মাহদি হাসান :
শিয়া সম্প্রদায় নিয়ে রয়েছে বিস্তর বিতর্ক ও সমালোচনা। অবশ্য পুরো বিশ্বের চোখে সুন্নি এবং শিয়া, এ দুটি হচ্ছে ইসলাম ধর্মের প্রধানতম দুটি দলের নাম। যদিও সংখ্যায় শিয়ারা মুসলিম বিশ্বের মাত্র পাঁচ থেকে দশ শতাংশের মতো, তবু শিয়া এবং সুন্নির মতভেদ চলে আসছে দীর্ঘ কাল ধরে। বহু যুগ অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও তাদের মধ্যকার বিতর্কে সমাপ্তির রেখা টানতে পারেনি কেউই। বরঞ্চ কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ মতপার্থক্যের ফলে সৃষ্ট হয়ে যায় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বেঁধে যাবার মতো পরিস্থিতি। শিয়া-সুন্নী সম্পর্ক ও বিদ্যমান সংঘর্ষের ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয় সূত্র জানার চেষ্টা করব এই লেখায়।
শিয়া এবং সুন্নিদের মাঝে আকীদাগত এবং বিভিন্ন রীতি-রেওয়াজগত মতভেদ রয়েছে তা সত্য। তবে তাদের মধ্যে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি ঝগড়া-ফ্যাসাদ এবং তর্কের সৃষ্টি করে তা কোনো আকীদাগত এবং ইবাদতগত বিষয় নয়। বরং তা হচ্ছে রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক ঘটনাবলী সংক্রান্ত বিষয়। সুন্নীদের সম্পর্কে আমরা অল্প কিছু জানলেও শিয়াদের সম্পর্কে আমাদের জানাশোনা খুবই অপ্রতুল। তাই প্রথমে শিয়াদের প্রাথমিক পরিচয় তুলে ধরি।
শিয়াদের মূলনীতি
শিয়া অর্থ বিচ্ছিন্নতাবাদী দল। নামের মর্যাদা রেখে তাদের মাঝেও সৃষ্টি হয়েছিল আরো অনেক উপদল। তাদের মাঝেও ছিল মতাদর্শ এবং চিন্তা-চেতনা এবং ফিকাহগত নানা পার্থক্য। লক্ষ্য করা দেখা গেছে যে, শিয়াদের আকিদা-বিশ্বাস ছিল অনেকটা ইতিহাসকেন্দ্রিক। তাদের যে দল যেভাবে ইতিহাস ব্যাখ্যা করেছে, সেটাই ঐ দলের আকিদা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে মোটাদাগে পাঁচটি মূলনীতিতে তারা একমত।
এক. আলী রা.-এর শ্রেষ্ঠত্ব এবং তাঁকেই খেলাফতের প্রথম ও একমাত্র উত্তরাধিকারী মনে করা। এ ব্যাপারে সকল শিয়া একমত। এছাড়া অন্য সকল বিষয়, যেমন সাহাবায়ে কেরামের ব্যাপারে তাদের অবস্থান, খেলাফত ও রাজনীতি আকিদার অংশ হওয়া এবং তাদের ইমামগণের সংখ্যা ইত্যাদি সকল বিষয়ে তাদের মাঝে রয়েছে মতপার্থক্য।
দুই. আহলে বাইতের সদস্যগণকে শরীয়তের মারজা তথা কেন্দ্রবিন্দু মনে করা। বিশেষ করে তাদের মধ্যে যাদেরকে শিয়ারা ইমাম মানে, তাদের কথা ও কাজকে শরীয়তের অংশ মনে করা। এর ফলে সুন্নি এবং শিয়াদের মাঝে হাদিসের সংজ্ঞা নিয়েও রয়েছে দ্বিমত। শিয়াদের কাছে হাদিসের সংজ্ঞা সুন্নিদের চেয়ে প্রসারিত। সুন্নিদের নিকটে হাদিস হচ্ছে শুধু রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা, কাজ এবং বিবৃতি। কিন্তু শিয়াদের কাছে তাদের ইমামগণের কথা এবং কাজও হাদিসের অন্তর্ভুক্ত এবং এগুলো শরীয়তের অংশ বলে গণ্য।
