আবদুল্লাহিল বাকি :
১.
মুসলমানদের মাঝে দর্শন চর্চা ও দর্শন-কেন্দ্রিক চিন্তার ধারা শুরু হয়েছে আব্বাসী আমল থেকে। উমাইয়া আমলেও আকিদা বিশ্বাস নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা পর্যালোচনা চলেছিল। কিন্তু আব্বাসী যুগে যখন ব্যাপকভাবে গ্রিক ভাষা থেকে গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসা, দর্শনের বিভিন্ন গ্রন্থ অনূদিত হতে থাকে, মুসলমানদের আকীদা-বিশ্বাস সংক্রান্ত আলোচনা তখন দার্শনিক ছাঁচে গড়ে উঠতে থাকে। গ্রিক দর্শনের সিদ্ধান্তগুলো অনেক চিন্তাবিদদের কাছে আবার প্রমাদহীনতার আখ্যা পেতে থাকে। তখন বিশেষ একটা দার্শনিক শ্রেণি গড়ে উঠেছিল। তারা মনে করতো, অ্যারিস্টোটলের চিন্তায় ভুলভ্রান্তি থাকা অসম্ভব।
একযোগে দার্শনিকদের হামলা, অন্যদিকে ধর্মতাত্ত্বিক মুতাকাল্লিমদের প্রতিরোধ যুদ্ধ— অনেক তরুণদের বিশ্বাস নড়বড়ে করে দিচ্ছিল। কারণ ইলমে কালাম দার্শনিকদের মোকাবেলা করতে চাচ্ছিল গ্রীক দর্শন দিয়েই। অথচ গ্রিক দর্শনে পাণ্ডিত্যপূর্ণ ব্যুৎপত্তি না থাকার কারণে— মুতাকাল্লিমের যুক্তিগুলো তরুণ সমাজের কাছে যৌক্তিক বলে বিবেচিত হচ্ছিল না। শান্ত করতে পারছিল না মনের উত্তপ্ত প্রশ্নাবলী।
পরিস্থিতির পর্যবেক্ষণের পর ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি একটি বিশেষ পদক্ষেপ নিলেন। মাদ্রাসায় ছাত্রদের ক্লাস প্রদানের পাশাপাশি, কয়েকবছর লাগিয়ে তিনি ইলমে কালাম থেকে দর্শন না শিখে, গ্রিক দর্শনের মৌলিক গ্রন্থাবলী অধ্যয়ন শুরু করলেন। এ পর্যায়ে প্রাথমিকভাবে দার্শনিকদের উদ্দেশ্য উন্মোচনের জন্য তিনি ‘মাকাসিদুল ফালাসিফা’ গ্রন্থ রচনা করলেন। এর পরবর্তীতে দার্শনিকদের অধিবিদ্যা সংক্রান্ত সিদ্ধান্তবলি খণ্ডনের জন্য রচনা করলেন ‘তাহাফাতুল ফালাসিফা’র মত অমর গ্রন্থ। গ্রিক অধিবিদ্যার অধীনে এর পূর্বে যেভাবে কালাম শাস্ত্র চর্চা করা হতো— এখান থেকে তিনি পুরোপুরি সরে আসলেন। নতুনভাবে ঈমান আকায়েদ ও আমলের যৌক্তিকতা বর্ণনার জন্য ইলমে কালাম থেকে একেবারে ভিন্ন আঙ্গিকে রচনা করলেন ‘ইহয়াউ উলুমুদ্দীন’।
কালাম শাস্ত্রে ইসলামী আকাইদের যৌক্তিকতা প্রদর্শন করা হয় এবং সেগুলোর একটা বস্তুগত ও বৌদ্ধিক দিক দাঁড় করানো হয়। এ শাস্ত্রে আলোচনা করা হয় আল্লাহ তাআলার সত্ত্বা গুণাবলী, জীবন জগতের তাৎপর্য, মানবসত্তার পরিচয়, ঐশী বাণী, ইলহাম, নবুয়ত, হাশর-নশর, জান্নাত জাহান্নাম, মানব-কর্মের ক্ষেত্রে ভাগ্যের সম্পৃক্ততা ইত্যাদি বিষয়ে।
২.
