Friday, May 1, 2020

আল্লামা ইকবালের কবিতায় নবীপ্রেম

রাকিবুল হাসান:

নবীজির প্রতি আল্লামা ইকবালের প্রেম ছিল প্রবাদতুল্য। তিনি মনে করতেন কুরআনের মগজ, ঈমানের আত্মা এবং ধর্মের প্রাণশক্তি হলো রাসূলকে ভালোবাসা। আল্লাহকে পেতে হলে রাসূলকে ভালোবাসতে হবেই। এইজন্য তিনি তার কবিতায় রাসূল প্রেমের এক অনন্য গীত গেয়ে গেছেন। তার কবিতার পঙক্তিতে পঙক্তিতে রাসূলপ্রেমের সুবাস, হুব্বে রাসূলের গুঞ্জরণ।

রাসূলের প্রতি ভালোবাসা এবং মদীনার প্রতি টান তার এতটাই প্রবল ছিল, যখনই মদীনার কথা আলোচিত হত, তার দু চোখ টলমল করে উঠত জলে। রাসূলকে নিয়ে লেখা তার কবিতাগুলো সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ মানে উত্তীর্ণ। রাসূলকে নিয়ে তিনি কবিতা লিখছেন, যেন মনে হচ্ছে তিনি কল্পনায় সফর করছেন মক্কা-মদীনায়। উথলে উঠেছে তার কবিতার ফল্গুধারা। রাসূলকে নিবেদন করে গেয়ে চলেছেন পঙক্তির পর পঙক্তি। এক নির্জীব হৃদয়ে প্রেমের তুমুল ঢেউ তুলে তিনি সফর করে চলছেন মদীনার অলিতে-গলিতে।

কল্পনায় তিনি পৌঁছে যান মদীনায়। রাসূলের রওজায় দাঁড়িয়ে নিবেদন করেন নিজের উচ্ছ্বাস ও ভালোবাসা। প্রিয় নবীর কাছে তুলে ধরেন সমস্ত মুসলিম উন্মাহ, বিশেষ করে হিন্দুস্তানের মুসলমানদের কথা। উম্মাহর স্বপ্ন-প্রত্যাশা, ব্যথা-বেদনার কথা তুলে ধরে বলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! দিন দিন মুসলিমরা একটু একটু করে তাদের ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলছে। হৃদয়ের আর্দ্রতা এবং ভালোবাসার শক্তিও কমে যাচ্ছে। তাদের হৃদয় এখন ভঙ্গুর, বেদনায় মলিন; কিন্তু তারা জানে না এর থেকে উত্তরণ। আপনি যে উচ্চতায় তাদেরকে তুলে দিয়ে গিয়েছিলেন, তারা সেখান থেকে পড়ে গেছে। যত উপর থেকে পড়ে, ব্যথা তত বেশি পাওয়া যায়।’

‘আপনার এই উম্মতগণ নিদারুণ সঙ্কটে এখন; নেতা নেই, পথ দোখানোর রাহবার নেই। যে কুরআনের শক্তিতে বিশ্ব জয় করেছিলেন আপনি, সে কুরআন তারা তুলে রেখেছে ঘরের তাকে। তেলাওয়াত না করতে করতে তাতে পড়েছে ধূলোর আস্তরণ, মাকড়সা এসে বাসা বাঁধছে। তারা ব্যস্ত বিলাসিতায়, গান-বাজনায়। তাদের চোখের জ্যোতি নষ্ট হয়ে গেছে। তাদের হৃদয় নিরানন্দ বিস্বাদে ছেয়ে গেছে।’