তিন. আহলে বাইতের সাথে গভীর আবেগের সম্পর্ক, তাদের নিদর্শনকে বারাকাত হিসেবে গ্রহণ এবং তাদের পবিত্র স্থানসমূহে স্থাপত্য নির্মাণ। যেমন একটি মজার ঘটনা বলি; আফগানিস্থানের বলখের এক ব্যক্তি স্বপ্ন দেখেন, আলি রাদি. এক ব্যক্তিকে সাদা ঘোড়ায় করে তার এলাকায় পাঠিয়েছেন এবং সে মৃত্যুবরণ করেছে। সে সূত্রে তিনি একটি মাজার গড়ে তোলেন, পরবর্তীতে ঐ এলাকার নাম মাজার-ই- শরীফ হিসেবে পরিচিত হয়।
চার. আহলে বাইতের বিরুদ্ধে যে রাজনৈতিক জুলুম হয়েছে, তার স্মৃতিচারণ। এই যে স্মৃতিচারণ, একে সুন্নিদের পক্ষে বুঝা অসম্ভব। কেননা রাজনৈতিক জুলুমকে সুন্নিরাও স্মরণ করে, তবে, অতিক্রম করতে চায়। শিয়ারা চায় দুঃখ-স্মৃতির চিরন্তনকরণ। এর জন্য শিয়াদের নানা প্রতিষ্ঠানও আছে, যার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দায়িত্ব হচ্ছে, দুঃস্মৃতির প্রচার। বিশেষ দুঃখ-স্মৃতিচারণ কীভাবে গড়ে উঠল, এ নিয়ে নানা অভিমত আছে ; পারস্য সংস্কৃতির প্রভাব বা প্রাক ইসলামি চিন্তার প্রভাব বা রাজনৈতিক জুলুমের দুঃস্মৃতি দিয়ে বর্তমান ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টা!
পাঁচ. সাহাবায়ে কেরামের বিরুদ্ধে নবী কারিম সা. এর অসিয়তের বিরুদ্ধাচারণের অপবাদ। তবে এই বিষয়ে শিয়াদের মধ্যে নানা ব্যাখ্যা আছে। “ভালো” শিয়ারা উপলব্ধি করেন যে, সাহাবাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ মানে ইসলামের বিরুদ্ধেই অভিযোগ, তাই কোন সূত্র পেলেই এর থেকে তারা বের হয়ে যান। যেমন, জাইদিয়ারা মনে করে, যোগ্যতম ব্যক্তি থাকা সত্ত্বেও অপেক্ষাকৃত কমযোগ্য ব্যক্তি খলিফা হতে পারে।
শিয়া-সুন্নী সম্পর্ক স্পষ্ট করার আগে শিয়াদের উপদলগুলো সম্পর্কেও জানিয়ে দেয়া দরকার।
শিয়াদের বর্তমান উপদল
বর্তমান শিয়াদের আমরা তিনভাগে ভাগ করতে পারি; জাইদিয়াহ, ইসমাইলিয়া ও জা’ফরিয়াহ। অথবা ভিন্নভাবে বললে, খামসিয়াহ, সাবইয়াহ ও ইছনা আশারিয়াহ।
এক. জাইদিয়াহ। এদের সর্বশেষ ইমাম, ইমাম জায়েদ। ইমাম মোট পাঁচজন। তাই তাদেরকে জাইদিয়াহ ও খামসিয়াহ বা পাঁচজনীয়ও বলা হয় । শিয়াদের মধ্যে এরাই সুন্নিদের সবচেয়ে নিকটবর্তী। সুন্নিদের মতোই রাজনীতি এদের কাছে মূল আকিদার অংশ নয়। এরা সিহাহ সিত্তাকে গ্রহণ করে। তবে এর সাথে শুধু একটি গ্রন্থ বাড়িয়ে দেয়, তা হচ্ছে মুসনাদে ইমাম জায়েদ। তারা সুন্নি উলামাদেরকেও গ্রহণ করে। শাওকানি, সানআনিকে যেমন সুন্নি ও শিয়া, উভয়েই হাদিসের উলামা মনে করেন। জাইদিয়ারা এবং সব শিয়াই, মুতাজিলাদের মাধ্যমে প্রভাবিত। বিশেষত আল্লাহর ছিফাতের প্রশ্নে।
দুই. ইসমাইলিয়াহ। এদের সর্বশেষ ইমাম, ইমাম ইসমাইল। এদের ইমাম মোট সাতজন। তাই তাদেরকে ইসমাইলিয়া ও সাবইয়াহ বা সাতজনীয়ও বলা হয়। তাদের কাছে ইমানের ভিত্তি হল, ওহদানিয়াহ, নবুওয়াহ ও ইমান বিল কোরআন। তবে তাদের কাছে কুরআন ভাষার মধ্য দিয়ে বুঝলে চলবেনা, বাতেনিভাবে বা ব্যাপক-ব্যাখ্যার মাধ্যমে বুঝা জরুরি। তারা মনে করে, প্রত্যেকটি ভাষার একটা বাতেন বা চিহ্ন আছে, সেই চিহ্নের মধ্য দিয়ে কুরআন বুঝা জরুরি। এ কারণে তাদেরকে বাতেনিয়াহও বলা হয়।
