Friday, June 26, 2020

কারাগারে আটক স্বপ্ন : অপেক্ষায় থাকা নারীদের গল্প

মুনশী নাঈম :

মুসলিম দেশে দেশে এখন কারানির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে। এর প্রভাব পড়ছে সর্বক্ষেত্রে— ব্যক্তিজীবন থেকে সমাজ ও পরিবারে সংক্রমিত হচ্ছে এর সর্বব্যাপী প্রভাব। এর প্রেক্ষিতে আল জাযিরার ময়দান বিভাগ মিসরের কারাবন্দীদের বাগদত্তা ও স্ত্রীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে এবং পরবর্তীতে এর ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন পেশ করে। আমরা এই লেখায় সে প্রতিবেদনের আলোকে কারাবন্দীদের বাগদত্তা ও স্ত্রীদের গল্প বলার চেষ্টা করবো।

২০১২ সালের শেষদিকে ফরিদের সঙ্গে এংগেজমেন্ট সম্পন্ন হয় সামিরার। কাবিনও লেখা হয় দস্তুরমতো। কেবল আনুষ্ঠানিক আয়োজন করে বিয়ের কাজটা সেরে ফেলা বাকি। সামিরার চোখে নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন, নতুন দিনের হাতছানি। বারবার হাতের রিংটার দিকে তাকায় আর ভাবে—এত ছোট্ট একটা রিং, এতবড় মানুষকে কিভাবে বেঁধে দেয়। নিজের ভাবনায় নিজেই হাসে সামিরা। কিন্তু তার এই হাসি টেকসই হয় না। আচমকা এক বিদ্যুচ্চমক কেড়ে নেয় তার হাসির সবটুকু সৌন্দর্য।

কাবিন লেখার কিছুদিন পরেই পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয় ফরিদ। কারাগারের প্রকোষ্ঠে নিক্ষিপ্ত হয় বড় নির্মমভাবে। সামিরার কোমল স্বপ্নের জগতে শক্ত ধাক্কা লাগে। এলোমেলো হয়ে যায় তার জগত। একদিন দুইদিন করে বছর পেরিয়ে যায়। ফরিদের মুক্তির কোনো আশা দেখা যায় না। ফরিদের বিরহ-যাতনা ভুলে থাকতে কাজের সন্ধানে দেশের বাইরে চলে যায় ফরিদা। পালাতে চায় বেদনা থেকে অনেক দূরে। কিন্তু কতদিন! সাড়ে চার বছর পর হুট করে চাকরিটা চলে যায়। আবার ফিরে আসে নিজের দেশ মিসরে। ফরিদের তখনো মুক্তি মেলেনি।

দেশে ফিরে উভয়মুখী সঙ্কটে পড়ে সামিরা। এখন সে কার কাছে থাকবে? বাবার বাড়ি, নাকি শ্বশুর বাড়ি? সামিরা নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে—আমি তার স্ত্রী, নাকি বাগদত্তা? অনেক প্রশ্ন এবং অনেক মতানৈক্যের পর সিদ্ধান্ত হয়—সামিরা শ্বশুর বাড়িতেই থাকবে। বাড়িতে কেউ নেই। শ্বশুর-শ্বাশুরি বৃদ্ধ; তাদের দেখাশুনা প্রয়োজন। কিন্তু কিছুদিন পরই আর মন মানে না ফরিদার। মনে হতে থাকে তার জীবন থমকে গেছে নৈরাশ্যের উপত্যকায়। তাকে গ্রাস করে ভয়ংকর বিষাদ। সে হারিয়ে ফেলে কাজের আগ্রহ, বিরক্তি দেখা দেয় সবকিছুতে। সারাদিন ঘুম আর ঘুম। দিনের সিংহভাগ কাটে ঘুমিয়ে। যতটুকু জেগে থাকে, চোখে ভেসে থাকে ফরিদের মুখ, বিয়ের স্বপ্ন, মিলনের দীর্ঘশ্বাস।

একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে দীর্ঘ এক বছর চিকিৎসা নেয় সামিরা। চিকিৎসায় মানসিকভাবে যখন একটু সুস্থ হয়ে উঠছে, তখন আদালত ফরিদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড (২৫ বছর) ঘোষণা করে। ফরিদার অপেক্ষার প্রহর তীব্র হয়, দীর্ঘ হয়, বড্ড দীর্ঘ। উপরে শান্ত, কিন্তু ভেতরে বয়ে চলে তার ঘূর্ণিঝড়। তার দিকে তাকিয়ে তার বাবা-মা চোখের জল ফেলে। বাবা-মায়ের জল ছলোছলো নীরব চোখ দেখে বুক ফেটে যায় সামিরার। তার বয়স এখন আঠাশ।

ফরিদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের কথাটি মনে পড়লেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠে সামিরার। বয়স তার আঠাশ পেরিয়ে উনত্রিশে পড়েছে। তার বয়েসী অনেকেই সংসারী হয়ে গেছে। সে সংসারী হয়েও হতে পারলো না। দুঃখ ভুলে থাকার জন্য চাকরি খুঁজে সামিরা। যে চাকরী তার মন সবটুকু দখল করে নিবে। পালাতে চাইলেই কি মানুষ পালাতে পারে? মানুষটি চোখের সামনে থাকলে তার থেকে পালানো যায়। কিন্তু যে মানুষটি চোখের সামনেই নেই, তার থেকে পালাবে কি করে?

মাঝেমধ্যে সামিরার ভাবনা হয়—ফরিদের সঙ্গে বাগদান ভেঙে দিলে কেমন হয়? কিন্তু ভাবনাটি মাথায় আসার পরই একটা অপরাধবোধ তাকে ঘিরে ধরে। যে মানুষটি তাকে সত্যিকার ভালোবাসে, দুজন এক হবার জন্য সে কত আয়োজন করেছিল, এখন সে অন্যায়ভাবে কারারুদ্ধ। এতে তার কী দোষ? আমি কিছু করতে না পরি, তার বন্দীত্বের কষ্ট তো কিছু কমাতে পারছি। কারাগারে দেখা করার সময় ফরিদ বারবার বলে—তুমি যদি না থাকতে, কারাগারের এই নির্মমতা আমি সহ্য করতে পারতাম না সামিরা। তোমার কল্পনা আমাকে স্বস্তি দেয়। ভাবি একদিন সব ঠিক হবে। আবার আমরা একসাথে হবো।

সামিরা ভাবে—আমাদের সম্পর্ক ছয় বছরের। একজন আরেকজনকে চিনি, জানি। হুট করেই ছেড়ে দেয়া তো সহজ না। নিজের ওপর নিজের রাগ হয় সামিরার। কিন্তু রাগ করেই বা কি হবে? ফরিদের ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে বাগদান ভেঙে দেবার শক্তি তো তার নাই।

ইহসানের সঙ্গে আমিরার যখন বাগদান সম্পন্ন হয়, তার বয়স ১৯। ইহসানের বয়স ২৩। বাগদান সম্পন্ন হবার কিছুদিন পর, বিয়ের আগেই গ্রেফতার হয় ইহসান। কিশোরী আমিরা তখন ভেঙে পড়ে দারুণভাবে। জীবনে এই প্রথম প্রিয়তমকে ঘিরে স্বপ্ন দেখছিলো। কাছে এসেও যেন কাছে আসা হলো না। ঘুমভেঙে স্পর্শ করতে গিয়ে যেন দেখলো কেউ নেই পাশে, কেউ নেই।

নিজের বাগদত্তা স্বামী কারাগারে বন্দী হবার পর পড়াশুনা শিকেয় উঠে আমিরার। জানালার পাশে বসে সে কেবল ভাবতে থাকে, কী এক নিদারুণ ভাগ্য তার। দুজনের বয়স বাড়ছে; একজনের বয়স বাড়ছে কারাগারে, আরেকজনের একলা ঘরে। আচ্ছা, সে যা ভাবছে, ওপ্রান্তে ইহসানও কি তাই ভাবছে?

