Monday, December 19, 2022

আরবি অদক্ষতা বাড়ছে কওমি মাদরাসায়

মুনশী নাঈম:

আরবিতে অদক্ষতা বাড়ছে কওমি মাদরাসাতেও। অনেক ছাত্রই আরবি ‘এবারত’ পড়তে পারছেন না। পরীক্ষায় আরবিতে লেখার জন্য অতিরিক্ত নম্বর থাকলেও অধিকাংশ ছাত্রই লিখছেন বাংলায়। কওমি মাদরাসার শিক্ষক, শিক্ষাবোর্ড, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এবং পরীক্ষার খাতা নিরীক্ষাকারীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। তারা বলছেন, আরবি অদক্ষতার কারণেই বাড়ছে বাংলা গাইড-নোট প্রবণতা।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে ধর্মীয় শিক্ষার মূল একটি ধারায় কেন এই সঙ্কট দেখা দিচ্ছে? এর পেছনের কারণ কী?

পরীক্ষা আরবিতে দিচ্ছে ‘খুব কম’

পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, নাহবেমির থেকে শুরু করে তাকমিল পর্যন্ত একই চিত্র। অধিকাংশ ছাত্রই আরবিতে পরীক্ষা না দিয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে বাংলায়। যারা আরবিতে খুব ভালো পরীক্ষা দিচ্ছে, তাদের অনেকে আবার মাদানি নেসাব থেকে উঠে আসা।

হাইআতুল উলইয়ার পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাওলানা ইসমাইল বরিশালীর কাছে তাকমিলের ছাত্রদের পরিসংখ্যান জানতে চাই। তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘তাকমিলের অধিকাংশ ছাত্রই বাংলায় পরীক্ষা দেয়। আরবিতে দেয় খুব কম। তবে কত শতাংশ বাংলায় দেয়, এমন কোনো পরিসংখ্যান করিনি।’

এ প্রসঙ্গে কথা হয় কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকের সহকারী পরিচালক মাওলানা যুবায়ের আহমাদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ফজিলত এবং সানুবিয়ার শিক্ষার্থীদেরও একই অবস্থা। তারাও অধিকাংশই বাংলায় পরীক্ষা দেয়। যারা আরবিতে খুব ভালো পরীক্ষা দেয়, তাদের অনেকে মাদানি নেসাব থেকে উঠে আসা। কয়েক বছর আগে মেশকাতে এক এবং দুই হয়েছিল যে দুজন ছাত্র, তারা মাদানি নেসাব থেকে পড়ে আসা। খাতা দেখেই বুঝতে পারি। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, সত্যিই।’

মাওলানা যুবায়ের আহমাদ বলেন, ‘পরীক্ষায় আরবিতে যেমন লিখতে পারে িনা, এবারতও পড়তে পারে না অনেকে। আমাদের একটা মধ্যম মানের ছাত্রও এবারত পড়তে ভুল করে।’

রাজধানীর জামিয়া আরাবিয়া হাজী ইউনুস কওমী মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা নিজামুদ্দিনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি গত বছর বেফাকের নাহবেমির পরীক্ষার্থীদের খাতা দেখেছেন। তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘নাহবেমিরের ছাত্ররা পরীক্ষা দেয় বাংলায়। সবাই পড়ে গাইডনির্ভর। প্রশ্নপত্রও হয় বাংলায়। এমনকি আরবি ব্যাকরণশাস্ত্র ‘শরহে মিআতে আমেল’ পরীক্ষার প্রশ্নও হয় বাংলায়। ফলে শিক্ষার্থীরা আরবিতে পরীক্ষা দেয়ার রিস্ক নেয় না।’

সমস্যা সিলেবাস নাকি অন্যকিছু?

মাওলানা নিজামুদ্দিন মনে করেন, প্রথম সমস্যা সিলেবাসে। বেফাকের মিজান জামাতে পড়াতে হয় আরবি শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বই। বইটির নাম ‘আত তরিক ইলাল আরাবিয়া’। কিন্তু শিক্ষকরা পুরো তিনখণ্ড পড়াতে পারেন না। দুইখণ্ড পড়ান, তৃতীয় খণ্ড কখনও পড়ানো হয়, কখনও পড়ানো হয় না। অথচ তৃতীয় খণ্ডও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তারপর নাহবেমিরে পড়ানো হয় আরবি শেখার প্রাচীন কিতাব ‘রওজাতুল আদব’। এটি না পড়িয়ে যদি ‘আত তরিক ইলাল আরাবিয়া’র তৃতীয় খণ্ড পড়ানো হতো, তাহলে আরও ভালো হতো। মিজান-নাহবেমিরে যদি আরবির ভিত শক্ত না হয়, পরে সেটা কঠিন হয়।’

