রাকিবুল হাসান নাঈম:
বন্যায় যখন দেশ ভাসছে, চারদিকে যখন পানিবন্দী মানুষের ক্ষুধার্ত চিৎকার, প্রবল বৃষ্টিতে আমরা যখন খুঁজে ফিরছি সূর্যের আলো, ঠিক নিদারুণ এই দুঃসময়ে ঝরে গেলো একটি নক্ষত্র। শোকে বাতাস ভারী হয়ে উঠলো। অফিসে এসে মাত্রই পিসি অন করেছি। ফাতেহের ড্যাশবোর্ড খুলতেই ইফতেখার জামিল ভাইয়ের মেসেজ ভেসে উঠলো—আল্লামা আবদুল হালিম বুখারী ইন্তেকাল করেছেন। নিউজ করো।
ফাতেহে যুক্ত হবার পর অনেক নক্ষত্র ঝরার খবর লিখতে হয়েছে। খবর লিখতে লিখতে অনুভব করেছি, আমরা মুরুব্বিহারা হয়ে যাচ্ছি। একসময় যাদের হুংকারে বাতিল কেঁপে উঠতো, তাকালে তাদের কাউকে আর দেখা পাই না। আমাদের দাবিগুলো নিয়ে যারা রাষ্ট্রপক্ষের সঙ্গে নেগোসিয়েশন করতো, তাদের হারিয়ে আমরা কেমন অভিভাবকহীন। আল্লামা বুখারীর ইন্তেকালের খবর লিখতে গিয়েও তেমনি অনুভূত হলো। বাংলাদেশে নাস্তিক্যবাদ বিরোধী সবচে বড় আন্দোলনে এই মানুষটি জড়িত ছিলেন গায়ে-গতরে। হেফাজতে ইসলাম নামটি তারই দেয়া। তিনি ছিলেন হেফাজতের প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির নায়েবে আমিরদের একজন।
আল্লামা বুখারীর প্রসঙ্গ তুলতেই কেমন কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলেন তাঁর শেষ জীবনের সার্বক্ষণিক সহচর ও খাদেম মাওলানা সুহাইল বিন রশিদ কাসেমি। তিনি বললেন, ‘হুজুরের জীবনের শেষ ১৫ মাস আমি তার খাদেম ছিলাম। একবারও তিনি আমাকে কোনো কাজের আদেশ করেননি। কোনো কাজের দরকার হলে বলতেন, এটা করলে ভালো হতো। তিনি আমার নাম ধরেও ডাকতেন না। ডাকতেন ‘মওলবি সুহাইল’ বলে।’
নিপাট, নির্মল জীবন ছিল তার। মাওলানা সুহাইল বলেন, ‘আমি হুজুরের বাজার করতাম। টাকা-পয়সা লেনদেনে সহযোগিতা করতাম। ব্যাংক থেকে টাকা তোলা, বিকাশ-নগদ থেকে বিল তোলা সবই করতাম আমি। হুজুর প্রতিদিনের হিসাব প্রতিদিন চুকিয়ে দিতেন; একটাকাও বাকি রাখতেন না। দুই টাকা বেশি খরচ হলে সেটা সেদিনই দিয়ে দিতেন। একবার দুইটাকা বাকি ছিল। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। একদিন হুজুর দুইটাকা হাতে দিয়ে বললেন, টাকাটা আমার কাছে পেতে। আমি অবাক হয়ে গেলাম হুজুরের লেনদেনের স্বচ্ছতা দেখে।’
হুজুরের দৈনিক আমল কেমন ছিল জানতে চাইলাম। ফোনের এপার থেকে বুঝলাম তার গলা ধরে এসেছে। বুকের হিমালয় ভেঙে বইছে জলপ্রপাত। একটু সামলে মাওলানা সুহাইল বললেন, ‘জামাতের সঙ্গে সবসময় নামাজ পড়তেন। কিন্তু শেষ বয়সে দুর্বলতার কারণে মাঝেমধ্যে পড়তে পারতেন না। তিনি ঘরে থাকতেন কিংবা বাইরে, তাহাজ্জুদ তার ছুটতো না। যত রাতেই ঘুমাতেন, ঠিক তাহাজ্জুদে উঠে যেতেন। এলার্ম বাজুক আর না বাজুক। শেষরাতে যখন উঠতেন, আমাদের কাউকে ডাকতেন না। নিজে কষ্ট করে অজু-এতেঞ্জা করে নামাজ পড়তেন। জিকির করতেন। এছাড়া অন্যসময় আমরা তাকে ধরে ধরে সব করাতে হতো। অজু, গোসল ইত্যাদি।’
মাওলানা সুহাইল যেমন হুজুরের খাদেম ছিলেন, তেমনি ছিলেন হুজুরের ছাত্রও। তিনি তিনবার হুজুরের কাছে বুখারী শরীফ পড়েছেন। তৃতীয়বার ছিল এবছর। যদিও এ বছর খতম করতে পারেননি। বুখারীর দরসের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘হুজুর দরসে ও বয়ানে মাঝেমধ্যে প্রাসঙ্গিক ঘটনা বলতেন। হুজুরের ঘটনাগুলো হতো অত্যন্ত বিরল ও আনোখা। ঘটনা সাধারণ ও প্রসিদ্ধ হলেও অভিনব পদ্ধতিতে বলার কারণে আমরা শুরুতে ধারণাই করতে পারতাম না যে, হুজুর আমাদের জানা ঘটনাটি বলছেন। সাজিয়ে গুছিয়ে অভিনব পদ্ধতিতে যেকোন বিষয় বর্ণনা করা ছিল হুজুরের অনন্য বৈশিষ্ট্য।
