Friday, June 26, 2020

কারাগার ও আমার জীবন : জিয়াউর রহমান ফারুকি

আহমাদ সাব্বির:

যাপিত জীবনের রকমফের

জীবন! কতো রকমভাবে যে মানুষ যাপন করে তার জীবন! খোদা প্রদত্ত ষাট সত্তর বছর আয়ুষ্কালের আদ্যোপান্ত কেউ অবগাহন করে যায় সুখ সায়রে৷ কেউবা আবার ঠিক তার বিপরীত; সুখ বলে যে একটা বস্তু আছে পৃথিবীতে তা আর জানা হয় না তার৷ এবং সুখ সম্বন্ধে এই অবিশ্বাস দৃঢ়ভাবে থেকে যায় তার মনে মৃত্যুর ফেরেশতা এসে শিয়রে দাঁড়াবার মুহূর্তটি পর্যন্ত৷ আবার এমন মানুষের সংখ্যাও অতীব নগণ্য নয়— যারা জীবনের তাবৎ সুখ-ঐশ্বর্য-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে বেছে নিয়েছে বাহ্যত গ্লানির জীবন৷ যে জীবনে আয়েশী তাকিয়া নেই৷ মখমলে মোড়া নরোম কোমল আরামদায়ক বিছানা নেই৷ আছে কেবল অবসন্ন দেহখানা এলিয়ে দেবার জন্যে এক টুকরো শীর্ণ চাটাই আর ভারাক্রান্ত মাথাটা ঠেকিয়ে রাখবার জন্যে শক্ত অমসৃণ এক খণ্ড প্রস্তর৷

শেষোক্ত বর্ণনার উদাহরণ অসংখ্য পাবেন আমাদের হীরণ্ময় ইতিহাসের পাতায় পাতায়৷ বিশেষত সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমদের জীবনে৷ দ্বীনের জন্যে, ইসলামের জন্যে সর্বোপরি নবিজির সম্মান ও ইজ্জত রক্ষার্থে তাঁরা যে নাজরানা পেশ করে গেছেন কেয়ামত অবধি তার তুল্য দেখাতে পারবে না কেউ৷

সাহাবায়ে কেরামের কোরবানীর সমপরিমাণ নয়; তবে দ্বীনের জন্যে এবং নবিজি ও সাহাবায়ে কেরামের ইজ্জত সমুন্নত রক্ষার স্বার্থে আয়েশি জীবন ত্যাগ করে বরণ করে নিয়েছেন পিড়ীতের জীবন; মুগ্ধকর সুবাসিত ফুলেল বাগিচা ছেড়ে নিবাস গড়েছেন অত্যাচারীর জিন্দানখানায়— এমন উদাহরণ কম নয়৷ ইতিহাসের প্রতিটি প্রান্তরে এমন ত্যাগী ও সাহসী ব্যক্তির দেখা পেয়ে যাবেন আপনি৷ নিকট সময়ের এমনই এক ব্যক্তিত্ব হলেন আমাদের গরবের ধন জিয়াউর রহমান ফারুকী৷ যিনি তার জীবনের আনন্দমুখর বসন্ত ছেড়ে ঝাঁপ দিয়েছিলেন বাহ্যত শুষ্ক রূক্ষ প্রচণ্ড উষ্ণ গ্রীস্মের তাপদাহে৷

ফারুকী এবং সিপাহে সাহাবা

আমাদের জীবনের স্বস্তির দিনগুলো হারিয়ে গেছে, আমরা বেছে নিয়েছি এক কঠিন পথ। এখন একে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে আমাদের দিন। আমাদের প্রতিটি কাজই এখন জীবনের এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য। আমি এই কণ্টকাকীর্ণ পথ স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছি। আমাকে কেউ বাধ্য করেনি। আমি এই পথে আসার আগেই মাকে বলে দিয়েছি— এই পথে আমাকে শাহাদাতের অলংকার পরতে হবে। কানে বাজবে হাতকড়ার ঝংকার। এই পথের দাবিই এটি।
— জিয়াউর রহমান ফারুকী৷

মাওলানা জিয়াউর রহমান ফারুকির জন্ম ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে, ফয়সালাবাদের সামুন্দরিতে। জামিয়া বাবুল উলুমে তার পড়াশোনা শুরু হয়। শুরু থেকেই একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে তার পরিচিতি ছিল। মাওলানা ফারুকী তার আত্মকথা ‘ফের ওয়াহী ক্বয়েদে ক্বফাস’ এ লিখেছেন—

‘ছাত্রজীবন ছিল এক আশ্চর্য বসন্তকালের মতো। আমি সেই সময়ের কথা এখনো স্মরণ করি। আমি চাই আবার সেই সময় ফিরে আসুক। গভীর রাত পর্যন্ত পাঠ্য এবং পাঠ্য বইয়ের বাইরের বই-পুস্তক পাঠ করা যেন আমার নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। জমিয়তে তালাবায়ে ইসলামের ব্যস্ততা এবং মাদরাসার পাঠ্যক্রমের পড়াশোনার বাইরেও দিনে গড়ে প্রায় একশো পৃষ্ঠা পড়া আমার অভ্যাস হয়ে উঠেছিলো। জীবনে কখনো খেলাধুলা করিনি। অবসরেও কোনো কাজে ব্যস্ত থাকাতেই ছিল আমার আনন্দ।’

