারলো না, সেবার ত্রাণকর্তা হয়ে এক ইংরেজ সাহেব এসেছিলেন। সাথে তার বাঙ্গালী বন্ধু। ওরা বলেছিলো, মহিত শেখ খৃস্টান হলে ওর আর কোন অভাব থাকবে না। সে অফুরান সুখের সন্ধান পাবে।
মহিতের অবশ্য সুখের প্রয়োজন ছিলো না। সে তার পাওনা জীবন পার করে এসেছে। এখন কাজ শুধু প্রাচীন বৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে থাকা। কিন্তু এই শিশুটির মুখের দিকে তাকিয়েই সে ঘুনে ধরা কাঠের মতো ধ্বসে পড়লো। ওরা অবশ্য বেশ কিছু টাকা দিয়েছিলো। কিন্তু টাকাগুলো ফুরিয়ে যাওয়ার পর ওদের টিকিটিও আর দেখা যায়নি। ওরা নিশ্চিত হয়ে গেছে, এই পাহাড়ের কারবারি এখন খৃস্টান। ওর খোঁজ নিলেও খৃস্টান, না নিলেও খৃস্টান। সুতরাং ওরা আর মহিত শেখকে নিয়ে মাথা ঘামায়নি। মহিতও দিনে দিনে বুঝে গেছে, এই পাহাড়ে, পাহাড়ঘেরা ঝোপজঙ্গলে কিছু মানুষ আসে। মুঁঠিভরা যাদের অর্থকড়ি। অর্থ দিয়ে ওরা ধর্ম কেনে। কেনাবেচা শেষ হলে হাহা করে কেঁদেও ওদেরকে খুঁজে পাওয়া যায় না।।
মহিত শেখ সব বুঝে গেছে। পাহাড়ের আদিম অভাব তাকে বেঁচে থাকার পন্থা বাতলে দিয়েছে। সে এখন ধর্মের বেসাতি খুলে বসেছে। নতুন কোনো ‘খদ্দের’ এলেই মহিত শেখের কাছে ধরে আনা হয়। মহিত শেখও পাড়ার লোকজন নিয়ে ধর্মান্তর উৎসবে বসে যায়। আগুনখেয়ায় চাপা একটা উৎসব উৎসব আমেজ ওঠে। শুধু মহিত শেখ ও তার শাগরেদদের চোখ থেকে অবিরল অশ্রু ঝরতে থাকে। যিনি টাকা নিয়ে এসেছেন তিনি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখেন, একজন অশীতিপর বৃদ্ধ ও তার সঙ্গীদের বিগত জীবনের সকল পাপ চোখের জলে ধুয়ে যাচ্ছে। লোকালয়ের মানুষগুলোও মহিত শেখদেরকে ঘিরে এমন একটা ভাব করতে থাকে- যেন তাদের চোখ বলছে, শেষ জীবনে বুড়োর কি মতিভ্রম হলো?, বাপ দাদার পাহাড়ী ধর্ম এভাবে কি কেউ ছুড়ে ফেলে?।
টাকাওয়ালা পাহাড়ীদের চোখে ঘৃণা দেখে আশ্বস্ত হয়- হ্যা, বাপ দাদার ধর্ম ত্যাগ করছে বৃদ্ধ মহিত শেখ। কোনো ফাঁকি নেই। এরপর অনেক নাটক শেষে আগন্তুক তার টাকার বান্ডিলে হাত দেয়। সবটা নয়, কয়েকটা মাত্র চকচকে নোট মহিত শেখদের দিকে বাড়িয়ে ধরে সে উঠে পড়ে। তার বাণিজ্য শেষ। লোকটা দৃষ্টির আড়াল হতেই মহিত শেখদেরকে ঘিরে থাকা জটলা থেকে আওয়াজ ওঠে, ব্যাটা হাড় কেপ্পন!।
কেউ বলে, ওকে উল্টো টাকা দেয়া উচিৎ ছিলো। যেই কলিজা, পুরো মুলিবাঁশের খোড়ল!। তৃতীয় কেউ বলে ওঠে, তোরা কেউ ক্যাঙের পেছন থেকে ভাঙা কলসিটা নিয়ে আয়। ওর বড্ড প্রয়োজন।
বলার ধরণে সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। এরপর অবশ্যি মহিত শেখ তড়িঘড়ি উঠে পড়তে চায় কিন্তু আগুনখেয়ার বাসিন্দারা চেপে ধরে, ‘ও হবে না মহিত শেখ! শুকর একটা মারতেই হবে।’
মহিত শেখ আঁৎকে ওঠে, তা কি করে হয়!। মোটে এই ক’টা টাকা। শুকর মারতে গেলেই তো উড়ে যাবে!। পাহাড়ের বাসিন্দারা নিরস্ত হয়না। যে নাটকের মাধ্যমে মহিত শেখ এতগুলো টাকা বাগালো সেই নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রে না হলেও পার্শ্ব চরিত্রে তারা ছিলো। সুতরাং তারা ঠকবে কেন?
