Friday, June 26, 2020

জয়নাব গাযালী : শতাব্দীর নুসাইবা বিনতে কা’ব

সাওরা আল বারী :

১.

কায়রোর সামরিক কারাগার। বেশ কয়েকফুট উঁচু এক প্রাচীরের উপর দুর্বল পায়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক নারী। তার পুরো শরীর ক্ষতবিক্ষত। পরনের পোশাকটাও পাশবিক জুলুমের সাক্ষী হয়ে শতচ্ছিন্ন হয়ে আছে। শরীরের জায়গায় জায়গায় জমাট বেঁধে আছে টকটকে লাল রক্ত।

নারীটিকে কিছুক্ষণ আগে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে আসা হয়েছে নতুন এই সেলে। এটা খুবই দুর্গন্ধময় ও নোংরা পানির সেল। এখানে অত্যাচারের এক জঘন্য পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। বন্দিদেরকে ডুবিয়ে রাখা হয় সেলের দুর্গন্ধময় পানিতে, যাতে তাদের ক্ষতস্থানগুলোর ব্যথা ও যন্ত্রণা কয়েকগুণ তীব্র হয়ে ওঠে।

নারীটি প্রাচীরের উপর দাঁড়িয়ে যখন ওপারে পানির সেল দেখতে পেলেন, তার পুরো অস্তিত্ব যেন কেঁপে উঠল। একে তো তার পুরো শরীর ক্ষতবিক্ষত এবং প্রতিটি ক্ষত তাজা, তার উপর জল্লাদের নির্দেশমতো তাকে এই উঁচু প্রাচীর থেকে সেলে ঝাঁপ দিতে হবে। ক্ষোভে নড়াচড়ার শক্তি হারিয়ে ফেললেন তিনি। এত উঁচু থেকে ঝাঁপ দেওয়ার অর্থ আত্মহত্যা করা, অথচ তিনি মনেপ্রাণে শাহাদাত কামনা করেন। বিক্ষত, বিধ্বস্ত ও দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও তিনি জল্লাদের নির্দেশ উপেক্ষা করে গর্জে উঠলেন, ‘আমি আত্মহত্যা করব না! তোমরা যদি আমাকে হত্যা করতে চাও, তাহলে তোমাদেরই এর পূর্ণ দায়িত্ব নিতে হবে!’

ওরা যেন মুহূর্তের জন্য চমকে উঠল। পরক্ষণেই শুরু হল নারীটিকে অকথ্য গালিগালাজ আর অনবরত চাবুকের আঘাত। এত আঘাত সইতে না পেরে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। রক্তে লাল হয়ে উঠল তার পুরো শরীর। জানোয়াররা তখন তাকে শূন্যে উঠিয়ে পানির সেলে নিক্ষেপ করল। শুরু হল এক অবর্ণনীয় যন্ত্রণার অধ্যায়। সেলের নোংরা পানির স্পর্শে ক্ষতগুলোর যন্ত্রণা এত তীব্র হয়ে উঠল যে, তিনি যন্ত্রণা বোধ করার অনুভূতি পর্যন্ত হারিয়ে ফেললেন। ঘণ্টাখানেক আগে তাকে যখন রডের স্ট্যান্ডে জবাইকৃত পশুর মতো উপুড় করে ঝুলিয়ে রেখে পাঁচশ বেত্রাঘাত করা হয়, তখনো তিনি এতটা যন্ত্রণা অনুভব করেননি।

জানোয়ারগুলো তাকে পানির সেলে নিক্ষেপ করার পরও চাবুক মারছিল। ওরা বলল, তাকে প্রতিদিন এক হাজার হান্টার মারার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। এজন্য পানিতে বিন্দুমাত্র নড়াচড়া করলেই তাঁকে দশবার করে হান্টার মারবে। নারীটি নির্বিকার ভঙ্গিতে তাদের কথা শুনলেন। এই অকল্পনীয় ভয়ঙ্কর পরিবেশে তার পক্ষে যে সোজা হয়ে বসে থাকা অসম্ভব, সেটা তিনিসহ সকলেই ভালো করে জানে। কয়েকশ হান্টার সহ্য করার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে নিলেন তিনি। শুরু হলো অত্যাচার…

