Friday, June 26, 2020

অন্ধকার জীবনের যন্ত্রণা : কারাগারের কথকতা

পৃথিবীর মধ্যেই আরেক পৃথিবী বলা হয় কারাগারকে। কারাগার ফেরত মানুষরা বলছেন, পৃথিবী নয়, কারাগার এক অমানবিক নিষ্ঠুর নরক। ফাতেহকে সেই নিষ্ঠুর পৃথিবীর গল্প শুনিয়েছেন আব্দুর রহমান , রেদওয়ান শাকিল এবং ফায়েজ আহমাদ। এগুলো তাদের ছদ্মনাম, বাংলাদেশে স্বনামে কারাজীবনের গল্প বলা এখনো খুব স্বাভাবিক বিষয় নয়। 

আব্দুর রহমান

কারো কাছে কারাগার হলো একটি নোংরা জনাকীর্ণ স্থানে টিকে থাকার সংগ্রাম। তৃতীয় বিশ্বের এই দেশের গাদাগাদিপূর্ণ জেলখানায় গিয়ে কারো মনে অসাধারণ কোন ‘আত্মোপলব্ধি’ জন্মাবে এমনটা ভাবাও কঠিন।  কারণ সেখানে নিজের নিতান্ত মৌলিক প্রয়োজনগুলো পূরণের সংগ্রামেই ব্যস্ত থাকতে হয়। এই দেশে পৃথক সেলে একাকী বন্দি রাখার আয়োজন নেই, তবে অল্পকিছু ব্যতিক্রম আছে। সেলগুলোতে একজনের থাকার কথা থাকলেও কমপক্ষে তিন-চারজন গাদাগাদি করে থাকতে হয়। আর ওয়ার্ডের কথা তো বলাই বাহুল্য! সেখানে প্রতিটি কক্ষে ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেকগুণ বেশি লোক গাদাগাদি করে থাকে।  এসব জায়গায় নিজের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করাই কঠিন, সেখানে একটু অবসর হয়ে কেউ বসে ‘কিছু’ ভাববে, আত্মোপলব্ধি করবে- এগুলো কষ্টকল্পনা ছাড়া কিছুই নয়! এখানে সবচেয়ে বড় সংগ্রাম হলো ঠিকমতো টয়লেট করতে পারা এবং অযু-গোসল করে সালাত আদায় করতে পারা। এটাই কারাগারের অন্যতম বড় অর্জন!

এছাড়া যদি কিছু পাওয়া যায় তাহলে পুরোটাই বোনাস।  তবে জীবন কখনো থেমে থাকে না, আর মানুষের অভিযোজন ক্ষমতাও অসাধারণ। বিভিন্ন কঠিন জায়গাতেও মানুষ নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে এবং নিজের মতো করে সবকিছুর একটি বিকল্প বানিয়ে নেয়। কাজেই, যে ‘কল্পনাবিলাসী’ সে কারাগারের দেয়ালের খসে যাওয়া পলেস্তরা দেখেও ‘আপন মনে’ অনেক কিছু ভেবে নেয়, আবার যে মাদকাসক্ত সে কারাগারে থেকেও আসক্তি পূরণের আয়োজন করে, আবার যারা জোর জুলুম করে মানুষের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে অভ্যস্ত তারা কারাগারে থেকেও বিভিন্ন উপায়ে বন্দীদের থেকে অর্থ রোজগারের পথ চালু রাখে।

আমার সৌভাগ্য আমি সেলে থাকতে পেরেছি, ফলে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের সাথে সংগ্রাম করে টয়লেট কিংবা অযু-গোসল করতে হয়নি। প্রয়োজনমতো টয়লেট করতে পেরেছি, পাক-পবিত্রতা অর্জন করতে পেরেছি, নামাজ আদায় করতে পেরেছি।  যদিও এর জন্য অনেক টাকা পয়সা খরচ করতে হয়েছে, সে আরেক কাহিনী!

