Tuesday, July 19, 2022

ধর্ম অবমাননার শাস্তি চান হিন্দু নেতারাও

রাকিবুল হাসান নাঈম:

নড়াইলে হিন্দু যুবক আকাশ সাহা মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে কটূক্তি করায় প্রতিবাদে উত্তপ্ত দেশ। শুক্রবার জুমার নামাজের পর প্রতিবাদ জানান স্থানীয় মুসল্লিরা। তাদের দাবি, ধর্ম অবমাননাকারীর বিচার নিশ্চিত করা হোক। ধর্ম অবমাননাকারীর বিচার কেবল মুসলিমরাই চাচ্ছেন না, চাচ্ছেন হিন্দু নেতারাও। তারা বলছেন, ধর্ম অবমাননাকারী যে সম্প্রদায়েরই হোক, তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করা সরকারের দায়িত্ব। অপরাধী যদি তাদের নিজের সম্প্রদায়েরও হয়, তবুও তারা অপরাধী গ্রেফতারে শতভাগ সহযোগিতা করবেন।

এক মাসের কম সময়ের মধ্যে নড়াইলে ফেসবুকে ধর্ম অবমাননাকে কেন্দ্র করে দুবার অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটল। এবার উত্তেজিত জনতা সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকটি বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরও চালিয়েছে। অনেকে বলছেন, দেশে ধর্ম অবমাননার বিচার না হওয়াতেই এসব ঘটনা বারবার ঘটছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী ফাতেহকে বলেন, ‘এভাবে একটা পোস্ট দেখেই হামলা করা, জ্বালিয়ে দেয়া কোনো যুক্তিতেই ঠিক না। সরকার চেষ্টা করলে এটা থামাতে পারতো। যখন ফেসবুক পোস্ট ভাইরাল হয়, ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি চাইলে সেটা সত্য কি মিথ্যা যাচাই করতে পারে। প্রশাসন আশু বিপদ প্রতিরোধে সতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু কেউ কোনো উদ্যোগ নেয় না। প্রশাসন আসে সবকিছু জ্বলে ছাই হয়ে যাবার পর।’

ধর্ম অবমাননা যেই করুক, চাই সেটা অমুসলিম কেউ কিংবা মুসলিম, তার বিচার চান এ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘ধর্ম অবমাননা সংবিধানবিরোধী কাজ। আমাদের সংবিধান এটার অনুমতি দেয় না। সংবিধানের নিয়ম রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব। ধর্ম অবমাননামূলক পোস্ট যে করবে, তদন্ত পরে, সরকারের উচিত তাকে আগে প্রোটেকশনে নেয়া, যেন তাকে বিচারের মুখোমুখি করা যায়। তারপর তদন্তে যে অপরাধী হয়, সে শাস্তি পাবে। এটা না করলে একজনের দায়ে ক্ষতির মুখে মুখে পড়ে পুরো গ্রাম, সম্প্রদায়। এসব ঘটনা বারবার ঘটছে।’

কথা হয় বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্তের সঙ্গে। তার মতে, হিন্দুদের নামে ইসলাম ধর্ম অবমাননা করে যে পোস্ট ভাইরাল হয়, সেগুলো ফেইক আইডি থেকে করা। প্রশাসন দায়িত্ব পালন না করায় গুজবে প্রতারিত হয়ে মুসলিমরা হিন্দুদের উপর হামলা চালায়। প্রতিবেদককে তিনিও বলেন, ‘বাংলাদেশে ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি আছে। সরকারের প্রশাসন আছে। ফেসবুক পোস্ট তাদের চোখে পড়ে। কিন্তু আসন্ন বিপদ প্রতিরোধে তারা উদ্যোগ নেয় না। ফলে এসব ঘটনা ঘটছে। সরকার, প্রশাসন এবং রাজনৈতিক দল যদি চায়, এসব হামলা তারা থামাতে পারবে।’

এ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্তের বক্তব্য হলো, একজন ব্যক্তির দায় সম্প্রদায় নিবে না। জানতে চাইলাম, দায় নিতে না চাইলে তো ধর্ম অবমাননার অপরাধের বিচার চাইতে হবে। দাশগুপ্ত বলেন, ‘আমরা তো বিচার চাই। যে ধর্ম অবমাননা করবে, চাই মুসলিম কিংবা অমুসলিম, সরকার তার বিচার করুক। আমাদের সম্প্রদায়ের কেউ হলে আমরা অপরাধীকে ধরতে সাহায্য করবো। কিন্তু বিচারের উদ্যোগ তো নিতে হবে। হামলা করার পর প্রশাসন আসে, টিন আর বিশ হাজার টাকা দেয়। এটা কোনো কথা! এ পর্যন্ত এসব ঘটনায় একজনেরও বিচার হয়নি।’

