আব্দুর রহমান রাফি :
১.
মহান কবি ও দার্শনিক আল্লামা ইকবালের জন্ম হয়েছিল ১৮৭৭ সালে, যখন অটোম্যান সাম্রাজ্য এবং রুশ জোটের মধ্যে একটা ঘোরতর যুদ্ধ চলছিল। এবং সে যুদ্ধে তুর্কি পক্ষ পর্যুদস্ত হয়। ইসলামী খেলাফতের এমন ক্রান্তিলগ্নেই পৃথিবীর আলো আর অন্ধকারে চোখ মেলেন ইকবাল।
সমগ্র মুসলিম জাতি তখন ইসলাম প্রদত্ত নিজস্ব স্বকীয়তাকে হারিয়ে বসেছিল। তারা ভুলে গিয়েছিল ‘আমি কে?—ফলে মুসলিমরা প্রতিটি ক্ষেত্রেই করুণভাবে হেরে যেতে থাকে। কালো মেঘের মত তাদের মাথার ওপর নেমে আসে হতাশা। ধীরে ধীরে তারা শাসক থেকে শাসিত আর শোষিতের স্তরে নেমে আসে।
ঠিক তখনই ইকবাল মুক্তির এক মহামন্ত্র নিয়ে এগিয়ে আসেন মুসলমানদের সামনে, তাদের হতাশা আর আশাহীনতার সম্মুখে। তার সৃষ্টিকর্মের অন্তর্গত বাণী হতাশাপীড়িত, ব্যথিত মানুষের জীবনে এক নতুন অর্থ ও তাৎপর্য তৈরি করে। ধুলায় পতিত মানুষদের হাত ধরে তিনি তাদেরকে তুলে আনেন নীলিমার কাছাকাছি; হলুদ বিবর্ণ চোখে এঁকে দেন সামুদ্রিক স্বপ্ন। জীবনের জরাগ্রস্ত কোলাহল এবং পঙ্কিলতার মিছিলের ঊর্ধ্বে মৃত্যুঞ্জয় এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখান তাদেরকে মহাকবি ইকবাল।
এই মহান মানুষটিকে নিয়ে, তার কর্ম নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে। এখনো ইকবালের কর্ম নিয়ে আমাদের মাঝে আগ্রহ ও কৌতূহল লক্ষ্য করা যায়। ইকবালকে আমরা আমাদের মত করে দেখার ও বোঝার চেষ্টা করি। কিন্তু এ কৌতূহল ও আগ্রহ আমাদেরকালেই সীমাবদ্ধ নয়, অতীতেও এর চল চালু ছিল। যখন বাংলা ভাষায় বর্তমানের মত এমন শোরগোল করে ইসলামের চর্চা হচ্ছিল না, যখন ক্ষুদ্র পরিসরে, অপরিসর বৃত্তে ইসলামকে নিয়ে ভাবা এবং লেখা হতো— তখনকার মানুষেরা ইকবালকে কিভাবে দেখতো, কালের ধূসর পৃষ্ঠা উল্টে তাদের খোদিত রক্তিম অক্ষরগুলো থেকে তাদের ইকবালকেই আমরা আজ দেখার চেষ্টা করব।
২.
কবি গোলাম মোস্তফার দৃষ্টিতে ইকবাল
গোলাম মোস্তফা (জন্ম: ১৮৯৭ – মৃত্যু: ১৩ অক্টোবর ১৯৬৪) একজন বাঙালি লেখক এবং কবি। তার কাব্যের মূল বিষয় ছিল ইসলাম ও প্রেম।
গোলাম মোস্তফা ইকবাল সম্পর্কে বলেন, ‘কবি ও দার্শনিকের এমন অপূর্ব সমন্বয় বড় একটা দেখা যায় না। দার্শনিক তত্ত্বের অভিনবত্ব ও নূতন দৃষ্টির জন্য তাহার(ইকবালের) কবিতা যেমন সম্পদশালিনী, অনুভূতি, আবেগ ও কাব্যরসের দিক দিয়াও তাহা তেমনি মর্মস্পর্শী, পেলব ও সুন্দর। মুসলিমের এ জাতীয় অধঃপতনের দিনে তিনি তাহাদের সুপ্ত প্রাণে যে বিপুল স্পন্দন জাগাইয়া তুলিয়াছেন, মরণ অন্ধকারে যে জীবনের সন্ধান দিয়াছেন,চক্ষে যে সত্য দৃষ্টি দান করিয়াছেন, তাহা চিন্তা করিতে গেলে ইকবালকে সত্যই “mussiah” বলিয়া আমাদের মনে হয়।…
ইকবাল সত্য- সত্যই আমাদের জন্য এক ‘জ্যোতির্ময় বাণী’ বহন করিয়া আনিয়াছেন। সে বাণীর চুম্বক হইতেছে-“back to the Quran” -অর্থাৎ কোরআনের দিকে প্রত্যাবর্তন। কুরআনকে অবলম্বন না করিলে আমাদের মুক্তি নাই, ইহাই তাহার দৃঢ় বিশ্বাস।…
হাফিজের মধ্যে একটা অলস করুণ তান আছে। সেখানে শুধুই বিরহের ক্রন্দন আর মিলনের ব্যাকুলতা। জীবনের উদ্দাম গতিভঙ্গি ও অশ্রান্ত চঞ্চলতা তাহার মধ্যে নাই। নিজেকে নিঃশেষে বিলাইয়া দিবার জন্যই তিনি ব্যাকুল। ইকবাল কিন্তু এই সুফি ভাবকে জীবনের আদর্শ বলিয়া গ্রহণ করেন নাই। তিনি মাওলানা রুমির আদর্শে অনুপ্রাণিত। জীবনকে তিনি গঠন করিয়া উপভোগ করিবার পক্ষপাতী, মৃত্যু অপেক্ষা জীবনকেই তিনি মূল্যবান মনে করেন।…