সেলে বন্দিত্বের মধ্যে যখন লোডশেডিং হতো তখন সেটা আশীর্বাদের মতো মনে হতো। বাইরের মুক্ত পৃথিবীতে যেমনভাবে পূর্ণিমা রাত বিশেষ আয়োজন নিয়ে আসে, ঠিক তেমনিভাবে কারাগারে লোডশেডিং বিশেষ রহমত মনে হয়। কিছুটা সময় হলেও মাথার উপর জ্বলজ্বলে বিরক্তিকর বাতি থেকে চোখটা বিশ্রাম পায়।  তবে ওয়ার্ডের কথা আলাদা, সেখানে একদল মানুষ বুনো আনন্দে থালাবাটি পিটিয়ে নানারকম গান-বাজনা হৈচৈ শুরু করে, আর অন্ধকারের মধ্যে গুনাহের কাজও চলতে থাকে। মানুষগুলোকে তখন পশু বলেই মনে হয়।

আমার পাশে কিছুদিন এক মুরুব্বী ব্যক্তি ছিলেন। প্রায়ই দেখতাম রাতের বেলা সবাই ঘুমিয়ে গেলে তিনি উঠে বসে থাকতেন এবং কখনো ঘুম ভেঙে তার দিকে তাকালে দ্রুত নিজের লাল চোখ লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করতেন। কিছুদিন পরেই জামিন হয়ে গেল। তখন তিনি বিদায় নিলেন, দুনিয়া থেকে মুমূর্ষ কেউ যেভাবে বিদায় নেয়, যেন অনেকটা সেরকম। একজন বন্দীর মুক্তি যেন মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তির সম্পত্তি বন্টন। কারাগারে একজন বন্দীর আর কিইবা সম্পদ থাকতে পারে? সামান্য গাট্টি বোঁচকা, কাপড়-চোপড় আর টুকটাক ব্যবহার্য্য জিনিস ছাড়া? এরমধ্য থেকে একটি জিনিস আমার কাছে অমূল্য মনে হলো। তিনি বিস্কুটের প্যাকেট একটা দশ বারো লাইনের কবিতা আমাকে দিলেন। কবিতাটি ভুলে গেছি, কাগজটিও সংরক্ষণ করা হয়নি। তবে কিছু লাইন অন্তরে দাগ কেটে আছে। তিনি লিখেছিলেন,

‘রাত্রি বাজে বারোটা
ঘুম নেই দুচোখে
লালচে চোখে লাইটের আলো
জ্বলছে আগুন বুকে!’

জানিনা, এটা তার নিজের কবিতা নাকি অন্য কারো কাছ থেকে লেখা।  তবে এই কয়টা লাইন এখনো মনে আছে। আরো কিছু লাইনে তিনি নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছিলেন।  যেমন- বন্দী অবস্থায় বাইরে ঘুরে বেড়ানোর আকুতি, বাইরের পৃথিবী দেখার ইচ্ছা, মুক্ত আকাশ দেখার ইচ্ছা, চাঁদ কিংবা পূর্ণিমা রাতে কোন মাঠে বসে থাকার ইচ্ছা- এগুলি বাকি লেখায় উঠে এসেছিল।

সবচেয়ে আপত্তিকর ও ক্লান্তিকর বিষয়য়গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো কোর্টে হাজিরা দিয়ে আসার সময় আসার কারারক্ষীদের হাতে বাজেভাবে দৈহিক তল্লাশির শিকার হওয়া।  নিতান্ত বাজেভাবে লজ্জাস্থান পর্যন্ত চেক করতো এবং কোন কিছু লুকিয়ে এনেছি কিনা যাচাই করতো। প্রযুক্তির এই যুগে এই ধরণের পদ্ধতিতে তল্লাশি করার কতটুকু যৌক্তিকতা আছে, আমার জানা নেই। এটি অত্যন্ত বাজে অভিজ্ঞতা।

আরেকটি বাজে অভিজ্ঞতা হচ্ছে কারাগারের পুরনো বন্দী ও কারারক্ষী-কারাকর্মকর্তাদের সমন্বিত ও সিস্টেমেটিক চাঁদাবাজির শিকার হওয়া। নিয়মিত টাকা না দিলে ‘ভালো জায়গায়’ থাকতে না পারা, একেবারে নোংরা পরিবেশে থাকতে বাধ্য হওয়া কিংবা সাধারণ মৌলিক প্রয়োজনীয় খাবারও উচ্চদামে কিনে খাওয়া- এগুলো বাজে স্মৃতি। ‘সরকারি খাবারগুলো মুখে দেওয়ার মতন নয়’- এ কথাটি যখন প্রথম শুনেছিলাম তখন আমিও ভেবেছিলাম, যতই খারাপ হোক, ওটাই খাব! কিন্তু আসলে খাওয়ার যোগ্য নয়। যদিও অনেকাংশেই এগুলো ইচ্ছাকৃত।  ভিতরে পৃথক ক্যান্টিনের ব্যবসা রমরমা রাখার আয়োজন।  ঐ খাবার কিনে না খেলে টিকে থাকা সম্ভব নয়। বাইরের পৃথিবীর জুলুমের একটি ক্ষুদ্র ভার্সন কারাগারেও চলে, যেভাবে অন্যান্য জায়গায় আমরা নানারকম সিন্ডিকেট দেখতে পাই, তেমনি বিষয়টা।