ধর্মহীনতার যে স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মুসলিম উম্মাহকে, তার কথাও তুলে ধরেছেন আল্লামা ইকবাল। ধর্মহীনতার কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন বস্তুতান্ত্রিকতা এবং হৃদয়হীনতা। আড়ম্বরপূর্ণ জীবন বিলাস মানুষকে বস্তুতান্ত্রিকতার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। আল্লামা ইকবাল রাহিমাহুল্লাহ মনে করেন, এই ধর্মহীনতার মোকাবেলায় একমাত্র হাতিয়ার রাসূলের ভালোবাসা এবং তাকওয়া। যে জীবন যাপন করে গেছেন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু, তেমন তাকওয়া ও ভালোবাসার জীবন যাপন করতে হবে আমাদের।

মুসলমানদের এই অধঃপতন ও পদস্খলনের জন্য দারিদ্র্য এবং জাগতিক বিষয়াবলীতে দুর্বলতাকে কারণ হিসেবে দেখেননি আল্লামা ইকবাল রাহিমাহুল্লাহ। বরং মুসলমানের হৃদয়ে জ্বলতে থাকা ঈমান ও ভালোবাসার প্রদীপ নিভে যাওয়াকেই কারণ হিসেবে দেখেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এই দরিদ্র মুসলিমরা যখন ভাবত, তারা কীভাবে আল্লাহর সামনে দাঁড়াবে, তখন তারা সাম্রাজ্যের হাল ধরতে পেরেছে। কিন্তু এই ভোগ বিলাসিতায় এই ভাবনার প্রদীপ যখন নিভে গেছে, সাম্রাজ্যের আসন থেকে তারা নেমে এসেছে কুঁড়েঘরে।’

তবে মুসলমানদের এত অধঃপতন সত্ত্বেও আল্লাম ইকবাল হতাশ কিংবা নিরাশ নন। ১৯১৮ সালে প্রকাশিত ‘রুমুজে বে-খুদী’র শেষদিকের পঙক্তিগুলোতে আশার কথাই ফুটে উঠেছে। তিনি প্রত্যাশা করেন—মুসলিমরা আবার নবীর প্রেরণামূলক নেতৃত্বের দিকে ফিরে আসবে। যে নবী তাদের জীবনের প্রদীপ প্রজ্বলিত করেছিলেন। মানুষের হৃদয়ে সত্যের চেতনা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। জনবল কম থাকা সত্ত্বেও পরাশক্তির সাথে লড়াই করেছিলেন। সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আল্লামা ইকবালের দৃষ্টিতে নবীজি অনুপ্রেরণা ও আদর্শের একমাত্র উৎস। এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমার বিশ্বাস—নবী এখনো বেঁচে আছেন। এ যুগের মানুষেরা তাঁর কাছ থেকেই অনুপ্রেরণা অর্জন করতে পারে। যেমন জাহেলি যুগে তাঁর থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছিলেন সাহাবিগণ।

জওয়াবে শেকওয়ার শেষ পঙক্তিতে লিখেছেন—’কী মুহাম্মাদ সে ওয়াফা তুনে, তো হাম তেরে হ্যায়/ইয়ে জাহা চিজ হ্যায় কেয়া? লওহে কলম তেরে হ্যায়।’ আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এই পঙক্তিটির অনুবাদ করেছেন—’আল্লাহকে যে পাইতে চায়/হযরতকে ভালোবেসে/আরশ-কুরসী লওহ-কলম/না চাহিতে পেয়েছে সে।’ আরেক পঙক্তিতে লিখেছেন—’মগজে কুরআন, রূহে ঈমান, জানে দ্বীন/হাসত হুব্বে রহমাতুল্লিল আলামীন।’

ব্যক্তি উন্নয়নের ক্ষেত্রেও রাসূল প্রেমের প্রভাবের কথা বলেছেন আল্লাম ইকবাল। ১৯১৫ সালে প্রকাশিত ‘আসরারে খুদীতে’ তিনি বলেন, ‘প্রেমের মাধ্যমেই আত্মা আরও জীবন্ত, আরও জ্বলন্ত, আরও ঝলমলে হয়।’ আরেক পঙক্তিতে বলেছেন, ‘মুসলমানের হৃদয় মুহাম্মদের বাড়ি/মুহাম্মদের নাম থেকেই আমার যথ গৌরব/আমরা একটি গোলাপের অনেকগুলো পাপড়ি/তিনি তার সৌরভ/তার ভালোবাসার গানে আমার শিরা উচ্ছ্বসিত/শতশত পঙক্তিতে ভরে যায় বুক।’