মাওলানা ফারুকির এই বিস্তৃত অধ্যয়ন পরবর্তী দিনগুলোতে তার লেখনী ও বক্তৃতার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছিলো। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে মিশকাত জামাতে অধ্যয়নকালে নবিজির জীবন নিয়ে ‘রাহবার ও রাহনুমা’ নামে একটি সিরাতগ্রন্থ রচনা করেন তিনি। এ সময়ে মাত্র তিন মাসে তিনি প্রায় একশোটি উরদু, ফারসি ও আরবি সীরাতগ্রন্থ অধ্যয়ন করেন।

ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি ও বক্তৃতার জগতে তিনি নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে এক সমাবেশে জুলফিকার আলি ভুট্টোর বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়ায় তিনি গ্রেফতার হন। সেই শুরু৷ তারপর থেকে জীবদ্দশায় তিনি আট বার বন্দি হন জালিমের বন্দিশালায়৷ আর বিভিন্ন সময়ে বক্তৃতা দিতে গিয়ে ঘন্টা খানিকের জন্যে বন্দিত্বের শেকল পড়েছেন যে কত বার— তার আর লেখাজোখা নেই৷

অল্পবয়সেই মাওলানা ফারুকি সুবক্তা হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার শেষে তিনি সারাদেশে সফর করে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতেন। একইসাথে লেখালেখিও অব্যাহত রাখেন। নিজের চিন্তা ও মতাদর্শগত মিল খুঁজে পেয়ে জীবনের এক পর্যায়ে তিনি ‘সিপাহে সাহাবা’র সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন৷ এবং মৃত্যু পর্যন্ত অবিচল থাকেন এই সংগঠনটির সাথে৷

সিপাহে সাহাবা পাকিস্তানের এমন একটি ধর্মীয় সংগঠন, যার জন্ম হয়েছিলো ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ সালে সংঘটিত ইরানি বিপ্লবের বিরোধিতার লক্ষ্য নিয়ে। সিপাহে সাহাবার জন্ম ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮৫ সালে। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মাওলানা হক নেওয়াজ জংগবি। ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে ইরানের ষড়যন্ত্রে তাকে হত্যা করা হয়। মাওলানার শাহাদাতের পর সিপাহে সাহাবার পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হয় মাওলানা জিয়াউর রহমান ফারুকীর কাঁধে৷ তিনি পরিচালনার দায়িত্ব সামলানোর পাশাপাশি সিপাহে সাহাবার কেন্দ্রীয় সদস্যপদ, মজলিশে শুরার প্রতিষ্ঠা, বিভিন্ন জেলায় আঞ্চলিক কমিটি প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি উদ্যোগের মাধ্যমে এর কাঠামো আরও মজবুত করে তোলেন। জিয়াউর রহমান ফারুকী পরিচালনার দায়িত্ব পাবার পর প্রথম পাঁচ বছরে পাকিস্তানসহ পৃথিবীর ২৬টি দেশে ১৫ হাজারের বেশি ইউনিট প্রতিষ্ঠিত হয় এই সংগঠনটির। আর সংগঠনে স্বেচ্ছাকর্মী হিসাবে নাম লেখায় ২০ লাখেরও অধিক তরুণ৷

প্রথম থেকেই সিপাহে সাহাবার দাবি ছিল অত্যন্ত সুস্পষ্ট: খোমেনির বইপত্র, ইরানি বিপ্লবের বন্দনায় পাকিস্তানি শিয়া ও ইরান দূতাবাস থেকে প্রচারিত বইপত্র নিষিদ্ধ করতে হবে। এসব বইয়ে হজরত আবু বকর, হজরত উমরসহ সকল সাহাবিকে তাকফির করা হয়েছিলো৷ উপরন্তু কুরআনকে বিকৃত বলে এবং নিজেদের কালিমায় পরিবর্তন এনে শিয়ারা তাদেরকে মুসলমানদের থেকে পৃথক করে ফেলেছিলো।

সিপাহে সাহাবার মূল উদ্দেশ্যই ছিলো— সাহাবায়ে কেরামের সম্মান সংরক্ষণ ও ইসলামের বিজয়ের চেষ্টা সাধন। শিয়ারা যেহেতু প্রকাশ্যে সাহাবিদেরকে তাকফির করে, কালিমায় পরিবর্তন করে, এবং অন্তরে পোষণ করে কুরআন বিকৃত হওয়ার বিশ্বাস তাই সিপাহে সাহাবার দায়িত্ব ছিল প্রকাশ্যে তাদের এসব প্রতারণা ও চাতুরি মানুষের সামনে তুলে ধরা এবং তাদেরকে অমুসলিম ঘোষণা করে দেওয়া৷

মাওলানা জিয়াউর রহমান ফারুকী শুরু থেকেই তিনি শিয়াদের এ সকল কর্মকাণ্ডের বিরধিতা করে আসছিলেন৷ এবং বিভিন্ন সভা-সেমিনারে যৌক্তিক ভাষায় সতর্ক করে আসছিলেন শিয়া মতবাদ ও তাদের ভ্রান্তি সম্পর্কে৷ আর এটাই ছিল জালিমদের চোখে তার অপরাধ (!)