সমাজবিজ্ঞানী ও মুসলিম ঐতিহাসিকরা লিখেন, ইসমাইলিয়ারা রাজনীতিতে ব্যর্থ হয়ে সিদ্ধান্ত নেন, শুধু রাজনীতির মধ্য দিয়ে পরিবর্তন সম্ভব নয় বরং গুপ্তহত্যা ও চিহ্ন-ব্যাখ্যার মধ্যে কাজ চালিয়ে নিতে হবে। এখান থেকেই ইসমাইলিয়াদের উত্থান ঘটে। শিয়াদের মধ্যে ইসমাইলিয়ারাই রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশী প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। বেশ কিছু রাষ্ট্র গড়তে সক্ষম হয় তারা। মিসরের ফাতেমীয় খেলাফত তাদেরই গড়া ছিল। এমনকি ফ্রান্সের প্রাচ্যবিদ লুইউমাসিউ দশম খৃস্টাব্দকে ইসমাইলিয় শতক বলে অভিহিত করেন। মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ জায়গায় তারা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন। অনেক জায়গায় ক্ষমতায় দখল করেন। তবে, বর্তমানে ইসমাইলিয়া শিয়াদের সংখ্যা খুবই কম।
তিন. ইমামিয়াহ ইছনা আশারিয়াহ। তাদের কাছে ইমাম বারজন, সর্বশেষ ইমাম_প্রতিক্ষিত ইমাম, ইমাম মাহদি। যিনি শেষ যুগে আসবেন বলে তারা বিশ্বাস করে।ইমামিয়াদের মধ্যেও তিনটা ভাগ আছে, মূলবাদী, বর্ণনাবাদী ও শায়খবাদী।
মূলবাদীরা অনেকটা বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যাখ্যা গ্রহণ করে, শিয়াদের যে ঐতিহাসিক কুসংস্কার-বর্ণনা আছে, সেগুলোকে নাকচ করে। কুরআন ও বুদ্ধির উপর বেশী নির্ভর করে। কিছুটা প্রাচীন মুতাজিলাদের মত এদের চিন্তা-ধারা। বর্তমানে এদের প্রাধান্যই বেশী।
বর্ণনাবাদীরা কুরআন বা সুন্নাহ ব্যবহার করে না। তারা মনে করে, একমাত্র ইমামরাই টেক্সট বুঝতে সক্ষম। ধর্মীয় ক্ষেত্রে বুদ্ধির ব্যবহারের অনুমতি খুব কম দেয়। এমন অনেক কুসংস্কারে বিশ্বাস করে, যাকে অন্য শিয়ারাও নাকচ করে। তবে তাদের প্রভাব ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে।
শায়খবাদীরা নতুন ধারা ও তাদের সংখ্যাও খুব কম।
ইমামিয়াদের কাছে আকিদার মূলনীতি হচ্ছে, তাওহিদ, নবুওয়াহ, আদল, মাআদ। স্পষ্ট যে এগুলো মুতাজিলাদের থেকেই গৃহীত। এ ছাড়া তারা ইমামাহ, তাকিয়াহ ও গাইবিয়াতে বিশ্বাস করে। তাকিয়াহ ঠিক আকিদা বলা যায় না, তবে আকিদার বাহিরেও নয়। গাইবিয়াহ মানে ইমামের গোপন থাকা, যিনি আখেরি জামানায় ফিরে আসবেন। এই যে প্রতিক্ষা তত্ত্বের কারণেই তারা রাজনৈতিকভাবে নেতিবাচক ছিল। কেননা তারা গাইবিয়া চিন্তার ভিত্তিতে মনে করতো, মাহদি আসার আগে কোনো রাষ্ট্র গঠন সম্ভব না। মাহদির জন্য আপেক্ষা করা হবে এবং রাষ্ট্রীয় কোন কার্যক্রমে শরিক হওয়া যাবেনা। যেমন এখন অনেক সুন্নিদের খেলাফতবাদীরা মনে করে, খলিফা ছাড়া রাজনীতি সম্ভব না এবং তারা একটা