বিভীষিকাময় রাতটা কেটে গিয়ে ভোরের আলো ফুটল অবশেষে। সারারাত হান্টারের আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে তিনি তখন ব্যথায় টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিলেন। তার এই শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া শরীর, যন্ত্রণায় নীল হয়ে থাকা চেহারা আর বিবর্ণ রঙ দেখে বোঝার উপায় নেই, এই নারী আর কেউ নয়, দেশের লক্ষ তরুণ-তরুণীর প্রিয় সেই মা- জয়নাব গাযালী।

২.

জয়নাব মুহাম্মদ আল গাযালী আল জুবাইলী। ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি মিসরের এক সুন্দর গ্রাম মাইতিনে জন্ম হয় তার। সেখানের বিশুদ্ধ বাতাসে শৈশবও পার করেছেন তিনি। তিনি ছিলেন বাবার আদুরে মেয়ে। তার পিতা জামেয়া আযহারের আলেম। জয়নাব যদিও খুবই অল্পদিন তার পিতাকে পেয়েছিলেন, তবুও এই দিনগুলোতেই পিতার সান্নিধ্যে থেকে তার হৃদয়ে রোপিত হয় ইসলামের দায়ী হওয়ার স্বপ্ন।

ছোট্ট জয়নাবের কাছে আদর্শ হিসেবে বিখ্যাত সাহাবী নুসাইবা বিনতে কা’ব রা.কে উপস্থাপন করতেন তার পিতা। তাকে সম্বোধনও করতেন সায়্যিদা নুসাইবা বলে, যা জয়নাবকে খুবই প্রভাবিত করে। ফলে তিনি প্রায় সময় নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে নামের সাথে নুসাইবা বিনতে কা’ব যুক্ত করে দিতেন।

পিতার ইন্তেকালের পর জয়নাব তার পরিবারের সাথে কায়রো চলে যান। গ্রামে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেছিলেন, কায়রোতে গিয়ে মাধ্যমিক ও জামেয়া আল আযহার থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন।

পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি যোগদান করেন হুদা শা’রাবীর ‘ইজিপশিয়ান ফেমিনিস্ট ইউনিয়ন’ ( – الاتحاد النسائي -) এ। কিন্তু তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে তিনি একমত হতে না পেরে কিছুদিন পর এ সংগঠন ত্যাগ করেন। পরে ১৯৩৬ সালে তিনি তৈরি করেন ‘মুসলিম ওমেন্স এসোসিয়েশন’ ( – جميعة السيدات المسلمات – ) নামে একটি সংগঠন, যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দাওয়াহ ও ইসলামী শিক্ষা। কায়রোর মাসজিদে ইবনে তুলুনে প্রতি সপ্তাহে সমবেত হতেন প্রায় তিন হাজার নারী। তিনি সেখানে বক্তৃতা দিতেন। নারীদের নসিহত করতেন। পাশাপাশি তার সংগঠন থেকে ম্যাগাজিন বের করা হত, এতিমখানা পরিচালনা এবং দরিদ্র পরিবারকে সহায়তা প্রদান করা হত।

জয়নাব গাযালীর চিন্তা, কাজ ও এসব সামাজিক কার্যক্রম ইখওয়ানুল মুসলিমীনের প্রতিষ্ঠাতা হাসান আল বান্নার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি তখন জয়নাবকে ইখওয়ানুল মুসলিমীনের নারী শাখার নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। হাসান আল বান্নার সাথে জয়নাব গাযালীর চিন্তা-চেতনার একাত্মতা ছিল। তবুও মুসলিম ওমেন্স এসোসিয়েশনের কথা ভেবে জয়নাব এ প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। অবশ্য পরবর্তীতে হাসান আল বান্নার শাহাদাতের পর তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ইখওয়ানে যোগদান করেন এবং ইখওয়ানের ঘোর সংকটকালে পালন করেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

