Friday, June 26, 2020

ইসলামের কারাগার দর্শন

ইফতেখার জামিল:

জেলখানা আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা যেমন সার্বজনীন অধিকারের কথা বলে, তেমনি সার্বজনীন শৃঙ্খলার কথাও বলে। সর্বব্যাপী তার নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারী চলে। অধিকার ও শৃঙ্খলা রক্ষিত হোক বা নাই হোক, নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারী বজায় রাখতে অধিকাংশ রাষ্ট্র জেলখানাকে ব্যবহার করে থাকে। যাদেরকে সে বিপক্ষ মনে করে, যাদেরকে মনে করে হুমকি, তাদেরকে অপরাধী বানিয়ে জেলখানায় পাঠায়। এভাবে তাদের স্বাধীনতা ও সক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়।

জেলখানা আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা-পর্যালোচনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একটা রাষ্ট্রে নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারীপ্রবণতা যত বেশী, ততই বেশী তার জেলখানার অধিবাসী। পাশাপাশি রাষ্ট্রের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বুঝতেও জেলখানা বিশেষভাবে সাহায্য করতে পারে। জেলখানায় কোন বিশেষ সম্প্রদায় বা অঞ্চলের লোকসংখ্যা বেশী থাকলে তাতে সামাজিক অসাম্য ও বৈষম্যের বিষয়টি বুঝে আসে। আবার যারা জেলখানায় বেশী যায়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবে তার বিশেষ বিরুপ প্রভাবও তাদের ওপরে পড়ে। তারা অপরাধী ও সন্দেহভাজন হিসেবে পরিচিতি পায়। এভাবে জেলখানা সন্দেহ, নিয়ন্ত্রণ ও বৈষম্য সৃষ্টিতে দ্বিমুখী চক্র হিসেবে কাজ করে থাকে।

জেলখানা আমাদের সমাজের আয়না, এখানে সমাজের ভেদাভেদ-বৈষম্যের প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠে। জেলখানা কায়েমি আইন-আদালতের ফলাফল। যদি রাষ্ট্রে জুলুমমূলক ব্যবস্থা থাকে, নিয়ন্ত্রণ-বৈষম্যমূলক আইনের ছড়াছড়ি থাকে ও আদালত হয় পক্ষপাতমূলক বা দুর্নীতিগ্রস্থ, তাহলে সেই রাষ্ট্রের জেলখানায় নিরপরাধ মানুষে ভর্তি থাকে। জেলখানা নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পশ্চিমা সভ্যতার প্রধান রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় পঁচিশ লাখ মানুষ কারাগারে বন্দী। দেশটিতে প্রতি একশোজনের মধ্যে প্রায় একজন কারাগারে আটক থাকে।

এখন আমরা যেহেতু নানাভাবে পশ্চিমা সভ্যতার মাধ্যমে প্রভাবিত, তাই আমাদের দেশগুলোতেও কারাগারের অধিবাসী বাড়ছে, বাড়ছে অনিয়ম ও বৈষম্য। আমরা যেহেতু ইসলামকে বিকল্প হিসেবে মনে করি, তাই ইসলামের আলোকে কারাগার দর্শন বুঝতে চেষ্টা করবো। এখানে কারাগার সংশ্লিষ্ট কোন মাসায়েল ও আহকাম বর্ণনা করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমাদের উদ্দেশ্য ইসলামের কারাগার দর্শনের উপস্থাপন। তাতে হয়তো আমাদের বিপর্যয় ও বিকল্প সমাধানের বিস্তারিত ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না। তবে একটা সরল ধারণা পাওয়া যেতে পারে।