পুরান ঢাকার জেলে আরেকটি আতঙ্ক ছিল নিম্নমানের টয়লেট; বিশেষ করে ওয়ার্ডে প্রায় এক থেকে দেড়শ লোকের জন্য মাত্র একটি টয়লেটের ব্যবস্থা! কিন্তু সেখানেও কোন পানির ব্যবস্থা নেই! হ্যাঁ, পাশে কয়েকটি ড্রাম ভর্তি পানি ছিল, তবে সেটাও কিনে ব্যবহার করতে হতো। আরেকটি ক্লান্তিকর অভিজ্ঞতা হলো প্রতিদিন সকালে ওয়ার্ডে কারারক্ষীদের গণনা এটেন্ড করা।  সাত সকালে বাজেভাবে ধাক্কা-গুঁতো দিয়ে, ঘুম থেকে উঠিয়ে ‘হাগু পজিশনে’ বসিয়ে ‘গুনতি’ মেলাতে হতো। তখন মনে হতো কারারক্ষীদের যোগ অংক মেলানো পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ।

কারাগারে ধর্মচর্চার প্রসঙ্গ আসতেই জয়নাব গাযালীর ‘কারাগারে রাতদিন’ বইয়ের কিছু কথা মনে পড়ল। জয়নাব গাযালী একটি অংশে বর্ণনা করেছেন, দীর্ঘ সময় একাকী সেলে বন্দি থাকার পর তাকে মূল কারাগারে প্রেরণ করা হয়। সেখানে তাকে অসংখ্য বন্দীদের সাথে থাকতে হচ্ছিল। সেই রকম একটি স্থানে নিজের পবিত্রতা অর্জন করা, ওযু করা, টয়লেট করা- এটাই প্রধান চ্যালেঞ্জ। আর বন্দীদের মধ্যে বিরাট অংশ নেশাগ্রস্ত, নানারকমের অনৈতিক কাজে জড়িত। এইসব মানুষদের খারাপ সাহচর্য থেকে বেঁচে থাকাই একটি বড় ধর্মচর্চা।

পরিহাসের বিষয় হলেও সত্যি আমি কারাগারে বসেই এই বইটি পড়েছি। মানুষের হাতে হাতে অল্প কিছু বই ঘুরে, মাসুদ রানা থেকে হুমায়ুন আহমেদ, এরকম আরও কিছু বই আছে। আর কারাগারের লাইব্রেরী অনেকাংশেই শুধু আনুষ্ঠানিকতা। একদিন খুব আগ্রহ নিয়ে সেখানে গিয়ে দেখি, লোকেরা হাপুস হুপুস করে ড্রামের পানি মাথায় ঢেলে গোসল করছে।  তবে বাকি অংশে কিছু বইয়ের তাক আছে।

ওয়ার্ডগুলোতে নিয়মিত নামাজ হয় এবং কোন একটি নির্দিষ্ট কোনায় পশ্চিম দেয়ালে ‘আল্লাহু আকবার’ লেখা অথবা মসজিদের একটি চিহ্ন এঁকে কিছুটা জায়গা অনানুষ্ঠানিকভাবে নামাজের জন্য নির্দিষ্ট করা থাকে। এটি অনেক মন্দের মধ্যেও একটি ভালো বিষয়- বলতেই হবে। আবার সেলগুলোর বারান্দাতে নামাজের আয়োজন আছে। এটাও অনানুষ্ঠানিক। অফিসিয়ালি, ইচ্ছাকৃতভাবেই নতুন জেলে নামাজের জায়গা বা মসজিদ রাখা হয়নি, পুরান ঢাকার জেলে ‘মসজিদ’ ছিল, আসলে সেটা হলো একসাথে অনেকের কয়েক ওয়াক্ত নামায আদায়ের জায়গা, পুরোদমে মসজিদ নয়।  তবে জুমার দিনে সেখানে জুমার সালাত পড়ানো হতো, যদিও বন্দীশালায় জুমার সালাত হয় কিনা-এক্ষেত্রে ফিকহের বিধান ভিন্ন, সেটা ভিন্ন আলাপ।

