ফাতেহ ডেস্ক:
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের প্রয়াত আমির শাহ আহমদ শফীর মৃত্যু আবারও অস্বাভাবিক বলে দাবি করেছেন তার বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ বিন আহমদ শফী আল মাদানী। মঙ্গলবার (২৮ ডিসেম্বর) সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে এক সংবাদ সম্মেলনে এই অভিযোগ করেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে মাওলানা ইউসুফ বিন আহমদ বলেন, ‘আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর আগের তিন দিন হাটহাজারী মাদ্রাসায় নারকীয় তান্ডব ও ধ্বংসলীলা চালানো হয়েছে। তার অফিস রুম ও হাটহাজারী মাদ্রাসার অনেক শিক্ষকের রুম ভাঙচুরের ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দুনিয়াবাসী প্রত্যক্ষ করেছেন। জীবনের শেষ মুহূর্তে মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে অতি প্রয়োজনীয় ওধুষ গ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি। রুমের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল, এসি-ফ্যানসহ আসবাবপত্র ভাঙচুর করা হয়েছিল, চিকিৎসায় ব্যাঘাত ঘটানো হয়েছিল, মুখের অক্সিজেন মাস্ক খুলে ফেলা হয়েছিল, হাসপাতালে যেতে বিলম্ব ঘটানো হয়েছিল। একশ বছরের বেশি বয়সী এই বয়োবৃদ্ধ আলেমের নাতির গলায় ভাঙা কাচ ধরে বলা হয়েছিল, “এই বুইড়া, স্বাক্ষর কর। না হয় তোর নাতিকে হত্যা করবো।” এ কথা বলে জোর-জবরদস্তিমূলক স্বাক্ষর নিয়ে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল। এসব কিছুর পরও কি বলতে হবে, আল্লামা শফীর মৃত্যু স্বাভাবিক হয়েছে?’
তিনি বলেন, ‘একটি চরমপন্থী উগ্রগোষ্ঠীর অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে সহজ-সরল ছাত্রদের উসকানি দেওয়া হয়েছে। সবকিছুই তো দেশবাসীর সামনে ঘটেছে। তারপরও বলতে হবে, আল্লামা শফীর মৃত্যু স্বাভাবিক হয়েছে? আরও জঘন্যতম বিষয় হলো, হেফাজতের তথাকথিত আমির জুনায়েদ বাবুনগরী গত ২৩ ডিসেম্বর হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষকদের সামনে বসিয়ে রেখে বলেছেন, “হুজুরের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।” কী চরম মিথ্যাচার! এর নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই। আল্লামা শাহ আহমদ শফীর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে বলে দেশের শীর্ষ এই প্রতিষ্ঠানের মুহাদ্দিসদের সামনে যেভাবে তিনি মিথ্যাচার করেছেন, আল্লাহ তায়ালার দরবারে এর জন্য কী জবাব দেবেন? অথচ জেনেশুনেও তারা এই মিথ্যাচারগুলো শুনে গেছেন, একটু প্রতিবাদ করার সাহসও কারও হয়নি! এটা কি আলেমদের স্বভাববিরোধী নয়?’
তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘সেই দিনগুলোতে হাটহাজারিতে কি অস্বাভাবিক ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়নি? তাহলে কেন বলা হচ্ছে যে, কোনো বিশৃঙ্খলা হয়নি। আমরা তো জানি, অনেক সিনিয়র শিক্ষকের গলায় গামছা লাগিয়ে টানাহেঁচড়া করা হয়েছে। তাদের রুম ভাঙচুর করা হয়েছে। তাদের অর্থ-সম্পদ লুণ্ঠন করা হয়েছে। এসব কি সেদিন হাটহাজারীতে হয়নি? তারপরও বাবুনগরী গং কীভাবে বলছেন, মাদ্রাসায় কোনও কিছুই হয়নি? আল্লাহ তায়ালা হেফাজত করুন। আমরা তার এসব মিথ্যাচারের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’
মাওলানা ইউসুফ বলেন, ‘জুনায়েদ বাবুনগরী বারবার বলছেন, আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যু স্বাভাবিক হয়েছে। আর এর স্বপক্ষে তিনি আমার ভিডিওবার্তার মাধ্যমে দেওয়া স্বীকারোক্তিকে বড় দলিল হিসেবে পেশ করছেন। অথচ আমার কাছ থেকে জোর করে এই স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়েছে ২২ সেপ্টেম্বর আর তা প্রচার করা হয়েছে এক সপ্তাহ পর। এতেই প্রমাণিত হয়, পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের বাঁচানোর হীন উদ্দেশ্যে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করার জন্য এই ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। অথচ আমি পরবর্তী সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিওবার্তায় বলেছি যে, আমাকে জিম্মি করে জোরপূর্বক ও ভয়-ভীতি দেখিয়ে এই পরিত্যক্ত স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়েছিল। আমি পরিষ্কার ভাষায় বলেছি, আমার বাবার মৃত্যু স্বাভাবিক হয়নি। এরপরও বিগত ২৩ ডিসেম্বর হাটহাজারী মাদ্রাসায় হেফাজতের নামে মামা-ভাগ্নের সংবাদ সম্মেলনে বাবুনগরী আমার সেই স্বীকারোক্তিকেই বড় দলিল হিসেবে পেশ করেছেন। এবং তিনি মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি-ধামকি দিয়েছেন, আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণার কথা বলেছেন। আমাদের প্রশ্ন, আমার পিতার মৃত্যু যদি স্বাভাবিক হয়ে থাকে তাহলে তদন্তে বাবুনগরী গং-এর এত ভয় কিসের? তার দাবি অনুযায়ী তদন্তে তিনি তো নির্দোষই সাব্যস্ত হবেন। এই মামলায় তো কাউকে অযথা হয়রানি করার জন্য করা হয়নি। সুতরাং এই মামলার তদন্তে কোনো ধরনের বাধার সৃষ্টি করা হলে এর সম্পূর্ণ দায় বাবুনগরী গংদের উপরই বর্তাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাবুনগরী কওমি ভিশন নামে তার ভাগিনার মাধ্যমে একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও ভিডিও চ্যানেল খুলে মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন। একদিকে ওই চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেন, ছাত্র আন্দোলনের সাথে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই, কে বা কারা আন্দোলন করেছে, তাও তিনি জানেন না। মাদ্রাসার ক্লাস বন্ধ করলো ছাত্ররা অথচ মসজিদের মিম্বারের দাঁড়িয়ে বাবুনগরী ঘোষণা দিলেন মাদ্রাসার ক্লাস চালু করার। এতে কি প্রমাণ হয় না যে, তার যোগসাজশেই বিশৃংখল এই আন্দোলন হয়েছে? তা না হলে তিনি ক্লাস চালুর ঘোষণা কিভাবে দেন? আমরা মনে করি, আল্লামা শাহ আহমদ শফীর অস্বাভাবিক এই মৃত্যুর বিচার বিভাগীয় তদন্ত হতে হবে। যারা এই তদন্তের বিরুদ্ধে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, কেননা তদন্ত কাজে বাধাদান ও এ জাতীয় হুমকি-ধমকি স্বাধীন ও স্বাভাবিক বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে।’