জেলখানা : কোরআনি মর্মের অনুসন্ধানে

কোরআনে জেলখানার কথা প্রায় দশবারের মতো এসেছে। প্রতিশব্দ গ্রহণ করলে সংখ্যাটা আরও বাড়বে। সে যাই হোক, দশবারের মধ্যে নয়বারই এসেছে সূরা ইউসুফের মধ্যে, একবার এসেছে সূরা শুয়ারার মধ্যে। জুলাইখা ইউসুফ আ.-কে খারাপ কাজে প্ররোচিত করে। জুলাইখা স্বামীর কাছে ধরা খেয়ে ইউসুফ আ.-এর ওপর দোষ চাপিয়ে দেয়। তাকে কারাগারে প্রেরণের অনুরোধ পেশ করে। যদিও পরবর্তীতে জুলাইখার দাবী মিথ্যা প্রমাণিত হয়, তবে তাতেও জুলাইখা প্ররোচনা থামায়নি। একপর্যায়ে ইউসুফ আ. অনুভব করলেন, তার পৃথিবী সংকুচিত হয়ে আসছে।

ক্রমাগত চাপের মুখে ইউসুফ আ. আল্লাহর কাছে বিনীত কণ্ঠে আবেদন জানালেন, আল্লাহ আমাকে তাদের প্ররোচনা থেকে বাঁচাতে জেলখানায় নিয়ে যাও। ইউসুফ আ. বন্দিত্ব গ্রহণ করে মুক্তি চাইলেন। জুলাইখার স্বামী ও তার সহযোগীরা যখন দেখলেন, জুলাইখার অপরাধের বিষয়টি জানাজানি হয়ে যাচ্ছে, তখন স্ত্রীর সম্মান রক্ষার্থে ইউসুফকে কারাগারে প্রেরণ করেন। এখানে আমরা কারাগারের তিনটি মর্ম পাই : অপরাধী ব্যক্তি নিজে বাঁচতে অন্যকে ফাঁসিয়ে দেওয়া, ফিতনা থেকে বাঁচতে কারা-জীবন কামনা ও জনমত নিয়ন্ত্রণ করতে ক্ষমতাবানদের সম্মান-ভাবমূর্তি রক্ষায় নিরপরাধ ব্যক্তিকে কারাগারে প্রেরণ।

সূরা শোয়ারায় ফিরআউন ও মুসা আ.- এর কথোপকথনে জেলখানার কথা এসেছে। মুসা আ.- এর সাথে তর্কে কুলিয়ে উঠতে না পেরে ফিরআউন তাকে ভয় দেখাতে শুরু করে। মুসা আ.- কে হুমকি দিয়ে বলে, তুমি যদি আমাকে খোদা হিসেবে মানতে অস্বীকার করো, তাহলে আমি তোমাকে কারাগারে নিক্ষেপ করবো। ফিরআউন নিজের মতাদর্শ জোরপূর্বক চাপিয়ে দিতে তাকে ক্ষমতার ভয় দেখায়। তাকে কারাগারে নিক্ষেপের হুমকি দেয়।

এভাবে পবিত্র কোরআনে হকপন্থীদের পরীক্ষা হিসেবে জেলখানার বর্ণনা এসেছে। নবীজি বলেন, পৃথিবী মোমিনের জন্য কারাগার স্বরূপ। (মুসলিম, ২৯৫৬)। বস্তুত পৃথিবীতে মুমিনকে নানারকম পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে। তার অংশ হিসেবে মোমিনের পার্থিব জীবনকে কারাগার হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনে মুসা আ.- কে ফিরাউন মতাদর্শ চাপিয়ে জেলখানার ভয় দেখায়, পাশাপাশি ইউসুফ আ. সামাজিক অনৈতিকতা ও দুর্নীতির শিকার হয়ে জেলজীবন বেছে নেন ও জেলে প্রেরিত হন।