ঐতিহাসিক খেলাফতের চিত্রকে একমাত্র মডেল মনে করে, সেটা যেহেতু অসম্ভব, তাই রাজনীতি অসম্ভব_ এভাবে রাজনীতি থেকে বিরত থাকে। যদিও, খেলাফতের বিষয়ে প্রাথমিক পাঠও তাদের নেই। জুলুম থাকা সত্ত্বেও সুন্নিরা সব শাসনকে কেন খেলাফত বলেছে, এটা বুঝারও ক্ষমতা নাই। যাক, এই চিন্তায় ব্যাপক পরিবর্তন আনেন ইমাম খোমেনি তার ওলায়াতুল ফাকিহ ধারণার মধ্য দিয়ে। আমরা তো এক হাজার বছর অপেক্ষায় ছিলাম, এখন কি আরও এক হাজার বছর অপেক্ষায় থাকবো? বরং মুজতাহিদ আলেম ইমামের স্থলাভিষিক্ত হবে, এই হচ্ছে ওলায়াতুল ফকিহ!
ইমামিয়ারা ইসলামের পাঁচ রুকন ছাড়াও তাওয়াল্লি ও তাবাররি বা সালাফি ভাষায় আল-ওয়ালা ওয়াল বারাকে ধর্মের রুকন মনে করে। বিষয় ও ফিকহের দিক থেকে সুন্নিদের মতো হলেও সূত্র ও প্রামাণ্যতার ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে। অনেক ইমামিয়ারা সিহাহ সিত্তা মানেনা। বিশেষত ইমাম বুখারিকে আক্রমণ করে। তারা মানে ইবনে বাবাওইহ,তুসি ও কুলাইনির চার কিতাব, যেগুলো চতুর্থ শতকে রচিত হয়েছে এবং এগুলোর মধ্য দিয়েই মূলত শিয়াইজম দানা বেঁধেছে। তবে শিয়াদের কাছেও এগুলো সহিহ বা সম্পূর্ণ শুদ্ধ কিতাব নয়। প্রায় পঁচিশ হাজার বর্ণনার মধ্যে মাত্র পাঁচ-সাত হাজার সহিহ। ফলে অনেক সুন্নি যে মনে করে, শিয়াদের কিতাবে আছে মানেই সেটা শিয়াদের আকিদা, এটা ভুল। যেমন বুখারি ও মুসলিমের প্রায় প্রত্যেক হাদিস সুন্নিদের বিশ্বাস হিসেবে গৃহীত, শিয়াদের মূল চার কিতাব এমন নয়।
শিয়াদের ভিন্ন চার কিতাব থাকলেও এর অর্থ এই নয় যে, এতে পার্থক্য হয়ে যাচ্ছে। কেননা শিয়াদের সহিহ হাদিসগুলোর অধিকাংশই সিহাহ সিত্তায় পাওয়া যাবে, হয়তো ভিন্ন সূত্রে। এ কারণেই শিয়া-সুন্নিদের ইবাদত ও ফিকাহের ক্ষেত্রে অনেক মিল পাওয়া যায়। বর্তমান সময়ের ফিকহের অন্যতম প্রধান আলেম অহবা জুহাইলি লিখেছেন, আমি ইমামি-শিয়া ফিকহের এক এক করে সব মাসআলা পড়েছি, বিশটির মত মত বাদে সমস্ত মতই সুন্নিদের কোন না কোন স্কুলের সাথে মিলে যায়। অপর প্রখ্যাত ফকিহ আব্দুল কারিম জাইদান লিখেছেন, জাইদি ও জাফরি ফিকাহ প্রায় এক, তেমনি হানাফি ও ইমামিয়া ফিকাহও প্রায় এক। এবং বিশ্ববিখ্যাত আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় শিয়া-ফিকহকে তাদের পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে।
শিয়াদের সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা নেবার পর এবার আমরা আলোকপাত করব শিয়া-সুন্নি সম্পর্ক কীভাবে বেড়ে উঠেছে তা নিয়ে।
শিয়া-সুন্নি সম্পর্কের ঐতিহাসিক বিকাশ
