Sunday, March 1, 2020

তালেবানরা ‘সন্ত্রাসী’ নয় : আফগানিস্তানে কেন সশস্ত্রতা সফল হয়েছে?

হামমাদ রাগিব

আফগানিস্তানে দীর্ঘ যুদ্ধের পরও আমেরিকা যখন তালেবানকে পরাজিত করতে পারেনি, তখনই আসে শান্তি আলোচনার প্রস্তাব। শান্তি আলোচনার মধ্য দিয়ে আফগানের মাটি থেকে নিজেদেরকে সম্মানজনকভাবে গুটিয়ে নিতে চেয়েছিল আমেরিকা। তবে শান্তি আলোচনাটা তারা প্রথমে সরাসরি না করে আফগানিস্তানে তাদের পুতুল সরকারের মাধ্যমে করাতে চেয়েছিল। কিন্তু তালেবান কোনোভাবেই রাজি হয়নি এ প্রস্তাবে। তারা পুতুল সরকারের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনায় বসতে অসম্মতি জানিয়েছিল এবং এ অসম্মতির ওপর অনড় অবস্থানে ছিল।

দুই-তিন বছরের ধারাবাহিক চেষ্টার পরও তালেবান যখন আফগান সরকারের সঙ্গে বসতে রাজি হলো না, তখন অনেকটা বাধ্য হয়েই গত বছরের শেষের দিকে কাতারের দোহায় আমেরিকা সরাসরি আলোচনায় বসে তালেবান প্রতিনিধিদের সঙ্গে। এরই মধ্যে হোয়াইট হাউজের বার কয়েকের বিবৃতিতে তালেবান যে ‘সন্ত্রাসী’ গোষ্ঠী নয়, এর জানান দেওয়া হয়েছে। কারণ, ‘সন্ত্রাসী’ হলে তাদের সঙ্গে আমেরিকা আলোচনায় বসবে কীভাবে!

অথচ দু’হাজার এক সালে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই’য়ের জন্যই আমেরিকা আক্রমণ চালিয়েছিল আফগানিস্তানে! দেড় যুগের দীর্ঘ যুদ্ধে আফগান পাহাড়ের কন্দরে কন্দরে তালেবানের তাড়া খেয়ে অবশেষে তারা বুঝতে পেরেছে, তালেবান কোনো ‘সন্ত্রাসী’ গোষ্ঠী নয়, সশস্ত্র এক বিদ্রোহী দল। তবে এরই মধ্যে তাদেরকে হারাতে হয়েছে অন্তত চার হাজার প্রশিক্ষিত সৈনিককে। বিশাল আকারের ক্ষতি হয়েছে আর্থিকভাবেও। গত বছর সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ সেন্টারের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আমেরিকার প্রতিরক্ষা দফতর আফগানিস্তানে ২০০১ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ব্যয় করেছে ৮৪০ বিলিয়ন ডলার। অন্য এক হিসাবে দেখা যায়, যুদ্ধে এ পর্যন্ত আমেরিকার ব্যয় হয়েছে এক ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি।

দীর্ঘ এ যুদ্ধে সামান্য এক পাহাড়ি যোদ্ধাদলের সঙ্গে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী বাহিনীটি কেন জয়ী হতে পারছে না, বা পারল না? কী এমন শক্তি অজেয় করে রেখেছে তালেবানকে? পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও তো আরও অনেক মুজাহিদদল লড়াই করছে, করেছে, কিন্তু কোনোখানেই তো কেউ সেভাবে সফল হতে পারছে না, তালেবান কীভাবে পেরেছে এবং পারল? এসব প্রশ্নের বাহ্যিক কিছু উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে নিম্নে।

সামাজিক ও ধর্মীয় আনুকূল্য

আফগানিস্তানের অধিকাংশ মানুষ ধর্মপ্রাণ। ধর্মীয় আবহ বিরাজমান প্রতিটা অঞ্চলেই। আর তালেবান হচ্ছে ধর্মপ্রাণ মুজাহিদদেরই সংগঠন, যার ফলে সাধারণ শ্রেণির মানুষের সার্বিক সহযোগিতা তারা সব সময় পেয়ে এসেছে। তাছাড়া অতীতে তালেবান রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। সেসময়কার তাদের সুশাসন ও ক্ষমতার সৎব্যবহার দেখেছে আফগান জনগণ, তাই চোখ বুঁজে অধিকাংশ আফগানিই তালেবানকে সমর্থন করেন।