কারাজীবনের ফিরিস্তি

প্রথম কারাবাস

জিয়াউর রহমান ফারুকী প্রথম যে বার গ্রেফতার হন তার বয়স মাত্র ২০ বছর৷ সময় তখন ১৯৭৩ খৃষ্টাব্দ৷ জমিয়তে তলাবায়ে ইসলামের পাঞ্জাব শাখার সহ-সভাপতি ছিলেন তিনি৷ আর পড়াশোনা করছেন জামিয়া বাবুল উলুমে।

২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩ এর কথা। খানিয়াল জেলার এক সম্মেলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টোর বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন তিনি। তার সেই বক্তব্যের অপরাধে তাকে এবং তার আরেকজন সহকর্মী নাদিম ইকবালকে গ্রেফতার করে মুলতান কারাগারে পাঠানো হয়। জীবনের সেই প্রথম কারাবাসে ১৫ দিন সরকারের আতিথেয়তা গ্রহণ করার সুযোগ হয়েছিল জিয়াউর রহমান ফারুকীর৷

দ্বিতীয় কারাবাস

৭ মে ১৯৭৪ সালে ফয়সালাবাদ থেকে খতমে নবুওয়াত আন্দোলনের সূচনা হয়। এসবই ছিল মুজাহিদে ইসলাম মাওলানা তাজ মাহমুদ এবং আলমি মজলিশে তাহাফফুজে খতমে নবুওতের চেষ্টার ফসল। এই আন্দোলনের দ্বিতীয় দিনেই ফয়সালাবাদ থেকে গ্রেফতার হন জিয়াউর রহমান ফারুকী। সে সময় তার সাথে তার বড় ভাই কারী আতাউর রহমান শাহবাজ এবং ছোট ভাই হাজি শিফাউর রহমান বুখারিও ছিলেন। বিক্ষুব্ধ জনতা হরতাল আহ্বান করে তাদের গ্রেফতারির প্রতিবাদে৷ ফলে চারদিনের বেশি আটক রাখা সম্ভব হয় না৷ চারদিন পর ফয়সালাবাদ সেন্ট্রাল জেল থেকে সবাইকে মুক্তি দেওয়া হয়।

মুক্তির পর জিয়াউর রহমান ফারুকী যেন নব উদ্যমে উদ্যোমী হয়ে ওঠেন৷ সারাদেশ সফর করে ছাত্র সংগঠনগুলোর উদ্যোগে আয়োজিত খতমে নবুওয়াত কনফারেন্সে যোগ দেন তিনি৷

তৃতীয় কারাবাস

জামিয়া বাবুল উলুমে উপস্থিতির পাশাপাশি তখন অসংখ্য জলসায় হাজির হওয়ার সুযোগ হচ্ছিল মাওলানা ফারুকীর।

১৯৭৪ সালের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ৷ মুজাফফরনগরের এক জেলা রোহিলানোলির কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রশাসন এই অনুষ্ঠানে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে আসরের নামাজের পর মসজিদে অনুষ্ঠান শুরু করা হয়। এসময় একজন ইন্সপেক্টর খান মুহাম্মদ জুতাসহ মসজিদে প্রবেশ করে এবং ১৩ জন কর্মীকে গ্রেফতার করে। সেই ১৩ জন বন্দির একজন ছিলেন মাওলানা ফারুকী৷ প্রথম রাত তাদেরকে থানায় রেখে পরদিন পাঠিয়ে দেয়া হয় মুজাফফরগড় কারাগারে৷ খতমে নবুওয়াত আন্দোলনে অংশ নেওয়ার অপরাধে তিনি-সহ বাকী ১২ জন ৪০ দিন কারা বরণ করেন। সেবারই তিনি জেলে বসে তার বিখ্যাত সীরাত গ্রন্থ ‘রাহবার ও রাহনুমা’র অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করেন৷

এ কারাবাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে জিয়াউর রহমান ফারুকী লিখেছেন—

‘মুজাফফরগড়ের কারাবাস আমার জীবনের গতি নির্ধারণ করে দেয়। নির্দ্বিধায় ও নির্ভয়ে ইসলামি আন্দোলনে অংশগ্রহণের মানসিকতা এখানেই দৃঢ় হয়ে যায়৷ আমার পিতা মাওলানা মুহাম্মদ আলি জানবাজ ছিলেন আমিরে শরিয়ত আতাউল্লাহ শাহ বুখারির সান্নিধ্যপ্রাপ্ত। বন্ধু এবং সহযোগী। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি মজলিশে আহরার ও মজলিশে খতমে নবুওয়াতের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। পিতা একবার আমার সাথে কারাগারে দেখা করতে আসেন। তিনি উপদেশ প্রদানের স্বরে আমাকে বলেন— যেই মিশনের কারণে কারাগারে এসেছ তা বাস্তবায়নের জন্য যদি জীবন দিতে হয় তবু পিছপা হবে না।

পিতার এই কথা আমার ভেতরের চেতনাকে জাগিয়ে তোলে। দ্বীনে মুহাম্মদির জন্য সবকিছু কোরবানি করার মানসিকতা তৈরি করে দেয়। কারাগারে থাকা অবস্থাতেই এল পাকিস্তানের ইতিহাসের সেই স্বর্ণোজ্জ্বল দিন। দিনটি ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ সাল৷ পাকিস্তানের সংসদ কাদিয়ানিদের কাফের ঘোষণা করে। এটি ছিল ১০০ বছর ধরে আশেকানে মুস্তফাদের ত্যাগ ও কোরবানি এবং মেহনতের ফসল।

