Saturday, July 16, 2022

চামড়া-সিন্ডিকেট : শত শত কোটি টাকা লুটপাট

মুনশী নাঈম:

গত কয়েক বছরের মতো এবারো প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের কারসাজিতে কোরবানির পশুর চামড়া ব্যবসায় কোটি কোটি টাকার লোকসান হয়েছে। সরকারিভাবে চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হলেও সেই মূল্য কার্যকর হলো কি না তার তদারকি না থাকায় বিনিয়োগকারীরা সমূহ ক্ষতির শিকার হয়েছেন। অন্য দিকে গরিব মানুষ এবং দ্বীনি প্রতিষ্ঠানগুলো বঞ্চিত হয়েছে বছরের প্রত্যাশিত আয় থেকে। প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ায় ৭ টাকা ও খাসির চামড়ার দাম ৩ টাকা বৃদ্ধি করায় মৌসুমি ব্যবসায়ী এবং মসজিদ, এতিমখানা ও মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ আশা করেছিলেন, চামড়ায় এবার বাড়তি দাম মিলবে। শেষ পর্যন্ত তা হয়নি।

এবার সরকারনির্ধারিত দাম অনুযায়ী ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর চামড়া প্রতি বর্গফুট ৪৭ থেকে ৫২ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৪০ থেকে ৪৪ টাকা করা হয়েছে। এ ছাড়া খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ঢাকায় ১৮ থেকে ২০ টাকা, বকরির প্রতি বর্গফুট ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়। গত রোববার কোরবানি শেষে বিভিন্ন স্থান থেকে নামমাত্র মূল্যে চামড়া সংগ্রহ করেছেন মৌসুমি ও সাধারণ ব্যবসায়ীরা। দাম না থাকায় চামড়া নিয়েও তেমন আগ্রহ ছিল না মানুষের। গরু আর মহিষের চামড়া কিছুটা বিক্রি হলেও ছাগলের চামড়া বিনামূল্যেই সংগ্রহ করেছেন অনেকেই।

মাদরাসাগুলো পায়নি সঠিক দাম

এবার ১০৫০ টি গরু-মহিষের চামড়া পেয়েও তেমন সুবিধা করতে পারেনি কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী মাদরাসা জামিয়া ইমদাদিয়া। পানির দরে চামড়া বিক্রি করতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা শাব্বির আহমদ রশিদ। তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘এবার ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে ফেলেছে। ফলে কেউ চামড়া নিতে চায়নি। নিলামে চামড়া প্রতি ৫১০ টাকা উঠলেও পরে তারা আর নেয়নি। পরে রাতে তাদেরকে ডেকে এনে, জোর করে সেধেই ৪১০ টাকা পিস চামড়া দিয়েছি। চামড়াগুলো তারা মাদরাসাতেই লবণ দিয়ে রেখেছে।’

জামিয়াতে খাসির চামড়া এসেছে দুই শতাধিক। খাসির চামড়া কেউ নিতে চায় না উল্লেখ করে মাওলানা শাব্বির আহমদ রশিদ বলেন, ‘খাসির চামড়া বিক্রি করতে হয়েছে মাত্র ১০ টাকা করে।’

কেরাণীগঞ্জের মক্কীনগর মাদরাসায় গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ৭৮০ টাকা পিস, খাসির চামড়া বিক্রি হয়েছে ৮০ টাকা পিস।

হোমনা থানার জামিয়া আরাবিয়া ইসলামিয়া এমদাদুল উলূম ও এতিমখানা গরুর চামড়া এসেছে ৩৩৩টি। প্রতিটি চামড়া বিক্রি হয়েছে ৫৫০ টাকা করে। তবে তারা খাসির চামড়া বিক্রি করতে পারেনি। ৫০ টি চামড়া উঠেছিল খাসির। সেগুলো ফ্রিতে দিয়ে দিয়েছে ব্যবসায়ীদের।