সংবাদ সম্মেলনে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয় – হাটহাজারী মাদ্রাসার দায়দায়িত্ব ছিনিয়ে নেওয়া ও আল্লামা শফীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর প্রায় মাসখানেক পর হেফাজতে ইসলামের নামে মামা-ভাগ্নের একটি অবৈধ কাউন্সিল করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে একটি অবৈধ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ বাবুনগরীর মামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী দুই বছর আগে নিজেই হেফাজত থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং জাতীয় দৈনিকে তার পদত্যাগের সেই ভিডিও এখনো বিদ্যমান আছে। তিনি হেফাজতের কোনো দায়িত্বে না থাকলেও তারই আহবানে অবৈধ কাউন্সিলের মাধ্যমে গঠিত তথাকথিত এই কমিটিতে বাবুনগরীর পারিবারিক সদস্যই রয়েছে প্রায় ২২ জন। এছাড়া দুইটি রাজনৈতিক দলের একটির ৩৬ জন আরেকটির ২৪ জন সদস্যকে বিভিন্ন পদে পদায়িত করে হেফাজতকে একটি চিহ্নিত রাজনৈতিক গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়ন ও দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা করা হচ্ছে।
হেফাজতের আমীর নির্ধারণ সঠিক হয়নি জানিয়ে তারা বলেন – আমীরের ইন্তেকালের পর শূরা নতুন আমীর নিয়োগ করবে, এখানে পুরো কমিটি ভেঙ্গে নতুন করে কমিটি করার পেছনে উদ্দ্যেশ্য কী? তাহলে তো মহাসচিবের মৃত্যুর পর নতুন করে পুরো কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। হেফাজতের নির্বাহী কমিটি তথা মজলিসে আমেলায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করে এবং হেফাজতের গুরুত্বপূর্ণ ৭০ জন কাউন্সিলরকে দাওয়াত না দিয়ে সিন্ডিকেট করে যে কমিটি গঠন করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ অবৈধ ও অসাংবিধানিক। আজকের এই সংবাদ সম্মেলন থেকে আমরা এই অবৈধ কমিটিকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি।
হেফাজত প্রধান আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীকে আমীর মানা হবে না উল্লেখ করে বলা হয় – আল্লামা শাহ্ আহমদ শফীর চরম বিরোধী ও বিদ্বেষী, মাজারপূজারী ভান্ডারীর প্রস্তাবে যিনি হেফাজতের আমীর হয়েছেন, তাকে এদেশের ধর্মপ্রাণ জনগণ মেনে নিতে পারে না। আমরা মনে করি, বর্তমান হেফাজত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে একটি পকেট কমিটি গঠিত হয়েছে, যেখানে আল্লামা আহমদ শফীর মূল অনুসারী হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা নেতৃবৃন্দকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বিগত দিনে যারা আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছেন, সক্রিয় ছিলেন, জীবন বাজি রেখে, জেল-জলুম উপেক্ষা করে, হামলা-মামলার তোয়াক্কা না করে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, তাদেরকে পাশ কাটিয়ে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে। গঠনতন্ত্রে না থাকলেও এককভাবেই তিনি নিয়ম বহির্ভূত প্রতিদিন নতুন নতুন সদস্যের নাম ঘোষণা করে চলেছেন। সুতরাং নিয়মতান্ত্রিকভাবে কাউন্সিল আহ্বান করে অচিরেই হেফাজতের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হবে ইনশাআল্লাহ। হেফাজতের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নিয়মতান্ত্রিকভাবে সব জেলা, থানা, শহর ও নগর কমিটিগুলো নবায়ন করে কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে হেফাজতের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হবে ইনশাআল্লাহ।
সংবাদ সম্মেলনে সর্বশেষ সাংবাদিকদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলা হয় – আপনারা সত্য প্রকাশে অহর্নিশ কাজ করে যাচ্ছেন। সত্য প্রতিষ্ঠার জন্যই আপনাদের এই নিরন্তর চেষ্টা প্রচেষ্টা। সুতরাং আল্লামা শাহ আহমদ শফীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা আপনারা দেখেছেন। আমাদের অনুরোধ, আপনারা সত্য উদঘাটনে অগ্রসর হোন। এক্ষেত্রে আপনাদের ভূমিকা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
The post ‘আল্লামা শফির মৃত্যু যদি স্বাভাবিক হয়, তদন্তে ভয় কিসের?’ appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%86%e0%a6%b2%e0%a7%8d%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a6%be-%e0%a6%b6%e0%a6%ab%e0%a6%bf%e0%a6%b0-%e0%a6%ae%e0%a7%83%e0%a6%a4%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a7%81-%e0%a6%af%e0%a6%a6%e0%a6%bf/
No comments:
Post a Comment