কারাগারে পুরনো কিছু কোরআন শরীফ দেখতে পাওয়া যায়।  আহা! সেগুলো হাতে নেয়ার কি অপার্থিব আনন্দ! সেগুলো সাধারণত নামাজী ব্যক্তিদের হাতে হাতে ঘুরতে থাকে।  তাদের মাঝে অল্প কিছু মানুষ থাকে, যতটুকু সাধ্য কুলায়- সে অনুসারে বাকিদেরকে কোরআন পাঠ শেখায়। এতোটুকুই হলো কারাগারের সাদামাটা ধর্মচর্চা।  অনেক আলেমরাও বন্দী হন, তবে নানা কারণে সাধারণ বন্দীরা তাদের থেকে উপকৃত হতে পারেন না।

যতটুকু সময় কারাগারে থেকেছি, আমার কাছে সবচেয়ে খারাপ মানুষদেরও কখনো জঘন্য মানুষ মনে হয়নি বরং মনে হয়েছে একেকজন অসহায় মানুষ, যাদেরকে আলোর পথ দেখালে তারা ঠিকই নিজেদেরকে সংশোধন করতে পারে। কিন্তু আমাদের কারাগারগুলোতে এ ধরণের কোনো সংশোধনের ‘বিন্দুমাত্র’ অফিসিয়াল আয়োজন নেই। সবাইকে যে যার মত এক জায়গায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে, এরপর সময় হলে কেউ জামিন পায়, কেউ সাজা শেষ করে মুক্তি পায়, আর সেখানে ভেতরেও নানা রকমের জুলুম চলতে থাকে; মোটকথা, সংশোধনের কোনো ব্যবস্থা নেই।

তাদেরকে যদি তাদেরকে ভালো কাজের দিকে সংশোধনের একটি আয়োজন করা যেত সেটাই সবচেয়ে উত্তম হতো! কিন্তু কে করবে কার সংশোধন? কারণ পত্রিকার খবরেই তো নিয়মিত দেখা যায়, কারারক্ষী ও কর্মকর্তাদের দুর্নীতির খবর! প্রত্যেকেই ব্যস্ত কিভাবে মানুষকে আরও কঠিন অবস্থায় ফেলে তাদের পরিবারের কাছ থেকে টাকা আদায় করা যায়!

বিশেষ ধারার কিছু ‘ধর্মীয়-রাজনৈতিক’ মামলা এবং অন্যান্য বিশেষ ধারা অনুসারে বন্দীদের চিহ্নিত করে, তাদেরকে আরো বিপদে ফেলে কিভাবে অর্থ আদায় করা যায়- এই কায়দা সেখানে দারুণ প্রচলিত আছে। এজন্যে অনেকে ধর্মীয় পরিচয় গোপন করে ফেলেন, যেমন- কেউ কেউ দাঁড়ি মুড়িয়ে ফেলেন। তবে আমি এসবের খুব একটা কার্যকারিতা দেখিনি। ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ/গোপনের মধ্যে খুব একটা উনিশ-বিশ ছাড়া তফাত নেই।

ফায়েজ আহমাদ

বিভিন্ন ধরণের জীবন আছে। আমার কারাগার জীবনও একটা জীবন। রমজান মাসে সন্ত্রাস দমনে বিশেষায়িত বাহিনীকর্তৃক আটকের মাধ্যমে যার সূচনা। রাস্তা থেকে তাদের আস্তানায়। রাতে বিভাগীয় কমিশনারের ইমাম হয়ে যখন আমার তারাবি পড়ানোর কথা, তখন আমি হাতকড়া পরা অবস্থায় একাকী তারাবির নামাজ আদায় করছি। বিভিন্ন অফিসারের জিজ্ঞাসাবাদে দুই দিন কেটে গেল। মনে হলো, হয়তো কালই মুক্তি পাবো। দুই দিন পর হঠাৎ দূরে কোথাও স্থানান্তর করা হলো আমাকে। নতুন অধ্যায়ের সূচনা। দিনরাত নির্ঘুম। এভাবে দেশের প্রচলিত আইনবহির্ভূত ৩৬ দিন আদালতের অনুমতি ছাড়াই আমাকে আটক রাখে তারা। এ দিনগুলিতে কুরআনের বিভিন্ন আয়াত নতুনভাবে অনুভব করছিলাম। রাতদিনে কখন কলিং বেল বেজে উঠে। কার ডাক আসে। কোন অফিসার ডাকবে? সেই আশংকার মধ্যেই দিনরাত গুজরান করতে হতো।