ইখওয়ানকে যখন পুনর্গঠনের কথা ভাবা হয়, তখন হাসান আল হুদাইবী, আবদুল ফাত্তাহ ইসমাইলের সাথে তিনিও আলোচনায় অংশ নেন এবং সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তৈরি করেন একটি এডুকেশনাল প্রোগাম, যার মাধ্যমে মুসলিমরা তাদের আকিদায় ফিরে আসবে। তরুণ-তরুণীর মনন নতুনভাবে গঠন হবে, দূর হবে অশ্লীলতা।

এই প্রোগামের ভেতর সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক কিছুই ছিল না, তারপরও তারা প্রেসিডেন্ট নাসেরের রোষানলে পড়ে যান। শুরু হয় এক কালো অধ্যায়।

৩.

১৯৬৪ সাল। এক বিকেলে নিজ গাড়িতে করে বাড়ি ফিরছিলেন জয়নাব। হঠাৎ বিপরীত দিক থেকে একটা গাড়ি এসে তার গাড়িকে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দেয়। তার গাড়িটি সাথে সাথে উল্টে যায়। জয়নাব গুরুতর আহত হয়ে সম্বিৎ হারিয়ে ফেলেন। যখন তার জ্ঞান ফেরে, নিজেকে হাসপাতালের সিটে দেখতে পান। এই অপকর্মটা যে নাসেরের গোয়েন্দা বাহিনীর ছিল, বুঝতে মোটেই অসুবিধা হয়নি তার।

এই এক্সিডেন্টের পর জয়নাব হাসপাতালে থাকা অবস্থায়ই ত্রিশ লক্ষ সদস্যের মুসলিম ওমেন্স এসোসিয়েশনকে নিষিদ্ধ করে সরকার। অথচ ওটা ছিল একটা ইসলামি সংগঠন। জয়নাব ইখওয়ানের সাথে সম্পৃক্ত থাকলেও এই সংগঠন ইখওয়ান থেকে আলাদা হয়ে কাজ করত। তারপর থেকেই শুরু হয় জয়নাবের বাড়িতে গোয়েন্দা বাহিনীর আনাগোনা। বিভিন্ন প্রস্তাব আর প্রলোভন। কিন্তু জয়নাব তাদেরকে চরমভাবে হতাশ করেন।

তখন প্রেসিডেন্ট নাসেরকে হত্যার ষড়যন্ত্র ও দেশে অরাজকতা সৃষ্টির মিথ্যে কাহিনী সাজিয়ে ১৯৬৫ সালের ২০ আগস্ট তাকে কায়রোর সামরিক কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। ওখানে গিয়ে হাজার হাজার ইখওয়ানের উপর কারাগারের পশুদের পাশবিক নিপীড়ন দেখে আঁতকে উঠেন জয়নাব। কাউকে হান্টার দিয়ে অনবরত পেটানো হচ্ছে, কারো চামড়া ফেটে বয়ে যাচ্ছে রক্তের প্লাবন। কাউকে আবার ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে ক্ষুধার্ত কুকুরের মুখে। এসব বীভৎস চিত্র দেখার শক্তি তার রইল না। তিনি সশব্দে আল্লাহর কাছে দুআ কর‍তে লাগলেন। সাথে সাথেই তার উপর শুরু হলো নির্যাতন। তাকে এমন এক কক্ষে আটকে রাখা হলো, যে কক্ষ ছিল হিংস্র কুকুর দিয়ে ভরপুর। কুকুরগুলো তাকে পেয়ে হামলে পড়ল। কয়েক ঘণ্টা ধরে কামড়ে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলল তার পুরো শরীর।