ইকবাল জীবনের কবি। জীবনের শতদলের পরিপূর্ণ বিকশিত মূর্তিই তিনি দেখিতে চান। কিন্তু তাই বলিয়া তিনি জড়জীবনের গান গাহেন নাই। সুফি মতবাদ জড়জীবনের দিকে মানুষকে অন্ধ করিয়া রাখিয়াছে— অন্যদিকে পাশ্চাত্য দর্শন বিজ্ঞান মানুষকে জড়বাদী করিয়া তুলিয়াছে। ইকবাল এই দুই ভিন্নমুখীর ভাবধারাকে অতি সুন্দরভাবে কাব্যরসের মধ্যে আনিয়া মিলাইয়া দিয়াছেন। তাহার মধ্যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিলন ঘটিয়াছে। সেই মিলনের সেই সমন্বয়ের বাণী এতই কবিত্বপূর্ণ যে, তাহা মস্তকে পৌঁছিবার পূর্বেই হৃদয় জয় করিয়া লয়।…
ইকবালের বাণী সত্য সত্যই আশার বাণী। সে বাণী শ্রবণ করিলে অসাড় প্রাণেও পুলক কম্পন লাগে। হতাশ জীবনে বাঁচিবার সাধ জাগে। জীবনের এমন অব্যর্থ সন্ধান আর কোন কবিই আমাদিগকে দিতে পারেন নাই।…
কবি নিছক আনন্দবাদীও নন। ”খাও দাও,ফুর্তি করো”- এই অর্থে তিনি জীবনকে ব্যাখ্যা করেন নাই। জীবনের একটা উদ্দেশ্য আছে, সেই উদ্দেশ্য সিদ্ধ করিবার জন্যই তিনি জীবনকে চান। সে জীবন পরিপূর্ণ সুন্দর ও সতেজ। সাহিত্য, আর্ট, বিজ্ঞান প্রভৃতি মানবের যাবতীয় ক্রিয়া-কলাপ এই জীবন বিকাশের জন্যই নিয়োজিত হওয়া উচিত।…
ব্যক্তিত্ব শক্তি ও বিকাশের উপরেই আমাদের ব্যক্তিগত ও জাতীয় উন্নতি নির্ভর করে। ব্যক্তিত্বকে সবল করিয়া তুলিতে হইবে, তাহা হইলে আমরা জগতে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করিতে পারিব।’ (প্রবন্ধ-ইকবালের বাণী)
ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর দৃষ্টিতে ইকবাল
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১০ জুলাই ১৮৮৫ – ১৩ জুলাই ১৯৬৯) ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের একজন স্মরণীয় বাঙালি ব্যক্তিত্ব,বহুভাষাবিদ,বিশিষ্ট শিক্ষক ও তাত্ত্বিক। তিনি আল্লামা ইকবাল সম্পর্কে বলেন,
‘গতিবাদ ইসলামের শিক্ষা। আল্লামা ইকবাল এই গতিবাদের কবি। পাশ্চাত্য মনীষীদের গতিবাদ হইতে ইকবালের গতিবাদের পার্থক্য আছে। তাহাদের গতিবাদ নাস্তিক্যবাদের সহিত জড়িত। ইকবালের গতিবাদ ইসলামের শিক্ষাসম্মত।…
ইকবালের দর্শনের প্রচারিত হইয়াছে মানুষের খুদী। খুদীর অর্থ ব্যক্তিত্ব। কোরআন শরীফের শিক্ষা মানুষ-“মাসজূদুদ মালাইক”(স্বর্গীয় দূতগণের নমস্য) এবং পৃথিবীতে খলীফাতুল্লাহ (আল্লাহর প্রতিনিধি)। এইজন্য মানুষ “আশরাফুল মাখলুকাত” বা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ। ইকবাল আন-ভোলা মানুষকে তাহার খুদীর মহত্ব ও মাহাত্ম্য স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন।…
ব্যক্তিত্বকে তিনি খুদী বলিয়াছেন। বাস্তবিক আসরারে খুদী ব্যক্তিত্বের তত্ত্বই বটে, ইহাতে তিনি সুফিদিগের নিষ্ক্রিয়বাদকে কঠোরভাবে আক্রমণ করিয়াছেন। আসরারে খুদীতে কবি পূর্ণ মনুষ্যের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি হযরত মুহাম্মদকে (দ) পূর্ণ মনুষ্যের আদর্শরূপে গ্রহণ করিয়াছেন।” (প্রবন্ধ-ইকবালের জীবন দর্শন)
প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁর দৃষ্টিতে ইকবাল