উপনিবেশোত্তর কালে মুসলিম চিন্তাবিদদের মধ্যে যাদের মাধ্যমে ইলমুল কালামের নতুন রূপ সামনে এসেছে, তাদের মধ্যে আল্লামা ইকবাল অগ্রগণ্য। অসংখ্য ফার্সি ও উর্দু কবিতার বাইরে চিন্তামূলক কাজ হিসাবে, ইংরেজিতে তার দুইটা গবেষণামূলক গদ্যগ্রন্থ রয়েছে। প্রথমত মিউনিখ লুডভিগ ম্যাক্সিমিলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় থাকাকালীন সময়ে যে বিষয়ে তিনি পিএইচডি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। বইয়ের নাম ‘The Development of Metaphysics in Persia’ (পারস্যে অধিবিদ্যা চর্চার বিকাশ)। আরেকটি হল মাদ্রাজ, হায়দারাবাদ ও আলীগড়ের বিভিন্ন সেমিনারে প্রদত্ত তার কয়েকটি লেকচার। প্রথমে এটি ইংরেজিতে ‘The Reconstruction of Religious Thought in Islam’ (ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন) নামে ছাপা হয়। এই গ্রন্থের মধ্যেই ইলমুল কালামের নতুন অভিমুখ তিনি তুলে ধরেছেন।
ইকবালের অনুভূতি ছিল— মুসলমানদের প্রাচীন স্বর্ণযুগে ধর্ম ও দর্শন পারস্পারিক সহযোগিতার হাত ধরে চলছিল। একে ছিল অপরের সহযোগী। কিন্তু আধুনিক যুগে বিষয়টা তেমন সরল থাকেনি। ধর্ম সেই প্রাচীন ধর্মই রয়ে গিয়েছে। কিন্তু দর্শন ও বিজ্ঞান এসেছে নতুনভাবে। যার ভিত্তি পুরোপুরি বাহ্যিক উপাদানের উপর, পর্যবেক্ষণ ও আরোহী পদ্ধতির উপর। প্রাচীন ধর্ম ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান পারস্পরিকভাবে সহযোগিতার হাত ধরে চলতে পারছে না। এক্ষেত্রে সমাধান হিসেবে নতুনভাবে ভাবতে হবে। প্রাচীন দর্শনকে সমাধান হিসাবে টেনে আনা হবে পশ্চাৎপদতার পরিচায়ক।
যেমনিভাবে ইকবাল মনে করেন, প্রাচীন ইলমে কালাম আধুনিক যুগের প্রশ্নগুলির উত্তর দিতে অক্ষম, তেমনিভাবে তার ধারণা— প্রাচীন তাসাউফ পদ্ধতির কঠিন কঠিন পরিভাষা, সাধনার কঠোর পদ্ধতি বর্তমান যুগে অচল। এজন্য তার মতামত হল, বর্তমান যুগে ধর্মীয় চিন্তাভাবনাকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের আলোকে।
ইকবাল লিখেছেন, ‘গত পাঁচশ বছর ধরে ইসলামে ধর্মীয় চিন্তা একরূপ গতিহীন হয়ে আছে। অথচ এমন একদিন ছিল, যখন ইউরোপীয় চিন্তাধারা প্রেরণা পেয়েছিল মুসলিম জাহান থেকে। আধুনিক ইতিহাসের বিশেষ উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা হচ্ছে এই যে, জাগতিক দিক থেকে মুসলিম জাহান পাশ্চাত্য জগতের দিকে খুব দ্রুত এগিয়ে চলেছে। এটি অবশ্যই অন্যায় কিছু নয়। কারণ জ্ঞানসাধনার দিক থেকে ইউরোপীয় সংস্কৃতি হচ্ছে ইসলামী তমদ্দুনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রূপের উন্নততর বিকাশ মাত্র।’
ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন কীরূপে সম্ভব? এক্ষেত্রে ইকবালের কথা ছিল, ইসলামী চিন্তার ভিত্তি কতক আগাম ধরে নেয়া ধারণার উপর না হয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা ও প্রত্যক্ষণের উপর হওয়া উচিত। ইসলামী চিন্তার ভিত্তি এরূপে গঠিত হলে ধর্ম ও বিজ্ঞানের সাথে আধুনিক যুগে যেসব পারস্পারিক সংকট পরিলক্ষিত হয়—তার সুরাহা হয়ে যাবে।
