Wednesday, December 28, 2022

বাইশের মুসলিম বিশ্ব: আলোচিত যত ঘটনা

মুনশী নাঈম:

বিদায় নিচ্ছে খ্রিষ্টীয় সাল ২০২২। প্রতিটা সালই বিশ্ব পরিস্থিতিতে নানা ঘটনা-উপঘটনার জন্ম দিয়ে মহাকালের ঠিকানায় হারিয়ে যায়। ২০২২-এও পৃথিবীর নানা প্রান্তে সংঘটিত হয়েছে এমন অসংখ্য ঘটনা, যার কোনোটি আলোচনার আলোয় এসেছে, আর কোনোটি থেকে গেছে অনালোচিতই। ঊনিশে মুসলিম বিশ্বে আলোচিত এমন তেরোটি ঘটনার উল্লেখ নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।

১. কর্ণাটকে হিজাব বিতর্ক

ভারতের বিজেপিশাসিত কর্ণাটকে হিজাব বিতর্ক ছিল আলোচনার শীর্ষে। ২০২১ সালে ডিসেম্বরের শেষ দিকে এবং ২০২২ সালের জানুয়ারী মাসের প্রথম দিকে, রাজ্যের অনেক কলেজে হিজাব নিয়ে ছাত্রী এবং প্রশাসনের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। কিন্তু ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতে, বিতর্ক আরও তীব্রতর হয়। উদুপি জেলার এক কলেজ কর্তৃপক্ষ হিজাব নিষিদ্ধ করে। প্রতিবাদে উদুপির এক মুসলমান ছাত্রী কর্ণাটক হাইকোর্টে মামলা করে।

সবচে বেশি আলোচনায় আসে মান্ডিয়ার কলেজের বিবি মুসকান খান নামের এক মুসলিম ছাত্রী। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, মুসকান একটি স্কুটিতে চালিয়ে কলেজে প্রবেশ করেন। তাকে প্রবেশ করতে দেখে গেরুয়া ওড়না পরা একদল তরুণ তাকে উদ্দেশ্য করে জয় শ্রীরাম স্লোগান দিতে শুরু করে। একটা পর্যায়ে তাদের স্লোগানের জবাবে মুসকান আল্লাহু আকবার বলে স্লোগান দেন। ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে পড়ে। হিজাব বিতর্ক আরও চাঙ্গা হয়ে উঠে। হিজাবের দাবিতে বিক্ষোভ করায় তুমাকুরু জেলার একটি সরকারি প্রি ইউনিভার্সিটি কলেজের ১০ জন মুসলিম ছাত্রীর নামে পুলিশ মামলা করে। রাজ্যের শিভামোগ্গা জেলার শিরালাকোপ্পার একটি সরকারি কলেজে হিজাব পরে আসায় ৫৮ জন ছাত্রীকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করে।

হিজাব পরার অধিকার চেয়ে ছাত্রীরা কর্নাটক হাইকোর্টে যে মামলা করেছিল, তার অন্তর্বর্তী আদেশে আদালত বলেছিল মামলাটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কোনও ধরনের ধর্মীয় পোশাক পরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া যাবে না। ১৫ মার্চ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের উচ্চ আদালত ক্লাসে হিজাব পরা নিষিদ্ধের পক্ষে রায় দেয়। প্রধান বিচারপতি রিতু রাজ অসথি, বিচারপতি কৃষ্ণ এস দীক্ষিত এবং জেএম খাজির সমন্বয়ে গঠিত তিন বিচারপতির বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদালতের মতে, হিজাব পরা অপরিহার্য ধর্মীয় অনুশীলন নয়। তাই এটি নিষিদ্ধ করা বা না করার এখতিয়ার রাখে স্কুল বা কলেজ কর্তৃপক্ষ।