মাওলানা নিজামুদ্দিন শিক্ষকদের প্রসঙ্গে বলেন, ‘আরেকটি সমস্যা হলো, শিক্ষকরা আরবি শেখার কিতাবগুলো যেভাবে পড়ানো দরকার, সেভাবে পড়ান না। ফলে ছাত্ররাও তেমন উপকৃত হতে পারে না।’

একই সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন বাঞ্চারামপুরের মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জি হুজুর মাদরাসার সিনিয়র শিক্ষক মাওলানা আশরাফুল হক। তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘মাদরাসায় আত তরিক কিতাবটি যেভাবে পড়ানো দরকার, সেভাবে পড়ানো হয় না। এই কিতাবের প্রতিটি খণ্ডেরই তামরিন কিতাব (অনুশীলনমূলক) আছে। কিন্তু তা খুব গুরুত্ব দিয়ে চর্চা করানো হয় না। এই কিতাবের মধ্যেও আরবি ব্যাকারণিক নিয়ম যুক্ত করে পড়ানো হয়। অথচ এটাতে ব্যাকরণ যুক্ত করার কথা না। এই কিতাব পড়ে মাদানি নেসাবের ছাত্ররা আরবি বুঝতে পারছে, অথচ আমদের ছাত্ররা এ কিতাব পড়েও আরবি বুঝতে পারছে না। এখানে পড়ানোর পদ্ধতিতে সমস্যা আছে।’

মাওলানা আশরাফুল হক গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি দিক উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘মাদরাসাগুলোতে আরবি শিক্ষার এই কিতাবগুলোকে মনে করা হয় ছোট এবং সহজ কিতাব। ফলে এই কিতাবের জন্য কম যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ দেয় অনেক মাদরাসা। অথচ, এটা ভাবা হয় না, এই কিতাবগুলো পড়েই একজন ছাত্রের আরবি শিক্ষার ভিত গড়ে উঠে। ফলে ছাত্ররাও আরবি শেখানোর ভালো শিক্ষক পায় না।’

শিক্ষাবোর্ড কী ভাবছে?

বেফাকের সহকারী পরিচালক মাওলানা যুবায়ের আহমাদ বলেন, ‘মুরুব্বিরা বিষয়টি জানেন। বিভিন্ন শিক্ষক ট্রেনিংয়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। কোন কিতাব কিভাবে পড়াতে হবে, তা বুঝানো হয়। ট্রেনিংয়ের মূল দায়িত্বে আছেন মাওলানা সাজিদুর রহমান, মুফতি মিজানুর রহমান সাইদ এবং মাওলানা মাহফুজুল হক। ট্রেনিংয়ে কী কী বলা হবে, তা তারাই নির্ধারণ করেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই সঙ্কট নিরসনে মূল দায়িত্ব পালন করতে হবে শিক্ষকদের। তাদেরকে আন্তরিকতা নিয়ে পড়াতে হবে। ছাত্রদের পেছনে মেহনত করতে হবে। মাদরাদসা কর্তৃপক্ষকে সতর্ক হতে হবে। তাহলে ছাত্ররাও আগ্রহী হবে আরবির প্রতি। আমরা তো ছাত্রদেরকে উৎসাহিত করতে পরীক্ষায় আরবিতে লেখার জন্য আলাদা নম্বর রেখেছি।’

তবে বোর্ডের নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, কওমি ছাত্রদের আরবি সঙ্কট বিষয়টি নিয়ে বোর্ডে কোনো উদ্বেগ কিংবা আলোচনা নেই। বিষয়টিকে কোনো ইস্যু হিসেবে দেখছেন না মুরুব্বিরা। বোর্ডের ভেতরে যেমন আলোচনা নেই, তেমনি আলোচনা নেই বাইরেও। বোর্ডের কার্যক্রম আটকে আছে কেবল কিছু বই বাজারজাত করা এবং পরীক্ষা গ্রহণেই। বোর্ড চলছে গতানুগতিক ধারায়।

 

The post আরবি অদক্ষতা বাড়ছে কওমি মাদরাসায় appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%86%e0%a6%b0%e0%a6%ac%e0%a6%bf-%e0%a6%85%e0%a6%a6%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%b7%e0%a6%a4%e0%a6%be-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%a1%e0%a6%bc%e0%a6%9b%e0%a7%87-%e0%a6%95%e0%a6%93%e0%a6%ae%e0%a6%bf/

No comments:

Post a Comment