Sunday, December 18, 2022

বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগগুলোর ‘সঙ্কট’ কাটছে না

রাকিবুল হাসান নাঈম:

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি অনুষদের সিলেবাস দিনদিন উন্নত হলেও আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। আরবি বিষয়টির প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহের চাইতে অনাগ্রহের পরিমাণই বেশি। পরিশোধিত সিলেবাসও তাদের আগ্রহ ফেরাতে পারছে না। শিক্ষকরা বলছেন, আরবি অনুষদের ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থীই অমনোযোগী। তারা আরবি না পড়ে বিসিএসএসের পড়াশোনা করছে। ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী কোনোমতে আগ্রহ ধরে রেখেছে।

পড়ানোর মান উন্নত না হওয়া এবং শিক্ষার্থীদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলার পেছনে বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করেছেন শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকরা। তাদের ভাষ্যানুযায়ী, সমস্যা দু দিকেরই রয়েছে। তারা এটাও স্বীকার করেছেন, বর্তমান পৃথিবীতে আরবির যে অবস্থান, তাতে যোগ্য হয়ে কাজ করার জন্য এই পরিস্থিতির ‍উন্নয়ন ঘটাতে হবে।

শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আরবি বিভাগে ৯০ শতাংশই দাখিল কিংবা ইসলামিক শিক্ষা ব্যাকগ্রাউন্ডের শিক্ষার্থীদের নেয়া হয়। বাকি ১০ শতাংশ নেয়া হয় স্কুল-কলেজ ব্যাকগ্রাউন্ডের। কখনও শর্ত দেয়া যায়, কখনও শর্ত দেয়া যায় না।

ঢাবির কারিকুলাম ও অভিযোগ

ঢাবির কারিকুলাম নিয়ে কথা হয় ঢাবির আরবি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শহীদুল ইসলামের সঙ্গে। ফাতেহকে তিনি জানান, আরবি বিভাগের ছাত্ররা বর্তমান পৃথিবীতে যেন সবক্ষেত্রে খাপ খায়, সে লক্ষ্যেই আমদের কারিকুলাম উন্নত করা হয়েছে। বর্তমান কারিকুলাম বেশ পরিমার্জিত একটি কারিকুলাম। যেমন আরবির সঙ্গে এখানে প্রফেশনাল কোর্স হিসেবে আছে কম্পিউটার বেসিক এন্ড এডভান্সড কোর্স, বাংলাদেশ স্টাডি, ইসলামিক ইকোনমি, সোশ্যাল রিসার্চ ইত্যাদি। নতুন করে মিডলইস্ট স্টাডি যুক্ত করার পরিকল্পনা চলছে। আরবিতে প্রথম দুই বছর আমরা আরবি ল্যাঙুয়েজ শেখাই। পরবর্তী দুই বছর শেখাই আরবি ভাষার ইতিহাস, কবিতা এবং ব্যবহারিক আরবি।

কারিকুলাম প্রতিনিয়ত উন্নয়ন করছেন বলে ফাতেহকে জানান ঢাবির আরবি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমরা যখন পড়াশোনা করেছি, তখনকার সিলেবাস আর এখনকার সিলেবাসে আকাশ-পাতাল তফাৎ। এখনকার ঢাবির আরবি সিলেবাস বেশ উন্নত।’

কারিকুলাম এবং পড়াশোনা নিয়ে কথা হয় ঢাবির আরবি তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তিনি জানান, ‘ক্লাসে শিক্ষকরা অধিকাংশই লেকচার দেন বাংলায়। পরীক্ষাও বাংলাতে দেয়া যায়। প্রশ্নের একটা পার্ট আরবিতে দেয়া বাধ্যতামূলক থাকে। ফলে শিক্ষার্থীরা আরবি না শিখে পরীক্ষায় ভালো করার একটা সুযোগ পেয়ে যায়। কেউ একাডেমিক বইগুলো পড়ে না। পড়ে নোট আর শিট। পরীক্ষায় যতটুকু দরকার ততটুকুই, এর বাইরে কিছু না। পুরো সময় শিক্ষার্থীরা বিসিএসএসের বই পড়ে, জবের পড়া পড়ে। যদি শিক্ষকরা আরবিতে লেকচার দিতেন, পরীক্ষা আরবিতে দেয়া বাধ্যতামূলক থাকতো, ইচ্ছে না হলেও অনেকে আরবিটা শিখতো।’