ইলমি মারকায থেকে ৪০ দিন অনুপস্থিত— সেজন্য হৃদয় ছিল ভারাক্রান্ত৷ কিন্তু আন্দোলনের এমন সাফল্যের সংবাদে প্রফুল্ল হয়ে উঠ। অধিক খুশি লাগছিল এই ভেবে যে— এই আন্দোলনে আমিও অংশী ছিলাম।

কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণার এক সপ্তাহ পর আমরা কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে আবার পড়াশোনায় ব্যস্ত হয়ে যাই।’

চতুর্থ কারাবাস

মার্চ ১৯৭৭ সাল৷ জুলফিকার আলি ভুট্টোর বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে দেশের সকল ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দল৷ পুরো দেশ মুফতি মাহমুদ রহিমাহুল্লাহর নেতৃত্বে তাহরিকে নেজামে মুস্তফার উপর ঐক্যবদ্ধ হয়। ভুট্টোর বিরুদ্ধে এ আন্দোলন ছিলো একই সাথে তার সকল জুলুম-অন্যায়-অবিচার, অসহায় পিড়ীতদের সম্পদ লুণ্ঠন এবং ইসলামবিরোধী সমস্ত কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে৷

মাদরাসার পড়াশোনা শেষ করে জিয়াউর রহমান ফারুকী সেসময় পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটিতে বিএ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আন্দোলন শুরু হতেই তিনি সকল কাজ ছেড়ে দিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন আন্দোলন নিয়ে। একদিকে সারা দেশে একের পর এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। অপরদিকে ফারুকী সাহেবের শহর সমন্দরিতে চলছে গ্রেফতারির মহড়া। প্রায় তিন মাস নানাভাবে আন্দোলনে সক্রিয় থাকার পর ১০ জুন ১৯৭৭ সালে এক সমাবেশের কারণে গ্রেফতার করা হয় তাকে। সে সময় তার নামে অনেকগুলো মামলাও দায়ের করা হয়। পনর দিন কারাগারে থাকার পর পঁচিশজুন তিনি মুক্তি পান৷

পঞ্চম কারাবাস

২ জুলাই ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দ৷ জামে মসজিদ বাগওয়ালিতে সরকারের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দেওয়ার কারণে গ্রেফতার হন তিনি। তবে একদিনের বেশি তাকে থাকতে হয় না কারাগারে৷ ইতোমধ্যে ৫ জুলাই ভুট্টোর ক্ষমতার চেয়ার উলটে গেছে। ক্ষমতায় এসেছেন জেনারেল জিয়াউল হক। ক্ষমতা হারানোর মাত্র দুইদিন না পেরোতেই ৭ জুলাই ১৯৭৭ এ ফাসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় এক সময়ের প্রতাপশালী জেনারেল ভুট্টোকে৷

ষষ্ঠ কারাবাস

১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারির কথা৷ ফয়সালাবাদের জামে মসজিদ আনওয়ারিতে জুমার নামাজের ইমামতি করবেন মাওলানা ফারুকী৷ তার পূর্বে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবার এবং খোলাফায়ে রাশেদিনের ভালোবাসা ও সম্মান ইত্যাদি নিয়ে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে আলোচনা করলেন তিনি। এই আলোচনার মধ্যে মাওলানা ফারুকী হজরত আলির কন্যা উম্মে কুলসুমের সাথে হজরত উমরের (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) বিবাহের ঘটনার উল্লেখ করেন।

মসজিদের পাশেই ছিল শিয়াদের ইমামবাড়া। তারা মাওলানার এই বক্তব্যে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে৷ এবং আলোচনার বিষয় নিয়ে শক্ত প্রতিবাদ জানায়। প্রতিবাদ করেই তারা ক্ষান্ত দেয় না; অতিসত্বর তাকে গ্রেফতারির দাবি করে। পরদিন প্রশাসন মাওলানা ফারুকীকে সমন্দরি থেকে গ্রেফতার করে ফয়সালাবাদ সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেয়।

যদিও বারো দিন পর কারাগার থেকে মুক্তি মেলে কিন্তু এই মামলার ধকল তাকে বয়ে বেড়াতে হয় টানা ৩ বছর। শিয়াদের দাবি ছিল মাওলানা ফারুকী তাঁর বক্তব্যে অপ্রমাণিত কথা বলে তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছেন। তিনি আদালতে শিয়াদের এই অমুলক দাবীর জবাব দেন এবং নিজ বক্তব্যের প্রমাণে শিয়াদেরই ৩৭ টি বই থেকে উম্মে কুলসুমের (রাদিয়াল্লাহু আনহা) বিবাহের ঘটনার সত্যতা দেখিয়ে দেন৷ মাওলানা ফারুকীকে নিয়ে এমন তুমুল হৈ চৈ হয় সর্ব প্রথম এই বক্তব্যটি কেন্দ্র করেই৷ আদালতেও তার সেই বক্তব্য নিয়ে কয়েক মাস আলোচনা-পর্যালোচনা চলতে থাকে।