ইবরাহীম খাঁ (ফেব্রুয়ারি ১৮৯৪ – ২৯ মার্চ ১৯৭৮) ছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক। তিনি ইকবাল সম্পর্কে বলেন, ‘…. ক্রমে ইকবালের সঙ্গে আত্মীয় পরিচয় হতে লাগলো। তার শেকওয়া ও জওয়াবে শিকওয়া আমাদের মনের দুয়ারে দারুণ আঘাত হানলো। মুসলমানের মনের দিগন্তে আশার আলো চিকমিক করে জ্বলে উঠলো। তিনি বলে যেতে লাগলেন,’আছে আমাদের সব আছে, শুধু চাই একজন নেতা!’…
ইকবাল আমাদের সৌন্দর্যের কবি যত বড়, শক্তির কবি তার চেয়ে অনেক বড়।…
ইকবাল এর আগে বা তার সময়ে ভূ ভারতে হিন্দু মুসলমান কোন কবিই এমন প্রাণী ভাষায় মানুষের শক্তির উদ্বোধন করেন নাই। কেবল কথা বলে বলে ইকবালের মন তৃপ্তি লাভ করল না। তিনি ভারতের মুসলমানের জন্য কার্যত কী করা যায়, ভাবতে লাগলেন। এমন সময় লন্ডনের গোলটেবিল বৈঠকে লন্ডনে অধ্যায়নরত পাঞ্জাবের ছাত্র চৌধুরী রহমতউল্লাহ পাকিস্তানের প্রস্তাব পেশ করলেন। গোলটেবিল বৈঠকের বিজ্ঞ সভ্যরা মুচকি হেসে চৌধুরী রহমতউল্লাহকে বিদায় করলেন।
কিন্তু বীজ উপ্ত হয়ে গেল। কবি ইকবাল কথাটা ভাবতে লাগলেন। তিনি মুসলিম লীগের প্রকাশ্য সভায় “পাকিস্তান” দাবী করে বসলেন। তাদের প্রিয় কবি দার্শনিক এর কথা ভারতের মুসলমানদের ভাবিয়ে তুলল। কবির প্রাণের আগুন কর্মীর প্রাণে গিয়ে লাগলো। কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তান প্রস্তাবকে তার আজাদি জিহাদের ঝান্ডায় বড় বড় হরফে লিখে এগিয়ে চললেন। তাই আজ ইকবাল শুধু শক্তির কবি নন, তিনি স্বপ্নেরও কবি; আবার তিনি শুধু স্বপ্নের কবি নন, সাধনারও কবি।” (প্রবন্ধ-ইকবাল)
ফয়েজ আহমদের দৃষ্টিতে ইকবাল :
ফয়েজ আহমদ (২ মে ১৯২৮ – ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১২) ছিলেন বাংলাদেশের একজন সাংবাদিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি ইকবাল সম্পর্কে বলেন, ‘ইকবালের চিন্তাধারা, দর্শন, বাণী এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে অনেক রচনা ও বই-পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু যতদূর আমার জানা আছে, তার কবি প্রতিভা এবং কাব্য সৃষ্টির ঐন্দ্রজালিক শক্তি সম্পর্কে অতি অল্প বিশ্লেষণমূলক আলোচনা হয়েছে।…
আমাদের মধ্যকার তথাকথিত চিন্তাশীল ব্যক্তিরা কবি চরিত্রকে কতকটা অমর্যাদার চোখেই দেখেন এবং কবি বাণীকে গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করতে অনেকখানি অসম্মত বটে। কবিকে মর্যাদা দানের অবস্থা দেখা দিলে বরং তারা তাকে চিন্তাবিদ বা দার্শনিক বা প্রচারক বা নিদেনপক্ষে রাজনীতিকের পোশাক পরিয়ে দেন। কবি হিসেবে আমাদের কাছে কবির কোন বিশেষ স্বীকৃতি বা মর্যাদা নেই।…
যাহোক, আমি আজ এ মনোভাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে দাঁড়াইনি। আমি শুধু একথা বলতে চেয়েছি যে এভাবে বিচার করবার মধ্যে যা কিছু ভালো বা যা কিছু মন্দ থাকুক না কেন, ইকবালের মত প্রতিভাসম্পন্ন একজন কবিকে যে নামে পরিচিত দেয়া হোক না কেন, নিঃসন্দেহে তার মাহাত্ম্য তাতে খর্ব হবে না। আমি মনে করি, এ কথা বলতে আমাকে তেমন কোনো প্রতিবাদের সম্মুখীন হতে হবে না যে, ইকবালকে আপনারা দার্শনিক, চিন্তাবিদ, ধর্মীয় নেতা; প্রচারক যাই বলুন না কেন, তার বাণীকে যা প্রকৃতই শক্তিমান করে তুলেছে তা হলো তার কবিতা।…