জামিয়া আরাবিয়া লালবাগে গরুর চামড়া উঠেছে ২০৪৫টি। প্রতিটি চামড়া বিক্রি হয়েছে ৬০০ টাকার কিছু বেশি। তবে খাসির চামড়া তাদের বিক্রি করতে হয়েছে মাত্র ১০ টাকা পিস।

রোকনপুর তালিমুল কুরআন হাফিজিয়া মাদরাসায় চামড়া উঠেছে ১৫০টি। তারা প্রতিটি চামড়া বিক্রি করেছে ৫৫০ টাকা করে।

জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম ফরিদাবাদ মাদরাসায় খাসির চামড়া এসেছিল এক হাজারের অধিক। প্রতিটি চামড়া বিক্রি হয়েছে মাত্র ১৫ টাকা করে। এ মাদরাসায় গরুর চামড়া উঠেছে ২২০০। কত দামে টাকা পাবে, তা এখনো নির্ধারণ হয়নি। দাম নির্ধারণ হয়নি জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া তাঁতিবাজার মাদরাসার চামড়ারও। তাদের গরুর চামড়া উঠেছে ৮৮৩ টি, খাসির চামড়া ৪০০টি। কাঁচা চামড়ার আড়তে তারা চামড়া দিয়েছে। দাম পরে নির্ধারণ হবে।

রামপুরা রোডে শেখ জনূরুদ্দীন র. দারুল কুরআন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাহফুজুল হক কাসেমী বলেন, তিনি এবার ২৭৪ পিস চামড়া গড়ে ৭৫০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন। তবে তিনি দাবি করেন গতবার তিনি ৮৩০ টাকা দরে প্রতি পিস চামড়া বিক্রি করেছেন।

খাসির চামড়া দাম এত কম কেন এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ ফাতেহকে বলেন, ‘ছাগলের চামড়ার বিশ্বব্যাপী ডিমান্ড কমেছে। আমরা হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিফট করেছি ২০১৭ সালে। সেখানে মূলত খাসি ও ছাগলের চামড়ার ইউনিটগুলোকে আমরা নিতে পারিনি। সাভারে আমাদের ৫ থেকে ৬টি ইন্ডাস্ট্রি আছে, যারা ছাগল ও খাসির চামড়া প্রসেস করে। এটার বিরূপ প্রভাব কয়েক বছর ধরে পড়েছে।’

ট্যানারী মালিকদের পকেটে শত কোটি টাকা

চলতি মৌসুমে ট্যানারী মালিকদের প্রায় এক কোটি চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য ছিল। তবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চলতি বছর পবিত্র ঈদুল আজহায় সারা দেশে মোট ৯৯ লাখ ৫০ হাজার ৭৬৩টি গবাদিপশু কোরবানি হয়েছে। এরমধ্যে ঢাকায় ২৮ লাখ ৯১ হাজার ৭৬৮টি গরুর কুরবানি দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামে প্রায় ২১ লাখ ২৮ হাজার ৪৫৯টি , খুলনায় প্রায় ৯ লাখ ২৬ হাজার ২০৯ টি, রাজশাহীতে ১৯ লাখ ৯৮ হাজার ১২৮ টি, বরিশালে প্রায় চার লাখ ৯৮ হাজার ৯৩৭টি, সিলেটে প্রায় ৩ লাখ ৯২ হাজার ৫৮৩টি, রংপুরে ১১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৯৬ টি, ময়মনসিংহ এলাকায় প্রায় ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৭৮৩ টি গবাদি পশু পশুকে কুরবানি দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে কিছু চামড়া নষ্ট হয়েছে। কিছু চামড়া রয়েছে বকরির। সে কারণে চলতি মৌসুমে শেষ পর্যন্ত ৯০–৯৫ লাখ চামড়া সংগ্রহ হবে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ।