বাগদত্তা স্বামী গ্রেফতার হবার কিছুদিন পর গ্রেফতার করা হয় আমিরার বাবাকেও। এবার তার পুরো পরিবার ভেঙে পড়ে। ঘর থেকে কারাগার—দৌড়াদৌড়ি করতেই সময় কেটে যায়। দুজনকেই এক সেলে রাখা হয়েছে। কিন্তু দুজনের সঙ্গে দেখা করার সময় ভিন্ন। সপ্তাহে দু’দিন। তাও দেখা করার জন্য অনুমতি আনতে হয় সামরিক কোর্ট থেকে।

দুঃখ ভুলে থাকতে আমিরা অনলাইনে কাজ শুরু করে ঘরে বসেই। যে সম্পর্কে সে জড়িয়ে পড়েছে, তা ক্রমশ জটিল আকার ধারণ করছে। কতদিন তাকে অপেক্ষা করতে হবে, তার নিশ্চয়তা নেই।

আড়াই বছর চিন-পরিচয়ের পর দু’ পরিবারের সম্মতিতেই আংটি পড়ানোর দিন ঠিক হলো শায়মা এবং মিরাজের। আংটি পড়ানোর দিনই আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হবে তাদের বিয়ের। কিন্তু তার আগেই গ্রেফতার হয়ে গেলো মেরাজ। চৌদ্দশিকের ভেতর শুরু হলো তার জীবনযাপন। কিন্তু ওই শিক আটকাতে পারলো না তাদের ভালোবাসার জোয়ার। মেরাজ কারাগারে থাকা অবস্থায়ই সম্পন্ন হলো বাগদান। কারাগারের শিকের ফাঁক দিয়ে শায়মার আঙুলে একটা আংটি পড়িয়ে দিলো মেরাজ। কারারক্ষীরা তাকিয়ে দেখলো।

প্রতি দু’ সপ্তাহ অন্তর মেরাজকে দেখতে যেতো শায়মা। বেশি বেশি দেখা করতে যাবার কারণে কারারক্ষীরাও তাকে চিনে ফেললো। রক্ষীরা মাঝেমধ্যেই তাকে লক্ষ্য করে টিপ্পনি কাটতো অশ্লীল ভাষায়। তবে সবসময় দেখা করার সুবিধা পেতো না শায়মা। এক ঈদুল আজহায় তার পরিবারের সবাইকে মেরাজের সঙ্গে দেখা করতে দিলেও শায়মাকে দেখা করার অনুমতি দেয়া হয়নি। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে—শায়মা মেরাজের নিকট আত্মীয় নয়।

কিন্তু দিন যত যেতে থাকে, শায়মার মনে হতে থাকে তার দম আটকে আসছে। অপেক্ষার এই দীর্ঘ দিন, দীর্ঘ রাত একদম অসহ্য হয়ে উঠে। সারাক্ষণ কেবল ভাবনা—একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। তাদের একটা ঘর হবে, তারা তাদের স্বপ্নগুলো কাছে পাবে। তার সমস্ত কাজে সে আর একলা থাকবে না। পাশে থাকবে প্রিয়তম, কাছে থাকবে ভরসায়। কিন্তু সেই একদিনটা আসবে কবে?

