Monday, May 18, 2020

এতেকাফে দোয়া ও মুনাজাত

জুবাইর আহমদ আশরাফ:

এতেকাফের অন্যতম প্রধান আমল দোয়া করা। দোয়া করতে হবে নিজের জন্য, নিজের পিতামাতা, আত্মীয়-স্বজন, ওসতাদ, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী, অসুস্থ, বিপদগ্রস্ত ও সারা পৃথিবীর মজলুম মুসলমানের জন্য। কবুল হওয়ার একীন নিয়ে দুআ করতে হবে। বান্দার সব দুআই আল্লাহ তাআলা কবুল করেন। আল্লাহ তাআলা অসীম জ্ঞানের অধিকারী। তিনি কখনো বান্দা যা চায় তা-ই দেন। কখনো এর চেয়ে উত্তম জিনিস দান করেন। কখনো বান্দার প্রার্থিত জিনিস না দিয়ে তার উপর থেকে কোন বিপদ সরিয়ে দেন। আবার কখনো বান্দার দুআ জমা থাকে। হাশরের দিন দোয়ার বিনিময় দেওয়া হবে। সুতরাং কোন মুমিন বান্দার কোন দোয়াই বৃথা যায় না।

একখানি হাদীসে রয়েছে, হযরত নো‘মান ইবনে বশীর রা. বলেন, রাসূল ‍সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,

الدُّعَاءُ هُوَ العِبَادةُ.

‘দুআ করাও অন্যতম এক এবাদত।’ এরপর তিনি আরও বলেন, তোমাদের প্রভু এরশাদ করেছেন,

اُدْعُوْنِىْ اَسْتَجِبْ لَكُمْ.

‘তোমরা আমার কাছে প্রার্থনা কর, আমি তোমাদের প্রার্থনা কবুল করব।’ (সুনানে আবু দাঊদ, হাদীস ১৪৭৯)

এ জন্যই রাসূল ‍সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,

يُسْتَجَابُ لِاَحَدِكُمْ مَا لَمْ يَعْجَلْ، يَقُوْلُ: دَعَوْتُ فَلَمْ يُسْتَجَبْ لِىْ.

‘তোমাদের প্রত্যেকের প্রার্থনাই কবুল হয়, যদি তাড়াহুড়া না করে। তাড়াহুড়া হল, এ কথা বলা যে, আমি দোয়া করলাম, কবুল হল না।’ (সুনানুত তিরমিযী, হাদীস ৩৪০৯)

আল্লাহ তাআলার কাছে প্রার্থনা না করলে আল্লাহ তাআলা অসন্তুষ্ট হন। রাসূল ‍সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেছেন,

مَنْ لَمْ يَسْئَلِ اللهَ يَغْضَبْ عَلَيْهِ.

‘যে আল্লাহ তাআলার কাছে কিছু চায় না, আল্লাহ তার প্রতি নারাজ হন।’ (মিশকাতুল মাসাবীহ, হাদীস ২২৩৮)

আল্লাহ তাআলা অত্যন্ত লজ্জাশীল ও দানশীল। যিনি এত বড় দানশীল ও লজ্জাশীল তিনি কোন প্রার্থনাকারীকেই কিছু না দিয়ে খালি হাতে ফিরাতে পারেন না। হযরত সালমান ফারসী রা. বলেন, রাসূল ‍সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,

اِنَّ رَبَّكُمْ حَيِىٌّ كَرِيْمٌ، يَسْتَحْيى مِنْ عَبْدِه اِذَا رَفَعَ يَدَيْهِ
فَيَّرُدَّهُمَا صِفْرًا.

‘নিশ্চয় তোমাদের রব অতি লজ্জাশীল ও বড় দানশীল। বান্দা যখন তাঁর কাছে হাত পাতে, বান্দাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে তিনি অনেক লজ্জাবোধ করেন।’ (সুনানে ইবনে মাজা, হাদীস ৩৮৬৫)

দোয়া কবুল হওয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম আছে। সে নিয়মনীতি রক্ষা করে দোয়া করতে হবে। এর অন্যতম এক নিয়ম হল, আল্লাহ তাআলার প্রশংসা ও রাসূল ‍সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি দরূদ পড়ে দুআ করতে হয়। তখন দোয়া কবুলের আশা করা যায়।