নবিজির জেলখানায়

ছুমামা বিন আছাল ছিলেন বনু হানিফা গোত্রের প্রভাবশালী ব্যক্তি। নবিজির কাছে তাকে ধরে নিয়ে আসা হলে নবিজি তাকে তিনদিন মসজিদে নববীর একটি পিলারের সাথে বেঁধে রাখেন। অনেক ব্যাখ্যাকারের মতে ইসলামি সমাজ ও মুসলিম সংস্কৃতির সাথে পরিচিত করতে নবিজি তাকে মসজিদে বন্দী করে রাখেন। মসজিদে নববী ছিল মুসলমানদের কেন্দ্রীয় মিলনায়তন। তিনদিন পর ছুমামা ইসলাম গ্রহণ করেন। এভাবে নবিজি ছুমামাকে কারান্তরীণ করার মাধ্যমে তাকে সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন, তাকে ইসলামের সৌন্দর্যের সাথে পরিচিত করেন। এভাবে যথাযথ ব্যবস্থাপনা থাকলে কারাগার হয়ে উঠতে পারে সংশোধনের বিশেষ মাধ্যম। নবিজির শিক্ষায় আমরা এর নির্দেশনা পাই।

বদর যুদ্ধে সত্তর জনের মতো কাফের বন্দী হিসেবে মুসলমানদের হাতে আসে। আলাপ-আলোচনার পর নবিজি তাদের থেকে মুক্তিপণ নেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। নবিজির প্রিয় চাচা আব্বাস বাধ্য হয়ে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, যদিও তিনি নিজে নিজে ইসলাম গ্রহণ করে ফেলেছিলেন। তিনি ইসলাম গ্রহণের কথা বলে নবীজির কাছে মুক্তিপণ ছাড়ের আবেদন জানান। নবিজি উত্তরে বলেন, আপনি নিজে নিজে ইসলাম গ্রহণ করে থাকলে আল্লাহ তার প্রতিদান দিবেন, তবে আমি আত্মীয় বলে আপনাকে ছাড় দিতে পারবো না।

আব্বাস ছিলেন নবিজির কল্যাণকামী। দ্বিতীয় বাইয়াতে আকাবায় তিনি নবিজির পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মদিনার আনসাররাও নবিজিকে ছাড় দেওয়ার জন্য বারবার আবেদন করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু নবিজি তার অবস্থান থেকে সরেননি। কেননা নবিজি আব্বাস রা. এর থেকে মুক্তিপণ আদায় না করলে একে স্বজনপ্রীতি হিসেবে উপস্থাপনের আশঙ্কা ছিল। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় আইনের চোখে সবাই সমান। নেতার আত্মীয় বলে কেউ বিশেষ সুবিধা পেতে পারেন না।

কয়েকজন বন্দী ছিল গরীব, তবে লেখাপড়া জানত। নবিজি তাদেরকে মুক্তিপণের বিনিময় হিসেবে মদিনার দশজন শিশুকে লেখাপড়া শেখাতে নির্দেশ দেন। আবার কিছু বন্দী ছিল গরীব ও অশিক্ষিত, তাদেরকে মুক্তিপণ ছাড়াই মুক্তি প্রদান করেন। সুহাইল বিন আমর বন্দী হিসেবে মুসলমানদের হাতে আসে, সে ছিল বদর যুদ্ধের অন্যতম প্রধান প্ররোচক। উমর বললেন, তার সামনের দাঁতগুলো ভেঙ্গে দেই, যাতে সে আর প্ররোচিত না করতে পারে। নবীজি উমর রা. কে বাঁধা দিলেন। বললেন, তাঁকে আপাতত ছেড়ে দাও। তাঁর সম্ভাবনাটুকু বাঁচিয়ে রাখো। হয়তো সে তাঁর ক্ষমতাকে ইসলামের কাজে ব্যবহার করবে। নবিজির এই আশা পূর্ণ হয়েছিল। ইরতিদাদের যুদ্ধে তাঁর আবেগময় ভাষণ বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল।

বদর যুদ্ধ ছাড়াও নবীজি অনেক অপরাধী বা যুদ্ধবন্দীকে বন্দী হিসেবে আটক রেখেছিলেন। নবীজির কারা কৌশল বিষয়ক গবেষক ডক্টর হাসান আবু গুদ্দার বর্ণনা মতে, নবীজি নারী, পুরুষ ও শিশুদেরকে আলাদা আলাদা স্থানে আটক রাখতেন। অর্থাৎ নবীজি বন্দীদের সংশোধন, নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সচেতন ছিলেন। নবীজি বন্দীদেরকে মসজিদে রাখতেন, স্থান সংকুলান না হলে স্ত্রীর ঘরেও রেখেছিলেন। পাশাপাশি কখনো প্রয়োজন হলে আলাদা ঘরের ব্যবস্থাও করেছেন।