২. নবীকে নিয়ে বিজেপির দুই নেতার মন্তব্যে ক্ষুব্ধ মুসলিম বিশ্ব

চলতি বছরের জুনে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির দু’জন নেতা ইসলামের নবী মোহাম্মদ সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য করার পর উত্তাল হয়ে উঠেছিল মুসলিম বিশ্ব। প্রথমে নবিজিকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেন বিজেপির মুখপাত্র নূপুর শর্মা। পরে ওই একই ইস্যুতে দলটির দিল্লি ইউনিটের প্রধান নাভিন জিন্দাল টুইট করার পর বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোড়ন উঠে। নবি অবমাননার প্রতিবাদ জানায় সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, মালদ্বীপ, জর্ডান, লিবিয়া ও বাহরাইনসহ আরও অনেক মুসলিম দেশ। কাতার বলেছে, তারা প্রত্যাশা করে ভারত যেন এ বিষয়ে প্রকাশ্যে ক্ষমা চায়। সৌদি আরবও তাদের দেয়া বিবৃতিতে বেশ কঠোর ভাষা ব্যবহার করেছে। ওআইসি এবং পাকিস্তানও ভারতের সমালোচনা করেছে। এমনকি বিজেপির দুই নেতার বিতর্কিত মন্তব্যের প্রতিবাদে ঢাকায় বিক্ষোভ হয়। বিক্ষোভ করে হেফাজতে ইসলাম ও জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি ইসলামপন্থী দল।

আরব বিশ্বের ক্ষোভ দমাতে বিজেপি নুপুর শর্মার সদস্য পদ বাতিল করে। পাশাপাশি নবীন জিন্দালকে দল থেকে বহিষ্কার করে।

৩. ইস্তাম্বুল ঘোষণা

২২ অক্টোবর, ইসলাম সম্পর্কে সঠিক তথ্য তুলে ধরতে এবং ইসলামফোবিয়া ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রতিরোধ করতে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর তথ্যমন্ত্রীদের ১২তম ইসলামী সম্মেলনে একটি ঘোষণাপত্র গৃহীত। এই ঘোষণাপত্রকেই বলা হয় ‘ইস্তাম্বুল ঘোষণাপত্র’

ইস্তাম্বুল ঘোষণায় ভুল তথ্যরোধ এবং ইসলামফোবিয়া থামাতে মিডিয়ার সঠিক ব্যবহারের উপর জোর দেয়া হয়েছে। নিচে ঘোষণার গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলো তুলে ধরা হলো।

১. পোস্ট-ট্রুথ এরা বা সত্য-উত্তরকালের ডিজইনফরমেশন এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ওআইসির সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সহযোগিতার গুরুত্বের উপর জোর দেয়া। পাশাপাশি লড়াইয়ের স্বল্প, মধ্যম এবং দীর্ঘমেয়াদী কৌশল প্রণয়ণ করা। উল্লেখ্য, পোস্ট-ট্রুথ এমন একটা পরিস্থিতি, যখন মানুষ সঠিক তথ্য ও প্রকৃত ঘটনার ওপর নয়, বরং তার বিশ্বাস ও আবেগের ওপর ভিত্তি করে কোনো বিষয়কে গ্রহণ বা বর্জন করে। এই পরিস্থিতিতে যেকোনো বিষয়ের বিশ্লেষণে মানুষের কাছে তাঁর আবেগ ও বিশ্বাসই প্রধান ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।
২. স্বল্প সময়ে নির্দিষ্ট সমস্যা এবং সম্ভাব্য পরিস্থিতি বুঝতে হবে। মধ্যম সময়ে তথ্যের যথার্থতা যাচাইয়ে যোগাযোগ ও কৌশল বাড়াতে হবে। তারপর দীর্ঘমেয়াদী মিডিয়া কন্টেন্ট সরবরাহ করতে হবে।
৩. ইসলাম সম্পর্কে সঠিক তথ্য তুলে ধরতে এবং ইসলামফোবিয়া বিরুদ্ধে লড়াই করতে নতুন এবং আধুনিক টেকনোলজি ব্যবহার করতে হবে।
৪. মুসলিম দেশগুলোর মিডিয়ায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি আগ্রাসনের বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে হবে। পাশাপাশি ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের অবসান ঘটাতে ফিলিস্তিনি জনগণের বৈধ দাবির স্বপক্ষে প্রচারণা চালাতে হবে।
৫. শরণার্থী, আশ্রয়প্রার্থী ব্যক্তিদের, বিশেষ করে ওআইসি সদস্য দেশগুলোর শরণার্থীদের সমর্থন করার জন্য মিডিয়ায় আন্তর্জাতিক সংহতি এবং সহায়তার গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে।
৬.ইসলামী সংস্কৃতি এবং বিশ্বের অন্যান্য সংস্কৃতির মধ্যে ডায়ালগ বাড়াতে হবে।
৭. অমুসলিম দেশগুলোতে যে ইসলামিক কালচার এবং ধর্মীয় ঐতিহ্য ধ্বংযজ্ঞের শিকার হচ্ছে, মিডিয়ায় তার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বাড়াতে হবে। বিশেষ করে সেইসব এলাকায়, যেখানে আদিবাসী মুসলিম সম্প্রদায় জাতিগত নির্মূলের শিকার হয়েছিল৷
৮. ওআইসি মিডিয়া ফোরাম (ওএমএফ)-এ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মিডিয়া প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করা।।