শিয়া-সুন্নি ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় তাদের মধ্যকার চিন্তা-চেতনা মতভেদ থাকলেও এবং চিন্তার এই দ্বৈরথ যুগে যুগে আরো প্রকট আকার ধারণ করলেও তাদের মাঝে সামাজিক সম্পর্ক এবং যোগাযোগ অক্ষুন্ন ছিল। এই সম্প্রীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হচ্ছে, শিয়া এবং সুন্নিদের ধর্ম, ইতিহাস, পরিবেশ, বেড়ে উঠা এবং প্রত্যাবর্তনস্থল যে একই সেই অনুভূতি সৃষ্টি হওয়া এবং সম্মিলিত শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে তাদেরকে যে একই কাতারে দাঁড়াতে হবে সেই বোধ সৃষ্টি হওয়া। তবে শিয়াদের মধ্যে যারা বিচ্ছিন্নতাবাদী, তারা শিয়া-সুন্নিদের এ সকল সম্মিলিত অনুভূতিকে অস্বীকার করে এবং দুই দলের মাঝে তারা উঁচু এক প্রাচীর সৃষ্টি করে। সাথে তাদের কুধারণা এবং খেয়ানতে বাড়াবাড়ি তো আছেই। একপর্যায়ে তারা সুন্নিদের শত্রু হয়ে দাঁড়ায়।
উমাইয়া খেলাফতকালে শিয়া-সুন্নিদের মাঝে কোনো আকিদাগত দ্বন্দ্ব ছিল না। যা ছিল তা হচ্ছে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও শিয়াদের কিছু সদস্যের কুসংস্কারে বিশ্বাস। অতঃপর আব্বাসীয় খেলাফতের জন্মলগ্ন থেকে শিয়াদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সুন্নিদের আকিদাগত দৃষ্টিভঙ্গির মাঝে মিশ্রণ শুরু হয়। উভয় দলের চিন্তা-চেতনা আরো গভীররূপ ধারণ শুরু করে আব্বাসীয় খেলাফতের প্রথম দিক থেকে।
আব্বাসীয় খেলাফতের প্রথম দিকের কয়েকজন খলিফার স্পষ্টত শিয়াইজমের দিকে ঝোঁক ছিল। যদিও তারা ছিল মতাদর্শের দিক দিয়ে সুন্নি। যেমন, আব্বাসীয় খেলাফতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উজির ছিল শিয়াদের অন্তর্ভুক্ত। খলিফা সাফফাহর উজির আবু সালামাহ আল-খাল্লাল, হারুনুর রশিদের দুই উজির মুহাম্মাদ ইবনুল আশ’আছ এবং আলি ইবনু ইয়াকতিন, খলিফা মাহদির উজির ইয়াকুব ইবনু দাউদ, খলিফা মু’তায এবং মুহতাদি বিল্লাহর উজির জাফর ইবনু মাহমুদ আল-আসকাফি, খলিফা মুকতাদির বিল্লাহর উজির প্রসিদ্ধ লিপিকার মুহাম্মাদ ইবনু মাকলা এবং খলিফা রাজিবিল্লাহর উজির ফজল ইবনু ফোরাত, এরা ছিল শিয়া।
খলিফা মামুনুর রশিদ, মু’তাসিম বিল্লাহ এবং ওয়াসিক বিল্লাহ তাদের রাজনীতিতে শিয়াইজমের দিকে আকৃষ্টতা দেখিয়েছেন। এমনকি খলিফা মামুন তার পরবর্তীতে আহলে বাইতের সদস্য আলি রেযাকে (যিনি শিয়া ইমামিয়াদের অষ্টম ইমাম ছিলেন) শাসক বানাতে চেয়েছিলেন। শিয়া এবং সুন্নিদের আকিদাগত এবং মাসয়ালাগত নিকটবর্তিতা তাদের সম্প্রীতিতে সাহায্য করেছে। আব্বাসীয় আমলে এবং আফ্রিকা (তিউনিসিয়া) অঞ্চলে ফাতেমীয় আমলের প্রথম দিকে আকিদাগত ভিন্নতা এবং শিয়া ইসমাইলিয়্যাদের নোংরা রাজনীতি সত্ত্বেও তাদের মাঝে সম্পর্ক ছিল। তবে তৎকালীন পারস্যে প্রতিষ্ঠিত সাফাভী সাম্রাজ্য মনে প্রাণে শিয়া ইসমাইলিয়্যাহকে গ্রহণ করে এবং তারা এ ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করে। তারা সুন্নি উলামায়ে কেরামকে একের পর এক হত্যা করে। ফলে সুন্নি উলামায়ে কেরাম পারস্য ছেড়ে অন্যত্র হিজরত করেন। এর সূত্র ধরে সাফাভীদের মাঝে এবং আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের মাঝে বেশ কয়েকবার যুদ্ধ হয়। সেই থেকে ইরান শিয়াদের মূল ঘাঁটিতে পরিণত হয়।