ফিকাহে জেলব্যবস্থা

ইসলামে শাস্তিব্যবস্থাকে প্রধানত তিনভাগে ভাগ করা হয়। হুদুদ, কেসাস ও তা’যীর। কিছু অপরাধের শাস্তি স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ভিন্ন হতে পারে না, তার মধ্যে শাস্তি পরিমাণ ও মাত্রা নির্ধারিত, এগুলোকেই হুদুদ বলা হয়। সরাসরি ব্যক্তিকে হত্যা বা শারীরিক ক্ষতি করলে তার বিধান বিবৃত হয় কিসাসে। যেসব অপরাধের শাস্তি স্থান-কাল-পাত্র ভেদে বিভিন্ন হতে পারে, সেগুলোকে বলা হয় তা’যীর। তা’যীরের একটি শাখা হচ্ছে, কারান্তরীণ করা।

আধুনিক আইনব্যবস্থায় কারান্তরীণ করাকেই প্রধান বা বলা যায় একমাত্র শাস্তি হিসেবে দেখা হয়। পক্ষান্তরে ইসলামে কারান্তরীণ করাকে সংরক্ষিত শাস্তি হিসেবে দেখা হয়, অন্যান্য বিকল্প ব্যবহারের সুযোগ না থাকলে কারান্তরীণ করা হয়। কেননা ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে এর প্রভাব অত্যন্ত বিধ্বংসী— ব্যক্তির অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট হয়, ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদা লঙ্ঘিত হয় এবং পাশাপাশি পারিবারিক-সামাজিক জটিলতা তৈরি হয়। এতে অনেক ক্ষেত্রে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশী হয়। সংশোধনের বদলে প্রতিশোধ ও অপরাধ প্রবণতাই বৃদ্ধি পায়।

কারান্তরীণ করাকে একমাত্র শাস্তি হিসেবে দেখলে এতে হুদুদ-কেসাসের প্রয়োগে শিথিলতা তৈরি হয়। এর প্রেক্ষিতেই ইমাম আবু ইউসুফ রহ. খলিফা মামুনুর রশিদকে বলেন, আপনি হুদুদ প্রয়োগে যত্নবান হলে জেলখানাবাসীর সংখ্যা অনেক কমে যেত। অপরাধী ও দুশ্চরিত্র লোকেরা ভয় পেয়ে যেত। ফুকাহাদের দৃষ্টিতে অপরাধী ও দুশ্চরিত্র লোকদের অনিষ্ট থেকে সমাজকে বাঁচাতে, তাদের অবস্থা যাচাই ও সংশোধিত করতেই জেলব্যবস্থার ধর্মীয় বৈধতা ও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

ফুকাহাদের দৃষ্টিতে কারাগারের উদ্দেশ্য

ফুকাহায়ে কেরামের মতে কারান্তরীণ স্বয়ং কোন বিশেষ শাস্তি নয়, বরং প্রশিক্ষণ ও সংশোধনের মাধ্যম। তাদের মতে কারাগারে অপরাধীদের সংশোধনের উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়, এর পাশাপাশি সমাজ তার অনিষ্ট থেকেও বেঁচে থাকতে পারে। অবশ্য কখনো অভিযুক্ত ব্যক্তির বিষয়ে তদন্ত করার জন্য স্বল্প মেয়াদীভাবেও আটক করা হতে পারে। এভাবে তাকে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়। কেননা কারাগারে থাকে ধর্মীয় নির্দেশনা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। তাতে অপরাধীর জীবন ও চিন্তায় বিশেষ প্রভাব পড়ে।