সেই রাতে আগুনখেয়া পাহাড়ের গায়ে মশাল জ্বলতে দেখা যায়। একটি ঢোলক সুরেলা আওয়াজে পাহাড়ী অঞ্চলটাকে উচ্চকিত করে রাখে। প্রজ্জ্বলিত মশালকে ঘিরে পাহাড়ীদের আদিম নৃত্য চলে আর পাহাড়ের এক কোনায় একটি শীর্ণকায় ডেকচিতে শুকরের মাংস টগবগ করে ফুটতে থাকে। ডেকচিকে ঘিরে চাতকের চোখে তাকিয়ে থাকে অনেকগুলো ক্ষুধার্ত মানুষ । ভেতরে মাংসের টগবগ আওয়াজ তাদের কাছে ঢোলের আওয়াজের চেয়ে সুরেলা মনে হয়। ডেকচির ভেতর গোশতের লাফিয়ে ওঠা তাদেরকে পাহাড়ী ললনাদের উদ্দাম নৃত্যের চেয়ে বেশী আনন্দ দেয় । ক্ষুধা এদের পাঁজরের সাথে মিশে থাকা পাপ।
আগুনখেয়ার আশপাশের বাসিন্দারা এই পাহাড়ে প্রায়ই উৎসবের মশাল জ্বলতে দেখে। ওরা ক্ষুণাক্ষরেও বুঝতে পারে না, এখানকার বাসিন্দারা যে তাদের ক্ষুধা মিটাবার একটা পন্থা বের করে নিয়েছে।
মহিত শেখ পানির ঘড়া আর অগ্রভাগ সুঁচালো একটা ট্যাটা হাতে বের হলো। সেবাগীকে খুঁজতে হবে। খুঁজতে খুঁজতে যদি কোন শিকার পাওয়া যায় সেটাও ধরতে হবে। ছেলেটা কোথায় যেতে পারে? আগুনখেয়ার উত্তরে পাহাড়ী ঝরণা। প্রাকৃতিক কাজ ওদিকেই সারতে হয়। মহিত শেখ শেবাগীকে খুঁজতে ওদিকেই হাঁটা ধরলো।
ঝরণাটা শুকিয়ে তেনা হয়ে গেছে। ওদিকে তাকালেই মন খারাপ হয়ে যায়। মহিত শেখরা প্রথম যখন এখানে এসেছিলো তখন অনেক দূর থেকে মেঘের গর্জনের মতো ঝর্ণার ডাক শোনা যেত। এই ডাক শুনেই তো মহিতের দাদা এ পাহাড়ে বাসা বেঁধেছিলো। এখন ছাগলের পেশাবের মতো টিপটিপ করে পানি পড়ে। ওদিকে তাকালে মহিতের নাক মুখ কুঁচকে আসে।
মুখ কুঁচকাতে কুঁচকাতে মহিত শেখ শেবাগীকে দেখতে পেলো, দিগম্বর সেবাগী প্রাকৃতিক কাজ সারতে বসছে আর হোৎকা একটা শুকর ওর পেছনে এসে ঘোৎ ঘোৎ করছে। ও উঠে গিয়ে একটু দূরে সরে বসছে, শুকরটাও পিছনে পিছনে গিয়ে মুখ দিচ্ছে। মহিত শেখ চেঁচিয়ে উঠলো, কতবার না বলেছি, শুকরকে ভয় পাবিনে। শুকরকে কি ভয় পেতে আছে?। শেবাগী মিনমিন স্বরে বললো, ‘কিন্তু আমার যে ভয় করে।’
মহিত শেখ ট্যাটা উঁচু করে ধরে ধৈ ধৈ করে তেড়ে গেলেও শুকরটার মধ্যে কোন চাঞ্চল্য লক্ষ্য করা গেলো না। সে দুলকি চালে হেঁটে হেঁটে ঝরণার পিছন দিকে চলে গেলো।
মহিত শেখ বলল, ঘর থেকে বেরিয়েছিস কেন? যদি সাপবিছুতে কামড় দিত?
