মুনশী নাঈম:
উত্তরাঞ্চলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের নামে চলছে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষা। এই অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি জেলায় রয়েছে উপজাতি মানুষ। তবে বৃহত্তর দিনাজপুরের ঠাকুরগাঁ, পঞ্চগড়, ঘোড়াঘাট, বৃহত্তর রংপুরের লালমনিরহাট, নীলফামারী, বৃহত্তর বগুড়ার জয়পুরহাট, পাঁচবিবি, বৃহত্তর রাজশাহীর নওগাঁ, নাচোল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং চলনবিল এলাকায় এদের বসবাস বেশি। খৃস্টান মিশনারীগুলো সেবার নামে দরিদ্র লোকদের টার্গেট করে। তারপর বিভিন্ন কৌশলে তাদেরকে খৃস্টধর্মের প্রতি দাওয়াত দিতে থাকে। এই কৌশলের অন্যতম একটি হলো নিজেদেরকে খৃস্টান না বলে ‘ঈসায়ী মুসলিম’ বলা। এতে শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা দরিদ্রদের বিভ্রান্ত করা সহজ হয়।
খৃস্টান না বলে ঈসায়ী মুসলিম বলা
১৯৭৮ সালে উত্তর আমেরিকার লুওয়াজিন নামক স্থানে সমকালীন খৃষ্টবাদ প্রচারের ধারাবাহিকতায় এক ঐতিহাসিক কনফারেন্সের আয়োজন করা হয়। তাতে সারা দুনিয়ার প্রায় দেড়শ প্রথম সারির খৃষ্টান ধর্মগুরু ও ধর্মনেতাগণ যোগদান করেন। তাদের প্রত্যেকেই বিভিন্ন দেশের বড় বড় গির্জা, মিশনারি প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি ছিলেন। উক্ত কনফারেন্সে অংশগ্রহণকারী সবাই গুরুত্বারোপ করেন যে, দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনার সময় যদি তাৎক্ষণিকভাবে মুসলমানদেরকে খৃষ্টবাদের বিষাক্ত ট্যাবলেট গলধকরণ করানো নাও যায় তাহলে সমস্যা নেই। কিন্তু কমপক্ষে অতি অবশ্যই মুসলমানদের মাঝে নৈতিক ও চারিত্রিক স্খলন ঘটানো এবং ধর্মীয় ক্ষেত্রে তাদেরকে পঙ্গু করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে যেতে হবে। এ লক্ষ্যে তারা মুসলমানদেরকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে। এতে c4. c5 এবং c6 ক্যাটাগরিতে মুসলিমদের দাওয়াতের যে পদ্ধতি তুলে ধরা হয়, তা হলো, সরসরি খৃস্টধর্মের প্রতি দাওয়াত দেয়া যাবে না। বরং নিজেদেরকে মুসলমানদের একটি ক্যাটাগরি হিসেবে উল্লেখ করেই দাওয়াত দিতে হবে। এক্ষেত্রে ঈসায়ী ধর্ম এবং ইসলোমে যে জিনিসগুলো মিল আছে, ইসলামি যে প্রেকটিসগুলো বাইবেলে স্বীকৃত, সেগুলো তুলে ধরতে হবে। বলতে হবে, তারা জিশুর অনুসারী।
মিশনারিরা মানুষকে ধর্মান্তরিত করার জন্য বিভিন্ন অপকৌশল অবলম্বন করে থাকে। এরমধ্যে কয়েকটি তুলে ধরা হলো।
ক. মুসলিম নাম ধারণ: মিশনারী সংস্থাগুলো মুসলিম নাম ধারণ করে কাজ করে। যেমন, নুর-ই-ইলাহী, খোদার পথ, মাসীহী জামাত, আল হানিফ কল্যাণ ট্রাস্ট। অনেক সময় নাম দেখে বুঝাই যায় না, তারা খৃস্টান ধর্ম প্রচারক সংস্থা।