এরপর কুকুরের খাঁচা থেকে বের করে তাকে নেওয়া হলো আরেক বদ্ধ কক্ষে, যেখানে বাইরের কোনো আলো-বাতাস প্রবেশ করতে পারে না। ওরা তাকে ওই রুমে টানা ছয় দিন ছয় রাত বন্দি করে রাখে। এই ছয় দিনে না কেউ একবার দরজা খুলল, আর না কেউ দিল এক ফোঁটা পানি বা সামান্য খাবার। এরপর থেকে শুরু হল জিজ্ঞাসাবাদের নামে নতুন অত্যাচার। অশ্রাব্য গালিগালাজ, লাথি-ঘুষি, অনবরত হান্টারের আঘাত, উল্টো করে ঝুলিয়ে রেখে চাবুক দিয়ে পেটানো, ইঁদুরভর্তি সেলে আটকে রাখা, দফায় দফায় নোংরা পানির সেলে ডুবিয়ে রাখা, জ্বলন্ত আগুনে পোড়ানোসহ পাশবিকতা প্রকাশের বাকি থাকল না কিছুই।

এত অত্যাচার মানুষ কেন, কোনো কিছুর পক্ষেই সহ্য করা সম্ভব নয়। জয়নাবও সহ্য করতে পারতেন না। অচেতন হয়ে পড়তেন তিনি। ব্যান্ডেজ ফেটে রক্তের বান ছুটত। তবুও তাদের কথা মেনে নিতেন না। তারা চাইত, তিনি যেন নাসের হত্যার মিথ্যে ষড়যন্ত্রের কথা স্বীকার করে নেন, ইখওয়ানের বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হন। এজন্য তারা তাকে বোঝাত, প্রলোভন দেখাত, ইখওয়ানের নামে ছলচাতুরী করত, হুমকি দিত। কিন্তু জয়নাব অনড়। তিনি প্রাণ দিতে রাজি, আদর্শ থেকে বিচ্যুত হতে কখনোই রাজি নন।

অবশেষে ১৯৬৬ সালে বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে তাকে ২৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডসহ তার সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হয়। সরকারের লোকেরা তার স্বামীর কাছ থেকে জোরপূর্বক তালাকের কাগজে স্বাক্ষর নেয়। এ ঘটনার পর পরই মারা যান তার স্বামী। সে সময় সাইয়েদ কুতুব, আবদুল ফাত্তাহ ইসমাইল, মুহাম্মদ হাওয়াশের মতো নেতাদের ফাঁসি কার্যকর হয়।

এত অত্যাচার, এত মানসিক কষ্টের মাঝেও শুধু মানবিক দুর্বলতাটুকু ছাড়া জয়নাব ছিলেন স্থির। শান্ত। এ যেন তার পিতার উপাধি দেওয়া সেই মহীয়সী ‘নুসাইবা’।

আদালতের রায়ের পর জয়নাবকে সামরিক কারাগার থেকে বেসামরিক কারাগার কানাতিরে স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানেই তিনি কারাগারের বাকি দিনগুলো পার করেন। অবশেষে আনওয়ার সাদাত মিশরের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ১৯৭১ সালে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।

এই মহীয়সী মা ২০০৫ সালের ৩ আগস্ট কায়রোতে ইন্তেকাল করেন।
.
সূত্র :

১. أيام من حياتي

২. سطور من حياة الداعية زينب الغزالي

The post জয়নাব গাযালী : শতাব্দীর নুসাইবা বিনতে কা’ব appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%9c%e0%a7%9f%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%ac-%e0%a6%97%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a7%80-%e0%a6%b6%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%ac%e0%a7%8d%e0%a6%a6%e0%a7%80%e0%a6%b0-%e0%a6%a8%e0%a7%81/

No comments:

Post a Comment