আমি মনে করি, ইকবালের রচনার খাঁটি কাব্যিক দিকে দৃষ্টি দেয়াও আমাদের অবশ্য কর্তব্য।…
ইকবাল নিজেই “আর্ট ফর আর্ট সেক” মতবাদের চরম বিরোধী ছিলেন। অতএব আমরা তার আর্ট অথবা তার স্টাইল অথবা তার বিষয়বস্তু অথবা তার অন্যান্য কাব্যিক গুণকে তার বক্তব্য থেকে আলাদা করে বিচার করতে পারি না। কারণ যদিও তার স্টাইলে কাল প্রগতির লক্ষণ স্পষ্ট ছিল এবং বৈচিত্র্য যথেষ্ট ছিল, কিন্তু তবুও তার সব রকমের প্রকাশভঙ্গির লক্ষ্য ছিল তার ভাবের বাহন হিসেবে যথাযথ রূপ অর্জন। অতএব, স্টাইলের গতিধর্মিতা তার চিন্তার গতিধর্মিতারই সমান্তরালভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং একটিকে অন্যটি থেকে পৃথক করে দেখার অর্থ হবে ব্যাপারটাকে অগভীর এবং ভ্রান্ত দৃষ্টি দিয়ে দেখা।'(প্রবন্ধ-ইকবালের কবিতা)
ফয়েজ আহমদ ব্যাখ্যা করেছেন ইকবালের সমগ্র কাব্যজীবন এবং কবিতাকে। দেখিয়েছেন, কিভাবে একটু একটু করে ইকবালের কবিতার ভাষা পরিবর্তন হয়েছে, কেন হয়েছে। ইকবালের কবিতার উপমা, উৎপ্রেক্ষা আর ছন্দ নিয়ে তিনি বিস্তর কথা বলেছেন।
তিনি তার আলোচনার শেষপ্রান্তে গিয়ে বলেন, ‘সে (মানুষ) তার ক্ষুদ্র পরমাণু সাদৃশ্য ব্যক্তিত্ব নিয়ে সমগ্র বিশ্ব প্রকৃতির সাথে দ্বন্দ্বের সম্মুখীন। এখানে এই শত্রু পরিবৃত মানুষকে এমনভাবে মহত্ব অর্জন করতে হবে যাতে সে তারকারাজির, চন্দ্রের, সূর্যের, মহাবিশ্বের সম্মুখে তাদের সমকক্ষ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এহেন বৃহতের বীজকে তার ক্ষুদ্রের মধ্যে লালন করতে এবং বিকশিত করে তুলতে হবে। জীবনের শেষ দিকে এই মহত্ববোধই ইকবালের কবিকীর্তিকে অতুলনীয় মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছিল, সুন্দর মহীয়ান করে তুলে ধরেছিল।’
ফররুখ আহমদের দৃষ্টিতে ইকবাল :
ফররুখ আহমদ (জন্ম : জুন ১০, ১৯১৮ – মৃত্যু : অক্টোবর ১৯, ১৯৭৪) একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশী কবি। এই বাঙালি কবি ‘মুসলিম রেনেসাঁর কবি’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তিনি ইকবাল সম্পর্কে বলেন, ‘উনিশ শতকের প্রাচ্যের অগ্নিপুরুষ সৈয়দ জামালউদ্দিন আফগানি আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন মুসলিমপ্রধান দেশগুলিকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করতে। তার সে চেষ্টা সম্পূর্ণরূপে বিফল হয়নি। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত তিনি যে প্রাণ বন্যার সঞ্চার করেছিলেন, উনিশ শতকের শেষ দিকে তার দেহাবসানের পর ইকবাল এলেন তারই উত্তরাধিকারী হয়ে। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের দর্শনে সমান অভিজ্ঞ আল্লামা ইকবাল প্রচার করলেন মূল ইসলামের প্রাণবাণী।…
ইকবাল তার দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন আমিত্বের দিকে।…..মূল ইসলামী ভাবধারায় তিনি ব্যাখ্যা করলেন সত্তার রহস্য। কারণ, ইকবাল বিশ্বাস করতেন যে, ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশেই আদর্শ সমাজ গড়ে উঠতে পারে এবং এই পরিপূর্ণতার স্বাক্ষর প্রত্যেক মানুষের মধ্যে নিহিত আছে।…