– আমি তো তোমাকে কত ডাকলাম, তুমি সাড়া দিলে না!
– বেরিয়েছিস, ভয় করেনি?
– করেছে তো, অনেক ভয় করেছে। কিন্তু ঘর নষ্ট করলে তো তুমি মারবে!
মহিত শেখের মায়া হল, নিজের উপর রাগও হল। এতো রাতে সাপের দৌড়ানি খেতে কেন পশ্চিমে যেতে হয়েছিল? ছেলেটা কত কষ্ট পেয়েছে! আবার তার মায়ার কথা মনে পড়ল। এবার সত্যিই তার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল।
পাহাড়ের এই পাশটা বেশ খানিক উঁচু। সেই উঁচু থেকেই ঝর্ণার পানি পড়ে। বেশীর ভাগ পানিই পাহাড়ের পিছন দিক দিয়ে নিচে নেমে যায়। এ পাশে আসে সামান্য কিছু পানি। সেই পানি দিয়েই আগুনখেয়ার বাসিন্দাদের নাওয়া খাওয়া চলে।
নাতিকে সামলে ঘড়া ভরে পানি নিলো মহিত শেখ। ফেরার সময় ঢাঁসা একটা ইঁদুর মহিত শেখের পাশ কেটে পালিয়ে যাচ্ছিলো। ঘড়াটা সেবাগীর হাতে দিয়ে সারা আগুনখেয়া ধাবড়ে বুড়ো মহিত ঝর্ণার কাছেই খপ করে ইঁদুরটাকে ধরে ফেললো।
পূবের বাঁশবনে কঁচি কঁচি বাঁশের কোরোলি হাড়ি চাপা দিয়ে রাখা ছিলো। ইঁদুরের লেজ ঝুলিয়ে ধরে মহিত শেখ বাঁশঝাড়ে এলো। একটা হাড়ি সরাতেই মহিত শেখের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। মুথাটা ফুলকপির মতো ফুলে পুরো হাড়ি ভরে গেছে। মহিত শেখ হাড়িটা নতুন গজিয়ে ওঠা আরেকটা মহ্ইয়ের উপর চেপে রেখে আগেরটা কেটে নিয়ে এলো। আজ চমৎকার একটা রান্না হবে। সিদ্ধ বাঁশের মুলির সাথে আস্ত একটা ইঁদুর, সেবাগীর আনন্দের কথা ভেবে মহিত শেখের সকাল থেকে মন খারাপ ভাবটা চলে গেলো।
হাড়ির ঢাকনাটা উঁচু করতেই একদলা গরম ভাপ মহিত শেখের চোখে মুখে আঁচড় কেটে গেলো। বুড়ো চামড়ায় তাপ সয় না। মহিত শেখ দুই হাত মুখের সামনে ধরে হাতে ফুঁ দিয়ে মুখের আঁচ ঠান্ডা করতে লাগলো। তখনই কারো প্রলম্বিত ছায়া হাড়ি-চুলো অতিক্রম করে মুখের উপর এসে থামলে মহিত শেখ চোখ তুলে তাকালো। তাকিয়েই চমকে উঠলো। মহিত শেখের বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করছে। যেন দূর পাহাড়ে বলি হওয়া কোন শুকর বুকের ভেতর চিৎকার করে উঠেছে। এমন তো হওয়ার কথা নয়, যে একবার যায় সে আর ফিরে আসে না। এই লোকটি ফিরে এসেছে। এর মানে কি?, একে একে সবাই ফিরে আসবে?। এসে হাত বাড়িয়ে বলবে, ফিরিয়ে দাও!। মহিত শেখের বুকের ভেতর অচেনা এক কামার হাতুড়ি পেটা করতে শুরু করলো।
পাকস্থলীতে জমে থাকা পানি যেন নিমেষেই শুকিয়ে গেছে। মহিত শেখ ঘামছে। আগন্তুক লোকটি মহিত শেখের কপালের দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসছে। এ হাসি কি প্রশ্রয়ের? নাকি লোকটা কিছু জানে না? অভিনেতা মহিত শেখ দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। হাঁড়ির ঢাকনা হাঁড়ির উপর ছুড়ে ফেলে চটাস করে দাঁড়িয়ে খটাস করে লোকটাকে একটা আদাব দিলো। বিগলিত মুখে জিজ্ঞাসা করলো, ভাইজান কেমন আছেন? মহিত শেখ জানে, সে উত্তর দেবে না, মাথা নাড়বে। সে বাংলা জানে না। তিন বছর আগে মায়া নামের বাছুরটাকে সেই উপহার দিয়ে গিয়েছিলো। ইংরেজ লোকটি মহিত শেখের ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে স্পষ্ট বাংলায় বললো, ভাল আছি, তুমি কেমন আছো মহিত মিয়া?