খ. ধর্মগ্রন্থের নাম পরিবর্তন: খৃষ্টানদের ধর্মগ্রন্থ সারা বিশ্বে বাইবেল নামেই বহুল পরিচিত। কিন্তু স্থান-কাল-পাত্রভেদে নাম পরিবর্তন করার কৌশলে খৃষ্টান মিশনারিদের জুড়ি নেই। বাইবেলকে নামকরণ করেছে কিতাবুল মুকাদ্দাস নামে। পরে কিতাবুল মুকাদ্দাসের ‘পুরাতন নিয়ম’ অংশের নামকরণ করেছে ‘তৌরাত, জবুর ও নবীদের কিতাব’ এবং ‘নতুন নিয়ম’ অংশের নামকরণ করেছে ‘ইঞ্জিল শরীফ’। ‘কিতাবুল মুকাদ্দাস’ ও ‘ইঞ্জিল শরীফ’ এর মলাট সম্পূর্ণ ইসলামী ঐতিহ্যের ধারক প্রচ্ছদে অলংকৃত করে প্রকাশ করেছে। বিভিন্ন রঙের সুদৃশ্য কভারের উপর সোনালী রঙের ইসলামী ধাঁচের প্রচ্ছদ দেখে এটাকে পবিত্র কুরআনের তাফসীর বা পবিত্র হাদিসগ্রন্থ বলে ভুল করা অস্বাভাবিক নয়।
গ. ইসলামী পরিভাষা ও নামাবলী ব্যবহার: খৃষ্টান মিশনারিরা তাদের ধর্ম গ্রন্থের নাম পরিবর্তনের সাথে সাথে ইসলামী পরিভাষা, শব্দ ও নামাবলী চুরি করে তাদের ধর্মগ্রন্থ ও বইগুলো প্রকাশ করে চলেছে। তাদের পবিত্র বাইবেলের কিছু শব্দ উল্লেখ করা হলো, যে শব্দগুলোকে তারা তাদের গ্রন্থ কিতাবুল মুকাদ্দাসে ইসলামী পরিভাষা ও নামের রূপ দিয়েছে (কিতাবুল মুকাদ্দাসের পরিবর্তিত রূপ ব্র্যাকেটে উল্লেখ করা হলো): আদিপুস্তক (আল-তৌরাত), প্রথম সিপারা (পয়দায়েশ), পরমগীত (নবীদের কিতাব সোলায়মান), গীতসংহিতা (আল জবুরঃ প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম সিপারা), ঈশ্বর (আল্লাহ), ঈশ্বর পুত্র (ইবনুল্লাহ), পরিত্রাণ (নাজাত), ভাববাদী (নবী), ভজনা (এবাদত), বিশ্বাস (ঈমান), ব্যবস্থা (শরীয়ত), আব্রাহাম (ইব্রাহীম), মোশি (মুসা), দায়ুদ (দাউদ), যীশুখৃষ্ট (ঈসা মসীহ), দূত (ফেরেশতা), শির্ষ (সাহাবী), প্রায়শ্চিত্ত (কাফফারা), উবড় (সিজদা), যাচঞা (মুনাজাত), অলৌকিক কার্য (মোযেজা) ইত্যাদি।
কোন কোন খৃস্টান মিশনারী কাজ করছে
বর্তমানে বাংলাদেশে ২১ টি এনজিও মিশনারী কাজ চালাচ্ছে। সেগুলো হলো: (১) কারিতাস, (২) এন.সি.সি. (ননলাইট সেন্ট্রাল কমিটি), (৩) লুথারান মিশন, (৪) দ্বীপশিখা, (৫) সালভেশন আর্মি, (৬) ওয়ার্ল্ড ভিশন, (৭) সি.ডি.এস. (সেন্ট্রাল ফর ডেভেলপম্যান্ট সার্ভিস), (৮) আর.ডি.আর.এস. (রংপুর দিনাজপুর রোড এন্ড সার্কেল), (৯) সি.সি.ডি.ভি. (খৃষ্টান কমিশন অফ ডেভেলপম্যান্ট), (১০) হিড বাংলাদেশ, (১১) সেভেন ডে এডভেঞ্চারিস্ট, (১২) চার্চ অফ বাংলাদেশ, (১৩) পের ইন্টারন্যাশনাল, (১৪) সুইডিশ ফ্রেমিশন, (১৫) কনসার্ন, (১৬) এডরা, (১৭) অস্ট্রেলিয়ান ব্যাপটিস্ট সোসাইটি, (১৮) এমসিনি, (১৯) ওয়াই.ডব্লিউ.সি. (২০) ফেমিলিজ ফর চিলড্রেন, (২১) আল-হানিফ কল্যাণ ট্রাস্ট ইত্যাদি।