‘আল্লাহর গুণরাজিতে সমৃদ্ধ হও’-এ হাদীসের উপর ইকবালের সম্পূর্ণ সত্তা পরিপূর্ণভাবে নির্ভর করছে বলা যেতে পারে। কারণ, উক্ত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই ইকবাল বুঝতে পেরেছিলেন যে, ক্ষুদ্রতম সত্ত্বার পক্ষেও কামালিয়াত পরিপূর্ণতা লাভ করা আদৌ অসম্ভব নয়। পরিপূর্ণতার পথে ইকবাল সর্বদা প্রবহমান জীবনের কল্পনা করেছেন। অবশ্য তার এই দৃষ্টিভঙ্গি বৈজ্ঞানিক সমর্থিত। প্রবহমান জীবনধারার সঙ্গে যখন সম্প্রসারণশীলতা সংযুক্ত হয়, তখনই মুক্ত হয় পূর্ণতার পথ।…
আত্মসংরক্ষণ অথবা আত্মার পরিপূর্ণতার জন্য মূল ইসলামের প্রয়োজনীয়তা তিনি ঘোষণা করেছেন। আজীবন তার কাব্যের বিশাল অংশ ইসলাম ও আত্মা সম্পর্কে মুখরিত, যে আত্মা ইসলামের বিধান মেনে ইশক বা প্রেমে সংরক্ষিত হয় সেই প্রেমিক মুসলমানের মধ্যে ইকবাল দেখেছেন ইনসানে কামেল বা পূর্ণ মানবের প্রতিশ্রুতি। “(প্রবন্ধ-ইকবাল প্রসঙ্গ)
অমিয় চক্রবর্তীর দৃষ্টিতে ইকবাল
অমিয় চক্রবর্তী (জন্ম: এপ্রিল ১০, ১৯০১ – মৃত্যু: জুন ১২, ১৯৮৬) বাঙালি সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ইকবাল সম্পর্কে বলেন, ‘যৌবন শেষ পর্যন্ত ইকবালের গীতিকাব্যে এই একটা মূল ধুয়ো, তার কল্পনার প্রসঙ্গ কত সহজ, মাটির কত কাছাকাছি, অথচ সূক্ষ্ম ভাবনায় শিল্পিত; নির্বিশেষে গ্রহণ করেছেন বিভিন্ন প্রাদেশিক স্বদেশীয়কে। কবিতার পাত্রটি গড়েছিলেন ভারতীয় ধাতু দিয়ে, তাতে বসল ইস্পাহানি নীলা, ভাষার মিশ্রিত কত রং মুসলিম আরবীয় উজ্জ্বল চিন্তার মণি। কাব্যের শাশ্বতকে তিনি কোনদিনই ভোলেননি, বড় করেছেন প্রেরণার দৈবকে; জানতেন সংকীর্ণ স্বার্থের সাধনার প্রকাশ নেই।…
পরবর্তীতে তার কাব্য চিত্তের সংঘর্ষ বিদ্যুতাভ হয়ে দেখা দিয়েছিল, শাণিত কাব্যের আঙ্গিকে মাধুর্যের চেয়ে কঠিন উজ্জ্বল্য চোখে পড়ে।…
আশ্চর্য প্রাঞ্জল তার একটিমাত্র গদ্যগ্রন্থ The Reconstruction of Religious Thought in Islam – এ শক্তিসাধক কবির পরিণত চিন্তাধারার পরিচয় পাওয়া যায়। তাতে কোরআন শরীফ এবং ইসলামী বিজ্ঞান দর্শনের প্রগাঢ় সুন্দর আলোচনা আছে, তরজমাগুলোও চমকপ্রদ। মোটের উপর তার কাব্যের দ্বিতীয় অধ্যায়, যা বিস্তৃত হয়েছিল জীবনের শেষ পর্যন্ত তার দার্শনিক এবং সামাজিক চিন্তাকেই প্রকাশ করেছে। তারমধ্যে গীতিকাব্যের লাবণ্যের চেয়ে জ্বলন্ত মতামতের পরিচয় সুস্পষ্ট।…
তার চিত্তের পরিচয় স্পষ্টতর দেখতে পাই ইসলাম সম্বন্ধে তাঁর আদর্শিক ছবিতে, যে আদর্শ পৃথিবীকে নূতন করে মৈত্রী এবং মুক্তির বিশেষ সন্ধান দেবে।…
ইকবালের মন দূরে সরে গিয়েছিল পশ্চিম থেকে। কিন্তু অন্তরের জ্বালা কোনদিন নেভেনি। পূর্বদেশিকে বারে বারে বলেছেন, সাবধান, নিয়তপ্রসারী বিশ্বভুক সভ্যতার দ্রষ্টা হতে এখনো নিজেকে বাঁচাও; লজ্জা দিয়ে, ভয় দেখিয়ে, আঘাত করে, যেমন করেই হোক তিনি শক্তি ফিরিয়ে দেবেন শক্তিহীনদের।…
মুসলিম ঐতিহ্যের স্মরণে স্বপ্নে, ভবিষ্যতের ছবিতে ইকবালের মন স্তরে স্তরে অভিষিক্ত ছিল। উপমায় অনুশাসনে কল্পনায় তিনি তার একান্ত পরিচিত অন্তরকে, সভ্যতাকে তার কাব্যে উদ্ভাসিত করেছেন। তিনি বলতেন,”ক্ষেত্র নির্দিষ্ট হোক, তারই গভীরে কবির চৈতন্য প্রবিষ্ট হলে বিশ্বাশ্রিত সত্যকে স্পর্শ করা যায়।…
…. ইকবালের কাব্যের স্বরূপ দেখতে হবে। স্বধর্মের উপলব্ধিকে যেখানে তিনি তর্কের অতীত সৌন্দর্যে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সেইখানে তার কাব্যের উৎকর্ষ, সেখানে তা বিশেষ কোন উদ্দেশ্যকে কোথায় ছাড়িয়ে গেছে।…