৪. মালয়েশিয়ার নির্বাচন

১৯ নভেম্বর মালয়েশিয়ায় অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আবারও অংশ নিচ্ছেন দেশটির প্রায় শতবর্ষীয় প্রবীণ রাজনীতিবিদ মাহাথির মোহাম্মদ। তবে কোনো দলই ২২২ আসনের পার্লামেন্টে সরকার গঠনে প্রয়োজনীয় সমর্থন দেখাতে পারেনি। দেশটিতে সরকার গঠনে ১১২ আসন নিশ্চিত করতে হয়। নির্বাচনে আনোয়ার ইব্রাহিমের দল পাকাতান হারাপান (পিএইচ) জোট ৮২টি আসনে জয় পায়। অন্যদিকে মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের দল পেরিকাতান ন্যাসিওনাল (পিএন) পায় ৭৩ আসন।

জাতীয় নির্বাচনে কোনো দল বা জোট সরকার গঠনের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। ফলে দেশটিতে নজিরবিহীন ঝুলন্ত পার্লামেন্ট তৈরি হয়। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে সরকার গঠনের জন্য সমঝোতায় পৌঁছাতেও ব্যর্থ হয়। তাই মালয়েশিয়ার রাজা সুলতান আব্দুল্লাহ জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠনের জন্য কয়েকদিনের আলোচনা শেষে দেশটির বিরোধী নেতা আনোয়ার ইব্রাহিমকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করেন। মি. আনোয়ার প্রায় সিকি-শতাব্দী ধরে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য রাজনীতি করে আসছিলেন।

৫. কাতারে বিশ্বকাপ, পশ্চিমাদের বয়কট

তবে সব ইস্যু ছাপিয়ে গেছে কাতারের ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন। নভেম্বর-ডিসেম্বররে অনুষ্ঠিত হওয়া বিশ্বকাপের পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত তৈরী হয়েছে। উপসাগরীয় ও আরব অঞ্চলে ফুটবল বিশ্বকাপের মতো অনুষ্ঠান আয়োজনকে ইউরোপ স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। ফ্রান্সে ইসলামফোবিক একটি ম্যাগাজিনের একটি কার্টুনে কাতার জাতীয় ফুটবল দলকে সন্ত্রাস হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। পুরো বিশ্বকাপ জুড়েই কাতারের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণায় লিপ্ত হতে দেখা যায় পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোকে। মূলত কাতারে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি, নারী স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে দেশটির অবস্থান, ইসলামি শরীয়াহ আইন, সমকামিতার বিপক্ষ অবস্থান ও অভিবাসী শ্রমিকদের প্রতি দেশটির আচরণ বিষয়ে অভিযোগ তুলে তারা। বিবিসি, গার্ডিয়ানের মতো গণমাধ্যম প্রায়ই নানা ইস্যুতে কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের নেতিবাচক দিক তুলে ধরে। এমনকি কাতার বিশ্বকাপ বয়কটেরও ডাক দেয় তারা।