এমনিভাবে ফাতেমীয় খেলাফত ছিল পরিপূর্ণ শিয়াদের নিয়ন্ত্রিত খেলাফত। তবে তারাও সুন্নি উজির নির্বাচিত করে্ন। সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবী ছিলেন ফাতেমীয়দের নির্বাচিত সুন্নি উজির। তিনিই পরবর্তীতে ফাতেমীয় খেলাফতের অবসান ঘটিয়ে আইয়ুবীয়া সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন এবং আব্বাসীয় খেলাফতের বশ্যতা স্বীকার করেন।
মোটকথা, ইতিহাস পর্যালোচনায় দৃষ্টিগোচর হচ্ছে যে, শিয়া-সুন্নিদের মধ্যকার দ্বিমত সত্ত্বেও তাদের মাঝে শান্তিপূর্ণ পারস্পরিক সহাবস্থান বজায় ছিল। যুগে যুগে প্রধানত ইসমাইলি শিয়ারাই এর মাঝে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। অবশ্য ঐতিহাসিকদের মতে সুন্নীদের হাম্বলি অংশেরও এই সংঘর্ষের পেছনে দায় ও দায়িত্ব আছে। সমকালীন সময়ে ইসমাইলি শিয়াদের সংখ্যা কমে গেলেও তাদের চিন্তার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে, পাশাপাশি সৌদির রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হাম্বলি চিন্তার ব্যাপক প্রসার হয়েছে। ইসলামি ইতিহাসের প্রধানতম দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ; ইসমাইলি শিয়া ও হাম্বলি সুন্নীদের মধ্যে তাই চলছে স্নায়ু যুদ্ধ ; যার নেতৃত্ব দিচ্ছে সৌদি ও ইরান, তবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে মুসলিম বিশ্বের সবাই।
বর্তমানে ইরান স্বতন্ত্রভাবে শিয়া হলেও ইরাক এবং সিরিয়ায় সুন্নি এবং শিয়াদের সহাবস্থান ছিল। মজার বিষয় হলো, সিরিয়ান আলাভি শিয়ারা (তারা একসময় প্রচুর উগ্র ছিল। পাহাড়ে বাস করতো। ইসমাইলিয়াদের দ্বারা প্রভাবিত ছিল।) যখন তাদের আইন প্রণয়ন করতে যায়, তখন একটা দল পাঠায় আজহারে আর আরেকটা দল নাজাফের শিয়াদের কাছে। তখন আজহারের আগে নাজাফ দল ও চিন্তা পাঠিয়ে দেয় এবং আলাভিরা ইমামিয়া শিয়ায় রুপান্তরিত হয়। তবে, সিরিয়ায় ব্যাপক কুরআন-হাদিস চর্চা এবং সালাফি প্রভাবহীনতার কারণে আলাভিদের সুন্নিদের প্রতি ঝোঁকও বাড়ছিল। রাজনৈতিক প্রসঙ্গ বাদ দিলে মোটাদাগে তাদের মাঝে সহাবস্থান ছিল। কিন্তু আলাভি শাসক বাশার আল-আসাদের ঔদ্ধত্য এবং সিরিয়ান গৃহযুদ্ধের ফলে বন্ধ হয়ে গেল এই সম্ভাবনার দুয়ার।
The post শিয়া-সুন্নি সম্পর্ক : ঐতিহাসিক ও ধর্মতাত্ত্বিক বিবেচনা appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%b6%e0%a6%bf%e0%a7%9f%e0%a6%be-%e0%a6%b8%e0%a7%81%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a8%e0%a6%bf-%e0%a6%b8%e0%a6%ae%e0%a7%8d%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%95-%e0%a6%90%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%b9-2/
No comments:
Post a Comment