কাব্য জীবনের শেষ পর্যায়ে ইকবালের মানবধর্ম হাস্যোজ্জ্বল নির্ভয়বাদিতার প্রমাণ দিয়েছিল। দৈবাৎ যদি আধুনিক কোন কবি ইকবালের ‘ইবলিস কি মজলিস- ই শোরা’ কবিতাটির সন্ধান পান তাহলে নূতন ইকবালের আবির্ভাবে বিস্মিত হবেন।….কবিতাটিতে ছন্দবদ্ধ কথোপকথনের ছলে বর্তমান যুগের ধনতন্ত্র জাতীয়তাবাদ ধার্মিক উগ্রতা প্রভৃতি বিপদগুলোর সূক্ষ্ম আলোচনা আছে, সবার উপরে উড্ডীন নূতনজাগ্রত মানবধর্মের নিশান। মুখ্যত ইসলাম ধর্ম সমাজকে লক্ষ্য করে কবিতা গঠিত, কিন্তু এই কাব্যের তাৎপর্য সকলেরই অবাধ গ্রহণীয় শ্রেষ্ঠতায় একটি প্রতীকরূপে যে লোভহীন, আদর্শিক ত্যাগভূষিত ইসলামের সগর্ব ধর্ম প্রেমশীলতার বাণী এই গভীর লীলাকৌতুকী কাব্যে প্রকাশিত হয়েছে তা যথার্থই অভিনব।…
মানবত্বের ডাক দিয়ে তিনি গেছেন সম্মুখের পথে। মুসলমান ধর্মের উৎকর্ষ ব্যাখ্যাতা তিনি। তার যে কাব্যে মানব মিলনের পারম্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্প্রীতি ভাষার মহিমায় হৃদয়শীল সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত হয়ে প্রকাশ পেল সেই সৃষ্টিগুলো বাংলা ভাষায় পরিচিত হবে এই আশা করে রইলাম।'(প্রবন্ধ-কবি ইকবাল)
দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের দৃষ্টিতে ইকবাল
দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ (২৫ অক্টোবর ১৯০৬ – ১ নভেম্বর ১৯৯৯) ছিলেন বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ, দার্শনিক., সাহিত্যিক ও সমালোচক। তিনি ইকবাল সম্পর্কে বলেন, ‘মহাকবি ইকবালের কাব্য পাঠে সর্বপ্রথমেই ভেসে উঠে তার অতি জোরালো প্রত্যয়শীলতা। সে প্রত্যয়শীলতা প্রথমদিকে আধুনিক ভাবধারা দ্বারা বিকশিত হয়েছে এবং বিকাশের ধারায় পরবর্তীকালে ধর্মীয় ধারণার দ্বারা পুষ্ট হয়ে পরিণতির দিকে অগ্রসর হয়েছে। প্রথমদিকে তার ভাব প্রকাশের বাহন হিসাবে তিনি বিজাতীয় ধারণা বা সংস্কৃতিকে গ্রহণ করলেও পরবর্তীকালে তিনি সম্পূর্ণ ইসলামী সংস্কৃতির ধারণার মাধ্যমে তার পরিণত বয়সের চিন্তার ফল প্রকাশ করেছেন। অবশ্য উভয় পর্যায়েই তিনি আধুনিক চিন্তাধারার সমালোচনা করে তার জীবন দর্শন প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন।…
ইকবালের জন্ম ইংরেজ শাসনের চূড়ান্ত পর্যায়ে। এদেশবাসীকে ইংরেজরা কি অমানুষিকভাবে শাসন ও শোষণ করছে তা তিনি মর্মে মর্মে অনুভব করেছিলেন। কাজেই স্বদেশপ্রেমের প্রাথমিক পর্যায়ের অনুপ্রেরণা তিনি লাভ করেছিলেন। বর্তমানকালে স্বদেশপ্রেমের যে বিষময় ফল এ দুনিয়ার সর্বত্র দেখা দিচ্ছে তাও তিনি পরিণত বয়সে উপলব্ধি করেছিলেন এবং সে পর্যায়ে তার কাব্যে যে বিদ্রোহ ঘোষিত হয়েছে তা বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে অনন্য।…
প্রকৃতপক্ষে ইকবালের কাব্য সাধনাকে অন্যান্য কবিদের কাব্য প্রচেষ্টার সাথে তুলনা করা যায় না। নিছক সৌন্দর্য সৃষ্টি বা সৌন্দর্য পূজা সাধনা তিনি করেননি। ‘শিল্পের জন্য শিল্প সৃষ্টি’ (art for art sake) করার চেষ্টা তিনি কোনোকালেই করেননি।…
