মুনশী নাঈম:
গত ১৬ সেপ্টেম্বর পুলিশ হেফাজতে কুর্দি তরুণী মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর থেকেই হিজাব-বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল হয়ে আছে ইরান। এ আন্দোলনে এখন পর্যন্ত ৩০০-এর বেশি বিক্ষোভকারীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা। তবে আন্দোলনে ২০০ জন বিক্ষোভকারীর মৃত্যু হয়েছে বলে শনিবার (৩ ডিসেম্বর) জানিয়েছে দেশটির সরকার।
যেই নৈতিকতা পুলিশ নিয়ে ইরানে বিতর্ক, দেশটিতে তাদের বলা হয় গাশত-ই এরশাদ (গাইডেন্স পেট্রল)। এটি পুলিশেরই একটি বিশেষ ইউনিট, যাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ইসলামিক নৈতিকতার সম্মান নিশ্চিত করার এবং পোশাকবিধি অনুসরণ না করা ব্যক্তিদের আটক করার। ২০০৫ সালে পুলিশের এই বিশেষায়িত বাহিনী প্রতিষ্ঠা করা হয়। শরিয়ার ব্যাখ্যার ভিত্তিতে তৈরি করা আইনের অধীনে একজন নারীকে তাদের চুল ঢেকে (হিজাব বা মাথার স্কার্ফ দিয়ে) রাখতে হয় এবং লম্বা ও ঢিলেঢালা পোশাক পরতে হয়। আর তারই বাস্তবায়নের দায়িত্ব বর্তায় নৈতিকতা পুলিশের ওপর। ১৩ সেপ্টেম্বর তেহরানের নৈতিকতা পুলিশ যখন তাকে গ্রেপ্তার করেছিল তখন আমিনির মাথার স্কার্ফের নিচে কিছু চুল দৃশ্যমান ছিল। পরে তাকে আটক করা হলে সেখান থেকে তাকে হাসপাতালে নেয়া হলে ৩ দিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় থাকার পর তিনি মারা যান।
মাহশা মারা যাবার পর বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতো। বিক্ষোভে সংহতি জানায় বিভিন্ন দেশের নারীরা। চলচ্চিত্র অভিনেত্রীসহ তারকা সংগীতশিল্পীরাও নিজেদের চুল কেটে ইরানি নারীদের সমর্থন জানান। এমনকি এই তালিকায় যুক্ত হন ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সদস্য আবির আল-সাহলানিও। ফলে ইরানে হিজাব এখন ধর্মীয় প্রতীক নয় কেবল, রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রতীক হিসেবেও বরিত হচ্ছে।
সরকার-জনতা দ্বন্দ
এক বিবৃতিতে আইআরজিসি জানিয়েছে, হাসপাতালে ইনটেনসিভ মেডিকেল কেয়ার এবং বিশেষ সতর্কতার সঙ্গে চিকিৎসা দেয়া সত্ত্বেও মাহশা আমিনির মৃত্যু হয়েছে। ভিডিও ফুটেজেও আমিনির মৃত্যুর বিষয়টি দেখা গেছে। কিন্তু তাকে কোথাও নির্যাতন করার ঘটনা পাওয়া যায়নি। হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, ‘ব্রেন ডেড’ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল মাহশাকে। হৃদ্স্পন্দন থাকলেও নড়াচড়ার ক্ষমতা ছিল না। তাঁকে আইসিইউতে ভর্তি করানো হয়। এর ৪৮ ঘণ্টা পর মাহশা হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। অনেক চেষ্টা করেও বাঁচানো যায়নি তাকে।
তবে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মৃত মাহশার বাবা আমজাদ আমিনি দাবি করেন, কোনও রকম অসুস্থতা ছিল না মাহশা আমিনির। প্রশাসন তার মৃত্যু নিয়ে মিথ্যে কথা বলছে। আমার মেয়ের কোনও রকম অসুস্থতা ছিল না। কয়েক বার ঠাণ্ডা লাগা ছাড়া ওকে কখনও হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়নি। ঘটনার দিন আমার সতেরো বছরের ছেলে মাহশার সঙ্গে ছিল। ছেলের বার বার অনুরোধ সত্ত্বেও মেয়েকে পুলিশ মারধর করে। মেয়েকে আটক করার পরে আমাকে এক বারও ওর সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। শুধু মৃত্যুর পরে কবরের জন্য মুড়ে রাখা শরীরটা আমরা দেখেছি। মাথা আর মুখটুকু খোলা ছিল। ওর পায়ের তলায় ক্ষতের দাগ ছিল।’
সরকারি ভাষ্য খোশ করতে পারেনি জনগণকে। তারা সরকারি বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে। শুরু হয় সরকারবিরোধী তুমুল বিক্ষোভ।
নিমা খুরামি লিখেন, বর্তমানে ইরানে যে বিক্ষোভ চলছে, তা তিনটি বিষয়ে তাদের প্রতিপক্ষ থেকে আলাদা। এক. পরিবর্তনের যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে নারীদের বিশিষ্ট ভূমিকা। দুই. বর্তমান বিক্ষোভের ব্যাপক বিস্তার, যা মধ্যবিত্ত বা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে শ্রমিক শ্রেণী সরকার বিরোধী বিক্ষোভ সংগঠিত করার জন্য সক্রিয় থাকলেও, বর্তমান বিক্ষোভ বিখ্যাত ক্রীড়াবিদ, শিল্পী এবং ধনী বণিকদের সমর্থন পেয়েছে। তিন. বিক্ষোভ কেবল বড় শহর নয়, বরং ছোট শহরগুলি বিক্ষোভের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। খুরামির ভাষ্যমতে, এই বিক্ষোভ ইরানে যেকোনো পরিবর্তন অর্জনের জন্য ইরানীদের শাসনের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তা করবে।
ইরানের হিজাব আন্দোলন