এক্ষেত্রে ইকবাল বলেছেন, ‘ইসলামের দৃষ্টিতে আদর্শ এবং বাস্তব এমন দুটি বিরোধী শক্তি নয় যে, তাদের মিলন অসম্ভব। আদর্শকে বেঁচে থাকতে হলে বাস্তবের সঙ্গে তার পূর্ণ বিচ্ছেদ ঘটানো প্রয়োজন নেই। বাস্তবকে উপেক্ষা করতে গেলেই জীবনের সামগ্রিক রূপ হয় বিনষ্ট, জীবনের সামনে তখন দেখা যায় নানাবিধ বাধা বিরোধ। পরিণামে বাস্তবকে নিজের রূপে রূপান্তরিত এবং তার গোটা সত্তাকে নিজের আলোকে রঞ্জিত করার উদ্দেশ্যে তাকে আয়ত্ত করার নিরন্তর প্রচেষ্টার মধ্যেই আদর্শের জীবন।’
তবে ইকবাল যেভাবে সকল ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষণের কথা বলছেন— সেটা আদৌ সম্ভব কিনা, এটা বিবেচ্য। কারণ ইসলামে অধিবিদ্যা ও অদৃশ্য বিভিন্ন বিষয়ে বস্তুগত বিচার ধর্মীয় জ্ঞানতত্ত্বের ক্ষেত্রে উপকারের চেয়ে ক্ষতি করবে বেশি। এভাবে সংশয়বাদের নতুন পথ খুলে যাবে। তবে ধর্মীয় অধিবিদ্যা ও অদৃশ্য জগতের বিচার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে বাহ্যিক প্রত্যক্ষণ যে কোন উপকার করতে পারে না— এটাও ইকবাল বুঝেছিলেন। এজন্যই প্রত্যক্ষণের প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করে তিনি ভিন্নভাবে এগুতে চেষ্টা করলেন।
তার ধারণা ছিল, ইন্দ্রিয়শক্তির প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে যেহেতু ধর্মীয় বিশ্বাসকে উপলব্ধি করা যাবে না, এজন্য প্রয়োজন তাসাউফের আত্মিক প্রত্যক্ষবাদ থেকে দীক্ষা নেয়া। এমনকি সকল প্রকার আকিদাগত আলোচনার ভিত্তি স্থাপন করা উচিত তাসাউফের প্রত্যক্ষণের উপর। যেন এর মাধ্যমে ধর্মীয় বিশ্বাসগুলোর যৌক্তিকতা ও প্রাসঙ্গিকতা আমাদের সামনে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।
ইকবালের মতে, একদিক থেকে ধর্ম ও বিজ্ঞানের রয়েছে সাযুজ্য। আরেকদিক থেকে রয়েছে দ্বৈততা। সাদৃশ্যের ক্ষেত্র হলো— বিজ্ঞান ও ধর্ম, বিশেষভাবে ইসলাম ধর্ম, উভয়ই বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষবাদকে স্বাগত জানায়। তবে ধর্মীয় বিষয়াবলীর প্রত্যক্ষণের ক্ষেত্রে বিবেচ্য হল inner nature বা অভ্যন্তরীণ প্রকৃতির চেতনা ও প্রত্যক্ষণ। আর বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গবেষণার পদ্ধতি হলো external behaviour বা বাহ্যিক আচরণের বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণ।
আর পারস্পারিক দ্বৈততা হলো এদিক থেকে যে, ধর্মীয় অভিজ্ঞতাবাদে সত্য ও তাৎপর্যের একটা সামগ্রিক ধারণা পাওয়া যায়। আর বৈজ্ঞানিক প্রত্যক্ষণে পাওয়া যায় সত্যের আংশিক ধারণা। এজন্যই ইকবাল বলেছেন, ‘প্রথম লক্ষণীয় বিষয় হল এই অভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষতা। এদিক দিয়ে জ্ঞানের মাধ্যম হিসেবে অন্যান্য অভিজ্ঞতার সঙ্গে মরমীয় অভিজ্ঞতার কোন পার্থক্য নেই। বস্তুত সকল অভিজ্ঞতাই প্রত্যক্ষ। বহির্জগতের জ্ঞানের জন্য যেমন আমাদের সাধারন অভিজ্ঞতাগুলো ইন্দ্রিয় নির্ভর বিশ্লেষণ সাপেক্ষ, আল্লাহ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের জন্যেও তেমনি মরমীয় অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণ প্রয়োজন।’