হযরত ফাযালা ইবনে ওবায়েদ রা. বলেন, একদিন রাসূল ‍সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে নববীতে বসা ছিলেন। সহসা জনৈক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে সালাত আদায় করেন। এরপর তিনি বলেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমার প্রতি দয়া করুন।’ তখন রাসূল ‍সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাএরশাদ করেন, হে মুসল্লি! তুমি তাড়াহুড়া করেছ। নামায শেষ করে বসে আল্লাহ তাআলার যথাযোগ্য প্রশংসা করবে, এরপর আমার প্রতি দরূদ পড়বে। অতঃপর প্রার্থনা করবে। হযরত ফাযালা রা. বলেন, এরপর দ্বিতীয় এক ব্যক্তি নামায পড়েন। তিনি নামায শেষে আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করেন এবং নবী আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালামের প্রতি দরূদ পড়েন। রাসূল ‍সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন তাকে বলেন, হে মুসল্লি! তুমি এখন দোয়া কর, কবুল হবে। (সুনানুত তিরমিযী, হাদীস ৩৪১০)

হযরত আবান ইবনে ওসমান রহ. তাঁর পিতা হযরত ওসমান ইবনে আফফান রা. থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল ‍সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি প্রতিদিনের ও রাতের শুর“তে তিনবার এ দুআ পড়ে:

بِسْمِ اللّٰهِ الَّذِىْ لَا يَضُرُّ مَعَ اسْمِهٖ شَيْئٌ فِىْ الْاَرْضِ وَلَا فِىْ
السَّمَآءِ وَهُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ.

সে আল্লাহর নামে আমি প্রভাত ও সন্ধ্যা অতিক্রম করছি, যার নামের সঙ্গে আকাশ ও পৃথিবীর কোন বস্তু কোনরূপ অনিষ্ট করতে পারে না, তিনিই সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ। কোন কিছু তার কোন ক্ষতি করতে পারে না।

হযরত আবান রহ. পক্ষাঘাত বা অর্ধাঙ্গ বাত রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তিনি এ হাদীস বর্ণনা করার সময় জনৈক ব্যক্তি তাঁর দিকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে ছিলেন। তাকানোর অর্থ হল, তিনি নিজে এ হাদীস দ্বারা কেন উপকৃত হলেন না। হযরত আবান রহ. তাকে বলেন, আপনি কী দেখছেন? শুনুন, আমি ভুল বলিনি, আমার পিতা হযরত ওসমানও ভুল বলেননি। হাদীস পুরোপুরি সহীহ। তবে একদিন আমি এ দোয়অ পড়িনি। যার ফলে সেদিন আমি এ ব্যাধির শিকার হই। সেই দিন আল্লাহর তাকদীর জারি হয়েছে। (সুনানুত তিরমিযী, হাদীস ৩৪১০)

হযরত আবু উমামা আল বাহেলী রা. বলেন, রাসূল ‍সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলার একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ফেরেশতা আছেন, যে ব্যক্তি তিনবার বলে, ইয়া আরহামার রাহিমীন, সঙ্গে সঙ্গে সে ফেরেশতা বলেন, আরহামুর রাহিমীন তোমার অভিমুখী আছেন, তুমি তাঁর কাছে প্রার্থনা কর। (আল আযকার, পৃ. ৩৪৭)

উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামা রা. বলেন, রাসূল ‍সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজরের নামাযের পর এ দোয়া পড়তেন,

اَللّٰهُمَّ اِنِّىْ اَسْئَلُكَ عِلْمًا نَافِعًا وَعَمَلًا مُتَقَبَّلًا وَرِزْقًا طَيِّبًا.

‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি উপকারী ইলমের, মকবূল আমলের এবং উত্তম জীবিকার।’ (মিশকাতুল মাসাবীহ, হাদীস ২৪৯৮)

হযরত সাওবান রা. বলেন, রাসূল ‍সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে কোন মুসলিম বান্দা সকালে সন্ধ্যায় যদি এ দোয়া পড়ে:

رَضِيْتُ بِاللّٰهِ رَبًّا وَّبِالْاِسْلَامِ دِيْنًا وَّبِمُحَمَّدٍ نَبِيًّا.