বাপরে! তিন বছরে লোকটা বাংলা শিখে ফেললো নাকি? মহিত শেখ মনে মনে লোকটাকে আরেকটা আদাব দিলো।
– ভাল আছি, চলুন ঘরে গিয়ে বসি।
– বাংলাভাষী ইংরেজ লোকটি আকর্ণ হেসে বললো, ঘরে তো বসবো কিন্তু তুমি মুহ্ই রাঁধছো কেন?
মহিত নিজের চেহারার উপর জলভারনত আষাড়ের মেঘ নিয়ে এলো। কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, চালের ঘটি যার শুন্য থাকে, বাঁশের মুলি তার শেষ ভরসা। দার্শনিকের মতো কথা বলতে পেরে মহিতের মন ফুরফুর করছে, চোখে যদিও অশ্রু। ইংরেজ সাহেবের মধ্যে কোন ভাবান্তর নেই। কথাটা বোধহয় তার হৃদপিণ্ডে টোকা দিতে পারেনি। মাত্র বাংলা শিখেছে, দার্শনিক কথাবার্তায় এখনো বোধহয় অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। লোকটা সোজা চোখে মহিতের দিকে তাকিয়ে বললো, তোমাকে যে গাইটা দিয়ে গিয়েছিলাম তার দুধ বেচেই তো অবস্থা পাল্টে যাবার কথা। তোমার দেখছি আগের চেয়ে করুণদশা হয়েছে। গাইটা করেছো কী?
মহিত শেখ ভীষণ চটে গেছে- ‘গাই না, বাছুর। বাছুরে দুধ হয় নারে হাম্বা। অনেক পথ পাড়ি দেবার পরেই একটা গাইয়ের ওলানে দুধ আসে। কথাটা মহিত শেখ মনে মনে বললো।
মুখে দারুণ বিগলিত ভাব দেখালো, চলুন মশায়, আপনাকে দেখিয়ে আনি!
আগুনখেয়ার পশ্চিমের খাদটার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা দু’জন । ইংরেজ সাহেব দেখলো, অনেক নিচে হাত-পা ছড়িয়ে একটা সাদা গাই গাছের গুড়িতে ঝুলে আছে। বাতাসে মড়া গন্ধ। বুদ্ধিমান সাহেব গন্ধ শুকেই ঘটনা বুঝে ফেললেন। তার চোখ এখন মায়ার মতোই মায়াবী হয়ে উঠেছে। মহিতের পিঠে হাত রেখে বললো, তোমাদের জীবনতো অনেক কষ্টের, তাই নারে কারবারী? মহিত শেখ এতোক্ষণ ধরে এমন একটি সময়ের অপেক্ষাই করছিলো। ইংরেজ ব্যাটা তাহলে ঘাড় পেতেছে! মহিত শেখ লোকটির হাত ধরে টেনে হিঁচড়ে ঘরের দাওয়ায় নিয়ে তুললো। এক ঘট পানি নিয়ে তার পা ধুইয়ে দিতে দিতে বাম হাতের উল্টো পিঠে ভেজা চোখ মুছলো।
অভিনয় ভাল হচ্ছে। মনে মনে মহিত শেখ বেজায় খুশী। লোকটাকে খাটে বসিয়ে মাথা মোছার গামছা দিয়ে তার পা মুছিয়ে দিতে দিতে মহিত শেখ রাজ্যের দুঃখের কথা বলতে লাগলো। চোখ তার উত্তরের ঝর্ণার মতোই ছলছল করছে। ভেজা চোখেই জলের ফোটার সাথে নড়তে নড়তে দৃশ্যটি মহিত শেখের চোখে স্থির হলো। পরীর মতো একটি মেয়ে খরগোসের মতো লাফাতে লাফাতে উঠোন পেরিয়ে এদিকে আসছে। মাথা ভরা সোনালী চুল আরবী ঘোড়ার কেশরের মতো কাধের উপর দুলছে। মেয়েটির পিছু পিছু সেবাগী ছুটছে।
খানিক দূরে আরেকজন অপরিচিত লোক আসছে। ঠিক অপরিচিত না, গতবার ইংরেজ লোকটিকে যে নিয়ে এসেছিলো, এ সেই লোক। মহিত শেখের পলকহারা দৃষ্টি অনুসরণ করে ইংরেজ লোকটি উঠোনের দিকে তাকালো। মেয়েটিকে দেখেই ইংরেজ সাহেব আদুরে গলায় ডাকলো, কাম হেয়া মামুনি!
