রাকিবুল হাসান :
ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মরহুম শেখ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ কিছু কওমি মাদরাসার জন্য আর্থিক অনুদান বরাদ্দ করেছেন বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সে নিয়ে তৈরি হয়েছে অনেক অস্পষ্টতা ও বিভ্রান্তি। অনেকেই অনুদানের বিষয়টা জানেন না। বাধ্য হয়ে কেউ কেউ এই অনুদান গ্রহণ করছেন। গ্রহণ না করার তালিকাটাও দীর্ঘ। যারা অনুদান গ্রহণ করেননি তাদের বক্তব্য—ধর্ম মন্ত্রণালয়ের এই অনুদান বিষয়ে তাদের সঙ্গে কেউ যোগাযোগই করেনি।
কিছু নিউজ পোর্টালের খবরে প্রকাশ—ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর অনুদানপ্রাপ্তির তালিকায় রয়েছে- চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসা,জামিয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ মাদরাসা, জামিয়া রাহমানিয়া সাতমসজিদ-মোহাম্মদপুর, ফরিদাবাদ মাদরাসা, মারকাযুদ দাওয়াতিল ইসলামিয়া হযরতপুর কেরানীগঞ্জ, শায়েখ যাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, দারুল উলুম মাদরাসা খুলনা, আল জামেয়াতুল ইমদাদিয়া কিশোরগঞ্জ, জামেয়া শরইয়া মালিবাগসহ আরও কয়েকটি মাদরাসা।
তালিকাটি প্রকাশের পরই প্রতিবাদ জানিয়েছেন মাওলানা মামুনুল হক। এক ফেসবুক পোস্টে তিনি জামিয়া রাহমানিয়া সাতমসজিদ-মোহাম্মদপুর মাদরাসা অনুদান গ্রহণ করেনি বলে জানান। এই পোস্টকে ঘিরে কওমি মহলে তৈরী হয় রহস্য। সেই রহস্যের জট ভাঙতে অনুসন্ধান চালিয়েছে ফাতেহ টুয়েন্টি ফোর।
যারা অনুদান গ্রহণ করেননি
শুরুতেই কথা হয় লালবাগ মাদরাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস ও শুরা সদস্য মুফতি ফয়জুল্লাহর সঙ্গে। ফাতেহ টুয়েন্টি ফোরকে তিনি বললেন, ‘লালবাগ মাদরাসা ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অনুদান গ্রহণ করেনি।’
একই সুরে কথা বললেন জামিয়া রাহমানিয়া সাতমসজিদ-মোহাম্মদপুর মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা মাহফুজুল হক। ফাতেহ টুয়েন্টি ফোরকে তিনি বললেন, ‘পত্রিকায় আমরা অনুদান গ্রহণ করেছি বলে যে খবর এসেছে, তা ভুল। অনুদান বিষয়ে তো আগে জানতে হবে। বিষয়টা আমরা জানিই না, অনুদান গ্রহণ তো দূরের কথা। জামিয়া রাহমানিয়া অনুদান গ্রহণ করেনি।’
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অনুদান প্রসঙ্গটি খানিক খোলাসা করে বললেন শায়েখ যাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ। ফাতেহ টুয়েন্টি ফোরকে তিনি বললেন, ‘ধর্ম মন্ত্রণালয়ের একজন সচিব আমার হোয়াটসঅ্যাপে অনুদানের তালিকাটি পাঠিয়েছেন। এরমধ্যে আমার মাদরাসার নামটিও ছিল। হোয়াটসঅ্যাপ চেক করিনি বলে তালিকাটিও চোখে পড়েনি। একদিন একজন ফোন দিয়ে অনুদান প্রসঙ্গটি তুললো। তখন হোয়াটসঅ্যাপ চেক করে দেখি এই খবর। অনুদান তালিকায় অনুদান গ্রহণের শেষ তারিখ ছিল ৩০ জুন। এই সময়ে অনুদান গ্রহণ না করা হলে সরকারের ফান্ডে চলে যাবে। কিন্তু আমি আর আগ্রহ দেখাইনি। ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকেও যোগাযোগ করা হয়নি আর।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই অনুদান আমরা চাইনি। ধর্ম মন্ত্রণালয় ইচ্ছে করে দিয়েছে। এখন যারা যারা গ্রহণ করতে চায়, করতে পারে। শরীয়তের দৃষ্টিতে কোনো সমস্যা নেই।’
‘আমি কিছু জানি না’
অনুদানপ্রাপ্তির তালিকায় নাম আছে জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম ফরিদাবাদ মাদসারাও। ফরিদাবাদের নায়েবে মুহতামিম মুফতি নুরুল আমিন সাহেব বিষয়টি জানেন না বলে স্বীকার করেছেন। ফরিদাবাদ মাদরাসা অনুদান গ্রহণ করেছে কিনা জানতে চাইলে ফাতেহকে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’ এরপর কথা হয় ফরিদাবাদ মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা আবদুল কু্দ্দুস সাহেবের ছেলে মুফতি যুবায়ের সাহেবের সঙ্গে। তিনি ফরিদাবাদ মাদরাসার শিক্ষকও। ফাতেহকে তিনি বললেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’