কৌশল

তালেবনদের দূরদর্শিতা ও কৌশলও এ যুদ্ধে তাদেরকে অজেয় করে রাখার অন্যতম কারণ। ২০০১ সালে আমেরিকা যখন হামলা চালায়, তালেবান খুব দ্রুতই আফগানের রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে সরে গিয়েছিল। চাইলে আরও কিছুদিন ক্ষমতায় থেকে আমেরিকার মোকাবেলা করতে পারত তারা। কিন্তু দূরদর্শী তালেবান নেতৃত্ব ক্ষমতা থেকে সরে নিজেদেরকে পাহাড়ের কন্দরে কন্দরে লুকিয়ে ফেলার মধ্যেই কল্যাণ দেখলেন। কারণ, সরাসরি ময়দানে থাকলে ন্যাটো বাহিনীর বিশাল সৈন্যবহর ও আধুনিক রণসরঞ্জামের মুকাবেলা বেশিদিন করতে পারতেন না তারা। পাহাড়ে লুকিয়ে যাবার ফলে চোরাগুপ্তা ও গেরিলা আক্রমণের মাধ্যমে শত্রুদেরকে উল্টো ঘায়েল করা সম্ভব হবে।

তালেবানের এই দূরদর্শিতা এতটাই ফলপ্রসূ হয়েছে যে দীর্ঘ দেড়যুগ পর আজ আফগানিস্তানের ৭০ ভাগ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে তালেবান। এটা বিবিসির জরিপ। আর ওয়াশিংটন নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তান পুনর্বাসনবিষয়ক স্পেশাল ইন্সপেক্টর জেনারেল কার্যালয় (এসআইজিএআর) বলছে, দেশটির ৫৯টি জেলা তালেবানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে, আংশিক নিয়ন্ত্রণ ১১৯ জেলায়।

নেতৃত্বের কারিশমা

নেতার আনুগত্যে খুবই যত্নশীল তালেবানের প্রতিজন সদস্য। একই সঙ্গে অনুগতদের প্রতি নেতার আচরণও খুবই চমৎকার এবং নমনীয়। যার ফলে ঐক্যে অটুট থেকে লক্ষ্য অর্জনে তারা সর্বদা তৎপর থাকতে পেরেছে।

মোল্লা উমর যখন জীবিত ছিলেন, আমেরিকা মনে করেছিল এই লোকের কারণেই বোধহয় সংগঠনটি একতাবদ্ধ এবং সংহত। এঁকে মেরে ফেলতে পারলে এ সংহতিতে ভাঙন ধরানো যাবে। কিন্তু ওমরের মৃত্যু এবং পরবর্তী ‘আমির’ মোল্লা আখতার মনসুরকে ২০১৬ সালের মে মাসে হত্যার পরও বাহিনীটির সংহতি টুটে যায়নি। বরং ক্রমে তা একটা বাহিনীর চেয়েও বেশি কিছু হয়ে উঠেছে।

গত দেড় দশকের লড়াইয়ে তালেবানদের এ ঐক্য, দৃঢ়তা এবং কৌশল তাদেরকে কেবল শক্তিশালীই করেছে। আফগানিস্তানের ৭০ ভাগ এলাকা তালেবান যে কেবল নিয়ন্ত্রণ করছে, এমন নয়, বরং এসব এলাকার মানুষের জীবনমানের উন্নতি ও নিরাপত্তায়ও পূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তালেবান প্রবর্তিত শাসনব্যবস্থায় চলছে যাবতীয় কর্যক্রম। ন্যাটোর নিয়মিত বোমাবর্ষণের মধ্যেই স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও বিচারব্যবস্থা চালু রেখেছে। প্রতিটি প্রদেশে তাদের সামরিক কমান্ডারের পাশাপাশি পৃথক একজন ছায়া গভর্নরও আছে।

তাদের বিভিন্ন স্তরের কর্মী-সংগঠকদের জন্য ২০০৬ থেকে ‘লেহা’ (আচরণবিধি) আছে, এর দ্বারা তারা বিকল্প এক শাসন-সংস্কৃতির জন্ম দিচ্ছে। তারা অধিকাংশ প্রদেশে স্থানীয় সরকার ও আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর সঙ্গে যৌথ কাজের সম্পর্ক দাঁড় করিয়েছে। তাদের প্রায় ৫০০ বিচারক কাজ করছেন। তালেবান ছায়া সরকার প্রায় ৩০টি সাহায্য সংস্থার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক চুক্তি করে নিয়েছে। বেসরকারি টেলিফোন কোম্পানিগুলো এই ছায়া সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছে। খনি থেকে শুরু করে কৃষিপণ্য পর্যন্ত করারোপের পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থার পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিল সংগ্রহের মতো নাগরিক কার্যক্রম বিশাল এলাকায় তাদের জিম্মাতেই হচ্ছে। প্রয়োজনে তারা জনগণের কাছে জবাবদিহিও করছে।

তালেবানের এই শক্তি, সততা, ঐক্য এবং দৃঢ়তাই তাদেরকে দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র আমেরিকার মোকাবেলায় অজেয় করে রেখেছে।

The post তালেবানরা ‘সন্ত্রাসী’ নয় : আফগানিস্তানে কেন সশস্ত্রতা সফল হয়েছে? appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a7%87%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%b0%e0%a6%be-%e0%a6%b8%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a7%80-%e0%a6%a8%e0%a7%9f-%e0%a6%86/

No comments:

Post a Comment