মাওলানা ফারুকী তাঁর আত্মজীবনীতে লিখছেন—‘পুরো বিষয়টি শিয়াদের গলায় আটকে যায়। আমি ইতিহাস পর্যালোচনা করে স্পষ্ট দেখি হজরত উম্মে কুলসুমের সাথে হজরত উমরের শেষ বয়সে বিবাহ হয়েছিল। তাদের এক কন্যা রুকাইয়া ও এক পুত্র জায়েদের জন্ম হয়। আদালতে শিয়াদের কয়েক ডজন কিতাব থেকে আমি বিষয়টি প্রমাণ করি। ম্যজিস্ট্রেট সাহেব একে ধর্মীয় বিষয় বলে কোনো মীমাংসা দেওয়া থেকে বিরত থাকলেন। ফলে এই বিষয়টি স্পষ্ট হলেও কোনো মীমাংসা হলো না।

এই ইস্যুতে শিয়াদের প্রতিক্রিয়া ছিল অকল্পনীয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো আমাদের বক্তব্যের কোনো জবাব তাদের সামনে ছিল না। সাহাবায়ে কেরামের সম্মানের জন্য এটাই ছিল আমার প্রথম কারাবাস। তারপর তো এই সিলসিলা শুরু হয়েছে এবং এখনও চলছে। প্রায় তিন বছর এই মামলার শুনানি চলেছিলো, অনেক মূল্যবান সময় ব্যয় হয়েছিলো কিন্তু আদালত কোনো ফায়সালা দিতে পারেনি। এর কারণ ছিল বে-দীন অফিসার এবং ইংরেজি সংস্কৃতির তল্পিবাহক কর্মকর্তাবৃন্দ।’

সপ্তম কারাবাস

জেনারেল জিয়াউল হকের শাসনকাল চলছে৷ চারদিকে মার্শাল ল’র কালো ছায়া। সবার মনেই সামরিক আইনের ভয়। এরই মধ্যে ফেব্রুয়ারি ১৯৭৮ এ কামালিয়া জেলার জামে মসজিদে সিরাতুন-নবি নিয়ে আলোচনা করেন মাওলানা জিয়াউর রহমান ফারুকী। এই আলোচনার কারণে তার নামে মার্শাল ল’র অধীনে মামলা ঠুকে দেয়া হয়। অথচ তিনি কেবল দরদি ভাষায় সরকারকে কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন। এর বেশি কিছু নয়৷

মামলার পর কৌশলগত কারণে আত্মগোপনে চলে যান মাওলানা ফারুকী। পুলিশ তাকে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে। কয়েক মাস পর গুজরাহ জেলার আদালতে তিনি উপস্থিত হলে কামালিয়া পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে কামালিয়া কারাগারে নিয়ে যায়৷ কারাগারে শহরের গণ্যমান্য আলেমরা যেতেন মাওলানা ফারুকীর সাথে দেখা করতে৷ মাওলানা আবদুল্লাহ লুধিয়ানবি, মাওলানা মুহাম্মদ ওয়াইস, সাইয়েদ সালমান শাহ, মাওলানা আবদুল গফুর, বিখ্যাত সাংবাদিক মাজিদ আনোয়ারসহ অনেকেই নিয়মিত যাতায়াত করতেন। প্রায় পনেরো দিন পর্যন্ত তাদের এই যাতায়াত চলতে থাকে। অবশেষে একদিন মাওলানার এলাকা সমন্দরি থেকে ৫০ জন আলেম ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এস এস পি টোবাটেক সিং এর সাথে সাক্ষাৎ করলে মাওলানা ফারুকীর ওপর থেকে মার্শাল ল’র মামলাটি তুলে নেয়া হয়৷ জামিনে মুক্তি পেয়ে তিনি বের হয়ে আসেন।

এক সময় শুধু বক্তৃতার জন্যেই মাওলানা ফারুকীর উপর একশোর বেশি মামলা হয়েছিল। নানা আদালতে হাজিরা দিতে হত, দিন তারিখ ও ঠিক রাখার কোনো জোঁ ছিল না৷ শেষমেষ বিরক্ত হয়ে হাজিরা দেওয়া ছেড়ে দেন মাওলানা ফারুকী। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল— অবস্থা বেশি কঠিন হলে একবারই গ্রেফতার হয়ে যাবে।

তার এই কৌশল কিন্তু কাজে আসে। এর আগে তাকে মুলতান, ফয়সালাবাদ, উকাড়া, দাহাড়ি, চিনউট, সারগোধা, গুজরানওয়ালা সবখানে ঘুরে ঘুরে আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছিল। ওয়ারেন্ট জারি হবে, পুলিশ এসে নিয়ে যাবে ফের জামিনে ছাড়া পেয়ে তিনি বের হয়ে আসবেন— এটা কেমন যেন নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাড়িয়েছিলো মাওলানা ফারুকীর জীবনে।

এই সময় প্রশাসন অত্যন্ত কঠোর হয়ে ওঠে। অনেক জেলাতে অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হয় মাওলানা ফারুকীকে। কোথাও কোথাও নিষেধাজ্ঞা জারি করে দেয়া হয় তার বক্তৃতার উপর৷ তবু থেমে জাননি মাওলানা জিয়াউর রহমান ফারুকী। গ্রেফতারি-জেল-জুলুমের ঝুঁকি সত্ত্বেও নিজের মত করে বিভিন্ন কনফারেন্সে নিয়মিত উপস্থিত হতে থাকেন তিনি। এসব কনফারেন্সে অনেক সময় তার দেখা হয়ে যেতো মাওলানা হক নেওয়াজ জংগবির সাথে৷ তখনো তিনি ‘সিপাহে সাহাবা’ প্রতিষ্ঠা করেননি।