বিশ্বের অনেক দেশে ধর্মীয় অবমাননা, বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের অবমাননার বিরুদ্ধে কঠোর আইন রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম’এর ২০১৭ সালের রিপোর্টে ৭১টি দেশের তালিকা উঠে আসে যেখানে ব্লাসফেমি আইন রয়েছে। এই আইনের অধীনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। যুক্তরাষ্ট্রের ‘লাইব্রেরি অব কংগ্রেস’ এর মতে ২০১৭ সালে ৭৭টি দেশের আইনে ‘ব্লাসফেমি, ধর্ম অবমাননা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও অনুরূপ আচরণ’কে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক শ্রী রমেন মন্ডল ফোন ধরেই বেশ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন। প্রতিবেদককে তিনি বললেন, ‘দাদা, বিষয়টি নিয়ে আমি একদমই হতাশ এবং ক্ষুব্ধ। একজন পোস্ট দিল, আর একদল এসে গ্রাম জ্বালিয়ে দিল, এটা কেমন কথা! দেশের প্রশাসন, আইন, সংবিধান, সরকার কোথায় গেলো।’

ধর্ম অবমাননার প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি বললেন, ‘ধর্ম অবমাননাকারীর বিচার তো আমরা চাইই। যে দোষ করবে, প্রশাসন তাকে বিচারের মুখোমুখ করুক। এতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। বিচারহীনতার এ দেশে আমি শঙ্কিত।’

বাংলাদেশে ধর্ম অবমাননার আইন ও শাস্তি

বাংলাদেশে যে আইনে ফৌজদারি অপরাধের বিচার করা হয়, সেই ১৮৬০ সালের ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে ধর্মীয় অবমাননার বিষয়ে সুস্পষ্ট আইন রয়েছে। আইনটি ১৯২৭ সালে সংশোধন করে নতুন একটি ধারা যোগ করা হয়। এই আইনের ২৯৫ থেকে ২৯৮ ধারায় ধর্মীয় অবমাননার ব্যাখ্যা ও শাস্তির বিষয়ে বলা হয়েছে।

ফৌজদারি দণ্ডবিধির ২৯৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোন ধর্মীয় স্থান বা সেখানকার কেনা বস্তু ধ্বংস করা, ক্ষতি করা বা অসম্মান করাকে ধর্মীয় অবমাননা হিসাবে গণ্য হবে। এক্ষেত্রে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। পরবর্তীতে ১৯২৭ সালে একটি সংশোধনীতে ২৯৫(ক) ধারায় যোগ করা হয়েছে, ইচ্ছাকৃতভাবে দেশের কোন নাগরিককে মৌখিক, লিখিতভাবে বা অন্য কোন উপায়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হলে তা ধর্মীয় অবমাননা বলে গণ্য হবে। এরকম অপরাধের ক্ষেত্রে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। একই আইনের ২৯৬ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, আইনসঙ্গতভাবে আয়োজিত ধর্মীয় কোন সমাবেশ বা অনুষ্ঠানে কেউ বাধা বা বিশৃঙ্খলার তৈরি করলে সেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে। তাহলে এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। ২৯৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তির ধর্মানুভূতিতে আঘাত করার উদ্দেশ্যে ধর্মীয় কোন স্থানে অনধিকার প্রবেশ করা, মৃতদেহের অসম্মান অথবা শেষকৃত্যানুষ্ঠানে সমস্যা তৈরি করা হলে সেটাও ধর্মীয় অবমাননা বলে গণ্য হবে। এরকম অপরাধের ক্ষেত্রে এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। ফৌজদারি দণ্ডবিধির ২৯৮ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ধর্মানুভূতিতে আঘাত করার উদ্দেশ্যে কোন বাক্য বা শব্দ বিকৃত করা, এমন অঙ্গভঙ্গি করা যাতে তার ধর্মবিশ্বাস আহত হতে পারে, এমন আচরণ করা হলে এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। সেই সঙ্গে জরিমানারও বিধানও রয়েছে।

২০১৮ সালে বাংলাদেশে যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তৈরি করা হয়েছে, সেখানে প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বা ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত করার শাস্তি আরও বাড়ানো হয়েছে। এই আইনের ২৮ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ কোন কিছু প্রকাশ, সম্প্রচার, ওয়েবসাইট বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রচারের মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কারো ধর্মীয় বিশ্বাস বা মূল্যবোধে আঘাত করেন, তাহলে সেটা একটা অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। এ ধরণের অপরাধ করলে অনূর্ধ্ব সাত বছরের কারাদণ্ড এবং অনূর্ধ্ব ১০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে। তবে কেউ যদি দ্বিতীয়বার একই ধরণের অপরাধ করেন, তাহলে তার অনূর্ধ্ব ১০ বছরের কারাদণ্ড, ২০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।

The post ধর্ম অবমাননার শাস্তি চান হিন্দু নেতারাও appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%a7%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ae-%e0%a6%85%e0%a6%ac%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%b6%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%bf-%e0%a6%9a%e0%a6%be%e0%a6%a8/

No comments:

Post a Comment