একদিন হুট করেই মেরাজের মুক্তির জন্য কাগজপত্র রেডি করতে বলা হয়। শায়মা দৌড়ে ছুটে চলে কারাগার কর্তৃপক্ষের কাছে। কিন্তু কোনো কাজ হয় না। কর্তৃপক্ষ শায়মার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, ‘এত তাড়াহুড়া কেন, সয় না?’ শায়মার ইচ্ছে করে প্রচণ্ড একটা চড় কষিয়ে দিতে অফিসারের গালে। কিন্তু নিজেকে সংবরণ করে। আরও বিভিন্ন টেবিলে যোগাযোগ করে জানতে পারে, মেরাজকে অমুক সেলে রাখা হয়েছে। ওই সেলের রক্ষীকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে সায়মা। রক্ষী প্রতিদিন ফোনেই মেরাজের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেয় শায়মাকে। কথা বলার সময় একদিন হুট করেই লাইনটা কেটে যায়। বুকটা ধক করে উঠে শায়মার। অশুভ কিছু হয়নি তো! একটুপর মেরাজ কল করে। শায়মা জিজ্ঞেস করে, কল কাটলো কেন? মেরাজ বললো, অফিসার এসেছিলো। জানতে পারলে মুক্তি বাতিল হয়ে যেতো।

মেরাজ মুক্তি পায়। মুক্তি পাবার পরও অনেকদিন সে চুপ করে থাকে। খুব বেশি কথা বলে না। শায়মার খুব কথা বলতে ইচ্ছে করে, গল্প করতে ইচ্ছে করে। আল জাযিরাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে শায়মা জানায়, ‘আমরা দুজন সময়টাকে কাটিয়ে দিয়েছি সমন্বয় করেই। স্বামী থেকে আলাদা হতে চাইলে তো বাহানার অভাব নেই। আমি কোনো বাহানা করতে চাইনি; জড়িয়ে থাকতে চেয়েছি। ভালোবাসার মূল-ই বিশ্বাস। এটা না থাকলে আর কিছুই বাকি থাকে না।’

উপরে মাত্র তিনটি গল্প বলা হয়েছে। এমন হাজারো গল্প প্রতিদিন তৈরী হচ্ছে পৃথিবীর কোণায় কোণায়। কতজন বাগদত্তা মেয়ে কারাগারে আটক তার স্বামীর মুক্তির অপেক্ষায় আছে—তা সঠিক হিসেব কখনোই হয়নি। হয়তো এ বিষয়টি অনেকে লক্ষ্যই করে না। অন্য অনেকের অপেক্ষার চেয়ে বাগদত্তা মেয়ের অপেক্ষা হয় তীব্র। তার যন্ত্রণা হয় অনেক বেশি। সামাজিক এবং মানসিক দুভাবেই পীড়নের স্বীকার হয় সে।

পীড়নের এই সময়ে তার সময়গুলো হয় বড় মর্মান্তিক। তবে তার পীড়ন কমাতে পারে কয়েকটি জিনিস।

ক. পরিবারের সাপোর্ট

বাগদত্তা স্বামী যখন এত দীর্ঘ সময় কারাগারে থাকে, সামাজিকভাবেই মেয়ের ওপর চাপ থাকে অন্যত্র বিয়ে করে ফেলার। কিন্তু এই চাপ অনেকটাই কমিয়ে দেয় পারিবারিক সাপোর্ট। কোনো কোনো পরিবারের সাংগঠনিক শক্তি থাকে, নৈতিক ভিত্তি মজবুত থাকে। তারা বিষয়টা সহজেই মেনে নিতে পারে। কোনো পরিবারে বাবা এবং বাগদত্তা দুজনই কারাগারে আটক। যেমনটা আমিরার ক্ষেত্রে দেখেছি। তারা তো নিজেরাই ভুক্তভোগী, অন্যত্র বিয়ে করার চাপ তারা কখনোই দেয় না। কোনো পরিবারের মেয়েরা ছোট থেকে এই পরিস্থিতির মুখোমুখি; কখনো তার বাবা, কখনো তার ভাই আটক হয়। মুক্তি পায়। তার চারপাশেও এমন ঘটে। তখন তাদের কাছে বাগদত্তার বিষয়টাও সাধারণ হয়ে যায়। পরিবারের এইটুকু সাপোর্ট বাগদত্তা মেয়ের চাপ কিছুটা কমিয়ে দেয়।