অষ্টম কারাবাস

সিপাহে সাহাবার প্রথম ঐতিহাসিক দিফায়ে সাহাবা কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয় জংগয়ে। এখান থেকেই অষ্টমবারের মতো গ্রেফতার হন মাওলানা ফারুকী। হাজারো কর্মীর প্রতিবাদের মুখে মুক্তি লাভ করেন৷ আর মুক্ত হয়েই তিনি একাত্মতা ঘোষণা করেন মাওলানা হক নেওয়াজ জংগবির মিশনের সাথে।

সেদিনের গ্রেফতারি এবং সিপাহে সাহাবার সাথে একাত্মতার ইতিবৃত্ত মাওলানা জিয়াউর রহমান ফারুকি লিখেছেন তার আত্মজীবনী ‘ফের ওয়াহী ক্বয়েদে ক্বাফাস’ এ৷ সেখান থেকে চুম্বুকাংশ পাঠকের জন্যে তুলে দিচ্ছি—

‘৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬ সালের কথা। চিনিউটের এক মামলায় জামিন নেওয়ার জন্য আমাকে জং যেতে হয়। চারদিন আগেই জামিন চেয়ে দরখাস্ত দিয়েছিলাম। আদালতে পৌঁছুতেই দেখি আদালত চত্বরে মাওলানা হক নেওয়াজ জংগবি দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বললেন— তিনদিন পর দিফায়ে সাহাবা কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হবে। আপনিও আয়োজকদের একজন। এখানকার সেশন জজ নাফিস আহমাদের কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করা যায় না। সে জামিন মনজুর করবে না। আপনার আজ আদালতে ওঠার দরকার নেই।

আমি বললাম— আজ আদালতে না উঠলে আমি নিশ্চিত গ্রেফতার হয়ে যাব৷ আদালতে ওঠা ছাড়া উপায় নেই। মাওলানা জংগবি আমাকে অনেক নিষেধ করলেন কিন্তু আমি মানলাম না। কিছুক্ষণ পর তাই হলো মাওলানা যা আশংকা করছিলেন। আমার জামিন বাতিল করে আমাকে গ্রেফতার করা হলো। চিনিউট পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় চিনিউটের সদ্য নির্মিত কারাগারে৷

১০ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার রাত এগারটার দিকে ম্যাজিস্ট্রেট ও কারা কর্মকর্তারা এসে বললেন, জিনিসপত্র নাও, এক্ষুণি যেতে হবে। আমি গন্তব্য জিজ্ঞেস করি কিন্তু তারা নীরব থাকে। আমি ভাবলাম হয়তো জং এর কারাগারে স্থানান্তর করা হবে। বাইরে বের হতেই দেখি আমার চিনিউটের মেজবান শেখ সেলিম সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। তিনিও আমাদের সাথে পুলিশের গাড়িতে উঠে বসেন। তিনি আমার কানে কানে বললেন, আপনি মুক্তি পেয়েছেন। জুমার পর সিপাহে সাহাবার কনফারেন্সে আগত ৪০ হাজার কর্মী আপনার মুক্তির দাবিতে রোড ব্লক করে বসে গেছে। পাঞ্জাব সরকারের বিশেষ আদেশে আপনাকে মুক্তি দিয়ে সম্মেলনস্থলে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।

সিপাহে সাহাবার প্রথম আন্দোলনই ছিল আমার মুক্তির জন্য। এ ছিল সারা দেশ থেকে আসা কর্মীদের ভালোবাসা আমার প্রতি। এতে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের আদেশ ছিল না৷ তবে জং এর কয়েকজন নেতা এই বিষয়ে জানপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। সোয়া ঘন্টায় ৯০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে রাত সাড়ে বারোটার দিকে আমরা সম্মেলনস্থলে উপস্থিত হই। পুরো ময়দানের আকাশ বাতাস নারায়ে তাকবির ধ্বনিতে কেঁপে ওঠে। হাজারো জনতা সানন্দে খোশ আমদেদ জানাতে থাকে। বরেণ্য আলেম ও স্কলাররা মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। মাওলানা জংগবি এগিয়ে এসে আমাকে অভ্যর্থনা জানান। পুরো সমাবেশ নিজেদের দাবি পূরণ হওয়ার আনন্দ প্রকাশ করতে থাকে।

এই সম্মেলনে আল্লামা আবদুস সাত্তার তিউনিসি, মাওলানা জিয়াউল হক কাসেমিসহ অনেক বরেন্য আলেম উপস্থিত ছিলেন।

সিপাহে সাহাবার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল প্রায় ছয় মাস আগে, ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে। কিন্তু এতদিন এই সংঘঠনের কার্যক্রম শুধু জং এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ১০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৬ সালের এই সম্মেলনের মাধ্যমে সিপাহে সাহাবা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ার স্পষ্ট ঘোষণা দিল। এর আগ পর্যন্ত মাওলানা হক নেওয়াজের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল ছাত্র যমানার বন্ধু ও সহপাঠী হিসেবে। সারাদেশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমরা একসাথে আমন্ত্রিত হতাম তাই ঘনিষ্ঠতা আরো বেশি ছিল। সিপাহে সাহাবার প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এর সাথে আমার আন্তরিক ভালোবাসা ছিল। কিন্তু এই সম্মেলন থেকে আমি সরাসরি সিপাহে সাহাবার সাথে যুক্ত হওয়ার ঘোষণা দেই।