দীর্ঘ ছত্রিশ দিন আটকে রাখার পর স্থানীয় থানায় হস্তান্তর করা হলো। প্রেসরিলিজ হলো, আজ বিকালে এদের আটক করা হয়েছে। পরদিন সকালে আব্বা এসে দেখা করলেন। আব্বাকে বরাবরই ভীতু হিসেবে জানি। তার কী হবে সেই চিন্তা আমাকে পেয়ে বসেছিল। সেই তিনি এসে যখন বললেন, ‘এটা আমাদের আসলাফের সুন্নাত’, পিতার সান্ত্বনাবাণীতে এতো দিনের কষ্ট নিমিষে উবে গেল। আদালতের মাধ্যমে এবার আনুষ্ঠানিক রিমান্ডের পর জেলখানায়।

নতুন জগতের আমদানি ওয়ার্ড, সকালে কেইস ফাইল থেকে জেলের বিশেষায়িত নিরাপত্তাকরিডোর সেলে পার্সেল করা হলো আমিসহ আরো তিনজনকে। এখানে নতুন কেউ এলে তার প্রতি স্নেহপ্রকাশ ও অভয় দেয়ার ঘটনা যেমন আছে, তেমনি নতুনদের সরলতার সুযোগে তাদের থেকে অর্থনৈতিক সুবিধে নেওয়ার লোকও কম নেই সেখানে।

জীবনকে কতটা ফলপ্রসূ ও উপভোগ্য করা যায়, শুরু হয় সেই পরিকল্পনা। আমার দাখিল পরীক্ষার মাত্র দুই মাস বাকি। আদালত পড়ালেখার অনুমতি দিলেও কারাকর্তৃপক্ষ খাতা-কলম দিতে টালবাহানা করতে থাকে। জেল সুপার জানালেন, ‘পড়ালেখা করার ইচ্ছে থাকলে বহুভাবে তা করা যায়। আপনি ফ্লোরে ম্যাথ অনুশীলন করুন।’ কিছুদিন এভাবে চলার পর আদালতের চাপে জেলপ্রশাসন কলমখাতা দিতে বাধ্য হয়। পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে আসছে। পরীক্ষার দিন সকালে বাবা-মা যেভাবে সন্তানের সবকিছু গুছিয়ে দেয়। আমার জেলসাথীরা সবকিছু গুছিয়ে দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, আজ তাদের কোন সন্তানের পরীক্ষা। খাতা-কলম ও বোর্ড ইত্যাদি গুছিয়ে দিল, ভাইয়া আজ পরীক্ষা দিতে যাবে। সকাল নয়টায় সিআইডি এসে হাক দিল, ফায়েজ আহমাদ! নেমে আসুন! তাদের সাথে জেলের ভেতর বিশেষভাবে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করা ডিভিশন ওয়ার্ডে ঢুকলাম। পরিক্ষার্থী আমি একা। বাহির থেকে পরিক্ষাকেন্দ্রের পরিদর্শক এলেন। প্রবেশপত্র দেখে খাতা দিলেন। একই সাথে কওমী ও আলিয়ার ছাত্র হওয়ায় আমার এক নির্মম সত্যের মুখোমুখি হতে হয়েছে। আলিয়া তথা সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার দায়িত্বশীলরা তাদের সন্তানদের অস্বীকার করতে পারেনি। কিন্তু কওমী মাদরাসা মিথ্যা মামলায় আটক তাদের সন্তানকে স্বীকার করতে চায় না। বরং সত্যমিথ্যার বিভিন্ন বাহানায় তাকে অভিযুক্ত করার নিরলস প্রয়াস প্রতীয়মান হয়েছে।

ম্যাথ পরিক্ষার আগের দিন রাতে জেলার পরিদর্শন করছেন কারাগার। রাত এগারটায় সকলের ঘুমিয়ে পড়ার নির্দেশনা। কিন্তু পরীক্ষার কারণে আমাকে তো পড়তে হবে। জেলার এসে বললেন,

-কী খবর! ফায়েজ! কাল কী পরীক্ষা?

– ম্যাথ।

-কোন সমস্যা আছে!

-ম্যাথ বুঝতে একটু সমস্যা হচ্ছে আমার।

-আমার কাছে আনো।

অবশেষ ম্যাথের সমস্যাটি তিনি সমাধান করলেন। বললেন, কেন যে তোমরা জেলখানায় আসো!

পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ পেল। খোদ জেলার এলেন। একটি কাগজে লিখে দিলেন! Congraulation! Your result is 4.75

সে এক ভিন্ন অনুভূতি। পরীক্ষার ফলাফল পেয়ে মিষ্টি এনে সেলের সবাইকে মিষ্টিমুখ করা হলো। রেজাল্ট বের হওয়ার পর যেমন আত্মীয় স্বজনদের মিষ্টি দিতে হয়। প্রথমেই আমি মিষ্টি খাওয়ালাম আমার ম্যাথের টিচার বাবু ভাইকে। একাউন্টিংয়ে অনার্স করা বিশেষ মামলায় আটক ভদ্রলোক জেলখানায় আমাকে ম্যাথ করাতেন।

সালাফিরা যেমন বাইরে তাদের দাওয়াতি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। তারা কারাগারেও সহীহ বুখারী বগলে নিয়ে তাদের দাওয়াতী কাজ অব্যাহত রাখে। ট্র্যাডিশনাল ধারার হুজুরদের দেখে নেতৃত্বহারা হওয়ার আশংকায় তাদের বিভিন্ন নেতিবাচক প্রচারণা চলতে থাকে। কারাগারে তাদের কিছু অনুসারী তৈরী হলেও অধিকাংশ মানুষের আস্থা থাকে ঐতিহ্যবাহী ধারার প্রতি । ততদিনে জেলখানায় বিডিয়ার বিদ্রোহের আসামীরা আসতে থাকে। তাদের জুমার নামাজ আদায়ের দায়িত্ব আসে আমাদের ওপর। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে কিছুদিন পর তা বন্ধ হয়ে যায়। জেলখানায় জুমার আলোচনা করা এবং দোয়া করার ক্ষেত্রে যে সচেতনতা বজায় রাখতে হয়, তাতে কেউ নামাজ পড়াতে চায় বলে মনে হয় না।

কারাগারে কথিত ‘সন্ত্রাস বিরোধী অভিযোগের’ শিকার মানুষরা সবচে বেশি নিগৃহীত হয় তল্লাশী নামক ব্যবস্থায়। কারাগারের সাপ্তাহিক কিংবা মাসিক তল্লাশীর এন্তেজাম থাকে শুধু এদের জন্যই। জেলপ্রশাসনে রদবদলের সাথে সাথে নীতিতে পরিবর্তন হয়। হঠাৎ ভোরবেলায় কারারক্ষীরা হাজির। বিছানাপত্র থেকে কুরআনের ভেতরেও তল্লাশী। কোথাও কোনকিছু বাদ যাওয়ার নিয়ম নেই। বাঁশের কঞ্চির মতো কারারক্ষীদের সাথে আছে কিছু জেল-আসামী। কারাপ্রশাসনের আস্থা অর্জনে তারা সবকিছুই করে। এবার তল্লাশীর পর কিছু ভারতীয় প্র্যাকটিসিং হিন্দুদের সাথে আমাদের রাখা হয়। আমরা নাকি মুসলিমদের কথিত উগ্রপন্থায় প্রভাবিত করি। যখন জেল থেকে বের হই, তখন সেই হিন্দুদের চোখে পানি ছিল। বললো, হুজুর! আপনাদের সবাই অন্যভাবে দেখে। কিন্তু কোন খারাপ কিছু দেখিনি। বরং আপনাদেরই সবচে ভালো পেয়েছি।

কারাগারেই এলো রমজানের ঈদ। পেছনে হাতকড়া দিয়ে চুল কাটানো হলো। ঈদ উপলক্ষে একটি লুঙ্গি পেলাম। কিন্তু তিন হাত চাওড়া, ছয় ফুট লম্বা ও ছয় ফুট উচু কামরায় বিশেষভাবে নির্ঘুম রাখার পদ্ধতিতে কোন পরিবর্তন আসেনি। তবে কিছু রহমদিল নিরাপত্তারক্ষী এ দিনে কিছু সময়ের জন্য হাত-পা ছেড়ে দিয়ে ঘুমানোর সুযোগ দিয়েছিল। ঈদে কারাগারে নাচ-গানের প্রতিযোগিতার পাশাপাশি কুরআন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। কিছুটা আলো বাতাসের সুযোগ নিতে আমরা প্রতিযোগিতায় নাম লেখাই। প্রতিযোগিতায় বাহির থেকে বিচারক এলেন কারা ইমাম ও এমন এক ব্যক্তি, যার সাথে খোদ আমি কুরআন প্রশিক্ষণ নিয়েছি। আমরা কুরআন তেলাওয়াত করলাম। স্বাভাবিকভাবে আমাদের এগিয়ে থাকার কথা হলেও আমরা প্রথম হইনি। কারাগার থেকে বের হওয়ার পর জানতে পারি, কারাপ্রশাসনের নির্দেশনায় এটা করা সম্ভব হয়নি। কারণ, এতে নাকি উগ্রবাদকে প্রমোট করা হবে।