কিন্তু পশ্চিমাদের নেতিবাচক প্রচারণা এবং বয়কটের ডাক মাঠে মারা যায়। বিশ্বকাপের আয়োজন এবং ব্যবস্থাপনা নিয়ে সবাই সন্তুষ্টি প্রকাশ করে। পাশাপাশি কাতার বিশ্ব দরবারে প্রশংসিত হয়।

৬. বিশ্বকাপে ফিলিস্তিন

কাতার বিশ্বকাপে ফিলিস্তিন ইস্যুটি বেশ শক্তিশালী সমর্থন এবং স্বীকৃতি পেয়েছে। যার প্রমাণ স্টেডিয়ামে স্টেডিয়ামে ফিলিস্তিনের পক্ষে জয়ধ্বনি। প্রতিটি ম্যাচের প্রতিটি সেকেন্ড-মিনিটে লাখো-কোটি মানুষের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে একটি নাম, ‘ফিলিস্তিন! ফিলিস্তিন’। স্বাধীনতার সংগ্রাম, বর্ণবাদবিরোধিতা ও উপনিবেশবাদের নিগড় থেকে মুক্তির লড়াইয়ে একাকার যে ভূখণ্ডের নাম–তারই পতাকা জড়িয়ে বিশ্বকাপের গ্যালারিতে হাজির হয়েছেন ফুটবল ভক্ত-সমর্থকরা। ম্যাচ যে দেশেরই হোক, গ্যালারিতে ভালোভাবে চোখ রাখলেই নজরে পড়েছে ফিলিস্তিনের পতাকা, পতাকার রঙের আর্মব্যান্ড ও ব্রেসলেট। কান পাতলেই শোনা গেছে ‘ফিলিস্তিন মুক্ত করো’ ধবনি। শুধু স্টেডিয়ামেই নয়, কাতারের রাস্তায় রাস্তায় ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে শোনা গেছে ফিলিস্তিনেরই জয়ধ্বনি।

ফিলিস্তিনি সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড সার্ভে স্টাডিজের একটি জরিপের ফলাফলে বলা হয়েছে, এই বিশ্বকাপের পর আরব জনগণের প্রতি আস্থা ফিরে পেয়েছে ফিলিস্তিনিরা। ইজরাইলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিক করার মিছিল দেখে হতাশ হয়েছিল তারা। ৬৬ শতাংশ ফিলিস্তিনি এখন মনে করেন, তাদের আশা পুনরুদ্ধার হয়েছে। ২১ শতাংশ শতাংশ ফিলিস্তিনি মনে করেন, তাদের আশা কিছুটা পুনরুদ্ধার হয়েছে। জরিপের আয়োজকরা বলেছেন, কাতারে ফিফা বিশ্বকাপের ম্যাচগুলোতে ফিলিস্তিনের ব্যাপক সমর্থনে ফিলিস্তিনি জনগণ মনে করছে, তারা ন্যায়বিচার পাবে। তারা একা নয়। তারা সমস্ত সম্ভাব্য উপায়ে দখলদারিত্বের অবসান চায়। এটা তাদের অধিকার।

৭. তালেবানের নারীশিক্ষা

নভিম্বরে আফগানিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের নিষিদ্ধ করেছে তালেবান। তালেবানের উচ্চ শিক্ষামন্ত্রীর একটি চিঠিতে এ নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। খবর বিবিসির। চিঠিতে বলা হয়েছে, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত আফগানিস্তানে নারীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকবে।

বিভিন্ন দেশ ইতিমধ্যেই আফগানিস্তানে নারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপের নিন্দা করেছে। তবে তালেবানের উচ্চশিক্ষাবিষয়ক মন্ত্রী নেদা মোহাম্মদ নাদিম বলেন, মেয়েরা পোশাকসংক্রান্ত নিয়মকানুন মেনে চলছিল না বলেই এ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। নেদা মোহাম্মদ নাদিম আরও বলেন, কিছু নারী শিক্ষার্থী এমন পোশাক পরছিল, যাতে মনে হতো যেন তারা কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের মতো কিছু বিষয় আছে, যা মেয়েদের পড়ানোর উপযুক্ত নয়।