একদিন বুখারি শরিফের দরসে হাদিসের ইবারত পড়ছিল আমাদের এক সাথী। সম্ভবত সে ইবারত দেখেনি। পড়তে গিয়ে ভুল পড়া শুরু করল। দুয়েকটা ইরাব ভুল পড়ল। হুজুর স্বভাবজাত গম্ভীর কণ্ঠে শুদ্ধ ইরাব বলে দিলেন। সে বারংবার ভুল করতে লাগল। আর হুজুর শুদ্ধ করে দিলেন। এমনকি সে কিছু শব্দও অশুদ্ধ পড়ল। হুজুর এতটুকুও রাগ দেখাননি সেদিন। বলেননি—’কালকে থেকে তুমি ইবারত আর পড়বা না।’ আমরা আপসে বলাবলি করছিলাম, ‘এ হল হুজুরের নামের প্রভাব। আব্দুল হালিম—সহনশীলের বান্দা।’
হাদিসের দরসে হুজুর ছিলেন পুরোধা। সেই যৌবন দীপ্ত সময়ে হুজুর তিরমিজির দরস দিতেন নিজস্ব ও অনন্য কৌশলে। সে সময়কার তালিবুল ইলমরা পটিয়াতে দাওরা পড়ে ইলম আহরণের জন্য যেতেন দারুল উলুম দেওবন্দ। তারা দেওবন্দে অন্য সব দরসে নতুনত্ব খুঁজে পেলেও হুজুরের তিরমিজির দরসের চেয়ে নতুন ও বাড়তি কিছু পেতেন না। পরে হুজুর নিজস্ব ধারায় বুখারি আওয়ালের দরস দিয়েছেন আমৃত্যু। ঠাণ্ডা-মাথায় স্পষ্ট ভাষায় ধীরে-সুস্থে তাকরির, গুছানো বর্ণনা ও অভিনব পদ্ধতিতে বিবরণ ছিল হুজুরের দরসের মূল বৈশিষ্ট্য। আমি যখন দেওবন্দ পড়ি, হুজুর গিয়েছিলেন দেওবন্দ সফরে। মেহমানখানায় বসেছিলেন হজুর। আমরা হুজুরকে তিরমিজির বিভিন্ন প্রশ্ন করছিলাম। হুজুর একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন। তার সেদিনকার উত্তর শুনেই আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, দেশে ফিরে হুজুরের খেদমতে থাকবো। দেশে ফেরার পর হুজুরের খেদমতে আসার সৌভাগ্য হয়।
মাওলানা সুহাইলের চোখে হুজুরের উল্লেখযোগ্য একটি গুণ—কর্মতৎপরতা। হুজুর কখনো অলস সময় কাটাতেন না। হুজুরের জীবন ছিল গোছানো। যতক্ষণ জেগে থাকতেন, কাজে কাটাতেন। দেখা যেতো তার ঘুম হতো না, ঘুমের ওষুধ খেতে হতো। তখনও যতক্ষণ জেগে থাকতেন, কাজ করতেন। আলসেমিকে তিনি প্রশ্রয় দিতেন না, পছন্দও করতেন না।
কথায় কথা বাড়ে। স্মৃতিচারণে সময় হয়ে উঠে কাতর। মাওলানা সুহাইলকে জিজ্ঞেস করলাম, হুজুরের সঙ্গে আপনার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল কেমন? এবার তার কণ্ঠে উচ্ছ্বাস ফুটে উঠলো একটু। আমি টের পেলাম৷ উৎকর্ণ হয়ে রইলাম। তিনি বললেন, ‘আমার সব বিষয়ে হুজুর বাবার মতো খোঁজ রাখতেন। পারিবারিক ও সাংসারিক জীবনে কোনো সমস্যায় পড়লে হুজুর সমাধান করে দিতেন। এমনকি আমার বিয়ের সময় হুজুর আমাকে ২০ হাজার টাকা হাদিয়া দিয়েছিলেন।’
মাওলানা সুহাইল আহমাদের সঙ্গে কথা বলা শেষ করে পিসিতে তাকালাম। নিউজফিডে দেখা যাচ্ছে একটি ছবি। আল্লামা আবদুল হালিম বুখারী রহ. একটি চেয়ারে বসে আছেন। সেই চেয়ারের দুপাশে বাঁশ লাগিয়ে পালকি বানিয়ে ছাত্ররা তাকে কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে। হয়তো কোনো প্রজেক্ট দেখতে গিয়েছিলেন। বার্ধক্যজনিত দুর্বলতায় হাঁটতে পারবেন না, কষ্ট পাবেন। ছাত্ররা তাকে সেই কষ্ট করতে দেয়নি। প্রিয় উসতাদকে তুলে নিয়েছে কাঁধে। আহা, ছবিটি আজ শুধুই স্মৃতি। আল্লাহ তাকে জান্নাতের সুউচ্চ মাকাম দান করুন।
The post আল্লামা আবদুল হালিম বুখারী: দুঃসময়ে ঝরে পড়া নক্ষত্র appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%86%e0%a6%b2%e0%a7%8d%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a6%be-%e0%a6%86%e0%a6%ac%e0%a6%a6%e0%a7%81%e0%a6%b2-%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a6%bf%e0%a6%ae-%e0%a6%ac%e0%a7%81%e0%a6%96%e0%a6%be/
No comments:
Post a Comment