সামগ্রিকভাবে ইকবালের লেকচারগুলো পাঠে অনুধাবন করা যায়, তার চিন্তার অভিমুখ ওয়াহদাতুল ওজুদ বা সর্বেশ্বরবাদের দিকে। ইকবালের কাছে এর ব্যাখ্যা ছিল, জগতের মধ্যে যত বস্তু আছে সবগুলোর একটা সমান আনুপাতিক মাপ আছে। এটাই হলো স্বাভাবিক অস্তিত্ব। আর সকল বস্তুর উপরে যা আধিপত্য বিস্তার করে রয়েছে, সেটা হল স্বাধীন মুক্ত অস্তিত্ব। দুয়ের মাঝে কোন বিভাজ্যতা নেই। অস্তিত্বের যত স্তর রয়েছে, মানুষের মাঝে এসে সবকিছুর সম্মিলন ঘটেছে। এটাই হলো ইকবালের খুদিবাদের ব্যাখ্যা।
স্বাভাবিক অস্তিত্ব ও স্বাধীন অস্তিত্বের পরিভাষা বিতর্কিত হওয়ার দরুন ইকবাল এই পরিভাষা ব্যবহার করেননি। এক্ষেত্রে তিনি ‘সীমাবদ্ধ আমিত্ব’ ও ‘অসীম আমিত্ব’ পরিভাষা ব্যবহার করেছেন। অর্থগত দিক থেকে অবশ্য দুই এর মাঝে কোন ফারাক নেই। অস্তিত্বের যেমন বিভিন্ন স্তর রয়েছে, তেমনিভাবে আমিত্বেরও রয়েছে অনেকগুলো ধাপ। অস্তিত্বের চূড়ান্ত স্তরে মানুষের অবস্থান, তেমনিভাবে আমিত্বেরও শেষ ধাপে মানুষ অবস্থান করছে। ওয়াহদাতুল ওজুদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, আল্লাহ এই পৃথিবীর বাইরে কোথাও নয়। বরং এ পৃথিবীর মধ্যেই তার অস্তিত্ব বিদ্যমান। ইকবালও এর সমর্থন ব্যক্ত করেছেন।
৩.
ইকবাল ‘ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন’ নামে যে গ্রন্থটি রচনা করেছেন, এতে সাতটি লেকচার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
১. জ্ঞান ও ধর্মীয় অভিজ্ঞতা (Knowledge and Religious Experience)
২. দর্শনের চোখে প্রত্যাদেশমূলক ধর্মীয় অভিজ্ঞতা (The Philosophical Test of the Revelations of Religious Experience)
৩. আল্লাহ সম্বন্ধে ধারণা ও এবাদতের মর্ম (The Conception of God and the Meaning of Prayer)
৪. মানুষের খুদী : তার আজাদী ও অমরত্ব (The Human Ego – His Freedom and Immortality)
৫. মুসলিম তমদ্দুনের মর্মকথা (The Spirit of Muslim Culture)
৬. ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় গতিশীলতা (The Principle of Movement in the Structure of Islam)
৭. ধর্ম কি সম্ভব? (Is Religion Possible?)
পঞ্চম ও ষষ্ঠ বক্তৃতায় এমন কিছু কথা চলে এসেছে, ইকবালের পক্ষ থেকে ধারণা করা যায় না। সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষতা ও পাশ্চাত্য চিন্তার ছাপ পড়েছে এই দুটি বক্তৃতায়। অন্যান্য বক্তৃতাগুলোতেও অনেক অস্পষ্ট ও বিরোধপূর্ণ কথা বিদ্যমান। তবুও তার চিন্তা অনুধাবনের ক্ষেত্রে বইটি গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও ইসলামে আত্মা, অনুভূতি, স্থান কাল পাত্র, অস্তিত্বের ধারণা নিয়ে তিনি গভীর তাত্ত্বিক ও একাডেমিক আলাপ করেছেন। আধুনিক ধর্মতাত্ত্বিকদের মধ্যে এ বক্তৃতাগুলো ধর্মীয় চিন্তা গঠনে সাহায্য করেছে ইরানের চিন্তক আলী শরীয়তী ও পশ্চিমা মুসলিম চিন্তক ড. তারিক রামাদানকে।
৪.