খ. কাবিন লেখা

বাগদত্তা মেয়ের জন্য কারাগারে তার স্বামীর সঙ্গে দেখা করাটা বেশ কঠিন। কারণ সে তার নিকট আত্মীয় নয়। ফলে দেখা করার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হয়। কখনো বোনের কার্ড দিয়ে, কখনো ফুপুর কার্ড দিয়ে দেখা করে। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে তো আর সুযোগ হয় না। তবে যদি তাদের কাবিন লেখা হয়ে যায়, তাহলে সে অনায়াসেই দেখা করতে পারে। কারণ, কাবিন হয়ে যাওয়া মানে সম্পর্কের চূড়ান্ত করে ফেলা। এখন চাইলেই খুব সহজে দুজন আলাদা হতে পারবে না। শায়মা আল জাজিরাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলে, ‘এই কাবিন লেখাটা দুজনের জন্যই উপকারী। এতে বাগদত্তা মেয়ে যেমন দেখা করার সুযোগ পায়, তেমনি এতে বন্দীও মানসিক প্রশান্তি পায়। এর মাধ্যমে দুজনের নৈকট্য বাড়ে। বাগদত্তা মেয়েটিও স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে।’

গ. শ্বশুরবাড়ির সাথে সম্পর্ক

বাগদত্তা মেয়ের সঙ্গে তার শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কটা একরকম অস্পষ্টই থাকে। তবে এই সময় ছেলের সঙ্গে যদি মেয়েকে দেখা করতে না দেয়, তাহলে এটা বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। অনেক পরিবার মেয়ের মনোকষ্ট বুঝতে চেষ্টা করে। সাক্ষাতের সময় সংক্ষিপ্ত হলেও ছেলে-মেয়ের জন্য আলাদা একটু সময় দেয় একান্তে কথা বলার জন্য। অনেকে সেটাও দেয় না।

বন্দী থাকার কারণে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে বন্দীর অনুভূতি, পুরুষত্ব। মানসিক পীড়ায় ভুগতে থাকে সে। তার এই মানসিক পীড়া কিছুটা কাটিয়ে তুলতে পারে একজন নারী, তার বাগদত্তা স্ত্রী। স্বামীর এই পীড়া লাঘব করতে বাগদত্তা মেয়েরাও কারাগারে কারাগারে ঘুরে বেড়ায়। তাদের দুজনের মাঝে সাক্ষাৎ সহজ হলে দুজনের কষ্টটাও কম হয়। হয়তো স্বামীকে দূরবর্তী কোনো কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। মেয়েকে দীর্ঘ সফর করে পৌঁছুতে হয় সেখানে। অনুমতি পাবার জন্য ধর্না দিতে হয় টেবিলে টেবিলে। স্বামীদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে কারাকর্মকর্তাদের লোলুপ দৃষ্টির সম্মুখিনও হয় তারা।

কারাগারে বন্দীর আনন্দের একমাত্র সম্বল হয় তার বাগদত্তা স্ত্রীর দিয়ে যাওয়া বিভিন্ন উপহার। হয়তো একটি রুমাল, একটি গোলাপ, একটি চিঠি, একটি সাবান। স্ত্রীর দিয়ে যাওয়া প্রতিটি জিনিস তাকে আনন্দ দেয়। তার নিঃসঙ্গতায় সঙ্গী হয়। কল্পনায় উড়ে আসে সুবাস, তৈরী হয় মোহময় আবেশ। ভালোবাসলে নাকি মানুষ নদী হয়ে যায়। এই নদী কারাগারের চৌদ্দ শিকের আটকাবার ক্ষমতা নেই।