মেয়েটি খরগোশের মতো দুলতে দুলতে এসে বাবার কোলে বসল। শেবাগীও ছুটতে ছুটতে এসে ইংরেজ সাহেবের পাশে বসে মেয়েটির হাত ধরে টানতে লাগলো, নিজের পাশে বসাবে। মহিত শেখের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, এতো বড় স্পর্ধার কী পরিণাম হতে পারে? মহিত শেখ নাতিকে কষে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দেয়ার আগেই ইংরেজ লোকটি বলল, হেলেন! এখানে বসো!
আঙুল দিয়ে শেবাগীর পাশের জায়গাটি দেখিয়ে দিল। হেলেন পাশে বসতেই সেবাগী তার মোমের মতো ফর্সা হাতটি নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো।
‘হতচ্ছাড়া পাজি! বয়স হয়নি বলে এখনো নেংটি পরা ধরিসনি, ওদিকে তলে তলে পেকে কাঁঠাল হয়ে গেছিস!- মনে মনে মহিত শেখ বেশ রেগে গেছে।
মহিত শেখের অবস্থা বুঝতে পেরে ইংরেজ লোকটি বললো, ধনী গরিব, বা পাহাড়ী ও ইউরোপিয়ান বড় কথা নয়, আমরা সবাই মানুষ। মানুষ বলেই ওদের বন্ধুত্ব হতে পারে। মহিত শেখ বাঁশের পাটাতনে বসে ছিলো। সাহেবের কথা শুনে মনে হলো, পাটাতন ভেঙ্গে নিচে পড়ে যাবে। ধনী গরিব সবাই মানুষ, ভাল কথা। তাই বলে ছেলেতে মেয়েতে বন্ধুত্ব হয় নাকি? মহিত শেখ বাপের জন্মে শোনেনি।
খালি গায়ে কাদামাখা কালো চামড়ার সেবাগীকে নীল ফ্রক পরা মেয়েটির পাশে একেবারে বুনো ভাল্লুকের ছানার মতো লাগছে। ভাল্লুক-ছানাটার দিকে আরেকবার তাকিয়ে মহিত শেখের বুক গর্বে ফুলে উঠলো। সেবাগীকে কাদামাটি মাখা ভাল্লুক মনে হলেও, ওর বুকের ছাতি জানান দিচ্ছে ওটা বাপের মতই চওড়া হবে। ওর নাক খাড়া পাহাড়ের মতো উন্নত, আঙুলের গিঁটগুলো তল্লা বাশেঁর গিঁটের চেয়ে মজবুত। মহিত শেখ কল্পনায় যেন ভবিষ্যৎ কঙ্কাবতিকে দেখতে পেলো। এ কঙ্কাবতি মৃত কঙ্কাবতির চেয়ে অনেক বেশী সৌর্য-বীর্যের অধিকারী, অনেক বেশী টগবগে জোয়ান।
মহিত শেখের চোখে কল্পনার প্রজাপতি পাখা মেলেছে। সে আগুনখেয়ার কারবারী বীর সেবাগীর পাশে ষোড়শী মারিয়াকে দেখতে পেলো- সামনের ওই খাটটিতেই, হাত ধরে বসা।
মহিত শেখের ঘোরলাগা চোখের দিকে তাকিয়ে ইংরেজ সাহেব বলে উঠলো, ওদের দিকে তাকিয়ে কী দেখছো মহিত?
মহিত শেখ কেঁপে উঠে বাস্তবে ফিরে এলো, না মানে… ইয়ে মানে…।
মহিত শেখের কথা জড়িয়ে গেছে। সে ভাবছে। কী দুঃসাহসী, কী নিষিদ্ধ কল্পনাই না সে করতে শুরু করেছে! মহিত শেখকে থেমে যেতে দেখে ইংরেজ সাহেবের ঠোঁটের কোনায় এক টুকরো অচেনা হাসি জেগে উঠল।
The post আগুনখেয়া (১ম পর্ব) appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%86%e0%a6%97%e0%a7%81%e0%a6%a8%e0%a6%96%e0%a7%87%e0%a7%9f%e0%a6%be-%e0%a7%a7%e0%a6%ae-%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ac/
No comments:
Post a Comment