‘আমি আল্লাহকে প্রভু হিসাবে, ইসলামকে আমার দীন হিসাবে এবং রাসূল ‍সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আমার নবী হিসাবে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নিয়েছি।’তবে আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন অবশ্যই তাকে সন্তুষ্ট করবেন। (সুনানে ইবনে মাজা, হাদীস ৩৮৭০)

হযরত সুলাইমান ইবনে সুরাদ রা. বলেন, একদিন আমরা রাসূল ‍সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট বসা ছিলাম। আমাদের সামনে দুই ব্যক্তি ঝগড়া করছিল। একজন অপরজনকে গালি দিচ্ছিল। ক্রোধে তার চেহারা রক্তবর্ণ ধারণ করেছিল। রাসূল ‍সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমি এমন একটি বাক্য জানি, যদি এ ব্যক্তি বলে, তবে তার ক্রোধ চলে যাবে। তা হল, আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম। (বুখারী শরীফ, কিতাবুল আদব, হাদীস ৬১১৫)

হযরত আলী রা.-এর কাছে জনৈক ব্যক্তি এসে বলেন, আমি বড় ঋণে আক্রান্ত হয়ে গেছি, আমার সহযোগিতা করুন। হযরত আলী রা. বলেন, আমি কি তোমাকে সেই দুআটি শিখাব না, যা রাসূল ‍সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে শিখিয়েছেন? তোমার উপর যদি বড় পাহাড় পরিমাণও ঋণ থাকে, আল্লাহ তাআলা তা পরিশোধ করার ব্যবস্থা করবেন। দুআটি হল,

اَللّٰهُمَّ اكْفِنِىْ بِحَلَالِكَ عَنْ حَرَامِكَ، وَاَغْنِنِىْ بِفَضْلِكَ عَمَّنْ سِوَاكَ.

‘হে আল্লাহ! আপনি আমাকে হারাম থেকে বাঁচিয়ে হালালের মাধ্যমে যথেষ্ট করুন এবং আপনার অনুগ্রহে আপনি ছাড়া অপরের কাছ থেকে আমাকে পুরোপুরি মুক্ত কর“ন।’ (সুনানুত তিরমিযী, হাদীস ৩৫৮৪)

হযরত আলী রা. বলেন, রাসূল ‍সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কোন অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতেন, তখন তিনি এ দোয়া পড়তেন,

اَذْهِبِ الْبَاْسَ رَبَّ النَّاسِ! وَاشْفِ، اَنْتَ الشَّافِىْ، لاَ شِفَآءً اِلَّا شِفَائُكَ، شِفَآءً
لَّا يُغاَدِرُ سَقَمًا.

‘ব্যথা দূর করে দিন, হে মানুষের প্রভু! আপনি সুস্থতা দান করুন, আপনিই রোগ নিরাময়কারী। আপনি ছাড়া আর কেউ নিরাময় করতে পারবে না। এমন নিরাময় যার পর আর কোন রোগ থাকবে না।’ (সুনানুত তিরমিযী, হাদীস ৩৫৮৫)

হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. বলেন, একদিন রাসূল ‍সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে প্রবেশ করেন। সেখানে দেখেন একজন আনসারী সাহাবী, যার নাম আবু উমামা। রাসূল ‍সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে বলেন, আবু উমামা! তোমাকে মসজিদে একা বসা দেখছি; অথচ এখন সালাতের সময় নয়! উত্তরে তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! অনেক দুশ্চিন্তা ও ঋণ আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। তখন রাসূল ‍সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, আমি কি তোমাকে এমন বাক্য শিখিয়ে দেব যা পড়লে আল্লাহ তাআলা তোমার পেরেশানী দূর করবেন এবং ঋণ থেকেও মুক্ত করবেন? উত্তরে তিনি বলেন, অবশ্যই। তখন রাসূল ‍সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, তুমি প্রতিদিন সকাল বিকাল এ দুআ পড়বে:

اَللّٰهُمَّ اِنِّىْ اَعُوْذُبِكَ مِنَ الْهَمِّ وَالْحُزْنِ، وَاَعُوْذُبِكَ مِنَ الْعَجْزِ وَالْكَسَلِ
وَاَعُوْذُبِكَ مِنَ الْجُبْنِ وَالْبُخْلِ، وَاَعُوْذُبِكَ مِنَ غَلَبَةِ الدَّيْنِ وَقَهْرِ
الرِّجَالِ.

‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে পানাহ চাই সব রকম দুঃখ ও দুশ্চিন্তা থেকে, আমি আপনার কাছে পানাহ চাই অক্ষমতা ও অলসতা থেকে, কাপুরুষতা ও কৃপণতা থেকে, আরও পানাহ চাই ঋণের বোঝা ও মানুষের অত্যাচার থেকে।’ (সুনানে আবু দাঊদ, হাদীস ১৫৫৫)

The post এতেকাফে দোয়া ও মুনাজাত appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%8f%e0%a6%a4%e0%a7%87%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%ab%e0%a7%87-%e0%a6%a6%e0%a7%8b%e0%a7%9f%e0%a6%be-%e0%a6%93-%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a6%be%e0%a6%a4/

No comments:

Post a Comment