১৯২৩ প্রকাশিত পায়ামে মাশরিকে তিনি নবীজির প্রতি প্রেম সম্পর্কে বলেছেন, ‘যে মোস্তফার প্রেমকে লালন করে/ সে সমুদ্র এবং স্থল সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে/ রাসূলের প্রেমই তার জীবনকে প্রাণ দেয়/ মহাবিশ্বকে দেয় সমৃদ্ধি।’

১৯৩৮ সালে প্রকাশিত হয় ‘আরমোগানে হিজায’। এই কাব্যগ্রন্থে ৬০ পৃষ্ঠারও বেশি নবীজিকে সম্বোধন করে কবিতা লিখেছেন। তার একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘আমি গন্তব্য থেকে যাবতীয় পর্দা সরিয়ে দিয়েছি/নিরাশ হবেন না; মোস্তফার পথ অনুসরণ করুন।’

আল্লামা ইকবাল রাহিমাহুল্লাহ তার কবিতায় যা বলতে চেয়েছেন, যা বুঝাতে চেয়েছেন মুসলিম উম্মাহকে, তা কতটুকু গ্রহণ করেছে তারা, এই নিয়ে গভীর দুঃখ ছিল তার। সেই দুঃখ লুকিয়ে রাখতে পারেননি। ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেছেন, ‘আমি আমার হৃদয় সবার সামনে রেখেছি, হয়তো কেউ তা গ্রহণ করবে। কিন্তু কাউকে আমি গ্রহণ করতে আগ্রহী পাইনি। আমার বুকে ধারণ করেছি যে ভালোবাসা, যে দরদ, তার মূল্যায়ন পাইনি। এবার আপনার ভালোবাসায় আমাকে মহিমান্বিত করুন। আপনার প্রেমের ভাষায় আমাকে উদ্বেলিত এবং উচ্ছ্বসিত করুন। এই পৃথিবীতে আমার চেয়ে বড় একা আর কেউ নেই ইয়া রাসূলাল্লাহ!’

আল্লামা ইকবাল রাসূলের ভালোবাসাকেই হৃদয়ের বেদনার উপশম ও সৌভাগ্যের একমাত্র অবলম্বন মানতেন। এই ভালোবাসা তাকে তাড়িত এবং আলোড়িত করেছে সারা জীবন। পশ্চিমা দুনিয়ায় পড়াশুনা করেও এই ভালোবাসার শক্তিতেই তিনি পশ্চিমা হওয়া গায়ে লাগতে দেননি। উচ্চারণ করেছেন কবিতা–

‘সে নামের কুসুম ছাড়া বুলবুলিদের
বিলাপ বৃথা,
ফুল বাগানের শোভা বৃথা, মুকুলরাজির
হাসি বৃথা,
ঐ নামের সাকী ছাড়া পাত্র বৃথা, শরাব
বৃথা,
মাহফিলের শোভা বৃথা’

 

 তথ্যসূত্র :

রাওয়াইউ ইকবাল, আবুল হাসান আলী নাদাবি

কুল্লিয়াতে ইকবাল, আল্লামা ইকবাল

নুকুশে ইকবাল, আবুল হাসান আলী নাদাবি

The post আল্লামা ইকবালের কবিতায় নবীপ্রেম appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%86%e0%a6%b2%e0%a7%8d%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a6%be-%e0%a6%87%e0%a6%95%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%95%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a7%9f-%e0%a6%a8/

No comments:

Post a Comment