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ফাতেহকে বলেন, ‘আরবিতে লেকচার দিলে ৪০ শতাংশ ছাত্র বুঝবে, ৬০ শতাংশ ছাত্রই বুঝবে না। তাই বাংলায় লেকচার দেয়া হয়। অনেকে আরবিতেও দেন। আর পরীক্ষা আরবিতে না বাংলায় নেয়া হবে, সেটা বিশ্ববিদ্যালয় ঠিক করে, আমরা ঠিক করি না। সিলেবাস আমরা উন্নত করেছি। আরবিতে কর্মক্ষেত্রও বিকশিত হচ্ছে। যারা পড়ছে মন দিয়ে, তারা ভালো করছে। যারা পড়ছে না, তারা কেবল অভিযোগ তুলছে।’

রাবির কারিকুলাম ও সমস্যা

রাবির কারিকুলাম নিয়ে কথা হয় রাবির আরবি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ সাজিদুল হকের সঙ্গে। তার দেয়া তথ্যমতে, রাবির আরবি বিভাগের অনার্স কোর্সগুলো চারভাগে বিভক্ত। এক. ভাষাকেন্দ্রীক: এখানে মূলত ল্যাঙুয়েজ শেখানো হয়। এতে ৯টা কোর্স রয়েছে। ব্যাকরণের ৪টা, ভাষাগত ৩টা, ব্যাবহরিক ২টা। দুই. আরবি সাহিত্য: এতে আরবি সাহিত্যের পদ্য, গদ্য, সমালোচনা পড়ানো হয়। এতে রয়েছে ১৮টি কোর্স। তিন. সহায়ক কোর্স: এখানে আরবি সাহিত্যের ইতিহাস, ধারাক্রম, বিবর্তন ইত্যাদি পড়ানো হয়। এতে ৪টি কোর্স রয়েছে। চার. প্রফেশনাল কোর্স: এতে ২০২০ সালে মাত্র একটি কোর্স ছিল। এখন রয়েছে ৩টি কোর্স; ইংরেজি, আইসিটি এবং কম্পিউটার।

অধ্যাপক মোহাম্মদ সাজিদুল হক ফাতেহকে বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার মিডিয়াম আরবি। আমরা আরবিতেই লেকচার দিয়ে থাকি। তবে কোনো কোনো কোর্স বাংলাতেও পড়ানো হয়। তবে এটা সত্যি, আমরা এখনো আন্তর্জাতিক স্তরের কারিকুলাম তৈরী করতে পারিনি। চেষ্টা করছি।’

রাবির এই অধ্যাপক বলেন, ‘আরবিতে কাজের ক্ষেত্র বাংলাদেশে পুরো বিকশিত না হলেও ক্ষেত্র কম না। দেশে আরবি অনুবাদের কদর বাড়ছে, বাজার বাড়ছে। বাইরের দেশে ২০-২৫টি রাষ্ট্রে আরবির কর্মক্ষেত্র রয়েছে। দেশে অনেক মাদরাসা-স্কুল রয়েছে। কাজের ক্ষেত্র থাকলেও আগ্রহী হচ্ছে না শিক্ষার্থীরা। আমদের গবেষণা বলছে, ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থীই অমনোযোগী। ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী কোনোরকম আগ্রহ ধরে রেখেছে।’

সমস্যা কোথায়?

ঢাবির অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ফাতেহকে বলেন, ‘আরবি বিভাগে মাদরাসার শিক্ষার্থীরা আসে বেশি। কিন্তু মাদরাসায় এখন আরবিটা ভালো করে পড়ানো হয় না। শিক্ষার্থীরা যখন ভর্তি হয়, তারা এক লাইন আরবিও বলতে পারে না। সেই শুরু থেকে তাদেরকে আবার পড়াতে হয়। ফলে যারা একটু পারে, তারা বিরক্ত হয়। বলে, এসব তো আগেই পড়েছি। আমরা পড়িয়ে তাদেরকে শেখাই। দিনশেষে দেখা যায়, তারা আধঘণ্টা আরবিতে কথা বলতে পারে।’

মাদরাসার শিক্ষা-দুর্বলতার কথা স্বীকার করেছেন রাবির আরবি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ সাজিদুল হকও। তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘স্কুল থেকে যারা আসে, তারা আরবি বুঝে না। মাদরাসা থেকে যারা আসে, তারাও বুঝে না। আগে কওমি মাদরাসা থেকে যারা আসতো, তারা আরবি ভালো পারতো। কিন্তু এখন কওমি মাদরাসা থেকে যারা ভর্তি হচ্ছে, তারাও ভালো পড়ছে না। ফলে আমরা আমাদের শ্রম অনুযায়ী ফলাফল পাচ্ছি না। অনার্স লেবেলে পড়াতে হচ্ছে প্রাইমারি লেবেলের আরবি।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাই চয়েজ আরবি পড়তে এসেছে এমন খুব কম হয়। সাধারণত, নম্বর তালিকা কিংবা কোটা হিসেবে যখন অন্য বিষয় পায় না, অটোমেটিক আরবি চলে আসে। কেবল ইউনিভার্সিটিতে থাকার জন্য তাদের আরবিটাকেই নিতে হয়। বলা হয়, আরবিটা নিলে নিতে পারো। নয়ত আর কোনো বিষয় নাই। ফলে সে বাধ্য হয়ে আরবি নেয়। পরীক্ষায় কোনোরকম পাশ করে। তার পুরো ধ্যান থাকে জবের পড়াশোনা।’অথচ অন্য দেশে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা থাকে। কোন সাবজেক্ট নিলে কী হবে, তা জানতে পারে শিক্ষার্থীরা। আমাদের দেশে সেটা নেই।’