এরমধ্যে ‘হিড বাংলাদেশ’ মৌলভী বাজারে, কমলগঞ্জে, সুন্দরবনে সেবার আড়ালে খৃষ্টধর্ম প্রচার করে যাচ্ছে। সূচনাতেই তারা ৬ লক্ষ মার্কিন ডলার নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে। ‘সেভেন ডে এডভেঞ্চারিস্ট’ খৃষ্টান মিশনারি তাদের সহযোগীদের মাধ্যমে ৮৫ টি প্রাইমারী স্কুল, মাধ্যমিক স্কুল পরিচালনা করে। এসব স্কুলে কোন মুসলমানের সন্তান ভর্তি নেওয়া হয় না। ‘সি. সি. ডি. ভি.’ নামক সংস্থা রংপুর, দিনাজপুরসহ উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে কাজ করছে।
তারা বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে খৃস্টধর্ম প্রচার করে বেশি। যেমন এগুর্ণা, চাকমা, মারমা, তনচৈঙ্গা, চাক, ক্ষুমি, ভৌম, ত্রিপুরা, খাশিয়া, মনিপুরী, খিয়াং, মাংখু, লুশাই, মগ, গারো, মুরু, সাঁওতাল, রাখাইন, হাজং, রাজবংশী, মুরং, কুকি, হুদি, পাংখো, উড়াও, বোনজোগী, দালই, লুসাই, খুশী, তংচংগা, বংশাই, বোম, মুনী চাক, চোক, হরিজন, মুন্ডা ইত্যাদি। এরমধ্যে সাঁওতালরা অধিকাংশই খৃস্টান হয়ে গেছে।
উত্তরাঞ্চল কোন ধর্মপ্রদেশের আওতায়
তারা সমগ্র বাংলাদেশকে প্রচারের আওতাভুক্ত করার জন্য ১৯৬৮ সালে ১লা সেপ্টেম্বর তৎকালীন ঢাকা মহাপ্রদেশের অধীনে পুরো পূর্ব পাকিস্তানকে চারটি ধর্ম প্রদেশে বিভক্ত করে।
১. চট্টগ্রাম ধর্মপ্রদেশ: এ ধর্মপ্রদেশের আওতাভুক্ত এলাকা প্রদেশের সমস্ত দক্ষিণাঞ্চল।
২. দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশ: দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে এ ধর্মপ্রদেশ। এ ধর্মপ্রদেশের পরিধি যমুনা নদীর পশ্চিমাঞ্চল তীর থেকে দক্ষিণে পদ্মা এবং পশ্চিমে ভারতীয় সীমান্ত এলাকা পর্যন্ত।
৩. খুলনা ধর্মপ্রদেশ।
৪. ময়মনসিংহ ধর্মপ্রদেশ।
কী ক্ষতি হচ্ছে
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মো. শহীদুল হক বলেন, ধর্মীয় জনগ্রাফি চ্যাঞ্জ হয়ে যাচ্ছে। তারা গোপনে গোপনে মুসলিম নাম ধারণ করে কাজ চালাচ্ছে। এতে অনেকে বিভ্রান্ত হচ্ছে। এটা ধর্মীয় ক্ষতি। এছাড়াও আর্থ সামাজিক ক্ষতি তো আছেই। ক্রমান্বয়ে আমরা ক্ষমতাহীন হয়ে যাব। যেমন, মক্তব বন্ধ করে দেয়া হবে। দাঈ ইমামদের খুন করা হবে। যেটা আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি। বিভিন্ন অঞ্চলে তারা যেমন কর্তৃত্ববাদী মনোভাব দেখাচ্ছে, এক হিসেবে সেটা স্বাধীনতার উপরও হস্তক্ষেপ।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট শাহিন হাসনাত বলেন, ধর্ম প্রচার সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু অসততা ও প্রতারণায় আশ্রয় নিয়ে ধর্ম প্রচার অপরাধ। সেবার নামে তারা খৃষ্টধর্মের শিক্ষা দিচ্ছে। আমাদের তরুণ সমাজ, যারা ক্যারিয়ার গড়তে চায়, তারা ঝুঁকে পড়ছে। খৃস্টান মিশনারীর সহযোগিতায় বিভিন্ন স্কলারশিপ, ওয়ার্কশপ ইত্যাদিতে যোগ দিচ্ছে। ভাবচে তাদের সঙ্গে থাকলে আমাদের ক্যারিয়ার উজ্জ্বল হবে। এটাই সবচে ভয়ের কারণ।