মাওলানা হক নেওয়াজ ছিলেন এই ঐতিহাসিক সম্মেলনের আহবায়ক ও ব্যবস্থাপক। কনফারেন্স শুরু হয়েছিল জুমার আগে। এই সম্মেলনে প্রায় একশো জন আলোচক শিয়া মতবাদের অসারতা ও তাদের বিরুদ্ধে আহলুস সুন্নাহর ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করেন। ইরানি বিপ্লবকে পাকিস্তানে ছড়ানোর ষরযন্ত্রের মুখোশ উম্মোচন করেন তারা। প্রায় ৫০ হাজার মানুষ এই সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে আলেমদের বক্তব্য শুনতে থাকে।
আমিই ছিলাম সম্মেলনের শেষ বক্তা। রাত সোয়া দুইটার দিকে আমি আলোচনা শুরু করি। আমার এই বক্তব্য ছিল আমার জীবনের একটি টার্নিং পয়েন্ট। সে সময়ই আমি আমার জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে ফেলি। মাওলানা হক নেওয়াজ প্রতিষ্ঠিত সিপাহে সাহাবার সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করি, এবং জীবনের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত এই মিশন বাস্তবায়নের জন্য চেষ্টা করাকে নিজের উপর আবশ্যক করে ফেলি।”

বন্দি দিবসের হালচিত্র

মাওলানা ফারুকীর জীবনের অনেকটা সময় কেটে যায় কারাভ্যন্তরে৷ এক বিবেচনায় এটা তার জন্যে নেয়ামতও ৷ আসলে সব বিপদই তো বান্দার জন্যে নেয়ামত; যদি বান্দা সেটা উপলব্ধি করে উঠতে পারে৷ বাহিরের জীবনে তো অখণ্ড অবসর ছিল না৷ ইতিহাস এবং সীরাত নিয়ে তার যে বিস্তৃত অধ্যয়ন সেসব পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেবার জন্যে লেখালেখির তো প্রয়োজন৷ কিন্তু লিখবেন যে সে অবসর কোথায় তার! লৌহ কপাটের পেছনে সে অবসর পেয়ে যান যেন মাওলানা ফারুকী৷ কারাগারে বসেই তিনি তার বিখ্যাত দুটি গ্রন্থ রাহবার ও রাহনুমা এবং খেলাফাত ও হুকুমাত রচনার কাজ শেষ করেন৷

এ ছাড়াও কারাবাসের সময়টা তিনি জিকির-আজকার ও তালিম-তারবিয়াতের মধ্য দিয়ে পার করতেন৷ কারাগারের অন্য কয়েদিদের নিয়ে তিনি নিয়মিত সাহাবাদের মর্যাদা ও দীনের জন্যে তাঁদের আত্মত্যাগ নিয়ে আলোচনা করতেন৷ তার এসব আলোচনা দাগি আসামিদের হৃদয়েও রেখাপাত করে যেতো গভীরভাবে৷ নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরামের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তিতে ভরে উঠতো তাদের মন৷

বন্দিদের জন্য দৈনন্দিন কর্মসূচী ঠিক করে দেন মাওলানা ফারুকী৷ তার আত্মজীবনীতে সে ছক তিনি তুলে দিয়েছেন৷

  • নামাজ ও কুরআন তিলাওয়াতের নিয়মিত পাবন্দি।
  • তাহাজ্জুদ, ইশরাক ও আওয়াবিনের প্রতি গুরুত্ব দান।
  • সকাল সন্ধ্যা সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি এই দোয়া পড়া।
  • ফজর এবং মাগরিবের পর ইয়া হাইয়ু ইয়া কাইয়ুম ১০০ বার করে পড়া এবং ইজতেমায়ীভাবে দোয়া করা।
  • গুনাহ থেকে পরিপূর্ণ তওবা, ইসলামের নিদর্শন গুলোর প্রতি সম্মান রাখা, এবং শরিয়া নিষিদ্ধ বিষয় থেকে বেঁচে থাকা।
  • প্রতিদিন নফস থেকে নিজের আমলের হিসাব নেওয়া৷
  • কুরআন শিক্ষার জলসায় নিয়মিত হাজির হওয়া৷

অমুসলিমদের ইসলাম গ্রহণ

মাওলানা ফারুকী ছিলেন একজন দরদী দায়ী৷ নবী ইউসুফের উত্তরাধিকারী তিনি৷ কারাগারকে তাই তিনি মনে করতেন দাওয়াতের উপযুক্ত ক্ষেত্র৷ তার দাওয়াতেরই ফলশ্রুতিতে লাহোর, মুলতান এবং রাওয়ালপিন্ডি কারাগারে প্রায় এক ডজনের মতো হিন্দু এবং খ্রিস্টান বন্দি তার তার হাতে হাত রেখে ইসলাম গ্রহণ করে। ইসলাম গ্রহণের পর তাদের ধর্মীয় শিক্ষার জন্য বিভিন্ন সাথিও তিনি নিযুক্ত করেন কারা অভ্যন্তরে। এছাড়াও বিভিন্ন সময় তার আলোচনা শুনে ইসলামের দিকে ঝুকে গিয়েছে এবং পরবর্তী সময় অন্য কারও হাতে ইসলাম গ্রহণ করে সৌভাগ্যবান হয়েছে এমন অমুসলিমের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়৷