৮. মিয়ানমারে গণহত্যায় ইজরাইলের সমর্থন, গোপন নথি

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের ইহুদীবাদি রাষ্ট্র ইসরাইলের আতাঁতের খবর পুরানো হলেও এ সংক্রান্ত নিশ্চিত কোনো ডাটা এতদিন পাওয়া যায়নি। কিন্তু চলতি বছর সেপ্টেম্বরে এই গভীর সম্পর্কের প্রায় ২৫ হাজার গুরুত্বপূর্ণ নথি প্রকাশ করেছে ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

নথিতে বলা হয়, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দুর্নীতি সত্ত্বেও রাজনৈতিক সমর্থনের বিনিময়ে অস্ত্র বিক্রির গোপন চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল ইসরায়েল। ইসরায়েলের প্রতিটি সরকার মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। মিয়ানমার মানবতাবিরোধী অপরাধে এই অস্ত্র ব্যবহার করছে জেনেও তারা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে এবং তাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করেছে। ইসরায়েল এ ব্যাপারে কোনো খবরই রাখেনি, বার্মিজ সেনাবাহিনীর জন্য অস্ত্র সরবরাহ, সমর্থন এবং সামরিক প্রশিক্ষণ দেশটিকে কোনও বাহ্যিক হুমকি থেকে রক্ষা করার জন্য ছিল না। বরং অস্ত্র, অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণ খোদ মিয়ানমারের জনগণের বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হচ্ছে। সেই সময় কোনো ইসরাইলি প্রতিনিধি মিয়ানমারের কাছে অস্ত্র বিক্রি বিষয়ে কোনো আপত্তি জানায়নি।

২০১৭ সালে রোহিঙ্গা জনগণের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও ইসরায়েল মিয়ানমারের সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে। , ২০১৯ সালের নভেম্বরে নির্যাতিত রোহিঙ্গা জনগণের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর অভিযোগে হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মামলা হয়েছিল সেখানে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জন্য ‘শুভকামনা’ জানিয়েছিলেন মিয়ানমারে ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত রনেন গিলর। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, মিয়ানমার সেনাবাহিনী এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশটির নিয়ন্ত্রণ দখল করে। জাতিসংঘের অনুমান অনুসারে, এখন পর্যন্ত ১৪ হাজার স্থানীয় বাসিন্দাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সেই সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে ২ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। তবে ইসরাইলি সরকার এই অভ্যুত্থান ও নৃশংসতার নিন্দা করতে অস্বীকার করেছে।

৯. ভারতীয় মাদরাসাগুলোতে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে মাধ্যমিক

শিক্ষার্থীদেরকে এসএসসি লেভেল পর্যন্ত জেনারেল সিলেবাস পাঠদান এবং এসএসসি লেভেলের পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সার্টিফিকেট নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসা। ১৮ আগস্ট দেওবন্দের এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে পাশাপাশি অন্যান্য মাদ্রাসাগুলোকেও বিষয়টি আমলে নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। দেওবন্দের এই সিদ্ধান্তের পর তুমুল আলোচনা শুরু হয়েছে বাংলাদেশেও।

বাংলাদেশের উম্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ভারতের একটি প্রতিষ্ঠানের নাম ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ওপেন স্কুলিং (এনআইওএস)। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই মূলত মাদ্রাসাগুলো এসএসসি লেভেলের পরীক্ষায় অংশ নেবে। ইতিমধ্যেই এনআইওএসের সঙ্গে একটি সমঝোতাও হয়ে গেছে। এই প্রকল্পের পেছনে রয়েছে ভারতের মুসলিমদের সবচেয়ে বড় প্লাটফর্ম জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের আরও কয়েকটি শিক্ষাপ্রকল্প রয়েছে। এটি সর্বশেষ সংযোজন। এই প্রকল্পের নাম ‘জমিয়ত ওপেন স্কুল’।