পোস্তার আড়তদারেরা জানান, বড় আকারের গরুর চামড়া ৩৫-৪০ বর্গফুট, মাঝারি ২১-৩০ এবং ছোট আকারের গরুর চামড়া ১৬-২০ বর্গফুটের হয়। একেকটি গরুর চামড়া সংরক্ষণে লবণ ও শ্রমিকের মজুরিসহ গড়ে ৩০০ টাকা খরচ হচ্ছে।

ধরা যাক, একটি মাঝারি আকারের গরুর চামড়ার আয়তন ২৫ বর্গফুট। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বেঁধে দেওয়া দর অনুযায়ী, লবণযুক্ত সেই চামড়ার দাম হয় ১ হাজার ২৩৭ টাকা। তার থেকে লবণ ও শ্রমিকের মজুরি গড়ে ৩০০ টাকা বাদ দিলে লবণবিহীন কাঁচা চামড়ার দাম হওয়ার কথা ৯৩৭ টাকা। তবে এই আকারের চামড়া বিক্রি হয়েছে ৩০০–৭৫০ টাকায়। দেশে গরু কুরবানি হয়েছে ৫০ লাখের অধিক।

ট্যানারী মালিকরা প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছেন চামড়া কেনার জন্য। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে এবার চামড়ার বাজার কমিয়ে দিয়েছেন। ট্যানারী মালিকরা এবার চামড়া কিনতেই চাচ্ছেন না। ফলে কেউ কেউ চামড়াপ্রতি ২টাকা লাভ রেখেও চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। ঋণের টাকায় যদি তারা চামড়া না কেনেন, তাহলে টাকাগুলো যাচ্ছে কোথায়? এর আগে ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন, ব্যবসায়ীদের মধ্যে চামড়া বাবদ ঋণ নিয়ে অন্য খাতে বিনিয়োগ করার প্রবণতা রয়েছে।

কয়েকটি ট্যানারির মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত লবণ এবং কেমিক্যালের দাম কয়েকগুণ বৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে তারা সরকার নির্ধারিত মূল্যে চামড়া ক্রয় করা থেকে বিরত থাকছেন। সালমা ট্যানারি-২ এর সুপারভাইজার সোলায়মান ফাতেহকে বলেন, এবার লবণের দাম দ্বিগুণ এবং কেমিক্যালের দামও পাঁচ গুন বেড়েছে। একটি চামড়া ওয়েট ব্লু করতে লবণ ও কেমিক্যালসহ ৭-৮ শ টাকা খরচ হয়। পাঁচ শ টাকার লবণের বস্তা কিনতে হচ্ছে এক হাজার টাকায়। তাতেও আবার ৬০ কেজি লবণের জায়গায় ৫০-৫৫ কেজি থাকে। ৯০ টাকার ক্রোম ১৮০ টাকা, ১৮ টাকার সালফিউরিক অ্যাসিড ৮০ টাকা হয়েছে। বড় ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করার কারণে এসব মালের দাম বেড়েছে। ফলে চামড়া সঠিক দামে কেনা যায়নি।

অর্থনীতিবিদ ও বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার দরিদ্র জনগোষ্ঠী কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকা সহায়তা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবেন। অন্যদিকে কম দামে চামড়া কিনতে পারায় এবং এখন কাঁচা চামড়া বিদেশে রপ্তানির অনুমতি মেলায় ৫০০ কোটি টাকার বেশি অতিরিক্ত লাভ হাতিয়ে নেবে আড়তদার, ব্যবসায়ী ও ট্যানারি মালিকেরা। সব মিলিয়ে হাজার কোটি টাকা ঢুকবে তাদের পকেটে।

The post চামড়া-সিন্ডিকেট : শত শত কোটি টাকা লুটপাট appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%9a%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a7%9c%e0%a6%be-%e0%a6%b8%e0%a6%bf%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a1%e0%a6%bf%e0%a6%95%e0%a7%87%e0%a6%9f-%e0%a6%b6%e0%a6%a4-%e0%a6%b6%e0%a6%a4-%e0%a6%95%e0%a7%8b%e0%a6%9f/

No comments:

Post a Comment