মারকাযুদ দাওয়াতিল ইসলামিয়া অনুদান গ্রহণ করেছে কিনা জানতে যোগাযোগ করা হয় মুফতি যাকারিয়া আব্দুল্লাহর সঙ্গে। ফাতেহকে তিনি বললেন, ‘এমনটি হওয়ার কথা নয়। বিষয়টি আমি সঠিক জানি না।’
দারুল উলুম হাটহাজারি মাদরাসা রয়েছে অনুদানপ্রাপ্তির তালিকার শীর্ষে। ফাতেহ থেকে আল্লামা আহমদ শফি সাহেবের ছেলে মাওলানা আনাস মাদানিকে ফোন করা হয় বেশ কয়েকবারই। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তিনি কল রিসিভ করেননি। তবে হাটহাজারি মাদরাসার সিনিয়র শিক্ষক মাওলানা আশরাফ আলি নিজামপুরী ফাতেহকে বলেছেন, ‘হাটহাজারির আশপাশের কয়েকটি মাদরাসা এই অনুদান গ্রহণ করেছে। তবে হাটহাজারি গ্রহণ করেছে কিনা, তিনি জানেন না।’
জামিয়া শরইয়াহ মালিবাগের মুহতামিম মুফতি বুরহানুদ্দিন সাহেবের সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। প্রথম কয়েকবার রিং হলেও কল রিসিভ হয়নি। পরে তার মোবাইলটি বন্ধ পাওয়া যায়। বন্ধ পাওয়া যায় মাদরাসার ফোন নাম্বারটিও। তবে মালিবাগ মাদরাসার মুফতি আব্দুল্লাহ আল মাসুম ফাতেহকে বলেন, মাদরাসা অনুদান গ্রহণ করেছে কিনা তিনি সঠিক জানেন না।
বাধ্য হয়ে অনুদান গ্রহণ
তবে যারা অনুদান গ্রহণ করেছেন, তারাও খুব স্বস্তির সঙ্গে অনুদান গ্রহণ করেননি। যোগাযোগ করা হয় তালিকায় থাকা জামিয়া ইমদাদিয়া কিশোরগঞ্জে। মাদরাসাটির মুহাদ্দিস মাওলানা শোয়াইব আবদুর রউফ ফাতেহকে বলেন, ‘আমরা দুদল্যমানায় ছিলাম অনুদান নিব কিনা। কিশোরগঞ্জের আরও বিভিন্ন মাদরাসা অনুদান নিয়েছে। পরে আমরাও নিয়েছি।’
অনুদান গ্রহণ করেছে দারুল উলুম খুলনা। মাদরাসাটির ভাইস প্রিন্সিপাল মাওলানা আবদুল হাফিজ ফাতেহকে বলেন, ‘আমরা অনুদান গ্রহণ করেছি।’ তবে অনুদান গ্রহণের অস্বস্তিকর গল্পটি বলেছেন এ মাদরাসারই শিক্ষক মুফতি মাহফুজুল হক। ফাতেহকে তিনি বললেন, ‘রমজানে সরকারের পক্ষ থেকে যে অনুদান দেয়া হয়, তা গ্রহণ করতে আমরা অস্বীকৃতি জানাই। দু’বার অনুদানের টাকা ফিরিয়ে দেই। কিন্তু ডিসি মহোদয় বললেন, আপনারা হয়তো জামাত-শিবির, তাই অনুদান নিচ্ছেন না। বাধ্য হয়েই আমরা তখন অনুদান গ্রহণ করি। এবার ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অনুদানটিও গ্রহণ করি। আমরা গিয়ে আনিনি। আমাদের তহবিলে চলে এসেছে।’
মৃত্যুর আগে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মো. আবদুল্লাহ মন্ত্রী হিসেবে প্রাপ্য মন্ত্রীর তহবিল থেকে দেশের বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা আর্থিক অনুদান বরাদ্দ দিয়েছেন। অনুদানের তালিকায় ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় অবস্থিত ৩৫৯টি প্রসিদ্ধ কওমি ও আলিয়া মাদরাসাসহ হেফজখানা এবং এতিমখানার নাম রয়েছে। তালিকায় নাম থাকলেও অনেক মাদরাসাকে জানানোই হয়নি। যাদেরকে জানানো হয়েছে, তাদের কেউ বাধ্য হয়ে গ্রহণ করেছে, কেউ করেনি। তবে খবরে প্রকাশিত বিভিন্ন মাদরাসার মুহতামিমগণ তারা অনুদান গ্রহণ করেছেন বলে যে খবর বেরিয়েছে, তার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। মাওলানা মাহফুজুল হক বলেছেন, ‘সত্য না জেনে নিউজ করা সাংবাদিকতার নীতিপরিপন্থী। অনুদানের ক্ষেত্রে এই নীতিপরিপন্থী কাজটাই হয়েছে।’
The post কওমি মাদরাসায় ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ‘গায়েবি’ অনুদান appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%95%e0%a6%93%e0%a6%ae%e0%a6%bf-%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a7%9f-%e0%a6%a7%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ae-%e0%a6%ae%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a7%8d/
No comments:
Post a Comment