এর আগে ২২ অক্টোবর ২০২০ অনুষ্ঠিত জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের মজলিসে আমেলার সিদ্ধান্ত মতে—২৫ নভেম্বর ২০২০ এনআইওএস-এর অধীনে মাদ্রাসা-শিক্ষার্থীদের এসএসসি লেভেল পর্যন্ত শিক্ষা দেওয়া বিষয়ক পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় এনআইওএস-এর অধীনে মাদ্রাসা-শিক্ষার্থীদের এসএসসি লেভেল পর্যন্ত পড়ানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

১০. আসামে এবার কওমি মাদরাসা বন্ধ

উত্তর-পূর্ব ভারতের আসাম রাজ্যের সরকারি আলিয়া মাদরাসা বন্ধের পর এবার কওমি মাদরাসা বন্ধের তোড়জোড় শুরু করেছে বিজেপি সরকার। শুধু আগস্টেই তিনটি মাদরাসা বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দিয়েছে প্রশাসন। মাদরাসার ছাত্রদের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে কিংবা কোনো স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি গ্রেফতার করা হচ্ছে ইমাম ও শিক্ষকদের।

এর আগে ২০২০ সালে মাদরাসা শিক্ষা আইন পরিবর্তন করে রাজ্য সরকারের অনুদানপ্রাপ্ত মাদরাসাগুলোকে সাধারণ স্কুলে পরিণত করে আসাম সরকার। সে সময় আসামের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন হিমন্ত বিশ্বশর্মা। এরপর ২০২১ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে মুখ্যমন্ত্রী হন তিনি। এর এক বছর পরেই ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই আইনের বৈধতার স্বীকৃতি দেন গুয়াহাটি হাইকোর্ট। মুসলমান সমাজের একটা অংশ ও বিরোধীরা এই আইন এবং রায়ের বিরোধিতা করলেও তাতে কোনো লাভ হয়নি। ফলে আসামে সরকারি মাদরাসা স্তরে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়।

আগস্টে পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল ভাস্কর জ্যোতি মোহন্ত ও গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্বে থাকা হীরেন নাথ কওমি মাদরাসা বোর্ড অল আসাম তনজিম কওমি মাদরাসার সচিব মাওলানা আবদুল কাদিরের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে সব কওমি মাদরাসার তালিকা চাওয়া হয়। পাশাপাশি ইমাম-শিক্ষক নিয়োগে পুলিশ ভেরিফিকেশন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে আসামে। বাইরের রাজ্য থেকে কোনো ইমাম বা মাদরাসার শিক্ষক আসামে এলে তাকে আগে পরীক্ষা করবে পুলিশ। তারপর তাকে নিয়োগ দেয়া হবে।

১১. আল-কায়েদার শীর্ষ নেতা জাওয়াহিরির শাহাদাত

আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র হামলায় আল-কায়েদার শীর্ষ নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরি নিহত হওয়ার ঘটনাটি ছিল একটি বিস্ফারিত ইস্যু। পয়লা আগস্ট টেলিভিশনে দেওয়া এক বক্তব্যে জাওয়াহিরির মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন কর্মকর্তার বরাতে বলা গণমাধ্যমে বলা হয়, হামলার সময় আল–কায়েদার এই নেতা কাবুলে একটি বাড়ির ব্যালকনিতে অবস্থান করছিলেন। এ সময় ড্রোন থেকে তাকে লক্ষ্য করে দুটি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়। এতে জাওয়াহিরির মৃত্যু হয়। ওই বাড়িতে তার পরিবারের অন্য সদস্যরাও ছিলেন। তবে হামলায় তাদের কোনো ক্ষতি হয়নি।