ওমর রা. বলেন, আমি তাকে আটক করেছি, যাতে সে তাওবা করে। আলী রা. কুফা থাকাকালীন নিয়মিত জেলখানা পরিদর্শন করতেন ও বন্দীদের খোঁজ নিতেন। তিনি জেলখানার নাম রেখেছিলেন যথাক্রমে নাফে ও মুখাইইস অর্থাৎ যথাক্রমে উপকারস্থল ও সংশোধনাগার। এতে বুঝা যায়, তিনি কারাগারকে প্রতিশোধ ও শাস্তির বদলে সংশোধনাগার হিসেবে দেখতেই পছন্দ করতেন। নিজেও নিয়মিত কারাগারের খোঁজ রাখতেন।

ইমাম আবু ইউসুফ রহ. ( মৃত্যু ১৮২ হি. ) বলেন, কারান্তরীণের উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রশিক্ষণ ও তাওবা করানো। ইমাম মাওয়ারদীর ( মৃত্যু ৪৫০ হি. ) মতে কারান্তরীণের উদ্দেশ্য, কল্যাণবোধ জাগ্রত করা-( সমাজের ) যোগ্য করে তুলা, তিরস্কার করা ও শিক্ষা-প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। ইবনে তাইমিয়া রাহঃ ( মৃত্যু ৭২৮ হি. ) এর মতে কারান্তরীণের উদ্দেশ্য ( অপরাধ থেকে ) নিবৃত করা ও প্রশিক্ষণ। ইমাম কাসানি রাহঃ ( মৃত্যু ৫৮৭ হি. ) এর মতে কারান্তরীণের উদ্দেশ্য তিরস্কার করা ও তাওবা করানো।

এভাবে সকল ফুকাহায়ে কেরামের মতেই কারান্তরীণের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রশিক্ষণ ও সংশোধনের ব্যবস্থা করা। ইবনে ফারহুন মালেকি ( মৃত্যু ৭৯৯ হি. )-এর ভাষায় তিরস্কার করে তাওবার উপযুক্ত করে তুলা। মুসলিম কারা ইতিহাস ও তত্ত্বের বিশেষজ্ঞ হাসান আবু গুদ্দাহ এভাবে প্রত্যেক শতকের ফুকাহাদের মন্তব্য বিবৃত করে দেখিয়েছেন, সালাফ ও আকাবিরগণ প্রশিক্ষণকেই কারান্তরীণের মূল উদ্দেশ্য হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। যেখানে গত একশো বছর আগেও পশ্চিমা সভ্যতায় কারান্তরীণের মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রতিশোধ, অপমান, অসম্মান, নিষ্ক্রিয়করণ ও নির্যাতন। যার প্রেক্ষিতে গত শতকে বৃহত্তর পরিসরে কারা সংস্কারের দাবী ও আন্দোলন জোরালো হয়।

কারাগার সংস্কারে মুসলিম আলেমদের দাবী

এখানে বলে রাখা ভালো, মুসলিম ইতিহাসে সবসময় ইসলামি কারাদর্শন পরিপূর্ণভাবে মানা হয়নি। নবিজির মৃত্যু ও খেলাফতে রাশেদার সমাপ্তির মধ্য দিয়ে মুসলিম সভ্যতায় নানারকম অনিয়ম ও শিথিলতা তৈরি হতে শুরু করে। যার প্রেক্ষিতে কারাব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনাতেও অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তবে ওলামায়ে কেরাম নিয়মিত এর প্রতিবাদ করে গেছেন। বন্দীদেরকে কেমন আবাসন ও সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে, সে নিয়ে বিস্তারিত বক্তব্য ও দাবী পেশ করেছেন।

