Thursday, December 15, 2022

লাস ভেগাস: পাপের শহরে পুণ্যের খোঁজ

মুনশী নাঈম:

অনেকের বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে, লাসভেগাস মুসলমানদের জন্য বসবাসের উপযুক্ত একটি শহর। এই শহরে রয়েছে বেশ কয়েকটি মসজিদ। এখানে বসবাসরত মুসলমানদের সংখ্যা ১৫ হাজারেরও বেশি। গত শতাব্দীর শুরুতে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দক্ষিণ-পশ্চিম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই শহরটি যৌনতা, অ্যালকোহল এবং মাদকের মতো সমস্ত ধরণের বিলাসি আয়োজনের স্বর্গরাজ্য হিসেবে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠে। বর্তমানে শহরটিতে ১৩০টির অধিক ক্লাব রয়েছে। শহরটি পায় বার্ষিক ৪০ মিলিয়ন দর্শক। জুয়া থেকে আয় করে ১০ বিলিয়ন ডলার। আত্মহত্যার দিক দিয়েও শীর্ষে রয়েছে শহরটি।

লাস ভেগাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেভাডা রাজ্যের সর্বাধিক জনবহুল শহর। শহরটি লাস ভেগাস উপত্যকা মহানগর অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত এবং বৃহত্তর মোজাভে মরুভূমির অঞ্চলের বৃহত্তম শহর। শহরটিতে ১৯১০ সালে জুয়া খেলা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ১৯৩১ সালে আবার বৈধ করা হয়। কেবল মরূভূমির শহরটি তখন হয়ে উঠে দর্শনার্থীদের প্রিয় শহর। লাস ভেগাসের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটি হয় ১৯৩১ সালে। যখন যখন ফেডারেল সরকার শহরগুলিকে জল এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ করার জন্য লাসভেগাসের ঠিক পূর্ব দিকে বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধিান্ত নেয়। এই সাইটে হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করে। ১৯৩৬ সালে বাঁধটি নির্মাণ সমাপ্ত হয়। এটি বিশ্বের বৃহত্তম বাঁধগুলির মধ্যে একটি। এই বাঁধ নির্মাণের পর শহরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়, দর্শনার্থী বাড়ে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিমাণ ১৯৬০-এর দশক থেকে ত্বরান্বিত হয় এবং ১৯৯০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে জনসংখ্যা ৮৫.২% বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়। একবিংশ শতাব্দীতে দ্রুত বিকাশ অব্যাহত রয়েছে। মার্কিন জনগণনা ব্যুরোর অনুমান অনুসারে, ২০১২ সালে শহরটির মোট বাসিন্দার সংখ্যা ৬,৫১,৩৯৯ জন এবং মহানগর অঞ্চলের জনসংখ্যা ২২,২৭,০৫৩ জন।

পাপের শহরে পুণ্যের মিনার

লাস ভেগাসের পাপের কেন্দ্র স্ট্রিপ স্ট্রিট থেকে কয়েক মিনিট দূরত্বে তাওহিদ মসজিদ। এটি শহরের বিখ্যাত ৭ মসজিদের একটি। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান লিখেছে, ‘এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা আফগান বংশোদ্ভূত অভিবাসী আহমেদুল্লাহ রোকে ইউসুফজাই। তিনি অনেক আগেই শহরে বসতি স্থাপন করেছিলেন। ইউসুফজাই এবং সেখানের মুসলিমরা বেশ সতর্কতার সঙ্গে হালাল উপার্জনের চেষ্টা করেন। যদিও লাস ভেগাসের মতো আধুনিক শহরে হালাল উপার্জন বেশ কঠিন। মুসলিমরা সেখানে বসবাস করেন বেশ নিরাপদে। তারা কোনো বৈষম্যের শিকার হন না।

ইউসুফজাই বলেন, ‘আমি যখন প্রথম লাসভেগাসে আসি, তখন স্ট্রিপের রাস্তায় প্রাপ্তবয়স্কদের বিনোদনের জন্য একটি ক্লাবের বিজ্ঞাপন বহন করছিলাম। আমার কানে ছিল হেডফোন। তাতে শুনছিলাম কুরআন তেলাওয়াত। আল্লাহর কাছে মনে মনে দোআ করছিলাম, আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করুন। তারপর আমি বিচ্যুত না হয়ে কিছু হালাল অর্থ উপার্জন করার চেষ্টা করি। এটা এমন এক শহর, যেখানে একটি হোটেলে চাকরি পেলে ২ হাজার বর্গমিটারের একটি বাড়ি এবং দুটি গাড়ি নিজের হতে পারে। একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার বা একজন কার্ড ব্যবসায়ী উপার্জন করতে পারেন ৬০ হাজাার ডলার।