প্রায় ৮৬ বছর আগে, শাহ রেজা খানের শাসনামলে, ইরানে হিজাব নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়। সেই আন্দোলন ছিল শাসকের হিজাববিরোধী নীতির কারণে। গত শতকের চল্লিশের দশকে আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের সাথে বন্ধুত্ব করেছিলেন শাহ রেজা। তিনি প্রতিবেশী তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ মডেল ধার করে ইরানী সমাজে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। সম্পূর্ণ পশ্চিমা মডেল ধার করার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ইরানের শাহকে প্রথমে ধর্মীয় পণ্ডিতদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত করায়। তিনি তখন তাদের কাছ থেকে অনেক সামাজিক সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাহার করে নেন। তার এই কাজ তখন অনেকের ক্ষোভকে প্রজ্বলিত করে। শাহ রেজা কেবল হিজাবই নিষিদ্ধ করেননি, বরং বোরকাও নিষিদ্ধ করেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির সাথে ঘনিষ্ঠতা এবং ইংল্যান্ডকে রাগান্বিত করার দায়ে শাহ নির্বাসিত হওয়ার পরে, তার পুত্র মোহাম্মদ রেজা পাহলভি ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তরুণ শাহ সেই সময়ে পর্দার নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার সিদ্ধান্ত নেন। পরে ইরানে যখন বিপ্লব বিজয়ী হয় এবং ইরানের শাসনব্যবস্থা ধীরে ধীরে একটি বিশুদ্ধ ইসলামী চরিত্রে রূপান্তরিত হয়, তখন পর্দা ও হিজাব প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৩ সালে হিজাব পরা বাধ্যতামূলক করা হয়। যারা হিজাব পড়তো না, তাদেরকে কাজে যেতে বাধা দেয়া হয়।
এই ঘটনার ঠিক চল্লিশ বছর পর ইরানে আবার বিক্ষোভ হচ্ছে। এবার শাসকের হিজাববিরোধী মনোভাবের জন্য নয়, বরং হিজাব পড়া বাধ্যতামূলক করায় ক্ষুব্ধ হয়ে। এতে প্রতীয়মান হয়, ইরানে যে নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠছে, তারা পশ্চিমা চিন্তাধারায় বেড়ে উঠছে। তারা যেহেতু ইরানের বিপ্লব দেখেনি, তাদের মধ্যে ইসলামি ভাবধারা লালনের মনোভাবও কম। তারা বিক্ষোভ করছে এমন প্রতীকের বিরুদ্ধে, যা মূলত শাসকদের শাসনের সাথে যুক্ত।
আজ ইসলামী প্রজাতন্ত্রের শাসন অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, যার শীর্ষে রয়েছে চলমান আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি এবং বেকারত্বের হার বৃদ্ধি। ধারণা করা হচ্ছে, সাম্প্রতিক বিক্ষোভ ২০১৭ সালের বিক্ষোভের তীব্রতাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। ইরানের ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি মনে করে, ২২ বছর বয়সী তরুণী মাহশা আমিনির মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে যা হচ্ছে, তা মূলত বিপ্লব বিরোধীদের ষড়যন্ত্র।
পরিবর্তন হচ্ছে হিজাব আইন
ইরানে দুই মাসের বেশি সময় ধরে চলা বিক্ষোভের মুখে আলোচিত হিজাব আইন পরিবর্তনের আভাস দিয়েছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ জাফর মনতাজেরি বলেন, ‘ইরানে নারীদের মাথা ও চুল ঢেকে রাখার যে আইন প্রচলিত রয়েছে, তা পরিবর্তনের জন্য যৌথভাবে কাজ করছে বিচার বিভাগ ও পার্লামেন্ট। ত বুধবার ইরানি পার্লামেন্টের সাংস্কৃতিক কমিশনের সঙ্গে দেখা করেছেন দুই বিভাগের প্রতিনিধিদলের সদস্যরা। এ সময় হিজাব আইনে সম্ভাব্য পরিবর্তনের বিষয়ে তাঁদের মধ্যে বিস্তারিত কথা হয়েছে।’
এর আগে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ইরানে সাংবিধানিকভাবে প্রজাতান্ত্রিক ও ইসলামিক মূল্যবোধ শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। তবে নির্দিষ্ট কিছু প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংবিধানে পরিবর্তন আনা সম্ভব।’ তাঁর এমন বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রচলিত হিজাব আইনে পরিবর্তনের প্রত্যাশা করা হচ্ছিল।
অন্যদিকে দুই মাসের বেশি সময় ধরে চলা বিক্ষোভের মুখে অবশেষে আলোচিত নীতি পুলিশ বিলুপ্ত করা হয়েছে। মনতাজেরি বলেন, ‘বিচার বিভাগের সঙ্গে নীতি পুলিশের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি বিলুপ্ত করা হয়েছে।’
The post ইরানে হিজাব আন্দোলন: বিপ্লবের প্রতীক থেকে ক্ষমতার প্রতীকে রূপান্তর appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%87%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a7%87-%e0%a6%b9%e0%a6%bf%e0%a6%9c%e0%a6%be%e0%a6%ac-%e0%a6%86%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a6%e0%a7%8b%e0%a6%b2%e0%a6%a8-%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%aa%e0%a7%8d/
No comments:
Post a Comment