আল জাজিরা জানিয়েছে, তাদের কাছে কিছু ছবি এসেছে। ছবিতে আল-কায়েদা নেতা যেখানে লুকিয়ে ছিলেন সেখান থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখা গেছে। আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে মার্কিন দূতাবাসের কাছে কূটনৈতিক জেলার একটি বাড়ি লক্ষ্য করে এ অভিযান চালানো হয়।

১২. ইমরান খানের পরাজয়

এ বছরের এপ্রিলে পাকিস্তান পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে হেরে ক্ষমতা হারিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। এতে দেশটিতে কোনো প্রধানমন্ত্রীই পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। ইমরান খান অবশ্য ক্ষমতা হারিয়ে চুপ থাকেননি। তিনি উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ইসলামাবাদে ধারাবাহিক প্রতিবাদ মিছিলে নেতৃত্ব দেন। আগস্টে তার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সন্ত্রাসবিরোধী আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ আনে সরকার। নভেম্বরে তাকে হত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং তিনি আহত হন। এ হামলার জন্য শরীফ ও জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের দায়ী করেন এবং দেশে আগাম নির্বাচনের দাবি জানান ইমরান খান।

১৩. ইরানে হিজাববিরোধী বিক্ষোভ

১৬ সেপ্টেম্বর পুলিশ হেফাজতে কুর্দি তরুণী মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর থেকেই হিজাব-বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল হয়ে আছে ইরান। এ আন্দোলনে এখন পর্যন্ত ৩০০-এর বেশি বিক্ষোভকারীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা। তবে আন্দোলনে ২০০ জন বিক্ষোভকারীর মৃত্যু হয়েছে বলে শনিবার (৩ ডিসেম্বর) জানিয়েছে দেশটির সরকার।

যেই নৈতিকতা পুলিশ নিয়ে ইরানে বিতর্ক, দেশটিতে তাদের বলা হয় গাশত-ই এরশাদ (গাইডেন্স পেট্রল)। এটি পুলিশেরই একটি বিশেষ ইউনিট, যাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ইসলামিক নৈতিকতার সম্মান নিশ্চিত করার এবং পোশাকবিধি অনুসরণ না করা ব্যক্তিদের আটক করার। ২০০৫ সালে পুলিশের এই বিশেষায়িত বাহিনী প্রতিষ্ঠা করা হয়। শরিয়ার ব্যাখ্যার ভিত্তিতে তৈরি করা আইনের অধীনে একজন নারীকে তাদের চুল ঢেকে (হিজাব বা মাথার স্কার্ফ দিয়ে) রাখতে হয় এবং লম্বা ও ঢিলেঢালা পোশাক পরতে হয়। আর তারই বাস্তবায়নের দায়িত্ব বর্তায় নৈতিকতা পুলিশের ওপর। ১৩ সেপ্টেম্বর তেহরানের নৈতিকতা পুলিশ যখন তাকে গ্রেপ্তার করেছিল তখন আমিনির মাথার স্কার্ফের নিচে কিছু চুল দৃশ্যমান ছিল। পরে তাকে আটক করা হলে সেখান থেকে তাকে হাসপাতালে নেয়া হলে ৩ দিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় থাকার পর তিনি মারা যান।

মাহশা মারা যাবার পর বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতো। বিক্ষোভে সংহতি জানায় বিভিন্ন দেশের নারীরা। চলচ্চিত্র অভিনেত্রীসহ তারকা সংগীতশিল্পীরাও নিজেদের চুল কেটে ইরানি নারীদের সমর্থন জানান। এমনকি এই তালিকায় যুক্ত হন ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সদস্য আবির আল-সাহলানিও। ফলে ইরানে হিজাব এখন ধর্মীয় প্রতীক নয় কেবল, রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রতীক হিসেবেও বরিত হচ্ছে।

The post বাইশের মুসলিম বিশ্ব: আলোচিত যত ঘটনা appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%87%e0%a6%b6%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%b8%e0%a6%b2%e0%a6%bf%e0%a6%ae-%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%b6%e0%a7%8d%e0%a6%ac-%e0%a6%86%e0%a6%b2%e0%a7%8b%e0%a6%9a/

No comments:

Post a Comment