ইকবাল বেঁচে থাকাকালীন সময়ই এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। সৈয়দ সুলাইমান নাদাবিও তখনই এটা পড়ে ফেলেছিলেন মূল ইংরেজি থেকে। কিন্তু কোন লিখিত প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেননি, নিজের সম্পাদিত ‘মাআরেফ’সহ অন্য কোন পত্রিকায়। এক্ষেত্রে তার বক্তব্য ছিল, ইকবালের এই বই এখনো জনসাধারণের কাছে পৌঁছায়নি। সুতরাং এই মুহূর্তে বইয়ের সমালোচনামূলক রিভিউ লিখলে— জনসাধারণ ইকবাল সম্পর্কে বিরূপ ধারণাবসত তার ইসলামী উদ্দীপনামূলক কবিতা পড়াও ছেড়ে দিবে। অথচ তার কবিতা পাঠ মুসলমানদের জন্য উপকারী।
কিন্তু ইকবালের ইন্তেকালের পর যখন গ্রন্থটির উর্দু অনুবাদ প্রকাশিত হয়, তখন সুলাইমান নদবী এই বই সম্পর্কে একটা সমালোচনামূলক রিভিউ লেখেন ‘জারীদা’ ম্যাগাজিনে। সেখানে তিনি ইকবালের এই গ্রন্থের কয়েকটি বিষয়ে সমালোচনা করেন। এখানে সংক্ষিপ্তভাবে সেই বিষয়গুলো তুলে ধরছি। কারণ, সোলায়মান নাদাবির সমালোচনার ভাষাটা উষ্ণ হলেও গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দিক তিনি ধরতে পেরেছেন।
১. তিনি বলেছেন, ‘গ্রন্থটি পাঠ করলে বোঝা যায়, মরহুম ইকবাল ইমাম গাজ্জালীর উপর কিছুটা ক্ষুণ্ন ছিলেন। তিনি মনে করতেন, গাজ্জালীসহ প্রাচীন মুতাকাল্লিম ও ফুকাহাদের দর্শন সমালোচনার কারণে মুসলমানদের উত্তরোত্তর বিজ্ঞানগত উন্নতি ও অগ্রগতির ধারা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তার ধারণা ছিল, যদি এমন ধর্মতাত্ত্বিকগণ, বিশেষত ইমাম গাজ্জালীর প্রতিক্রিয়াগুলো সামনে না আসতো, তাহলে মুসলমানদের দর্শন ও বিজ্ঞান চর্চার পথ রুদ্ধ হতো না। এরই ফলশ্রুতিতে মুসলমানদের যে বর্তমান অধঃপতন— সেটাও প্রকট হয়ে আমাদের সামনে দেখা দিত না।
কিন্তু তার কাছে এই প্রশ্নের কি কোন জবাব ছিল… আল্লাহর রসূল এবং সাহাবায়ে কেরামের সামনে তো দর্শন জাতীয় কোন বস্তু ছিল না। তাহলে কায়সার ও কিসরা কিভাবে বিজিত হল? তিনি পাশ্চাত্যের সকল উন্নতি ও অগ্রগতির ভিত্তি মনে করে থাকেন ইসলামকে। অথচ এটি একটি মারাত্মক প্রমাদ। তিনি বারবার একটা কথা বলেছেন, ‘যদি কোরআনে চিন্তাভাবনা ও বিবেক ব্যবহারের ক্ষেত্রে এতটা গুরুত্ব ও তাগিদ দেয়া না হতো, তাহলে পাশ্চাত্যের অভিজ্ঞতা ও ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বস্তুগত বিদ্যা এতটা অগ্রগতি লাভ করতে পারত না।’
তার এই বক্তব্য কোরআনের উদ্দেশ্যের সাথে সাদৃশ্য রাখেনা। এতে মনে হয়, কোরআন যেন কোন পথপ্রদর্শক কিতাব নয়। যেন এটি একটি বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা শিক্ষা দেবার রসায়নিক গ্রন্থ। যদি বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি শিক্ষা দেয়াই হত কোরআন ও ইসলাম ধর্মের মৌলিক ভিত্তি, তাহলে নবী-রাসূলগণ অন্তত বৈজ্ঞানিক জ্ঞান সম্পন্ন মানুষ হতেন। এবং বিভিন্ন প্রকৃতিগত আবিষ্কার করে দেখাতেন। ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত নেই।