অধ্যাপক সাজিদুল হক প্রাতিষ্ঠানিক কিছু কমতির কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘পড়ার মান উন্নতকরণ নিয়ে শিক্ষার্থীদের যে অভিযোগ, তার পেছনে প্রতিষ্ঠানের দায় আছে। যেমন ভার্সিটিতে একটা ল্যাব নেই। আরবি লিসেনিং স্কিল ডেভেলপ করতে হলে তো ভালো অডিও সেটাপ লাগবে। ভিজ্যুয়াল সিস্টেম লাগবে। তার ব্যবস্থা নেই। সিলেবাস উন্নত হচ্ছে ঠিক, পড়ার মান উন্নত হচ্ছে না। কেন? কারণ, বাইরের দেশে প্রতিনিয়ত মাতৃভাষা ছাড়া অন্যভাষা শেখানোর মেথড তৈরী হচ্ছে নতুন নতুন। বইও বের হচ্ছে। কিন্তু আমদের দেশে এসবের চর্চা নেই। শিক্ষকদের ট্রেনিং দেয়া হয় না। শিক্ষকরা নিজে থেকেও রিসার্চ করেন না। ফলে সেই পুরাতন পদ্ধতিতেই পড়াচ্ছেন। পুরোনো রীতিতেই প্রশ্নপত্র তৈরী করছেন।’

সমস্যা নিরসনের উদ্যোগ

এই সমস্যা নিরসনে শিক্ষকরা ব্যক্তি পর্যায়ে চেষ্টা করছেন। তবে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থায় সমস্যা নিরসনের প্রচেষ্টা নাই বললেই চলে। ঢাবির অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম ফাতেহকে বলেন, ‘প্রথম বর্ষ থেকে আমরা একটা নতুন উদ্যোগ নিয়েছি। যে ভালো পারে, তাকে প্রধান করে যারা কম পারে, তাদের একটা গ্রুপ করে দিচ্ছি। যেন সে সবাইকে শেখাতে পারে। এর কিছু ফলাফলও পাচ্ছি আমরা। শিক্ষার্থীরা হতাশায় ভোগে। তাদেরকে মোটিভেট করতে হয়। সেটাও আমরা প্রতিনিয়ত করছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমাদের একটা বিষয় নিয়ে কথা চলছে। আরব যে কান্ট্রিগুলো আছে, কিংবা দেশের বাইরে তাদের যে প্রজেক্টে আরবি বিষয়ক লোক দরকার, তা যেন আমদের থেকে নেয়, এমন একটা চুক্তির পরিকল্পনা হচ্ছে। বিষয়টি হলে ছাত্ররা আশা করছি আরও মোটিভেট হবে। কারণ, দিনশেষে অর্থনৈতিক দিকটাও ভাবতে হয়। ছাত্ররা জব এবং বিসিএসএসের পড়া পড়ছে অর্থের জন্যই।’

রাবির অধ্যাপক সাজিদুল হক ফতেহকে বলেন, ‘একবার আমরা নতুন একটা উদ্যোগ শুরু করেছিলাম কয়েকজন শিক্ষক মিলে। ক্লাসের বাইরেও শিক্ষার্থীদের আরবি ক্লাস নিতাম। বেশ ভালো ফলাফলও পেয়েছিলাম। প্রথম বর্ষে স্কুল শিক্ষার্থীরাও আরবিতে কথা বলতে পারতো। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক সহায়তা না থাকার কারণে সেটা বন্ধ হয়ে যায়।’

রাবির এই অধ্যাপক মনে করেন, ‘আরবি বিভাগ পুরোটা মাদরাসার ছাত্রদের জন্য ছেড়ে দেয়া উচিত। তাহলেও কিছুটা উন্নতি করা যাবে। পাশাপাশি ভাষাশিক্ষার জন্য দরকারি উপকরণ সরবরাহ এবং শিক্ষকদের ট্রেনিং করাতে পারলে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো যাবে।’

The post বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগগুলোর ‘সঙ্কট’ কাটছে না appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%b6%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%86%e0%a6%b0%e0%a6%ac%e0%a6%bf-%e0%a6%ac%e0%a6%bf/

No comments:

Post a Comment