ইউসুফজাই বলেন, তখন, সেই আশির দশকে এখানে, একটি মসজিদ পূর্ণ করার বা হালাল মাংস পাওয়ার মতো পর্যাপ্ত মুসলমান ছিল না। আমরা শহরের বাইরে একটি খামারে যেতাম, পশু কিনতাম এবং নিজেরা জবাই করতাম। এই তাওহিদ মসজিদে এখনও কোনো নির্দেষ্ট ইমাম নেই। দুজন লোক আছে, তারা একটু-আধটু কুরআন শিখেছে, তারাই ইমামতি করে। তবে ধর্মীয় বা কুরআনিক প্রতিষ্ঠান দ্বারা স্বীকৃত নয়। তাদের একজন একটি ক্যাসিনোতে রুটি বানায়, কেক তৈরী করে। আরেকজন কুরিয়ারম্যান এবং ড্রাইভার।

ইউসুফজাই উল্লেখ করেছেন, এই জায়গায় বসবাস করার জন্য খোদ মুসলমানরাই তাদের সমালোচনা করে। তাদের অবিশ্বাস করে। তবুও আমরা আমাদের ধর্ম মেনে চলি। অনেকে এসে আমাদের জিজ্ঞেস করে, ‘ক্যাসিনো কর্মীদের সম্পর্কে কী ভাবেন। আমরা বলে দেই, যে যার আমল নিয়ে কবরে যাবে। একজনের কবরে আরেকজন যাবে না।

বাচ্চাদের উপর প্রভাব

কিন্তু লাস ভেগাসের মুসলিম যুবক ও শিশুদের উপর এই পাপপূর্ণ পরিবেশের কোন প্রভাব পড়ে কিনা? ইউসুফজাই বলেন, ‘পৃথিবীর অন্য যে কোন জায়গার তুলনায় এই শহরে হারিয়ে যাওয়া সহজ। এখানে আপনি যেকোনো সময় যেকোনো রূপ বদলাতে পারবেন। যেকোনো ক্লাবে যেতে পারবেন। যেকোনো কাজ করতে পারবেন। সেখানে অ্যালকোহল একটি অপরিহার্য জিনিস হয়ে উঠেছে। এই শহরে পিতামাতার ভূমিকা খুব কঠিন। আমি শিক্ষার শাস্তিমূলক পদ্ধতিতে বিশ্বাস করি না। কিন্তু এমন পাপের শহরে সন্তানকে ঠিক রাখা আসলেই কঠিন।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রথম এবং দ্বিতীয় প্রজন্মের কিছু বিভ্রান্ত নারী নিজেদের শরীর বিক্রি করে অতিরিক্ত টাকা কামানোর জন্য। কিশোরীরা প্রাপ্তবয়স্কদের বিনোদন ক্লাবে কাজ করে, নাচ করে। সব অর্থের জন্য। কেউ কেউ মদের পরিচারিকার কাজ করে। তবে তারা সমাজ থেকে, মসজিদ থেকে, পরিবার থেকে দূরে থাকে। আমেরিকান নাম ব্যবহার করে। বাবা-মারা জানলেও কিছু করতে পারে না। কারণ, সন্তানকে শাসন করতে গেলেই পুলিশ এসে গ্রেফতার করবে। মুসলিম মেয়েরা বাবা-মায়ের শাসনের বিরুদ্ধে গিয়ে আদালতে পর্যন্ত যায়।’

ইউসুফজাই বাবা-মায়ের উদাসিনতার কথাও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, একটি বিশ বছরের মেয়ে মসজিদে এসে কান্নায় ভেঙে পড়ে বলছিল, কীভাবে নামাজ পড়তে হয়, আমি জানি না। আমার বাবা-মা আমাকে কখনও শেখায়নি। তারা আমাদের সংস্কৃতির নিয়ম ও রীতিনীতির ব্যাপারে কঠোর ছিল। কিন্তু তারা আমাকে ইসলাম শেখায়নি। কারণ তারা অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত ছিল।

মুহাম্মাদ শাকের নামে মরক্কো থেকে আসা অন্য একজন মুসলিম গার্ডিয়ানকে বলেছে, অন্য মুসলমানরা মনে করে এখানে থাকাটা পাগলামি। কিন্তু আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করছি মসজিদে আসার এবং সমস্ত খারাপ জিনিস থেকে দূরে থাকার। এখানে থাকতে আমাদের কোন সমস্যা নেই। আমার মতে, স্থানের বৈচিত্র্য এবং দর্শনার্থীদের বৈচিত্র্যময় জায়গায় একজন মুসলিম হিসাবে বসবাস করা সহজ, কঠিন নয়। জায়গাটিতে অনেক পাপ রয়েছে। কিন্তু এখানে আপনি নিজেকে একটু বাঁচিয়ে যদি নামাজ পড়েন, সেটা দারুণ চমৎকার হবে।