কারাগারের জীবনে উল্লেখযোগ্য দিক হল ইলমে দ্বীন শিক্ষাদানের অভিনব এক পদ্ধতি। সাধারণ শিক্ষার সুযোগে আমি খাতা কলম ব্যবহারের সুযোগ পেলেও আমার সাথে কারাগারে আসা একছোট ভাইয়ের সে সুযোগ ছিল না। সবে হেফজ সম্পন্ন করেছে। দুই বছরে কাফিয়া পর্যন্ত আমার কাছে পড়েছে। খাতার অভাবে সিগারেটের কাগজে এসো আরবি শিখি, মুখে মুখে মিজান ও নাহবেমীর শিক্ষার সে এক ভিন্ন ইতিহাস। কুরআন থেকে উদাহরণ বের করে করে অনুশীলন করানোর মাধ্যমে অন্তরের খোরাক যোগান দেয়া হতো। কারাজীবনে কেউ কারো জন্য কিছু করতে চায় না। প্রত্যেককে কাপড় ধোয়া থেকে শুরু করে সবকিছু নিজে করে। কিন্ত এখানে এক শিক্ষার্থী তার শিক্ষকের জন্য সবকিছু করেছে।

একদিন আব্বা দেখা করতে এলেন। চোখে পট্টি বাঁধা। বললেন, ‘কষ্টে আমার চোখ শাদা হয়ে গেছে।’ সন্তানের জন্য পিতার চোখ নষ্ট হওয়া এটা যে কতটা বেদনাদায়ক, তা কল্পনা করা ছিল অকল্পনীয়।

আটক জীবনের তৃতীয় রমজান তখন। সকাল নয়টায় এক মারফতে তথ্য আসতে শুরু করলো জামিন হয়েছে। সকলের জন্য প্রতিদিন সাক্ষাতের সুযোগ থাকলেও আমাদের মতো আসামীদের জন্য সপ্তায় একদিন পরিবারের সাথে দেখা করার সুযোগ ছিল। আমাদের ভেতর খুশি আর আশংকা একই সাথে ভর করতে থাকে। নিশ্চিত হতে পারছি না। আসলেই জামিন হলো কি না? সেই দিনের রাতটা বেশ দীর্ঘ ছিল। পরদিন সকালে নিশ্চিত জানতে পারলাম, জামিন হয়েছে। বিকালে সেলের সামনে জামিন ডাকার লোক এলো!

‘জামিনে মুক্তিপ্রাপ্তদের নাম শুনুন’ একে একে নাম বলতে থাকলো জামিন ডাকার লোক। এক সময় নাম ডাকলো, ‘ ফায়েজ! পিতা-আবুল কালাম’

বিকাল থেকেই সেলের সকলের সাথে বিদায়ী সাক্ষাত শুরু হলো। হাঁটতে হাঁটতে কারাগেটে পৌঁছলাম। কারাগারে বিশেষ দায়িত্বে থাকা সিআইডি যে বিভিন্ন সময় অযাচিত কথা বলেছে, হাত ধরে মাফ চেয়ে বললো, ’তোমাদের অনেক কিছু বলেছি, মাফ করে দিও আমাকে।’

কারাগেট দিয়ে অফিসে প্রবেশ করলাম। নাম ঠিকানাসহ বিস্তারিত তথ্য নিয়ে কারাপ্রশাসন নিশ্চিত হচ্ছিল। সর্বশেষ শরীরের বিভিন্ন চিহ্ন দ্বারা শনাক্তের কাজ শুরু হলো। ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে বাহিরে দেখার চেষ্টা করছিলাম। আত্মীয়স্বজন কারা এসেছে। কারা মসজিদের ইমাম পূর্ব-পরিচিতির সুবাদে ভেতরে ঢুকে আমাদের দ্রুত ছাড়ার অনুরোধ করলেন। কারাগারের ছোট গেট দিয়ে বের হয়ে আকাশের দিকে তাকাবার আগেই গোয়েন্দা শাখার এক লোক পাশে ডেকে নিল। কী হতে যাচ্ছে! দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পরিবারের লোকও বুঝতে পারছিল না। আমাদের নাম ঠিকানা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বললো,‘ এটা আমাদের ডিউটি। কিছু মনে করবেন না। এবার যেতে পারেন।’