উত্তরণে করণীয় কী
অধ্যাপক মো. শহীদুল হক বলেন, এর থেকে উত্তরণের জন্য আমাদেরকে বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে।
ক. সরকারকে বুঝাতে হবে, যেন সরকার প্রভাবিত না হয়। সমাজকল্যান অধিদপ্তর, এনজিও ব্যুরোকে বলতে হবে, তারা যেন মিশনারী এনজিওগুলোর প্রতি দৃষ্টি রাখে, তারা কখন কী করে। তাদের অর্থের উৎস কী।
খ. বাংলাদেশী দাঈদের সতর্ক হতে হবে। দাঈদের সংগঠন বাড়াতে হবে। বর্তমানে দাঈ দরকার ১০ হাজার। সেখানে কাজ করছে মাত্র ৩০-৪০ জন।
গ. আলেমদের সোশ্যাল এক্টিভিটি বাড়াতে হবে। দরিদ্রদের পাশে দাঁড়াতে হবে। যেন আলেমরাই মূলধারা হয়ে যান।
ঘ. এলাকাভিত্তিক মক্তবশিক্ষা বাড়াতে হবে। টার্গেট করে আলোচিত অঞ্চলে কাউন্সেলিং করতে হবে।
ঙ. মেইনস্ট্রিম গণমাধ্যমে আলাপ তুলতে হবে। ফিচার, ক্রোড়পত্র, সাময়িকী, বিশেষ সংখ্যা, রিপোর্ট ও প্রতিবেদন করে সবাইকে জানাতে হবে।
চ. একাডেমিয়া গড়ে তুলতে হবে। যেখান থেকে প্রতি বছর জরিপ প্রকাশ করা হবে, প্রতিবেদন ও বার্ষিক রিপোর্ট তৈরী করতে হবে। তৈরী করতে হবে রিসার্চ পেপাার। বাংলা ছাড়াও বিভিন্ন ভাষায়। যেন আন্তর্জাতিক মুসলিম সমাজ সতর্ক হয়ে বাংলাদেশের উপর চাপ প্রেয়োগ করতে পারে মিশনারীদের ব্যাপারে।
মিডিয়া কাভারেজ কতটুকু সম্ভব
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট শাহিন হাসনাত বলেন, খৃস্টান মিশনারীদের খবর প্রকাশ করা ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, তাদের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করলে তারা ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে ইন্টারফেইথ হরমোনি নষ্ট হবার অভিযোগে মামলা করে দিতে পারে। সরকারও এই আইনের ব্যাপারে খুব কঠোর। সুতরাং একদম খোলামেলা প্রচারণা চালানো যাবে না। তবে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সংস্থা জরিপ প্রকাশ করে জনগণকে সতর্ক করা যায়। জরিপে সেই ভয়টা থাকে না।
The post ‘ঈসায়ী মুসলিম’ : উত্তরবঙ্গে বিস্তৃত হচ্ছে ষড়যন্ত্রের ছায়া appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%88%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a7%9f%e0%a7%80-%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%b8%e0%a6%b2%e0%a6%bf%e0%a6%ae-%e0%a6%89%e0%a6%a4%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%b0%e0%a6%ac%e0%a6%99%e0%a7%8d/
No comments:
Post a Comment