ইমাম আবু ইউসুফ রহ. লেখেন, বন্দী যদি মুশরিক হয়, তবুও তার পানাহারের ব্যবস্থা করা ও ভালো আচরণ করা জরুরী। চূড়ান্ত ভিন্ন কোন রায় আসলে সে রায় বাস্তবায়ন করতে হবে, তবে তার আগে বন্দীদের যত্ন নিতে হবে। যদি বন্দী পাপী মুসলমান হয়, তাহলে তার অযত্ন কীভাবে মেনে নেওয়া যায়, সে ক্ষুধায় মারা যাবে, এটা কোনভাবেই মেনে নেওয়া যেতে পারে না। তিনি ওমর বিন আবদুল আযীযের বক্তব্য উল্লেখ করেন যে, কোন মুসলিম বন্দীকে কারাগারে বেঁধে রাখে যাবে না, তার যাতে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে কোন অসুবিধা না হয়। ইমাম আবু ইউসুফ রহ. বলেন, বন্দীদের প্রচণ্ড রোদে রাখারও কোন অনুমতি নেই।

ইবনে হুবাইরা হাম্বলি রহ. বলেন, বন্দীদেরকে এমন সংকীর্ণ জায়গায় রাখা যাবে না, যাতে তাদের ওজু-নামাজে কোন সমস্যা হয়, এমন কোন অবস্থায় রাখা যাবে না, যাতে তারা ঠাণ্ডা বা গরমে কষ্ট পায়। ইবনে তাইমিয়া রাহঃ বলেন, খুবই সংকীর্ণ কোন জায়গায় আটকে রাখা ইসলাম সমর্থিত নয়, কারান্তরীণের মানে হচ্ছে, তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা, যাতে সে চাইলেই যা ইচ্ছা সবকিছু না করতে পারে, এটা মসজিদেও হতে পারে বা বাসা-বাড়িতেও হতে পারে।

ইমাম মাওরদি রহ. এর সাথে যোগ করে বলেন, বন্দীদেরকে এমনভাবে রাখা যাবে না, যাতে একজন আরেকজন সতর দেখে ফেলার আশঙ্কা তৈরি হয়। তাজুদ্দিন সুবকী রহ. বন্দীদের স্বাস্থ্যের প্রতি লক্ষ্য রাখতে বলেন। তাদের চিকিৎসার সুযোগ নিশ্চিত করার দাবী জানান। সর্বোপরি ফিকাহের স্বীকৃত সূত্র অনুযায়ী কারাগারে থাকা অবস্থায় কারো অবহেলায় যদি বন্দী মারা যায়, তাহলে এটি পরোক্ষ হত্যা হিসেবে বিবেচিত হবে।অবহেলাকারীর বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।

কারাগার সংস্কারে মুসলিম শাসকদের ভূমিকা

ওমর বিন আবদুল আজিজ রহ. কারাব্যবস্থাপনায় বিশেষ বিভাগ তৈরি করেন, পাশাপাশি বন্দীদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করেন। খলিফা হারুনুর রশিদ কারাব্যবস্থা ও বন্দীদের অবস্থা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। সেই প্রেক্ষিতে তৎকালীন শীর্ষ আলেম ও প্রধান বিচারক আবু ইউসুফ রহ. কে একটি বিশেষ কিতাব রচনা করতে বলেন, যেখানে কারাবন্দীদের কষ্টলাঘব ও সংশোধনের জরুরী প্রস্তাবনা অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এতে খলিফার আগ্রহ ও সংস্কারকামিতার বিষয়টি স্পষ্টভাবে বুঝা যায়।

সালাহুদ্দিন আইয়ুবি রহ. কায়রোর একটি কারাগারের খারাপ অবস্থা দেখে সেটি ভেঙ্গে ফেলেন এবং তার স্থানে মাদরাসা নির্মাণ করেন। আব্বাসি খলিফা মুকতাদির বিল্লাহের যুগে কেন্দ্রীয় কারাব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয় এবং তিনি বন্দীদের চিকিৎসা, ওষুধ সরবরাহ ও বসবাসের মান উন্নয়ন করার নির্দেশনা জারি করেন।