দর্শন ও বিজ্ঞানকে ছোট করে দেখার কিছু নেই। কিন্তু ধর্মের মৌলিক উদ্দেশ্য অভিজ্ঞতা ও প্রত্যক্ষণের মধ্যে নিহিত দেখা— ইসলামের মৌলিক উদ্দেশ্যগুলো থেকে দৃষ্টি আচ্ছন্ন করে রাখতে পারে।’
২. ‘খুতুবাতে ইকবালে যেখানে যেখানে চিন্তা ও দর্শনের সমর্থনে বিভিন্ন আয়াত আনা হয়েছে— সকল স্থানে প্রাসঙ্গিকতা সংকট রয়েছে। মরহুম ইকবাল তাফসীরশাস্ত্র সম্পর্কে খুব বেশি জ্ঞান রাখতেন না। প্রাচীন তাফসীর গ্রন্থগুলোর সাহায্য না নিয়ে আকলের মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন আয়াতের অর্থ উন্মোচন করতে চেয়েছেন। এজন্যই এই সংকট তৈরি হয়েছে।’
৩. ‘ইকবাল জগতকে মনে করেন আল্লাহ তাআলার একটি সৃষ্টিগত প্রক্রিয়া, যা এখনো অসম্পূর্ণ রয়েছে। এবং মানুষের মাধ্যমে সম্পন্ন হওয়ার পথে অগ্রসর। সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় এখনো তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। এরচেয়ে আগে বেড়ে তিনি মানুষের অবস্থান এতটা ঊর্ধ্বে উঠিয়েছেন আর খোদার ভূমিকা এতটা সীমিত করেছেন যে— ভাবলেই গা শিউরে উঠে। পাশ্চাত্য দর্শনের প্রভাব তাকে এতদূর বলিয়ে নিয়েছে যে, ‘আল্লাহ আপন স্বাধীনতা, জীবনের শক্তিমত্তা ও সক্ষমতার ক্ষেত্রে মানুষকে অংশীদার বানিয়ে নিয়েছেন।’
মরহুম ইকবাল বিশ্বজগতের ‘হরকত’ তথা অবিরাম চলিঞ্চুতার এমন এক ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যা কোন ঐশী গ্রন্থ ও ধর্মীয় সংস্কৃতির ইতিহাসে অপরিচিত। তিনি বলেছেন, ‘তাকদীর আল্লাহ লিখে রাখেননি। বরং কার্যকারণ তত্ত্বের অধীনে মানুষই আপন তাকদীর লিখে যাচ্ছে অবিরাম।’
এছাড়াও আমরা খুতুবাতে ইকবালে দেখতে পাই, তিনি বহুবিবাহকে ইসলামের প্রাথমিক যুগের প্রেক্ষাপট প্রয়োজনীয়তা হিসেবে দেখেছেন। বর্তমান যুগে যার কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। এমনকি এটাকে তিনি মনে করেছেন, ধর্মীয় অজুহাতে ব্যভিচারের বৈধতা বলে।
ইসলামে যে ধর্মের অবমাননাকারী ও মুরতাদদের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে— এটাকে তিনি স্বীকার করেননি। মনে করেছেন, এগুলো প্রাচীন যুগের কট্টরপন্থী ফকিহদের আবিষ্কার। বর্তমান যুগে যে, আলিমদের ইজতিহাদের যোগ্যতা নেই, এই অজুহাতকে তিনি আমলে নিতেন না।