তার কাব্যের গোড়াতেই রয়েছে এক তীব্র প্রতিবাদ। সে প্রতিবাদ সর্বপ্রথম দেখা দিয়েছে প্রচলিত সংস্কারের বিরুদ্ধে এবং ক্রমবিকাশের ধারা তা পূর্ণ পরিণতি লাভ করেছে মানব- জীবন সম্বন্ধে দীর্ঘকাল পোষিত নিরাশাবাদের বিরুদ্ধে। এ প্রতিবাদ বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে তিনি উচ্চারণ করেছেন তার নিজস্ব অভিমত প্রচার করার উদ্দেশ্যে এবং তাতে তিনি সফল হয়েছেন অপ্রত্যাশিতভাবে।…
এ দুনিয়ায় যারা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব কায়েম করতে চায়, আল্লাহর মহিমা প্রতিষ্ঠিত করতে চায় এবং নিজে ‘ইনসানে কামেল’ হয়ে আল্লাহর কাজের সহায়ক হতে চেষ্টা করে সে মানব-সমষ্টিই ছিল ইকবালের চোখে সত্যিকার মুমিন। এজন্যই তিনি সে আদর্শবাদী মানুষের আবাসস্থল বলে সারা দুনিয়া কে গ্রহণ করেছিলেন। ‘পাকিস্তান’ চাওয়ার মূলে ছিল আদর্শবাদী মানুষ গড়ে তোলার জন্য একটা পরীক্ষাগারের সৃষ্টি।…
তিনি মানবজীবন সম্বন্ধে যে আশার বাণী ঘোষণা করেছেন, অনাগত ভবিষ্যতে তার প্রেরণায় মানুষ উচ্চ থেকে উচ্চতর লোকে আরোহণে সমর্থ হবেই হবে।” (প্রবন্ধ- মহাকবি ইকবাল)
অধ্যাপক শাহেদ আলীর দৃষ্টিতে ইকবাল
অধ্যাপক শাহেদ আলী (১৯২৫ – ২০০১) বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবী। তিনি ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের একজন ভাষাসৈনিক। তিনি ইসলামী চিন্তাবিদ, সাংবাদিক, অনুবাদক, গবেষক হিসাবেও পরিচিত।
আল্লামা ইকবাল সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ইকবাল পাশ্চাত্যের সমালোচনা করেছেন, কিন্তু তার মধ্যে পাশ্চাত্যের প্রতি ঘৃণা নেই; তিনি কেবল তার ত্রুটিগুলোর প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন সংশোধনের প্রত্যাশায়। পক্ষান্তরে নির্জীব, উদ্যোগ ও ব্যক্তিত্বহীন নিজ সমাজকেই সমালোচনার কষাঘাতে রক্তাক্ত করেছেন, মোল্লা ও খানকা ব্যবসায়ী পলায়নবাদী সুফিদের অন্ধতা ও পরাজয়ী মনোভাব থেকে মুক্ত করার জন্য তীব্র ভাষায় তাদের আক্রমণ করেছেন।…
ইকবাল পাশ্চাত্যের জড়বাদ নিরীশ্বরবাদ ও অর্থগূঢ়তার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে পাশ্চাত্য সভ্যতাকে সংশোধন করতে চেয়েছেন। এসবের মানবতাবিনাশী সমূহ ক্ষতিকর পরিণাম সম্বন্ধে সজাগ করে দিয়ে ওদের অন্ধ অনুকরণ থেকে মুক্ত মুসলিম মিল্লাত ও প্রাচ্য জাতিসমূহকে স্বকীয় আদর্শের উপর নিজেদের সামগ্রিক জীবন গড়ে তোলার জন্য তাকিদ দিয়েছেন।…
খিলাফতের মত একটি সংস্থার মাধ্যমে ইকবাল একদিন বিশ্ব মুসলিমকে সংগঠিত করার স্বপ্ন দেখেছেন। কিন্তু উসমানীয় সাম্রাজ্যের বিলুপ্তির পর খিলাফতের যখন অবসান হলো, তুরস্ক নিজেকে ঘোষণা করল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্ররূপে এবং আরব জাতিগুলো কয়েকটি স্বাধীন, অর্ধ- স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে আবির্ভূত হলো তখন ইকবাল স্বাভাবিকভাবে তার চিন্তাধারার সংশোধন করে।…
ইকবাল তার নিসর্গ প্রেম, দেশপ্রীতি, সৌন্দর্যপ্রীতি ও বিশ্ব প্রেমের গভীর প্রাণস্পর্শী অনুভূতি প্রকাশ করেছেন প্রধানত কাব্যে, তার অনুকরণীয় ভাষা, ছন্দ ও গীতিময়তায়।…..
তার উপলব্ধির গভীরতা এতই অতলস্পর্শী যে, তার প্রভাবে তার ভাষায় হয়ে উঠেছে দেশ কালের গন্ডি অতিক্রম করে যাওয়া এক অনুপম কাব্যের নিদর্শন। তাতেই এ প্রমাণ মেলে যে, আন্তরিকতার গুনেই তার কবিতা তার দেশ ও জাতির হয়েও বিশ্বের সকল মানুষের কাব্য হয়ে উঠেছে।…..