পরিবর্তনের চেষ্টা চলছে

তবে মুসলমানরা কেবল তাদের চারপাশের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা করেছে এমন নয়। এর বাইরেও এমন কিছু লোক ছিল যারা শহরের বাস্তবতা পরিবর্তনের প্রচেষ্টায় উদ্যোগী হয়েছিলেন, যদিও সীমিত পরিসরে। তাদের মধ্যে একজন হলেন ইমাম ফাতেন সাইফুল্লাহ। তিনি ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পাপ ও অন্ধকারের শহরটিকে আলোর নগরীতে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করছেন। স্ট্রিপ স্ট্রিট থেকে কয়েক মাইল দূরে আল-সাবোর মসজিদ। তিনি এই মসজিদকে ঘিরেই শুরু করেন পরিবর্তনের কাজ। তিনি মসজিদের আশেপাশের এলাকায় মাদকসেবী এবং গ্যাংদের তাড়িয়ে দেন। এতে সহযোগিতা করেন এলাকার মানুষ এবং স্থানীয় পুলিশ। ফলে এলাকাটি আগের চেয়ে নিরাপদ হয়েছে।

সাইফুল্লাহ মসজিদের আশেপাশের এলাকাটিকে “মুসলিম উপত্যকা” বলে ঘোষণা দিয়েছেন। বেশিরভাগ গ্যাং এবং মাদক ব্যবসায়ীদের বিতাড়িত করার পর তিনি আশেপাশের অধিকাংশ বাড়ি কিনে নেন। তিনি আগামী দশ বছরে একটি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চাইছেন। চাইছেন হরের উপকণ্ঠ থেকে মুসলমানরা যেন এই শহরে আসে। এখানে বাড়ি কিনে। তিনি আশা করছেন, শীঘ্রই অনেক মুসলিম পরিবারের জন্য আলাদা ঘর নির্মাণের কাজ শেষ হবে। যেন এই এলাকায় তারা বসতি স্থাপন করতে পারে এবং মসজিদের আশেপাশে তাদের জীবন শুরু করতে পারে।

তবুও আশ্চর্যজনক!

এই শহরে অন্ধকার প্রকৃতি ছাড়াও আশ্চর্যজনক কিছু ঘটনা দেখা যায়। আমেরিকান জার্নাল অফ সোশ্যাল সায়েন্স অ্যান্ড মেডিসিন দ্বারা পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, লাস ভেগাসে আত্মহত্যার হার আমেরিকার অন্যান্য শহরগুলির তুলনায় দ্বিগুণ। এই শহরে প্রতিদিন একজন আত্মহত্যা করে। গবেষকরা আশ্চর্যজনকভাবে দেখছেন, যারা এই শহর ছেড়ে যায়, তাদের আত্মহত্যার ঝুঁকি কম থাকে। যারা এখানে আসে, তাদের আত্মহত্যার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

অসংখ্য মৃত্যু ও আত্মহত্যার তদন্ত করেছেন ৩০ বছর ধরে ভেগাসে বসবাসকারী মাইক মারফি। তিনি দেখেছেন, কেবল জুয়া খেলায় হেরেই মানুষ আত্মহত্যা করে না। বরং অনেকে এই শহরে আসেই আত্মহত্যা করার জন্য। তারা হয়ত বাড়িতে আত্মহত্যা করতে পারে না। তিনি সাম্প্রতিক বছরগুলিতে শহরে একটি নতুন ধরণের আত্মহত্যার উত্থান লক্ষ্য করেছেন। যেখানে একজন ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির জীবন শেষ করে এবং তারপরে নিজেকে হত্যা করে।

দ্বিতীয় আশ্চর্যজনক ঘটনা হলো, এই শহরে নিয়মিত পঙ্গপালের আক্রমণ হয়। স্থানীয় আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ৩০ বছর ধরেই এই আক্রমণ হচ্ছে। লাস ভেগাস জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেক ক্যাসিনো এবং জুয়ার ক্লাবের উপরে এই আক্রমণ হয়। অনেকে এটাকে লাস ভেগাসের লোকেদের জন্য একধরনের শাস্তি হিসেবে আখ্যা দেয়।

The post লাস ভেগাস: পাপের শহরে পুণ্যের খোঁজ appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%b8-%e0%a6%ad%e0%a7%87%e0%a6%97%e0%a6%be%e0%a6%b8-%e0%a6%aa%e0%a6%be%e0%a6%aa%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%b6%e0%a6%b9%e0%a6%b0%e0%a7%87-%e0%a6%aa%e0%a7%81%e0%a6%a3%e0%a7%8d/

No comments:

Post a Comment