ডাকাত ও সন্ত্রাসীদের তওবা

কারাগারে জুমার খুতবা দেয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন মাওলানা জিয়াউর রহমান ফারুকী৷ সেই সুযোগটি তিনি বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজে লাগান৷ উপস্থিত জুমার মুসল্লিদের অধিকাংশই ছিল ডাকাত ও দাগি অপরাধী৷ তিনি অত্যন্ত দরদি ভাষায় পাপকাজ পরিত্যাগে সকলের প্রতি আহ্বান জানান৷ এবং তার এ আহ্বানে অভূতপূর্ব সাড়া লক্ষ্য করা যায়৷ তার দরদমাখা খুতবার ফলে অনেক ডাকাত, চোর, দাগী আসামী এবং সন্ত্রাসী ধরণের লোকজন তওবা করে। বিশেষ করে মাওলানা আজম তারিক, কারী আবদুল কাইয়ুম, মাওলানা মুজিবুর রহমান ইনকিলাব প্রমুখের আলোচনা দরস মানুষের মধ্যে প্রচুর প্রভাব ফেলে। তাদের ঈমানদীপ্ত আলোচনায় কারাগারের পরিবেশ বদলে যায়। সেখানে ঈমান ও আমলের একটি নতুন পরিবেশ তৈরি হয়।

কারাগারে সিরাত চর্চা

মুলতান এবং লাহোর কারাগারে সিপাহে সাহাবার পক্ষ থেকে বড় বড় কয়েকটি কনফারেন্স এবং ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। এসব অনুষ্ঠানে বন্দিরা অত্যন্ত আগ্রহের সাথে উপস্থিত হয়েছিল। ঈমানদীপ্ত আলোচনার মাধ্যমে বছরের পর বছর ধরে বন্দি থাকা এসব ব্যক্তিরা উজ্জীবিত হয়েছিল ইমানের নতুন চেতনায়। অনেক মানুষের জীবন বদলে যায়। সাহাবায়ে কেরামের জীবনী শুনে পালটে যায় তাদের জীবনের গতিপথ। প্রথমদিকে কারারক্ষীরা নানা ভয়ের কারণে এসব অনুষ্ঠান করতে বাধা দিতো। কিন্তু কয়েকটি অনুষ্ঠান করার পর যখন দেখা গেল বন্দিদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে তখন তারা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হলো যে, কারাবন্দিদের সংশোধনের জন্য এর চেয়ে উত্তম কোন প্রক্রিয়া হতে পারে না। কিন্তু দেশের আইন-ই যেখানে এমনভাবে তৈরি করা যাতে করে বন্দিদের আত্মিক উৎকর্ষ হতে পারে এমন কোনো আলোচনা সভার আয়োজনের উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে না পারে সেখানে সামান্য কারারক্ষীদের কিইবা করার থাকতে পারে৷

মাওলানা জিয়াউর রহমান ফারুকী তার এই অভিজ্ঞতা নিয়ে খুবই আফসোসের সাথে বলেন—

‘এটা পরিষ্কার— যতক্ষণ অপরাধীদের অন্তরে আল্লাহর ফরমানের প্রতি ভয় এবং নববী শিক্ষার আলো জ্বেলে না দেওয়া হবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের জীবন বদলাবে না। ভালো কাজের দিকে আহবান এবং গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার জন্য ইসলাহী বয়ান এর কোন বিকল্প নেই। কিন্তু ইংরেজের তৈরি করা এসব কারা ব্যবস্থায় এর কোনো ভূমিকা নেই। আর কারাগারে যারা কর্মরত তাদের বিশেষ কোনো আগ্রহ নেই কিভাবে কারাবন্দিদেরকে শুদ্ধ মানুষে পরিণত করা যায় তা নিয়ে। তাদের শুধু কিছু পয়সা উপার্জনের আকাঙ্খা।

কারাগারে সকল ধরনের অপরাধীরা একত্রিত হওয়ার সুযোগ পায়। এর ফলে তাদের মধ্যে অপরাধের প্রবৃত্তি দূরে সরে যাবার পরিবর্তে আরো মজবুত হয়ে জেঁকে বসার সুযোগ হয়। অথচ এদিকে আমাদের প্রশাসনের কোন নজর নেই। হায় যদি প্রশাসনের লোকেরা কারাবন্দি এ সকল অপরাধীদের শুদ্ধ মানুষে পরিণত করার সঠিক পদ্ধতি নিয়ে ভাবতো!

কারাবাসের সুবাদে আমি কারাগারের ব্যবস্থাপনা এবং কয়েদিদের অবস্থা খুব কাছে থেকে দেখেছি। এখানে সব বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করার সুযোগ নেই। তবে যে কথাটি না বললেই নয়— আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে যে সকল কদর্যতা লুকায়িত রয়েছে তার মধ্যে একটি কদর্যতা হল বর্তমানের কারাগার ব্যবস্থা। এখানে মাজলুম হয় নির্যাতিত জালেম পায় আরও বেশি জুলুম করার সুযোগ।’

The post কারাগার ও আমার জীবন : জিয়াউর রহমান ফারুকি appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%97%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%93-%e0%a6%86%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%9c%e0%a7%80%e0%a6%ac%e0%a6%a8-%e0%a6%9c%e0%a6%bf%e0%a7%9f%e0%a6%be%e0%a6%89/

No comments:

Post a Comment