ইকবাল সকল দেশের, সকল মানুষের, সকল কালের কবি। কারণ, ব্যক্তি ও সমাজ মানুষের পরমোৎকর্ষের শাশ্বত স্বপ্নই তার কাব্যের বাণী।” (প্রবন্ধ- আমাদের কালঃ ইকবালের প্রাসঙ্গিকতা)
শঙ্খ ঘোষের দৃষ্টিতে ইকবাল
শঙ্খ ঘোষ (৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩২ – ) একজন বিশিষ্ট ভারতীয় বাঙালি কবি ও সাহিত্য সমালোচক। তিনি একজন বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ। তিনি ইকবাল সম্পর্কে বলেন, ‘ইকবালের কাছে ধর্ম এসে পৌঁছায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াবারই একটা পদ্ধতি হিসেবে। এভাবে তিনি বললেন যে, ‘ফখর’ই হতে পারে যথার্থ সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তি, যে ফখরের মধ্যে মিলানো আছে জিকির আর ফিকির।…
ইকবালের চেতনার কেন্দ্র ছিল সাধারণ নিষ্পেষিত মানুষ, ইতিহাসের প্রবাহে সেই মানুষকে তিনি দেখতে চেয়েছিলেন অত্যুন্নত,মুক্ত আর সমতায়, এরই স্বপ্নাচ্ছন্নতায় তীব্র এক আবেগের ভাষায় তিনি লিখেছিলেন তার বিবৃতিপ্রধান কবিতাগুলো, এরই আবেগে তিনি ধিক্কারে বিদ্ধ করেছেন সেই সমস্তকেই- যা কিছু এর পরিপন্থী, সাম্যের বিপক্ষে যা কিছু এসে দাঁড়ায়।…
…… এই স্বপ্নে যিনি এসে পৌঁছেছিলেন একদিন, আজ তাকে আমাদের সম্পূর্ণভাবে লক্ষ্য করা দরকার আমাদের নিজেদেরই ইতিহাসকে পরিচ্ছন্ন করে তোলার জন্য, আমাদের নিজেদেরই স্বপ্ন চরিতার্থতার পথগুলোতে নির্মূল করার গরজে অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে ইকবালকে আমরা বুঝতে চাই আজ। (প্রবন্ধ- কেন ইকবাল?)
৩.
ইকবালের জীবনের সারসংক্ষেপ বা তার জীবনকে একদম ছোট করে বলতে গেলে এভাবে বলতে হবে যে, ইকবালের অনুভূতি ছিল কাব্যধর্মী, চিন্তাধারা ছিল দার্শনিক, আর মতবাদ ছিল সম্পূর্ণ ইসলামী আদর্শভিত্তিক। তার কাব্য ছিল তার দর্শন প্রকাশেরই যুৎসই মাধ্যম। আর তার দর্শন ছিল ‘খুদীবাদ’। এবং তার মতবাদ, তথা ইসলামের মধ্য দিয়েই খূদীবাদ এক অসামান্য জীবনের সন্ধান দেয় মানুষদের। সেই অসামান্য জীবন অনন্ত অসীম এক উচ্চতায় উন্নীত করে তাদেরকে।
ইকবালকে বহুজন বহুভাবে দেখেছেন, তাকে বিভিন্ন আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করেছেন। সেগুলো পড়লে আমাদের মনে ইকবালের জন্য বিশেষ একটা জায়গা তৈরি হয়। এক অনন্য মহত্ববোধ জাগ্রত হয় আমাদের ভেতর।
সেই মহত্ববোধ একটি পবিত্র আবেদন নিয়ে অবচেতনে আমাদের মননে ঘুরপাক খায়। আবেদনটি হলো, আমাদের জীবনে ইকবালের জীবন- দর্শনের সার্থক বাস্তবায়ন। খুদীবাদ। একজন মানুষ যখন ইসলামের সবুজ উদ্যানে থেকে নিজের ভিতরের ‘আমি’কে চিনতে পারে, এবং সে ‘আমি’র গভীরের নিভৃত লুকায়িত পরম ক্ষমতাকে উত্তরোত্তর প্রস্ফুটিত এবং বিকশিত করতে থাকে তখন সে আর ধুলির জগতের মানুষ থাকে না। নক্ষত্রের উচ্চতায় পৌঁছে যায়। মাটির মানুষ থেকে সোনার মানুষে রূপান্তরিত হয়। তাই আসুন আমরা নিজেদের ভেতরের ‘আমি’টা কে খুঁজে বার করতে চেষ্টা করি।এবং নিজেদেরকে ইনসান-ই- কামেল-রূপে গড়ে তোলার প্রয়াসে নিমগ্ন হই।
The post বাঙালি লেখকদের দৃষ্টিতে ইকবাল appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%99%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a6%bf-%e0%a6%b2%e0%a7%87%e0%a6%96%e0%a6%95%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%a6%e0%a7%83%e0%a6%b7%e0%a7%8d%e0%a6%9f%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a7%87/
No comments:
Post a Comment