সামনে বাবা-মা গাড়ি নিয়ে দাঁড়ানো ছিলেন। দ্রুত পায়ে এগিয়ে তাতে উঠে পড়লাম। তখন ইফতারির আজান দিয়েছে। কারা-ইমামের দেয়া ইফতারি খেতে খেতে বাড়ির পথে চলতে থাকলাম। রাস্তায় চলতে চলতে দেখলাম, সবকিছু কেমন বদলে গেছে। গাছপালা যেন নতুন পোশাক পরেছে। মনে হলো, আমি এ জগতে নতুন। সকলের সাথে নতুনভাবে আমাকে পরিচিত হতে হচ্ছে।

রেদওয়ান শাকিল

তিনদিন গুম ছিলাম। আমরা ছিলাম পাঁচজন। ঠিকমত খেতে দিত না আমাদের। একবার সবাইকে মাছ, ভাত, তরিতরকারি দিয়ে সুন্দর করে খেতে দিল। ভাবলাম আজকে ক্রসফায়ারে দিবে হয়তো। সে জন্য শেষবারের মত ভাল করে খেতে দিচ্ছে। ইসলাম প্র্যাকটিস শুরু করার আগে একটা মেয়েকে পছন্দ করতাম। ওর সাথে একবার কথা বলতে খুব ইচ্ছা করছিল।

জেলে অনেকবার জামিন হবে হবে করেও হয় না। এই দিনগুলো কষ্টকর। তবে এক দুইবারের পর অভ্যাস হয়ে যায়। এরপর আর জামিন নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়ার কিছু থাকে না।

আমি কিশোর বয়সে জেলে ছিলাম। যৌন নির্যাতন থেকে বেঁচে থাকা আমার জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। আল্লাহর রহমতে আমি সহি সালামতে থাকতে পেরেছি। তবে সবাই আমার মত খোশনসিব না।

আমি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরিক্ষার্থী ছিলাম। ভর্তি গাইড, প্রশ্নব্যাংক দেওয়ার জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ভাইয়ের উপর নির্ভর করতাম। আমি তাকে খুবই ভরসা করতাম। কিন্তু আমি অসংখ্যবার তার কাছে বার্তা পাঠানোর পরও তিনি আমার কাছে ভর্তি গাইড আর প্রশ্নব্যাংকগুলো পাঠান নাই। এটা মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়েছিল। আসলে জেলের ভেতরে বন্দীদশায় অফুরন্ত অবসর। বাইরে তো সবাই নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত।

একই মামলায় আটক হওয়া লোকদের বলা হয় কেইস পার্টনার। কেইস পার্টনারদের সাথে দাবা খেলা, সমাজ-ধর্ম-দর্শন-রাজনীতি-ইতিহাস নিয়ে আলোচনা-তর্ক-বিতর্ক ছিল নিথর জীবনে একটু প্রাণের ছটা।

মাঝেমাঝেই মন বিদ্রোহ করত। নিজেকে শক্ত রাখা খুব কঠিন হয়ে গিয়েছিল একবার। আমার কেইস পার্টনারের দাড়ি-টুপি থাকায় গালিগালাজ শুনতে হত। ওয়ার অন টেরর রেটরিকের বহুল চর্চা ছিল। গুলশান পরবর্তী সময়ে তরুণদের জন্য ধর্মচর্চা খুবই কঠিন হয়ে যায়। এমনিতে জেলে গেলে বেনামাজীও নামাজ পড়ে। কিন্তু আমরা যারা তরুণ এবং জামাত-শিবিরও করি না, তারা বেশী ধর্মে মনযোগী হলে জঙ্গী ট্যাগ দেওয়া হত।

দীর্ঘদিন জেলে থেকে মুক্তি পাওয়ার পর এডজাস্ট করতে কষ্ট হয়। প্রতিবারই হয়েছে। সপ্তাহখানেক লাগে অন্তত। এ সময়ের মানসিক কষ্টটা অসম্ভব। যে এই পরিস্থিতিতে পড়েনি, তার পক্ষে এই যন্ত্রণা বুঝা সম্ভব নয়। সময় তবু থেমে থাকে না। জীবন ও জীবিকার ব্যস্ততায় আমরা হয়তো যন্ত্রণা ভুলে যাই, তবুও মনের কোথাও একজায়গায় লেগে থাকে যন্ত্রণার কামড়।

The post অন্ধকার জীবনের যন্ত্রণা : কারাগারের কথকতা appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%85%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a7%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%9c%e0%a7%80%e0%a6%ac%e0%a6%a8%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%af%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a3%e0%a6%be/

No comments:

Post a Comment