খুতুবাতে ইকবালে আছে, যদি একক ব্যক্তির ইজতিহাদের যোগ্যতা না থাকে, তাহলে পার্লামেন্টারির অধীনে অনেকগুলো মেধার সমন্বয়ে ইজতিহাদ সংগঠিত হবে। এছাড়া ইসলামে যে আলেমদের ‘ইজমা’র ধারণা রয়েছে, সেটাকে তিনি গণতান্ত্রিক অধিকার বলে মনে করতেন। অর্থাৎ এই ইজমার অধীনে সকল ধরনের এবং সকল স্তরের মুসলিম জনসাধারণের মতামত গ্রহণ করা প্রয়োজনীয়।
সোলাইমান নাদাবি অবশ্য বলেছেন, ‘পরবর্তীতে ইকবালের সাথে ব্যক্তিগত চিঠি আদান প্রদানের মাধ্যমে আমি বুঝতে পারি, এই বইয়ের মধ্যে প্রক্ষিপ্ত অনেক ধারণা থেকে ইকবাল সরে এসেছেন। বিশেষত তার জীবদ্দশায় মাসিক ‘সিদক’ ম্যাগাজিনে মাওলানা আব্দুল মাজেদ দরিয়াবাদীর একটা সমালোচনা প্রকাশের পর ইকবাল বুঝতে পারেন, ধর্মীয় দিক থেকে বিষয়গুলোকে তিনি যতটা সরল, সোজাসাপ্টা ভেবেছেন— ততটা নয়। বরং এর সাথে ঈমান ও আকাইদের অনেক প্রসঙ্গ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
এজন্যই গ্রন্থের ইংরেজি নাম যদিও ছিল ‘The Reconstruction of Religious Thought in Islam’, কিন্তু তিনি গ্রন্থের নাম বলতেন ‘Islam as I understand it’ (ইসলামকে আমি যেমনটা বুঝেছি)। এটা সংস্কারেরও ইচ্ছা ছিল তার। কিন্তু জীবন তাকে এর সুযোগ দেয়নি।
এই গ্রন্থকে বলা যায় মর্ডান মুসলিমের জন্য বাইবেল স্বরূপ। তবে মজার ব্যাপার হলো, গ্রন্থটির ভাষা এতটাই গভীর ও দার্শনিক পরিভাষায় পরিপূর্ণ যে— মর্ডানিস্টরাও যে গ্রন্থটি বুঝে ফেলবে— এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। ফলে এর ভুলগুলো তারা ধরতে পারবে না। ইকবালের উদ্দেশ্যও তাদের কাছে পরিস্ফুট হবেনা। ফলে আশঙ্কা অপেক্ষাকৃত কম।’
ইকবালের এই গ্রন্থের অনেক ভুলভ্রান্তি সত্ত্বেও মুসলিমদেরকে নতুনভাবে চিন্তা করতে সাহায্য করবে। যেমনিভাবে তারিক রামাদান ও আলি শরীয়তীর চিন্তার জগত গঠনে সহায়তা করেছে। গ্রন্থটি পাঠে বোঝা যায়, অংশ থেকে তিনি সমগ্রকে অনুধাবন করতে পারতেন। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অনেক ব্যাখ্যা টেনে নিয়েছেন। তাছাড়া তার প্রশ্ন উত্থাপন যোগ্যতাও অতুলনীয়। সিদ্ধান্তবলীর সবকিছু গ্রহণযোগ্য না হলেও তত্ত্বগত মৌলিক উপাদান এই গ্রন্থ থেকে আবশ্যিকভাবে গ্রহণীয়। কাঠামোবাদের (structuralism) অধীনে এই গ্রন্থকে পাঠ না করে, উত্তরাধুনিক চিন্তক জ্যাক দেরিদার বিনির্মাণ তত্ত্বের (Deconstruction) অধীনে এই গ্রন্থকে পাঠ করলে নতুনভাবে ইকবালের সাথে হয়তো আমরা বোঝাপড়ায় লিপ্ত হতে পারব।
The post মুসলিম চিন্তার বিনির্মাণ : ইকবালের বোঝাপড়ায় appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%b8%e0%a6%b2%e0%a6%bf%e0%a6%ae-%e0%a6%9a%e0%a6%bf%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%a8%e0%a6%bf%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%a3/
No comments:
Post a Comment