আব্বাসি খলিফা মুকতাফির মন্ত্রী আউনুদ্দিন ইবনু হুবাইরা লেখেন, বর্তমানে যেভাবে কারাব্যবস্থা চলছে, তাকে কোনভাবেই বৈধতা দেওয়া যায় না। ছোট জায়গায় অনেক বন্দী, ওজু-নামাজের কষ্ট ও ঠাণ্ডা-গরমের যন্ত্রণার বিশেষ সমস্যা তৎকালীন কারাগারগুলোতে বিদ্যমান ছিল। তিনি লেখেন, এগুলো অতি সম্প্রতি তৈরি হয়েছে। এই অবস্থা পরিবর্তনে আমি সদাসচেষ্ট ও আগ্রহী, বাকি আল্লাহর ইচ্ছা।

মোটকথা ফুকাহায়ে কেরামের অব্যাহত চাপের মুখে মুসলিম শাসকগণ কারাব্যবস্থার সংস্কারে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হতেন। যুগেযুগে তাই আমরা মুসলিম শাসকদের নিয়মিত কারাসংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখি।

প্রচলিত কারাগার ব্যবস্থার বিকল্পের অনুসন্ধানে

আমরা আগেই বলেছি, আমাদের বিদ্যমান কারাব্যবস্থা পশ্চিমা উপনিবেশিক শক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত। ব্রিটিশরা যে কারা আইন তৈরি করেছিল, এখনো আমাদের কারাব্যবস্থা সেই আইনের মাধ্যমেই পরিচালিত হয়। পশ্চিমা দেশগুলোতেও এখন কারাসংস্কার আন্দোলন জোরালো হচ্ছে। তবে উপনিবেশিক ব্যবস্থার উত্তরাধিকারের অংশ হিসেবে আমাদের কারাব্যবস্থায় এখনো সংস্কারের ছোঁয়া লাগেনি। তাতে একদিকে যেমন বিপুল পরিমাণ নিরপরাধ মানুষ আটক হচ্ছেন, পাশাপাশি বন্দীরাও যথাযথ মর্যাদা ও অধিকার পাচ্ছেন না। সে প্রেক্ষিতে ইসলামের কারাদর্শন বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।

নিরপরাধ বন্দীরা ইউসুফ ও মুসা আ.-দের আদর্শের কথা মাথায় রাখতে পারেন। হক-বাতিলের লড়াই কেয়ামত পর্যন্ত চলবে, সেই প্রেক্ষিতে পশ্চিমা উপনিবেশিক ও তাদের দোসর শাসকদের আমলে হকপন্থীদের কারান্তরীণ হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। ইউসুফ আ. যেমন ভেঙ্গে পড়েননি, আমাদেরও ঠিক তেমনিভাবে সাহস ধরে রাখতে হবে। কারাগারে ইসলাম চর্চা, প্রচার ও মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। কোরআনের কারাগার কাহিনী এক্ষেত্রে আমাদের উত্তম আদর্শ।

বাংলাদেশ যেহেতু মুসলিম দেশ, তাই এখানের কারাব্যবস্থার সমালোচনা ও সংস্কারে আলেমদের বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে, যেমন ইমাম আবু ইউসুফ ও ইবেন তাইমিয়ারা ভূমিকা রেখেছিলেন। পাশাপাশি মুসলিম শাসকদের কারাসংস্কারে আগ্রহী ও উদ্যোগী করে তুলতে হবে। তাতে হয়তো কারাগার একদিন হয়ে উঠবে সমাধানের পথ, অন্ধকার ও প্রতিশোধ প্রবণতা কেটে যাবে। কারাগার হয়ে উঠবে খানকা ও মাদরাসার মতো সংশোধনের বিকল্প প্রতিষ্ঠান।

সূত্র:

১. আল কোরআন।
২. বুখারি ও মুসলিম।
৩. সিরাতে ইবনে হিশাম।
৪. আহকামুস সিজন ও মুয়ামালাতুস সুজানা ফীল ইসলাম। হাসান আবু গুদ্দাহ।
৫. কিতাবুল খারাজ। ইমাম আবু ইউসুফ।

The post ইসলামের কারাগার দর্শন appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%87%e0%a6%b8%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%97%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%a6%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%b6%e0%a6%a8/

No comments:

Post a Comment