তবে সবচে দুঃখের বিষয় হলো—দীর্ঘ সময় পর কারাগার থেকে মুক্তি পাবার পর কারো কারো ভেঙে যায় বাগদান। এতদিনের অপেক্ষা সব চূর্ণ হয়ে যায়। মনোবিদগণ এক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই দায়ী করেন। তারা বলেন, সদ্যই কারাগার থেকে বেরিয়ে একটা মানসিক ট্রমার মধ্যে থাকে স্বামী। স্থিত হতে তার কিছু সময় দরকার। কিন্তু স্ত্রী অপেক্ষা করতে করতে অসহ্য হয়ে উঠে। স্বামী স্থিত হবার আগেই চাইতে থাকে সব আদর সোহাগ। ফলে দ্বন্দ্ব বেঁধে যায়। দ্বন্দ্ব বাড়তে বাড়তে একসময় বাগদানটাও ভেঙে যায়।

শায়মা বলেছিল, ‘মেয়েটা হতো জানে না কারাগারে তার স্বামীর মন কেমন করে বদলে গেছে। মানুষের বাহ্যিক পরিবর্তন চোখে পড়ে, কিন্তু অন্তর্গত পরিবর্তন খুব কমই চোখে পড়ে। আর কারাগারের নির্মমতা মানুষের মন তার অজান্তেই পরিবর্তন করে দেয়। তাই স্বামী কারাগার থেকে বেরিয়ে আসলেই সব শেষ নয়। বরং এখন স্বামী এবং স্ত্রী দুজনেরই চিকিৎসা দরকার। সহনশীলতা দরকার।’

এক্ষেত্রে পরিবারও দায়ী। কিছু কিছু পরিবার ছেলে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসতে না আসতেই আনুষ্ঠানিক বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে। অথচ তখনও সে সুস্থ হয়নি, স্থিত হয়নি। ফলে তার মাঝে এবং বাগদত্তা মেয়ের মাঝে কখনো কখনো বিরোধ বাড়তে থাকে। তাই কারাগার থেকে মুক্তি পাবার পর ছেলের নিজস্ব সময় দরকার। যেন সে সুস্থ হয়ে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে। এতে বাগদত্তা মেয়ের অপেক্ষা হয়তো কিছুদিন বাড়বে, বাড়ুক। এতে দুজনের উপকার হয়।

আটক স্বামীর বাগদত্তা স্ত্রীর সবচে ভয়ংকর সময় হলো—যখন তার মনে হয় তার জীবন থমকে গেছে। নৈরাশ্য গ্রাস করছে চারদিক থেকে। প্রথম তিনটি গল্পে আমরা যা দেখেছি। এই নৈরাশ্যবাদিতা থেকে মুক্তি পেতে মেয়েটি হয়তো কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, জিমে যায়, পড়ালেখায় মন দিতে চায়। কিন্তু এগুলো তো সাময়িকের জন্য দুঃখ আড়াল করে রাখে। একবারে নিঃশেষ করে দিতে পারে না। তাই তার দরকার হয় অন্য মেয়েদের মানসিক সাপোর্ট, উৎসাহ।

কারাগারে কষ্ট কেবল ছেলেটিই পায় না, কারাগারের বাইরে আরও একটি প্রাণ ছটফট করে, তীব্র যন্ত্রণায় চিৎকার করে। এটা কোনো অংশেই কম নয়। পরিবার, সমাজ, বাবা-মায়ের নীরব দৃষ্টি কিংবা চাপ উপেক্ষা করে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকা মেয়েটির সময় খুব সহজে কাটে না। যতটা সহজে আমরা চিন্তা করতে পারি। এক বন্দীর বাগদত্তা স্ত্রী তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছিলেন, ‘জানি, এই সময় কেটে যাবে, খুব ধীরে হলেও। কিন্তু আমার হৃদয়ে রেখে যাবে সমস্ত ভার, অবসাদ। চুরি করে নিয়ে যাবে আমার বয়স।’

The post কারাগারে আটক স্বপ্ন : অপেক্ষায় থাকা নারীদের গল্প appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%97%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%87-%e0%a6%86%e0%a6%9f%e0%a6%95-%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%a8-%e0%a6%85%e0%a6%aa%e0%a7%87%e0%a6%95/

No comments:

Post a Comment